রাতদুপুরে

ইমদাদুল হক মিলন

দাদা, আমার মাথাটা দেখেছেন? মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না। মাথাটা যে কোথায় গেল!
আমি হতভম্ব। এরকম কথা শুনলে কে হতভম্ব না হবে! একজন বলছে সে তার মাথা খুঁজে পাচ্ছে না…
আসুন না? মাথাটা একটু খুঁজে দিন না? আমি তো একা একা খুঁজে পাচ্ছি না…
একটু আগে থেকে বলি।
এ এক জ্যোৎস্না রাতের ঘটনা। কয়েকদিন আগে পূর্ণিমা ছিল। চাঁদ ক্ষয় হতে শুরু করেছে। এখন চাঁদ ওঠে মধ্যরাতে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভরে যায় চারদিক।
বন-পাহাড়ের ধারে নির্জন নিরিবিলি স্টেশন মধ্যরাতের জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করছিল।
জায়গাটার নাম বনপাহাড়পুর।
ছোট্ট স্টেশন। সারাদিনে দুটো মাত্র ট্রেন। একটা ঢাকা থেকে আসে সকাল সাড়ে এগারোটায়। আরেকটা শেষ বিকেলের দিকে দিনাজপুর থেকে। দু-চারজন যাত্রী নামায়, দু-চারজন তোলে। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার। তারপর হুইসেল দিয়ে কুঁ-ঝিক-ঝিক। একটা চলল দিনাজপুরের দিকে, একটা ঢাকার দিকে।
ট্রেন আসার আগে যাত্রীরা স্টেশনে এসে অপেক্ষা করে। সবাই গরিব নিম্নবিত্তের মানুষ। সঙ্গে বোঁচকা-বুচকি। কেউ একা, কেউ সপরিবারে। কারো কোলে বাচ্চা। বাচ্চার কান্না, মানুষের কথাবার্তায় স্টেশনটা একটু একটু করে জাগে। বাকি সময়টা মৃত। কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই। একদমই মৃতপুরি। ট্রেন যতক্ষণ থাকে, যাত্রীর ওঠানামায় কোলাহল বাড়ে। ট্রেন চলে গেল তো আবার যেই কে সেই। মৃতপুরি।
দুটো দোকান আছে স্টেশনের বাইরে। একই রকমের দোকান। পান বিড়ি সিগ্রেট চা কলা বনরুটি বিস্কুট ও লজেন্স। প্রাণ কোম্পানির ছোট ছোট চানাচুরের প্যাকেট মালার মতো ঝুলে থাকে। শিঙাড়া নিমকি ভাত তরকারি সবই পাওয়া যায়। খুবই নিম্নমানের জিনিস। গরিব মানুষরা সস্তায় খেতে পারে। ট্রেনে ওঠানামার যাত্রীরা ওখান থেকেই কাজ চালিয়ে নেয়। যার যা প্রয়োজন কেনে, ভাত-তরকারি খায়। তবে দুই দোকানের ব্যবসাই খুব খারাপ। কোনো রকমে চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ না থাকলে ব্যবসা হবে কাকে দিয়ে?
ব্যবসা ভালো আড়াই তিন কিলোমিটার দূরের বাজারে। বড় বাজার। ঘনবসতি এলাকা। দিন-রাত মানুষের হল্লাচিল্লা, বাস-ট্রাকের চলাচল। রিকশা-ভ্যানের আসা-যাওয়া। সপ্তাহে একদিন সেই বাজারে গিয়ে নিজের সপ্তাহ চলার মতো জিনিসপত্র কিনে আনি। একটা রিকশা ঠিক করা আছে। রিকশাঅলার নাম বজলু মিয়া। ওই বাজারের দিকেই থাকে। যাত্রী নামাতে এসেছিল স্টেশনে। সেদিনই পরিচয়। চুক্তিটা করিয়ে দিলো দুই দোকানদারের একজন মিনহাজ। এই বজলু, মাস্টারসাব নতুন লোক। সপ্তাহে একদিন তাঁরে বাজারে আনা-নেওয়া করবি। নাইলে মাস্টারসাবে খাইব কী!
সেদিন স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেছে। শেষ বিকেল। খানিক আগে ট্রেন চলে গেছে। ওঠার যাত্রীরা উঠে গেছে, যারা নেমেছিল তারা গেছে যে যার রাস্তায়। বজলু কোনো যাত্রী পায়নি। বাজারের দিক থেকে পাঁচজনের একটা পরিবার নিয়ে এসেছিল। স্বামী-স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে। স্বামীর কোলে একজন, স্ত্রীর কোলে একজন। বড় বাচ্চাটা বসেছিল পায়ের কাছে।
স্টেশনে যাত্রী নিয়ে এলে বজলুর আশা থাকে ফেরার সময়ও একজন না একজন পাবেই। দুর্ভাগ্য, সেদিন পায়নি। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে মিনহাজের দোকানের সামনে। সেখানে একটা বেঞ্চ পাতা। হতাশ ভঙ্গিতে বেঞ্চে বসে চায়ে ভিজিয়ে টোস্ট বিস্কুট খাচ্ছিল বজলু।
আমি হাঁটতে হাঁটতে গেছি ওদিকটায়। মাসখানেক আগের কথা। দুদিন হলো এই স্টেশনের মাস্টার হয়ে এসেছি। স্টেশন মাস্টারের রুমের পেছন দিকটাই কোয়ার্টার। ব্রিটিশ আমলের লাল দালানের বিশাল বিশাল তিনটা কামরা। রান্নাঘর, চাপকল আছে, একটা কুয়াও আছে। আমার দেখভালের দায়িত্ব মোস্তফা নামে এক লোকের। বয়স আমার মতোই হবে। পঞ্চাশের ওপর। গল্পবাজ ধরনের মানুষ। কথা বেশি বলে। এসে স্থির হয়ে বসতে পারিনি, এই যে কথা শুরু করল, আর থামেই না। শুরু করল এইভাবে…
আপনার নাম আমি জানি স্যার। আজগর আলী। এখানে বদলি হয়ে আসার আগে ছিলেন হরিরামপুর স্টেশনে। পরিবার নাই। অর্থাৎ বিবাহ আপনি করেন নাই স্যার। সেটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। বিবাহিত লোক হলে স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে এই এলাকায় এলে দশদিনও টিকতে পারতেন না। এই রকম নিরিবিলি জায়গায় কে থাকে, বলেন? একা মানুষ হলে থাকা যায়। যার কোনো পিছুটান নাই, যার সংসার নাই, তার পক্ষে যে-কোনো জায়গায় থাকাই সম্ভব। না কি বলেন স্যার? হে হে হে, হে হে হে।
এই আরেক স্বভাব মোস্তফার। হে হে করা অদ্ভুত হাসি। কিছুক্ষণ কথা বলেই হাসিটা সে হাসবে। হাসার কারণ নেই, তবু হাসবে।
মানুষের যে কত রকমের স্বভাব!
