রহস্যময় শব্দসংসার

আবদুশ শাকুর

বাংলাভাষার জাদুকর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাবধি সুদীর্ঘকাল জাদুটি প্রদর্শন করে যাওয়ার পরেও ৭৭ বছর বয়সে রচিত ‘বাংলাভাষা পরিচয়’-এর ভূমিকায় প্রথমেই তিনি লিখেছেন – ‘ভাষার আশ্চর্য রহস্য চিন্তা ক’রে বিস্মিত হই।’ আমার মতে এর অন্যতম কারণ, ভাষা একটা ‘ইনার্ট প্রোসেস’ বা অতৎপর প্রক্রিয়া। সে পথ চলে আনমনে। চলার পথে তার গায়ে অনেক কিছুই লাগে। কোনোটা থাকে, কোনোটা থাকে না। তাতে তার নিজের কোনো মর্জি থাকে না বলে, অন্যের মর্জিও সে মানে না।
শব্দ দিয়ে ভাষা বোনা, ভাষা দিয়ে সাহিত্য রচনা। কিন্তু এদেশে প্রায়শ শব্দ ও ভাষার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ না-দিয়েই সাহিত্য রচনা চলে, তাও পর্যাপ্ত পরিশীলন-পরিমার্জন ছাড়া। অথচ সভ্য মানুষ শব্দ দ্বারা শাসিত, তাঁদের তাবৎ শাস্ত্র শব্দে ক্ষোদিত এবং এই শব্দকে জীবন্ত ও যথাযথ রাখার একমাত্র নিমিত্তই হল রচিত সাহিত্য। এদিকে আবার সাহিত্যের ভাষাও টেকো হয়ে গেছে, গণসংযোগের মাধ্যম এবং তৎপ্রসূত সংস্কৃতির নিজস্ব রুচিমাফিক তৎপরতায়। এই সংস্কৃতি যে-অল্পবিদ্যাধারী পাঠকশ্রেণিকে বাজারে নিয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে মামুলি শব্দাবলির মাধ্যম ছাড়া কী দিয়েই বা যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে।
জর্জ স্টাইনারের সেকালের সাড়া-জাগানো ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যান্ড সাইলেন্স (১৯৬১) গ্রন্থটির বক্তব্যমতে, প্রতীচ্য সভ্যতাজুড়ে শব্দের অগ্রগণ্যতা ছিল সুবিদিত। সপ্তদশ শতকে মিল্টন-যুগের শেষ থেকে অর্থের অন্যান্য সংকেতের চাপে, বিশেষত অঙ্কের, শব্দ থেকে লেখকের পশ্চাদপসরণ শুরু হয়। ষোড়শ শতকের ইংরেজি ভাষার মাত্র দেড় লক্ষ শব্দসম্ভার (তার ৫০০ বছর পরে আজকের বাংলা ভাষার শব্দসংখ্যা মাত্র এক লক্ষ) থেকে যত শব্দ শেক্সপিয়ারের ব্যবহারাধীন ছিল, বিশ শতকের ষাটের দশকের ছয় লক্ষ শব্দভান্ডার থেকে যে-কোনো লেখকের ব্যবহারাধীন শব্দসংখ্যা শেক্সপিয়ারের ইডিয়লেক্ট থেকে বিপজ্জনকরকম কম। মেকনাইটের অনুমানে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার জনসাধারণের কথোপকথনের ভাষার অর্ধেকটা জুড়ে ইদানীং মাত্র ৩৪টি মৌলিক শব্দ। এবং তাদের কাছে বোধগম্য হবার জন্য সমকালীন গণসম্প্রচারমাধ্যম ইংরেজি ভাষাকে অর্ধশিক্ষিত অবস্থায় নামিয়ে নিয়েছে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে বর্তমানে ইংরেজি ভাষার শব্দসম্ভার দশ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে, টেকনিক্যাল শব্দাদিসহ।
তবু সে-ভাষার আজকের লেখক আলোচিত কালপর্ব দুটির চেয়েও অনেক কমসংখ্যক এবং কম রঞ্জক শব্দ ব্যবহার করেন। কারণ গণসংযোগমাধ্যমবাহিত গণসংস্কৃতি লেখাপড়ার ধারণাটাকে একেবারে মামুলি করে দিয়েছে। শব্দের এই সঙ্কুচিত বিশ্বে, সুবিধের দেখে, বিদ্যমান পরিস্থিতিটিকে বরণ করে যেন মাথায় তুলে নিয়েছেন লেখককুল। অন্য কথায় তাঁরা বনের আগুনে সিগ্রেট জ্বালিয়ে মনের সুখে সুখটান দিয়ে চলেছেন মধ্যবিংশশতক থেকে। এমন শব্দসংকোচন ভাষার উৎকর্ষ আতঙ্কজনকভাবে নষ্ট না-করে পারে না।
ব্যবহারিক বাংলা ভাষার শব্দসংকোচনের পরিস্থিতি আরো শোচনীয়।
এখানেও সাম্প্রতিক গদ্যভাষা টেকো হয়ে গেছে গণসংযোগ-মাধ্যম এবং তৎপ্রসূত সংস্কৃতির পছন্দমতো। ভাষাকে সহজ সরল তরল এবং বহতা রাখার জন্য শব্দের কবর-খনকগণ আমাদের শেখাচ্ছেন যে লেখক-পাঠকের মধ্যে সফলতম যোগাযোগের ভাষায় শব্দ হবে দুই সিলেব্ল সংবলিত এবং কোনো বাক্যেই কোনো উপবাক্য থাকবে না। ভাষার এই ন্যাড়া হয়ে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগকেই মাঝারি মানে নামিয়ে দিয়েছে। ফলে সাহিত্যিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকতা ধরনের কিছু একটা। গল্প-উপন্যাস-কবিতা হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেদনধর্মী।
যাহোক, ইংরেজি সাহিত্যে শব্দ থেকে সাধারণভাবে পশ্চাদপসরণের পর্বে পৃষ্ঠরক্ষীদলের কিছু লেখক সার্থক প্রতি-আক্রমণও রচনা করেছেন। ভাষার অবনতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সপ্রাণ পালটা অভিযান চালিয়েছেন জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১)। সাহিত্যে তিনি অজস্র শব্দকে নতুন নিয়োগ দিয়েছেন এবং ভাষা থেকে অব্যাহতি-দেওয়া বহু শব্দকে ফিরিয়েও এনেছেন। দীর্ঘনিদ্রিত, মর্চেপড়া, প্রত্যাবর্তিত শব্দদের মেজেঘষে কথাসাহিত্যের নতুন কাজে লাগিয়েছেন নতুন বিন্যাসে।
বাংলা কাব্যে যেমন করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : ‘অধরের অঞ্চিত কার্মুকে’, ‘ভুঞ্জেছি নিষ্কুণ্ঠমনে সে-সকলই’। কুঞ্চিত-অর্থে অচলিত ‘অঞ্চিত’, ভোজন করা অর্থে বিরল-চলিত ‘ভুঞ্জা’ এবং ধনুক-অর্থে পরিভাষারূপে চলিত ‘কার্মুক’ – ‘এবম্ভূত’ শব্দাবলির ব্যবহার নিঃসন্দেহে ভাষার বাহার বাড়িয়েছে। কেবল বাহার নয়, আহার বাড়ানোর জন্যও এ ধরনের শব্দাবলি ব্যবহারে আনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। যেমন ‘কথানক’-শব্দটি, অর্থ : ক্ষুদ্র আখ্যান বা ছোট কাহিনী (শব্দসঞ্চয়িতা, ১৯৯৫, কলকাতা)। অব্যবহারে অচেনা হয়ে যাওয়া এই সংস্কৃত শব্দটি ইংরেজি Anecdote-শব্দটির, বর্তমানে না-থাকা, বাংলা প্রতিশব্দের জোগান দিতে পারে। বহুবচনে চলতে পারে ‘কথানকমালা’।
শব্দের এ-অনটন দূর করতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, আইয়ুব, কমলকুমার, বিষ্ণু দে প্রমুখের মতো শব্দপ্রেমীদের দৃষ্টান্তে শব্দসচেতনতা কর্ষণ করতে হবে। শব্দের সম্ভাবনা সম্প্রসারণ করতে হবে। সর্বদা সজাগ থাকতে হবে শব্দের সন্ধানে, শব্দার্থের অন্বেষণে।
উপর্যুক্ত অভিধানটির ভূমিকাটি লক্ষণীয় :
‘বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সুবিশাল। এই বিপুল শব্দসম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকটি অভিধান ব্যতীত অধিকাংশ আধুনিক অভিধানেই নির্মম ঔদাসীন্যে বর্জিত। শুনে অনেকেই বিস্মিত হবেন, অসংখ্য বৈদিক তৎসম শব্দ ও লৌকিক শব্দ দীর্ঘকাল যাবৎ আধুনিক বাংলা অভিধানে অজ্ঞাত কারণে অনুল্লে¬খিত এবং সেই হেতু অজ্ঞাত। এই সকল মূল্যবান শব্দ জ্ঞাত বা প্রচলিত থাকলে বাংলা ভাষার অধিকতর সমৃদ্ধি ঘটত, বিশেষ করে সৃজনশীল লেখক ও ছাত্রসমাজের অনেক উপকার হতো।’

বর্তমান মিডিয়াশাসিত দেশকালে শব্দসংসারের যৎকিঞ্চিৎ হালহদিশ দেবার পরে এবার সংসারটির একটি রহস্যময় দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। অর্থই শব্দের সর্বস্ব হলেও একই শব্দ চিরকাল একই অর্থ বহন করে না। শব্দের মতিগতি বুঝে ওঠা মুশকিল। শব্দের পরিবর্তন ঘটে নানা কারণে – ঐতিহাসিক, ভাষিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি। পরিবর্তন হয়ে থাকে বিভিন্ন ধারায় – যেমন সংকোচন, সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে একেবারে ডিগবাজি পর্যন্ত। এই পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো একটি শব্দের অর্থ সমগ্র থেকে ধীরে ধীরে অংশবোধক হয়ে পড়ে, যেমন – শাক শব্দটি। আগে শাক বলতে সকল প্রকার শাক-সবজিকে বোঝাতো, এখন বোঝায় শুধু পাতা শাক।
শব্দের মূল অর্থের সংকোচনের মতো সম্প্রসারণও ঘটে থাকে। উৎপত্তির সময় শব্দের একটা স্বতন্ত্র অর্থ থাকে। অর্থ প্রসারের ফলে শব্দটি মূল অর্থের বন্ধন না মেনে আরো নতুন অর্থের কথা বলে। কালি শব্দটির আগের অর্থ ছিল শুধুই কালো রঙের কালি। এখন লাল-নীল-মেরুন-সবুজ – সবই কালি, কেবল কলমের মুখ থেকে বেরুলেই হল। কতকগুলো শব্দের অর্থের গৌরব বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ চাকরি। মূল অর্থ চাকরের কাজ। এখন এদেশে সবচেয়ে সম্মানজনক জীবিকা। কিছু শব্দের আবার গৌরবহানিও ঘটে। যেমন – রাগ শব্দটির মূল অর্থ অনুরাগ। কিন্তু এখনকার সাধারণ অর্থ ক্রোধ।
