রিজিয়া রহমানের শিল্পীসত্তার স্বরূপ

আমার প্রথম শৈশবটি কেটেছে কোলকাতায়। ব্রিটিশ ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক শহর ছিল সেটি। স্বভাবতই আমাদের শিক্ষিত পরিবারটি ছিল বেশ আধুনিক। আমার মা বাংলাদেশের বিশাল নদী পদ্মাপাড়ের অভিজাত এক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও সেই চল্লিশের দশকে ছিলেন কোলকাতার আধুনিকা। বাসে-ট্রামে চড়তেন। সিনেমা-থিয়েটার দেখতেন। দোকান থেকে নিজেই কেনাকাটা করতেন। বইপড়া ও গান শোনার নেশা ছিল তাঁর। তখনকার জনপ্রিয় গানের রেকর্ড কিনে আনতেন (বাড়িতে একটা গ্রামোফোন ছিল আমাদের), আলমারিতে ছিল মায়ের সংগ্রহের বই। ‘বসুমতী’, ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘দেশ’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলোর নিয়মিত গ্রাহিকা ছিলেন আমার মা। গল্প উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠিকা ছিলেন। (মায়ের আলমারির বই, পরে আমার পড়ার তৃষ্ণা মিটিয়েছে।)
বাবারও ছিল পড়ার অভ্যাস। বড় হয়ে দেখেছি, রোগী আর হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও, প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর কিছু পড়তেন, এক সময় বেহালা বাজাতেন (ডাক্তারী পেশা তাঁর এই সুর চর্চা প্রায় রুদ্ধই করে দেয়)। মায়ের কাছে শুনেছি, তিনি চমৎকার বাঁশিও বাজাতেন।
এমন একটি আলোকিত শিল্প অনুরাগী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা শিল্প-সাহিত্যকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আমার বড় ভাই চমৎকার ছবি আঁকতেন, লেখার দক্ষতাও ছিল। ডাক্তারী পড়বার সময় বেশ কিছু ভাল ছোটগল্প লিখেছিলেন। আমার মামাবাড়ি থেকে হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের হতো, ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা আমার এক মামা ছিলেন সম্পাদক। সেই পত্রিকায় আমার, আমার বড় ভাইয়ের ও মেজ বোনের লেখা প্রকাশ পেত। আমার ছোট দুই ভাইয়ের ছিল গিটার বাজানোর দক্ষতা। সেজভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় কলেজের অনুষ্ঠানে গিটার বাজাত।
উদ্ধৃত অংশটি সদ্যপ্রয়াত কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের দীর্ঘ আলাপচারিতার অংশবিশেষ। লেখক হয়ে-ওঠার গল্প এবং সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে একজন আধুনিক লেখক হয়ে-ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রসঙ্গে লেখক এই কথাগুলো বলেছিলেন। বাবা-মা, ভাইবোন, এমনকি মাতৃকুলের পরিবারের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, এই ইতিহাস গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের। এই সময়কালে কলকাতাকেন্দ্রিক মুষ্টিমেয় মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আধুনিক জীবনচেতনা ও বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার মূলধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল। বাঙালি নারী, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম নারীকে লেখক হয়ে-ওঠার জন্য যেসব ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, রিজিয়া রহমানকে ঠিক সেরকম কোনো প্রতিকূলতা বা বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং তাঁর লেখক হওয়ার সমস্ত পরিবেশ প্রস্ত্তত হয়েছিল তাঁর জন্মের পূর্বেই। তাই মাত্র দশ বছর বয়সে, সম্ভবত পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তিনি, লিখে ফেলেছিলেন একটি কবিতা। বালক-বালিকা বয়সে কবিতা লিখলে সবাই সাধারণত লুকিয়ে রাখে বা ছিঁড়ে ফেলে, কিন্তু রিজিয়া রহমানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। প্রথম লেখা কবিতাই বাড়ির সবাইকে একে একে শুনিয়েছেন; কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি কবিতাটি তাঁর লেখা। আর এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে দ্বিতীয় আর একটি কবিতা লিখতে হয়। এবার আর কেউ অবিশ্বাস করেনি, বরং পরিবারের সবাই অভিনন্দন জানিয়েছে। এরপরেই চলে একের পর এক কবিতা লেখার হাতমকশো। পরিবারের মধ্যে কবিখ্যাতি বেড়েই চলেছে এবং বড়দের কাছে বিশেষভাবে মর্যাদাবান হয়ে-ওঠার গৌরবও তৈরি হয় বালিকামনে। বড়রা যখন কবি বলে ডাকত বা ঠাট্টা করত তখন বরং রিজিয়া রহমান গৌরববোধ করতেন। ধীরে ধীরে লেখাপড়ার পাশাপাশি কবিতা লেখা তাঁর স্বভাবের অংশ হয়ে ওঠে। এমনকি পরিবারে কোনো অতিথির আগমন ঘটলে নিজের কবিতার খাতা থেকে কবিতা পড়ে শোনার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে হতো।
