রূপসী বাংলা : মননের দ্বিধা

রূপসী বাংলা, অনুমান, সব আগ্রহী বাঙালির কাছে সবচেয়ে আদরের বই। ভালোবাসা

অকৃত্রিম। তার দিক থেকে। যারা পড়ে, শোনে বা জানে, তাদের দিক থেকেও। প্রথম ছেপে বেরোয় ১৯৫৭-য়। শুরুতেই সাড়া জাগায় তুমুল। তখন থেকে তার অগ্রযাত্রা অবিরাম। এখনো। কোনো কোনো শব্দবন্ধ বা বাক্য এর প্রবাদপ্রতিম। অবিনশ্বর। আমাদের শুদ্ধ আবেগ তাদের চরণ ছুঁয়ে থাকে। সেই করুণ-রঙিন ছোঁয়ায় হৃদয়ের পাপড়িগুলো খোলে। অনুভবে পবিত্র হই। মুক্তি আমাদের ‘ধুলায়-ধুলায় ঘাসে-ঘাসে’ মিশে গিয়েও আকাশে-আকাশে ঊর্ধ্বে ভাসে। কোনো জিগীষা জাগায় না। অহংকারী করে না। কেবল শান্ত-ধীরলয়ে বাংলার রূপ, এবং রূপের পেছনে স্মৃতি-বিস্মৃতির আলোছায়ায় ইতিহাসে-কিংবদন্তিতে-কথকতায় জড়ানো প্রাণের স্বরূপ বিরতিহীন ফুটিয়ে চলে। তাতেই নিমগ্ন থাকে। ‘কালের চিরচঞ্চল গতি’ থামে না। কিন্তু তারই পটভূমিকায় বাংলা এক কোমল দুঃখে – গভীর মমতায় জীবনের অসীমতায় স্থির হয়। প্রায় সবই সনেট। যদিও রূপের কাঠিন্য বা নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণের বিধিবিধান পড়বার সময় আমাদের এতটুকু সচকিত করে না। অবশ্য বহিরঙ্গে ওরা তার ছাঁচের বিশেষ একটা আদল ধরে রাখে ঠিকই। রূপ কিন্তু ভাসমান। ‘ভেসে যায়, যায় ভেসে যায়’, অন্তরঙ্গে স্থির অনিঃশেষ হয়েও। রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী বা সুধীন দত্ত তাঁদের সনেটে বৈদগ্ধ্যের ছটায় আমাদের চমৎকৃত করেন। এখানে আপাতদৃষ্টে তেমন কোনো চেষ্টাই চোখে পড়ে না। আবেদন সরাসরি হৃদয়ের কাছে। এবং তাতে কপটতা বা মালিন্য নেই এতটুকু। অনুভব পবিত্র হয়। জাগ্রত হয়। এবং তাতে যেন ব্যালাড (নধষষধফ) বা ডার্জের (ফরৎমব) চরণচিহ্ন পড়ে। কিন্তু মোটেই বিলাপ-সংগীত হয় না। আমরা অভিভূত হই। অসংযমী হই না। কবিতার ভারসাম্য বিন্দুমাত্র টলে না। পূর্ণতা অপচয়ে ছাপিয়ে যায় না। শ্রেষ্ঠ কবিতাই রচিত হয়। পেয়ে ধন্য হই।

তবে অদৃষ্টের পরিহাস,

না-কি কবির অন্তর্জাত সংশয়, রূপসী বাংলা তাঁর জীবদ্দশায় (১৮৯৯-১৯৫৪) আলোর মুখ দেখে না, – যদিও তা সবটাই ছিল সুসম্পূর্ণ ও প্রকাশযোগ্য (১৯৩৪) – তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর আগেই। কিন্তু এর অস্তিত্ব তিনি কাউকে জানতে দেননি। গোপন ভালোবাসার মতো আগলে রেখেছেন, তা-ও কিন্তু মনে হয়নি। হঠাৎ করে, আক্ষরিক অর্থেই, ‘পরীর দেশের বদ্ধ দুয়ার’ খুলে যায় তাঁর মৃত্যুর পর। তার কাহিনি অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি  হওয়ার রোমাঞ্চ জাগায়।

যাঁর কাঠির ছোঁয়ায় ওই ‘দুয়ার’ খোলে, তাঁর নাম ভূমেন্দ্র গুহ। জীবনানন্দের সঙ্গে

সাক্ষাৎ-পরিচয় তাঁর ১৯৫২ সালে। নিজে মেডিক্যাল কলেজের নবাগত ছাত্র। পূর্ব বাংলা থেকে কলকাতায় আসা। থাকেন কজন সহমর্মী-সহপাঠী মিলে এক ভুতুড়ে বাড়ির চিলেকোঠায়। তখনকার ওই বয়সের অনেকের মতো তাঁরাও সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতার অনুরাগী। ময়ূখ নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকাও বের করেন, যেমন করেন এরকম চাক বেঁধে আরো কোনো তরুণ গোষ্ঠী। অধিকাংশই দীর্ঘায়ু হয় না। ময়ূখও হয়নি। তবে তার নাম-যশ স্থায়ী হয়ে আছে জীবনানন্দ-সংযোগে। এবং এই সংযোগে মুখ্য ভূমিকা ভূমেন্দ্র গুহের।

তিনি জানাচ্ছেন (আলেখ্য : জীবনানন্দ, আনন্দ, কলকাতা, অবসর, ঢাকা, ২০১১), ওই সময়ের বাংলায় জীবনানন্দই ছিলেন তাঁদের সবচেয়ে আগ্রহের কবি। তাও প্রথম দিকের চেয়ে পরের দিকের কবিতার জন্যেই বেশি। চাইছিলেন তাঁরা কবির কোনো অপ্রকাশিত কবিতা নিজেদের পত্রিকায় ছাপতে। এতে তাঁদের বালখিল্যপনা গুরুত্ব পাবে। নিজেদের ভালো লাগার বাসনাও তৃপ্ত হবে। কিন্তু সরাসরি জীবনানন্দের সামনে গিয়ে লেখা চাওয়া, সাহসে কুলোয় না। কবি যে আইভরি টাওয়ারের বাসিন্দা, তা নয়। খ্যাতিতে উদাসীন, এমনও নয়। সমালোচনার হুল যে তাঁকে বিঁধে না, তা নয়। কিন্তু সর্বংসহ আচরণে আত্মমগ্নতাই তাঁকে চেনায়। ভিড়ের রাস্তাতেও তিনি একা। সামনে পড়লেও ডেকে কথা বলার সাহস জোগায় না। ভূমেন্দ্র গুহ ও তাঁর কতিপয় সঙ্গী কবির বাসার সামনে দিয়ে কদিন এমাথা-ওমাথা পায়চারি করেও ব্যর্থ। অবশেষে কবির বোন সুচরিতা দাশের নজরে পড়েন। তিনিই মধ্যস্থ হয়ে জীবনানন্দকে ডেকে বাসাবাড়ির দরজার সামনে এনে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ভূমেন্দ্র গুহ যোগাযোগের একটা সুযোগ পান। বেশি ভাব হয় তাঁর সুচরিতাদির সঙ্গে। বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি হয়। জীবনানন্দও