সাধারণত শব্দের অর্থবদলের উদাহরণ আহরণ করা হয় বিভিন্ন অভিধান ও ব্যাকরণগ্রন্থ ঘেঁটে। তবে আমার সে শ্রম লাঘব করে দিয়েছে আমারই জনৈক কৃতী ছাত্র ভাষাবিলাসী অভিধান-আমুদে গদ্যশিল্পী ফরহাদ খানের বাংলা শব্দের উৎস অভিধান (প্রতীক, ঢাকা, ২০০০)-নামক গ্রন্থ ও ‘অভিধানে আমোদ’-নামক দীর্ঘ রম্যরচনা। প্রধানত এ দুটি উৎস থেকে অনেক তথ্যসহ শব্দাবলি আহরণ করে আমি আমার অভিপ্রেত কাজে লাগিয়েছি এ-লেখাটিতে।
এবার চলুন কিছু নমুনা দেখে আমরাও রবীন্দ্রনাথের মতোই ‘ভাষার আশ্চর্য রহস্য চিন্তা ক’রে বিস্মিত হই’।
আটঘাট : ‘আটঘাট’ বেঁধে কাজে নামতে হয় কেবল তবলচিকে। তবলার কাড়ির চতুর্দিকে মোট আটটি কাঠের গুটির ওপর চারটি করে চামড়ার ফিতা থাকে। গুটিগুলির মধ্যেকার আটটি ফাঁককে বলে ‘আট ঘাট’। আটটি গুটির ওপর হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ফিতেগুলিকে লুজ-টাইট করে সুষমভাবে স্বরের স্কেল মেলাতে হয়। তবেই তবলা কাঙ্ক্ষিত সুরে বাজে। অথচ শব্দবন্ধটির এমনি দাপট যে আপনি শত শত কাজের ‘হাজার ঘাট’ বেঁধে আপনার ষড়তল ভবনটির নির্মাণে লাগলেও সবাই বলবে লোকটি ‘আটঘাট’ বেঁধে লেগেছে।
খোল নলচে বদলে যাওয়া ও কলকে পাওয়া : শব্দসংসারের রহস্যময় সদস্য একবার হয়ে গেলে প্রবাদটি তার পদ সাধারণত হারায় না। যেমন হুঁকো খাওয়া পরিত্যক্ত এবং সিগ্রেট খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরেও আমরা অনেক কিছুরই ‘খোল নলচে’ বদলে চলেছি অদ্যাবধি। এমনকি কোনো আসরে ‘কলকে পাওয়া’ যাচ্ছে না বলে আক্ষেপও করে বেড়াচ্ছি। বাংলাদেশে একসময়ে ব্যাপক সামাজিক প্রথা ছিলো সমাজে বা সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তামাক খেতে দিয়ে আদর-অভ্যর্থনা করা। তামাকের হুঁকো কিংবা নলের মুখ ঘুরতো এ-হাত থেকে ও-হাতে। এই ব্যাপারটির অংশীদার হওয়া ছিলো সামাজিক মর্যাদার লক্ষণ। এই মর্যাদাই কালে কালে বাংলা বাক্যভঙ্গিতে হয়ে গেছে কলকে পাওয়া।
আষাঢ়ে গল্প : প্রবাদ তার পদ না হারানোর আরেক জাজ্বল্যমান উদাহরণ এটি। বীজ-সার-পানি-প্রযুক্তির কল্যাণে সাংবৎসরিক ক্রপ-রোটেশনের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় ‘আষাঢ় মাসে’ও আজকাল চাষবাসের চাপে সকলেরই নাভিশ্বাস ওঠে। তবু বাংলাসাহিত্যে আজো ‘আষাঢ়ে গল্পে’র আসর বসে।
খয়ের খাঁ : তবে কোনো কোনো সদস্য তার পদটি হারায়ও, যেমন ‘খয়ের খাঁ’। তবে এ শব্দবন্ধটি অর্থের ডিগবাজির উদাহরণও বটে। আরবি ‘খায়ের’ মানে শুভ আর ফারসি ‘খাহ্’ মানে চাওয়া – এ-দুয়ে মিলে বাগ্ধারাটি শুদ্ধার্থে বোঝাচ্ছিল ‘শুভার্থী’। তবে বঙ্গদেশে নকল শুভার্থী বেড়ে গেলে ‘খায়ের খাহ্’ হয়ে গেল ‘খয়ের খাঁ’ এবং বোঝাতে লাগলো চাটুকার। বাংলাদেশে এসব স্তাবকের মোসাহেবি আরো বেড়ে গেলে তুচ্ছার্থে ‘খয়ের খাঁ’ হয়ে গেল ‘চামচা’ – বেলচার থেকে ক্ষুদ্র বলেই হয়তো।
ধুরন্ধর : ধুরন্ধর শব্দের মূল অর্থ হলো ভারবাহী বা ভারবাহক। ধুরন্ধর শব্দের আদিযুগে গাধা এবং ঘোড়াই ছিলো প্রকৃত ধুরন্ধর। আলংকারিক প্রয়োগে শব্দটির অর্থ দাঁড়ালো : যিনি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে যে কোনো কার্যভার অনায়াসে বহন করতে পারেন, তিনিই ধুরন্ধর। ফরহাদ খান বলেন – ‘আমাদের চোখের সামনে দিয়েই ধুরন্ধর শব্দটা উচ্ছন্নে চলে গেলো। শয়তান, ধড়িবাজ লোককে আমরা এখন বলি মহাধুরন্ধর কিংবা ধুরন্ধর শয়তান। অথচ বছর পঞ্চাশেক আগেও ধুরন্ধর শব্দটির এমন দুর্গতি ছিলো না। তখন গর্দভ থেকে শুরু করে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ধুরন্ধর বলা যেতো।’
অনেক গুণ না থাকলে ধুরন্ধর হওয়া যায় না। তাই বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকেই ধুরন্ধর বলা হতো। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপাচার্য, অধ্যক্ষ, মহাপরিচালক – সকলেই তখন ধুরন্ধর ছিলেন। এখন এঁদের ধুরন্ধর মহাধুরন্ধর সম্বোধন করার মানে হবে গালি খাওয়া মার খাওয়া থেকে জেলে যাওয়া, এমনকি প্রাণ যাওয়াও। একবার বলে দেখুন : এতক্ষণ আপনারা ধুরন্ধরগণের বক্তৃতা শুনছিলেন, এবার সভাপতির ভাষণ দেবেন মহাধুরন্ধর প্রধানমন্ত্রী…
ভাষার কী বিচিত্র গতি! ধুরন্ধর শব্দের সেই গৌরবের দিনের কিছুই আর বাকি নেই। চতুর, ধড়িবাজ, ঘড়েল লোকেরাই এখন ধুরন্ধর। পন্ডিতগণ এবং সম্মানিতজনদের আর ধুরন্ধর বলা যাবে না। বললে গণপিটুনির শিকার হতে হবে এবং এই গণপিটুনিতে নেতৃত্ব দেবেন একালের ধুরন্ধরগণ। কেমন করে এমন হল – ভাববার মতো বিষয় বটে।
রসাতল : বাংলাভাষা কেন মানুষবিশেষকে ত্রিভুবনের স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতালের শেষ বা সপ্তম তলে, মানে খাস ‘পাতালে’, না-ঠেলে ষষ্ঠ তলটিতে, মানে ‘রসাতলে’ রেখে দিচ্ছে। এটা একান্তই রহস্যময়। সমাজ, সংসার, দেশ থেকে শুরু করে ধরাতল পর্যন্ত রসাতলে যেতে পারে। নানান অবিচার-অত্যাচার দেখে মানুষ বড় দুঃখে বলে – সবকিছু রসাতলে গেল। রসাতল শব্দের ব্যবহারিক অর্থ অধঃপাত বা ধ্বংস। রসাতলের সঙ্গে অধঃ শব্দটির যোগ রয়েছে। তাই বলে রসাতল শব্দের মূল অর্থ অধঃপাত নয়।
রসাতল ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত সপ্ত অধোভুবনের অন্যতম একটি ভুবন। ক্রম অনুযায়ী এই সাতটি অধোভুবন হল – অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। আমরা যে কথায় কথায় আকাশ-পাতাল তফাতের কথা বলি – আকাশের বিপরীত সেই পাতাল হলো একেবারে নিম্নতম তল। এখন কথা হল চরম অধঃপাতে গেল বোঝাতে পাতালে গেল বলি না কেন? নাগলোকে? কেউটের আবাসে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে বলে? সম্ভবত অধঃপতন থেকে প্রত্যাবর্তনের ক্ষীণ আশা জিইয়ে রাখতেই বাংলা ভাষা পাতালে না বলে রসাতলে গেল বলে।
বাধিত : মূল সংস্কৃতভাষায় ‘বাধিত’-শব্দটির অর্থ হল ‘বিড়ম্বিত’ ‘বিরক্ত’ ইত্যাদি – যা সবলরা দুর্বলদের করে থাকে। অথচ বাংলাভাষায় শব্দটি মারফত আমরা ঋণী, কৃতজ্ঞ ইত্যাদি হতে চাই বলেই নিবেদনের অন্তে লিখি ‘বাধিত করিবেন’। অবশ্য বড়রা ছোটদের লাথি দিয়েও ‘ঋণী’ করতে পারেন বলে ‘বাধিত’ করার আবেদনকে ব্যাজস্ত্ততিও জ্ঞান করা যায়।
কারচোবি : এক এক শব্দের এক এক তামাশা – যেমন ফারসি থেকে আসা ‘কারচোবি’-শব্দটি। এর অর্থ হল কাপড় বা কাঠের ওপর লতাপাতা বা ফলফুলের সূক্ষ্ম-জটিল নকশা তোলার কাজ করা। কাজটি নিঃসন্দেহে শংসাবাচক। অথচ বাংলায় এসে শব্দটি হয়ে গেল নিন্দাবাচক ‘কারচুপি’, যার অর্থ সূক্ষ্ম চালাকি। বাংলাদেশে নির্বাচনের পরে পরাজিত দলের প্রয়োজনে অপকর্মটি ডবল বোঝানোর জন্য সূক্ষ্মও ডবল হয়ে যায় – বলা হয় নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে।
কারসাজি : কারচোবির চেয়েও মারাত্মক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে ‘কারসাজি’ শব্দটি। মূলভাষা ফারসিতে শব্দটির অর্থ হল কার্য-সম্পাদনকারী কিংবা নির্মাতা। তবে ‘কারসাজ’ প্রধানত সবচেয়ে বড় নির্মাতাকে অর্থাৎ ‘বিধাতা’কেই বোঝায়। সৃষ্টিকর্তার কাজ সৃষ্টি করা বা কারসাজি করা – যা করার গরজে তিনি এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে সকল ভাঙাগড়ার নিয়ামকও বটেন। কী সৃষ্টিছাড়া কান্ড দেখুন, বাংলাভাষায় এসে ‘রহমান’-এর এ মহৎ কাজটি হয়ে গেল ‘শয়তান’-এর অসৎ কাজ। আমরা ‘কারসাজি’ দিয়ে ‘শয়তানি’ বা ‘প্রতারণা’ বোঝাই।
ঘড়িয়াল : সেই জলঘড়ির কাল থেকেই রাজা-মহারাজার বিশাল হাবেলির ডজন ডজন ঘড়ির সঠিক সময়ে ঘণ্টা বাজানোর জন্য ‘ঘটিকাপাল’ বা ‘ঘড়িয়াল’ নিয়োজিত থাকতো। শব্দটি মনুষ্যের শৈথিল্যপ্রিয় রসনার ডগায় এসে হয়ে গেল ‘ঘড়েল’। ঘড়িবাবুর দায়িত্ব স্বভাবতই সতর্ক থাকার। তা থাকতে পারে কেবল চালাকচতুর লোক। ওদিকে চালাকচতুর হতে হয় ধড়িবাজ লোকদেরও। ফলে ‘ঘড়েল’-কর্মচারীটির কপালই পুড়েছে এবং তার অভিধাটি এই ধান্দাবাজ কালে কেবল ফন্দিবাজকেই বোঝাচ্ছে।