রিজিয়া রহমান দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেন যে, পূর্ব সিদ্ধান্ত বা প্রস্ত্ততি নিয়ে তিনি লেখক হননি। লেখক হওয়ার ইচ্ছা ও সম্ভাবনা শিশুকালেই তৈরি হয়েছিল। শৈশবে তাঁর ডাক্তার পিতা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? রিজিয়া রহমান প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ডাক্তার। ডাক্তার হলে মানুষের সেবা করা যায়। ডাক্তার হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। রিজিয়া রহমান ছিলেন দুর্বল কৃশকায়। তাই পিতা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর কী হতে চাও? এবার রিজিয়া রহমানের জবাব ছিল, আমি লেখক হতে চাই। বই লিখতে চাই। লেখক হওয়ার প্রতিভা রিজিয়া রহমান জন্মসূত্রেই পেয়েছেন এবং তাঁর প্রতিভা বিকাশের প্রধান শক্তি পারিবারিক পরিবেশ। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘প্রতিভা স্ফূরণের প্রথম স্তরে পারিবারিক এই পরিবেশটি না পেলে ষাটের দশকের আধুনিক লেখক হয়ে উঠতাম কি না সন্দেহ।’
কবিতা লেখার পাশাপাশি বই পাঠের খিদেও প্রবল ছিল রিজিয়া রহমানের। বাড়িতে প্রচুর বই ছিল এবং পরিবারের সকল সদস্যের বই পাঠের অভ্যাস ছিল। বইপাঠের প্রতি রিজিয়া রহমানের প্রবল অনুরাগ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জন্মেছিল। বইয়ের প্রতি প্রথম অনুরাগের প্রকাশ ঘটে নিতান্তই শিশুবয়সে। লেখক শামসুন্নাহার মাহমুদের স্বামী ছিলেন রিজিয়া রহমানের পিতার সহকর্মী এবং তাঁদের বাসাও ছিল পাশাপাশি। রিজিয়া রহমান শামসুন্নাহার মাহমুদকে খালাম্মা বলে ডাকতেন এবং খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন। শামসুন্নাহার মাহমুদের ব্যক্তিগত বইয়ের লাইব্রেরি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাঁর অন্য ভাইবোনরা যখন খেলায় মগ্ন, তখন তিনি শামসুন্নাহার মাহমুদের বইয়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে শুধু বই দেখতেন। কারণ তখন পর্যন্ত তিনি ভালোভাবে পড়তে শেখেননি। কিন্তু বইয়ের প্রতি তাকিয়ে থাকতে তাঁর ভীষণ ভালো লাগত। বইয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখে শামসুন্নাহার মাহমুদ নিজেই একদিন রিজিয়া রহমানের হাতে বই তুলে দিয়েছিলেন। বইটি নিয়ে তিনি জানালার ধারে বসে পড়লেন। বইয়ের পৃষ্ঠা উলটে একটি ছবি দেখেন, একটি লোক উলটে পড়ে যাচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি লোক। শিশুপাঠ্য বই পড়া থাকলেও বড়দের বই পড়ার বয়স তখনো হয়নি বিধায় বইটিতে কী লেখা আছে তা পড়তে পারেননি। পড়তে না পারা এবং বুঝতে না পারার ব্যর্থতায় কেঁদে ওঠেন। ব্যথা পেয়ে কেঁদে উঠেছে ভেবে শামসুন্নাহার মাহমুদ ছুটে আসেন। রিজিয়া রহমান কান্না থামিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফুঁপিয়ে কান্না আর থামেই না। শামসুন্নাহার মাহমুদের ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র মামুন প্রথম বিষয়টি লক্ষ করেন। তিনি রিজিয়া রহমানকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বইটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। তখন থেকেই রিজিয়া রহমানের বইয়ের প্রতি নেশা। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ঠাকুরমার ঝুলি ও হ্যান্স অ্যান্ডারসনের রূপকথা পড়ার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি মায়ের টেবিল থেকে সংগৃহীত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছিল। বাড়িতে পর্যাপ্ত বই থাকার পরও রিজিয়া রহমানের পাঠক্ষুধা নিবৃতির জন্য বন্ধুবান্ধব, স্কুলের লাইব্রেরি বা পাড়ার লাইব্রেরির বইয়ের প্রয়োজন পড়েছিল। যে-বয়সে একজন বালিকার স্কুল আর খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা এবং প্রধান বিনোদন হওয়ার কথা, সেই বয়সে রিজিয়া রহমান রীতিমতো ‘গ্রন্থকীট’। অবশ্যই এজন্য অন্য কারণও উল্লেখ করেন লেখক, ‘বই পড়ার প্রতি আমার আকর্ষণের আর একটি কারণও সম্ভবত ছিল, তা হল শিশুকাল থেকেই আমি ছিলাম দুর্বল আর রোগা। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। অন্য ভাইবোনদের মতো খেলাধুলা, ছুটোছুটি, হুড়োহুড়ি করতে পারতাম না। গলায় শব্দও তেমন জোরালো ছিল না, প্রায় নিঃশব্দ। ফলে বইয়ের জগতই হয়ে উঠেছিল আমার মতো নিঃসঙ্গ রুগ্ন শিশুর জগত।’ (গল্পকথা) বইয়ের মতো আর কোনো কিছুর প্রতি জীবনে গভীর নেশা তৈরি হয়নি। শিশুবয়সে বইয়ের প্রতি যে-নেশা তৈরি হয়েছিল, সে-নেশা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল আমৃত্যু। পরিণত রিজিয়া রহমানের পাঠপরিধি ছিল সুবিসত্মৃত। শিল্প-সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস ও অর্থনীতির পাঠ ছিল নিবিড়ভাবে। তাঁর একটি সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল, যে-লাইব্রেরিতে বিপুল পরিমাণে ইতিহাস ও অর্থনীতির বই ছিল।
ইতিহাস রিজিয়া রহমানের প্রবল ভালোবাসার বিষয়। অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় এবং এই বিষয়ে কিছুকাল অধ্যাপনা করার সূত্রে অর্থনীতির জ্ঞানও ছিল গভীর। ফলে যে-কোনো বিষয়ের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্পৃক্তি আবিষ্কারের ও ডিটেইলস বা অনুপুঙ্খভাবে দেখার বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল তাঁর। ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’ – কবির এই মানসভ্রমণের মতো রিজিয়া রহমানের শিল্পীসত্তার মানসভ্রমণ বা অন্তর্দৃষ্টিও বহুদূরগামী ছিল। এ-কারণেই বং থেকে বাংলার মতো উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়েছে। পতিতাপল্লিতে সশরীরে না গিয়েও রক্তের অক্ষরের মতো উপন্যাস লিখতে পেরেছেন শিল্পীমনের চিত্রকল্প থেকে।
