রাজনগরে কী ঘটে

মোসাদ্দেক আহমেদ

অমিয়ভূষণ মজুমদার যত বড়মাপের কথাশিল্পী, ঠিক ততখানি তো দূরে থাক, কীর্তির তুলনায় এক-দশমাংশ পরিমাণ সমাদরও তিনি পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। যে-ধারাবাহিক সাহিত্যিক অবহেলার তিনি শিকার, একে সাহিত্যের বদমায়েশি বলা চলে কিনা গুণীজনরা একদিন তা ভেবে দেখবেন বইকি। অধ্যাপক অমলেন্দু বসুকে এক ব্যক্তিগত পত্রে অমিয়ভূষণ জানিয়েছিলেন, ‘আপনার কাছে কবুল করা উচিত আমার অধিকাংশ গল্প এবং উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়নি… ছেলেরা কিছু বললে আমি খুব গম্ভীর মুখে Hopkins-কে স্মরণ করতে বলি… একটা বিষয় ওদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে… আমি entertainer নই।’ ফলে ১৯৮৬ সালে তাঁর রাজনগর বঙ্কিম পুরস্কার ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হলে তিনি ‘প্রসঙ্গ : রাজনগর’ শিরোনামে জানিয়েছিলেন, ‘আশির দশকের একজন উদীয়মান লেখক হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থিত হতে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করেছিলাম।’ অথচ তাঁর মানের ঔপন্যাসিক খুব কমই আছেন বাংলা সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যে মানসম্পন্ন উপন্যাসের অভাব আছে বলে যে-আক্ষেপের কথা আমরা প্রায়শ শুনি, সেটার অনেকখানি সুরাহা হবে যদি এই মহৎ শিল্পীকে তাঁর প্রাপ্য আসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর তা তখনই সম্ভব, যখন আমরা তাঁর বিপুল রচনাবলির নিবিড় পাঠ ও পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হবো।
ভাবলে অবাক হতে হয়, যখন দেখি, যেসব সাহিত্যসত্য তিনি বহুপূর্বে বলে গেছেন, সেটার প্রতিধ্বনি করছেন সাম্প্রতিক নোবেলবিজয়ী লেখকগণও। অধুনা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক মারিও বার্গাস ইয়োসা যখন তাঁর নোবেল-ভাষণে বলেন, ‘আমার জন্য সাহিত্য হয়ে উঠল দৈব-দুর্বিপাক ঠেকানোর পন্থা, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের হাতিয়ার, অসহনীয়তা থেকে পলায়নের পথ এবং আমার বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা’, তখন সেইসব মর্মার্থ কি বেশ আগেভাগ আমরা জেনে যাই না অমিয়ভূষণের সাহিত্যভাবনার বদৌলতে? মিলিয়ে নেওয়ার স্বার্থে এবার উদ্ধার করা যাক অমিয়ভূষণের বহুমূল্য সাহিত্যচিন্তা, ‘জীবন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এবং জাগতে আমার ভালো লাগছে না। এই জাগরণে আমার বৃদ্ধি নেই… আমি ঐ পার্টিকুলার ধরনের এস্কেপ চাচ্ছি। মায়ের জঠরে যে এস্কেপ করেছিলাম জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখবার, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা… দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি দিয়ে তো নিজেকে জানা হল না। সে সব দিয়ে যা জেনেছি তা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সাহিত্য সৃষ্টির মূলে হয়তো অস্বস্তি থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা।’ এই এস্কেপ কিন্তু জীবন থেকে পলায়ন নয়; বরং এই নান্দনিক আনন্দ এমন এক অনির্বচনীয় আনন্দ যা ব্রহ্মস্বাদের সহোদরা।
ফলে হয় কী, অমিয়ভূষণ entertainment-এর ধার দিয়ে তো যানই না, তার বদলে সাহিত্যকে তিনি দেখেছেন একটি সামাজিককর্ম হিসেবে, একটা কমিউনিকেশনের শক্তিশালী মাধ্যম রূপে। কথাসাহিত্য সম্পর্কে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা থাকায় জীবনের স্বরূপকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সহৃদয়তার সঙ্গে, কোনো ইজম বা তত্ত্বের আলোকে নয়। ফিজিক্যাল ও পলিটিক্যাল এনটিটির চেয়ে মানুষের সাইকোলজিক্যাল এনটিটিকে অধিক মূল্যায়িত করেছেন, ‘মানুষ কী? এ জানতে বুঝতেই তো হয়রান।… মানুষকে কেউ এক্সপ্লেন করতে পারে না। সে একটা কাব্য।’ তাঁর মতে, ‘সাহিত্যের পথ বিচার ও বিশ্লেষণের নয়, গঠন ও বিশ্বাস উৎপাদনের। অস্বীকার করা যায় না, একজন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার অথবা কবি আবেগের ভাষাতেই কথা বলেন। …এবং এইজন্য বোধহয় উপন্যাস বলতে boy meets a girl কখনও ভাবতেই পারি না… উপন্যাস আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের এ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির উপায়ও নয়। উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নিচে ফুটে ওঠে… অর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব।’ উপর্যুক্ত বিষয়াদি ঝালিয়ে নেওয়ার হেতু এই, অমিয়ভূষণের সাহিত্য-মননের কাছাকাছি যাওয়া আর সেই আলোকচ্ছটায় রাজনগর উপন্যাসে কী ঘটে সেটা বোঝার চেষ্টা করা। প্রকৃতপ্রস্তাবে রাজনগর উপন্যাসটি তাঁর প্রকল্পিত ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড; প্রথম খন্ডের নাম নয়নতারা; তৃতীয় অংশ যার পূর্বনির্ধারিত নাম ছিল ‘স্যর রাজচন্দ্র’ শেষমেশ আর লিখিত হয়নি। ফলে রাজনগর উপন্যাসের আলোচনায় নয়নতারার অথবা বিস্তৃতির স্বার্থে অন্য বইগুলোর প্রসঙ্গ যে ঘুরেফিরে আসবে, এতে আর আশ্চর্য কি!
ট্রিলজির এই দুই পার্টধৃত সময়কাল ১৮৫৫ থেকে ১৮৮৩, যার মধ্যে নয়নতারার কালখন্ড ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৭ আর বাদবাকি কালখন্ড রাজনগরে সন্নিবিষ্ট। বস্ত্তত স্থিরীকৃত তৃতীয় খন্ড লিখিত না হলেও রাজনগর উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে ‘স্যর রাজচন্দ্র’র সারসংক্ষেপ যে ঢুকে পড়েছে তা সহজে অনুমেয়; কেননা শেষ পরিচ্ছেদের কালসীমা বিস্তৃত হয়েছে দীর্ঘ দুদশক জুড়ে, অথচ তার আগপর্যন্ত পুরো বইটির সময়কাল মাত্র কয়েক বছরের। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় হিসেবে ইতিহাসের এই সময়খন্ডকে লেখক বেছে নিলেন কেন? কেন অাঁকলেন তৎকালীন ফিউডাল সমাজের চিত্র? কারণ নিশ্চয় আছে। আমরা জানি, ওই ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল, যার ভরকেন্দ্রে ছিল সিপাহি বিদ্রোহ আর ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের প্রভোকেশনগুলোর ছিল এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় গরু ও শুয়োরের চর্বির ব্যবহার, সতীদাহ দমন, বিধবা বিবাহ আইন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও শাসকশক্তি ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় ধর্মের কুৎসা রটনার মতো ব্যাপারসমূহ। সাধারণ বাঙালি এ-জাতীয় আন্দোলনে সোৎসাহে যোগ দেয় সত্য কিংবা গদিচ্যুত কোনো কোনো সামন্ত অথবা কোনো কোনো জমিদার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনও জানায় বটে, তবে বাস্তবতা এটা, জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো কোনো আদর্শ এখানে ছিল না, বড়জোর ছিল ইংরেজবিরোধিতা। সিপাহি বিদ্রোহ একটি খন্ডিত বিদ্রোহ ছিল, কেননা সর্বভারতীয়বোধ তখনো তৈরি হয়নি, হয় পরের বছর; হেতু এই, ভারতবর্ষ বলতে যা বোঝায় সেটির জন্ম ১৮৫৮ সালে, বস্ত্তত ইংরেজরা যেদিন থেকে লাল ম্যাপ এঁকেছিল, সেদিন থেকেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের সূচনা। এর আগে তো এই দেশ ভিন্ন-ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। শুধু কি তাই, বিদ্রোহ সফল হলে কে হবেন সংযুক্তির কর্তা এটাও ছিল বিশাল প্রশ্ন। কারণ সম্ভাব্য সংযুক্তির কর্তা হিসেবে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁকে কি নির্দ্বিধায় মেনে নিত শিখ, মারাঠা কিংবা বাংলা-অযোধ্যার নবাবরা? ইত্যাকার জটিল রাজনৈতিক ভাষ্যের দায়ভার লেখক নিজেই অন্যত্র মিটিয়ে গেছেন বলে উপন্যাসদ্বয়ের রসাস্বাদনে পাঠক বাড়তি সুবিধাভোগ করেন। আন্দাজ করি, এর বাইরেও বৃহৎ কারণ আছে। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের রচনাকাল বাংলা কথাসাহিত্যের কেবল উন্মেষপর্ব নয়, অত্যন্ত গুরুত্ববহ অধ্যায়ও বটে। তিনজন শিল্পীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবার একাই একশ : বিকাশোন্মুখ বাংলা ভাষাকেই শুধু পূর্ণতা দান করেননি, তাঁর হাত ধরে বাংলাসাহিত্য একলাফে সাবালকত্ব অর্জন করে। কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়। তাঁদের রচনায় কলোনিয়াল সমাজকাঠামো সেইভাবে চিত্রিত না হলে হয় কী, উত্তরসাধক হিসেবে অমিয়ভূষণকে এগিয়ে আসতে হয়। নয়নতারা, রাজনগর ও গড় শ্রীখন্ডসহ একাধিক উপন্যাসে তিনি ফিউডাল চালচিত্রকে প্রতিবিম্বিত করেছেন; মধু সাঁধুখায় এসেছে আরো পেছনের সমাজ, ১৫৮৬ সালের জীবনচিত্র। এতে বোঝা যায়, ঔপনিবেশিক সমাজপ্রেক্ষিতকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন বেশ ভালোভাবে। তাই গড় শ্রীখন্ড পাঠের পর অমিয়ভূষণের বাবা যখন ছেলের সম্পর্কে স্ত্রীর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘না-দেখে, না-শুনে সে কী করে-বা বাবার ঠাকুরদাদাকে তাঁর পোশাক, চালচলন, কথা বলা, মনের ভঙ্গি, নীল ভূঁইয়ার দেওয়ালে এঁকে ফেলেছে’, তখন সেই বিস্ময়বোধ আমাদেরকেও সমান ছুঁয়ে যায়। আন্দাজ হয়, তাঁর বাবার ঠাকুরদা মথুরাপ্রসাদমশায়ের ক্রয়কৃত সিপিয়া রঙের দুর্গাকার নীলকুঠির সামন্ততান্ত্রিক আবহ এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে থাকবে। নয়নতারা ও রাজনগর উপন্যাসে ইতিহাসের ডিটেল্স এতো ব্যাপকভাবে এসে যাচ্ছিল, একশ বছরের ইতিহাসের ধারাকে তিনি যেন ঠিক বাগে রাখতে পারছিলেন না, পরিণতিতে তৃতীয় পার্ট লেখার পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। বোধকরি লজিকটি ষোলো আনা সত্য নয়, অর্ধসত্য বড়জোর; তৃতীয় খন্ড প্রকাশের ব্যাপারে প্রকাশকদের অনীহাও এখানে কম দায়ী নয়। ইতিহাসাশ্রিত হওয়া সত্ত্বেও গ্রন্থদ্বয় ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, কারণ চরিত্রগুলো সব কাল্পনিক। আবার ঐতিহাসিকও বটে, কারণ দুই পার্টে নীলাক্ত সমাজকে প্রতিফলিত করা হয়েছে। উপন্যাসযুগলে কেবল রাজরাজড়াদের কাহিনি নয়, বরঞ্চ যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসমেত উনিশ শতকই উঠে এসেছে; এমনকি সেকালে একটা আমূল পরিবর্তনের ঢেউ যেভাবে সর্বত্র আছড়ে পড়ছিল, সেটির উত্তাপও পাঠকের গায়ে এসে লাগে। কলোনিয়াল শাসনব্যবস্থায় আধুনিক পুঁজির প্রাথমিক বিকাশ কী জন্মরোগাব্যক্তির উত্থান কিংবা নীলাক্ত সময়কে তিনি হাজির করেছেন সত্য, কিন্তু কখনো তা ইতিহাসপ্রধান কিংবা জীবনী হয়ে ওঠেনি, বরং ইতিহাস সরাসরি ঢুকে গেছে ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে; প্রায় গোটা ঊনবিংশ শতক ছায়া-ছায়া হয়ে ছড়িয়েছে উপন্যাসে, কখনো ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট তারিখের নিচে টাইট ফিটিং হয়ে বসেনি। কারণ আমরা অমিয়ভূষণের বরাত দিয়ে জানি, ইতিহাস এক ভাস্বর দ্বান্দ্বিক স্রোত বলেই না কবরখানার নামান্তর; সেখানে স্থান পাওয়া তাই এমন কোনো বাহাদুরির ব্যাপার নয়। প্রসঙ্গক্রমে কথাশিল্পী ই এম ফরস্টারকে স্মরণ করা যেতে পারে, শুনি তাঁর আস্পেক্ট অব দ্য নভেল গ্রন্থের বক্তব্য, ‘ইতিহাস গড়ে ওঠে সত্য ঘটনার অবলম্বনে, পক্ষান্তরে উপন্যাসের ভিত্তিভূমি হচ্ছে ঘটনা এবং কমবেশি অন্যকিছু যা ঔপন্যাসিকের মানসলোক থেকে সঞ্জাত। তিনি ইতিহাসের চরিত্রের অন্দরমহলে ঢুকে গিয়ে তার গোপন জীবনকে তুলে ধরেন। তিনি এমন একজন মহারানি ভিক্টোরিয়া নির্মাণ করেন, যা ঠিক ইতিহাসের মহারানি ভিক্টোরিয়া নয়। ইতিহাসবিদ ঘটনা লেখেন আর ঔপন্যাসিক সৃষ্টি করেন।’ সুখের কথা, অমিয়ভূষণ মানবচরিত্রের সেই দিকটি উন্মোচিত করেছেন যা উপাখ্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ ব্যক্তির সেই রোমান্টিকতাকে যা বিনয় বা লজ্জার কারণে চরিত্রটি বলতে পারে না। এই অর্থে উপন্যাসদুটি ইতিহাসের শূন্যস্থান পূরণ করে; তার মানে ইতিহাস যেখানে গিয়ে নির্বাক হয়ে যায়, কথাসাহিত্য সেখান থেকেই কথা জোগায়। আর তা করতে সংগত কারণেই অমিয়ভূষণকে ইতিহাসের মহাসড়ক ছেড়ে হৃদয়বৃত্তিক পথে অগ্রসর হতে হয়েছে। সুতরাং হয় কী, যাদের ঘিরে উপন্যাস আবর্তিত – সেই রাজবাড়ির রানীমা, রাজকুমার রাজু, দেওয়ান হরদয়াল, সদর-নায়েব, নায়েবগিন্নি, নায়েবের ভাগ্নে গোবর্ধন কিংবা রাজবাড়ির শক্ত প্রতিপক্ষ ইংরেজ নীলকর ডানকান হোয়াইট, চাইকি দেওয়ান হরদয়ালের স্কুলের শিক্ষক চন্দ্রকান্ত অ্যান্ড্রুজ বাগচী ও তার ফিরিঙ্গি স্ত্রী ক্যাথারিন কেট এবং আরেক অন্যতম প্রধানচরিত্র ফরাসি খ্রিষ্টান পিয়েত্রো ও তার ম্যানেজার-কাম-ডানহাত বুজরুক আলীসহ প্রজাকুলের একাংশ প্রাণাবেগে উত্তাপিত ও সজীব। কাহিনির প্রারম্ভিক ফ্লাশব্যাকে আমরা দেখতে পাই – ফরাসি পিয়েত্রোর বাবা জাঁ পিয়েত্রো ১৭৯৪ সালে নৌকাযোগে ভ্রমণের সময় নদীতীরবর্তী বনের মধ্যে এক ব্রাহ্মণকন্যাকে সতীদাহের আগুন থেকে রক্ষা করলে হয় কী, ওই বেঁচে-যাওয়া ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে গান্ধর্বমতে জাঁ পিয়েত্রোর বিয়ে পড়িয়ে কনের ভাই সমাজত্যাগ করে কাশীবাসী হন। ঘটনা সুতো ছাড়তে থাকে এই জায়গা থেকে, যদিও নয়নতারার আনুষ্ঠানিক সূচনাকাল ১৮৫৫। গান্ধর্বমতের এই নাটকীয় বিয়েটি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না, জাঁ পিয়েত্রোর ব্রাহ্মণ স্ত্রী বর্তমান পিয়েত্রোকে জন্ম দেওয়ার পরপর মারা যায়। এদিকে আরেক নাটক এমনতর যে, ব্রাহ্মণকন্যার সেই কাশীবাসী ভাইয়ের মেয়েই হচ্ছেন আলোচ্য উপন্যাসের জমিদার রানীমা অর্থাৎ রানীমার পিসতুতো ভাই বর্তমান পিয়েত্রো; বয়সের হিসেবে রানীমার যখন ১৪, বর্তমান পিয়েত্রোর বয়স তখন ৪০। ওই সময় দুজনার বিয়ের কথাবার্তা উঠলেও রক্তের সম্পর্কের কারণে বিয়েটা শেষমেশ ভেঙে যায়। বিয়েটা ভেঙে যায় বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রণয়পূর্ণ বন্ধন গড়ে উঠেছিল শেষদিন অবধি তা দুজনার হৃদিপদ্মে সংগোপনে সযত্নে ক্রিয়াশীল থাকে। এই ইস্থেটিক ডিলাইট ও লাভই শেষতক সবকিছু ছাপিয়ে উপন্যাসের মূল থিম বা রূপের আধার হয়ে ওঠে।
পিয়েত্রোর সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর রানীমার বিয়ে হয় অন্যত্র, রাজনগরের জমিদারের সঙ্গে এবং আমরা দেখি, রাজনগরের জমিদার দীর্ঘজীবী হননি; জমিদারের মৃত্যুর পর রানীমা কার্যভার গ্রহণ করেন; শুধু তাই নয়, রানীমা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জমিদারকার্য পরিচালনা করে বাৎসরিক আয় দ্বিগুণ করতে সমর্থ হন। রাজনগরের পাশের গ্রাম ফরাসডাঙ্গায় তখনো চিরকুমার পিয়েত্রো বাস করছেন ও আমৃত্যু ফরাসডাঙ্গায় বসবাস করেন। তার ছিল মসলিন ও রেশমের বিশাল ব্যবসা। নিঃসঙ্গ অকৃতদার বৃদ্ধ পিয়েত্রোর সঙ্গে রানীমার একমাত্র ছেলে রাজুর নিত্য ওঠাবসা থাকলে হবে কী, রাজু কিন্তু কোনোদিন জানতে পারে না – পিয়েত্রো হচ্ছেন তার মায়ের পিসতুতো ভাই আর তার মা পিয়েত্রোর মামাতো বোন। এমনকি পিয়েত্রোর পিয়ানোতে খোদিত ‘বইচে’ নামখানি যে তার মায়ের একটি স্মৃতিময় সুরভিত আবেগাকুল নাম – সেটিও অজানা থাকে রাজুর। পিয়ানো বাজানোর শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও বন্দুক-চালনাসহ বহু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজুকে একজন যোগ্য রাজকুমাররূপে গড়ে তোলার সবরকম চেষ্টা করেন পিয়েত্রো। তবে এখানে একটি কথা; রাজুকে উত্তরণের সাধনায় যদি কেউ সফল হয় তবে সে নয়নতারা। টোল পন্ডিতের বোন কবিরাজ নয়নতারার সান্নিধ্যে আসার পর থেকে রাজুর মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়; যে-রাজু একদা নীলকর ডানকানের এলাকা মরেলগঞ্জের সদর-তহশিলদারকে কথাকাটাকাটির এক তুচ্ছ পর্যায়ে খুন করে বসে, পরে সেই রাজুর মধ্যে নানাবিধ মানবিক গুণাবলির সমাবেশ ঘটতে থাকে; চিন্তা ও অনুভবে পরিপক্বতা আসে; হরদয়ালের স্কুলের সফলতা যেমন সে কামনা করে, তেমনি নিজে শিক্ষিত না হওয়ার কষ্ট রাজুকে বেদনার্ত করে। ডানকানের জুলুমকে সহ্য করতে পারে না বলেই সে সিপাহি বিদ্রোহে নৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন জানায়, এমনকি একদা সে প্রজাদের জমি নয়নতারার নামে কিনে নেয়, যাতে করে ডানকান সেখানে নীলচাষ করতে না পারে। না, একে ধনাঢ্যের পীড়া বলা যাবে না, যেহেতু রাজুর ঐকান্তিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না।
কলকাতায় যখন রেনেসাঁস বা রিভাইভাল ঘটছে তখন শুধু কলকাতা নয়, সেটির অভিঘাত যে কলকাতা থেকে দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও আছড়ে পড়ে – অনালোচিত এই দিকটি লেখায় সবিশেষ গুরুত্ব পাওয়ায় গোটা উনিশ শতককে আমরা নতুন আলোয় অবলোকন করার সুযোগ পাই যা উপন্যাসযুগলকে বিশিষ্টতা দান করে বইকি। দেওয়ান হরদয়াল চরিত্রটিই এর প্রমাণ; কেননা কলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত-রাজা রামমোহনের পুত্র রমাপ্রসাদ-ঈশ্বরচন্দ্র-প্যারীচরণ কিংবা রামগোপাল ঘোষের বিপরীতে ওই প্রান্তবর্তী রিভাইভালের একজন বলিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে দেওয়ান হরদয়ালও কম উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠেনি; তাই লেখক তাঁকে অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। রাজনগর গাঁয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা হরদয়ালই গ্রহণ করে। তার উদ্যোগটি ক্রমশ পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়, বিশেষ করে যখন ওই স্কুলের চাকরি নিয়ে উচ্চশিক্ষিত চন্দ্রকান্ত অ্যান্ড্রুজ বাগচী সস্ত্রীক মধ্যপ্রদেশ থেকে অজপাড়াগাঁ রাজনগরে পদার্পণ করে। স্মরণ করা ভালো, স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে হরদয়ালকে যথেষ্ট শ্রম দিতে হয়েছে এবং প্রতিকূলতাও কম পোহাতে হয়নি। রাজনগরের পাশের গ্রাম মরেলগঞ্জের নীলে-সাহেব ডানকান হোয়াইট কখনো চায়নি যে, পাড়াগেঁয়ে স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটুক। কারণ ইংরেজি-জানা শিক্ষিত লোকগুলো তখন নীলচাষের বিরুদ্ধে হরেকরকম ঘোঁট পাকিয়ে তুলছিল। একথা ঠিক, ইংরেজি-জ্ঞানে ভারতীয়দের মন উন্নত না হলেও তীক্ষ্ণ হচ্ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হলে যে-যোগ্যতা দরকার সেটি তারা হাতিয়ে নিচ্ছিল ইংরেজদের কাছ থেকে; লেখকের ভাষায় ‘ঠিক যেন বারুদের ব্যবহার জানি-দুশমনের কাছ থেকে শিখে নেয়া’। বিশেষত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর রাজশক্তি ইংরেজরা এতটা তটস্থ হয়ে পড়ে যে, বিদ্রোহদমনের আনন্দে তারা কালীঘাটে পূজা দেয় পর্যন্ত এবং ১৮৫৭-এর আশঙ্কাকে তারা আর কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারে না, ফলে অনেকে তাদের পরিবারকে হোমে রাখে। কালাপানির খেরোখাতার সাক্ষ্য মোতাবেক সিপাহি বিদ্রোহের যেসব জীবিত বিদ্রোহী ফাঁসিকাষ্ঠ এড়াতে সমর্থ হন, তাঁদেরকে প্রথমবারের মতো দ্বীপান্তরিত করা হয় কলকাতা থেকে ১১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের আন্দামান দীপপুঞ্জে, যাতে করে কোনোদিন তারা আর মূল ভূখন্ডে ফিরতে না পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এভাবে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার কারাগারে কালাপানি দেওয়া হতে থাকে বিভিন্ন ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষদের যাঁরা জীবন ঘষে আগুন জ্বালাতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৮৫৭-এর পর ইংরেজদের পলিসিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে; খ্রিষ্টধর্ম প্রচার অব্যাহত রাখলেও আগের মতো তারা আর ভারতীয় ধর্মের অপপ্রচার করে না, ধর্মবিদ্বেষ থেকে কৌশলগত কারণে সরে আসে এবং সবচেয়ে যা উল্লেখযোগ্য, ১৮৫৭-এর প্রভাবে কোম্পানি রুলের বদলে সেক্রেটারি অব স্টেটের রুল জারি হয়; স্বেচ্ছাচারী নীলকরদের লাগাম টেনে ধরতে গঠিত হয় ইন্ডিগো কমিশন; নীল-সাহেবদের অত্যাচারের নতুন কূটকৌশলের সামনে কমিশনের কার্যক্রম যদিও অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে, তথাপি কমিশনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে-অবকাশ নেই, তার আরেক নজির কাঙাল হরিনাথের বস্ত্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতাও, ‘ভারতবর্ষে নবাগত শিবিল কর্ম্মচারীদিগের বিশ্বাস আছে, নীলকররা, খৃস্টীয় ধর্ম্মাবলম্বী, সভ্য জাতি, সচ্চরিত্র। তাঁহাদিগের দ্বারা প্রজাপীড়ন অসম্ভব। হাঙ্গামা কেবল প্রজাদিগের দোষেই হইয়া থাকে। …যদি করেন, তবে তাঁহাদিগকে পাদ্রি সাহেবরা মিথ্যাবাদী একথা স্বীকার করিতে হয়। …এবং নীল কমিশনার প্রধান প্রধান লোকদিগের রিপর্ট পুস্তকখানিও একবার স্থিরচিত্তে পাঠ করিয়া অবগত হউন। তাহা হইলে স্পষ্টরূপে জানিতে পারিবেন, নীলকরেরা অত্যাচারী কি না।’ হরদয়াল চরিত্রটি আরেক কারণেও মনে রাখার মতো। হেডমাস্টার বাগচীর সুন্দরী ফিরিঙ্গি স্ত্রী ক্যাথারিন কেটের সঙ্গে রাজকুমার রাজুর মেলামেশায় ক্ষিপ্ত হয়ে রানীমা যখন একপর্যায়ে বাগচীদম্পতিকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন, তখন হরদয়াল ক্যারেক্টারের তেজ বোঝা যায়; প্রথমবারের মতো রানীমার হুকুমপালনে হরদয়াল অস্বীকৃতি জানায় এই দুর্ভাবনায় যে, এতে তার সাধের স্কুলটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফল অবশ্য ভালো হয়নি; স্কুলটি রক্ষা পেলেও হরদয়াল তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত হয়। তবে রানীমা তাকে বহিষ্কার করেননি হয়তো এই কারণে যে, হরদয়াল রাজুর সেই নরহত্যার কথা জানে এবং বিবেক বিসর্জন দিয়ে সে রাজুকে হেফাজত করেছিল। তবে আর পাঁচজন দেওয়ানের মতো কাজটি করলেও হরদয়ালের স্বাতন্ত্র্য এই, মরেলগঞ্জের সেই নিহত সদর-তহশিলদারের মৃতদেহের ভার সে জীবনভর বয়ে বেড়ায়। জমিদার বা জমিদারতনয় কর্তৃক নরহত্যা নতুন কিছু না হলেও হরদয়ালের আত্মোপলব্ধি পাঠকের কাছে নতুন ও হৃদয়গ্রাহী। হরদয়ালের সূত্র ধরে আমরা উনিশ শতকের জাগৃতির অন্য প্রান্তিক নায়কদেরও স্মরণ করতে পারি বইকি! কলকাতা থেকে বহুদূর তো বটেই, তদানীন্তন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও নদীয়া জেলার অন্তর্গত কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়া গ্রাম ও কুমারখালী ছিল নিতান্ত প্রত্যন্ত অঞ্চল; অথচ সেখানে আমরা কী দেখি। অন্ত্যজ মানুষের মধ্য থেকে লালন উঠে এসে বাউল মত ও পথের সর্বোচ্চ স্ফুরণ ঘটান আর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় অজগাঁয়ের চরম অবহেলিত এবং অত্যাচারিত গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরে কাঙাল হরিনাথ বনে যান এক গ্রামীণ নায়ক। আসলে এখানেই ইতিহাসবিদের সঙ্গে কথাসাহিত্যিকের মৌল পার্থক্য; ইতিহাস যখন কলকাতার বাবুসমাজকে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দিচ্ছে, কথাসাহিত্যিক তখন মুখ ফেরান প্রান্তবর্তী জনপদ ও মানুষের দিকে। আলোচ্য উপন্যাসদুটির শিল্পকুশলতা মাথায় রেখে আজ এ প্রতীতি জন্মে যে, লালন ও কাঙাল হরিনাথকে নিয়েও দুটো চমৎকার উপন্যাস লেখা সম্ভব; অমিয়ভূষণের মতো বড়মাপের শক্তিমান ঔপন্যাসিকের পানে ভাবীকাল তাকিয়ে আছে বললে নিশ্চয় অযুক্তির হবে না।