কালেভদ্রে : ‘ভদ্র কাল’ কদাচিতই পাওয়া যায়। তাই ‘কদাচিৎ’ বোঝাতে শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়। তবে উলটিয়ে নিয়ে বলা হয় ‘কালেভদ্রে’, ভাষার স্বভাবসুলভ সহজ উচ্চারণের পথ খোঁজার কারণে। ‘ভদ্র কাল’ থেকে ‘কালেভদ্রে’ বলাটা মুখে সহজে খেলে। হুবহু একই কারণে বাংলাদেশে ফোন ‘করবেন’ হয়ে যায় ফোন ‘দেবেন’, বা ‘দিয়েন’ যন্ত্রটি ‘ডিস্টার্ব করে’ হয়ে যায় ‘ডিস্টার্ব দেয়’।
ব্যাধি : শব্দের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয় অগণিত কারণে। যেমন বাঙালির মনের রোগের চেয়ে দেহের রোগ শতগুণ বেশি বলে শারীরিক ‘ব্যাধি’-শব্দটির প্রতাপ মানসিক ‘আধি’-শব্দটিকে ভাষা থেকে প্রায় তাড়িয়েই দিয়েছে। আমরা কি কখনো কোনো মনোবিকারগ্রস্ত রোগিণীর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছি যে আপনার স্ত্রীর ‘আধি’র অবস্থাটি এখন কেমন? করলেও তিনি বলতেন – তার কি ‘আধিব্যাধি’র আর শেষ আছে? মানে ‘আধি’কে ঘাড়ে বয়েও মুখে চলে আসে ‘ব্যাধি’-শব্দটি।
বিদগ্ধ : সংস্কৃত ‘বিদগ্ধ’-শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে দগ্ধ – যেমন খাদ্য পাকস্থলীতে ‘বিদগ্ধ’ কিংবা জীর্ণ না-হলে অজীর্ণ রোগ হয়। বাংলাভাষায় এসে শব্দটি প্রাচীনকালে বোঝাতে থাকলো ধূর্ত ও বুদ্ধিমানকে, মধ্যযুগে বিদ্বান ও রমণীরসিককে; আর আধুনিককালে রসকলাবিৎ কিংবা রসপন্ডিতকে। ভাষার স্বেচ্ছাচারিতার বহর দেখুন – কেমন অবলীলায় শব্দটি শারীরিক খাদ্য জঠরে পরিপাক করার পেশাদার চাকরি ছেড়ে দিয়ে, মানসিক খাদ্য মগজে পাক করার শৌখিন কাজটি বাগিয়ে নিয়েছে।
উত্তম-মধ্যম : ‘উত্তম-মধ্যম’ বোঝাতো যুগপৎ ‘উত্তম’-রূপের প্রহার আর ‘মধ্যম’-মানের লাঞ্ছনা – যেমন, মেরে নেংটা করে বের করে দেওয়া। হালের উত্তেজনাপ্রবণ উত্তাল কালে ওজস্বী শব্দবন্ধটি পালিয়ে গেল নিরীহ একটি শব্দের ঠেলায় – ‘ধোলাই’, যা প্রহার এবং লাঞ্ছনার যোগফলের চেয়েও বড় বালাই। তার ওপর ‘রামধোলাই’ দিলে তো বেচারার মুখে কথাই থাকে না, ধড়ে প্রাণটাও না থাকার আশঙ্কা হয়।
সাহস : বাংলা অভিধানে সাহস অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি শব্দ। পুরুষ মানুষের সাহস না থাকলে তিনি অভিহিত হন কাপুরুষ। সংস্কৃত ভাষায় কাপুরুষ শব্দের অর্থ ঈষৎ পুরুষ বা খানিকটা পুরুষ। সাহস শব্দটি মূলত সংস্কৃত – বাংলা ব্যাকরণে যাকে বলা হয় তৎসম শব্দ। ভাগ্যিস সংস্কৃত ভাষা থেকে কেবল শব্দটিই ধার করা হয়েছে, অর্থসহ নয়। সংস্কৃত অর্থটিও গ্রহণ করা হলে ‘সাহসী’ লোকটিকে বাংলাভাষীমাত্রই পেটাতো। কারণ, সংস্কৃত ভাষায় শব্দটির অর্থের মধ্যে আছে হঠকারিতা, অবিমৃশ্যকারিতা, অনৌচিত্য ইত্যাদির সঙ্গে বলপূর্বক কৃত নানা দুষ্কর্ম – যথা ধর্ষণ, পরদারগমন, নরহত্যা, নারীহত্যা প্রভৃতি। মোটকথা সংস্কৃত শব্দটির মধ্যে কোনও বীরত্ব তো নেই-ই, মর্যাদাও নেই – যে দুটি অর্থ বাংলা সাহস-শব্দটির মধ্যে মুখ্য।
সংস্কৃত হেয় শব্দটি বাংলায় শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠলো সম্ভবত মনস্তত্ত্বের সূত্র ধরেই। বাংলায় প্রবেশকালে শব্দটির অর্থবদলের কাজটা সম্ভবত সমাজ-মনস্তত্ত্বই করেছে। সাহসী মানুষের কাজে সমাজ উপকারিতা পায় বলেই ধার করা শব্দটির মূল্যযোজনকালে তার কদর্থগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া খুব ভেবেচিন্তে কাজ করলে সাহসী হওয়াও যায় না। সাহসীকে কিছুটা হঠকারী এমনকি অবিমৃশ্যকারীও হতে হয়।
সামান্য : সামান্য শব্দটা এখন বেশি চলে ‘অল্প’ বোঝাতে। প্রয়োগের বিচারে সামান্য শব্দের আরো অনেক অর্থ রয়েছে। যেমন, ‘সামান্য লোক’ – গুরুত্বহীন; ‘সামান্য ব্যাপার’ – অকিঞ্চিৎকর ‘সামান্য আয় – নগণ্য উপার্জন। সামান্য শব্দের মূল অর্থ কিন্তু সমানতা। যার অর্থ সমানভাব বা সাম্য – সেই ‘সামান্য’ কি করে ‘অল্প’ হয়ে সে-অর্থেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। ভাষার সে এক ‘আশ্চর্য রহস্য’।
হঠকারিতা : জঘন্যতম অর্থবোধক হঠকারিতা শব্দটি বাংলা ভাষায় কী করে এতটা সহনীয় হল যে ব্যাপারটাকে আমরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও বিবেচনা করি না। হঠকারিতা বলতে এখন প্রধানত বোঝায় অবিবেচনা, অভদ্রতা, গোঁয়ার্তুমি ইত্যাদি। অথচ শব্দটির মূল ভাষাতে অর্থ ছিল ‘বলাৎকার’। এজন্যই শব্দসংসারটাকে এত রহস্যময় মনে হয়।
ছাত্র : ছাত্র শব্দটির চলমান অর্থ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়া। বাংলায় ছাত্র শব্দের নারীবাচক রূপ হলো ছাত্রী। সংস্কৃতে ছাত্রী বলতে বোঝায় ছাত্রের পত্নী বা স্ত্রী, ব্যাকরণ অনুযায়ী ছাত্রের নারীবাচক রূপ হলো ছাত্রা। ছাত্র শব্দের মূল অর্থ কিন্তু – যে গুরুর দোষ ঢেকে রাখে। এদেশে একালের ছাত্ররা তো গুরুর খুঁৎ খুঁজে বেড়ায়, তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য।
অভ্যুত্থান : ‘অভ্যুত্থান’ অত্যন্ত পরিচিত এবং বেদনাদায়ক একটি শব্দ। বাংলাদেশ দেখেছে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অভ্যুত্থানের কেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সামরিক অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে অনেক অবাঞ্ছিত পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। অথচ বাস্তবিক অনর্থের হোতা এই অভ্যুত্থান শব্দটির মৌলিক অর্থ বিপরীত – কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য আসন থেকে ওঠা বা উন্নত, উদ্গত, অভ্যুত্থিত হওয়া ইত্যাদি। শব্দের স্বেচ্ছাচারিতা এমনি যে একালে ‘অভ্যুত্থিত’ হওয়া বা আসন থেকে ওঠা কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য নয় – ল্যাং মেরে ক্ষমতাসীনের আসনটি বা গদিটি দখল করার জন্য।
ঐশ্বর্য : শব্দের গৌরবহানির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঐশ্বর্য শব্দটি। মূলত ঐশ্বর্যের সঙ্গে সম্পর্ক ঈশ্বরের, মনুষ্যের নয়। সংস্কৃত ভাষায় ঈশ্বর থেকে তৈরি ঐশ্বর্য শব্দের অর্থ ঈশ্বরের ভাব বা কর্ম, অলৌকিক গুণ বা শক্তি (যেমন বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্য রায়)। অথচ আজকাল ঐশ্বর্য বলতে আমরা মানুষের বিষয়-আশয়ই বুঝে থাকি এবং ঐশ্বর্য বলিও কেবল বিপুল ধনসম্পত্তি বোঝাতেই।
সংবাদ : সংবাদকে এককালে বলা হতো সন্দেশ। সন্দেশ শব্দের মূল অর্থ, যা সম্যকরূপে দিক-নির্দেশ দেয় এবং তা থেকে অর্থ দাঁড়ায় – যা সঠিক জিনিস জানায়। আগের দিনে কোনো আত্মীয়কে কোনো খবর দিতে হলে আত্মীয়বাড়িতে কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে যাওয়া হতো। কালক্রমে এই অনুষঙ্গের সূত্রে সন্দেশের অর্থ দাঁড়ায় – দূতের উপসর্গটি বাদ দিয়ে শুধুই মিষ্টান্ন। তখন যে কোনো মিষ্টান্নই ছিল সন্দেশ। পরে অর্থের আরো পরিবর্তন ঘটে। সন্দেশ বলতে এখন শুধু বিশেষ এক রকমের মিষ্টান্নকেই বোঝায়। সন্দেশ শব্দের পরে আসে সংবাদ শব্দটি। সংবাদ শব্দের মূল অর্থ খবর নয় – পরস্পরে কথাবার্তা। মুসলমান আমলে আসে ফারসি শব্দ খবর। আজকের বাংলাদেশে খবর মানে খারাপ খবর। কথায় কথায় একে অপরকে ধমকাচ্ছে – এটা হলে ‘খবর’ আছে, ওটা করলে ‘খবর’ আছে। এর অর্থ হল শাস্তি আছে, বিশেষ বিপদ আছে ইত্যাদি।
