রিয়ার প্রার্থনা

নীহারুল ইসলাম

রিয়া ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর দাদা বিভাস ক্লাস সেভেনে। বিভাস পোলিও আক্রান্ত। অবশ্য তার একটা হুইল চেয়ার আছে। যেবার দরগার স্কুলে ফাইভে ভর্তি হয়, স্কুল থেকে ওটা দিয়েছিল। ওটায় চড়ে দাদা স্কুলে যায়। সঙ্গে রিয়া নিজে থাকে। স্কুলের রাস্তাটা খুব খারাপ। তার ওপর গাড়িঘোড়ার ভিড়। গাড়িঘোড়া বলতে গরুগাড়ি-ঘোড়াগাড়ি নয়, মাটির বহা ট্রাক-ট্রাক্টর – আজকাল আবার জুটেছে ফটফট নছিমন। আর আছে চ্যাংড়া ছুল্লুদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল! এসবের ভিড়ে দাদার হুইল চেয়ারের প্যাডেল ঘোরাতে কষ্ট হয়। পদে পদে চাপা পড়ার ভয় থাকে। তাই তো রিয়া দাদাকে একা ছাড়ে না। দাদার হুইল চেয়ারের পিছু পিছু থেকে দাদাকে সাহায্য করে। চাপা পড়ার বিপদ এড়িয়ে স্কুলে নিয়ে যায়। স্কুল থেকে আবার বাড়ি নিয়ে আসে।

আগে নাকি স্কুলটা কাছেই ছিল। একেবারে বাড়ির কাছে। সে অনেকদিন আগের কথা। স্কুলটার কী সুন্দর দোতলা বিল্ডিং ছিল। চওড়া সিঁড়ি ছিল। লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেমেয়েরা দোতলায় উঠত। রিয়া মায়ের মুখে গল্প শুনেছে। তার মা সেই স্কুলে পড়েছে। তার মাও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠত স্কুলের দোতলায়। তারপর সিঁড়ির রেলিং বেয়ে পিছলি খেয়ে নেমে আসত। তাহলে সেই সুন্দর স্কুলটা গেল কোথায়? রিয়া গল্প শুনে মাকে প্রশ্ন করেছিল। মা বলেছিল, ওই যে আমাদের গ্রামের পাশে নদীটা আছে, পদ্মানদী – ওই নদী স্কুলটাকে গিলে খেয়েছে।

শুধু কি স্কুল? তাঁদের যে আদি বাড়ি ছিল, বসত ডিহি ছিল, আগান-বাগান ছিল – সবকিছু গিলে খেয়েছে ওই নদী। তারও আগে ‘খান্দুয়া’ নামের পুরো একটা গ্রাম গিলে খেয়েছিল। তাই নাকি আজকে তাদের এই ভিখারির অবস্থা!

আজকের অবস্থা নিয়ে রিয়া কিছু ভাবে না। তবে নদীটাকে নিয়ে ভাবে। যা যা ইচ্ছে হয়েছিল গিলে খেয়েছিল, কিন্তু তার দাদা বিভাসের কষ্ট বাড়াতে নদী কেন যে স্কুলটাকে গিলে খেল, সে বুঝতে পারে না। সেই কারণে নদীটার ওপর তার যত রাগ! সেই রাগ থেকে নদীটার সঙ্গে সে কথা বলে না। নদীর জলে স্নান করে না। নদীর পাড়ে বেড়াতেও যায় না। সে তার দাদা বিভাসকে বুঝতে পারে। দাদার কষ্ট বুঝতে পারে। দাদা হাঁটতে পারে না। দাদা হামাগুড়ি দেয়। দাদার পা-দুটি পা নয়, বটের ঝুরি। বাতাসে নড়ে। তাই সবসময় সে দাদার সঙ্গেই থাকে।

রিয়া যে-স্কুলে পড়তে যায়, সেখানে একটা কবর আছে। একটা বহু পুরনো বটগাছ আছে। সেই গাছের অনেক ঝুরি। রাখালের দল থেকে স্কুলের ছাত্রছাত্রী ওই ঝুরি ধরে ঝুল্লু খায়। রিয়ারও ঝুল্লু খেতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু ঝুল্লু খেতে পারে না, দাদা বিভাসের পা-দুটিকে মনে পড়ে তার। সে দাদার কথা ভাবতে ভাবতে চুপটি করে বসে সবার ঝুল্লু খাওয়া দেখে।