আখ্যানের এ তো গেল একদিক, অন্য পিঠে রয়েছে রানীমা ও নীলকর ডানকান হোয়াইটের ভেতরকার বিবিধ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্ব-কলহ; অপ্রকাশ্য বিরোধের মূলে থাকে সিপাহি বিদ্রোহের প্রতি রাজু এবং পিয়েত্রোর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। এতদ্ব্যতীত পূর্বেকার কিছু কারণ ছিল। পিয়েত্রোর ম্যানেজার বুজরুক আলীর কাছে বন্দুক-চালনা রপ্ত করার প্রথমদিনেই রাজু গুলি করে ডানকানের দেওয়ান মনোহর সিংয়ের নৌকা শুধু বানচাল করে না, নৌকার মাস্ত্তলে-লাগানো ইউনিয়ন জ্যাকের রাষ্ট্রীয় পতাকাটিও ফর্দাফাই করে ফেলে, যা আত্মগর্বী ইংরেজ ডানকান কখনো সহজভাবে নেয়নি; উপরন্তু রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীককে অবমাননার দায়ে রাজুর ফেঁসে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, সবটুকু সত্যের মূল্য বেনিয়া ইংরেজরা দেয় না। রাষ্ট্রের প্রতিভূ না হয়েও নীলকররা যে তাদের জাহাজে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতীককে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে তা আমলে আসে না। মাঝখান থেকে রাজুর বিপদ ঘনিয়ে আসে। তবে এক্ষেত্রে রাজুকে যে জেলে যেতে হয় না এর পেছনে কাজ করে পিয়েত্রোর সেই পুরনো নীরব ভালোবাসা; রাজুর অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে জেলে যায় পিয়েত্রোর দক্ষিণহস্ত বুজরুক আলী। জেলে যাওয়ার পরে কালেক্টরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে বুজরুক চিঠি দেয় সত্য, তবে উদ্দেশ্য কিন্তু আত্মসমর্পণ নয়, জেল থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর যজ্ঞে ব্যাপৃত হওয়া; হলোও তাই। মুক্তিলাভের পর গোবর্ধনসহ গ্রামের কিছু যুবাকে সংগঠিত করে অস্ত্র-চালনা শিক্ষা দেয় বুজরুক আলী; বারাকপুরে সিপাহিরা যেদিন যুদ্ধে নেমে তাদের আজাদি কায়েম করে, সেদিন বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার জন্যে সদলবলে বুজরুকরাও গ্রাম ছেড়ে বারিকপুরের দিকে রওনা হয়। তবে আফসোস, যারা বিদ্রোহে গিয়েছিল, তাদের প্রায় কেউই ফেরে না; প্রায় সবাই নিহত হয়। তো সিপাহি বিদ্রোহে ফরাসি পিয়েত্রো ও রাজু মদদ দিলেও হরদয়ালকে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায় এই বিবেচনায় যে, শুধু ২০০ বছরের পরাধীনতা নয়, তার আগের ৫০০ বছরের ইতিহাসও যে শুধুই যুদ্ধের: জাতিটা কেবল যুদ্ধই করল, কখনো পাঠানের বিরুদ্ধে, কখনো মোগলের, কখনো-বা পাঠানের হয়ে মোগলের বিরুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের শেষ হলো না। এভাবে সব ধ্বংস হলো, কিছু সৃষ্টি হলো না; ফলে হরদয়াল কিছুতে যুদ্ধ চায়নি। অধিকন্তু ইংরেজরা বিতাড়িত হলে বাহাদুর শাহের মতো নপুংসক লোকরা ক্ষমতাসীন হবে, তাতে আখেরে লাভ কী! কেননা রাজা একটা ধারণামাত্র; অনেক মানুষের চিন্তার ধারণা, শক্তির ধারণা; যে নিজেকে বন্দি করতে দেয় সেই বাহাদুর শাহরা তো নকল রাজা, তাদের ক্ষমতায়নে জনতার লাভ কী! চিন্তার এই ভিন্নতা কেবল হরদয়ালকে গভীর করে না, উপন্যাসকেও প্রগাঢ় করে তোলে।
এদিকে ডানকান ও রানীমার মধ্যেকার পুরনো শক্রতা চরমে ওঠে যখন রাজনগরের সীমানাঘেঁষে ডানকানের পাতা রাস্তা রানীমার লোকজন গুঁড়িয়ে দেয়। পরবর্তী-পর্যায়ে এই সংঘাত সংঘর্ষে গড়ালে উভয়পক্ষে কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরিণামে রাজকুমার রাজুকে সেই পর্যন্ত পিয়েত্রোর বাংলোয় গৃহবন্দি থাকতে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইংরেজ কালেক্টর ম্যাকফার্লানের তদন্ত শেষ হচ্ছে। তদন্ত যাতে সপক্ষে আসে সে ব্যবস্থা করে হরদয়াল; কালেক্টরকে বিরাট অঙ্কের (১০ হাজার পাউন্ড) ঘুষ দেওয়া হয়। বস্ত্তত ঢাউস উপন্যাসদ্বয়ে কাহিনির এত ঘাতপ্রতিঘাত ও ডালপালা যে, সংক্ষেপে তুলে ধরা মুশকিল।
উপন্যাসটি সম্পর্কে একধরনের অভিযোগ আছে যে, তিনি নিচু, ভূমিহীন ও সর্বহারাদের সঙ্গে একই সমবেদনার দৃষ্টিতে অভিজাত ও বুর্জোয়াদেরও এঁকেছেন, উচ্চবিত্তকে আলাদাভাবে শোষক ও দুর্নীতিপরায়ণ হিসেবে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতায় বিচার করলে এ-ধরনের অভিযোগের সঙ্গে সহমত পোষণ করা অসম্ভব, বরং এটি নিতান্ত ভাসা-ভাসা ও খন্ডিত ধারণা। কারণ প্রাকনির্ধারিত মতবাদে আটকে থাকলে একজন ঔপন্যাসিকের সকল কাজ পন্ড হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, জীবনের পরিণতির নিকট যেতে হলে বারবার একই ভুল করা তাঁর পোষায় না। তদুপরি কাউকে তিনি রেয়াত দিয়েছেন বলা যাবে না। রাজবাড়ির ভালোমন্দ দুই দিকই তিনি লেখকসুলভ নির্লিপ্তিতে তুলে ধরেছেন। রানীমার কথাই একবার ভাবুন। কোমলে-কঠোরে মেশানো রানীমার চরিত্র; কখনো সে প্রজাপীড়ক, চাইকি হত্যার মদদদাত্রী, আবার কখনো-বা মমতাময়ী, আশ্রয়দাত্রী ও মঙ্গলময়ী; তার স্বভাবে আত্মসম্মানবোধ ও স্বার্থপরতা ঠিক যেন মেঘ আর রৌদ্রের মতো লুকোচুরি খেলে যায়, মোটেই টাইপ চরিত্র নয়। ‘বড়লোকমাত্রে খারাপ’ – নিছক এই ত্বকগভীর ধারণার বশবর্তী হয়ে রানীমার দূরদর্শিতাকে খারিজ করা কি অবুদ্ধিজীবিতার শামিল নয়? স্বামীর মৃত্যুর পর বৈষয়িক সাফল্য অর্জনে রানীমার বিচক্ষণতা উল্লেখ করার মতো; তিনি কেবল শিক্ষিত হরদয়ালকে নায়েব করেননি, পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষিত বাগচীকে ছেলে রাজুর সেক্রেটারি নিযুক্ত করেছিলেন; এমনকি রাজুর জন্য ইংরেজি ভাষা ও আদবকায়দা-জানা কনে পছন্দ করেছিলেন; সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও হৈমী বা নয়নতারাকে নয়, কারণ তারা স্বল্পশিক্ষিত, তারা রাজবাড়িকে প্রভাবিত করতে পারবে না। আবার কিশোর রাজুর বেলায় কী দেখি? রাজু তো কাহিনির প্রারম্ভে নরহত্যা করে বসে। কেবল কি তাই, অন্দরমহলের রগরগে কেচ্ছাও ঠাঁই পেয়েছে উপন্যাসে। রাজুর বাবা অর্থাৎ রাজনগরের রাজা যে ধোয়া তুলসীপাতা নয়, এরও প্রমাণ রয়েছে; উপরন্তু বিধবা ব্রাহ্মণকন্যা, রানীমার সহচরী সুকণ্ঠী গায়িকা কাদম্বিনী একদা রাজার ভ্যোগ্যা হয়ে গর্ভবতী হলে কাহিনির আরেকদফা বিস্তার ঘটে। দ্বিতীয় যুবরাজ কায়েতকুমার তো সেই রক্ষিতারই সন্তান। আবার রাজবাড়ির সমৃদ্ধির পেছনে যে লুটপাটের ইতিহাস বর্তমান – সে-কথাও তুলে ধরতে লেখক ভোলেন না, ‘হয়তো এ-রাজবাড়ির পিতামহ পিতার সময়ে লুটপাট ইত্যাদি অর্থ সংগ্রহের ভিত্তি ছিল। আমার তো মনে হয়, ও জিনিসটার সঞ্চয়ের গোড়ায় লুট, ধ্বংস, নৃশংসতা থাকেই। যদিও এখানকার প্রচুর ধনের কারণ কার্পণ্য।’ এদিকে রানীমার নতুন নায়েবের নিষ্ঠুরতা কখনো-সখনো আরো মারাত্মক; স্বার্থের প্রয়োজনে মাত্র দুই সপ্তাহে পঞ্চাশজনকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছিল। আর পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর সেই অসামান্য পরিণামদর্শিতাকে, ‘ন্যায়-অন্যায়ের তুলনায় রাজ্যচালনা বেশি মূল্যবান। ন্যায়ের চাইতে পলিসি মূল্যবান।’ কী সাংঘাতিক! মানুষ এভাবেই দিনকে দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে আর সমানুপাতিক হারে দানব হয়ে উঠছে বিশ্বায়ন-তত্ত্ব, পার্টির ইশতাহার, চাইকি সংবিধান পর্যন্ত। আসলে উপন্যাস ঠিকই আছে; মূলত সমস্যা তাদের, যারা অবিবেচনাপ্রসূত অভিযোগ করেছে। তাদের চিত্তরঞ্জনের দিকে লেখক চলেননি বলেই এই অভিযোগ। আসল ব্যাপার কী, তারা যে-কিছিমের বাক্সবন্দি কেচ্ছা পছন্দ করেন, রাজনগর আদতে ওই গোত্রভুক্ত নয়। কেননা, এথিকসকে কখনো তিনি সেন্টিমেন্টালাইজ করেননি অর্থাৎ সোশ্যাল এথিকসের সস্তা প্রয়োগ ঘটিয়ে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার সহজ পথকে তিনি পাশ কাটিয়ে গেছেন সজ্ঞানে। বিষয়টি অধিক পরিষ্কার করার স্বার্থে উপস্থিত করা যাক তাঁর বিবিক্তা উপন্যাসের পোস্টমাস্টার পাত্রকে, যার মধ্যে কোরাস হিসেবে লেখককে ঢুকতে হয়েছিল অন্য কোনো কারণে নয়, কনসেনট্রেশন অব দ্য থিমকে সংহত রাখার তাড়নায়, ‘ঔপন্যাসিক আর তার চতুষ্পার্শ্বে যে অসামঞ্জস্য তা দূর করার দিবাস্বপ্নই তো উপন্যাস। প্রথম ঔপন্যাসিক হয়তো এই নিষ্কৃতি আবিষ্কার করেছিল। তারপরে আমরা সকলেই কি তাকে অনুকরণ করে চলছি না? ওতে কি এখন নিবৃত্তি হয়?’ বাস্তবিক অর্থে নতুন ভাবনাটাই এখানে, তাই রাজনগরে কোনো একপেশে প্রতিবেদন পাওয়ার জো নেই। এমনকি বহুল আলোচিত নাটক নীলদর্পণ বা নীলচাষসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ পুস্তকে নীলাক্ত সমাজ যেভাবে বিধৃত, ট্রিলজির দুই পার্টে সেই সরলীকৃত হিসেবের ছিটেফোঁটাও নেই, বরং নীলাক্ত সময়খন্ডের নিরপেক্ষ চিত্রই সেখানে প্রতিফলিত; কাজেই অনেক অবহেলিত সমাজসত্য জানা সম্ভবপর হয়। তখন প্রচলিত মুখরোচক ধোঁয়াশাকে হটিয়ে জানা যায় যে, নীলচাষ কেবল চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস ছিল না, অনেক সময় লাভের আশায় কৃষকরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েও করেছে; আখচাষ তখন তেমন লাভজনক ছিল না, বিদেশি চিনির সঙ্গে দামে কুলিয়ে ওঠা কঠিন হচ্ছিল। আবার সবাই ধান করলে ধানের দামে ধস নামছিল, তাতে লাভ হচ্ছিল সেইসব বাবুর, যারা সস্তায় চাল কিনে খায়। এছাড়া দাদনসম্পর্কিত প্রচল ধারণাও যায় পালটে; দাদন যেমন খারাপ, তেমনি দাদনের ভালো দিকও ছিল, তাতে অন্তত উৎপাদিত ফসলের বিক্রির নিশ্চয়তা থাকে। পাশাপাশি নীলচাষের কুফলের কথাও কম নেই উপন্যাসে; ইন্ডিগো কমিশনের নজরদারির কারণে নীলকররা কৃষকদের সরাসরি শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকলে হবে কী, পরোক্ষ শাস্তি যা দেয়, তাতেই কৃষকদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ডানকানের লাঠিয়ালরা কৃষক অমত্যকে পিঠমোড়া করে বেঁধে আত্মীয়স্বজনদের সামনে ঘুরিয়ে বেইজ্জত করলে একপর্যায়ে অমত্যের মাথা যায় বিগড়ে, অপমানের জ্বালা সইতে না-পেরে অ্যালবেট্রস জাহাজে চড়ে পালিয়ে যায় মরিশাসে। এদিকে ইংরেজরাই যে কেবল নীলচাষ করেছে, তা কেন; বাঙালিরাও নীলকর হয়েছে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা যেমন হয়েছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিহাসবিদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও অমিয়ভূষণকে পারেননি আর পারেননি আরেকজনার চোখকে : তিনি কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ; আট খন্ডে লেখা প্রায় ২০০০ পৃষ্ঠার কাঙালের অপ্রকাশিত দিনলিপির যে দুটি সংক্ষিপ্ত অংশ কলকাতার চতুষ্কোণ পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, সেখানেও একই ইতিহাসসত্য প্রতিধ্বনিত, ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পর্য্যন্ত মহর্ষি নাম গ্রহণ করেন নাই, সে পর্য্যন্ত প্রজাগণ তাঁহাকে দুঃখ নিবেদন করিয়া কিছু ফল পাইয়াছিল, কিন্তু তিনি মহর্ষি নাম পরিগ্রহ করিলে তাহার পর প্রজার হাহাকার তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায় নাহ।’ এ-কথা অনস্বীকার্য যে, যেদিন থেকে সংবাদপত্রে রাজনীতি প্রাধান্য পেতে থাকে, সেদিন থেকেই সংস্কৃতি গৌণ হতে শুরু করে; সে-বিচারে উনিশ শতককে বোঝার ক্ষেত্রে কাঙালের অপ্রকাশিত দিনলিপিও মূল্যবান মনে করি।
এই ফাঁকতালে একটি দুটি কথা; সংবাদভাষ্যের উপরিতলে আটকে যাওয়াটা যেহেতু উপন্যাসের স্বভাব নয় এবং যেহেতু মানুষের মনের তলার মনের বা অবচেতনের খবর নেওয়াটা উপন্যাসের কলা-নির্ধারিত এখতিয়ার, তাই সাংবাদিকের চেয়ে ঔপন্যাসিকের দায় অনেক বেশি; যে-কারণে নীলচাষের ইতিবৃত্ত রাজনগর কী নয়নতারার কোথাও দগদগে করে চিত্রিত হয়নি। এখন স্বাভাবিকভাবে কৌতূহল জাগতে পারে, লেখক এই জরুরি নির্মোহ জাতিনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আত্মস্থ করলেন কী করে? উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে তাঁর শৈশবে; আসল ঘটনা কী, ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে একবার কলকাতা ট্রপিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি হলে ইংরেজ ডাক্তার ও নার্সের অকৃপণ সেবাযত্নে সেরে ওঠার পর বালক অমিয়ভূষণের মনে যে নতুন ভাবান্তর হয় সেখান থেকে তিনি আর সরেননি। আজীবন লালন করেছেন এই ধারণাকে, ‘ইংরেজরাও আমাদের মতোই মানুষ। পাঞ্জাও লড়া যায়, ভালোবাসাও যায়। রাক্ষসও নয়, দেবতাও নয়…।’ অধিকন্তু আউটসাইডারসুলভ মনোভঙ্গি তাঁর জীবনাচরণেও প্রতিবিম্বিত, ‘আমি মদ ছুঁই না। মদকে ঘৃণাও করি না। আমার স্মৃতিতে পিতামহ এবং হুইস্কি এবং পোর্ট অবিচ্ছেদ্য। আমি রেডিও, মাইক, স্লোগান ও মদ থেকে দূরে দূরে থাকি, কারণ মস্তিষ্কের ভিতরে যে মদ ক্ষরিত হচ্ছে তাই আমাকে যথেষ্ট নাশ্শায় রেখেছে।’
তবে এর মানে এটা নয় যে, ইংরেজদেরকে তিনি ছাড় দিয়েছেন। উপনিবেশবাদের নানা তল তিনি উন্মোচন করেছেন পরতে-পরতে। অধুনাকালে মনে করা হচ্ছিল যে, উপনিবেশবাদ উঠে যাবে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। লুটপাট ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে উপনিবেশবাদ আজও মহাসর্বনাশা এবং বহুরূপী; অনেকক্ষেত্রে এটির পুনর্জন্মও ঘটেছে। আগে পশ্চিমা শক্তিধররা নিজ নিজ সাম্রাজ্যবিস্তার ও সম্পদ-আহরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকলেও এখন তাদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে; এখন তারা সব একাট্টা ‘দি ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি’র ব্যানারে। পরাধীন ভারতের দুর্ভাগ্যকে তিনি ভাষায়িত করেছেন ব্যতিক্রমী ব্যঞ্জনায়। ভারতবর্ষে প্রায় সবরকম বর্ণের মানুষ থাকার যে নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অমিয়ভূষণ দিয়েছেন তা কেবল চমকপ্রদই নয়, অকাট্যও বটে; বিভিন্ন দেহবর্ণের হেতু যে ধারাবাহিক বহিরাগত শাসনের স্মারকচিহ্ন – একথা বলার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের প্রায় হাজার বছরের নিদারুণ বঞ্চনার ইতিহাসই ফুটে ওঠে। একের পর এক বিদেশিরা এসেছে, ছাপ রেখে গেছে গাত্রবর্ণে; ইংরেজরাও তাই, ছাপ রেখে গেছে গাত্রবর্ণে। তবে তাদের মধ্যে ইংরেজরা এককাঠি সরেস, সাতিশয় শয়তান। নেটিভদের প্রতি তো বটেই, এদেশের যারা ইংরেজ-রক্তে সংশ্লিষ্ট তাদেরকেও ইংরেজরা স্বীকৃতি দিতে চায় না। ফলে ফিরিঙ্গি ইংরেজরাও হয়ে পড়ে না-ঘারকা, না-ঘাটকা; না-ভারতের সরকার, না-ইংল্যান্ডের সরকার তাদের মেনে নিতে চায়। এমনকি মিশ্ররক্তের ১০ হাজার অফিসার ও জওয়ান একপর্যায়ে ছাঁটাই হতে বসেছিল সমঅধিকার চাওয়ায়। সমস্যার জট বিস্তৃত হয় ব্যক্তিক স্তরেও; মিশ্ররক্তের ওসুলিভান ভারতীয় মায়ের ওপর অবিশ্বাস ও ঘৃণা থেকে তো এখন মেরি মাতাকেই অবিশ্বাস করে, ফলশ্রুতিতে স্কুলের মাস্টারির চাকরি হারিয়ে ফেরিওয়ালা সাজতে হয়। হ্যাঁ, ইংরেজদের অধীনে নেটিভরা যে ধনবান হতে পারে না, বড়জোর নিম্নমধ্যবিত্ত কী মধ্যবিত্তের পর্যায়ে উঠতে পারে – এসবও জানা যায় উপন্যাসধৃত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ঘেঁটে। তখনকার বাবুকালচারের নানামুখী বৈপরীত্যও নেহাত কম সুস্পষ্ট হয়নি; একদল যখন মদ খেতে না-শেখায় পুত্রস্থানীয়দের কী করে ভদ্রসমাজে পরিচিত করবেন ভেবে চিন্তিত, অন্য দল তখন মদ্যপান নিবারণের উপায় সম্বন্ধে ভাবছে। আরো কৌতুকের যে, নাটকে মদ ও ভ্রষ্টাদের সমালোচনা করা হলেও নাটকের লেখক ও পৃষ্ঠপোষকরাই ব্যক্তিগত জীবনে মদ ও নষ্টাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উপমহাদেশের চালচিত্রের ফাঁকে-ফাঁকে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক পটভূমিকাও দরকারমতো বইয়ে হাজির; তৎকালে ইংরেজ ও ফরাসিরা ছিল জাতশত্রু যার প্রভাব পড়ে উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও; পলাশীর যুদ্ধ বলো কী সিপাহি বিদ্রোহ বলো – সবখানে ফরাসিদের দেখা যায় ভারতীয়দের পাশে। যে-কারণে বুজরুক আলীর বন্দুক কেনার টাকা জোগান দেয় ফরাসি পিয়েত্রো, এমনকি নীলকর ডানকান ও রানীমার ফ্যাসাদে সর্বদাই পিয়েত্রোর ভূমিকা রানীমার সপক্ষে। হয়তো পিয়েত্রোর কথা আলাদা, তবে বোঝা যায় দুই জন্মশত্রুর বিরোধের মূলে কাজ করে অন্যকিছু নয়, স্রেফ উপনিবেশবাদী স্বার্থ। তবে একালের উপ্যাখ্যান হলে যে পিয়েত্রো ও ডানকানদের সম্পর্কসূত্র অন্যরকম হতো, তা লেখাই বাহুল্য; রক্তাক্ত ইরাক, লিবিয়া, আফগানস্তানসহ অনেক দেশ আজ তেমন কথাই বলে। সত্যি, উপনিবেশবাদ এক অনন্তযৌবনা দুগ্ধবতী গাভী বটে; ছড়াকার নাসের মাহমুদের একটি সৃষ্টিসফল ব্যঙ্গাত্মক ছড়াকে অনুকরণ করে সামান্য রদবদলপূর্বক তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘লাড়ে লাপ্পা লাড়ে লাড়ে, কেয়্যা মজাদার বারে বারে…’
এবার ফেরা যাক উপন্যাসের মূল থিমে, অমিয়ভূষণের ভাষায় যা চোখের নিচে ফুটে ওঠে। যদি বলা যায় গ্রন্থধৃত বহুরৈখিক প্রেমই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় থিম তাহলে বোধকরি ভুল হবে না। প্রেম এখানে কেবল দহনক্রিয়া নয়, আলোও বটে; আরো নির্দিষ্ট করে বললে তা কনেদেখার মতোই এক রুচিস্নিগ্ধ আলোর ঝলক। এ যেন পশুবৃত্তিকে অতিক্রম করে মানুষের মানুষ হওয়ার চেষ্টা, তাঁর অনুভবে যা এমনতরো, ‘মদ আর ভাত কি এক? আলো আর আগুন কি এক? তেমন প্রেম এবং sex এক নয়।… দুটো শরীর দগ্ধ হয়, তার ফলে উত্তাপ আর অঙ্গার ছাড়া যদি ক্ষণিক আলো জ্বলে তবে তাইতো প্রেম, আর তা নিয়েই কাব্য।’ হাফিজ যেমন প্রেয়সীর গালের কণাপ্রমাণ তিলের জন্যে তৈমুরের রাজধানী বোখরা ও উপরাজধানী সমরখন্দ বিকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বুঝতে পারি, অমিয়ভূষণসহ তাবৎ মহাজন লেখকের পক্ষপাত সেই মোহনিয়া বিপর্যয়েরই পানে। ফলে এখানকার হৃদয়সমীকরণ বহুদিকে বহুভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; একদিকে চতুর্দশীর সৌরভময় প্রেমকাহিনিখ্যাত রানীমা ও পিয়েত্রোর মৌনী অথচ গভীর থেকে গভীরতর ভালোবাসা, অন্যপ্রান্তে রাজকুমার বনাম তিনজন রমণীর হৃদয়ালেখ্য। গুরুত্বের বিবেচনায় চতুর্দশীর সৌরভমন্ডিত প্রগাঢ় প্রেমকাহিনির আলোচনা বরং পরে করলে ভালো; তার আগে আস্বাদ নেওয়া যাক রাজকুমার রাজু ও তিন রমণীর হৃদয়ঘটিত আখ্যানের। রাজুর জীবনে তিন তিনজন নারীর আগমন ঘটলেও নয়নতারার প্রভাব সর্বাধিক। পন্ডিত ন্যায়রত্নের বোন কবিরাজ নয়নতারা যে কেবল রাজকুমারের সুপ্ত মননকে জাগিয়ে তোলে তা নয়, উপন্যাসের একদম শেষে এসেও নয়নতারার আবশ্যকতা সমান বহাল থাকে। রানীমা মানস-সরোবরের দিকে মহাপ্রস্থান করার পর রাজকুমারও যখন প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে একই বিপজ্জনক পথের অভিযাত্রী হতে চায়, তখন রাজুকে কিন্তু নিবৃত্ত করে ওই নয়নতারাই; তবে স্বনামে নয়, শেঠানীর ছদ্মবেশে। লিও টলস্টয় যেমতে আন্না কারেনিনা চরিত্রকে তিল-তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, অমিয়ভূষণও নয়নতারাকে এঁকেছেন সমধর্মা দ্যোতনায়। দ্বিতীয় নারী ক্যাথারিন কেটও একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। বিশেষ করে কেট ও রাজু যখন একসঙ্গে পুরনো রাজবাড়ি বা গড় দেখতে রওনা হয়, তখন কেটকে আর বাগচীর স্ত্রী মনে হয় না, কেট যেন অতিদ্রুত রাজুর প্রেমিকাস্থানীয়া হয়ে ওঠে। যাত্রাপথে দুজনার ভাবভঙ্গিতে পরস্পরের প্রতি এমন অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ লতিয়ে ওঠে যে, যার অপর নাম হতে পারে যৌনতা। একই ব্যাপার দেখি, নয়নতারা যখন মেয়েলি ছল খাটিয়ে রাজুর হাতিতে চেপে বসে; ঘন বনের মধ্যে হাতি থামার পর নয়নতারা হাতের ইশারায় মাহুতকে সরিয়ে দিয়ে যে-চপলতায় নিজ হাতে রাজুর মুখে খাবার তুলে দেয় সেখানেও থাকে উপচানো আকর্ষণ অথচ সংযমের ছিলা একাধিকবার হুমকির মুখে পড়েও ছিঁড়ে যায় না, স্থিতিস্থাপকতা অটুট থাকে। সংযমের এই স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে খেলতে বোধকরি অমিয়ভূষণ ভালোবাসেন। কারণ তাঁর অনেক রচনাতে এই কানামাছি খেলার ঝিলিক লক্ষ করা যায়। তাঁর বিরাটকায় উপন্যাস তাসিলার মেয়রের কথাই ধরুন; তাসিলা ফরেস্ট ডিভিশনের ডিএফও বলিন বসু তার অপরূপা স্ত্রী রিনি বসুকে মেয়রের বাংলোয় রেখে নুমপাই ফরেস্টরেঞ্জ আবিষ্কারে যাওয়ার পর একরাতে হয় কী, একাকিনী রিনি বসুর ইশারা মোতাবেক তরুণ দীর্ঘকায় মেয়র