মোস্তফা তারপর নিজের কথা বলতে শুরু করল। আমার অবস্থাও প্রায় আপনার মতোই স্যার। প্রায় বললাম এই জন্য যে, স্ত্রী নাই। বছর আটেক আগে মারা গেছে। অল্প বয়সে বিবাহ করেছিলাম। বাচ্চাকাচ্চা মাত্র একটা। মেয়ে। মেয়ের নাম স্যার শিরিন। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বিবাহ দিয়েছি। জামাইটা মাশাল্লা ভালো পেয়েছি। গরিব ঘরের ছেলে। তবে লেখাপড়া জানে। আইএ পাশ করেছে। ওই পাশে তো পিয়নের চাকরি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না! আমার সামান্য জমাজমি ছিল। ছোট একটা বাড়ি আছে। সব কিছুর মালিক তো মেয়েটাই, না কি বলেন স্যার! জমি বিক্রি করে জামাইকে স্যার ব্যবসায় নামিয়ে দিলাম। বাজারে দোকান নিয়েছে। ঢেউটিনের ব্যবসা। বাড়িও মেয়ের। জামাই বাড়িতে গিয়ে মেয়ের থাকার কথা। আমার মেয়েটার ক্ষেত্রে হয়েছে স্যার উলটা। জামাই থাকে মেয়ের বাড়িতে। হে হে হে…
মাঝখানে আমি একটু কথা বললাম, তার মানে জামাই হচ্ছে ঘরজামাই।
তা স্যার বলতে পারেন। জামাইটা আসলে আমি কিনে এনেছি স্যার। ভালো ঘরের ছেলে। এমন ছেলে তো সহজে পাওয়া যায় না! তবে আমার মেয়ে মাশাল্লা খুবই সুখে আছে। এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয় নাই। আমার জন্য স্যার বিরাট টান মেয়ের। আমারে না দেখে থাকতেই পারে না। এজন্য দিনদশেক পর পর আমি স্যার বাড়িতে যাই মেয়েকে দেখতে। একটা-দুটা দিন মেয়ের কাছে থেকে আসি। বাকি সময় তো স্যার এই কোয়ার্টারেই। এখানে তো মাস্টার সাহেবরা বেশিদিন থাকেন না। ছয় মাস, নয় মাস থাকার পর উপরঅলাদের ধরে ট্রান্সফার নিয়ে নেয়। এরকম জায়গায় কে থাকে বলেন? শুধু বন আর পাহাড়, মানুষ নাই, জন নাই। দিনে দুটা মাত্র ট্রেন। ওই দুটা ট্রেনের জন্য কেন যে স্টেশনটা রাখছে রেলওয়ে, আমার স্যার মাথায়ই ঢোকে না। তবে নিজের কথা ভেবে রেলওয়েকে আমি স্যার ধন্যবাদও দেই। এই স্টেশন না থাকলে আমার উপায় হতো কী? আমি তো স্যার চাকরি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিলাম। স্টেশন মাস্টারের পিয়ন চাপরাশি বাবুর্চি সবই তো একলা আমি। বাড়িও বেশি দূরে না। সাত-আট কিলোমিটার হবে, খাদিমপুর গ্রাম। হে হে হে…
একটু থেমে বলল, আজ মাত্র এলেন তো। আজকের দিনটা স্যার রেস্ট নেন। কাল জায়গাটা চিনিয়ে দেব। দুজন দোকানদার আছে, রেলের লাইনম্যান আছে, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। দিনের বেলা স্যার ওই দু-চারজন লোক পাবেন। বিকেলের ট্রেন চলে যাওয়ার পর কিচ্ছু পাবেন না। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। ওই যে বোবা বুড়িটা পড়ে থাকে স্টেশনে, সেই বুড়িটাও যেন কোথায় চলে যায়। ফিরে আসে সকালের দিকে। যখন দোকান দুটা খোলে। তাও স্যার নয়টার আগে না। অর্থাৎ সকাল হয় দেরিতে আর সন্ধ্যা হলো কি সব শেষ। এই আমাকে ছাড়া কাউকে পাবেন না। হে হে হে…।
তবে স্টেশন নিরিবিলি হলে হবে কী স্যার, ডর-ভয়ের কিছু নাই। চোর ডাকাত গু-া বদমাশ এদিকে আসেই না। কেন আসবে বলেন? লাভ কী এসে? পাবে না তো কিছু! চুরি করে পোষাবে না, ডাকাতি করে পোষাবে না। গু-ামি-মাস্তানি করে জুটবে না কিছু। তাহলে আসবে কোন লোভে! লাভ না হলে কেউ কোনো কাজ করে, বলেন! কথায় আছে না, ‘লাভে লোহার বোঝা বহন করে, বিনা লাভে তুলার বোঝাও বহন করে না।’ হে হে হে…
কত রাত গেছে পুরো এলাকায় আমি স্যার একা, একদম একা। কেউ নাই। স্টেশন মাস্টার ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছেন। নতুন মাস্টার আসবেন। আমি তাঁর অপেক্ষায়। ইস একত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে কত পদের স্টেশন মাস্টার যে দেখলাম, সেটা বলে স্যার শেষ করতে পারব না। একেকজন একেক পদের। তবে ছয় মাস থেকে নয় মাসের বেশি কেউ থাকেই না। কী করে থাকবে বলেন? এমন জায়গায় লোক থাকে? প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভালো লাগে তারপর শুরু হয় একঘেয়েমি। তবে স্যার জায়গা ভালো। নির্জন নিরিবিলি, চোর ডাকাত গু-া বদমাশ নাই। শুধু ওই একটা…
কথাটা শেষ করল না মোস্তফা, অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলো। চলেন স্যার দোকানদার দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। মাঝে মাঝে গেলেন ওদের দোকানে। এক-দু কাপ চা খেলেন, গল্পসল্প করলেন। সময় কাটাতে হবে না! তবে দিনদুয়েক খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা করবেন না স্যার। আজকের রাতটা আমি যা খাই ও-ই খেলেন। কাল-পরশু খেলেন মিনহাজ আর হারুনের দোকানে। দুই দোকানে খেয়ে স্বাদ নিলেন কার খাবার কত ভালো অথবা কত খারাপ। হে হে হে…
অনেকক্ষণ মোস্তফার বকবকানি শুনে, কথা বলার সামান্য ফাঁক পেয়ে বললাম, তারপর?
তারপর স্যার খেতে হবে বাজার করে। আমি আপনাকে বাজারে নিয়ে যাব। মিনহাজ বা হারুন কেউ একটা রিকশা ঠিক করে দেবে। যে দু-চারজন রিকশাঅলা এদিকটায় আসে তাদের সঙ্গে ওদের দুজনের খুবই খাতির। ওরকম কাউকে পেলেই কাজ হয়ে যাবে। সপ্তাহে একদিন সে আমাদের বাজারে নিয়ে যাবে, স্টেশনে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। মাসে চারদিনের কারবার। মাসকাবারি চুক্তি করে নেবেন রিকশাঅলার সঙ্গে। ওরকম না হলে পোষাবে না। একদিন বাজার করবেন, সাতদিন খাবেন। কোয়ার্টারে পুরানা ফ্রিজ আছে, অসুবিধা কী! তবে ফ্রিজটা স্যার এক্কেবারে লক্কড় এবং ঝক্কড়। মালামাল ঠান্ডা হতে চায় না। কী আর করা, ওতেই কাজ চালাতে হবে। তবে স্যার আপনি একলা খাবেন না, আমিও স্যার আপনারটাই খাব। একত্রিশ বছর ধরে এই নিয়মেই চলছি স্যার। অর্থাৎ আমার তিনবেলার আহার স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে, তাঁর খাবারই। হে হে হে…
তারপরই মিনহাজ আর হারুনের সঙ্গে পরিচয়। রিকশাঅলা বজলু মিয়ার সঙ্গে পরিচয়। মোস্তফার বাতলে দেওয়া পথে জীবন চলতে লাগল। কিন্তু ওই যে কী একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল মোস্তফা সেই কথাটা তো শোনা হলো না!
এক সন্ধ্যায় ধরলাম তাকে। মোস্তফা।
জি স্যার।
কী একটা কথা বলতে গিয়ে সেদিন বললে না। ‘শুধু ওই একটা’, এ পর্যন্ত বলে কথা ঘোরালে। ব্যাপারটা কী?
শেষ বিকেলে মোস্তফা চা বানিয়েছে। আদা চা। আমাকে দিয়েছে, নিজে নিয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়েই কথাটা জিজ্ঞেস করলাম।
মোস্তফা ফুরুক করে নিজের কাপে চুমুক দিলো। তার আগে বলেন স্যার, আমার চা কেমন? রান্নাবান্না কেমন? আমাকে আপনার কেমন লাগছে?