কখনো-কখনো এক-আধটা মন্তব্য করেন। কিন্তু খোলামেলা হন না। অবশ্য ময়ূখের শারদ সংখ্যায় নিজের বাছাই করা একটা কবিতা দেন। এতে ওই পত্রিকার মান ও খ্যাতি, দুই-ই বাড়ে। খেয়াল করি, কবিতা নিয়ে, এমনকি, গোটা সাহিত্যকর্ম নিয়েই কোনো আপস এই কবি কখনো করেননি। ভেতর থেকে সায় না পেলে কোনো লেখাই ছাপতে দেননি। নিদারুণ অর্থকষ্টেও লেখাকে পণ্য করেননি। অসম্ভব কৃচ্ছ্রের ভেতরে দু-একবার কথাসাহিত্যের পসরা সাজাবার কথা ভেবেছেন। কিন্তু তা অচিরেই ত্যাগ করেছেন। এই কঠিন আত্মমীমাংসা এক চরম ব্রত। জীবনানন্দ যেভাবে তা পালন করেছেন, তা আত্মনিগ্রহের পর্যায়ে পড়ে। সাহিত্যের

মূল্যবিচারও বোধহয় একপেশে হয়ে যায়। পাঠকের সাড়া দেওয়া সব সময়ে যথার্থ হয় না। বাংলায় বুদ্ধদেব বসুর, না। এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও। কিন্তু সবটাই কবির নিজের কাঁধে নিয়ে চলা। দুর্ভোগ কি তাতে এড়ানো যায়? সাহিত্যের বাছ-বিচারও কি, যতদূর দেখা যায়, যথার্থ থাকে? জীবনানন্দের নিজের বেলাতেই এ-প্রশ্ন তোলা যায়। অবশ্য তাঁর স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়নকে পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েই।

যাই হোক, ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দের আস্থাভাজন হন, ভাই অশোকানন্দ ও ভ্রাতৃবধূ নলিনী দাশেরও। বোন সুচরিতা যোগাযোগ করে দেন। জীবনানন্দ নলিনী দাশের সঙ্গে আগে থেকেই টুকটাক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এছাড়া অশোকানন্দ ছিলেন উঁচু পদে আসীন কর্মকর্তা। যথেষ্ট সচ্ছল। পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতা আসার পর কর্মজীবনে ব্যর্থ ও উপেক্ষিত জীবনানন্দ তাঁর ওপর প্রায়ই নির্ভর করতে বাধ্য হতেন।

জীবনানন্দের আকস্মিক অপঘাতে মৃত্যুর পর তাঁর অপ্রকাশিত রচনাবলির হিসাব-নিকাশ শুরু হলো। দুই পরিবারেই স্বীকৃতি পাওয়ায় এবং জীবনানন্দের কবিতার অকৃত্রিম অনুরাগী হওয়ায় ভূমেন্দ্র গুহ এই উদ্যোগে, বিশেষ করে সুচরিতার আগ্রহে, সহযোগিতা করার ডাক পান। তিনিও একে শ্রদ্ধেয় ও অবশ্যকরণীয় বলে মনে করেন। নিজের ঘরে জীবনানন্দ কটি ট্রাংকে যে তাঁর লেখার ভাণ্ডার যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন, এটা তিনি আগেই লক্ষ করেছেন। কাউকে লেখা দিতে রাজি হলে কবি ওইসব ট্রাংকের কোনোটি অর্ধেক খুলে মাথা গলিয়ে লেখাটি হাতড়ে বের করে এনে আবার তখন-তখনই তাতে

তালা-চাবি লাগিয়ে দিতেন। এখন ওই সম্পদের উদ্ধার, তালিকা প্রণয়ন, শ্রেণিবিভাজন, বর্গীকরণ, এসবের জরুরি প্রয়োজন পড়ল। প্রবল উৎসাহে ভূমেন্দ্র গুহ এ-কাজে হাত লাগালেন। তখনই আবিষ্কৃত হলো, কবি তিরিশের দশক থেকেই বেশ কিছু উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে এসেছেন। কখনো তাদের ছাপতে দেননি। এদের অস্তিত্ব তিনি ছাড়া আর কেউ জানতেন না। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, ভূমেন্দ্র গুহর হাতে উঠে এলো একটা বাঁধাই খাতা। তাতে সবটা জুড়ে আছে এক পুরো কাব্যগ্রন্থের পা-ুলিপি। কাটাকুটি নেই বললেই চলে। শুধু কোনো কোনো কবিতায় টুকটাক জায়গায় জায়গায় বিকল্প শব্দের উল্লেখ দেওয়া আছে। মনে হয়, যেন প্রাথমিক খসড়া নয়, পুরোটাই তৈরি। পাশে অনামা কাউকে তাঁর হাতে লেখা এক চিঠি, যা অনুমান, তিনি আর ডাকে দেননি। লেখা আছে তাতে, ভূমেন্দ্র গুহ তাঁর স্মৃতি থেকে জানাচ্ছেন, ‘একটি বিশেষ ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে আবহমান বাংলা ও বাঙালির প্রেক্ষিতে কতকগুলি