যখন বসের সুন্দরী স্ত্রীর গেলাসে মদ ঢেলে দিতে থাকে এবং যখন একটুখানি মদ মেয়রের মুখে তুলে দিতে স্বচ্ছ গাউনপরা স্খলিতচরণা বেহেড রিনি বসু এগিয়ে আসতে গিয়ে টালমাটাল হয়ে মেয়রের গায়ে ঢলে পড়ে, তখন সেই হিরণ্ময় যৌনতাই জেগে ওঠে পলকে। কিংবা ধরা যাক তাঁর রাভা আদিবাসীদের ওপর রচিত উপন্যাস বিনদনির কথা; রাভা আদিবাসীদের মিথ এই, সম্পত্তি রক্ষার্থে শাশুড়ি চাইলে মৃত মেয়ের স্বামী অর্থাৎ জামাইকে বিয়ে করতে পারে। মিথের এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে শ্বশুরবাড়িতে দীর্ঘকাল বাদে-ফেরা জামাই জনাদন শাশুড়ির জমিজমা আধিয়ার বোজোর হাত থেকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা না-পেয়ে একরাত্রিতে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধমাত্র যখন নিজস্ব ভাষায় বলে, ‘তো শোনেন, আজ থাকি আমি শোং তোমার মরৎ’ এবং যখন দরজায় পিঠ রেখে দাঁড়ানো জনাদনকে শাশুড়ি আর ছেলেমানুষ ভাবতে পারে না, তখন সেই ট্রেডমার্ক লুকোচুরি খেলার মোহন প্রভাই ঝিলমিলিয়ে ওঠে। কিন্তু না, মেঘে-ঢাকা চাঁদের মতো ওই অপ্রতিরোধ্য যৌনতা বারংবার উঁকি দিলে হবে কী, শেষমেশ স্নায়ুক্ষরা সংযমের জয় হয়। তখন লিও টলস্টয়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ফাদার সিয়ের্গি’র প্রসঙ্গকথা অনিবার্যভাবে চলে আসে; পাশের ঘরে আশ্রয়-নেওয়া স্বাস্থ্যবতী ফাজিল মেয়েটি যখন নানানভাবে প্রলুব্ধ করে ফাদার সিয়ের্গির অগ্নিপরীক্ষা নিতে থাকে এবং যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে ফাদার সিয়ের্গিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে স্বীয় আঙুল কর্তনপূর্বক চূড়ান্ত বিচারে উত্তীর্ণ হতে হয়, তখন কি যৌনাকর্ষণের চিরায়ত স্নায়ুপীড়নকারী আবহের সৃষ্টি হয় না? এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সাপ হয়ে অমিয়ভূষণ বারবার যৌনগন্ধী খেলা খেলেনই-বা কেন, আবার ওঝা সেজে কামতপ্তবিষ নামাতেই-বা যান কেন? এর উত্তর খুঁজতে হলে তাসিলার মেয়রের তাসিলা ফরেস্ট ডিভিশনের ডিএফও বলিন বসুর লাস্যময়ী স্ত্রী রিনি বসুর লেখা একটি চিঠির শরণ নেওয়া ভালো : চিঠিপাঠে আমরা জানতে পারি – স্ত্রীলোকদের মনের মধ্যে চকোলেট রঙের কী কালো রঙের একটা স্পট থাকে, যা দারুণ অভিকর্ষে পুরুষকে আত্মস্থ করে। রিনি বসুর চিঠির ভাষ্যমতে, ‘প্রেমের কবিতা, ঘরভাঙা, অসাধ্যপটীয়সিতা, সবই সেই কালো স্পটের ষড়যন্ত্র।’ তবে ষড়যন্ত্রই শেষ কথা নয়, অপর পৃষ্ঠেও কিছু বাক্য থেকে যায়; সৃষ্টির স্বার্থে সংযতকরণের কিছু সঞ্জীবনী মন্ত্রেরও দরকার হয়। আর এতে আখেরে উপকৃত হয় পাত্রপাত্রীরা, তারা লাভ করে দীর্ঘ পরমায়ু। কেননা, এর অন্যথা হলে বিপর্যয় অবধারিত; যৌনবিষয় অহেতুক মুখ্য হয়ে উঠলে ক্যাথারিন কেট কী নয়নতারা কিংবা রিনি বসু বা শাশুড়ি বিনদনিরা বিদেহ হয়ে পড়ত, রক্ত-মাংসের স্ত্রীলোক না-হয়ে বরণ করে নিত নেহাত ডামির দুর্ভাগ্য। অমিয়ভূষণের প্রবন্ধ মারফত আমরা জানি যে, শায়িত নারীরা কামকলায় যত পটীয়সী হোক না কেন, উপন্যাসের বাস্তব বিশ্বাস উৎপাদনে তারা অসমর্থ। তবে এমনটি মনে করার কারণ নেই যে, যৌনতার ক্ষেত্রে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত লেখক ছিলেন। একবার খেয়াল করুন তাঁর হলং মানসাই উপকথা উপন্যাসটির কথা; খুনের মামলার দন্ডিত আসামি গাজেন ঢালি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে ফিরে এসে আরো যথেচ্ছচারী হয়ে উঠলে তাকে ঘায়েল করে উঠতি যুবক ফালটু ও চন্দানি বনে পালিয়ে গিয়ে বনের কুঁড়েঘরের আলাদা চাটাইয়ে বসবাস করতে-করতে একপর্যায়ে চন্দানি যখন সরে এসে ফালটুর চাটাইয়ের ওপর যেয়ে ফালটুর গায়ে হাত রেখে বলে, ‘তুমি এমন ছোট থাকবা কেন্? আমার গায়ে হাত দেও… পারছোই তো। কাডে বউ বলে লিখাতে হইছে’, তখন তাঁকে শুচিবায়ুগ্রস্ত লেখক বলা ভীষণরকম অন্যায়। তাঁর ‘তাঁতী বউ’ গল্পটি তো রীতিমতো এক দুঃসাহসিক আখ্যান যেখানে যৌবনসমীকরণের সমস্ত ব্যাপ্তি তছনছ হয়ে গেছে, অথচ তারপরও পঙ্কিলতা ছাপিয়ে তাঁতীবউয়ের পতিভালোবাসা জেগে উঠেছে লাল পদ্মের মতো। যথার্থত যতক্ষণ পর্যন্ত নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের আলো প্রজ্বলিত থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনিও উদারহস্ত; পাপপুণ্যের অনেক তথাকথিত ধারণাকে তিনি ভেঙে দিয়েছেন কলমের এক তুড়িতে, ‘১. সে জানে পুরুষের কামনা কখনও কখনও একটা কোমল প্রার্থনার মতো। সুকুমার সুবেশ রাজকুমারের যদি তেমন নিঃশব্দ অনুরোধ – পরিচারিকা হাঁপাতে লাগল। আ, ছি, ছি-ছি, না… ২. কিন্তু নয়নতারা শয্যায় এল। বলল,‘বা, আমাকে বুঝি দেখবে না?’ শেজের আলোয় নয়নতারা ঝিকমিক করে হাসল।… ৩. মোতিদির গড়নের সৌন্দর্য ফুটে আছে। হৈমন্তী অস্বীকার করবে কি করে মোতিদির সেই সোনালি রঙের শরীর সে উপাসনার দৃষ্টিতে দেখেছিল (বিবিক্তা)।… ৪. দুই সুন্দর তরুণ নারীদেহ যেন দুটি আলোর মতো, দুটি নদীর সঙ্গমের মতো মিলিত হতে থাকে। এই সমকামী প্রেম যেন বিবিক্তার ওষুধ হতে পারে (বিবিক্তা)।’ তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে – পুরুষটি যতবেলা ইভের এ্যাডাম, ততবেলা সম্পর্কের সুতো ছাড়তে তিনি যাকে বলে অমায়িক নাম্বার ওয়ান অর্থাৎ এই ফাঁকে তোমরা যা কিছু করো না বাপু, বাধা দিতে আমার বয়েই গেছে। হ্যাঁ, তোমাদের ইন্দ্রিয়উদ্দীপনা দেখে চোখ টাটানোর মতো জেলাস আমি মোটেই নই। জেলাসি থাকলে কি সিস্টার নেলি হাসপাতাল ত্যাগের সময় ঢ্যাঙা সুকুমারের জুতোর ওপর দাঁড়িয়ে, তার কোমর জড়িয়ে ধরে, তার ঠোঁটদুটোকে নিজের আপেলগন্ধী দুঠোঁটে পাক্কা এক মিনিটের জন্য ধরে ফেলতে পারে? পারত না। তবে পুরুষসঙ্গীটি যদি ইভের অ্যাডাম হওয়ার পরিবর্তে ইভটিজার হয়ে ওঠে, তাহলেই তিনি কৃপাণহস্ত। তখন তুমি যে-ই হও না কেন, এমনকি তুমি যদি বিপ্লবের নাম করেও তিববতী রমণীকে ধর্ষণ কর, তাহলে তোমাকে ধর্ষক নামেই ডাকা হবে, কমিউনিস্ট হিসেবে নয় ( দ্রষ্টব্য : সাইমিয়া ক্যাসিয়া)। প্রসঙ্গক্রমে কথাশিল্পী হেনরি মিলারের আলাপচারিতা মনে পড়ে, যেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘কোনো রাখঢাক না করেই আমি বলতে পারি, যে-কোনো জীবিত লেখকের চেয়ে আমি নিজেকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেশি যোগ্য মনে করি। কেন? কারণ আমি অনেক প্রথা ভেঙেছি, আমি নির্ভীক, আমার লেখাও সাহসী, তা বহু পাঠককে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে… (অনুবাদ : খোরশেদ আলম)।’ সাহিত্যিক হিসেবে অমিয়ভূষণও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকেননি, তাঁর উচ্চারণ বরং আরো গভীরতাব্যঞ্জক, ‘কারণ যে কোনো একটি মুহূর্তে সমাজ তৎকালে কতগুলো প্রতিষ্ঠিত ভ্যালুর সমষ্টিমাত্র। লেখক সেই ভ্যালুজকেই বদলাতে চাইবেন। নইলে তিনি লেখক কেন? লেখক যদি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চান, তবে তো সেই সময়ের status quo-র কাছেই দায়বদ্ধ থাকবেন…’। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি কথা টানলে কথা; ইত্যবসরে মসলিনের আলোচনাই-বা বাদ থাকবে কেন? মসলিন শাড়ির কিংবদন্তিতুল্য সুখ্যাতির পেছনে এর আশ্চর্য গঠনশৈলী কি শেষকথা? রাজনগর কী নয়নতারা পড়তে-পড়তে নতুন ভাবনাও যে ঘাই মারে মাথায়। যে মসলিন শাড়ি ওজনে একখানা রেশমি রুমালের সমান এবং ভাঁজ খোলার পর যে-শাড়ি অদৃশ্যপ্রায় হয়ে পড়ে, সেখানে কি ধনবতী নারীদের দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে না? তাহলে তো হরেদরে সে-কথা, মসলিনের ভুবনজোড়া জনপ্রিয়তার মূলে যৌনচেতনাও একটি ফ্যাক্টর বটে। পক্ষে একাধিক প্রমাণ এই, তৎকালে নবাবের নাচওয়ালিদের পরিধেয় পেশোয়াজকে স্বচ্ছপ্রায় করে তুলতে যে মসলিনই ছিল শেষ ভরসা; তখন নাচে মশগুল ডানকানের উপলব্ধির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন, ‘এই ভারতবর্ষ। এলাচ লবঙ্গর দেশ, মসলিন ও সোনার দেশ, এই নাচের দেশ।… এই সোনার দেশে সবই প্রখর। প্রখর এর আকাশ, প্রখরা এর নারী। … মখমলের মতো মসৃণ উষ্ণস্পর্শ বলে আশা হয়। রানীর কণ্ঠের মালায় স্থান পাবার মতো ক্যাট্সআই পাথরে তৈরি চোখ, কী নরম, কী ভাস্বর সেই দৃষ্টি। কী অপূর্ব প্রাণনা, কী সর্বগ্রাসী নিথরা নেশা।’ মসলিনের কামচেতনা অস্বীকার করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে যখন আমরা তাঁর বিবিক্তা উপন্যাসে ঢুকে পড়ি; অনেকদিন আগে অাঁকা নুড ছবির ধুলো অাঁচল দিয়ে ঝাড়তে গিয়ে শৌখিন চিত্রকর হৈমন্তীর যেই অন্যমনস্কতা কেটে যায়, তখন সে বুঝতে পারে, ‘ছবিটা ঠিক নুড নয়, শায়িতা এক মহিলার যার পরনে মসলিন।’ এরূপে যৌনচেতনা ও নারীভাবনা যেন পরস্পরের সহোদরা যদি মাঝখানে মসলিন রাখা যায়। তো রাজকুমারের শেষ নারীর নাম হৈমী; হৈমী রাজুর দূরসম্পর্কিত মামাতো বোন। হৈমী বাল্যবিধবা, তার ইংরেজ কী আইরিশ স্বামী দানাপুরের কাছে কানোয়ার সিংকে রুখতে গিয়ে নিহত হয়। রাজনগর উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে এই হৈমীকে আবার রাজকুমারের সঙ্গে ট্রেনে করে রাজনগরের দিকে ফিরতে দেখা যায়। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ না-হয়েও তারা একতালে চলতে থাকে। তিন রমণীর মধ্যে নয়নতারা বা কেট যতখানি দীপ্তিমতী, হৈমী ঠিক ততটা নয়; তবে শেষ খন্ড লিখিত হলে তাদের অবস্থানগত ক্রমবিন্যাস কী দাঁড়াত বলা শক্ত; অনাগত কালেও পাঠককে তা ভাবাবে বইকি।