শাক : শাক শব্দের প্রচলিত অর্থ হলো রেঁধে খাওয়ার যোগ্য এক ধরনের উদ্ভিদ বা লতাপাতা যেমন – পালং শাক, পুঁই শাক, ডাঁটা শাক, কলমি শাক, লাল শাক ইত্যাদি। তবে শাক শব্দের মূল অর্থ মানুষ ‘যা দ্বারা ভোজনে সমর্থ হয়’। ভাতের সঙ্গে নিদেনপক্ষে নিরামিষ হলেও ব্যঞ্জনের অনুষঙ্গ লাগে। এই অর্থে সকল প্রকার তরকারিই কিন্তু শাক। এজন্যেই সম্ভবত এককালে নিমন্ত্রণপত্রে লেখা হত – ‘শাকান্ন ভোজনে বাধিত করিবেন’। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে শাক ছয় রকমের – পত্র শাক যেমন পালং শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক; পুষ্প শাক যেমন ফুলকপি, কলার মোচা, বকফুল, কুমড়োর ফুল; ফল শাক যেমন লাউ, কুমড়ো, বেগুন, পটল; নাল শাক যেমন লাউ-কুমড়োর লতা, কচুর লতি; কন্দ শাক যেমন আলু, ওল, কচু, মুলা; সংস্বেদজ শাক যেমন পাতাল কোঁড, মাশরুম ইত্যাদি।
বৃদ্ধ : প্রবীণ, বয়োজ্যেষ্ঠ, মুরবিব মানুষকে আমরা বৃদ্ধ বলে জানি। কত বছর বয়সের মানুষকে বৃদ্ধ বলা যাবে – এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। সাধারণ হিসাবে প্রৌঢ়ত্বের পরে আসে বার্ধক্য। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বের কালসীমা তো নির্ধারিত নেই। সনাতন ধর্মের স্মৃতিশাস্ত্র মতে, সত্তর বছর বয়সের ঊর্ধ্ববয়স্ক ব্যক্তি হলেন বৃদ্ধ। ভীমরতি বা ক্ষ্যাপামি দেখা দেয় বয়স সাতাত্তর বছর সাতমাস সাতরাত পূর্ণ হলে। দেখা যাচ্ছে বয়েস সত্তর বছর পার না হলে বৃদ্ধ হওয়া যায় না। অভিধান ও ব্যাকরণে বৃদ্ধের সঙ্গে বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। বৃদ্ধ শব্দের মূল অর্থ – বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। প্রশ্ন হল কী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত? জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা তো বটেই, তবে মনে হয় সেই সঙ্গে প্রেশার এবং সুগারও।
ইস্তফা : আরবি ইসতিফা শব্দের অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। শব্দটি বাংলায় এসে হয়েছে ইস্তফা, যার প্রকাশিত অর্থ হচ্ছে চাকরি পরিত্যাগ করা বা মাফ করবেন বলে অর্পিত কর্মের দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি চাওয়া। কোনো সংগঠনের সভাপতি বা সম্পাদক কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কার্যনির্বাহী সভায় বলতে পারেন – আমি ইস্তফা দিচ্ছি, মানে মাফ চাচ্ছি – অর্থাৎ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছি। ইস্তফা শব্দের সঙ্গে মাফ চাওয়া বা দুঃখিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপারটা এখানে স্রেফ ভাষিক বিনয় – পদত্যাগ করলাম, বা চাকরি ছেড়ে দিলাম না বলে মাফ চাইলাম বলে বস্ত্তত দায়িত্বপালনে অপারগতা জ্ঞাপন করলাম। বাংলা ইস্তফা শব্দের অর্থ তাহলে আক্ষরিক নয়, আলংকারিক। তবে পদত্যাগ করার স্থলে ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো আশ্চর্য মৃদুভাষণ বাংলা ভাষায় কী করে ঢুকলো ভেবে হয়রান হতে হয়।
শুশ্রূষা : শুশ্রূষার সঙ্গে সেবা শব্দের সম্পর্ক সুনিবিড়। অধিকাংশ সময়েই সেবা শব্দটা আগে বসে জোড় শব্দরূপে উচ্চারিত হয় – সেবাশুশ্রূষা। অভিধানে ও ব্যাকরণে শব্দ হিসাবে সেবা শব্দের সঙ্গে শুশ্রূষার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনে আছে। সেবা ও শুশ্রূষার বিষয়টি প্রধানত রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। পরিবারে কেউ অসুস্থ হলে তার খোঁজখবর নিতে হয়। এই খোঁজখবর নেওয়ার সঙ্গে কিন্তু শুশ্রূষা শব্দটির অভিধান ও ব্যাকরণগত সম্পর্ক রয়েছে। শুশ্রূষা শব্দের মূল অর্থ হলো শোনার ইচ্ছা। অসুস্থ ব্যক্তির কখন কী-রকম বোধ হচ্ছে সেটা যদি শোনা না হয়, তাহলে তার সেবা করা সম্ভব হবে কীভাবে? বিশেষত রোগী তাঁর কষ্টের কথা শোনানোর জন্য সারাক্ষণ ডাকাডাকি করে। অথচ শোনার জন্য কেউ তাঁর কাছে যেতে চায় না, থাকতে চায় না। তাই এই শোনাটাই শুশ্রূষা শব্দকে সেবার সঙ্গে যুগলবন্দি করেছে।
মর্যাদা : মর্যাদা শব্দের মূল অর্থ – সীমা, ক্ষেত্রসীমা, নিয়ম ইত্যাদি। আগে মর্যাদা লঙ্ঘন বলতে জমির আইল ঠেলা বা ভাঙাও বোঝাতো। এখন মর্যাদা, ভাঙনের বদলে, কেবল হানিরই বিষয়। ফলে মর্যাদা এখন বেড়ে যাওয়া মানহানি মামলারই জোগানদাতা। মর্যাদার বিন্দুমাত্র হানি ঘটলে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মর্যাদা নানা প্রকৃতির। এর মধ্যে আত্মমর্যাদা ও বংশমর্যাদাই প্রধান। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আরো অনেক কিছুর সঙ্গেই মর্যাদা শব্দটি যুক্ত হতে পারে। মানুষ কোনোটিরই হানি সহ্য করতে পারে না।
মর্যাদার সহচর শব্দ হলো মান। মানমর্যাদা শব্দদ্বৈত হিসাবে উচ্চারিত হয়। মর্যাদা শব্দের বর্তমান প্রচলিত অর্থ – সম্মান, সম্ভ্রম, গৌরব, প্রতিপত্তি ইত্যাদি। এ জাতীয় অর্থ কীভাবে এল এবং নব পরিগৃহীত অর্থ কী শক্তিবলে মূল অর্থকে হটিয়ে তো দিলই, ভুলিয়েও দিল – সেটাই শব্দসংসারের এক অভেদ্য রহস্য।
কালি : কালি এখন নানা রঙের হয় – লাল কালি, নীল কালি, সবুজ কালি ইত্যাদি। বিভিন্ন দফতরে লেখার ভুল মোছার জন্য সাদা রঙের যে ঘন তরল ব্যবহৃত হয় তাকেও বলা হয় ‘সাদা কালি’। মানে সাদা-কালোর পার্থক্যটাও আর রইল না। অথচ কালো বলেই নামটা ছিল কালি। কালি শব্দের মূল অর্থ – লেখার জন্য ব্যবহৃত কৃষ্ণবর্ণ তরল পদার্থবিশেষ। কালির আলংকারিক প্রয়োগও রয়েছে এবং তা কালির মৌলিক কালো রঙের সুবাদেই, যেমন – কুলে কালি দেওয়া, মুখে চুনকালি দেওয়া। এখানে কালি বলতে কালির আসল কালো রঙের কথাই বলা হয়েছে।
তেল : তেল শব্দটি তৈরি হয়েছে তিল থেকে। ঘানিতে পিষে বের করা হয় বলে কী? সর্ষের তেলও তো ঘানিতে পিষেই বের করা হয়। তো শব্দটা সর্ষে থেকে তৈরি হল না কী কারণে? উত্তর হল ভাষার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। সে যাক। তেল রান্নায় লাগে। গায়ে মাখা হয়। মাথায় দেওয়া হয়। এমনকি নাকে দিয়ে ঘুমাতেও বলা হয়। তেল মাখার ফলে মাথার চুল ও দেহ মসৃণ এবং উজ্জ্বল হয়। কখনো কখনো এই উজ্জ্বলতা ও মসৃণতা সঞ্চারিত হয় মনে। তখন সৃষ্টি হয় দর্প, তেজ ও অহংকারের। এসব বিশেষণের ব্যক্তিবিশেষকে দেখে লোকে বলে, মানুষটার বড় তেল হয়েছে। দেহে তেল হয়তো না দিলেও চলে, যন্ত্রে না দিলে তো যন্ত্র চলেই না – যেজন্যে বলে, নিজের চরকায় তেল দাও। তেলের আলংকারিক ব্যবহার এবং তজ্জনিত তিরস্কার ব্যাপক। ক্ষমতাবানকে তেল মেরে কার্য উদ্ধারকারী তিরস্কৃত ধান্দাবাজদের কথা ভাবুন।
প্রফুল্ল : ফুলের সঙ্গেই প্রফুল্ল শব্দের আসল সম্পর্ক। শব্দটির মূল অর্থ প্রস্ফুটিত; বিকশিত। উদাহরণ – প্রফুল্ল গোলাপ, প্রফুল্ল রজনীগন্ধা, প্রফুল্ল কদম। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে – ‘প্রজাপতির দল যেখানে জুটি/ রঙ ছড়াল প্রফুল্ল রঙ্গনে’। প্রফুল্ল শব্দের এই জাতীয় প্রয়োগ এখন আর নেই। কবে যেন শব্দটি বাগান ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে, সম্পর্ক তৈরি করেছে মানুষের সঙ্গে – অর্থও ফেলেছে পালটে। প্রফুল্ল শব্দের বর্তমান অর্থ – প্রসন্ন, সহাস্য, হৃষ্ট, পুলকিত। প্রফুল্ল চিত্ত, প্রফুল্ল মন, প্রফুল্ল বদন। প্রফুল্ল শব্দের নিবিড় সম্পর্ক ইদানীং দৃশ্য বদনের সঙ্গে আর অদৃশ্য হৃদয়ের সঙ্গে। সংস্কৃতে বদন শব্দের অর্থ মুখমন্ডল – যেমন মলিন বদন, প্রফুল্ল বদন। আর ফারসিতে বদন হলো দেহ – যেমন গুলবদন অর্থাৎ ফুলের মতো কোমল দেহধারিণী। উদাহরণত একটি লোকসংগীত স্মরণ করুণ – ‘সোহাগ চাঁদবদনী ধনী নাচো তো দেখি’।
অভিমান : বাংলা ভাষার অতি বিশিষ্ট এবং গদ্যে-পদ্যে সমান ব্যবহৃত একটি শব্দ অভিমান। শব্দটির প্রচলিত অর্থ হলো প্রিয়জনের অপ্রিয় আচরণ ও অগোপন অনাদরের কারণে সৃষ্ট মনোযাতনা বা চাপা ক্ষোভ। আরেকটি অর্থ হল প্রিয়জনের প্রতি কৃত্রিম বিরূপতা প্রকাশ, যেমন – প্রেমিক-প্রেমিকার অভিমান। অভিমান কথাটা সহজ নয়। অভিমান ভাঙানো আরো কঠিন। শব্দটির মূল অর্থ কিন্তু বর্তমান প্রচলিত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। অভিমান শব্দের মূল অর্থ হল নিজের প্রতি মান, ‘আমার সমান নেই’ এই রকম ভাব। আর এই ভাব থেকে সৃষ্ট অভিমান শব্দের আরো আরো অর্থ হলো আত্মসম্মান, গৌরব, মান, অহংকার এবং এ জাতীয় আরো অনেক কিছু।