রিজিয়া রহমান লেখালেখিকে সাংসারিক কাজের ফাঁকে অবসরের বা নৈমিত্তিক কাজ হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি একজন পূর্ণকালীন লেখক ছিলেন। লেখালেখিই ছিল জীবনের প্রথম ও প্রধান কাজ। লেখার প্রতি সৎ ও নিবেদিত থাকার প্রত্যয়ে কলেজের অধ্যাপনার চাকরিও ছেড়েছিলেন। রিজিয়া রহমান অত্যন্ত পরিশ্রমী লেখক ছিলেন। বং থেকে বাংলা এবং অন্যান্য ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাস লেখার সময় দীর্ঘ পাঠ-প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করেছিলেন। উপন্যাসের বিষয়-সংশিস্নষ্ট বিষয়ে রীতিমতো গবেষণায় লিপ্ত হতেন। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়কে উপন্যাসের বিষয় করে বাংলাদেশের উপন্যাসে রিজিয়া রহমান অনন্য কৃতিত্ব ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তী ছয় দশকে এমন শেকড়সন্ধানী কথাশিল্পী আর একজনও আসেনি। সমাজের রুগ্ণতার সব গলিঘুঁজি এবং পঙ্কিল অন্ধকার দিকটিও লেখকের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে ভিন্ন আঙ্গিকে। সেসব জায়গায় শিল্পের আলো ফেলে রিজিয়া রহমান দেখিয়ে দিয়েছেন ঘা বা পচন কী ভয়াবহ রকমের। গতানুগতিক বা আটপৌরে কোনো বিষয় নিয়ে রিজিয়া রহমান কখনো কলম ধরেননি। সৈয়দ আকরম হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, ‘গতানুগতিক জীবন নয়, এরও বাইরে যে জীবন উপেক্ষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত সেসবকে কথাসাহিত্যে আনতে না পারলে লিখতে উৎসাহ পাইনে।’
আজন্ম নির্জনতাপ্রিয় রিজিয়া রহমান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একপ্রকার ঘরকুনো মানুষই ছিলেন। প্রচার মিডিয়ার আলোর ঝলকানিতে বা লেখক-শিল্পীর আড্ডা বা মেলায় তাঁর উপস্থিতি ছিল নিতান্তই অনুল্লেখ্য। তাঁর বন্ধুপরিম-ল ছিল নির্ধারিত কিছু মানুষ নিয়ে। অগ্রজ লেখক রাবেয়া খাতুনের প্রিয়পাত্রী ছিলেন রিজিয়া রহমান। রাবেয়া খাতুনই মাঝেমধ্যে তাঁকে টেনে ঘর থেকে বের করে নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। তবে সেখানেও স্বল্পবাক স্বভাবের গুণে বরাবরই নীরব স্রোতা হয়ে থেকেছেন। আত্মপ্রচারবিমুখ নির্জনতাপ্রিয় শামিত্মপ্রিয় এই কথাশিল্পী জীবন ও জগৎকে দেখার শক্তিশালী নির্লিপ্ত দৃষ্টিকোণের অধিকারী ছিলেন। রিজিয়া রহমানের ব্যক্তিসত্তা ও লেখকসত্তা দুটোই নির্লিপ্ততার চাদরে ঢাকা ছিল। এক অর্থে নির্লিপ্ততাই তাঁর জীবন ও লেখালেখির মূল শক্তি। সৈয়দ আকরম হোসেনের ভাষায় রিজিয়া রহমানের ‘দূরত্ব সৃষ্টিকারী স্নিগ্ধ আভিজাত্য’ ছিল এবং ‘এটাই তাঁর পুনরুত্থানের আলোকিত পথ। তিনি সারাজীবন সকলের সঙ্গে বিনয়ী ও আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু সুলভ ছিলেন না।’ রিজিয়া রহমান সম্পর্কে সমকালের খ্যাতিমান লেখক হাসান আজিজুল হকের মূল্যায়ন এরূপ :
রিজিয়া রহমান কিন্তু খুব অল্পভাষী, খুব শান্ত, অনেক নির্লিপ্ত। তাঁর লেখায়ও তাই ধরা পড়ে। এক ধরনের নির্লিপ্ততা বরাবরই কাজ করে তাঁর লেখকসত্তায়। প্রাচীন ইতিহাসের চরিত্র, বারবণিতা, চা শ্রমিক, আদিবাসী, খনি শ্রমিক, হাঙর শিকারী ইত্যাদি বিচিত্র চরিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি আশ্চর্য নির্লিপ্ততার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর নির্লিপ্ততাই তাঁর জীবন, এই নির্লিপ্ততাই তাঁর লেখায় পাই। এ কারণেই, রিজিয়া রহমানের পরিমিতিবোধও খুব প্রবল, খুব স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন, লিখতে পারেন, এবং যা বলতে চান তা কখনোই জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে একাকার হয়ে যায় না। বিশাল দীর্ঘ উপন্যাস তিনি লেখেননি।
পারিবারিক পরিম-লের বাইরে রিজিয়া রহমানের লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় সে-সময়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক গৌরকিশোর ঘোষ-সম্পাদিত দৈনিক পত্রিকা সত্যযুগের ছোটদের পাতায়। তখন তিনি স্কুলের নিচু ক্লাসের শিক্ষার্থী। অতঃপর স্কুলজীবনেই ঢাকা ও কলকাতার বেশ কিছু পত্রিকার ছোটদের পাতায় নিয়মিত লেখা ছাপা হয়। তাঁর লেখা ‘অনন্য পৃথিবী’ নামে একটি গল্প দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয় ষাটের দশকের গোড়ায় এবং এই গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়াকালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ অগ্নি-স্বাক্ষরা (১৯৬৭) বেরিয়েছিল এবং এই সময় তিনি প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর লিখেছিলেন। প্রথম উপন্যাসেই রিজিয়া রহমানের জীবনদর্শন বা শিল্পীসত্তার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘পৃথিবীতে চিরকালই এই একদল ভোগ করে আরেক দল বঞ্চিত থাকে।’ – রিজিয়া রহমান এই বঞ্চিতদের জীবনচিত্র নির্মাণের জন্য কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর কলমের আঁচড়ে শোষিত-বঞ্চিত মানুষেরা মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। তাদের জীবনদৃষ্টি পালটে যায় এবং ভাগ্যপরিবর্তনের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রথম উপন্যাসটির বিষয়বিন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনসংগ্রাম, নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাস্ত্তহারা মানুষেরা শহরে এসে যে কঠিন-নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়, তারই নিবিড় পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে ঘর ভাঙা ঘর উপন্যাসে। উপন্যাসটি পাঠের সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, অদ্বৈত মলস্নবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সমরেশ বসুর গঙ্গা, অমরেন্দ্র ঘোষের চর কাশেম কিংবা দেবেশ রায়ের তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত প্রভৃতি নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা জাগে মনে। তরুণ লেখকের প্রথম উপন্যাসের বিষয় ও নির্মাণশৈলী উল্লিখিত উপন্যাসগুলোর মতো হয়নি, তবে এ-উপন্যাসে রিজিয়া রহমানের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে একজন বড় ঔপন্যাসিকের সম্ভাবনা এবং তাঁর শিল্পীসত্তার স্বরূপ। নদীর এ-পার ভেঙে ও-পার গড়ার খেলার মতো নদী-তীরবর্তী মানুষগুলোর নিয়তিও প্রতিমুহূর্তে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়। রিজিয়া রহমান নদীভাঙনের নিষ্ঠুরতার শিকার মানুষগুলোকে অস্তিত্বের প্রয়োজনে শহরে নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু মনোজগতে তারা নদীতীরেরই অধিবাসী। নদী তাদের মাতৃতুল্য, যার সঙ্গে সম্পর্ক জন্মসূত্রে, প্রকৃতির নিয়মে। এই সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু বহতা নদীর মতো জীবনেরও প্রতি মুহূর্তে বাঁক পরিবর্তন ঘটে। বাস্তবতার কাছে জীবনের বহু স্বপ্নকে বলি দিতে হয়; কিন্তু স্বপ্নগুলো হারায় না। তাই দেখা যায় শবেবরাতের রাতে, যে-রাতে মুসলমানদের ভাগ্যলিপি লেখা হয়, সেই রাতে নামাজে বসে নদীভাঙা মানুষেরা সমবেতভাবে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করে, ‘ফিরিয়ে দাও খোদা আমাদের সেই গাঁয়ের কুঁড়ে ক্ষেতের ধান, আলুক্ষেতের পরে সবুজ মাঠের শেষে বালুকাময় তটে ঢেউ ভেঙে ভেঙে বয়ে যাওয়া নীল নদী।’ নদীভাঙা মানুষের, বিশেষ করে নারীর, মনস্তত্ত্বের অসাধারণ কিছু বিশ্লেষণ উঠে আসে উপন্যাসটিতে। গ্রামের যে-নারী শুধুই গৃহবধূ, স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত, যার জীবনপরিধি রান্নাঘর, সমত্মান জন্ম, পালন ও স্বামী-সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, শহরে সেই নারীই হয়ে ওঠে উপার্জনের প্রধান ব্যক্তি। এই উপার্জন করতে গিয়ে গ্রামের সরল-সোজা গৃহবধূর বিশ্বাসে বা সংস্কারে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে এবং বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ‘গইগেরামের সদা গিরসেত্মর বউ আমরা। বাড়িতে বইয়া ধান সিজাইছি। মরিচ বাছচি। ঢেঁকিতে পাড় দিছি। স্বামী বাদে পরপুরুষের মুখ দেহি নাই। শইলের রক্ত পানি কইরা ছয়টা বাসার কাম করি। আব্রম্ন গেল। পথে পথে ঘুরি কাগো লাইগ্যায়? এই হারামের বাজেরা আমার সব খাইল। আমার শইলের রক্ত আমার আব্রম্ন আমার ইজ্জৎ।’ বাঙালি নারীর চিরায়ত সংস্কার-বিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ায় পুরুষশাসিত সংসারের ধারণাও আর টেকে না। নারী তার উপার্জনের স্বীকৃতি দাবি করলে পুরুষের ‘মেইল-ইগো’তে প্রচ- রকমের আঘাত লাগে। পুরুষ তার উপার্জনক্ষম স্ত্রীর অধিকারচেতনাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মাকে সংসারে রাখার ব্যাপারে স্বামীর সিদ্ধামেত্মর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় জুলেখার মা, ‘ক্যা? রোজগার বড় তোমার একলার নি! আমি কাম করি না? আমি ট্যাকা আনি না? আমার মায়রে আমি খাওয়ামু।’ গ্রামের গৃহবধূ জুলেখার এই অবস্থান নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। আবার বিপরীত দৃশ্যও দেখি, স্বামীর ডাকাতির বিরোধিতা করা খালেক স্ত্রীকে শাসায়, ‘তুই ম্যায়া মানুষ, তর অতো খবরের কাম কী? খাবিদাবি চুপ থাকবি। আর ভাল না লাগলে যাবি গা হাইটা বাপের বাড়ি।’ নারীর এই দুই সামাজিক অবস্থানের পাশাপাশি ‘ময়না’র মতো নারীকেও পাই, যে নারীসত্তার অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। কৌশলে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। নদীভাঙনের শিকার জীবনের গল্প লিখতে গিয়ে ঔপন্যাসিক চিরকালের শোষিত-বঞ্চিত নারীর সামাজিক অবস্থান ও আত্মনির্মিতির গল্প লিখেছেন।