মাস্টারমশাইরা বলেন, কষ্ট করে বিভাসের স্কুলে আসার দরকার নেই। শুধু পরীক্ষার সময় এলেই হবে। রিয়া সে-কথা শোনে না। স্কুলে না গেলে তার দাদা মানুষ হবে কী করে? তার বাবা স্কুলে যায়নি বলে মানুষ হয়নি, মুনিশ হয়েছে। এ-কথা তার মা বলে। সে মায়ের কথা শোনে, বিশ্বাস করে। তার মা খুব ভালো। বাবাটা কেমন যেন! পাশের বাড়ির মুস্তাফা-মাস্টারের গেরস্তিতে মুনিশ খাটে আর মদ খায়, তাড়ি খায়। সংসারে পয়সা দেয় না। মা বিড়ি বেঁধে সংসার টানে। তবু সংসারের টানাটানি যায় না। পেটপুরে দুবেলা সবার ভাত জোটে না। রিয়া এসব বোঝে। তাই তো সে আইসক্রিম খাওয়ার জেদ করে না, কিংবা পূজার সময় ভালো জামাকাপড়ের জেদ করে না। জেদ করে শুধু দাদাকে স্কুলে নিয়ে যায়। দাদার জন্যে একটা থালা আর নিজের জন্য আরেকটা থালা নিয়ে যায় বইয়ের ব্যাগে পুরে। খাবার ঘণ্টা পড়ে যখন, দুটো থালা নিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। যেদিন ডিম থাকে কিংবা মাংস, গোষ্ঠীর মেয়ে যারা রান্না করে খাওয়ায় তারা প্রশ্ন করে, দুটো থালা কেন? পাশে যে মাস্টারমশাই দাঁড়িয়ে থাকেন তিনিও জানতে চান। খুব লজ্জা করে তখন। তবু বলতে হয়, একটা আমার আর একটা আমার দাদার। কে তোর দাদা? লজ্জায় কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বেরোয় না, তবু বলে, আমার বিভাস দাদা! তাই তো স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান হয় যখন, ‘স্বাধীনতা দিবস’, ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কিংবা ‘শিক্ষক দিবস’ – মাস্টারমশাইরা যখন কবিতা আবৃত্তি করতে বলেন কিংবা গান গাইতে! কেউ এগিয়ে যায় না, সে যায়। সাহস করেই এগিয়ে যায়। এই তো এই সেদিন ‘শিক্ষক দিবসে’ বাংলার মাস্টারমশাই যখন সবাইকে ডাকছেন, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না দেখে সে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল। তারপর একটি নয়, গলা খুলে পরপর দুটি গান গেয়েছিল। শেষে গেয়েছিল এই গানটি :