অভিমান হিন্দি ভাষায়ও আছে। সেখানে শব্দটি আদি অর্থ বহন করে এবং গীত-গজলে বহুলব্যবহৃত সেই শ্লাঘা অর্থেই। তবে লক্ষণীয় যে বাংলার স্নিগ্ধ কোমল শ্যামল প্রকৃতিতে অভিমান শব্দটি যে অম্লমধুর অর্থ বহন করে হিন্দিভাষী উত্তর বা পশ্চিমভারতের শুষ্ক কঠোর প্রকৃতির পরিবেশে অভিমানের মধ্যে সেই পেলবতা, আর্দ্রতা বা লাবণ্যের ভাবটি নেই। অভিমান লাবণ্যের মতোই অধরা মাধুর্যমন্ডিত একটি শব্দ।
মুহূর্ত পলক নিমেষ ও ক্ষণ : ‘মুহূর্তেই শেষ’ বললে মনে হবে নিমেষেই শেষ অথবা চোখের পলকেই শেষ। আসলে কোনোটাই ঠিক নয়। এগুলো হল সময়ের হিসাব না করে অত্যন্ত অল্প সময় বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত বাগ্ধারা, বা ইডিয়ম বা ‘টার্ন অব স্পিচ’। সময়ের মাপে এক মুহূর্ত হল ৪৮ মিনিট। নিমেষ হলো পলক, চোখের পাতা ফেলার মধ্যবর্তী সময়। নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে থাকার অর্থ পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা। তবে সময়ের হিসাবে এক নিমেষ হয় ষোলো মিনিটে।
পলক শব্দটি ফারসি। পলক ও নিমেষে অর্থগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে কিছুটা আছে প্রয়োগের বেলায়। চোখের নিমেষে আর চোখের পলকে দুটোই চলে। কিন্তু চোখের নিমেষ পড়ছে না বলে না। বলে চোখের পলক পড়ছে না। ক্ষণও অতি অল্প সময় বোঝায়। তবে কতটা অল্প, তা হিসেব করার প্রয়োজন আমাদের হয় না। সময়ের মাপে ক্ষণেরও নির্দিষ্ট হিসাব আছে। ক্ষণ হলো নিমেষের এক-চতুর্থাংশ সময় অর্থাৎ চার মিনিট। তবে জ্যোতিষ শাস্ত্রে ক্ষণের কালসীমা হলো মুহূর্তের সমান, অর্থাৎ ৪৮ মিনিট।
কদলি : কদলি বা কলা বাংলাদেশের অতি প্রাচীন অতি স্বাদু অতি উপকারী একটি ফল। পুষ্টিকর এই ফলটির ফসল এবং ফলনসহ প্রায় সবকিছুই ‘অতি’। এটি পাওয়া সহজ, ছিলা সহজ, গিলা সহজ এবং হজমও সহজ। পটাশিয়ামসহ বহু ভেষজগুণ সংবলিত কদলি নানাবিধ খনিজ পদার্থে ভরা। বিশাল কদলিপত্র তো গণভোজনের পাত্র হিসেবে একান্তই অবিকল্প। কলার গাছটিও সহজ সরল এবং একেবারেই ঝামেলামুক্ত।
সর্বপ্রকার সহজের সমাহার বলেই সহজ সরল প্রাণী গোরু-গাধার মতো ফল ও গাছসহ কদলি নানাবিধ গালির একটি উৎকৃষ্ট উপকরণ। যেমন কারও প্রতি ‘তুমি আমার কলাটা করবে’ কিংবা ‘কাঁচকলা খাও বা কলাপোড়া খাও’ – এমন ধরনের বাক্য প্রয়োগ। কাউকে কলা দেখানোর চর্চা তো এই ভোগানো আর ঠকানোর দেশে ব্যাপকতম হারেই চলে। ভেতরে-বাহিরে সমান মসৃণ এই বোকা ফল কলার সংস্কৃত নাম রম্ভা দিয়ে তৈরি শব্দবন্ধ ‘কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা’ তো জবর বকা।
কদলি বলতে গাছ ও ফল দুটোকেই বোঝায়। তবু অনেক সময় আলাদা করার জন্য বলা হয় কলাগাছ, কদলিবৃক্ষ – এমনকি রম্ভাতরুও। উচ্চারণে যত ওজস্বীই হোক, তরকারি হিসেবে সুপাচ্য এবং নির্দোষ। তবে ব্যঞ্জনটি সুস্বাদু নয় বলে এটিও ব্যবহৃত হয় মন্দার্থেই – কপালে আছে কদলিভক্ষণ। বৃক্ষ-তরু বলা হলেও কলার গাছটি সর্বাংশে পানসে এবং এতই নরম যে ঝড়ের প্রথম দমকাতেই ভেঙে পড়ে। কদলি শব্দটির মূল অর্থও তাই – যা বায়ু কর্তৃক দলিত হয়।
চাকরি : চাকর ফারসি শব্দ। ফারসি উচ্চারণ ‘চাকার’। শব্দটির অর্থ গোলাম, ভৃত্য, ফাইফরমাশ খাটে এমন ব্যক্তি। চাকরি শব্দটিও ফারসি, যার অর্থ চাকরের কাজ। শব্দটি বাংলাতে এসে চরিত্র হারায়নি, তবে এর অর্থের হয়েছে অভাবনীয় উন্নতি। শব্দের অর্থের যে কত বেশি উন্নতি হতে পারে বাংলায় চাকরি শব্দটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চাকরি ফারসি ভাষায় চাকর বা গোলামের কাজ হলেও বাংলাদেশে কিন্তু জীবিকা হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রসিকতা করে বলেছেন, ‘যাঁহারা চাকরি করেন, যদি তাঁহাদিগকে তাঁহাদের মনিবের চাকর বলা যায়, তবে হয়তো তাঁহারা মানহানির মোকদ্দমা রুজু করিবেন।’
অবশ : শরীর অবশ হয়, মনও। অবশ হলে শরীর নেতিয়ে পড়ে, হাত-পা চলতে চায় না। মন অবশ হলে কিছুই ভালো লাগে না। ব্যাধির কারণেও শরীর অবশ হতে পারে। পক্ষাঘাতে শরীরের একাংশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যায়। কোনোরকম সাড় বা অনুভূতি থাকে না। অবশ শব্দের মূল অর্থ – যা নিজের বশে নেই অর্থাৎ যা নিজের বশীভূত নয়। অবশ বলতে তাই স্বাধীনও বোঝায়। মূল অর্থগত দিক থেকে অবশ কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর বিশেষণ হতে পারত। কিন্তু ভাষার বিচিত্র খেয়ালে তা হয়নি। অবশ এখন কেবল দেহের এবং মনের বিশেষণ, ব্যক্তির নয়।
খই ফোটা : কারো কারো মুখে কথার যেন খই ফোটে। মানুষ তাতে মুগ্ধ হয়ে যায়। খই ফোটা বিশিষ্টার্থক একটি বাগ্ধারা। এর অর্থ অনর্গলভাবে কথা বলা, চমকপ্রদ বক্তৃতার ভঙ্গিতে দ্রুত কথা বলা। কথাটির উৎপত্তি ধান্যজাত সুপরিচিত সুখাদ্য খই থেকে। নেই কাজ তো খই ভাজ বলে একটা প্রবচন চালু আছে। তবে তা নিতান্তই কথার কথা। মানুষ কাজ হিসেবেই খই ভাজে এবং সেটা বিশেষ প্রয়োজনেই। খই নির্দোষ সুপাচ্য খাদ্য বলেই রোগীর পথ্য।
খই ভাজার জন্য বিশেষ আয়োজনও করতে হয়। মুখ চওড়া হাঁড়িতে বালু পর্যাপ্ত পরিমাণ তপ্ত করে সেই তপ্ত বালুর ওপর নির্দিষ্ট কায়দায় ছেড়ে দেওয়া হয় খইয়ের বিশেষ ধান। তারপরই হাঁড়িতে খই ফুটতে থাকে সশব্দে, পপকর্নের মতো। সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। চুলায় সশব্দ খই ফোটার এই দৃশ্যটিই ‘মুখের কথায় খই ফোটা’ বাগ্ধারায় পরিণত হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে।
জের ইজা : পরের পাতায় হিসাবের জের টানা থেকে শুরু করে জীবনের অনেক কিছুরই জের টানতে হয় মানুষকে – তর্কের জের, ভুলের জের, ঝগড়ার জের, মারামারির জের ইত্যাদি। মনোমালিন্যের জের টানা তো বংশবিশেষে জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চলতে থাকে। জের টানার এই ব্যাপারটি থেকে আলংকারিক অর্থ – ভুলের মাসুল দেওয়া অর্থাৎ পরিণাম ভোগ করা। হিসাবের খাতা থেকে উঠে আসা শব্দটির সাধারণ অর্থ হল আগের পাতার শেষ না হওয়া হিসাব পরের পাতায় ওঠানো। এই হল মূল জের টানা।
জের ফারসি ভাষার শব্দ। ফারসিতে শব্দটির অর্থ নিম্নে, বা নিচে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত জের শব্দের প্রতিশব্দ হলো ইজা। এই শব্দটিও ফারসি। তবে ফারসিতে ইজা বলতে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত জের বোঝায় না, বোঝায় অধিকন্তু, আরও, এ ছাড়া, পূর্বে উল্লিখিত ইত্যাদি। ইজা শব্দের এসব অর্থের মধ্যে জের শব্দের অনেকটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। মূল ফারসি ভাষায় কিন্তু জের কিংবা ইজা কোনোটাই হিসাবের খাতার শব্দ নয়। এটাও আরেক তামাশা রহস্যময় শব্দসংসারের।
আশকারা : বাংলায় আশকারা বলতে আমরা বুঝি প্রশ্রয় বা আবদার। বাপ-মার বেশি আশকারায় ছেলে উচ্ছন্নে যায়। আশকারা পেয়ে অনেকে মাথায় ওঠে। আশকারা শব্দটির এটা বর্তমান প্রয়োগ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে আছে – ‘সেই চুরির কোনো আশকারা হলো না কি?’ এখানে আশকারা শব্দের অর্থ – অনুসন্ধানের পর ব্যবস্থা নেওয়া। ‘খুনের মোকদ্দমা আশকারা করা’ – আশকারা শব্দের এমন প্রয়োগও ছিল এককালে। আশকারা বলতে এখানে সুরাহা বোঝানো হয়েছে। বাংলা ভাষায় আশকারা শব্দের এ জাতীয় প্রয়োগ এখন আর দেখা যায় না।
আশকারা ফারসি শব্দ। কিন্তু ফারসি ভাষায় আশকারা শব্দের অর্থ প্রশ্রয় বা সুরাহা কোনোটাই নয়। মূল ভাষায় শব্দটির অর্থ : প্রকাশ – গুপ্ত বিষয়ের প্রকাশ। শব্দ-সংসারের এ রহস্যের গোমর প্রকাশ করবে কে?