দেশি-বিদেশি লেখকের বিচিত্র বইয়ের বিপুল পাঠ-অভিজ্ঞতা রিজিয়া রহমানের লেখকসত্তার প্রধান স্তম্ভ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসটি তাঁর শিল্পীসত্তায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘তবে সাহিত্যজীবনে প্রকৃতি ও মানুষ আমার কলমে স্থান করে নেওয়ার নেপথ্যে শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটির। সেই কৈশোরকাল থেকে আজ পর্যন্ত এ উপন্যাস আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’
ষাটের দশক বাঙালির স্বাধিকার চেতনার জাগরণের দশক। এই দশকেই বাঙালির মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের আকাঙক্ষার জন্ম হয়। এই দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব একটি গতিপথ নির্দিষ্ট হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের জনজীবনের সংগ্রাম ও স্বপ্ন সাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠে। এবং ষাটের দশক থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। রিজিয়া রহমান মনে করেন, বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রিজিয়া রহমান সাহিত্যের সংজ্ঞা বিরোধী। সৃজনশীল সাহিত্যের এমন কোনো দায় বা শর্ত নেই যে, এই এই সূত্র মেনে চলতেই হবে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সবকিছুই বদলে যাচ্ছে, তাই সাহিত্যের রূপ-রীতি বদলাবে – এটাই স্বাভাবিক। পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংজ্ঞাও এখন আর কার্যকর নেই। শুধু ছোট প্রাণ ছোট ব্যথাই নয়, বড় প্রাণ বড় ব্যথাও ছোটগল্পের বিষয় হতে পারে। তাঁর ভাষ্যে, ‘রবীন্দ্রনাথের সময়কার সেই কলোনিয়াল পিরিয়ড আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এক নয়। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফাস্ট গ্রোয়িং কান্ট্রি, অথবা গেস্নাবাল ভিলেজের অংশ, কিংবা বলা যায় জঙ্গিআক্রান্ত বাংলাদেশ। এখন রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট দুঃখ, ছোট ব্যথা, ছোট বেদনা নিয়ে বসে থাকা যায় না।’
সাহিত্যকে বিশেষ কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলায় তাঁর যেমন আপত্তি, তেমনি আপত্তি বিশেষ কোনো দর্শন, তত্ত্ব বা এজেন্ডার সেস্নাগানে আবদ্ধ করে ফেলার ব্যাপারে। নিজেকে তিনি নারীবাদী লেখক হিসেবে মনে করেন না। নারীকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই তিনি দেখেন এবং যেখানে তিনি লেখক সেখানে নারী-পুরুষের কোনো পার্থক্য নেই। সব মানুষই মানুষ এবং জন্মগতভাবে প্রকৃতির সবকিছুতেই তাঁর সমান অধিকার, এই বিশ্বাসেই তাঁর কলম চলেছে। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রগামী ষাটের দশকের নারীদের একজন রিজিয়া রহমান লেখক হিসেবে তেমন কোনো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হননি। তবে বারবণিতাদের জীবনবাস্তবতা নিয়ে লেখা রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি লেখার পর বেশ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সমাজের চোখে ঘৃণ্য পেশা হলেও এই পেশা রাষ্ট্রস্বীকৃত এবং প্রকাশ্যেই চলে পতিতাপল্লি। শিক্ষিত মার্জিত একজন ভদ্রঘরের মেয়েমানুষের পক্ষে এই বারবণিতাদের পেশাগত জীবনের করুণ কাহিনি নিয়ে উপন্যাস লেখা দুরূহ ব্যাপারই ছিল। বহু চেষ্টা করেও ভদ্রঘরের মেয়ে হওয়ায় পতিতাপল্লিতে যেতে পারেননি লেখক। রক্তের অক্ষর তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে বটে, কিন্তু তার জন্য নিজেকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের যথেষ্ট দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রকাশ্যে ধিক্কার ছাড়াও রাতে ‘পুরুষকণ্ঠের অশস্নীল ফোনের উৎপাত’ পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে। ষাটের দশকের এই নারী-লেখককে সত্তরের দশকে ‘মেইল-ইগো’সম্পন্ন পুরুষ লেখক-সমালোচকের অবিশ্বাস্য এক আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘ফেমিনাইন’ দুর্বলতাজনিত কারণে নারীদের লেখা ঠিক বড় লেখকের লেখা হয়ে ওঠে না। এই ধরনের পশ্চাৎপদ ধারণাকে রিজিয়া রহমান পাত্তা দেননি এবং এই ধরনের বিভ্রামিত্মমূলক ধারণাও আর টেকেনি।
পাকিস্তানি শাসকের লক্ষ্যভেদী বজ্রকঠিন শাসন এবং বঞ্চনা ও শোষণের বিষবৃত্ত থেকে বাঙালি বেরিয়ে এসেছিল জাতীয়তাবোধের শক্তি ও প্রেরণাকে পুঁজি করে। ফলে কি বাঙালি সংস্কৃতি, কি বাংলা ভাষা-সাহিত্য, কি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, কি সর্বধর্ম সমন্বয়ী অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যেখানেই পাকিস্তানিরা হাত ফেলেছে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বা সংশোধন বা সংস্কার করার জন্য, সেখানেই প্রত্যাঘাতটা পেয়েছে ভয়ংকরভাবে। ফলে, ধর্মের মতো এমন শক্তিশালী দাওয়াইও কোনো কাজে আসেনি। এই শক্তি আর প্রেরণাকেই শাণিত তরবারির মতো ব্যবহার করেছিলেন ষাটের দশকের শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, রিজিয়া রহমান, রাজিয়া খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুশ শাকুর, মাহমুদুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সেলিনা হোসেন