মোস্তফার রান্নাবান্না তেমন সুবিধার না। বাচাল টাইপের লোক আমার একদমই পছন্দ না। মোস্তফা চূড়ান্ত বাচাল। তবু তার সঙ্গেই চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হয়, নিন্দামন্দ না করাই ভালো। বললাম, ভালো, বেশ ভালো। তুমি লোকও ভালো। কথাও বলো ভালো।
হে হে হে। ধন্যবাদ স্যার, ধন্যবাদ। তবে আপনার সাহস কেমন স্যার? ভূতপ্রেতে ভয় পান নাকি? আমি কিন্তু পাই না। ভূত বলতে আসলে কিছু নাই স্যার। ওসব মানুষের মনগড়া। নির্জন নিরিবিলি জায়গায় বটগাছ তেঁতুলগাছে ভূত থাকে, এসব কাহিনি স্যার লোকে বানায়। ভয় পাবেন না। আমি তো স্যার আপনার সঙ্গে দিনরাত আছি। মাসে দুই-তিনটা দিন মেয়ের কাছে যাই। ওই সময় স্যার একলা থাকতে হবে। ভয় পাবেন না। ওসব কিছু না।
কোন সব?
মানে আপনি যা জানতে চাইলেন স্যার।
আমি তো কিছু জানতে চাইনি। তুমি একটা কথা শেষ না করে থেমে গিয়েছিলে, বাকি কথাটা শুনতে চাই।
মোস্তফা আবার চায়ে চুমুক দিলো। আমি স্যার কোনোদিন কিছু দেখি নাই। কোনো কোনো স্টেশন মাস্টার বলেছেন।
কী বলেছেন?
জ্যোৎস্না রাতে কে একজন নাকি…। থাক স্যার, আরেকদিন বলব। আপনি স্যার ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নাই।
আমি ভয় পাচ্ছি এটা তুমি ভাবছ কেন? আমি মোটেই ভীতু লোক নই। ভূতপ্রেতে বিশ্বাসই করি না। ভূতের ভয় আমার একদম নেই। এই স্টেশনে রাতের পর রাত একা থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমারও তো চাকরি জীবন কম দিনের না। বহু নির্জন নিরিবিলি স্টেশনে একা একা থেকেছি। কোনোদিন ভয় পাইনি। ভূতপ্রেত, অশরীরী আত্মা এসব নিয়ে আমি ভাবিই না। ভয় তো পাই-ই না, আমার কোনো আগ্রহও নেই। বরং নির্জন ধরনের জায়গা, গাছপালা বন মাঠ পাহাড় এসব আমার ভালো লাগে। আমি প্রকৃতিপ্রেমী মানুুষ।
তবে স্যার ঠিক আছে। আমি স্যার সামনের সপ্তাহে মেয়ের কাছে যাব। একটা দিন আর একটা রাতের ব্যাপার স্যার। ফিরে এসে আপনাকে বলব। যদি আপনি শুনতে চান স্যার। হে হে হে…
আজ বলতে অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নাই। বাদ দেন তো স্যার, পরে একদিন বলব। তবে স্যার এদিকটায় বেড়াতে আপনার খুব ভালো লাগবে। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ আপনি। ভালো লাগবে, খুব ভালো লাগবে। এলাকার সিন-সিনারি খুব সুন্দর। দূরে পাহাড়। রেললাইনের ওপার থেকে শুরু হয়েছে বন। বনের মাঝে মাঝে খোলা মাঠ আছে। প্রচুর পাখি আছে। শিয়াল খাটাশ বেজি ইঁদুর আছে। বনবিড়ালও আছে। আর স্যার বাঘদাস আছে, সজারু আছে। জ্যোৎস্না রাতে ভারি সুন্দর লাগে চারদিক। ওই যে স্টেশনের দক্ষিণ দিকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে, গাছের তলার বেঞ্চটায় যদি জ্যোৎস্না রাতে গিয়ে বসে থাকেন স্যার, আপনার মনে হবে আপনি স্যার একটা অন্য জগতে আছেন। অন্য একটা পৃথিবীতে হঠাৎ করে এসে পড়েছেন। হে হে হে…
সেই অন্য পৃথিবী দেখতেই বেরিয়েছিলাম আজ রাতে।
বিকেলের ট্রেন চলে যাওয়ার পরপরই একটা ভ্যানগাড়ি পেয়ে গেল মোস্তফা। দূরের পথে যাবে কয়েকজন গরিব মানুষ। তাদের সঙ্গে চান্সটা নিল। শপিংব্যাগে লুঙ্গি গামছা আর একটা শার্ট। পরনে রেলওয়ের ড্রেস। শপিংব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, মনটা শিরিনের জন্য বড় কান্নাকাটি করছে স্যার। যাই মেয়েটিকে দেখে আসি। ভ্যানগাড়ির এদিক-ওদিক বসে জনা সাত-আটেক লোক যেতে পারবে। আমাদের ওই খাদিমপুরের দিকেই যাচ্ছে। ভাড়া কম পড়বে। গেলাম স্যার। শুধু আজকের রাতটা। কাল বিকেলের ট্রেন আসার আগে চলে আসব। সংক্ষিপ্ত সফর আর কি! হে হে হে…
তবে স্যার আপনার খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। ভাত তরকারি রান্না করা আছে। একটু গরম করে নিলেই হবে। স্টোভ আছে, ওটা তো স্যার ব্যবহার করতে আপনি পারেনই…
আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না মোস্তফা। জীবনে বহু বছর আমি নিজের রান্না নিজে করে খেয়েছি। একা জীবন কাটাতে আমি অভ্যস্ত। তুমি নিশ্চিন্তে মেয়ের কাছে যাও। কাল যদি আসতে না চাও, এসো না। কোনো অসুবিধা নেই। আমি একা সব চালিয়ে নিতে পারব।
তা পারবেন স্যার, তা অবশ্যই পারবেন। আর যদি না পারেন, তবে তো একটা পথ খোলাই আছে।
কথাটা বুঝলাম না। কী পথ?
হে হে হে, ওই যে মিনহাজ আর হারুনের দোকান। কালকের দিনটা ওদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেবেন।
কী রকম?
দিনটা আপনি কেমন করে শুরু করবেন, কেমন করে শেষ করবেন সাজিয়ে দিচ্ছি স্যার। আপনি তো ওঠেন স্যার একটু বেশি সকালে। উঠেই হাঁটাহাঁটি করেন, পানি খান। নাশতা করেন স্যার আটটার দিকে। আমি খেয়াল করেছি আপনি খুবই নিয়মমানা লোক। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। এজন্য আপনার শরীর স্বাস্থ্য মাশাল্লা খুব ভালো। খুবই ভালো। আমার বয়সী হওয়ার পরও আপনাকে স্যার খুবই ইয়াং দেখায়। বয়স মনে হয় চল্লিশ হবে। আর আমি গেছি বুড়া হয়ে। বয়স যা, দেখায় তার অনেক বেশি। হে হে হে…
কী বলতে চাইছ সেটা বলো।
বলতে চাইছি স্যার, সকালবেলা আপনার রুটিন মতোই আপনি দিন শুরু করলেন। ঘরে যা আছে, ওই আর কি টোস্ট বিস্কুট, পাউরুটি। পাউডার দুধ আছে। চা চিনি আছে…
তোমার কথা আমি বুঝেছি। ওসব দিয়ে নাশতা করে নেব, এই তো?
না আর একটু আছে।
কী?
আমি বলতে চাইছি শুধু চা পাউরুটি বা টোস্ট বিস্কুট খেয়ে আপনার স্যার পোষাবে না। আমি মিনহাজকে বলে যাচ্ছি সে দোকান খুলেই আপনার জন্য গরমাগরম পরোটা ভাজবে। ওরা দুইরকমের তেল ব্যবহার করে। গরিবদের জন্য এক রকম, ভদ্রলোকদের জন্য আরেক রকম…
তোমার এই কথাটায় আমার আপত্তি আছে মোস্তফা।
হে হে, আমি বুঝেছি স্যার। গরিব মানুষরাও ভদ্র হতে পারে, এই তো বলতে চান!