মামলা : ফারসি মোয়ামেলা শব্দ বাংলায় হয়েছে মামলা। ফারসি মোয়ামেলা শব্দের অর্থ কিন্তু বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মোয়ামেলা বলতে বোঝায় লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আচার-আচরণ। বাংলায় মামলা শব্দের অর্থ মোকদ্দমা, কেস, ব্যাপার বা বিষয়। বাংলায় মামলা শব্দটির ব্যবহার বিচিত্র। মামলা যেমন দায়ের বা রুজু করা হয়, তেমনি আবার মাত্র এক রাতের মামলাও হয় – যার অর্থ একরাতের বিষয়।
বিষয় অর্থেই প্রশ্ন করা হয় মামলাটা কী? মামলার সঙ্গে মোকদ্দমা-শব্দটা অনেক সময় একেবারে গায়ে গায়ে লেগে থাকে – যেমন মামলা-মোকদ্দমা। এ শব্দটা আরবি ভাষার। মজার ব্যাপার হল আরবি মোকদ্দমা শব্দের মূল অর্থ কিন্তু মামলার সমার্থক কিছু নয়। এর অর্থ : উপস্থাপন করা, পেশ করা যথা ইবনে খালদুনের ‘মোকাদ্দামা’। সম্ভবত মামলার আর্জি পেশ করা থেকেই মোকদ্দমা শব্দটি মামলার গায়ে সেঁটে গেছে।
হেস্তনেস্ত : সমস্যা জিইয়ে না রেখে তার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। হেস্তনেস্ত শব্দটা বাংলায় চরম বোঝাপড়া, এস্পার-ওস্পার বা শেষ নিষ্পত্তি অর্থে প্রয়োগ করা হয়।
ফারসি ভাষার ‘হাস্ত্ ও নিস্ত্’ বাংলায় হয়েছে হেস্তনেস্ত। ‘হাস্ত্ ও নিস্ত্’ কথাটার অর্থ হওয়া এবং না হওয়া অথবা থাকা এবং না থাকা। ফারসিতে শব্দবন্ধটি নিতান্তই অনিশ্চয়তাসূচক কিন্তু বাংলা ভাষায় বাগ্ধারাটি নিশ্চয়তাকামী ফয়সালা-সন্ধানী। সেজন্য আমাদের প্রায়ই শুনতে হয় : আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক অথবা আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। মোটকথা হেস্তনেস্ত অত্যন্ত জোরালো ভাবপ্রকাশক একটি ইডিয়ম।
জলাঞ্জলি : জলাঞ্জলি বলতে বোঝায় বিসর্জন বা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ, যেমন সুখশান্তি জলাঞ্জলি দেওয়া। জলাঞ্জলি বলতে অপচয় বা অপব্যয়ও বোঝানো হয়, যেমন – টাকা-পয়সা জলাঞ্জলি দেওয়া। জলাঞ্জলি শব্দের মূল অর্থ হলো জলের অঞ্জলি বা অাঁজলাপূর্ণ জল। সনাতন ধর্মানুসারে শ্মশানঘাটে শব দাহ করার পর মৃতের আত্মার তর্পণ বা তৃপ্তিবিধান এবং চিতার আগুন নেভানোর স্মারক হিসাবে অঞ্জলিপূর্ণ জল চিতায় নিক্ষিপ্ত হয়। এটি শব দাহ করার একেবারে শেষের ক্রিয়াকর্মের মধ্যে পড়ে। এই ঘটনা থেকে কোনো কিছু একেবারে পরিত্যাগ বা বিসর্জন অর্থে জলাঞ্জলি শব্দের আলংকারিক ব্যবহার।
অস্ত্রশস্ত্র : একক শব্দের স্থানে জোড়া শব্দের ব্যবহার বাংলাভাষার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক জোড়া শব্দের দ্বিতীয় শব্দটি অর্থের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও প্রথম শব্দের বহুবচন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে পরাধীন হয়ে যায়। ফলে কালক্রমে দ্বিতীয় শব্দটি লোকমুখ থেকে হারিয়েও যায়। প্রথম শব্দের সঙ্গে না থাকলে শব্দটিকে আর চেনাও যায় না। ঠিক এ রকম ব্যাপারটাই ঘটেছে অস্ত্রশস্ত্র শব্দের শস্ত্র শব্দটির বেলায়। শস্ত্রও যে একটি স্বাধীন শব্দ এবং সেও যে সমাসবদ্ধ পদ শস্ত্রপাণি হয়ে (শস্ত্র পাণিতে যার) শব্দের আগে বসে অস্ত্রধারী অর্থ জ্ঞাপন করতে পারে, সে কথা আমরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি।
দুটোর অর্থ আলাদা কিন্তু কাজ করে একই। এই একই ধরনের কাজ করার কারণেই সমার্থক হিসাবে শস্ত্র শব্দটি অস্ত্র শব্দটির অনুগামী হতে বাধ্য হয়েছে। অনুগামী হওয়ার কারণ – অস্ত্র শব্দটি নিত্যব্যবহৃত, শস্ত্র শব্দটি ব্যবহৃতই নয়। অস্ত্র-শব্দের অর্থ হলো যা নিক্ষেপ করে আঘাত করতে হয় যেমন বাণ, বর্শা ইত্যাদি। অন্যদিকে শস্ত্র শব্দের অর্থ হলো যা হাতে ধরে আঘাত করতে হয় যেমন তরবারি, গদা ইত্যাদি।
ইংরেজ ইংরেজি : ইংরেজি ভাষার শব্দভান্ডার থেকে বাঙালিরা প্রচুর শব্দ ধার করেছে, কিন্তু বহুলতম ব্যবহৃত ‘ইংরেজ’ আর ‘ইংরেজি’ শব্দ দুটো সে ভান্ডার থেকে ধার করেনি। কারণ, আমরা ইংরেজদের চিনেছি পর্তুগিজদের মাধ্যমে, তারা এদেশে আগে এসেছিল বলে। পর্তুগিজরা ইংরেজদের বলতো Engrez। তাদের মুখে শুনে আমরাও বলেছি ইংরেজ। সে সূত্রে, তাদের ভাষাকে বলি ইংরেজি ভাষা। তাদের ভাবসাব, রকমসকম, কাজকারবারও আমাদের কাছে ইংরেজি ক্রিয়াকলাপ। এই ব্যাপারগুলো ইংরেজদের উৎকট অনুকারী কোনো বাঙালির মধ্যে দেখতে পেলে সেটাকে বলা হয় ইংরেজিয়ানা।
উপনিবিষ্ট বাঙালির কাছে অহংকারী ঔপনিবেশিক জনগোষ্ঠী ইংলন্ডীয়দের আরেক নগণ্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশের ভাষায় ‘ইংরেজ’ হয়ে যাওয়া অপমানকরই বটে। বোধ হয় এটাকেই বলে কালের কুটিল রীতি কিংবা ইতিহাসের বিচিত্র গতি।
উঞ্ছবৃত্তি : উঞ্ছ শব্দটির অর্থ হলো, মাঠের শস্য কেটে নেওয়ার পর পরিত্যক্ত শস্যকণা খুঁটে খুঁটে সংগ্রহ। উঞ্ছের দ্বারা যিনি জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁর বৃত্তিই হলো উঞ্ছবৃত্তি। জনসাধারণের সব সময় ব্যাকরণ জানার বা ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন পড়ে না – তাই উঞ্ছ বস্ত্তটি কী, সেটি এখন অভিধান না খুলে অনেকেই বলতে পারবেন না। তবে উঞ্ছবৃত্তি কী, তা কিন্তু সকলেই জানেন – কায়ক্লেশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাঁর জীবন চলে তিনিই উঞ্ছবৃত্তিনির্ভর বলে পরিচিত। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে – তিনি অতিশয় অকিঞ্চিৎকর কিছুর জন্যেও অন্যের কাছে হাত পাতছেন বলে সকলে তাঁকে হেয় জ্ঞান করছে।
বিচিত্র ও বিতর্কিত বৃত্তিসমৃদ্ধ বর্তমান সমাজে উঞ্ছবৃত্তিকে সবচেয়ে হেয় বৃত্তি বলেই জ্ঞান করা হয় এবং ব্যবহারও করা হয় শুধু মন্দ অর্থেই। এ যেন ঘৃণ্য ভিক্ষাবৃত্তির চেয়েও হীন মানের বৃত্তি। অথচ এককালে উঞ্ছবৃত্তিই ছিল দরিদ্র সৎ মানুষের সকলের সমীহ সৃষ্টিকারী একমাত্র বৃত্তি। মূল্যবোধের এ নিদারুণ অবক্ষয় লক্ষণীয়।
একচ্ছত্র : একচ্ছত্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, যে ছত্রে কেবল একজনমাত্র ব্যক্তির অধিকার বর্তমান – অর্থাৎ রাজার। এই শব্দটির আড়ালে ছত্র বা ছাতা ব্যবহারের প্রাচীন ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ছত্রের আদিযুগে ছাতা ছিলো ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ছাতা তখন ব্যবহার করতেন শুধু রাজা বা সম্রাটরাই। ফলে রাজশক্তি ও ছাতা তখন সমার্থক শব্দ বলে বিবেচিত হতো। রাজশক্তির প্রতীকই ছিলো ছত্র। একচ্ছত্র শব্দটির উৎপত্তিও ছাতার ওই ক্ষমতা থেকেই।
যাহোক, ছাতার দাপট কালে কালে অন্তর্হিত হয়েছে। এ রঙবেরঙের রেইনকোটের যুগে কালো রঙের নিরীহ ছাতার এতখানি গৌরবহানি ঘটেছে যে পিতা নতুন ছাতা হাতে গুঁজে দিলেও পুত্র লজ্জায় ওটা রাস্তায় নেমে খোলে না, ভিজে ভিজেই চলে। গরিবের অপরিহার্য কার্যটি করার জন্য পুরাতন ছাতার মেরামতকারী কোথাও বসার জায়গাও পায় না, একমাত্র বুড়ো বটতলা ছাড়া। কিন্তু ছত্রের হারানো দাপটের সঙ্গে হারিয়ে যায়নি একচ্ছত্র শব্দটির দাপট। প্রতাপের অখন্ডতা বোঝাতে শব্দটি আজও আমরা ব্যবহার করে চলেছি। তবে প্রতাপটা এখন ‘প্রজাবিশেষে’র – রাজার নয়।
এলাহি কান্ড : আরবি ইলাহি শব্দের বাংলা রূপান্তর হলো এলাহি। বাঙালি মুসলমান সমাজে চিঠিপত্র, হিসাবের খাতাপত্র ইত্যাদির শীর্ষদেশে এলাহি ভরসা কথাটি লেখার রেওয়াজটা সেকাল থেকে চলে আসছে এবং একালেও বহাল আছে। আরবি ইলাহি এবং হিন্দি ভরসা মিলে তৈরি হয় শুভ কামনাসূচক বাংলা বাক্যভঙ্গি এলাহি ভরসা। এই বাক্যভঙ্গির মধ্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, নির্ভরতা এবং তাঁর অসীম মহিমার কীর্তন সবই প্রকাশ পায়। আরবি ইলাহি শব্দের অর্থ হলো আমার আল্লাহ।
কিন্তু ভাষার গতি বড়োই বিচিত্র। এই এলাহি ভরসার পাশাপাশি কালে কালে দেখা যায় যে এলাহি কান্ড, এলাহি কারখানা, এলাহি ব্যাপার ইত্যাদি বাক্যভঙ্গি তৈরি হয়ে গেছে – যেগুলোর মধ্যে এলাহির মূল অর্থের বদলে চলে এসেছে কেবল এলাহির বিশালত্ব ও ক্ষমতাসূচক গুণাবলি। দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের চোখে যে আয়োজনটি বিশাল কিংবা যা করা তাদের সাধ্যাতীত, সেই ব্যাপারগুলোই তারা প্রকাশ করছে এলাহি শব্দ দিয়ে। বলাবাহুল্য ব্যাপারটি সমাজ-মনস্তত্ত্বের।
এই একই মনস্তাত্ত্বিক কারণে হিন্দুদের অবতার রাম বা রাঘব তাঁর দেবত্ব, বীরত্ব, মহত্ত্ব ইত্যাদির বদলে ছাগল, বোকা, পাঁঠা, বোয়াল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ভাষার এই পাকেচক্রে পড়ে রামছাগলের রাম হয়ে আকারের বড়োত্বকে এবং রামবোকার রাম হয়ে বোকামির শীর্ষত্বকে বুঝিয়ে থাকেন মহামহিম রাম।