তিন স্ত্রীলোকের শ্রেষ্ঠত্বের দৌড় নিয়ে যত প্রশ্ন থাক, পিয়েত্রো ও রানীমার অনুরাগরঞ্জিত প্রেমগাথায় রানীমার appeal কিন্তু অবিসংবাদিত। রক্তের সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে যাওয়ায় চতুর্দশী রানীমা ও পূর্ণবয়স্ক যুবক পিয়েত্রোর বিয়ে বানচাল হয় বটে, কিন্তু তাদের আবাল্য ভালোবাসা ফিকে হয়নি কখনো; উপরন্তু সময়ের পথপরিক্রমায় তা আরো খাঁটি হয়ে ওঠে। এমনকি পিয়েত্রোর মৃত্যুর পরে তো রানীমার হৃদয়াবেগে রীতিমতো দার্শনিকতার ছোঁয়া লাগে। অখাদ্য-খাওয়া অনাচারী সেই আধা-ফরাসি পিয়েত্রোর অবর্তমানে তার হাওয়াঘরের মেঝেতে রানীমার ইচ্ছায় মন্দির নির্মিত হলে হয় কী, রানীমা শিবলিঙ্গের চন্দনে বুকের অনেকটা কেটে রক্ত লাগিয়ে দেন। ব্যাপারখানি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব; বুকের এই ফোঁটা-ফোঁটা রক্তকে যদি নারীর ঋতুস্রাবের রজঃকল্পনা করা যায়, তাহলে লিঙ্গের উপাসনা কি আরো বাস্তব হয়ে ওঠে না? যোজন দূরত্ব সত্ত্বেও দুজনার দেহমন কি একাকার হয়ে যায় না? আবার এই চিন্তাস্রোতকে আরো একধাপ প্রসারিত করার অবকাশ আছে। রানীমার বুক-চেরা রক্তকে যদি মাতৃযোনির রক্তের মর্যাদা দেওয়া যায়, তাহলে চাঁপার চেয়েও সৌরভময় ভালোবাসা অপার্থিবতায় উত্তীর্ণ হতে বাধ্য। শুধু কি তাই, উপন্যাসের শেষাংশ যে এর অধিকতর প্রমাণ; জমিদারবৃত্তি এবং ঘরসংসার ছেড়ে জীবনের শেষ কটি বছর রানীমা হিমালয়ের পাদদেশে একাকী ঘুরে-ঘুরে কাটাচ্ছিলেন, কারণ ততদিনে রানীমার অন্তরে গিরিবর হিমালয় ও মৃত পিয়েত্রো এক এবং অভিন্ন হয়ে গেছে; হিমালয় যেন আর কিছু নয়, পিয়েত্রোরই প্রতীক অর্থাৎ রানীমার ভালোবাসা তখন ওই স্তরে দাঁড়িয়ে গেছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, হৃদয়াসনে বসিয়েও যাকে ভালোবাসা দিতে পারেননি, সেই পিয়েত্রোকে রানীমা ভালোবাসা জানাচ্ছেন হিমালয়ের নৈকট্যে এসে। তখন ভালোবাসা বিষয়ে হেনরি মিলারের ভাবনাগুচ্ছ আপনাআপনি মনে পড়ে, ‘আপনি যখন সম্পর্ককে তার সামগ্রিকতায় চিন্তা করবেন তখন যৌনতাকে বালতিতে এক ফোঁটা পানির সমতুল্য মনে হবে। জগতের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার সম্পর্কগুলো ছিল যৌনতারহিত (অনুবাদ আলম খোরশেদ)।’ উপন্যাসের পরিশেষে এসে তো পাঠক আরেক ধাপ চমকে ওঠে। রানীমা যখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তিববতের মানস-সরোবরের অভিমুখে একলা হেঁটে যাচ্ছেন তখন বোঝাই যাচ্ছে, তিনি আর ফিরবেন না। এক সুইসাইডাল যাত্রাপথে ততদিন একটানা হাঁটতে থাকবেন যতদিন পর্যন্ত না-তিনি নিঃসাড় হয়ে লুটিয়ে পড়ছেন পথের ধারে। অগস্ত্যযাত্রা আরকি! একঅর্থে যা লাইফ এবং লাইফের পরিণতি, অন্য অর্থে তা ইস্থেটিক ডিলাইট এবং লাভ। লেখকের জবানে তা আরো বিশদ জানতে পারি, ‘ওখানে এই জিনিসটা বলা আছে – আমরা যাকে রেনেসাঁস বলেছি, কালচারাল রিভাইভাল বলেছি, এই যে আমাদের হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের উপর দিয়ে ঊনবিংশ শতকে যেসব পরিবর্তনগুলো হয়েছিল, যা নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেখানে আমি দেখাতে চেয়েছি যে এর মধ্যেও সৌন্দর্য, রূপবোধ এবং জীবন ভালোবাসা – এগুলো এত মহার্ঘ যে বিভিন্ন সময়ের মধ্য দিয়েও ফুটে ওঠে।’
রাজনগর উপন্যাসের অন্যতম বড় সম্পদ এর প্রধানচরিত্রসমূহের অতলস্পর্শ গভীরতা; রানীমা বাদেও রাজু-নয়নতারা-হরদয়াল-বাগচী-কেট কিংবা পিয়েত্রোর চরিত্রচিত্রণে অমিয়ভূষণের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কোনো পূর্বনির্ধারিত ফর্মুলায় কাউকে অাঁকা হয়নি। প্রায় প্রতিটি চরিত্রের প্রগাঢ় অনুভবের বিভায় আলোচ্য বইদুটি ঋদ্ধ। সে-কারণে নয়নতারার শেষ অঙ্কে পিয়েত্রো মারা গেলে হবে কী, পুরো রাজনগরজুড়ে কায়াহীন পিয়েত্রোর জোরালো প্রভাব বিদ্যমান থাকে। এদিকে উপন্যাসের একটা বিরাট অংশব্যাপী যে খ্রিষ্টধর্মচিন্তার বিস্তার ঘটেছে, তা আবার অ্যান্ড্রুজ বাগচী, ক্যাথারিন কেট ও অংশত হরদয়ালকে ঘিরে আবর্তিত। ইউনিটেরিয়ান মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পর খ্রিষ্টসমাজ কর্তৃক বাগচীদম্পতি কেবল একঘরে হয় না, পদে-পদে ডানকান-কীবলদের গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে। তাদের অপরাধ এই, ইউনিটেরিয়ানদের ধর্মীয় বিশ্বাসমতে যিশুর অবস্থান বেশ ভিন্ন; তারা ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্টদের ন্যায় জিসাসকে ঈশ্বরপুত্র মনে করে না, তাদের বিবেচনায় জিসাস মানবপুত্র এবং সর্বোপরি সর্বোত্তম মানুষ। সন্দেহ নেই, এ-কারণে লেখক যতটা না ডানকান ও কীবলদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ছেড়েছেন বাগচী এবং কেটকে। ইউনিটেরিয়ানদের মতবাদ অনেক বেশি মানবতাবাদী এই যুক্তিতে যে, তারা জিসাসকে মানুষের মর্যাদায় দেখতে চেয়েছেন, ঈশ্বরের আত্মজরূপে নয়; অর্থাৎ মানুষের পক্ষেও ক্রাইস্ট হওয়া সম্ভব, যার অর্থ মানুষ তার penal code-এর চাইতে বড়। লেখকের বিবেচনায় এটা একটা প্রচন্ড বিদ্রোহ। বোঝা যাচ্ছে বিদ্রোহ নানামাত্রিক হতে পারে; আর যা বোঝা যায় – জাত লেখকরা কখনো উচ্চকণ্ঠ নয়, বরং অন্তঃসলিলার মতো বিদ্রোহের যে-ফল্গুধারা মানুষের তলদেশে প্রবহমান, সেটিই থাকে তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ যে-কোনো কুইক রিমেডি সম্বন্ধে তাঁরা সদাসজাগ। ফলে অমিয়ভূষণের বেলায়ও যে ব্যাপারটি উপর্যুপরি ঘটবে, এতে আর আশ্চর্য কি! লেখকের বক্তব্য টেনে এটি আরো খোলাসা করলে দোষ কি, ‘আমি লিখি তার অর্থ এই নয় যে আমার সাবকনসাস আমাকে লেখায়। I’am forced to dream. I consciously create dreams – সেটাই আর্ট…।’ মধু সাধুখাঁ উপন্যাসের শুরুতে লেখক যখন বলেন, ‘মৃদু সা সাতিশয় হারামজাদা ছিল – সন্দেহ কি?’ তখন আমাদের বুঝতে দেরি হয় না যে, মধু সাধুখাঁ হচ্ছে সেই ধরনের ইমমরালিস্ট যার পক্ষপাত মানুষের প্রতি, অন্য কিছুর দিকে নয়। আবার তাঁর মতি ঘোষ পার্ক ভানু গুপ্ত লেন উপন্যাসের শেষদিকে মধুরা যখন তার ছেলে বিমানের সঙ্গে বাড়ির সাধারণ কর্মচারী সুমিতার বাগদান ঘোষণা করে, তখন লেখক বিমানকে সেরা বিপ্লবীর মর্যাদা দেন; কারণ এতে সমাজের শ্রেণিবিন্যাস কাঠামো অন্তত একবারের জন্যে হলেও ভেঙে পড়ে। এভাবে বাগচী, বিমান, বিনদনির জনাদন, মধু সাধুখাঁ, বিশ্ব মিত্তিরের পৃথিবীর তরু এবং লেখক আর আলাদা থাকেন না, বরং তখন সবাই একচিত্ত বা সহোদর। সিনেমাটিক কায়দায় নায়কের তলোয়ারের এককোপে ভিলেনের মুন্ড নামিয়ে যারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, তারা আর যা-ই হোক সাহিত্যরাজ্যের পাহারাদার নয়, তারা বড়জোর সাহিত্যের জামাইবাবু। আসলে সাহিত্যের রুচিবোধই একজন রূপকারকে মানবতাবাদী, ইমমরালিস্ট ও অধার্মিক করে। মরালিটিসংশ্লিষ্ট তাঁর ভাষ্যটি আপন প্রয়োজনে ঝালিয়ে নেওয়া যাক, ‘মরালিটি মূলত কাল্পনিক নৈরাজ্যের ভয়ে সৃষ্টি, ক্ষমতাচ্যুতি না ঘটে তার সেফগাড…’
এদিকে ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসের মূলে খ্রিষ্টধর্মের যেহেতু বিশাল অবদান আছে, তাই ইংরেজদের পূর্বপ্রেক্ষাপট বোঝার স্বার্থে লেখক খ্রিষ্টীয় ধর্মচিন্তাকে উপন্যাসে ব্যাপকভাবে ঠাঁই দিয়েছেন বললে দোষের হবে না। এ কারণে অন্য একটি উপন্যাস কুমার টপাদারে তিনি লিখেছেন, ‘বাছা, ক্রিশ্চিয়ান-সংস্কৃতি থেকে রোম্যান ক্যাথলিক ধর্মের আবেগ সরে গেলে রাফায়েলের ম্যাডোনা আগের মতো মূল্যবান থাকে?’ তো ইংরেজদের দেখাদেখি এদেশের শিক্ষিত সমাজেও ভারতীয় ধর্মের নবজাগরণ শুরু হয়। মজার ব্যাপার এখানে, ভারতে যখন ধর্মের নব্যজাগরণ আরম্ভ হয়, ইংল্যান্ডে তখন ধর্মের প্রাধান্য হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ দুটো বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ধর্মের প্রভাব ইউরোপে আরেকপ্রস্থ ক্ষয়ে যায়, অথচ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের হাতে ঘটে উলটো ব্যাপার; সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতকে দ্বিখন্ডিত করা হয়। এসব দেখেশুনে কথাশিল্পী আনোয়ার পাশা একদা নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করেছিলেন – হিন্দুর দেশ যদি হিন্দুস্তান আর মুসলমানের দেশ যদি পাকিস্তান হয়, তাহলে মানুষের দেশ কোনটি? যা হোক বাগচীর চরিত্রে পুনরায় ফিরলে দেখা যায়, তার সাহায্যে সাধারণ আমজনতার সুবিধাবাদী স্বভাবধর্মও পরিস্ফুটিত হয়েছে কালাতিরিক্ত ব্যঞ্জনায়। বাগচী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অত্যাচারিত নীলচাষিদের অভিযোগগুলো ইংরেজিতে লিখে দরখাস্ত আকারে ইন্ডিগো কমিশনে জমা দেওয়ার পর হয় কী, নীলকরদের ভয়ে হোক কী প্রলোভনে পড়ে হোক – নীলচাষিদের হাবভাব যায় বদলে; অত্যাচারী ডানকনের বিপক্ষে কিছু বলা দূরে থাক, উলটো কমিশনের নিকট ডানকানের প্রশংসা করে আর উপকারী বাগচীর নামে করে দোষারোপ। এতে করে ভারতীয়দের (ভারতীয় বলতে এখানে গোটা উপমহাদেশের লোক অন্তর্ভুক্ত) যে-স্বার্থবাদী চরিত্র প্রকটিত হয়েছে, আজতক কি এর গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে? মানুষ সত্যই এক আজব চিজ বটে! এ-কারণে তাঁর উপন্যাসের লোকজন মোটেই একরৈখিক নয়; উপন্যাসের মানুষজন তাঁর কাছে ব্যক্তিরূপে আসে; ব্যাপারখানা শোনা যাক না কেন তাঁর কণ্ঠস্বরে, ‘ফলে তার চেহারা ও চরিত্রের চাপে পূর্বজাত abstract idea বরং ফেটে যায়, ছিঁড়ে যায়।’ তখন হয় কী, পাত্রপাত্রীর সম্পর্কসূত্র সরল রাস্তায় না চলে অনেকসময়ই বিধিবহির্ভূত বাঁক নেয় আর তাদের চিন্তাতরঙ্গ থেকে উঠে আসে উপন্যাসের আর্গুমেন্ট যা উপন্যাসকে উপন্যাস হিসেবে দাঁড় করায়। তাঁকে কোট করে তাই বলতে সাধ হয়, ‘তাতে যদি উপন্যাসের সংখ্যা কমে যায় তাতে লোকসান বইওয়ালাদের, পাঠকের নয়।’
পরিশেষে অমিয়ভূষণের গদ্যশৈলীবিষয়ক দু-চার কথা; উপন্যাসের গদ্য এতদূর ঐশ্বর্যসম্পন্ন যে, পাঠের সময় এর ভাষাশৈলী কানে সংগীতের মতো বাজে; ভাষার গতি এমন স্বতঃস্ফূর্ত যে, তা যেন বাড়ির পথধরা হাতির ছুট, মাহুত সেজে লেখকের অঙ্কুশ ব্যবহার করতে হয় না। অমিয়ভূষণের ভাষা-উপলব্ধি যে কতটা প্রখর ও সহজাত – তা জানতে পারি তাঁর ‘উপন্যাসের ভাষা’ প্রবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে : ভাষাকে কখনো তিনি উপন্যাসের থিম থেকে পৃথক করে দেখেননি, উপরন্তু ওটাকে থিমের অবিচ্ছেদ্য ভেবেছেন; স্ত্রীলোকের চামড়া বা আদিম শাড়ির সঙ্গে তার রক্ত-মাংসের যে প্রাণময় সম্পর্ক, উপন্যাসের সঙ্গে ভাষার সম্বন্ধও অবিকল একই। যে-কারণে তাঁর ভাষা অন্তর্মুখী, কদাচ সংবাদপত্রের বা দরখাস্তের ভাষা নয় কিংবা টিপিক্যাল প্রোজও নয়। শুধু তাই নয়, থিম অনুযায়ী তাঁর উপন্যাসের ভাষাও বদলে গেছে প্রতিবার। তবে এই পরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে, চট করে ধরা মুশকিল অথবা অধিকাংশক্ষেত্রে আমরা সাধারণ পাঠক তা বুঝতে পারি না। অন্য জায়গায় যা-ই ঘটুক, তাঁর ফ্রাইডে আইল্যান্ড এসে পাঠককে আর ভাষাগত তফাৎটি বলে দিতে হয় না; স্বরধ্বনির টানাপড়েনে মন্ত্রের নকশা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে তিনি শেষতক ফ্রাইডে আইল্যান্ডের ভাষার সিনট্যাক্সকে এতটা বদলে ফেলেছেন যে, তখন আরেক মজুমদার অর্থাৎ কমলকুমার মজুমদারকে মনে পড়ে। কমলকুমারকে মনে পড়লে হবে কী, ফ্রাইডে আইল্যান্ডের ভাষা একান্ত অমিয়ভূষণের স্বকপোলকল্পিত এবং নতুন কিরণে সমুদ্ভাসিত। ভাষাকে প্রয়োজনমাফিক দুমড়ে-মুচড়ে ইস্পাত ও ঢালাই লোহার পার্থক্যনিরূপণের যে খেলা আজীবন তিনি খেলেছেন, তা অসামান্যই বটে। মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসের ভাষাভঙ্গিসংশ্লিষ্ট লেখকের বক্তব্য এক্ষেত্রে জুড়ে দিলে মন্দ হয় না, ‘এই উপন্যাসের ভাষার ‘যেন একটা লোকাল কালার আছে, কিন্তু কোনো লোকালিটির নয়’, কারণ কোচবিহারের ভাষায় ‘ডায়লগ’ লিখতে থাকলে ‘সেটা বৃহত্তর বঙ্গের অন্য কোথাও কম্যুনিকেট করতে পারবে না।’ এছাড়া যা অনুমান করি, তাঁর লেখকসত্তা সমৃদ্ধশালী হয়েছে চিত্রকরসত্তার মিতালিতেও। সাক্ষাৎকারে ‘যখন লিখতে পারি না তখন ছবি অাঁকি’র কথা লেখক বললেও ল্যান্ডস্কেপের চিত্রণে তাঁর দুটো শিল্পীসত্তা সর্বদা একাকার হয়ে গেছে। শুধু ট্রিলজির দুই পার্ট কেন, যেখানে-যেখানে নিসর্গের বর্ণনা এসেছে, সেখানেই তাঁর চিত্রকরসত্তা যারপরনাই প্রভাবসঞ্চারী, যার উত্তম প্রমাণ তাঁর তাসিলার মেয়র; কারণ উপর্যুক্ত উপন্যাসে তাসিলা অঞ্চলটি স্বীয় ফরেস্ট-পাহাড়-অসংখ্য টিলা-রিজ-উপত্যকা ও উজ্জ্বল বর্ণসম্ভার নিয়ে নিজেই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। গোটা তাসিলা রেঞ্জ প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠায় হয় কী, তাসিলার ভূমিপুত্ররা অর্থাৎ আদিবাসী পাশাং, ভোট ও চামলিংরাও নিজস্ব মিথ-ভাষা-সমাজব্যবস্থাসহ ততোধিক জীবন্ত হয়ে ওঠে। এক্ষণে নিসর্গদৃশ্যের কতিপয় সার্থক বিবরণ ও ভূমিপুত্রদের মিথের আস্বাদ নেওয়া যাক, ‘১. শীতকালে প্রকৃতিতে সবুজ কমে, বাদামি, হলুদ, সোনালি বাড়ে। এতক্ষণ তো রেলপথের দু-পারেই মাঠগুলোতে, কৃষকদের বাড়িগুলোতে অনেক গাছের পাতায় সেই বাদামি, হলুদ, লাল এবং সোনালি… ২. বনের মধ্যে গাছের ফাঁকে ম্লান হলুদের আভাস-লাগা ফিকেকালো অন্ধকার থাকে, কখনও পাতাকাটা ছায়া পড়ে পায়ে। আবার অল্প আলোর ছাই রঙে ছেয়ে গেলে মনে হয় উপত্যকা জুড়ে একদল জন্তু পা গুটিয়ে, ককুদ জাগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর এক রাতে কুয়াশা আর আলোর তারতম্যে উপত্যকাটাকেই বাদামি হলুদ, খয়েরি হলুদে আঁকা প্রান্তর মনে হচ্ছিল (তাসিলার মেয়র)… ৩. এরা সেই টুং-এর আদিবাসী।… ওদের গায়ে, বিশেষ স্ত্রীলোকদের, একরকম ঘা হয়। হয়তো কোন ফাঙ্গাস ইনফেকশন। হয়তো অপুষ্টি থেকে, কিন্তু একে অন্যকে সংক্রামিত করে চলেছে। তো, ওদের এক প্রধান বলেছিল, সেই সোর নাকি ভগবানের আশীর্বাদ, তারই ভয়ে তাদের সুন্দরী স্ত্রীলোকদের অন্যজাতের পুরুষেরা অপবিত্র করে না (তাসিলার মেয়র)।… ৪. সেটা পার হয়ে আরো উত্তরে বেগনি বাদামি, বেগনি নীল, নীল পাহাড়ের পর্যায়। এই উপত্যকা আর তার লাগোয়া পাহাড়শ্রেণিতে বেশ খানিকটা হলুদ রং। সূর্য যদি রঙের বাটি হয় তবে তা থেকে ছলকে পড়ে, ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই রঙের কোন প্রান্ত উজ্জ্বল, কোন প্রান্ত ভার্ডিগ্রিস (তাসিলার মেয়র)… ৫. ছবিতে যেমন সাজিয়ে অাঁকা হয়, তেমন করে সাজানো ডালপালা। গুঁড়িটা সাদা। বসন্ত আসতে না আসতেই থলো থলো গোলাপি ফুলে আপাদমস্তক ঢেকে যায় গাছটার… আর থলো থলো গোলাপি ফুলের মধ্যে কখনো কখনো নাকি দুটো ডালে ফুল ফোটে… হলুদ এমন যে তাকে সোনালিই বলতে হয় (‘সাইমিয়া ক্যাসিয়া’)… ৬. বাতাস সেদিনও ভিজে, ব্যাঙ তখনও ডাকছে, কিন্তু মেঘলা মেঘলা জোছনা বনের মধ্যে হালকা হালকা হলুদ দাগের মতো (সোঁদাল)।’ এবার তাঁর কারুকার্যখচিত দ্যুতিময় কতিপয় উপমা উদ্ধৃত করা যাক – ‘১. সেজন্য ওপারের সবই বিস্ময়ের আর কৌতূহলের। কী বলবে? রানীর মতোই? নাকি একটা হীরার মতো? আলো দেখে মনে হয় ভেতরটা ছুঁতে পারা যায়, কিন্তু কে কবে হীরার ভিতরে ঢুকেছে?… ২. ‘হ্যাঁ, কেট, তোমাদের দেশে কালো চুল, কালো চোখ কি হতে নেই? তাতে কি তোমাদের পুরুষরা বশে থাকে না? তারা কি শুধু মণিমাণিক্য আর সোনাই খোঁজে? যেজন্য তোমার চোখ দুটিকে গোমেদ আর চুলকে সোনা করতে হয়েছে?’… ৩. সেই বালিকার প্রেম চাঁপা সুঘ্রাণের চাইতেও সুন্দর ছিল, এমনকী সর্বশ্রেষ্ঠ ফরাসি মদের বোকেও তার তুলনায় কিছু নয়… ৪. ব্লাউজের হুক খুলে গিয়েছে, চাঁপারঙের অর্গান্ডির আন্ডারগার্মেন্টের শাসনবিচ্যুত সুপক্ব পুষ্ট স্তনের অর্ধাংশ, যা নাকি স্বর্গের মতো… ৫. চিৎকারে সেই লাঠিগুলো, কালো বল্লমগুলো, কালো কালো রামদাগুলো, সাপের জিভের মতো, ফলার মতো উঠছে নামছে (সোঁদাল)… ৬. জল এখন এত কম যে মার্বেলের গুলির মতো ছোট ছোট পাথরের সবটুকু ডোবে না (মহিষকুড়ার উপকথা)… ৭. সেবার যখন জাফর তিনমাস খামারে ছিল না, তখন কিন্তু বেশ একটা মোরগের মতোই ঝুঁটি ফুলিয়ে বেড়াতো আসফাক (মহিষকুড়ার উপকথা)।’ এছাড়াও বাক্যগঠনের তাঁর একটি প্রিয় অথচ কার্যকরী ঝোঁক চোখে পড়ে যার কতিপয় দৃষ্টান্ত এরকম – ‘১. বনে তেমন হঠাৎ আলো কমলে বাঘ শব্দটা মনে না হলেও, যে ভয়টা চারদিকে কালো কালো হয়ে ঘনিয়ে আসে, তাকেও বাঘ বলা যায়… ২. সে যে রাতে বন ছেড়ে চলে যেতো কখনও কখনও, তার প্রমাণ তো চন্দানির মানসাঘাটের কঁড়ে থেকে তার মশারি, মাদুর আর তোবড়ানো অ্যালুমুনের হাঁড়িকুড়ির এঘরে থাকা… ৩. সেটা বোধহয় হাত দেড়েক লম্বা, ধরলে মুঠো ভরে যায় এত মোটা এক কুচলো মাছ (হলং মানসাই উপকথা)… ৪. তার বাড়ি আমোদনগরের উত্তর প্রান্তে, যেখানে ন্যাশনাল হাইওয়ে আর রায়ডাক সমান্তরাল চলতে চলতে, কে কাকে অতিক্রম করবে তার দ্বিধা করতে থাকে… ৫. একটা মিথ্যায় একটা অর্ধসত্য যোগ করে, আর তাকে জোরদার করতে একটা অ্যালুমিনির মাঝারি কৌটা, যা লবঙ্গলতিকার জন্য হতে পারে, কেরিয়ারে বসিয়ে সে রওনা হয়েছিল (মাকচক হরিণ)… ৬. বলতে লজ্জা হলেও, বলতে হবে, সারাটা সময়ই তিনি এক দীর্ঘ ছিপছিপে সুন্দর যুবককে লুব্ধ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন (‘মাকচক’)… ৭. এই গাউন, নাকি ম্যাক্সি, যা নিতম্বের দিকে বেশ চওড়া, ঢলঢলে সেই লালে সাদা প্রিন্ট জামার নিচে, বোধহয় ব্রেসিয়ার ছাড়া, ত্রিশোত্তর বুক, কিংবা সুকুমার তেমন অভিজ্ঞ নয় যে, জানবে নানেরা ওটা ব্যবহার করে কিনা, নিচু নাকের ওপরে স্টিলের চশমা (কুমার টপাদার)।’ এতে করে তাঁর ভাষা কেবল চরিত্রচিত্তের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না, চরিত্রসমূহের চিন্তার অনুগামী হয়ে ওঠে; আর এভাবেই তাঁর কথাসাহিত্যের ভাষা হৃদয়সংলগ্ন হয়ে ওঠে, যা একই সঙ্গে হৃদয়-সংবেদী পাঠকের জন্য রেখে যায় এক অতিরিক্ত ঈপ্সিত আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। পড়তে-পড়তে আরো যা লক্ষ করি, লেখকের কৌতুকবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। চাষিপীড়ক নীলে-বাঁদর ডানকানকে যখন ডানকানা বলে পরিহাস করেন, তখন তাঁর কৌতুক পরিমিতিবোধে ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তাঁর চমৎকার রসবোধের পরিচয় সব জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো, এমনকি যেখানে তিনি নিজের কথা লেখেন সেখানেও, ‘চাকরি করার একবছর হতে-না-হতে বিয়ে… বাইশে পৌঁছে ষোড়শী স্ত্রী পেয়ে স্ত্রীলোকের অভাব বোধ করতে হয়নি। মনস্তাত্ত্বিকরা বলতে পারেন, হয়তো এইজন্য আমার কবিতা লেখা হয়নি এবং এইজন্যই প্রেমের গল্প লিখতে পারিনি।’ ফাঁকতালে তাঁর আরও কিছু ঝলমলে রম্যের আস্বাদন হতে পারে, ‘১. একদিন চিন্তায় কিছু রসিকতা মিশিয়ে আলেফ ভাবলো : নারীর সঙ্গে জমির এইটুকুমাত্র তফাৎ যে নতুন ও লোভনীয় দেখলেই তাকে ভালোবাসা যায়। তার জন্য ছেলে-বউয়ের কাছে মাথা হেঁট করতে হয় না। (প্রসঙ্গক্রমে জমি ও নারীবিষয়ক ইলিয়াসের অসাধারণ কিছু ক্রোধসমৃদ্ধ কৌতুকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে)… ২. কাগজগুলো রোদ্দুরে দিতে যেতে হস্তান্তরের একটি দলিল চোখে পড়েছে – দাতা মকরমৌলি, গ্রহীতা শ্রীমতী রাশেশ্বরী। সান্যাল মনে মনে হাসলেন গোটা জমিদারি ঘুস। রসিক ছিলো বটে (‘সান্যালদের কাহিনী’)… ৩. সে বেশ আজ রাগ করেই বলছিল বেনের ছেলে বলতে তো ওই একটি, নাতি কি সওয়া লাখ হবে যে তার জন্য এই বাড়ি তুলছে বেনে (‘বণিক লক্ষেশ্বর’)… ৪. চন্দানি ফিক করে হেসে বলেছিল, খুব রাগ যে! খুন না হয় নাই করছো। কাকার টাকা আর তার বেটিছাওয়াক নিয়া পালাছো। সেটা কম অপরাধ? (হলং মানসাই উপকথা)… ৫. একজন বললে, পরীক্ষায় মাস্টারমশাই আম অাঁকতে দিয়েছিলেন। ও এঁকেছে আলু। মাস্টারমশাই দিয়েছেন গোল্লা। অপরজন বললে, ও এঁকেছে বেগুন, মাস্টারমশাই দিয়েছেন মাইনাস ওয়ান। (‘কার্তিক-গণেশ’)… ৬. এই একশো কেজি সারা শরীরে ছড়িয়ে দিতে হলে বকসিং অথবা মল্লযুদ্ধে যোগ দিতে হয়। একজন গাইনো সার্জনের সে অবসর কোথায়? সুতরাং ওজনের একটা বড় অংশ শরীরের মাঝামাঝি জমে যাওয়ায় কোমরবন্ধের ঘের ষাট ইঞ্চির কাছাকাছি। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলে, দূর থেকে দেখলে ভোম্বলদাসকে একটা অ্যামেরিকান মার্কা, রেকর্ডবুকে ওঠার মতো, বড় লাটিম মনে হয় (‘একটি কুয়োর গল্প’)… ৭. সুকুমার যেন এতক্ষণে ধরতে পারল, তার হিন্দিতে দোষ আছে আর ম্যানেজারের ইংরেজিতে (কুমার টপাদার)।’ তাঁর রম্য তৎকালিক প্রয়োজনের নিমিত্তমাত্র নয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁর সেন্স অব হিউমার ভারসাম্যপূর্ণ; বুঝতে পারি, বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের বাইরে গেলে বিপদ ভারি; তখন রসিক ও ফাজিলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। পার্থক্য থাকে কী করে? তখন যে তাঁর বয়ান মোতাবেক, ‘রস টানলে ফাজিল।’ ফাজলামি যে হাস্যরসের পরিবর্ত নয় তা তাঁর কুমার টপাদার উপন্যাসেও স্পষ্ট, ‘কিন্তু সুকুমার সঙ্গে সঙ্গেই বলল, খুব কায়দা করে যে চলে তার পদস্খলনে যে হাস্যরস, তা কিন্তু উঁচু জাতের নয়।’
উপসংহার টানার আগে গুরুত্বসহকারে যে-প্রসঙ্গ বলা জরুরি, সেটা সৃজনধর্মের বৈশিষ্ট্য; বড় ক্যানভাসে যাওয়ার আগে প্রায়শ তিনি স্কেচ করে নিতেন। আবার যে বড় উপন্যাসটা তাঁর অরুণস্পৃষ্ট প্রাক-কূজন নভে সবে অবয়ব পাচ্ছে, সেটার কোনো কোনো চরিত্রকে আর চেপে রাখা যাচ্ছে না, তখন তা ছুটকে গল্প হয়ে বেরিয়ে গেছে। এ যেন ভাতের চাল বাছতে গিয়ে পুষ্টিকর খুদের জাউ রান্না করা। তাঁর ‘অন্ধকার’, ‘স্বর্ণসীতা’, ‘পায়রার খোপ’ গল্পগুলোই প্রমাণ করে কীভাবে অজাত উপন্যাসের চরিত্রসমূহ ছুটকে গল্প হয়ে বেরিয়ে এসেছে। একই দৃষ্টিকোণে ‘সান্যালদের কাহিনী’ গল্পটাকে আমরা বলতে পারি তাঁর গড় শ্রীখন্ড উপন্যাসের উত্তর-পাঠ; উভয় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সামন্ততান্ত্রিক পরাক্রমশালী জমিদারিপ্রথা ভেঙে পড়ছে আর উত্থান ঘটছে নতুন জোতদারগোষ্ঠীর, যদিও কালের নিয়ম এই – একদিন এই নব্যধনিক জোতদারগোষ্ঠীর ক্ষমতাও হাতবদল হবে। এদিকে তাঁর চাঁদ বেনে পাঠমাত্র বোঝা যায়, উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো কীভাবে ‘বণিক লক্ষেশ্বর’ গল্পের স্বল্পপরিসরে স্বরূপে দেখা দিয়েছে। ভাইস ভার্সা নিদর্শনও কম নয়; ‘একটি খামারের গল্প’টিই দু-দশকের বেশি সময় পরে উপন্যাসরূপ পেয়ে হয়ে ওঠে মহিষকুড়ার উপকথা। তেমনি করে ‘মধুরার ফ্ল্যাট এবং মিউজিয়াম’ গল্পটি শিরোনামের সামান্য রদবদল ঘটিয়ে হয়ে দাঁড়ায় নাটক মধুরার ফ্ল্যাট ও মিউজিয়াম। এইসব ছুটকে গল্পের সুবিধা এই, সংশ্লিষ্ট উপন্যাসটি বোঝার ক্ষেত্রে তা খোলা জানালার কাজ করে। শুধু কি তাই, পাঠকের লাভ পদে পদে অর্থাৎ একই বিষয়ভিত্তিক একটি ছুটকে লেখা কখন ছোটগল্প এবং কখন গোত্র বদলে উপন্যাসে দাখিল হয় – তাও তুলনামূলক পাঠের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তাঁর ব্লুপ্রিন্টগুলোও কিন্তু কম সহায়ক নয়; সব মিলিয়েই এক অখন্ড সজীব অমিয়ভূষণ। আবার গল্প-উপন্যাসের যখন খরা চলে, তখন ‘জর্ন্যাল থেকে’ এবং ‘ইমমরালিস্টের চিঠি’ এই শিরোনামে তিনি করে যান open form-এর সাধনা। কেবল কি তাই, লেখা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁর পরিমার্জনার আরাধনা চলতে থাকে নিরন্তর। প্রয়াসের ভিতরকথা শোনা যাক তাঁর কণ্ঠে, ‘কোন লেখা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে থেকে যায় আমার গল্প, আমার উপন্যাস, আর আমি, শিল্প হয়েছে কিনা এই পরীক্ষা চলতে থাকে।’ যে-কারণে দেখতে পাই, অরুণা প্রকাশনীর গড় শ্রীখন্ডের একেবারে শেষের দিকে কিছু বাড়তি অংশ সংযোজিত হয়, যা কিনা নাভানা সংস্করণে ছিল না। সমতুল প্রচেষ্টার আরেক সম্প্রসারণ গল্প ‘মাকচক’ ও আরো পরের উপন্যাস মাকচক হরিণ; কারণ বিনদনি উপন্যাসের পরও রাভা-কোচ জনজাতির সম্পর্কে লেখকের অনুসন্ধান শেষ হয় না, ‘রানি-বিনদনি’/ ‘আনি বিনদনি’ নামে যে বৃহদায়তন উপন্যাস লেখার আয়োজন চলছিল, সেই সূত্রেই ওই গল্প-উপন্যাস রচিত হয়। এদিকে মাকচক হরিণকে ভোজ ধরলে সম্ভবত ‘ম্যাকডাফ সাহেব’ গল্পটি ভোজী। পঞ্চায়েত সেক্রেটারি মোহান্ত ও তার চেলা বোজো মোহান্তের (যারা বাম শাসনের নামে রাভা-কোচদের জমি চাষ করে জোরপূর্বক অর্ধেক ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছিল) হাত থেকে শাশুড়ি বিনদনির ধানিজমি বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা না-পেয়ে জামাই জনাদন অস্ত্র তুলে নিয়ে দুই মোহান্তকে মারার পর হয়কি, শেষ দৃশ্যে পুলিশের গুলি খেয়ে জনাদনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিনদনি উপন্যাসটি যেখানে সমাপ্ত হয়, সেখান থেকে মাকচক হরিণের আরম্ভ; পার্থক্য এতটুকুই, বিনদনির পার্শ্বচরিত্র, জনাদনের বাল্যবন্ধু ডাকপিয়ন বমভোলা হয়ে ওঠে মাকচক হরিণের প্রধান চরিত্র, যদিও মূল থিমের তেমন পরিবর্তন হয় না; বারবার বমভোলার স্মৃতিতে পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা-হয়ে যাওয়া জনাদন হানা দেয় আর বাতাসের কান্নার মতো অবিশ্রান্ত ধ্বনিত হতে থাকে রাভা আদিবাসীদের করুণগাথা; সেই রাভারা যারা পাঁচ হাজার বছর আগে এদেশে এসেছিল অথচ তারাই আজ উড়ে এসে জুড়ে-বসা লোকদের আগ্রাসনে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে! আবার ‘মাকচক’ গল্পে আরেক পার্শ্বচরিত্র বিদুনবালা উচ্চশিক্ষিত ছেলে প্রদ্যুম্ন নামভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বটে, তবে তা ট্রাইবাল সংকটকেই ঘনীভূত করার নিমিত্তে। অর্থাৎ পাত্রপাত্রীর ভূমিকা বদলে গেলেও লেখকের খননকার্য চলতেই থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা বিষয়বস্ত্তর তলদেশ স্পর্শ করে। আর কে না জানে একজন সত্যিকার লেখকের বৈশিষ্ট্যই সেটা, কেননা যিনি মানুষের জীবন ও পরিণতি অনুসন্ধান করেন তাঁকে জমিনেই থাকতে হয়, তাঁকে আসমানের তারকা হলে চলে না, হিরো তো নয়ই। মিথ বাদেও আদিবাসীদের গোড়ার কথা, এলাকার পত্তন থেকে নামকরণের অজানা তথ্যই না উঠে এসেছে তাঁর পরিশ্রমী স্বর্ণাভ কলমে। এমনকি সোঁদাল উপন্যাসের নায়ক মোন্নাত, যে কিনা নকশালবাড়ি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর শুটআউটে সঙ্গীদের হারিয়ে যখন আদিবাসীর এলাকায় আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়, সেই পলাতক ছদ্মবেশী পাগল মোন্নাতের ফেরার জীবনের মধ্য দিয়েও কোচ-মেচ-রাভা-রাজবংশী-মুন্ডাদের টোটেম আর ট্যাবুসমেত অন্তর্লীন বাঁচামরার অনুষঙ্গকে কত আঙ্গিকেই না তিনি বীজ বোনার মতো ছড়িয়ে দেন। তখন কি আমাদের পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিষ্পেষণের চালচিত্র সমান্তরালবর্তী হয়ে ওঠে না? আজতক ভূমির অধিকার পাওয়া তো দূরে থাক, রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানও তাদেরকে আদিবাসীর মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত; হোমোসেপিয়ান্সদের মধ্যে যারা অগ্রজ, কথিত ঈশ্বরের কাছ থেকে যারা প্রথম ভূমির দখল নেয়, আজকে তারাই উদ্বাস্ত্ত-উন্মূল! যাদের ভাষায় শোষণ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই, সেই আদিবাসীদের জীবনচক্র শোষণের শতেক জাঁতাকলে বাঁধা। পৃথিবীতে যে ৩৭ কোটি আদিবাসী মানুষ আছে, তারাই কিন্তু পৃথিবীর প্রায় ৬০০০ ভাষার মধ্যে ৫০০০ ভাষার অধিকারী। প্রতিনিয়ত তারা শুধু হারিয়ে যাচ্ছে না, তাদের বিপুল ভাষাভান্ডারও দিনে-দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। রাভা জাতির বাঁচার আন্দোলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিনদনির জোন ম্যাডাম কী সুন্দর করেই না মনুষ্যবৈচিত্র্য ও ভাষাবৈচিত্র্যের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, ‘ভাষা কি করে একটা জাতির বাসস্থান, আবহাওয়া, নদনদী, পাহাড়, বন, আকাশ, শস্যক্ষেত্র, সামাজিক আচার, রুচি, অরুচি, সমাজের মানুষগুলোর পরস্পর সম্বন্ধ ধরে রাখে, ভাবলে অবাক হতে হয়… সুতরাং ভাষা শুধু চিন্তাকে ধরে রাখে না, জাতির ব্যক্তিত্ব, আর কোথায় সে ব্যক্তিত্বের অবস্থান তাও ধরে রাখে। বলা যায়, একটা জাতির মৃত্যু ও একটা ভাষার মৃত্যু প্রায় একই কথা।’ অনুসন্ধানের পরবর্তী ধাপে মাকচক হরিণ লিখিত হয়েছে সত্য, কিন্তু আরো নতুন হয়ে ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন বলেই সম্ভবত মৃত্যুকাল পর্যন্ত তা ছাপতে দেননি। সত্য বলতে কী, লেখাটি উল্লেখযোগ্য না-হওয়া পর্যন্ত এবং লেখকের সই পাওয়ার উপযুক্ত না-হওয়া পর্যন্ত তা তাঁর লেখার টেবিল থেকে সরেনি। শিল্প হয়ে ওঠার জন্যে লেখালেখির পেছনে যে অমানুষিক শ্রম তিনি বিনিয়োগ করেছেন, তা অত্যাশ্চর্যই বইকি! কত অজস্র কাটাকুটি, সংশোধন ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে যে-লিখনপ্রক্রিয়া এগিয়েছে, সেটির প্রত্নসাক্ষী অবশ্যই LIC বা memoranda চিহ্নিত তাঁর ডায়েরির পাতাগুলো। তাঁর সৃজনধর্মের আরেকটি দিক লক্ষণীয়; ব্যাপক ডিটেলের কাজের মধ্যেও সংবেদনশীল জায়গাসমূহ তিনি ইঙ্গিতধর্মী অাঁচড়ে এঁকে গেছেন, এতে করে তাঁর সাহিত্যকৃতির সংহতি বেড়েছে বই কমেনি। অকারণ ডিটেলের নামে বাচালতাকে তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন; বলা কথার চেয়ে না-বলা কথাগুলোও যে বেশি দরকারি হয়ে উঠতে পারে, অধিক প্রকাশক্ষম হয়ে দাঁড়াতে পারে অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে কবিতার রং লাগলে কথাসাহিত্য যে আরো কংক্রিটের মতো জমাট বাঁধে – এই অনাস্বাদিত সাহিত্যসত্যও তাঁর গোটা সাহিত্যকর্মেই প্রতিভাত; আশ্চর্য বাকসংযমী বলেই বুঝি তাঁর কথাসাহিত্যের বাকবিভূতি এতটা শিখরস্পর্শী।
অ্যাংলো-স্যাক্সনি মুখোশে-আবৃত কলকাতা থেকে সুদূর প্রান্তিক লোকালয়ে (প্রধানত বাংলাদেশের পাবনা-রাজশাহী ও ভারতের কোচবিহার) বসে তিনি যে একার সন্ন্যাস রচনা করেছেন, যে নতুন ঢঙের, বিষয়ের, থিমের, স্ট্রাকচারের সুবিপুল রচনাসম্ভার আমাদের জন্যে রেখে গেছেন, সেটাকে পাশ কাটানো হবে আত্মহননের অন্তর্গত। বস্ত্তত আত্ম-আবিষ্কারের প্রচলিত অর্থের বাইরে গিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের নতুন মানে তিনি আমাদের দান করেছেন। যাঁর ভিশনে উপন্যাস ভাষাসমেত পরিপূর্ণ বৃক্ষের মতো উঠে আসে, উপন্যাসের আদি-অন্ত যিনি আগাম দেখতে পান এবং সর্বোপরি কথাসাহিত্য সম্পর্কে যিনি অসংখ্য মৌলিক কথা-ইশারা রেখে গেছেন (তাঁর অনেক কথা-ঋণ এখানে ব্যবহৃত) আর সর্বদা যিনি মানুষের পক্ষে বাজি ধরেছেন অর্থাৎ বিদ্বেষকে যিনি কখনই মতবাদ মানেননি, তাঁর মান্যতা প্রশ্নাতীত; যিনি মানুষকে তার অবচেতন, নিজ্ঞান, প্রাক-মুখর মনসমেত অাঁকতে পারেন, তাঁর মধ্যে নিশ্চিত কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বিশাল কিছু আছে আর তাতে উঠবার লোকেরও অভাব হবে না (তবে এটা ধরে নেওয়ার কোনো হেতু নেই যে, তাঁর লেখা গণগ্রাহ্য হবে, বস্ত্তত বিশ্বের সকল ক্ল্যাসিক সাহিত্য দীক্ষিত পাঠকগ্রাহ্যমাত্র, কদাচ আমজনতাগ্রাহ্য নয়। ওয়ান টাইম বলপেন মার্কা সাহিত্যের সঙ্গে মহৎ সাহিত্যকে তাই এক পাল্লায় মাপলে চলে না; গতর-দেখানো ঝুমুর ঝুমুর নাচ অথবা ‘বুকটা ফাইটা যায়…’ কী ‘ইন্দুর পালাইছে গরমে…’ জাতীয় গানের সঙ্গে তো নয়ই)। তাঁর লেখা থেকে জানি, উপন্যাসকে দুভাবেই দেখা যেতে পারে – জীবনের সমান্তরাল হয় না বলেই উপন্যাস আর্ট, আবার এরকমও সত্য হতে পারে, ‘আমরা যতটা সত্য আমাদের সম্বন্ধে, উপন্যাস তার চাইতে বেশি সত্য হতে পারে। কারণ এরকম হতে পারে, আমাদের চিন্তা অনেক সময়েই অপরিস্ফুট থাকে, নানা কৌশলে উপন্যাসে তা পরিস্ফুট আর যুক্তিসিদ্ধ করা যায়।’ অর্থাৎ খেলার মতো মন নিয়ে লেখা শুরু হলেও পরে লেখালেখি হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জীবনের ‘কেন’ বা first love, এককথায় তাঁর জাগ্রত ও নিদ্রার আনন্দ। তাঁর সঙ্গে একাত্মতা পোষণপূর্বক নির্দ্বিধায় বলতে পারি তাঁর সাহিত্য সেকালের গহরজানদের অথবা একালের হেমামালিনীদের মতো নয়, বরং তা যেন গ্রামীণ কোনো ছোট এক লাখেরাজখন্ডের সুন্দরী মালকিনদের মতো, যাদের সৌন্দর্যের খবর জানতো তাদের স্বামীরা আর ব্যাপারটা তাদের সন্তানদের রূপে দু-এক পুরুষ কী বংশপরম্পরা ধরে হতো প্রমাণিত। তাঁর রূপ তৈরির ফ্রেমগুলো অর্থাৎ মাটি, জল আর আকাশের যে অনিঃশেষ সৌন্দর্যকে তিনি নিজের মন বুদ্ধি চেতনা দিয়ে কেটে নিতে-নিতে রূপে ধরেছেন তা নতুন সাহিত্যের পরিপোষক; ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, জনপ্রিয়তার আহাম্মক রেলগাড়ি তাঁকে সওয়ার না করেই চলে গেছে। লেখা বাহুল্য, এতে তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি, কারণ পঞ্চমুন্ডীর আসনে (তাঁর ভাঙা চেয়ারখানি) বসে সকালের রোদ পিঠে ফেলে নান্দনিক আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি অবিরাম স্বীয় কাজের কাজটি করে গেছেন ধারাবাহিক অবহেলাকে উপেক্ষা করে, ‘লিখি নিজের সুখের তাগিদে সে কী intensive delight, কী করে বোঝাবো? কোথায় ছাপা হবে, ছাপা হবে কিনা তা ভাবার যুক্তি কোথায়? দেখো তো, আমি কি লোকের চোখে দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করবো ব্রাহ্মণীকে আমি ভালোবাসি।’ অন্তর্জ্ঞান থেকে জানতেন তিনি যা রেখে যাচ্ছেন তার অপর নাম জীবন্ত অস্তিত্ব। অথচ প্রজাপতির নির্বন্ধ যেনবা; যেমন এক ধরনের সাজা বাউল আছে, যারা নিজের মধ্যে অধর মানুষকে না-খুঁজে যত্রতত্র হাতড়ে বেড়ায়, আমাদের এক কিসিমের রিভিউয়ারদের অবস্থাও অনেকটা তদ্রূপ; ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, হাতের কাছে ভরা কলস থাকতেও আমরা তৃষ্ণার্ত। সত্যি, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা! আজ অবগুণ্ঠনের সকল কালো মেঘ ছিন্ন করে আপন গরজেই তাঁর কাছে আমাদের শুধু একবার নয়, বারবার ফিরতে হবে। কেননা, অমিয়ভূষণের পথ সোনালি সমরখন্দের পাশ দিয়ে চলে গেছে জীবনের বড্ড কাছাকাছি! 