সনেট-জাতীয় কবিতা দু-তিন দিনের ভিতরে লিখে ফেলেছিলেন; লেখাগুলি খুব সহজেই হয়ে উঠেছিল নিজেরা, লেখবার সময় তারা ও তাদের অবয়ব প্রায় পূর্ণ দৃষ্টিলোকী হয়ে উঠেছিল, এ-রকম হয়েছিল যে, সেগুলি এক জায়গায় গুছিয়ে তুলবার সময় তাঁর কখনও মনে হয়নি যে, সম্পূর্ণতার তাগিদে তাদের রূপের কোনও পরিবর্তন দরকার হবে আর।’ ‘তিনি আরো বলেছেন, লেখাগুলিকে বাংলার ত্রস্ত নীলিমা নামে গ্রথিত করা যেত হয়তো দূরের কোনও এক সময়ে, কিন্তু ১৯৪৫-৪৬-এ পৌঁছে সে জিনিস করা আর সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে, অনেক সাম্প্রতিক রচনাই তো প্রকাশিত না হয়ে পড়ে থাকছে আর সময়ও

অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে ওই লেখাগুলির সময়ের থেকে।’

আরো একটা কথা জানানো দরকার। রূপসী বাংলা-নাম বিতর্কের সময় ভূমেন্দ্র গুহ নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বলে দেন, ওই পা-ুলিপির নাম-পত্রে তিনিই একসময় অন্যমনস্কভাবে ‘গাঙুড়ে’ শব্দটি আলগা করে একপাশে লিখে রাখেন। এতে প্রশ্ন ওঠে, জীবনানন্দই এই বিকল্প নাম ভেবেছিলেন কি না। কারণ ওই শব্দটির প্রতীকী তাৎপর্য ও বিষয় মহিমা অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোর ভাবলোকের কাছাকাছি। কবি নিজেও কবিতাগুলো রচনার সময় তাঁর কল্পপ্রতিমায় আচ্ছন্ন ছিলেন। তার অসামান্য প্রয়োগও ঘটিয়েছেন। যেমন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’তে। তুলনাহীন এই উচ্চারণ –

– বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে –

কৃষ্ণ দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় –

সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,

শ্যামার নরম গান শুনেছিল – একদিন অমরায় গিয়ে

ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়

বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।

এর আবেদন অনিঃশেষ। এমন অসামান্য পঙ্ক্তিমালা বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে খুব কমই। ‘গাঙুড়ে’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা পুরাণে বেহুলা-কথা অমর হয়ে আছে। মৃত স্বামী লখিন্দরের জীবনভিক্ষায় এই নদী গাঙুড়ে ভেলা বাসিয়ে স্বর্গে দেবসভায় ইন্দ্রকে নাচ দেখিয়ে তুষ্ট করে তাকে পতির প্রাণ ফিরে পেতে হয়। বেহুলার অদৃষ্ট যেন চিরকালের বাংলার। লখিন্দর যুগপরম্পরায় বাঙালি। গাঙুড়ে তাদেরই জীবন-মৃত্যু প্রবাহ।

‘গাঙুড়ে’-আবার এসেছে ‘তোমার বুকের থেকে’-তে :

– তবু যেন মরি আমি এই

মাঠ-ঘাটের ভিতর,

কৃষ্ণা যমুনার নয় – যেন এই ‘গাঙুড়ের ঢেউ’এর আঘ্রাণ

লেগে থাকে চোখে মুখে – ‘রূপসী বাংলা’ যেন বুকের উপর

জেগে থাকে; –

এতটা প্রাসঙ্গিক হওয়ায় ধন্দটা মনে হয় স্বাভাবিক। তবে ভূমেন্দ্র গুহ নিজেই সব খোলসা করে দেন। পা-ুলিপি পাবার পর অশোকানন্দ দাশ সিগনেট প্রকাশনীর কর্ণধার দিলীপ গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি সাগ্রহে বইটি ছাপাতে রাজি হন। কিছু সম্পাদকীয় স্বাধীনতাও নেন; এবং, অশোকানন্দের সঙ্গে কথা বলে বইটির কবির দেওয়া নাম, বাংলার ত্রস্ত নীলিমা পালটে রূপসী বাংলা করে দেন। কোনো মৃত কবির বইতে তাঁর প্রস্তাবিত নাম এভাবে বদলে দেওয়া নীতিগতভাবে সমর্থন করা যায় না। তবে এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, এই পরিবর্তন অযথার্থ হয়নি। রূপসী বাংলা, বইটির মর্মবাণী যেভাবে তার সার্বিক ভাবকল্পনায় ধারণ করে, মনে হয় ‘ত্রস্ত নীলিমা’য় তা ফোটে না।

এখানে অবান্তর, তবু আলটপকা নাক গলিয়ে অন্য একটি কথা। আমাদের শামসুর রাহমানের নন্দিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭)। ‘ত্রস্ত নীলিমা’র খবর তখনো চাউর হয়েছে কি-না জানি না। এর পরেই নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮)। আমার মনে হয়েছে (শুধুই মনে হওয়া, কোনো সিদ্ধান্ত নয়), বইয়ের নাম-পরিচয়ে বিধ্বস্ত নীলিমা ও নিরালোকে দিব্যরথ যদি পরস্পর জায়গা বদল করত, তবে তা দুটি কবিতাগুচ্ছের মর্মপরিচয়ের সঙ্গে বেশি খাপ খেত। তারপরেই নিজ বাসভূমে (১৯৭০)। শুধু নামের দিক থেকে বিধ্বস্ত নীলিমা শব্দের ভাবব্যঞ্জনা তার কাছাকাছি। নিরালোকে দিব্যরথ বইয়ের কবিতাগুলো কিন্তু নিজ বাসভূমে-মুখো। বিধ্বস্ত নীলিমার ঠিক ততটা নয়। যে নতুন মেজাজ ও সুর নিরালোকে দিব্যরথে ফুটে উঠতে শুরু করেছে, তা তীব্রতর, স্পষ্টতর ও ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে নিজ বাসভূমেতে। নিরালোকে দিব্যরথ-নাম অন্যরকম প্রত্যাশা জাগায়। বিধ্বস্ত নীলিমা কিন্তু নাম হিসেবে নিজ বাসভূমেতে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত ধরে রাখে।