বাহ, তুমি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। হ্যাঁ, আমি এটাই বলতে চাই। গরিব হলেই মানুষ অভদ্র হয় না। আমি এই জীবনে বহু ভদ্র গরিব মানুষ দেখেছি আবার বহু অভদ্র বড়লোক দেখেছি। ঘটনা আমি এখানেই শেষ করে দিচ্ছি। তুমি বলতে চাইছ দশটার দিকে মিনহাজ এসে ভালো তেলে আমাকে পরোটা ভেজে দেবে, হালুয়া বা সবজি বানিয়ে দেবে, ওই খেয়ে আমি দুপুর পর্যন্ত থাকব। রান্না করতে ভালো না লাগলে দুপুরবেলা মিনহাজ আমার জন্য স্পেশাল ভাত-তরকারি করে দেবে, তুমি না ফিরলে রাতের খাবারটাও আমি ওর দোকান থেকে এনে রাখব, এই তো?
আমার কথা শুনে ভারি কেলানো হাসিটা অনেকক্ষণ ধরে হাসল মোস্তফা। হে হে হে, হে হে হে, হে হে হে। আপনি স্যার একদম আমার মতো। আমি যা বলতে চাইলাম একদম সেই কথাগুলোই বললেন। তবে আমি যাই স্যার। আপনাকে নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নাই। কম ভাড়ায় ভ্যানগাড়িতে চড়ে মেয়েটাকে স্যার দেখে আসি। মনটা বড় কান্নাকাটি করছে।
যাও যাও। সময় নষ্ট করো না। তোমার জন্য ভ্যানগাড়ির চারদিকে পা ঝুলিয়ে বসে অপেক্ষা করছে লোকগুলো।
ঠিক স্যার, একদম ঠিক। তবে আমি গেলাম।
মোস্তফা দৌড়ে মিনহাজ হারুনের দোকানের দিকে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বড় করে একটা হাঁপ ছাড়লাম আমি। যেন এক যন্ত্রণা থেকে বেঁচেছি।
মোস্তফা সত্যি এক যন্ত্রণা। কথা বলতে বলতে আমার কানের সব পোকা খসিয়ে ফেলেছে। এত কথা লোকে যে কী করে বলে! তবে আমিও কম না। মোস্তফাকে সামাল দেওয়ার পথ বের করে ফেলেছি। সে তো সবসময় চান্স খুঁজছে কখন আমার সামনে আসবে, কখন কথা শুরু করবে। আমি তখন এমন ব্যস্ততার ভান করি, যেন আমি বিশাল কোনো কাজ করছি এমন ভঙ্গিতে কোনো একটা পুরনো ফাইল, নয়তো একটা খবরের কাগজ কিংবা বই ঘাঁটতে থাকি। আর নয়তো ব্যস্ত ভঙ্গিতে স্টেশনের নির্জন দিকটায় চলে গেলাম। অযথাই কোনো একটা দিকে হাঁটতে লাগলাম। কোয়ার্টারে ঝক্কা একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি আছে। আমার আগের স্টেশন মাস্টার ফেলে গেছেন। ওটা নেওয়ার মতো জিনিসও না। অন করলে ছবি আসে দেরিতে, সাউন্ড আসে দেরিতে। তাও পরিষ্কার না কোনোটাই। সাউন্ড জড়ানো, ছবি ভেঙে ভেঙে যায়। ঝিরঝির করে। ও জিনিস দেখা যায় না। তাছাড়া টিভি নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। মোস্তফার হাত থেকে বাঁচার জন্য ওটাও কখনো কখনো ছেড়ে রাখি। খুবই আগ্রহ নিয়ে খবর শুনি, খবর দেখি। শব্দ ছবি কোনোটাই পরিষ্কার না, তবু দেখি। মোস্তফা ভাবে, স্যার বিরাট ব্যস্ত। কাছে ঘেঁষে না।
তবে…
তবে মোস্তফার কথা শোনার ইচ্ছাও কখনো কখনো হয়। একঘেয়ে নির্জনতায় যখন একদমই হাঁপিয়ে উঠি, তখন। কোয়ার্টারের বারান্দায় একটা পুরনো ভারী ধরনের চেয়ার রাখা আছে, ওই চেয়ারে বসে মোস্তফাকে ডাকি। মোস্তফা।
মোস্তফা ছুটে আসে, জি স্যার।
চা বানাও। চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গল্প করি।
স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে টুকটাক আসবাবপত্র যা আছে তার সবই দীর্ঘদিনের। বহু বহু বছরের পুরনো। একেকবার একেকজন স্টেশন মাস্টার এসেছেন, এসে সংসার সাজিয়ে বসেছেন। চলে যাওয়ার সময় কিছু না কিছু ফেলে গেছেন। কেউ চৌকিটা নেননি, টেবিল চেয়ারটা নেননি। থালাবাসন হাঁড়িকুড়ি ফেলে গেছেন কেউ। আলনা ফেলে গেছেন। বালতি মগ, এরকম টুকটাক অনেক কিছু। আর মোস্তফা যেটা করেছে, প্রতিটি জিনিসই আগলে রেখেছে। ওসব দিয়ে সংসার সাজিয়েছে কোয়ার্টারের ভেতর।
বছর কয়েক আগে এক স্টেশন মাস্টার তো ফ্রিজটাই ফেলে গেলেন। এখানে আসার আগে কয়েক বছর ব্যবহার করেছেন। এই চলে, এই বন্ধ হয় এমন জিনিস। সাত মাসের মাথায় যখন বিদায় নিলেন তখন ফ্রিজটা নষ্ট। কে পয়সা খরচা করে ঠিক করে ওই জিনিস! ফেলেই চলে গেলেন। পরে মোস্তফা সামান্য কয়েক টাকা খরচা করে ঠিক করে নিয়েছে।
মোস্তফার কাছ থেকে এসব গল্প শুনি।
কী বলব স্যার। মাস্টার সাহেবরা আসেন বিরক্ত হয়ে, চলে যান…
কথা শেষ না করে বলে, এরকম জায়গায় তো কেউ আসতেই চায় না। বাধ্য হয়ে, বিরক্ত হয়ে আসেন। চলে যাওয়ার সময় এত তাড়াহুড়া করেন, অনেক কিছুই নিয়ে যেতে ভুলে যান। আর ওইসব জিনিস জমিয়ে জমিয়ে আমি স্যার কোয়াটার ভরে ফেলেছি। তাকান স্যার, তাকান কোয়াটারের দিকে। কী নাই বলেন? সব আছে, সব পাবেন। আমার জিনিস, আপনার জিনিস। চৌকি চেয়ার বাসনকোসন হাঁড়ি-পাতিল। স্টোভ টিভি ফ্রিজ। তবে আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে স্যার। খুব পছন্দ হয়েছে। আপনি বলতে গেলে স্যার ঝাড়া হাতপা। বিছানাপত্র, নিজের ব্যবহারের টুকটাক জিনিসপত্র আর জামাকাপড় ছাড়া কিচ্ছু আনেননি? হে হে হে। ভালো বাংলায় যাকে বলে চালচুলাহীন। আপনি হচ্ছেন স্যার চালচুলাহীন লোক। এখানে কেন, আপনাকে আফ্রিকার জঙ্গলে ট্রান্সফার করলেও গিয়ে থাকতে পারবেন। হে হে হে…। আফ্রিকার জঙ্গলের কথা বলছি স্যার এজন্য, রেল তো ব্রিটিশদের কারবার। ব্রিটিশরাই তো ভারতবর্ষে, আফ্রিকায় আরো কোনো কোনো দেশে রেল চালু করেছে। একসময় তো ব্রিটিশ রাজত্বে সূর্য অস্ত যেত না। তখন এই রেলটা ওরা চালু করেছে। যদি ব্রিটিশ আমলে আপনি এই বয়সী থাকতেন বা রেলওয়েতে চাকরি করতেন তবে স্যার আপনাকে নির্ঘাত আফ্রিকাতে ব্রিটিশরা পাঠাতই। আপনিও নির্বিঘেœ গিয়ে থাকতে পারতেন। সংসার পিছুটান নাই, চালচুলাহীন মানুষ। হে হে হে…