প্রমুখ ষাটের দশকের কথাশিল্পী। সাহিত্যের মাধ্যমে জীবন ঘষে আগুন বের করে আনার কঠিন কর্তব্যটিই পালন করেছিলেন তাঁরা। এই শক্তি ও প্রেরণার ওপরেই প্রতিষ্ঠিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা – আজকের এই বাংলাদেশে। ফলে এই প্রত্যাশা অমূলক ছিল না যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্রভাবে নতুন একটি ধারা তৈরি হবে। এত বড় মুক্তিযুদ্ধ, এত বড় একটি বিজয়, স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র হবে এই নবতর ধারার প্রধান প্রেরণা বা শক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটল উলটো ঘটনা। সমগ্র সত্তরের দশকে নাম-উচ্চারণ করার মতো তেমন শক্তিশালী কথাশিল্পীর আগমন ঘটেনি। বিশাল স্বপ্ন, আশা ও প্রত্যাশার জায়গাটি মরুভূমির মতো নিষ্ফলাই রয়ে গেল। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতিকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করার সদম্ভ নৃশংসতা মূলত মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাঙালির জাতীয়তাবোধকে অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকেই একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই জিজ্ঞাসা আরো পাকাপোক্ত হয় যখন জনগণ-বিচ্যুত রাজনীতি-বিবর্জিত সেনাশক্তি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সংবিধান সওয়ার হয় সেই সেনাশক্তির ট্যাঙ্ক আর গোলাবারুদের ওপরে, যারা পাকিস্তানি আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের সেনাশাসনের অধীনে ট্রেনিং নিয়েছিল, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ফলে, আমাদের সেনাশক্তিও সেই একই পথে হাঁটল – গণতন্ত্র, সংবিধান, শাসনব্যবস্থা এবং সেনাশাসকের প্রবর্তিত রাজনৈতিক দল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলে জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা – প্রত্যেকটিই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার চেতনাবিরোধী, যা স্বপ্নবাজ তরুণদের নিদারুণভাবে আশাহত করে, যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি ছিল। এই আশাহত তরুণ সমাজ থেকে শক্তিশালী কথাশিল্পী উঠে আসেননি। অধিকন্তু যাঁরা গল্প-উপন্যাসকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ষাটের দশকের সেসব কথাশিল্পী শুধু হতাশই নন, ভয়ানক সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা কলম চালিয়ে গেছেন; কিন্তু নবসৃষ্ট বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, বা স্বাধীনতার অমরকীর্তি রচনা করেননি। রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবী শ্রেণি অথবা রাষ্ট্রের বা সমাজের অন্য যে-কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজশক্তির অবিচার বা নৃশংসতাকে নিয়তি বা উপায়হীন বাস্তবতা বলে মেনে নিলেও সত্যদ্রষ্টা লেখক কখনো তা মেনে নেন না। তাঁর হতাশা, ক্রোধ, প্রতিবাদ, জিজ্ঞাসাকে অক্ষরে অক্ষরে গেঁথে ফেলেন, মুক্তির নতুন স্বপ্ন তৈরি করেন। ‘জীবন ঘষে আগুন’ বা ‘শোণিত সেতু’র মতো গল্প লিখেছেন যিনি, সেই স্বপ্নদ্রষ্টা লেখক মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় লিখলেন ‘ঘরগেরস্তি’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, ‘সম্মেলনে’র মতো গল্প। সেখানে আমরা কী দেখছি – বিজয়ের দিনেই পা-হারানো মুমূর্ষু এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার আত্মজিজ্ঞাসা ‘দ্যাশ স্বাধীন হলে কী হয়’ এবং অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার আত্মজিজ্ঞাসা ‘আমি যুদ্ধে গিইলাম কেন’ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আরো আতঙ্কিত হই যখন দেখি, মৃত্যুর পূর্বে মুমূর্ষু মুক্তিযোদ্ধা হারানো পা ফেরত চেয়েছে অথবা গ্রামে ফেরা মুক্তিযোদ্ধা সরকারের অস্ত্র জমা দেওয়ার আহবানে সাড়া না দিয়ে অস্ত্র ডোবায় লুকিয়ে ফেলে পুনর্বার মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে। এক মুক্তিযোদ্ধা কাঁধে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যে-বিজয়োল্লাস দেখেছে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পায়নি, দেখেছে সেই সুবিধাবাদী শ্রেণির মানুষদেরই, যারা নয় মাস আত্মগোপনে ছিল বা রাজাকারদের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের সম্পদ ও সম্ভ্রম নিরাপদ করেছিল; মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনেই হালের গরু, ভিটেবাড়ি থেকে থালাবাটি পর্যন্ত সর্বস্ব ছিনিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় তাড়িয়ে দিয়েছে যে-রামশরণকে, নয় মাস মর্মামিত্মক জীবন কাটিয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে সে প্রশ্ন তুলেছে, ‘স্বাধীন হইছি না কি হইছি আমি বুঝব কেমন করে? আগে এট্টা ভিটে ছিলো, একন তাও নেই। আমি স্বাধীনটা কিসি?’ ষাটের দশকের এই লেখকরাই সত্তর ও আশির দশকে সেনাশাসনে অবরুদ্ধ জাতিসত্তা পুনরুদ্ধারের জন্যে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গেছেন। এই লড়াইয়ে রিজিয়া রহমান প্রধানতম কথাশিল্পী, এবং তাঁর লড়াইয়ের ধরন ও কৌশল অন্যদের তুলনায় ভিন্ন। তিনি তাঁর সমকালীন অন্য লেখকদের তুলনায় বেশি ধীরস্থির এবং দূরদৃষ্টি আরো প্রখর। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর বিপুল লেখাপড়া, হাজার বছরের দীর্ঘ বাধাসংকুল বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের অলিগলি-বাঁক সর্বত্রই তাঁর প্রদীপ্ত মানসভ্রমণ তাঁর বিশ্বাস ও চিমত্মাকে ঋজু ও প্রত্যয়দীপ্ত করেছে। যে-কারণে তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি যে, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ থেমে যাবে। বাঙালির ইতিহাসের সেই আদিচিহ্ন, যেখান থেকে বাঙালির যাত্রা শুরু, সেখান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাস তিনি তুলে এনেছেন বং থেকে বাংলা উপন্যাসে। সেই আর্য-আক্রমণের কাল থেকে বাঙালি তার ভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর লড়াই চালিয়ে এসেছে। কখনো কখনো পরাস্ত হলেও হেরে যায়নি বা পিছু হটেনি, অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে গেছে। প্রধানত বিদেশি শক্তি এবং কখনো দেশের অভ্যন্তরের শক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের লড়তে হয়েছে। তাই, রিজিয়া রহমান দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারেন, নয় মাসে কোনো একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হয় না, এই মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিভূমিকায় রয়েছে বহুস্তরান্বিত সুদীর্ঘ ইতিহাস। তাঁর উপন্যাসে তাই আমরা দেখছি, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে মিন্টু-রমিজার স্মৃতিতে জেগে ওঠে প্রাচীন বাংলার প্রথম প্রেমিক জুটি বং ও এলার প্রসঙ্গ। ‘মিন্টু ফিসফিস করল – তুমি আমার এই দেশের মতো। অনেক দুঃখসহা আনন্দময়ী। অনেক বিদেশি দস্যুর নির্যাতন সয়ে যে বেঁচে থাকে। … বং আর এলা নামে দুই-আড়াই হাজার বছর আগে দুটি তরুণ-তরুণী সব হারিয়ে এই পাখী-ডাকা নীলজল টলটল শাপলা ফোটা বিলের ধারে, এই নদীর পাড়ে আল বেঁধে ঘর গড়েছিল। সেই বংআল আজ হাজার হাজার বছরে বঞ্চনা লাঞ্ছনা আর যন্ত্রণার আবর্তনের মধ্যে দিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে হল বাংলাদেশ।’
এত দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে-জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা বা যে-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কিছু ক্ষমতালোলুপ শকুনরূপী দানবতুল্য হিংস্র মানুষের জন্য তা নস্যাৎ হয়ে যাবে, এ-কথা রিজিয়া রহমান কিছুতেই বিশ্বাস করেন না, স্বীকারও করেন না। ক্ষমতার জোরে সংবিধান পরিবর্তন করে, অস্ত্রের মুখে গণতন্ত্র ও জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে, সাময়িকভাবে হয়তো বাঙালির জাতিসত্তার ইতিহাসকে বিভ্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা চলবে, কিন্তু বাঙালি ঠিকই একদিন অন্যায় শাসন ও অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আপন শক্তিতে। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার বা দুর্বৃত্ত-শক্তির উত্থান, বিকাশ ও নিপীড়নের শিকার মানুষেরা সাময়িকভাবে পরাজিত বা বিপর্যস্ত হতে পারে; কিন্তু চিরদিনের জন্য মানুষ পরাজিত হয় না। কি ব্যক্তিক কি সামষ্টিক – দু-ক্ষেত্রেই মুক্তিকামী মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি অনড় বিশ্বাস রিজিয়া রহমানের। তাঁর এই বিশ্বাসে তিলার্ধ ফাঁক ও ফাঁকি ছিল না। এক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হকের মূল্যায়ন স্মরণ করছি।
বিচিত্র বিষয় নিয়ে চমৎকার গদ্য লিখেছেন রিজিয়া রহমান। আমি বরাবরই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি তাঁর লেখা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রিজিয়া রহমানের লেখায় একটা দৃঢ়তা আছে। সেইসঙ্গে, অনেক লেখককেই দেখা যায় জ্ঞান দেখানোর চেষ্টা করেন, রিজিয়া রহমান সেটা কখনই করেননি। যদ্দূর পেরেছেন মিশিয়ে নিয়েছেন, নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। এবং লেখা পড়লেই বুঝতে পারা যায়, তিনি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন এবং যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে কাটিয়েছেন, সেখানে কোথাও ফাঁক বা ফাঁকি রাখেননি। মানুষের জীবনকে খুব কাছে থেকে না দেখলে লেখায় উষ্ণতার সঞ্চয় হয় না। লেখার উষ্ণতা আসলে মানুষের উপস্থিতির উষ্ণতা, সেটা করতে গেলে বাছ-বিচার চলবে না, সকল মানুষের সাথেই মিশতে হবে। এক্ষেত্রে রিজিয়া রহমানের ঘাটতি নেই।