কদর্য : কু মানে কুৎসিত এবং অর্য অর্থ স্বামী – এই ব্যুৎপত্তির পটভূমিতে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় কদর্য শব্দটির একমাত্র অর্থ ছিল কুৎসিত স্বামী। আসলে যে সে স্বামীও নয়, যে ব্যক্তি স্ত্রীপুত্রকন্যাকে নিপীড়ন করে ধনসঞ্চয় করতো সেই মহাকৃপণ পরিবারপতিকেই বলা হতো কদর্য। শব্দসংসারের ক্রিয়াকলাপ এমনি খেয়ালি আর স্বেচ্ছাচারী যে কদর্য শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে তার নিজস্ব অর্থটি ভুলে। ফলে এ আধুনিক ভাষার অনেক কিছুকেই সে ইচ্ছেমতো বিশেষিত করছে। এ ভাষায় তাই কদর্য বলতে কেবল কুৎসিত স্বামী বোঝায় না, স্বামী-অস্বামী নির্বিশেষে যা কিছু কুৎসিত বিশ্রী গর্হিত তাকেই বলা হয় কদর্য – যেমন কদর্য আচরণ, কদর্য চেহারা, কদর্য কথাবার্তা ইত্যাদি। এতে কুৎসিত স্বামীটি হয়তো কিছু স্বস্তি পেতে পারে।
গড্ডলিকা প্রবাহ : গড্ডলিকা হল গড্ডল বা ভেড়ার স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থাৎ ভেড়ি। গড্ডলিকা প্রবাহের গড্ডলিকা হল মেষপালের সর্বাগ্রবর্তিনী ভেড়ি। বাগ্ধারাটির অর্থ হলো স্ত্রী ভেড়ার পিছু পিছু চলা ভেড়ার পাল। এভাবে চলাটা ভেড়াদের এক বিশিষ্ট স্বভাব। গাড়ল প্রকৃতির মানুষেরাও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে বেশ স্বস্তি বোধ করে। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশু হিসেবে ভেড়ার ভূমিকা তাৎপর্যহীন – বিরক্তিকর পশমের আধিক্যের কারণেই বোধ হয়। সম্ভবত একই কারণে গড্ডল বা ভেড়াজাত শব্দগুলো সবই মন্দ অর্থেই ব্যবহারের চল হয়েছে বাংলা ভাষায়। গড্ডল থেকে যেমন তৈরি হয়েছে গাড়ল, তেমনি ভেড়া থেকে তৈরি হয়েছে ভেড়ুয়া। দুটি শব্দই গালি হিসেবে ব্যবহৃত – পার্থক্য কেবল মাত্রার।
বাংলাভাষায় গড্ডলিকা প্রবাহ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত প্রয়োগ আর নেই বললেই চলে। এখন চলছে কথাটির আলংকারিক প্রয়োগ। নিজে বিচারবিবেচনা না করে অন্ধ ও গাড়লের মতো অন্যকে অনুসরণ করাই হলো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া।
জঘন্য : জঘন্য শব্দটি এসেছে জঘন থেকে। জঘন শরীর সম্পর্কীয় শব্দ। অর্থ হলো স্ত্রীলোকের কটিদেশ, তলপেট, নিতম্ব এবং নিতম্বের সম্মুখভাগ। স্ত্রীলোকের দেহের এই অংশটি অতিশয় প্রিয়দর্শন হলেও সমাজে প্রদর্শনীয় নয়। শুধু স্ত্রীলোক কেন, পুরুষের দেহেরও এই অংশটি সমাজে প্রদর্শনযোগ্য নয়। কারণ, বিধিনিষেধ শাসিত সভ্য সমাজে তা হবে অসভ্যতা। কিছু শারীরিক ব্যাপারস্যাপার ঢাকতে শিখেই মানুষ সভ্য হয়েছে।
যা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং যা প্রদর্শনীয় নয়, তা প্রদর্শন করা নিতান্তই গর্হিত ব্যাপার। এই গর্হিত ভাবটিই পরে জঘন্য শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফলে শব্দটির সাধারণ অর্থের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। জঘন্য এবং জঘন দুটোই সংস্কৃত ভাষার শব্দ। সংস্কৃত ভাষায় জঘন্য শব্দের অর্থ নিতম্বস্থ, জঘনের মতো বা জঘনতুল্য। অথচ বাংলা ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় ঘৃণিত, গর্হিত, নোংরা বা কদর্য ধরনের কাজ, কথা, চেহারা বা প্রকৃতি বোঝাতে। কিন্তু একটি অতি প্রিয় অর্থের অতি সুন্দর শব্দ কেন যে অতি অপ্রিয় অর্থবোধক শব্দস্বরূপ চালু হল – ভাষার সে রহস্য একান্তই অভেদ্য।
তোগলকি : সৃষ্টিছাড়া, গোঁয়ার্তুমি, পরিকল্পনাহীন ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত এই শব্দটি আমার চিত্তকে বরাবরই ব্যথিত করে। কারণ সাধারণ মানুষ দ্বারা একজন অসাধারণ মানুষের চরিত্রহনন এবং তাঁর নামের ওপর চিরস্থায়ী কলঙ্ক লেপনের এক অতি জঘন্য দৃষ্টান্ত এটি।
দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের নাম থেকে এই বাক্যভঙ্গির জন্ম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মুহম্মদ বিন তুগলক। বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, দর্শন ও সাহিত্যে তিনি ছিলেন সুপন্ডিত এবং কবি ও বক্তা হিসেবেও বেশ বিখ্যাত। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজত্বকাল।
তবে দিল্লির সাম্রাজ্য শাসকদের গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কিছু সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎমুখী সংস্কার প্রচেষ্টার জন্য তিনি মধ্যযুগের দিল্লির সম্রাটদের মধ্যে সর্বাধিক তিরস্কৃত হয়েছিলেন। সমকালীন ঐতিহাসিকরাও তাঁকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ‘পাগলা রাজা’ বলে আখ্যায়িত করেন। নিন্দাবাচক ‘তোগলকি’ শব্দটির জন্ম হয় তাঁর বিপ্লবাত্মক কল্যাণকামী কিছু কর্মকান্ডকে ভুল বুঝে এবং পরবর্তীকালে সেই ভুলটিকে চিরস্মরণীয় করে তুলে।
দেশের শাসনকার্যে উলেমাদের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত জ্ঞানে বন্ধ করেন তিনি – যেটি সাধারণত আজও অবাঞ্ছিত বলেই বিবেচিত। দোয়াব অঞ্চলে করবৃদ্ধি, দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, মুদ্রাসংস্কার ও তামার নোট প্রচলন ইত্যাদি ব্যাপারে তিনি সমকালের চিন্তাধারা থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলেন বলে দেশবাসী তাঁকে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যৎমুখী বিবেচনায় এসব পদক্ষেপ খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হত। কিন্তু বাস্তবে প্রবাদে পরিণত ‘তোগলকি’ পাগলামির প্রতীক হিসেবেই হয়ে গেল অপরিবর্তনীয় ইতিহাস।
থ : কোনো কারণে আমরা যখন থ মেরে যাই কিংবা থ হয়ে পড়ি, তখন আমরা অনেক কিছুই হই যেমন, অভিভূত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতভম্ব, স্তম্ভিত, নির্বাক, অবাক ইত্যাদি। প্রচুর অর্থ বহন করলেও আমরা জানি থ একটি বর্ণমাত্র – ব্যঞ্জন বর্ণমালার সপ্তদশ এবং ত বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ। কিন্তু আমরা যখন থ হই, তখন বর্ণমালার অক্ষরবৎ থ হই না – হই শব্দভান্ডারের একটি শব্দস্বরূপ থ এবং সেই থ শব্দটির অর্থ হলো পর্বত।
পর্বত অর্থে থ শব্দের ব্যবহার অন্ত্যমধ্যযুগের বাংলা কবিতায় শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া যায়। তারপর থেকে শুরু হয় থ শব্দের আলংকারিক বা উপমাঘটিত প্রয়োগ। ঘটনাচক্রে পড়ে আমরা অতি সংক্ষেপে থ হওয়া শিখি। এই শিক্ষাটা আমরা পাই থ অর্থাৎ পর্বতের নিকট থেকে। থ যেমন নিশ্চল-নিশ্চুপ হয়ে থাকে, তার এই ভাবটিই আমরা গ্রহণ করি বিশেষ পরিস্থিতিতে – যখন আমাদের মুখে আর কথা সরে না, আমরা হয়ে থাকি পর্বতবৎ মৌন ও নিশ্চল।
ন্যাকা : জেনেও না জানার এবং অসৎ হয়েও সততার ভান করাকে বাংলা বাগ্ধারায় ন্যাকামি করা বা ন্যাকা সাজা বলা হয়। একটি ফারসি শব্দের রহস্যজনক অর্থ পরিবর্তনের ফলে বাংলা ন্যাকা শব্দটির উৎপত্তি। এর মধ্যে রস ও রহস্য দুটোই রয়েছে। ন্যাকা একটি শ্লেষাত্মক শব্দ।
ফারসি ‘নেক’ থেকে তৈরি হয়েছে বাংলা ন্যাকা। ফারসিতে নেক শব্দের অর্থ হলো পুণ্য, মঙ্গল, ভালো ইত্যাদি। নেক শব্দটির প্রচলন রয়েছে বাংলায়ও। ধর্মাত্মা ব্যক্তিকে বাঙালি মুসলমানগণ নেক বান্দা বলে থাকেন। নেক বান্দা সদা সর্বদা নেক কাজ বা পুণ্যকর্ম করে থাকেন। ধর্মভীরু মুসলমান জানেন, মৃত্যুর পর অবশ্যই তাঁর নেকি-বদির অর্থাৎ নেক কাজ ও বদ কাজের হিসাব নেবেন আল্লাহতালা। নেকি শব্দটিও নেক থেকে তৈরি।
সমাজে পুণ্যাত্মাগণের পাশাপাশি দুরাত্মারাও বাস করে। এই দুই শ্রেণির মাঝখানে থাকে ভন্ডরা। তারা দুরাত্মার চেয়েও ভয়ংকর। দুরাত্মার দৌরাত্ম্য মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায়। কিন্তু ভন্ডরা কাজ করে গোপনে গোপনে। নেক কাজের আড়ালে তারা বদ কাজ করে। অর্থাৎ ভন্ডের নেক কাজ হলো তার ভান।
ভন্ডদের নেক কাজের এই রহস্যজনক ভানই বাঙালিকে ন্যাকা শব্দ নির্মাণে প্রণোদনা জুগিয়েছে। ন্যাকা শব্দটি পরবর্তীকালে পাপ-পুণ্যের বাইরে নানা ব্যাপারে হালকা চালে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জেনেও না জানার ভান করে যে ব্যক্তি, তার আচরণকে বাঙালি ভন্ডামি অর্থে ন্যাকামি করা বা ন্যাকা সাজা বলে থাকে। ন্যাকাকে কার্যকরভাবে বকা হয় শব্দটাকে স্রেফ বিশেষ স্বরভঙ্গিতে উচ্চারণ করে – ন্যাকা!