কথাটা মন্দ বলেনি মোস্তফা। আসলেই তো আমি চালচুলোহীন মানুষ। বিয়েশাদি করিনি। সংসার বলতে কিছু নেই। প্রকৃত অর্থে আপন বলতেও কেউ নেই। মানুষ হয়েছি এতিমখানায়। অতি গরিব ঘরের ছেলে। জন্মের সাত মাস পর বাবা মারা গিয়েছেন, মায়ের হলো যক্ষ্মা। পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। তখনকার দিনে যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই। মৃত্যু অবধারিত। মা মারা গিয়েছিলেন আমার যখন বছরদেড়েক বয়স। কে প্রতিপালন করবে? চারপাশের সবাই গরিব মানুষ! মা মারা যাওয়ার পর যে খালা আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন তার চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে। স্বামী গরিব স্কুলমাস্টার। কোনো কোনোদিন বাড়িতে চুলা জ্বলে না। বাধ্য হয়ে সেই খালুই ব্যবস্থা করে আমাকে দিয়েছিলেন এতিমখানায়। এতিমখানার ছেলেদের সঙ্গে বড় হয়েছি আমি। এতিমখানার নিয়মমতো পড়াশোনা করেছি। বিএ পাশ করার পর তারাই রেলের চাকরি পাইয়ে দিয়েছিল।
সেই খালা খালু কবে মারা গেছেন! খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই নেই। এতিমখানায় তারা কেউ কোনোদিন আমাকে দেখতেও আসত না। আমার যারা আপনজন তারা সবাই ওই এতিমখানার। এক বৃদ্ধা মহিলা আমাদের বয়সী শিশুদের দেখাশোনা করতেন। তাঁর কথা মনে পড়ে। এতিমখানার সুপার ছিলেন হাবিব সাহেব, তাঁর কথা মনে পড়ে। খুবই দয়ালু টাইপ ভালো মানুষ ছিলেন। এতিমখানার ছেলেরা ছিল তাঁর নিজের ছেলের মতো।
চাকরিতে ঢোকার পর ছুটিছাটা পেলেই যেতাম সেই এতিমখানায়। হাবিব সাহেব মারা যাওয়ার পর, বন্ধুবান্ধবরা ওখান থেকে বেরিয়ে যে যার মতো জীবন গুছিয়ে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে সেখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে ক্বচিৎ কখনো যোগাযোগ হয়, হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায় কোথাও কোথাও। ব্যস, এটুকুই।
এতবড় পৃথিবীতে সর্ব অর্থেই আমি আসলে একা। এই একা জীবনেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিন কেটে যাচ্ছে।
এবার যখন ট্রান্সফারের কথা উঠল, বনপাহাড়পুর নাম শুনে কেউ রাজিই হলো না আসতে। বলল, দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দেব তাও ওরকম স্টেশনে যাব না। টাকা-পয়সা খরচা করেও এখানে ট্রান্সফার হয়ে আসা ঠেকাল কেউ কেউ। তারপর আমার পালা। স্যারকে কারা কারা যেন বুদ্ধি দিলো, আজগরকে পাঠান স্যার। ওর তো কোনো অসুবিধা নেই। ঝাড়া হাতপায়ের মানুষ। যেখানে পাঠাবেন ওখানেই যাবে।
আসলেই তাই। আমার কোনো চয়েজ নেই। যেখানে পাঠাবে সেখানেই যাব। বরং এক-দু বছর পর পর ট্রান্সফার আমার ভালোই লাগে। কত নতুন নতুন জায়গা, কত নতুন নতুন মানুষ। বনপাহাড়পুরে না এলে মোস্তফার মতো চরিত্র পেতাম কোথায়! নামের মতোই বনপাহাড় ঘেরা ছবির মতো সুন্দর জায়গাটা কি দেখা হতো! এ রকম জায়গায় কি কখনো থাকা হতো!
মোস্তফা চলে যাওয়ার পর বিকেলটা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। কোয়ার্টার ফাঁকা, স্টেশন ফাঁকা। স্টেশনের বোবা বুড়িটা কোন ফাঁকে চলে গেছে। দোকান বন্ধ করে প্রায় একই সময়ে চলে গেল মিনহাজ আর হারুন। অদ্ভুত এক পরিবেশ। এতবড় একটা জায়গায় কোথাও লোকজন নেই। আমি, শুধু আমি। একা আমি।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। স্টেশনের পেছনে মাটির রাস্তার ধারে মিনহাজ হারুনের দোকান। গাছপালা ঝোপঝাড় আর নিষ্ফলা জমি। কয়েক কিলোমিটার জায়গা পড়ে আছে এই অবস্থায়। লোকবসতি নেই। লালচে ধরনের শক্ত মাটি। ফসল ফলে না। কিছু বুনো ঝোপঝাড়, গাছপালা। আর স্টেশনের সামনে রেললাইন। রেললাইন ছাড়িয়ে কয়েক কদম পর থেকেই শুরু হয়েছে বন। শুধুই গজারি গাছের বন। বনের ভেতরে ভেতরে হঠাৎ একটুখানি মাঠ, একটুখানি খোলা জায়গা। ডোবানালাও আছে। তারপর সমতল থেকে উঁচু হতে শুরু করেছে জমি। গাছপালা ঝোপঝাড় ধীরে ধীরে উঠেছে ওপর দিকে। টিলা নাকি ছোট পাহাড়! তেমন উঁচু না, গাছপালা ভর্তি।
এ রকম নির্জনতা জীবনে দেখিনি আমি। দেখা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি যে এরকম বিশাল একটি এলাকায়, আজ এই শেষ হয়ে আসা বিকেলে আমি ছাড়া কোনো মানুষ নেই।
চৈত্র মাসের হাওয়া বইছে। গাছের ডালে ডালে দিনের শেষ ডাক ডেকে নিচ্ছে পাখিরা। এক গাছ থেকে উড়ে যাচ্ছে আরেক গাছে। দূর থেকে নিজের গাছের দিকে উড়ে আসছে কোনো কোনো পাখি। একটা শেয়াল দৌড়ে গেল রেললাইনের এপাশ থেকে ওপাশে। ঝিঁঝিঁ তো ডাকছেই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমে। দিনের শেষ আলোটুকু কমে আসছে দ্রুত।
কী অদ্ভুত পরিবেশ!
খোলা প্ল্যাটফর্মে ধীরে ধীরে পায়চারি করছি। কলেজজীবনে পড়া, নাকি স্কুলজীবনের শেষদিকে পড়েছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা চাঁদের পাহাড়। শংকর নামের এক যুবক রেলওয়ের চাকরি নিয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার নির্জন এক স্টেশনে। আমার জীবন দেখছি সেই শংকরের মতো।
তারপরই একটা কথা মনে করে চমকে উঠলাম। এক রাতে ঘুম ভেঙে শংকর দেখেছিল তার বিছানার সামনে ফণা তুলে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত, বিশাল লম্বা সাপ ব্ল্যাকমাম্বা।
বনপাহাড়পুরে কি সাপ নেই?
শেয়াল খাটাশের কথা বলল মোস্তফা, সাপের কথা তো বলল না!
এরকম জায়গায় সাপ না থাকে কী করে?