মোরা নাচি ফুলে ফুলে দুলে দুলে,

মোরা নাচি সুরধুনি-কূলে-কূলে।

কখনো চলি বেগে, কভু মৃদু চরণে,

কখনো ছুটি মোরা ফুল-ফল হরণে।

কোথা হতে এসেছি, কবে যে ভেসেছি,

তা গেছি ভুলে।

খেলি লুকোচুরি কভু বনে,

মাতি নিধি-সনে কভু রণে,

ভাসি আকাশে নীরদ-সনে

শত পাল তুলে।

যখন থাকি ঘুমে, থাকে ঘুমে ধরণি –

গহন-নদী-নিধি-নভে মেঘ-তরণি।

পুনঃ জাগে হরষে মোদের পরশে

নয়ন খুলে।

বাড়িতে মা বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে তাকে, দাদাকে এই গানটি বেশি বেশি শোনায়। মায়ের কোলে তখন বিড়ি বাঁধা কুলো থাকে। তবু মা কীভাবে যে তার আর দাদার মাথা দুটো কোলে নেয়, সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মায়ের গাওয়া গানের অর্থ বুঝতে পারে। কোথায় তারা নাচে ফুলে ফুলে? দুলে দুলে? সে নাচতে পারলেও দাদা বিভাস? দাদার তো পা-দুটিই নেই। তাই তার কখনো কখনো নাচতে ইচ্ছে হলেও সে নাচে না। তখন তার চোখে মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। মা তো গান গায় না, মা কাঁদে। তার জন্য নয়, দাদা বিভাসের জন্য। শিক্ষক দিবসের দিন সে যখন এই গানটি গাইছিল, তার চোখেও জল এসে গিয়েছিল। হেডমাস্টার তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিন্তু সে তো দাদার জন্য কাঁদে না, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। মা দুগ্গা আসেন যখন, দাদাকে সঙ্গে নিয়ে হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে শিকারপুর, পাহাড়পুরের মন্ডপে মন্ডপে যায়। দাদা মা দুগ্গার কাছে কী চায় কে জানে! তবে সে চায় দাদার পা-দুটো বটের ঝুরি না থেকে যেন সত্যিকারে পা হয়ে যায় মা! দাদা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে!

শুধু তাই না, তাদের স্কুলের কাছে দরগাতলায় যে-কবরটা আছে, কোন ঠাকুরের কবর কে জানে, সেখানেও সবার অজান্তে প্রার্থনা করে, দাদার পা-দুটো ভালো করে দাও ঠাকুর। এটা সে শিখেছিল তাদের গ্রামের সমর ঘোষকে দেখে। সমর ঘোষকে সে ‘সমরকা’ বলে ডাকে। তো, তার সেই সমরকা রোজ দুপুরবেলা ওইখানে এসে ঠাকুরের কবরে মাথা ঠুকে প্রণাম করে। প্রণামি বাক্সে পয়সা ফেলে। ক্লাসরুম থেকে জানালা দিয়ে সে রোজ দেখতে পায়।

সাহস করে একদিন রাস্তায় সমর ঘোষকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মুসলমানদের ঠাকুরের কবরে প্রণাম করো কেন সমরকা? পয়সা দাও কেন? সমরকা বলেছিল, মারে রোজ বিশটা গরুর দুধ দুই। ওই বিশটা গরুর বাচ্চারা মায়ের দুধ পেটপুরে খেতে পায় না। আমি দুহে নিই। তারা আমাকে অভিশাপ দেয়। সেই অভিশাপ থেকে বাঁচতে আমি শুধু মুসলমানদের ঠাকুর নয়, সব ধর্মের ঠাকুরের কাছেই মাফ চাই। প্রার্থনা করি। পেটের দায়ে সব ধর্মের মানুষের বাড়ির গরুর দুধ দুইতে হয় যে আমাকে!

সে-কথা শুনে রিয়াও একদিন ওই মুসলমান ঠাকুরের কবরে প্রার্থনা করেছিল। চুপিচুপি। মায়ের দেওয়া ঝালমুড়ি খাওয়ার পয়সার নিজের ভাগটা প্রণামি বাক্সে ফেলেছিল। দাদা জিজ্ঞেস করেছিল, তুই ঝালমুড়ি খাবি না বোন? সে উত্তর দিয়েছিল, আমি পরে খাব। তুই খা দাদা! বলে পাশ কাটিয়ে ছিল সে। দাদা তবু ব্যাপারটা কীভাবে জেনে যায়, বাড়িতে গিয়ে মাকে বলে। তখন সে দাদার পাশেই দাঁড়িয়ে, কী ভয়! কী ভয়! মা যদি রাগ করে? কিন্তু না, মা রাগ করে না। সবকিছু শোনার পরেও বলে, পরে শুনবো – যা তো এখন, তাড়াতাড়ি ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে আয়! খাবি।

মা পরে আর কিছু শোনেনি – বিড়িবাঁধা কুলোর দুপাশে কলজের দুই টুকরোকে শুইয়ে বলেছিল, তোর দাদুকে এসব কিছু বলিস না আবার! শুনলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।

মায়ের কথা শুনে রিয়ার মনে হয়েছিল, দাদু যা রাগী! তার ওপর দাদু মুসলমানদের একদম দেখতে পারে না। কী জানি মুসলমানদের ওপর তার কীসের রাগ? মুসলমানদের ঠাকুরের কবরে প্রণাম করেছে, প্রণামি দিয়েছে শুনলে বোধহয় তাকেই বাড়ি থেকে বের করে দেবে। কিন্তু সে বেরিয়ে গেলে দাদাকে কে দেখবে? দাদাকে কে স্কুলে নিয়ে যাবে? দাদাকে কে মানুষ করবে?