বরখাস্ত : শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। মূল ভাষায় বরখাস্ত অর্থ হল জেগে ওঠা, ওপরে ওঠা, অদৃশ্য হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ এটি একটি নিরুদ্বিগ্ন শব্দ। বাংলা ভাষায় শব্দটির অর্থ হল – কর্মচ্যুত হওয়া, ছাঁটাই হওয়া। ফলে এটি একটি সীমাহীন উদ্বেগ সৃষ্টিকারী শব্দ। বড়োসাহেব বরখাস্ত হয়েছেন শুনে বাংলাভাষীরা ভাববেন বড়ো সাহেবের চাকরিটা গেল। আর ফারসিভাষীরা বুঝবেন বড়ো সাহেব দিবানিদ্রা থেকে এই বুঝি জেগে উঠলেন কিংবা এতোক্ষণ তিনি বসেছিলেন, এইবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অথবা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। বাংলা বরখাস্তের ফারসি প্রতিশব্দ হলো ‘বারকেনার’। বারকেনার করা মানে ছেঁটে ফেলা, এক্ষেত্রে অর্থ হল কর্মচ্যুত করা।
বিনীত বিনত বিনয়াবনত : বস্ত্তত, বিনীত শব্দটি বিনয় থেকে জাত। বিনয় শব্দের মূল অর্থ বিশেষ নয়ন। এই নয়ন যাঁর থাকে তিনি নিরন্তর জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকেন। ভাষায়, চিন্তায়, কর্মে, আচরণে শৃঙ্খলাবোধ জন্ম নেয় তাঁর। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিনীত শব্দের মূল অর্থ সুশিক্ষিত, সংযত, নিয়ন্ত্রিত, অনাড়ম্বর, মার্জিতরুচি, সংস্কৃতিবান ইত্যাদি। কিন্তু এইসব গুণের অধিকারী কোনো ব্যক্তি তো অন্যের কাছে নিজেকে বিনীত বলে বিশেষিত করতে বা নিজের ঢাক নিজেই পেটাতে পারেন না। তাই বিনীত লিখলে পত্রপ্রাপক ভাবতে পারেন পত্রলেখক বুঝি তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন। দাপ্তরিক পত্র হলে, ঊর্ধ্বতন তার অধস্তনের কাছে নিঃসন্দেহে কৈফিয়ত তলব করতেন এবং সাবধান করে দিয়ে বলতেন, আপনার যে পদগত অবস্থান, সেটা বুঝে তবে বিশেষণ লাগাবেন – অর্থাৎ বিনীত না লিখে, বিনত লিখবেন।
ধনী, শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ইত্যাদি বিশেষণ যেমন নিজের নামের আগে নিজের হাতে বসানো চলে না, নীতিগতভাবে বিনীত বিশেষণও তেমনি চলে না। কিন্তু তারপরও চলে, অজান্তেই চলতে থাকে। এটাই হলো ভাষার জগতে শব্দের রহস্য। এবং এই রহস্যের কারণেই বিনীত শব্দের বর্তমান অর্থ বিনম্র, বিনীত, বিনয়ী, শান্ত ইত্যাদি। চিঠিপত্রে নাম স্বাক্ষরের আগে বিনীত বলে বিশেষণ প্রয়োগের অলঙ্ঘনীয় রেওয়াজই দাঁড়িয়ে গেছে। দাপ্তরিক চিঠিপত্রেও বিনীত শব্দের ব্যবহার প্রায় বাধ্যতামূলক। তাই ঊর্ধ্বতনদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে অধস্তনগণ বিনীত হতে বাধ্য হন। চিঠিপত্রে বিনীত শব্দটি থাকলে পত্রপ্রাপক প্রীত হন। বিনীত স্বভাবের লোকদের সকলেই পছন্দ করে।
তবু আমি বলবো বিনীত না লিখে বিনত বা বিনয়াবনত লেখা ভালো, রবীন্দ্রনাথের মতো।
বেলেল্লাপনা : বেলেল্লা শব্দটি মানুষের অনেকগুলো বদগুণের সমাহার। শুধু তাই নয়, এই বদগুণগুলো যখন কারো মধ্যে সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন ‘নির্লজ্জ’ শব্দটিকে সে ভাবটি প্রকাশের জন্য যথেষ্ট মনে হয় না বলেই মানুষ বেলেল্লা শব্দটির শরণ নেয়। বেলেল্লাদের বেলেল্লাপনা বা বেলেল্লাগিরিকে ঘৃণা করে সকলেই। সমাজ বেলেল্লা লোককে বিলকুল বরদাশত করে না।
ফারসি বে এবং আরবি লিল্লাহ মিলে তৈরি হয়েছে বেলেল্লা শব্দটি। ফারসি অব্যয় ‘বে’ বলতে বোঝায় বিহীন, ছাড়া, বিনা, ইত্যাদি। আর, আরবি ‘লিল্লাহ’ শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহ’র জন্য। তাই বেলেল্লা শব্দের মূল অর্থ যা আল্লাহ্র জন্য নয়। আর, যা আল্লাহ্র জন্য নয় তা নিশ্চয় শয়তানের জন্য। এ থেকেই বেলেল্লা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ধর্ম ও নীতিজ্ঞানহীন, নির্লজ্জ, লম্পট, কান্ডজ্ঞানহীন, উচ্ছৃঙ্খল। দুটি আরবি-ফারসি শব্দের সঙ্গে বাংলা ভাববাচক প্রত্যয় পনাযোগে তিনটি শব্দের সমাহারে সৃষ্ট হয়েছে চূড়ান্ত নির্লজ্জতাজ্ঞাপক বেলেল্লাপনা শব্দটি। যথাযথ শব্দসৃষ্টিকল্পে শব্দ-পরিবারের সমবায়ী উদ্যোগের এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বোমা : বাংলায় বোমা বললে প্রথমেই বিস্ফোরক পদার্থ দিয়ে তৈরি মারণাস্ত্রের কথা মনে আসে, যেহেতু বহুদিন ধরে বাংলাদেশে লাগাতার এটারই ব্যবহার এবং ব্যবহারহেতু চর্চা চলছে। ধ্বনি তৈরি করার ও বস্ত্ত ধ্বংস করার ক্ষমতা ভয়াবহ এ বোমার। তবে বাংলা ভাষায় নিত্যব্যবহৃত আরো একটি বোমা আছে – যার কাজ নিতান্ত নিরীহ, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বোমা হলো এক ধরনের আগাচোখা যন্ত্র, অবশ্য যন্ত্র বললে বাড়িয়ে বলা হবে আবার অস্ত্রও বলা যাবে না – যেমন বঁটি, কাঁচি, কাস্তেকে যন্ত্র বা অস্ত্র কোনোটাই বলা হয় না। মোট কথা এই বোমা হলো চাল-ডালের আড়তে বস্তা থেকে মালের নমুনা বের করার নিত্যপ্রয়োজনীয় একটা হাতিয়ার।
ধান চালের আড়তে শ্রমিকরা বস্তার গায়ে এই বোমা মেরে চাল, ডাল, গম ইত্যাদির প্রয়োজনীয় নমুনা বের করে দেখিয়ে থাকে। এই অনুষঙ্গ থেকেই আমরা পেটে বোমা মারার বাক্যভঙ্গিটি ব্যবহার করে বলি – ‘পেটে বোমা মারলেও একটি অক্ষর বেরুবে না’। অর্থাৎ লোকটি এমনই অশিক্ষিত যে তার পেটে বিদ্যা বলতে কিছুই নেই যে কণামাত্রও বেরুবে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে পেটে আড়তদারদের বোমার বদলে সন্ত্রাসীদের বোমা মারলে বিদ্বানদেরও বিদ্যা বেরোবে না – বেরোবে নাড়িভুঁড়ি।
ম্যাগাজিন : শব্দটি এখন প্রথমত পরিচিত – সাময়িক পত্রিকা ও পাঁচমিশেলি বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান অর্থে। দ্বিতীয়ত পরিচিত – কার্তুজের কুঠরি ও অস্ত্রভান্ডার অর্থে। চেয়ার, টেবিল, বই, খাতা, পেনসিল ইত্যাদি শব্দ বিদেশী ভাষা থেকে এলেও এখন এগুলো রীতিমতো বাংলা শব্দ। ম্যাগাজিন শব্দটি যেন এখনো তেমনি অঙ্গীভূত হয়নি বাংলা ভাষার। তাই মনে হয় এটা ইংরেজি শব্দ। অতএব এর একটা বাংলা করে নিলেই বোধ করি ভালো হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ম্যাগাজিন শব্দের জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
লাগসই ইংরেজি প্রতিশব্দ ইংরেজরাও খুঁজে পায়নি বলেই তারা ম্যাগাজিন শব্দটি আরবি থেকে নিয়েছে। বস্ত্তত ইংরেজি ম্যাগাজিন শব্দটি আরবি ‘মাখ্জান’ শব্দের উচ্চারণ বিকৃতিমাত্র। বাংলা ভাষা শব্দটিকে ইংরেজি থেকে নিয়েছে বলে উচ্চারণ বিকৃতির দায় তাকে বইতে হয়নি, কিন্তু মূল মহাজনের নাম ভুলতে হয়েছে। ইংরেজরা বিদেশী শব্দের উচ্চারণ পালটাতে মহা ওস্তাদ – পালটায় মূল শব্দকে গুম করে আত্মসাৎ করার দুরভিসন্ধিতেই। সে অসদুদ্দেশ্যেই ‘মাখ্জান’কে ম্যাগাজিন করেছে তারা। না হয় য-ফলা আর ই-কার যোগ করা ট্যারা ম্যাগাজিন শব্দটি সাদামাটা দুটি আকার দিয়ে গঠিত মাখজান শব্দটি থেকে দৃশ্যতই নিকৃষ্টতর।
আরবি মাখজান শব্দের অর্থ হলো ভান্ডার। তবে অস্ত্রপূজারি লুটেরা ইংরেজরা ভান্ডার শব্দটিকে গ্রহণ করেছে অস্ত্রভান্ডার অর্থে। ফলে তাদের ম্যাগাজিন বোঝায় কেবল অস্ত্রপাতি, গোলাবারুদ আর রাইফেল-রিভলবারের কার্তুজ-কুঠরি ইত্যাদির ভান্ডারকে – মাখজানের মতো সাধারণ ভান্ডারকে নয়।
১৭৩১ সালে সামরিক অর্থধারী ম্যাগাজিন শব্দটি নতুন এক অসামরিক অর্থের তাৎপর্য লাভ করে – ব্রিটেন থেকে The Gentleman’s Magazin নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সূত্রে। পত্রিকাটির সম্পাদক প্রথম সংখ্যাতেই জানিয়ে দেন, এটি অস্ত্রভান্ডার নয় – এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অপূর্ব তথ্যভান্ডার। প্রতিমাসে এই ভান্ডারে অজ্ঞানতা-বিনাশক জ্ঞানের বিবিধ অস্ত্র জমা হতে থাকে এবং এজন্যই এটির নাম ম্যাগাজিন রাখা হল। বলাবাহুল্য সেই থেকেই ম্যাগাজিন শব্দটি অসামরিক বিশ্বে এই নতুন অর্থেই ব্যাপকতম পরিচয়টি লাভ করেছে এবং এ পর্যন্ত তা ধরে রেখেছে।
লাবণ্য : লাবণ্য শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো সৌন্দর্য, কান্তি, কোমলতা, চাকচিক্য ইত্যাদি। কারো দেহলাবণ্য আছে না তিরোহিত হয়েছে সেটা তার মুখ দেখে চট করে বলে ফেলা যায়। কিন্তু লাবণ্যটা কী পণ্য? অভিধানের অর্থ দিয়ে সহজে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করা যায়। লাবণ্য শব্দটির মূলে আছে লবণ। কিন্তু কেন? কারণ লবণের মধ্যে আর্দ্রতা আছে। দেহলাবণ্যেও রয়েছে এক ধরনের আর্দ্রতা। এই আর্দ্রতাই আসল লাবণ্য – যা একালের আধুনিকারা নানা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে রক্ষার চেষ্টা পান। টিভি খুললেই শোনা যায় সবচেয়ে বেশি চিৎকৃত শব্দটি হল ময়েশ্চারাইজার। বিজ্ঞাপক বলতে থাকেন – বেস্ট কোয়ালিটি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বকের আর্দ্রতা সংরক্ষণ করুন। কেন? লাবণ্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য।
লবণের কথায় বেকনকে মনে পড়লো। সতেরো শতকেই তিনি বলেছিলেন যে এসে বা রচনা নামটা একালের হলেও বস্ত্তটি সেকালেরই। তাহলে ‘ফাদার অব এসে’ মিশেল মঁতেইন (১৫৩৩-১৫৯২) নতুন করলেন কী? প্রাচীন ভাষ্যটিকে তিনি, স্বল্প পরিসরে স্বচ্ছন্দ ও মনোহর ভঙ্গিতে, লেখকের স্ব-কে প্রকাশ করার একটি নতুন শিল্পসংরূপে পরিণত করলেন। রূপটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণটি, ‘ফাদার অব ইংলিশ এসে’ ফ্র্যান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) নিজের এসে সম্পর্কে-করা, একটি উক্তিতেই মূর্ত হয়ে ওঠে : রচনা হল লবণের দানা, যা ভোগে উদ্বুদ্ধ করবে; ভোগক্লান্তির সৃষ্টি করবে না। এই হল লাবণ্যের গোপন তত্ত্ব – যা উপভোগে উদ্বুদ্ধ করবে, কিন্তু উপভোগক্লান্তির সৃষ্টি করবে না।

প্রাচীনকালের এক সৌন্দর্যবিশারদ লাবণ্যের লক্ষণ সম্বন্ধে বলেছেন – মুক্তার অভ্যন্তরে যে সুন্দর তরল ছায়া দেখা যায় সেইরূপ ছায়া অঙ্গে বিদ্যমান থাকলে তাকেই লাবণ্য বলা যায়। লাবণ্যের এই লক্ষণবর্ণনা বেশ কাব্যময়। মোটকথা লাবণ্য হল অধরা মাধুরী। 