আমার ধারণা সাপ আছে। অবশ্যই আছে। ইঁদুর থাকলে সাপ থাকবেই। ইঁদুর হচ্ছে সাপের প্রিয় খাদ্য। মোস্তফা সাপের কথা ইচ্ছা করেই বলেনি। ভূতপ্রেতে ভয় না পেলেও সাপে আমি ভয় পেতে পারি বোধহয় একথা ভেবে বলেনি। সাপ ভয় পায় পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই।
শেষ বিকেল আর সন্ধ্যাটা আমি খুবই উপভোগ করলাম। পূর্ণিমা গেছে ক’দিন আগে। পূর্ণিমা সন্ধ্যাটাও কাটিয়েছিলাম চমৎকার। সঙ্গে অবশ্য মোস্তফা ছিল। তাকে নিয়ে অনেকটা রাত পর্যন্ত বেড়িয়েছি এদিকটায়। বনের ভেতর খোলা একটা মাঠেও গিয়েছিলাম। কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় ব্রিটিশদের তৈরি করে যাওয়া বাঁধানো বেঞ্চ আছে। ওরকম পাঁচটা বেঞ্চ দূরে দূরে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলাটা। ওখানটায় গিয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। আমি বসে আর একপাশে দাঁড়িয়ে মোস্তফা তার বকবকানি চালাচ্ছে। আমার কানে ঢুকছে না কিছুই। আমি আকাশ দেখছি, চাঁদ দেখছি। জ্যোৎস্নায় অপূর্ব হয়ে থাকা বনপাহাড় দেখছি।
আজ চাঁদ উঠবে দেরিতে।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কোয়ার্টারে ফিরলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, আজ ইলেকট্রিসিটি নেই। প্রায়ই থাকে না। দিনের বেলা তো থাকেই না, মাঝে মাঝে আসে। রাতের বেলাও একই অবস্থা। এজন্য হাতের কাছে মোমবাতি আর একটা হারিকেন রেখে দিয়েছে মোস্তফা। ম্যাচ রেখে দিয়েছে।
নিজের রুমে ঢুকে প্রথমে মোম জ্বালালাম, তারপর হারিকেন। কেরোসিন ভরা আছে হারিকেনে, চিমনিও পরিষ্কার। হারিকেনের আলোয় খাওয়া-দাওয়া সেরে দশটার দিকেই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখনো পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি আসেনি।
না আসুক। এক ঘুমেই তো রাত পার হবে। ইলেকট্রিসিটির দরকার কী! হারিকেনও নিভিয়ে দিলাম।
এক ঘুমে রাত কাটল না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। চৈত্র মাসের রাত। গরম পড়ে গেছে। পায়ের দিককার জানালা খোলা রেখেছি। ভালোই হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। একটুখানি জ্যোৎস্না এসেও ঢুকেছে। জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরেটা খুব ভালো লাগল। মনে হলো ঘুম যখন ভেঙেই গেছে, বিছানায় শুয়ে থেকে আর কী হবে! যাই একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি করি। এরকম মধ্যরাতে চাঁদের আলোয় একা একজন মানুষ নির্জন এক স্টেশনে, অনুভূতিটা কেমন হয় দেখি একটু।
তখনো পর্যন্ত অন্য কিছু ভাবা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি কোন দৃশ্য রেললাইনে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল…
প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি সত্যি অপূর্ব পরিবেশ। ক্ষয় হয়ে আসা চাঁদের আলোয় ঝিমঝিম করছে চারদিক। ঝিঁঝিঁর ডাক আর হাওয়ার শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। কোথাও ডাকে না একটাও রাতপাখি। শেয়াল খাটাশের ডাক তো দূরের কথা, চলাচলের শব্দও নেই। অর্থাৎ ভয়াবহ নির্জনতা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত পরিবেশ, অদ্ভুত এক অনুভূতি। আমার তো ডরভয় বলে কিচ্ছু নেই। চৈত্র রাতের হাওয়াটা ভালো লাগছে, জ্যোৎস্না আর নির্জনতা ভালো লাগছে। রাত ক’টা বাজে জানিও না। একটু হাঁটাহাঁটি করে রুমে ফিরলে আবার হয়তো ঘুম আসবে।
হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় এলাম। ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়েছে বেঞ্চটায়। ইচ্ছে হলো ওখানে গিয়ে একটু বসে থাকি। অনুভব করি এই অপার্থিব নির্জনতা।
বসার মিনিট দুতিনেক পরই চোখে পড়ল দৃশ্যটা।
বেঞ্চে বসেই প্রথমে তাকিয়েছিলাম আকাশের দিকে। ক্ষয় হওয়া চাঁদ তেমন প্রখর না। জ্যোৎস্নাও কেমন ম্যাটম্যাটে। হাওয়া বইছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে। মøান জ্যোৎস্না আটকে দিয়েছে বনপাহাড়ের গাছপালা। গাছপালার মাথার ওপর দিকে জ্যোৎস্না, তলায় আবছা অন্ধকার।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি সব। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। অপূর্ব অনুভূতি। এরকম অনুভূতি জীবনে কখনো হয়নি। এমন একটা জায়গায় রাতদুপুরে আমি একা, সম্পূর্ণ একা। নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।
প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকটায় বেশ কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছ। দুটো বেঞ্চ আছে পাশাপাশি। গাছগুলোর পেছনে অচেনা ঝোপঝাড়, বুনোফুল ফুটে থাকে। একটা জলাভূমি আছে অনেকখানি জায়গা নিয়ে। জায়গাটা তেমন পরিচ্ছন্ন না। আমার ভালো লাগে না। ওদিকটায় গিয়ে কখনো বসিনি। ঘুরেটুরে দেখেছি সব। বসা হয়নি।
আমার ভালো লাগে এদিকটা। একলা একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাল ফুলে ভরে আছে গাছটা। তলায় একটা বেঞ্চ। পেছনে বেশ বড় খোলা মাঠ, ছবির মতো। এখানটায় এলেই, বেঞ্চটায় বসলেই মন অন্যরকম হয়ে যায়।
সেই অন্যরকম মন নিয়ে তাকিয়েছি প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকটায়। তাকিয়ে চমকালাম। একজন কাউকে যেন দেখা যাচ্ছে! পরিষ্কার না, আবছা মতন দেখতে পাচ্ছি প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে আছে, নাকি হাঁটছে!
হ্যাঁ, হাঁটছেই তো! অতি ধীরপায়ে হাঁটছে।
এত রাতে কে এলো স্টেশনে? কে হাঁটছে? দিনের বেলাই যেখানে লোক থাকে না, লোক দেখা যায় না, সেখানে এই রাতদুপুরে কে এলো?
সত্যি কি কাউকে দেখছি, নাকি আমার চোখের ভুল?
চোখে কয়েকটা পলক ফেললাম, একটু কচলালাম চোখ। মাথা একটু ঝাঁকালামও। পরিষ্কার চোখে তাকালাম ওদিকটায়।
না, ঠিকই দেখছি। একদমই ঠিক। একজন কেউ ধীর পায়ে প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় হাঁটছে।
কে?
লোকটা কে?
এত রাতে কোত্থেকে এলো স্টেশনে?
লোকটা তারপর রেললাইনে নামল। প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইন একটু নিচে। সে যেন একটু কষ্ট করেই নামল। মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ মানুষরা যেভাবে নামে।
এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। রেললাইনের দুপাশেই গাছপালা, মাঝখানটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা জায়গায় চাঁদের আলো কিছুটা আছে। লোকটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একবার খানিকটা এদিক গেল, আরেকবার ওদিক। যেন কিছু খুঁজছে। কিন্তু তার মাথাটা দেখা যাচ্ছে না। শুধু শরীরটা। মাথাটা যেন নেই…
ব্যাপারটা কী? লোকটাকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু তার মাথা দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া খুঁজছেই বা কী? যেন খুবই মূল্যবান কিছু রেললাইনে হারিয়ে ফেলেছে সে, খোঁজার ভঙ্গিটা এমন।
বাস্তবিকই দৃশ্যটা কি আমি দেখছি?