এদিকে রূপসী বাংলার চৌম্বক আকর্ষণ ত্রস্ত বাংলায় নেই। চেতনায় সে সরাসরি আসন পাতে। মুছে যায় না। উল্কি যেন। তবে তা বাংলা ও বাঙালির স্বপ্নকল্পনার অতীত প্রবাহের সমস্তটা গ-ূষে তুলে নেয়। বহিরঙ্গে তার স্বর্ণ-বিভা ছড়ায়। মনে হয় তা অবিনশ্বর। এত কোমল, এত আত্মমুখী অন্তর্গত সনেট-সমগ্রে তার বিরতিহীন বিস্তার, যে ভাবাই যায় না বাঙালির সামূহিক মুক্তিসাধনায় তা মন্ত্রপূত ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠবে। বাস্তবে কিন্তু তা-ই হয়। অথচ অশোক মিত্রের ভাষায় জীবনানন্দ তাদের বিশ বছর ‘ঘুম পাড়িয়ে’ রেখেছিলেন। এবং এইটিই তাঁর যথার্থ মনে হয়েছিল। কবি নিজেও, অনুমান, তেমনটিই ভেবেছিলেন। নইলে অনামা কাউকে ডাকে না দেওয়া চিঠিটিতে কেন দ্ব্যর্থহীন লিখতে যাবেন, ঢের আগে এদের প্রকাশের কাল পেরিয়ে গেছে। চলমান বাস্তব নিতান্তই বিমুখ।

অস্বীকার করা যায় না, গত শতকে তিরিশ ও চল্লিশের দশকের অবিভক্ত বাংলায় কোনো শান্তি ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার করাল-দংষ্ট্রা ক্রমশ মুখ-ব্যাদানে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ভয়ংকরের বীভৎসাকে প্রত্যক্ষে উলঙ্গ করে ‘শান্তি-কল্যাণ’-শিকড়-সুদ্ধ চিবিয়ে খেতে ধেয়ে আসতে থাকে। বিশ্বব্যাপী মহামন্দার ছোবল এখানেও পড়ে। আশার জগৎ ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে বহু-মানুষের

অকৃতার্থতার অক্ষমতাকে পারস্পরিক ঈর্ষার দিকে ঠেলে দিয়ে তিক্ততার বিস্তারে ইন্ধন জুগিয়ে চলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরোক্ষ আঘাত জনজীবনে বিপর্যয় আনে। আগ্রাসী মন্বন্তরে লক্ষ-লক্ষ মানুষের প্রাণ যায়। শস্যের ফলন কমে যাবার কারণে নয়, সরকারের যুদ্ধ-নীতির প্রয়োগে উৎপাদিত খাদ্য সরকারি মজুতে চালান দেওয়ায়, এবং আকস্মিক দিনমজুর ও

মাঝি-মাল্লার কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। চূড়ান্ত পর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গোটা বাংলাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাওয়া। পরিণতিতে দেশভাগ,

লক্ষ-লক্ষ মানুষের স্থায়ী ভিটে-মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া, যাদের ভেতরে মিশে যায় বরিশালে সর্বানন্দ-ভবনের জীবনানন্দ পরিবার। সেই অনিবার্যতার মুখে দাঁড়িয়ে ১৯৪৫-৪৬-এ তাঁর যদি মনে হয়, ‘হা-হা রবে’ ‘তার ছিঁড়ে গেছে’, ওইসব সনেট বেসুরো বাজবে, তবে তা সবটাই অসংগত মনে করার কোনো কারণ নেই। আজ কিন্তু পেছন ফিরে তাকিয়ে অনেক ডামাডোল পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, বাঙালি প্রাণের শুদ্ধ স্বর অবিমিশ্রিত শুনতে পাই যে সব রচনায়, তাদের সারিতে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’র সঙ্গে সবার ওপরে পাশাপাশি অটল মহিমায় জায়গা করে নিয়েছে রূপসী বাংলার ‘বাংলা-র মুখ আমি দেখিয়াছি’ ও ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে’ – এই কবিতা দুটি। একাত্তরে ক্রান্তিকালে ‘আবার আসিব ফিরে’ হয়ে উঠেছিল অস্তিত্বের সংগ্রামে সব বাঙালির জীবনমুখী শপথ। এটা এক আশ্চর্য সমাপতন, আমাদের উজ্জীবিত করায় এই তিনটি কবিতার কোনোটিই বীররসের উত্তেজনা ছড়ায় না। আত্মকরুণাও জাগায় না। শুধু অনাবিল সরলতায় অনুভবের শুদ্ধ বাক্যগুলি অপার করুণায় ডুবিয়ে উচ্চারণ করে।

তাহলে কি দেশভাগের প্রাক্-মুহূর্তে জীবনানন্দের ভাবনা

বিপথগামী ছিল? অথবা বাস্তবই পরে ভোল পালটেছে? ১৯৫৭-র আগে জনসাধারণের কাছে রূপসী বাংলার অস্তিত্বই ছিল অজানা। (একটা খটকার মীমাংসা আমার জানা নেই। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রকাশকাল ১৯৫৪, যদিও তাঁর মৃত্যুর পর। এই বই ১৯৪৭-৫৪ পর্বে বাংলা সাহিত্যে সেরা বই বিবেচিত হয়ে ভারতীয় সাহিত্য অকাদমি পুরস্কার পায়। ওই বছরই এই পুরস্কারের প্রবর্তন। এটা বোঝা যায় তাঁর কবিত্ব প্রতিভা তখন চাপা বা অবহেলিত ছিল না। যদিও রূপসী বাংলা তখন বিবেচনায় আসার কথা নয়। একে বাদ দিয়েই তখন তাঁর কবিখ্যাতি ও মর্যাদার মূল্যায়ন! তেমন হলে রূপসী বাংলা আড়ালে থাকা অবস্থাতে তাঁর কবিচেতনার ক্রমবিকাশ ও দিকনির্দেশনাই মর্যাদা পায়, যদিও এসবে অনেকের উদাসীনতা, এমনকি বিরাগ, যথেষ্টই প্রবল ছিল। তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা নাভানা-সংস্করণ, যা প্রথম দেখি, তা ১৯৫৭-র পরের। ‘রূপসী বাংলা-র কবিতা তার আপন’ পরিচয়েই তাতে আছে।) একটি বিষয় এখানে ধরা পড়ে, তাঁর

কবি-মহিমা ও স্বীকৃতি তখনো রূপসী বাংলা নির্ভর হয়নি। এবং, এই বই প্রকাশে তাঁর দ্বিধা, ফলে, আলাদা গুরুত্ব পায়। এদিকেও একটু নজর দেওয়া, বোধ হয়, প্রাসঙ্গিক।

 