রিজিয়া রহমান তাঁর প্রায় ৮০ বছরের দীর্ঘ জীবনের পূর্ণাংশই লেখালেখি করে কাটিয়েছেন। তাঁর লেখকজীবনের অধিকাংশ সময় জুড়ে প্রধানত গল্প-উপন্যাসই লিখেছেন। উপন্যাস লিখেছেন মোট ৩৩টি। উপন্যাসগুলোকে মোটাদাগে চারটি ভাগে বিভক্ত করে উপস্থাপন করা যায়। ক. ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও জাতিসত্তার উপন্যাস : ১. অলিখিত উপাখ্যান, ২. আবে-রওয়াঁ, ৩. শুধু তোমার জন্য, ৪. তৃণভূমি বাইসন, ৫. পবিত্র নারীরা, ৬. আলবুর্জের বাজ, ৭. উত্তরপুরুষ, ৮. একাল চিরকাল, ৯. শিলায় শিলায় আগুন; খ. মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস : ১. বং থেকে বাংলা, ২. একটি ফুলের জন্য, ৩. কাছেই সাগর, ৪. উৎসে ফেরা; গ. রাজনৈতিক ও সামাজিক উপন্যাস : ১. ঘর ভাঙা ঘর, ২. রক্তের অক্ষর, ৩. সূর্য সবুজ রক্ত, ৪. হারুণ ফেরেনি, ৫. সুপ্রভাত সোনালী দিন, ৬. সীতা পাহাড়ে আগুন, ৭. জগৎ জুড়িয়া কান্দে, ৮. অন্ধকারে বেতোফেন, ৯. জ্যোৎস্নায় নীল সীমানায়, ১০. অতলান্ত নীল, ১১. ডাইম নিকেল, ১২. ধবল জ্যোৎস্না, ১৩. বাঘবন্দি; ঘ. প্রেমের উপন্যাস : ১. সবুজ পাহাড়, ২. প্রেম আমার প্রেম, ৩. ঝড়ের মুখোমুখি, ৪. হে মানব-মানবী, ৫. গোলাপ তবু তুমি, ৬. বান্ধবী প্রিয়দর্শিণী, ৭. চন্দ্রাহত।
উল্লিখিত ৩৩টি উপন্যাস ছাড়াও রিজিয়া রহমান অগ্নি-স্বাক্ষরা, দূরে কোথাও, খাওয়া-খায়ির বাঙালি ও চার দশকের গল্প নামে চারটি গল্পগ্রন্থ, নদী নিরবধি ও প্রাচীন নগরীতে যাত্রা নামে দুটি আত্মজীবনী এবং আজব ঘড়ির দেশ, ঝিলিমিলি তারা ও মতিশীলের বাড়ি ও অন্যান্য নামে তিনটি শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা।
রিজিয়া রহমানের গল্প-উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র্য অনন্য। তাঁর কথাবিশ্ব প্রাচীন বাংলা থেকে আজকের বাংলাদেশ, বেলুচিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, চা-শ্রমিক, নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী, প্রেম ইত্যাদি বিচিত্র ও বহুমুখী বিষয়ে সমৃদ্ধ। এমন বিষয়বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আর কোনো কথাশিল্পীর সৃষ্টিকর্মে পাই না। গল্প-উপন্যাসের বিষয় বা আঙ্গিক নির্বাচনে রিজিয়া রহমানকে কোনোপ্রকার জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়নি।
বিষয় ও আঙ্গিক নির্ধারণে তেমন জটিলতার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি। তবে অনেক উপন্যাস, বিশেষ করে, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক উপন্যাসগুলো লিখতে গিয়ে তথ্য পেতে প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়েছে। উপন্যাসের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে পূর্ব পরিকল্পিত বা সচেতনভাবে আঙ্গিক তৈরিতে মনোযোগ দিইনি আমি। উপন্যাসের বিষয়ই আঙ্গিক নির্বাচন করে দিয়েছে। সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতা থাকায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই এসে গেছে উপন্যাসের বিষয়। কখনও ইতিহাস বা নৃতত্ত্বের পড়াশোনা থেকেও খুঁজে পেয়েছি উপন্যাস লেখার বিষয়। যে অঞ্চল, যে মানুষ, যে জীবন আমাকে আকৃষ্ট করেছে, সে বিষয় ধরে লিখতে পেরেছি উপন্যাস।
ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস বাঙালির জাতীয় জীবন তথা হাজার বছরের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ে রিজিয়া রহমানের লেখকসত্তার বিকাশ ও পরিণতি। এই অধ্যায়েই বাঙালি প্রথম স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্নের পথ ধরে এগোয়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি সমগ্র সত্তা নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষিক, সাহিত্যিক অর্থাৎ সর্বদিকপ্রসারী ছিল এই লড়াই। জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁক পরিবর্তনের কালে একজন লেখক তো বটেই, একজন সাধারণ মানুষেরও সমস্ত কর্মের মূল গতিপথ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার অভিমুখে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন লেখিকা রিজিয়া রহমান এই লড়াইয়ে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। আশা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই লড়াইয়ের অবসান ঘটবে এবং বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয়ের সংকটেরও সমাধান হবে। বাস্তবে দেখা গেল, ষাটের দশকের লড়াই স্বাধীন বাংলাদেশেও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। পাকিস্তানি আদর্শপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুত্থান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও চেতনাকে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। অস্ত্রের মুখে অবরুদ্ধ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মুক্তি এবং সেইসঙ্গে অন্যায়-অত্যাচার-বৈষম্যের শিকার সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা রিজিয়া রহমানের সাহিত্যিক বিদ্রোহ কখনো থামেনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে তো বটেই, বাঙালির জাতীয় ইতিহাসেও রিজিয়া রহমানের অবদান বহুকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ হবে।

  • উদ্ধৃতি সূত্র : গল্পকথা (রিজিয়া রহমান সংখ্যা), রাজশাহী, ২০১৭।