নাকি চোখের ভুল?
বিভ্রম?
নাকি মাঝরাতে আমার ঘুমই ভাঙেনি! কোয়ার্টার থেকে আমি বেরই হইনি। আমি আছি ঘুমের ভেতর। এসবের কোনোটাই বাস্তবে ঘটছে না। আমি আসলে স্বপ্ন দেখছি।
তা-ই বা হয় কী করে!
জীবনে কখনো তো এমন হয়নি।
আমি আবার চোখ কচলালাম, মাথা দোলালাম, চোখে পটপট করে পলক ফেললাম।
না, সব ঠিক আছে।
আমি ঘুমিয়ে নেই। জেগে আছি, স্টেশনের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলার বেঞ্চে বসে আছি।
আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য শরীরে একটা চিমটিও কাটলাম। চিমটির ব্যথা বেশ ভালোই পেলাম।
না, স্বপ্ন না। বাস্তব। পুরো ব্যাপারটাই বাস্তব। অতি বাস্তব।
আমি তারপর উঠে দাঁড়ালাম। বুঝতে হবে, ব্যাপারটা আমাকে বুঝতে হবে। লোকটা কে? তার মাথা দেখতে পাচ্ছি না কেন? রেললাইনে এরকম রাতদুপুরে কী খুঁজছে সে!
আমি দ্রুত পায়ে লোকটার দিকে হাঁটতে লাগলাম।
যত কাছাকাছি হই, অবাক হওয়াটা বাড়ছে। সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিস্ময়।
আসলেই লোকটার মাথা নেই। হাত পা শরীর সবই কাঁধ পর্যন্ত। তারপর আর কিছু নেই। অর্থাৎ মাথাটাই নেই। মাথাহীন শরীরে রেললাইনের এদিক যাচ্ছে সে, ওদিক যাচ্ছে। কী যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে, একটু যেন দিশেহারা ভঙ্গিতে খুঁজছে।
এ কী করে সম্ভব?
মাথাহীন একজন মানুষ বেঁচে আছে কী করে? তার শরীর চলছে কী করে? সে দিব্যি হাঁটছে, হারিয়ে যাওয়া জিনিস খোঁজাখুঁজি করছে!
কী করে সম্ভব?
এ তো অবিশ্বাস্য দৃশ্য!
আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এরকম একজন মানুষ, যার মাথা নেই, হাঁটাচলা করছে এরকম রাতদুপুরের নির্জন স্টেশনে, তাকে দেখে মোটেই ভয় লাগছে না আমার। সে মানুষ না ভূত, বুঝতেই পারছি না। বা ওরকম কোনো ভৌতিক অনুভূতিই আমার হচ্ছে না। যেন আমি আছি এক ঘোরের মধ্যে। যেন ডরভয়ের অনুভূতিটাই আমার নেই।
লোকটি যেখানে খোঁজাখুঁজি করছে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে মানুষ যেভাবে কোনো কিছু খোঁজে, ভঙ্গিটা তেমন, আমি প্রায় তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে রেললাইনে, আমি প্ল্যাটফর্মে।
এ সময় লোকটা, লোকটা না বলে মু-ুহীন লোকটা, মাথাহীন দেহটা যেন আমাকে দেখতে পেল। মাথা থাকা মানুষ যেভাবে চোখ তুলে কারো দিকে তাকায় সেই ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুরল দেহটা। কথা বলে উঠল। খুবই কাতর শব্দে বলল, দাদা, আমার মাথাটা দেখেছেন? মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না। মাথাটা যে কোথায় গেল?
কাঁধের ওপর থেকে কারো যদি মাথাটাই না থাকে তাহলে তার মুখও থাকার কথা না। চোখ কান গাল কপাল কিছুই থাকার কথা না। গলা নেই, শব্দও বেরোবার কথা না, তবু সে কথা বলছে। শব্দ করেই বলছে। গলার আওয়াজ পরিষ্কার। তবে কাতর, করুণ। নিজের মাথা হারিয়ে খুবই চিন্তিত এবং দিশেহারা সে।
আমি কী জবাব দেব কিছু বুঝতে পারছি না।
দেহটা কাতর অনুনয়ের গলায় বলল, আসুন না, আমাকে একটু সাহায্য করুন না! মাথাটা একটু খুঁজে দিন না। মাথা ছাড়া ভারি কষ্ট হচ্ছে। চোখে দেখতে পাচ্ছি না কিছু, কানে শুনতে পাচ্ছি না। মুখটা নেই, কথা বলতে পারছি না। একটু সাহায্য করুন দাদা। একটু দয়া করুন আমাকে। মাথাটা একটু খুঁজে দিন।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইনে নামলাম। সত্যি সত্যি ভদ্রলোকের মাথাটা খুঁজতে লাগলাম। অন্য কোনো অনুভূতি আমার মধ্যে তখন কাজই করছে না। ব্যাপারটা যে একেবারেই অবাস্তব, এ যে কিছুতেই সম্ভব না, মাথাহারা একজন মানুষের যে বেঁচে থাকাই সম্ভব না, হাঁটাচলা কথা বলা যে সম্ভব না, এসব আমার মনেই হচ্ছে না। আমিও তার মতো করে তার মাথাটা খুঁজতে লাগলাম। যেন তাকে সাহায্য করা খুবই জরুরি। তার মাথাটা খুঁজে বের করা জরুরি।
আশ্চর্য ব্যাপার, মাথাটা একসময় আমরা খুঁজে পেলাম। এই ফাঁকে কতটা সময় কেটে গেছে মনে নেই। রেললাইনের ওপাশটায়, বনের ধারে দেখি একটা মাথা পড়ে আছে। গলার ওপর থেকে পুরো মাথাটা। যেন অতি যতেœ মাথাটা কেটে কেউ ফেলে রেখেছে ওখানে। একটুখানি জ্যোৎস্না পড়েছে ঠিক কাটা মাথাটার ওপর। ফলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মাথায় হালকা কিছু চুল, কপালের দিক থেকে টাক পড়ে আসছে। চোখ দুটো খোলা, মুখটা বন্ধ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। যেখানে পড়ে আছে মাথাটা, জায়গাটা ভেজা ভেজা। বুঝলাম রক্ত। ওইটুকু জ্যোৎস্নায় রক্তের রং বোঝা যাচ্ছে না।
মাথা পেয়ে দেহটা খুবই উৎফুল্ল। লাফ দিয়ে গেল মাথাটার কাছে। হারিয়ে যাওয়া সন্তান খুঁজে পেলে মা যেমন দু-হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে, কোলে নেয়, ঠিক সেই ভঙ্গিতে মাথাটা তুলল সে। আনন্দে ফেটেপড়া গলায় বলল, এই তো পেয়েছি! এই তো আমার মাথাটা!
দু-হাতে মাথাটা কাঁধের ওপর বসাল সে। বসাল না বলে সেট করল বলা ভালো। দেহ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া কাদামাটির মূর্তি যেভাবে মূর্তির দেহে স্থাপন করা হয় ঠিক সেভাবে স্থাপন করল। তারপর আর কোনো কথা না বলে দ্রুত হেঁটে বনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। কতটা সময় কেটে গেছে মনে নেই। কখন সকাল হলো টেরই পেলাম না। কখন কোয়ার্টারে ফিরলাম মনেই করতে পারছি না।
মোস্তফা এলো বিকেলবেলা। মাত্র ট্রেন গেল আর সে এলো। খুবই আনন্দে আছে বোঝা গেল। আমি কোয়ার্টারের বারান্দায় হাতলঅলা চেয়ারটায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছি। কাল রাতের ঘটনা কিছুতেই মন থেকে, চোখ থেকে সরছে না। ঘুরেফিরে শুধুই মনে হচ্ছে এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনাও পৃথিবীতে ঘটে? মাথা নেই এমন একটি দেহ রাতদুপুরে রেললাইনে তার মাথা খুঁজছে! কাটা মাথা পেয়ে সেটা জায়গামতো সেট করে দ্রুত হেঁটে বনের ভেতর মিলিয়ে গেল!