দুই

কোথায় পড়েছি, ঠিক মনে পড়ছে না – দায়ী আমার আলস্য ও দুর্বল স্মরণশক্তি – কথাগুলো ছিল, আন্দাজ, এই-রকম : জীবনানন্দ তাঁর কবি-পরিচিতি পাবার গোড়ার দিকে বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লিখছেন, এই বেদান্তের দেশে কায়াকে ছায়া বলা দূরের কথা, ছায়াকেই তিনি কায়া করে তুলবেন। এর তাৎপর্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী। সব ভাবনা-কল্পনার জন্ম তাঁর চেতনাজগতে। প্রবহমান বাস্তবে তিনি তাদের রূপারোপ করেন। কল্পনার সঙ্গে অভিজ্ঞতার রসায়ন ঘটে। ওই কায়া প্রাণ পায়। রূপও বিভিন্নতায় ছড়ায়। কালের প্রবাহে মিশে গিয়ে আকর্ষণে-বিকর্ষণে একটা সমান্তরাল বাস্তব তারা নির্মাণ করে। সমান্তরাল, কিন্তু অভিব্যক্তিতে, অনুনয়নে তারা প্রত্যক্ষের সারাৎসার ধারণ করে। কবিতা মাধ্যম। তাকে অবলম্বন করেই কবি তাঁর সৃষ্টিক্রিয়ায় বাস্তবস্য বাস্তবের প্রকাশ ঘটান। যদি তাতে প্রাণবস্তু সত্যের আভায় ফোটে, এবং তা ফোটাবার জন্যেই কবিতায় শব্দ-ছন্দ-মিল-অমিলের নিরন্তর আয়োজন, তবে তা সগৌরবে স্থায়িত্বের দাবিদার হতে পারে। এ স্থায়িত্ব কিন্তু নশ্বর বাস্তবের বিবেচনাতেই। জীবনানন্দ নিজের ভেতরে এই স্থায়িত্বের আকাক্সক্ষা আজীবন লালন করেছেন। এতটুকু ভেজাল মেশাতে চাননি তাতে। চৈতন্যের পরিসরে নিজের সঙ্গে নিজে অবিরাম কথোপকথনে মগ্ন থেকেছেন। প্রত্যক্ষে হয়ে পড়েছেন খাপছাড়া। কিন্তু করণীয় ও লক্ষ্য থেকে একচুল সরেননি। তার মানে এই নয়, তাঁর কবিতা

ঐতিহ্য-বিচ্ছিন্ন – স্বয়ম্ভূ। সপ্তসিন্ধু-দশ দিগন্তে কবিতার যে সঞ্জীবনী-মায়াময় জগৎ, তার উত্তরাধিকার তিনি অস্বীকার করেননি। বরং তাকে শ্রদ্ধায় আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু করার পরেও সৃষ্টিকলায় তাঁর অক্ষয় ছাপ ক্রমশ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। উঠে চলেছে।

কেউ যদি খেয়াল করে তাঁর কবিতার কথা একটু খুঁটিয়ে পড়েন, তাহলে কি মনে হবে না, এ তাঁর নিজেরই স্বগত-কথন? একরকম ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’?

(কবি মোহাম্মদ রফিকের একটি বইয়ের শিরোনাম বিনানুমতিতে নিয়ে।) তিনি জানাচ্ছেন, (যারা কবি) ‘তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে।…’ আরো যোগ করেন তিনি ‘…আমাকে অনুভব করতে হয়েছে যে, খ–বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায় – একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়।…’

লক্ষ করি, তাঁর কথামতো কোনো সত্যিকারের কবি চেতনালোকে কোনো ক্ষুদ্র বেষ্টনীতে বাঁধা থাকেন না, –

স্থান-কাল উভয়ত। পার্থিব বাস্তবতা-ও-দূরতম নক্ষত্রের অন্বয় একই সঙ্গে তাঁর কল্পনাকে ও ভাবনাকে আলোড়িত করে। এই মননতাড়িত আবেগ তার সবটুকু ঢেলে দিয়ে ভরে তোলে হৃদয়। প্রকাশ খোঁজে তা কবিতায়। শব্দ-দৃশ্য-পরম্পরা, পারস্পরিক সংযোগ-দূরত্ব, প্রত্যক্ষে সুদূরের ইঙ্গিতময়তা, অথবা তার বিপরীত, এ সবই তার ফসল। তবে এও আমরা জানি, কবিতাকে বাঁধতে হয় পরপর সাজিয়ে শুধুই শব্দের মায়ায়। এই শব্দেরও আছে স্থান ও কালে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠার ইতিহাস। কবির রচনাও, সত্যিই যদি তা নতুন সৃষ্টি হয়, – ওই ইতিহাসেই জায়গা করে নেয়, এমনকি তাকে সমৃদ্ধ করে। নতুন মাত্রা, নতুন সুরও আনে তাতে।

কবিতা সৃষ্টির এই দায়বদ্ধতায় ও মাপকাঠিতে যদি স্বয়ং জীবনানন্দকে বোঝার চেষ্টা করি, তবে রূপসী বাংলা বাদ দিয়ে ধূসর পা-ুলিপি থেকে শেষ রচনা পর্যন্ত এক নিরন্তর আত্মমগ্নতার, আত্মানুশীলনের ও বিশ্বচরাচরে আত্মব্যাপ্তির সৎ অনুশীলনের ধারাবাহিকতাই আমরা দেখি। পরিপার্শ্বের জটিলতার সঙ্গে তাল মেলাতে, বাইরের অভিঘাতকে শব্দে-স্পর্শে-ঘ্রাণে যথার্থ প্রতিফলিত করে কবিতায় সঞ্চালিত করতে এতটুকু ছলনার আশ্রয় তিনি নেননি, সহজ সুখের ভ্রান্তিও জাগাননি। এ যেন এক অসিধারা-ব্রত – যে পিঠে তরবারির ধার, তার ওপর দিয়ে হাঁটা। তিনি আপস করেননি। অনেক গঞ্জনার মুখে অবিচল থেকেছেন। দুর্বোধ্যতার অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছেন। এমনকি কাব্যে অনাচারেরও। প্রায়ই নীরব উপেক্ষায় তিনি তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। পথভ্রষ্ট হননি।

এখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে, জীবনানন্দ কি ভাবনা-বলয়ে ছিলেন হেগেলীয়? অবশ্য ব্যাপক অর্থে? হেগেল চৈতন্যকে পূর্বগামী ধরে তাঁর তত্ত্ব-কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন। প্রাথমিক চৈতন্য অবশ্য অব্যাখ্যাত, পূর্বনির্ধারিত। সেই সূত্রে আসে অধিবিদ্যক পরম শক্তির ধারণা। আজ অবশ্য এটুকু আমাদের জানার বৃত্তে যে, মানব চৈতন্য নির্মিত হয় বাস্তব মহাবিশ্বেই, যার উদ্ভব অকল্পনীয় ভর-সমৃদ্ধ শূন্যাবস্থা (ঝরহমঁষধৎরঃু ঈড়হফরঃরড়হ) থেকে। কেন, তার জবাব, যদ্দূর জানি, এখনো মেলেনি; তবে তাতে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটে প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে। তা থেকেই আবির্ভাব ঘটে পদার্থ, শক্তি, সময় ও স্থানের। আবার তার তিন লক্ষ বছর পর শক্তি ও পদার্থরাশি পরস্পর সংঘাতে ও সংমিশ্রণে ‘কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই’  আকর্ষণে-বিকর্ষণে অণু-পরমাণুর বিচরণক্ষেত্র রচনা করে। তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একইভাবে নতুন-নতুন সৃষ্টিতে প্রসারিত হয়। এই প্রক্রিয়া শুরুর অনেক পরে, মহাবিস্ফোরণে সৃষ্ট নীহারিকা, নক্ষত্রপুঞ্জ, ছায়াপথ, গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদির চলমানতার গতিপথ রচিত হবার প্রায় দশ বিলিয়ন বছর পর বিভিন্ন রসায়নের পরিণামে পৃথিবী নামে এই ছোট গ্রহটিতে ঘটে প্রাণের আবির্ভাব। বিবর্তনের পথে বিভিন্ন প্রাণীর পাশাপাশি মানুষের দেখা মেলে সত্তর হাজার বছর আগে। অনুশীলনে-অধ্যবসায়ে-দ্বন্দ্বে-সমন্বয়ে তার মেধার ও চৈতন্যের ক্রমবিকাশ; সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন পথপরিক্রমা। নির্দ্বান্দ্বিক নয়। মিলনও বরাবর একই রকম বাস্তব। তবে চৈতন্য মহাবিশ্বাতিগ নয়। যদিও প্রাণের জাগরণে ও উদ্বোধনে মূল চালিকাশক্তি চেতনাই। অন্যান্য কর্মপ্রতিভাকে বিভিন্ন গতিপথে তা নির্দেশ পাঠায়। নিয়ন্ত্রণ বা প্ররোচিত করে। হেগেলীয় তত্ত্ব-কাঠামোর ভেতরেও এভাবে দেখা সম্ভব। এতে চিন্তায় যান্ত্রিকতা বোধ হয় এড়ানো যায়। জীবনানন্দকে এই ছকে হেগেলপন্থী বলায় কোনো অসংগতি দেখি না। যদিও গত শতকের

ভাবনা-শৃঙ্খলায় বিভাজনরেখা আজ অনেকটাই তাৎপর্যহীন।

কথাটা কিঞ্চিৎ খোলসা করেন জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধের দ্বিতীয় প্যারাতেই। – ‘বলতে পারা যায় কি এই সম্যক কল্পনা-আভা কোথা থেকে আসে? কেউ কেউ বলেন, আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সেকথা যদি স্বীকার করি তাহলে একটি সুন্দর জটিল পাককে যেন হীরের ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম।…  কিন্তু মানুষের জ্ঞানের এবং কাব্য সমালোচনা-নমুনার নতুন নতুন আবর্তনে বিশ্লেষকরা এই আশ্চর্য গিঁটকে – আমি যতদূর ধারণা করতে পারছি – মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খসাতে চেষ্টা করবেন।’ আবার একইসঙ্গে তিনি কোনো পূর্বনির্ধারিত তাত্ত্বিক বা নিয়ম-মাফিক প্রক্রিয়ায় কবিতা-সৃজন সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করেন। প্রতিভার ব্যতিক্রমী মৌলিক ভূমিকা তাতে থেকেই যায়। এবং এখানেই তিনি গভীরভাবে হেগেলের দূরান্বয়ী সহচর। একথাও অনস্বীকার্য, কোনো দুজন মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া একরকম নয়। প্রকৃতি পরিবেশের ভূমিকা একটা আছে। কিন্তু তারপরেও – অথবা তার আগেই – যা অনুপেক্ষণীয়, তা হলো, মানুষের মগজে রাসায়নিক সংস্থান প্রত্যেকের আলাদা, এবং ওই অভ্যন্তরীণ বস্তুটির অতিসামান্য অংশের ক্রিয়াকলাপের যথার্থ সূক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদই এখন পর্যন্ত মানুষের আয়ত্তে। তার সবটাই কিন্তু পঞ্চভূতের নানা উপাদানের – জানা, বা, অজানা – মিশ্রণ। এতে বিশ্বচরাচরের বাইরের কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করা বাতুলতা।

সৃষ্টিকল্পনার এই প্রাথমিক ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে সেখান থেকে জীবনানন্দের কবিতা যাত্রা। রূপসী বাংলাকে এক পাশে সরিয়ে রাখলে তাতে ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় বিরাম নেই। অন্যেরা যে-যাই বলুক, নিরাসক্তভাবে দেখলে এটা মনে হওয়া, অনুমান, অমূলক নয় যে, তাঁর কবিতা ক্রমাগত নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে, মানব-ভাগ্যের অণুবীক্ষণের ও দূরবীক্ষণের দিকে প্রসারিত হয়েছে। তিনি যেন বোধিসত্ত্বের ভূমিকায়। তবে উচ্চকণ্ঠ কদাপি নন। যা উচ্চারণ করেন, তার তলদেশে এক নৈর্ব্যক্তিক ধারা বহমান। ছায়াকে, অর্থাৎ ভাবনা-কল্পনার সারাৎসারকে কায়ায় বা প্রত্যক্ষের প্রাণে-অপ্রাণে ফুটিয়ে তুলে তাতে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকতা প্রকাশমান করাতেই তিনি অন্তরঙ্গ দৃশ্যকলা পরপর বুনে যান। নিজস্বতা ততটুকুই যোগ হয়, যা তাঁর আপন অভিজ্ঞতার সারাৎসার। অন্যান্য সৎ অভিজ্ঞতার মতো। প্রতিমা নির্মাণ ও তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা কবিচৈতন্যে নিরাসক্ত-নৈর্ব্যক্তিক মনন ও অনুভবের পরিণাম। আমরা স্মরণ করি, ‘আট বছর আগের একদিন’ – কবিতাটি ১৯৩৮ সালে ছেপে বেরোবার বেশ পরে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র কবি বলে তাঁকে অভিযুক্ত করেছিলেন। জীবনানন্দ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন, ‘আধুনিক কবিতায় যে ‘আমি’-র ব্যবহার করা হয়… সে ‘আমি’… কবির নিজের ব্যক্তিগত সত্তা মোটেই নয়, কবি মানসের কাছে সমাজ ও কালের রূপ যেভাবে ধরা পড়েছে তারই প্রতিভূ সত্তা…।’