তারপর থেকে মুসলমানদের ওই ঠাকুরের কবরের দিকে সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। প্রণামি দিতে পারে না বলে মনে মনে ‘মাফ’ চায়। সমরকা যেমন রোজ মাফ চায়, তেমনি। নিজের ঝালমুড়ি খাওয়ার পয়সায় অসীমদার কাছে ঝালমুড়ি খায় না। দাদাকে খাইয়ে দেয়। কাগজের প্যাকেটের ঝালমুড়ির পরিমাপ এক থাকলেও গোপনে অসীমদাকে বলে, একটু বেশি চানাচুর, একটু বেশি বাদাম, একটু বেশি ভেজা ছোলা মিশিয়ে দাও। দাদা কিছু বুঝতে পারে না। কিংবা বুঝলেও কিছু বলে না। দাদা খেতে খুব ভালোবাসে।

অসীম কিন্তু বুঝতে পারে। সেও বিভাসের মতো। তার পা-দুটোও ওই বটের ঝুরি। তার যে হুইল চেয়ারটা সেটাতেই তার ঝালমুড়ির খঞ্জা আঁটা। শিকারপুরের যদুপ্রধান ওটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাই তো স্কুল হোক, না হোক দরগাতলায়, অসীমদা আসবেই আসবে। ছাত্রছাত্রী না হোক, রাখালেরা তার ঝালমুড়ি খাবে। তাড়িখোররা তো আছেই। তার কাছ থেকে নেশা করার জন্য চাট কিনবে। বেশি বেশি লংকাকুচি মাখা চালভাজার চাট। চানাচুরের চাট। ভেজা ছোলার চাট। পাশেই যে বাগানটা আছে – ডাক্তারের বাগান, সেখানে গরমকালে সারাদুপুর তাড়ির আড্ডা বসে। অন্য সময় দেশি মদ! বাজারে মণি রায়ের কাউন্টার থেকে বোতল কিনে এনে জঙ্গলে লুকিয়ে রাখে গোলাপনগরের স্বপন হালদার। কত দূর দূর গ্রাম থেকে যে কত মানুষ নেশা করতে আসে ওখানে! ওদের সঙ্গে তার বাবাও থাকে নিশ্চয়। ওদের সবার জন্য রোজ পাহাড়পুর মোড় থেকে অসীমদাকে আড়াইশো করে কাঁচা লংকা কিনতে হয়। যেদিন লংকার বাজার চড়া থাকে, সেদিন অসীমদার মুখে দেশ-দুনিয়ার সংবাদ শোনা যায়। রিয়ার শুনতে ভালো লাগে। এই তো সেদিন অসীমদাকে বলতে শুনেছিল, কাশ্মিরে বান হইছে আর শালা ইখানে লংকা ডুবি গ্যালো। পাটনা থাইকি লংকা আইনি বিক্রি করতেছে তো, তাই খুব দাম!

কাশ্মির কোথায় রিয়া জানে না। তবে পাটনা কোথায় তা জানে। তাদের প্রসাদপুর গ্রামের পাশের গ্রাম শিকারপুর-কোড়িপাড়া। সেখানে সব বিহারি ভক্তদের বাস। পাটনা-গয়ায় তাদের সব আত্মীয়। বিক্রম ভক্তের ছেলের বিয়ে হয়েছে পাটনায়। বউটা খুব ভালো। ডাবরার পুকুরে তার মা যখন স্নানে যায়, বউটাও স্নানে আসে। ছুটির দিন মায়ের সঙ্গে সেও যখন স্নানে যায়, বউটাকে দেখে। কী সুন্দর বউটা! গায়ের রং কী ফর্সা! আর চামড়া একেবারে মাখনের মতো। তবে খুব মোটা। ওই বউটা তার দাদার জন্যে পাটনা থেকে মলম এনে দিয়েছে। সেই মলম দাদার পায়ে মালিশ করলে দাদা নাকি দাঁড়াতে পারবে! মা অনেকদিন ধরে সেই মলম দাদার পায়ে মালিশ করছে। তবু দাদা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে কই?