কী করে সম্ভব?
অন্য কেউ এরকম কোনো ঘটনা বললে কিছুতেই আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এ তো বিশ্বাস না করে উপায় নেই! ঘটনা অন্য কেউ আমাকে বলেনি। ঘটেছে আমার চোখের সামনে। আমি নিজেও সেই দেহের সঙ্গে তার মাথা খুঁজেছি। সে চলে যাওয়ার পর সকাল পর্যন্ত আবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম রেললাইনে।
মোস্তফাকে কি ঘটনাটা বলা ঠিক হবে?
সে কি বিশ্বাস করবে, নাকি হাসাহাসি করবে? বলবে, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন না, তারপরও বলছেন ভৌতিক কাহিনি?
তার সেই অদ্ভুত হাসিটা হাসবে কথা শেষ করে। হে হে হে…
মেয়ের বাড়ি থেকে মোস্তফা আমার জন্য পাটালি গুড় আর মুড়ি নিয়ে এসেছে। একটা প্লেটে মুড়ি আর বড় একটুকরো গুড় দিয়ে বলল, খান স্যার, খান। মুড়িটা আজ সকালেই ভাজা হয়েছে, গুড়টাও তাজা। খেয়ে দেখেন স্যার, অমৃত অমৃত। হে হে হে…
মোস্তফা নিজেও এক প্লেট মুড়ি আর একটুকরো গুড় নিয়েছে। তার বসার একটা টুল আছে। টুলে বসে গুড়মুড়ি খেতে লাগল। এক ফাঁকে তীক্ষè চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে স্যার?
আমি গুড়মুড়ি চিবাতে চিবাতে উদাস গলায় বললাম, আমাকে দেখে তোমার মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে?
জি, মনে হচ্ছে স্যার।
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে আপনি খুবই চিন্তিত। কী যেন ভাবছেন।
ঠিকই বলেছ। ভাবছি।
কী ভাবছেন স্যার? না মানে আপনার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে আমাকে বলতে পারেন। মনের কথার মুশকিলটা হলো কী স্যার, ওসব মনের মধ্যে যত চেপে রাখবেন তত সমস্যা। অন্য কাউকে বললে মন হালকা হয়। মনের ভার কমে যায়। এখানে তো স্যার আপনার আপন বলতে কেউ নাই। এই আমি আছি। আপনার পিয়ন চাপরাশি, বাবুর্চি, কেয়ারটেকার যাই বলেন সবই আমি। ভাই বন্ধু আপনজন যদি বলেন, তাও আমি। ঠিক কিনা স্যার? হে হে হে…
ঠিক।
তাহলে স্যার আমাকে বলে ফেলুন। মনটা হালকা হবে। আর যদি খুবই গোপন কিছু হয় তবে স্যার বলতে না চাইলে বলবেন না।
না, গোপন কিছু না।
অর্থাৎ আপনি চাইলে বলতে পারেন?
পারি।
তাহলে স্যার বলে ফেলুন। তবে স্যার আমি কিছুটা অনুমান করতে পারছি।
কী অনুমান করছ, বলো তো?
অনুমান করছি, কালরাতে আপনি কিছু দেখে ফেলেছেন।
মোস্তফার কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে চমকালাম। একমুঠ মুড়ি মুখে দিলাম, এক কামড় গুড় মুখে দিলাম।
তোমার অনুমান ঠিক।
কী দেখেছেন তাও আমি বলে দিতে পারি।
আমি চমকালাম। সত্যি?
সত্যি স্যার। রাতদুপুরে আপনি নিশ্চয় কোয়াটার থেকে বেরিয়ে ছিলেন। প্ল্যাটফর্মের উত্তর দিকটায় একটা লোককে দেখেছেন, যার শুধু দেহটা আছে মাথাটা নেই। রেললাইনে সে তার মাথা খুঁজছিল। একসময় লাইনের ওপাশে মাথাটা খুঁজে পেয়ে, জায়গামতো মাথা বসিয়ে বনের ভেতর উধাও হয়ে গেছে।
ঠিক, একদম ঠিক। এ ঘটনাই ঘটেছে।
এ কথাটাই আপনাকে বলতে গিয়ে আমি স্যার সেদিন বলিনি। আপনি বলেছেন আপনার ভূতপ্রেতে বিশ্বাস নাই, ডরভয়ও কম। এজন্যই বলি নাই। আপনি কি স্যার খুবই ভয় পেয়েছেন?
না, ভয় সেভাবে পাইনি। পুরো ঘটনাই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। এ কী করে সম্ভব!
সম্ভব স্যার। এই স্টেশনে যত স্টেশন মাস্টার এসেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় চোখের সামনে এ ঘটনা দেখেছেন। ওরকম মধ্যরাতে, হালকা জ্যোৎস্নায়। এই ভয়েই এই স্টেশনে স্যার বেশিদিন কেউ থাকে না। হে হে হে…
তুমি কোনোদিন দেখোনি?
তিন-চারবার দেখেছি স্যার। দূর থেকে। সামনে যাইনি। তবে অন্য স্টেশন মাস্টাররাও স্যার দূর থেকেই দেখেছেন। সামনে কেউ যাননি।
আমি গিয়েছিলাম।
মোস্তফা একেবারে আঁতকে উঠল। বলেন কি? ওই জিনিসের সামনে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে, আমাকে তার মাথা খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ করেছে। আমি তার সঙ্গে তার মাথা খুঁজেছিও।
মোস্তফা আকাশ থেকে পড়ল। বলেন কী স্যার?
আমি মিথ্যে বলি না।
তা জানি স্যার, তা জানি। আর এই ঘটনা নিয়ে মিথ্যা বলার কী আছে? তবে দয়ালবাবু লোক ভালো। কারো কোনো ক্ষতি করেন না।
দয়ালবাবুটা কে?
ওই তো স্যার, যিনি তাঁর মাথা খোঁজেন।
ঘটনাটা খুলে বলো তো?
মোস্তফা মুড়ি মুখে দিলো, গুড়ে কামড় দিলো। গুড়মুড়ি চিবিয়ে, গিলে বলল, অনেক অনেক বছর আগের কথা স্যার। ব্রিটিশ আমল। দয়ালবাবু ছিলেন এই স্টেশনের মাস্টার। আপনার মতো অবস্থা স্যার। বিয়েশাদি করেননি, ঘরসংসার নেই। একা একা স্টেশনে থাকতেন। একটু অন্যমনস্ক টাইপের লোক। বয়সও হয়েছিল। বিকেলের ট্রেনটা আসছে দেখার পরও কী কাজে যেন রেললাইনের ওপাশটায় যাচ্ছিলেন, দৌড় দিয়েই যাচ্ছিলেন, পায়ে পা বেঁধে পড়ে গেলেন। কাটা পড়লেন এমন ভাবে, দেহ একদিকে, মাথা আরেক দিকে। শরীর থেঁতলে যাওয়া, মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া, এসব কিছু না। শুধু দেহ থেকে মু-ুটা আলাদা। তারপর নতুন স্টেশন মাস্টার এলেন, কয়েক মাস পর তিনি প্রথম এক জ্যোৎস্নারাতে দেখলেন, মাথা নেই এমন একটা দেহ রেললাইনে কী যেন খুঁজছে। ওই যে স্যার শুরু হলো, আশি-নব্বই বছর ধরে ওই কারবারই চলছে। কোনো কোনো জ্যোৎস্না রাতে দয়ালবাবু তাঁর মাথা খোঁজেন। মাথা পাওয়ার পর জায়গামতো লাগিয়ে বনের ভেতর উধাও হয়ে যান।
এবার আর হে হে হে হাসিটা হাসল না মোস্তফা।