শুধু ‘আমি’ নয়, সব সর্বনামের বেলাতেই, এবং নাম-বিশেষ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এই-রকমই। এটা মাথায় থাকলে ‘নাটোরের বনলতা সেন’-এর

ঠিকানা-কুলুজি খুঁজতে গবেষকদের গলদঘর্ম হতে হয় না।

আমরা জানি, জীবনানন্দের এই ক্রমবিকাশ তাঁকে ‘কতিপয়’-এর কবি করে তুলেছিল। তাঁর নিজের সংজ্ঞাতেই এটা যৌক্তিক। তিনি বলেছিলেন এ-রকম : কবিতার বড় বাজারে তাঁর বই কাটে না। শুধু ছোট-বাজারে একটু-আধটু। এ-ও জানি, যতই চুপচাপ থাকুন, নিজের বোধের কাছে সত্য হয়ে না ওঠা পর্যন্ত তিনি তাঁর কোনো কবিতা প্রকাশযোগ্য মনে করেননি। এ বিষয়ে তিনি একগুঁয়েই ছিলেন। কখনো নিন্দা-প্রশংসায় ভেসে যাননি। সত্য কথা, জীবদ্দশায় তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না। সাহিত্যিক সমালোচনা নয়, আক্রমণ সহ্য করেছেন অনেক। কিন্তু খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠা তাঁর জোটেনি, এটা অর্ধ-সত্য। বাংলা সাহিত্যে সাত বছরের সেরা কীর্তির জন্য সর্বভারতীয় অকাদমি পুরস্কার তাঁর প্রতিভারই স্বীকৃতি। অজস্র পুরস্কারের বহুল প্রচলন তখনো শুরু হয়নি। প্রথম প্রহরে বুদ্ধদেব বসু প্রগতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা পড়ে তাঁকে আনন্দঘন স্বীকৃতি জানিয়েছেন। ধূসর পা-ুলিপি (১৯৩৭) প্রকাশের পর কবিতা পত্রে তাঁর সপ্রশংস আলোচনা ছাপিয়েছেন। ‘প্রকৃতির কবি’ বলে তাঁকে শনাক্ত করেছেন। বনলতা সেন (১৯৪২) বের হয় ‘কবিতা ভবন’ থেকে। সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসু আবার উচ্ছ্বসিত। জীবনানন্দের বিরল প্রতিভার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবার তাঁকে অভিধা দেন, বাংলা ভাষায় ‘সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র কবি।’ বুদ্ধদেবের ব্যতিক্রমী কবিতা-পত্রিকার আবির্ভাব ১৯৩৫ সালে। প্রথম সংখ্যাতেই তিনি ছাপেন জীবনানন্দের দুটো কবিতা : ‘বনলতা সেন’ ও ‘মৃত্যুর আগে।’ দ্বিতীয় কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে জানান, ‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে।’ অন্যত্র তিনি লেখেন, এই কবির সৃষ্টিতে তিনি পান ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ।’ তবে একটা বিষয় খচখচ করে, ওই সংখ্যায় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির ওপর কি তাঁর নজর পড়েনি? বুদ্ধদেব অবশ্য তাঁর সৎ সমালোচনার দৃষ্টান্ত রাখেন এই বলে, ‘তাঁর কাব্য বর্ণনাবহুল, তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল, তাঁর চিত্র বর্ণবহুল।’ এই উদ্ধৃতিগুলো এখন জীবনানন্দ কাব্যপাঠে বৈশিষ্ট্যসূচক মাদুলি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কি যথেষ্ট? অথবা একি আরো ভেতর-মহলে ঢোকার পথে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়?

ওই পর্বে জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া ছিল কিন্তু মিশ্র। সরাসরি এক চিঠিতে তিনি লেখেন : ‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে।’

রবীন্দ্রনাথ এখানে যে ‘শান্তি’র কথা বলেছেন, তার তাৎপর্য কী? তা না থাকলে কি মহান সাহিত্য হয় না? ইলিয়াড ও রামায়ণের পরিসমাপ্তি আক্ষেপে। শুদ্ধ সাহিত্যপাঠে মহাভারতও মনে কোনো প্রশান্তি আনে না। হয়তো জীবনের অনিত্যতায় আসক্তিহীনতার নির্বেদ জাগায়। আনা কারেনিনা পড়ে তাঁর ভালো লাগেনি, এ-কথা তিনি নিজেই বলেছেন। তারপরও একে কি ‘বড়ো জাতের রচনা’ বলা যাবে না? স্বয়ং কবির যোগাযোগ উপন্যাসে ‘শান্তি’ কোথায়? এবং এই শান্তির ভাবনাও কি সব সময়ে স্থান ও কালে আপেক্ষিক নয়?