রিয়ার বিশ্বাস, তার বিভাস দাদা একদিন না একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। রাতে ঘুমানোর আগে সে-কথা সে তার দাদাকে জোর দিয়ে বলে, দেখিস দাদা – একদিন তুই ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবি।

বিভাস জিজ্ঞেস করে, ধুর! ওসব মিথ্যা কথা। আমি আমার পায়ে কোনোদিন দাঁড়াতে পারব না, আমি জানি বোন।

– কী করে জানলি তুই?

– মুস্তাফা-মাস্টারের বৈঠক বারান্দায় যে দিদিমণিটা রোজ সকালে সাইকেল চড়ে এসে পাড়ার বাচ্চাদের পড়ায়, খিচুড়ি খাওয়ায়। সেই দিদিমণি বলে।

– কাকে বলে?

– যেসব মা তাদের বাচ্চাদের নোংরা রাখে, তাদের বলে।

– কী বলে?

– বাচ্চার যত্ন নিতে পারো না! যত্ন না নিলে কী হয় জানো, বাচ্চার পোলিও হয়। তোমাদের গ্রামের বিভাসকে দেখছো না! ওর মতো অবস্থা হবে। জীবনভর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না।

শুনে প্রথমেই মাকে মনে পড়ে রিয়ার। তাহলে কি দাদার ছোটবেলায় মা দাদার যত্ন নেয়নি? কিন্তু মা তো অমন নয়! সেই কবে থেকে মাকে দেখছে। মা খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন! তাদের ঘুম ভাঙার আগেই মায়ের ঘরদোর নিকানো হয়ে যায়! বাসনকোসন মাজা হয়ে যায়। তারপর তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দাঁত মাজায়। হাত-মুখ ধোয়ায়। খাওয়ার আগে ভালো করে হাত-পা না ধুলে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না। তাহলে মায়ের দোষ কোথায়? তখন রিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়ে ওই দিদিমণিটার ওপর। দিদিমণিটা একেবারে মিথ্যুক। কাল সকালে আসুক, দেখাবে মজা! রিয়া ভাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে রিয়া মায়ের মুখে যে খবরটা শোনে – তাতে সে শুধু আশ্চর্য হয় না, তার মনে অপরাধবোধ জন্ম নেয়। দিদিমণিটা নাকি সেন্টারে আসার সময় ডাবরার পাড়ে মাটিবহা ট্রাকের তলায় চাপা পড়েছে। দুটো পায়ের ওপর দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে গেছে। আশপাশে ছিল যারা, ছুটে এসে হাসপাতালে নিয়ে গেছে চটজলদি। বাঁচবে কিনা সন্দেহ!

রাতে দিদিমণিটার ওপর তার যে খুব রাগ হয়েছিল, ওই রাগেই দিদিমণির এমন সর্বনাশ হলো না তো? রিয়া ভাবছে। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না, চোখ বন্ধ করে হাতজোড় অবস্থায় প্রার্থনা করে, দিদিমণির যেন কিছু না হয় ভগবান! দিদিমণি যেন দাদার মতো পা-দুটো না হারায় ভগবান! দাদার পা হারিয়েছে হারিয়েছে, পৃথিবীতে আর কারো যেন পা না হারায় ভগবান! দাদার পা হয়ে আমি বেঁচে থাকব। কিন্তু ওই দিদিমণি যেন বেঁচে থাকে। দিদিমণি তার পা-দুটো যেন ফিরে পায় ভগবান! দিদিমণি বেঁচে না থাকলে, দিদিমণির পা-দুটো ফিরে না পেলে গ্রামের আরো অনেকের দাদার মতো অবস্থা হবে ভগবান!

খুব ছোটবেলায় ওই দিদিমণি যে তাকেও কোলে নিয়েছিল, আদর করেছিল, নিজ হাতে খিচুড়ি খাইয়ে দিয়েছিল – প্রার্থনা করতে করতে রিয়ার এক-এক করে সব মনে পড়ছে।