প্রায় সমসময়ে (বা. ১৩৪০) তিনি ‘সাহিত্য তত্ত্ব’ নামে যে-প্রবন্ধ লেখেন, তাতে তাঁর ‘সন্দেহ’ বিরক্তিতে গিয়ে ঠেকে। নিজের অভিমত সরাসরি জানান : ‘- যদি বলা হয়, আগেকার কবিরা বাছাই করে কবিতা লিখতেন, অতিআধুনিকরা বাছাই করেন না, সে কথা মানতে পারিনে, এঁরাও বাছাই করেন। তাজা ফুল বাছাই করাও বাছাই, আর, শুকনো পোকায় খাওয়া ফুল বাছাই-ও বাছাই। কেবল তফাৎ এই যে, এঁরা সর্বদাই ভয় করেন পাছে এঁদের কেউ বদনাম দেয় যে এঁদের বাছাই করার শখ আছে। অঘোরপন্থীরা বেছে-বেছে কুৎসিত জিনিস খায়, দূষিত জিনিস ব্যবহার করে, পাছে এটা প্রমাণ হয় ভালো জিনিসে তাদের পক্ষপাত। তাতে ফল হয়, অ-ভালো জিনিসেই তাদের পক্ষপাত পাকা হয়ে ওঠে। কাব্যে অঘোরপন্থীর সাধনা যদি প্রচলিত হয়, তাহলে শুচি জিনিসে যাদের স্বাভাবিক রুচি তারা যাবে কোথায়!’ কিছু আগে ‘আধুনিক কাব্য’ (বা. ১৩৩৯) প্রবন্ধে একই বক্তব্য জাহির করতে তিনি এলিয়টের ‘চৎবষঁফবং’ কবিতাটির অনেকখানি অনুবাদ করে তাতে জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘বাঁশি’ কবিতায় (১৩৩৯ বা.) ‘চৎবষঁফবং’-এর ছায়া পড়েছে। যদিও স্থান-কাল-প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আরো যোগ করা যায়, গীতবিতানের পূজা-পর্বের প্রথম গানটিতেই পড়ি, ‘অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে’। অশান্তির আঘাতে যদি শান্তির সুর বাজে তবে তা আত্মখ-ন। তাঁর নিজের সৃষ্টিতেও তেমন কোথাও নেই। পরিণাম যা-ই হোক। বিঠোভেনের ফরাসি বিপ্লবপ্রাণিত কম্পোজিশনে অশান্তির সংগতিই মহান।

মনে হয়, শান্তি-অশান্তি নয়, জীবনানন্দের কবিতায় যে শব্দে

গুরুচণ্ডালী-আকছার ব্যবহার, সর্বনামে ক্রিয়াপদের পাশাপাশি সাধু-চলিত প্রয়োগ, ধুলো-মাটি থেকে কুড়িয়ে আনা শব্দের কুলীন সংযোগ, এসবেই তাঁর প্রত্যাশিত অভ্যাসের তাল কাটে। কাল কিন্তু

আজ-পর্যন্ত জীবনানন্দের

শব্দ-প্রয়োগ-কুশলতার পক্ষেই রায় দিয়ে চলেছে। আর একটা প্রশ্ন মনে জাগে, তাঁর কালজয়ী ‘বোধ’ কবিতায় (ধূসর পা-ুলিপি) মনন-সম্ভূত বাণী, ‘সকল লোকের মাঝে ব’সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?…’ – এখানে ‘মুদ্রাদোষ’ শব্দটি, এবং পুরো

বাক্-চিত্রটি, কি রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে ‘কাব্যের মুদ্রাদোষটা’ – এই কথার প্রতিক্রিয়ায়?

বনলতা সেনের পর, জীবনানন্দের জীবদ্দশায় তাঁর আরো দুটি অনন্যনির্ভর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় – মহাপৃথিবী (১৯৪৪) ও সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। ধূসর পা-ুলিপি, বনলতা সেন ও মহাপৃথিবী পরপর প্রকাশিত হলেও কবিতাগুলোর রচনাকালের ক্রমানুসারে বই তিনটের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। সাধারণভাবে তাই এই তিনটেকে কিছু ব্যতিক্রম মেনে নিয়ে একই বলয়ে ফেলা চলে। যদিও মহাপৃথিবীতেই গোটা বিশ্বের টালমাটাল অবস্থার সঙ্গে বাংলায় দুর্দশার ছাপ অল্পবিস্তর পড়তে শুরু করে। তবু চরিত্রবিচারে ধূসর পা-ুলিপি থেকে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১) পর্যন্ত (রূপসী বাংলা বাদে) একই ধারার বলে চিনে নেওয়া যায়। দেখি কবি যত পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছেন, তত তাঁর মনন-প্রতিভা শানিত হয়েছে। কল্পনায় ইতিহাসের গতিরেখা আরো স্পষ্ট হয়েছে। বিমূর্তভাব বেশি-বেশি প্রতীকী প্রতিমাকে আশ্রয় করেছে।

আভাসে-ইঙ্গিতে, চিত্ররূপে নৈর্ব্যক্তিক ঘটনারাশির অভিঘাতে প্রচ-তা ধরা পড়েছে। যে বুদ্ধদেব বসু শুরুতে তাঁর

প্রকৃতিপ্রেম ও নির্জনতার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, তিনিই এখন তাঁর কবিতাকে ‘নিঃসুর’ ও ‘নিস্বাদ’ বলে প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেন। অথচ কবির বিবর্তন ঘটেছে শুরু থেকেই, এবং এক যৌক্তিক মোহানার দিকেই তাঁর যাত্রা। আবেগ সংহত, জাগ্রত চৈতন্যের স্বাক্ষর স্পষ্ট। কবিতার ঘনত্ব ক্রমবর্ধমান। প্রতীকী মায়ায় বহুস্বরের অনুরণন। তাতে প্রতিফলিত হতে পারে একই সঙ্গে একৈকান্তিক

(ড়হব-ড়হব), একানেকান্তিক (ড়হব-সধহু), অনেকৈকান্তিক (সধহু-ড়হব) ও অনেকানেকান্তিক (সধহু-সধহু) কর্তা-কর্ম সম্পর্ক। ভেক্টর-স্পেসে (াবপঃড়ৎ ংঢ়ধপব) যেমন বোঝায় তেমন। কবিতার অতিরিক্ত মেদ ঝরে যায়। (জীবনানন্দ শুরু থেকেই অবশ্য কবিতায় মিতবাক।) আবেগের আতিশয্যে ও তার বর্ণাঢ্য আয়োজনে যাঁদের তৃপ্তি, তাঁরা হতাশ হন। কিন্তু কবিতা বাস্তব জটিলতার কেন্দ্রবিন্দু স্পর্শ করে। বিষয়টি বোঝার জন্যে সাতটি তারার তিমির-এ ‘আকাশলীনা’ কবিতাটি বেছে নিই। এতে দৃশ্যত এক নারীর কাছে গলার শিরা ছেঁড়া আবেদন, সে যেন অন্য কারো আকর্ষণে না ভোলে। এইটিই কবিতার শেষ কথা হলে এতে ব্যতিক্রমী কিছুই আমাদের মনে সাড়া জাগাতো না। কিন্তু এ বিশেষ থেকে নির্বিশেষে যায়। এবং তা কবিতায় সুরঞ্জনা নামে এক নারীতে নির্দিষ্ট থেকেই। যে-কোনো সত্যিকারের কবিই বলবেন, তাঁদের নির্মিত অনেক

নারী-প্রতিমাই টুকরো বাস্তবের ওপর ভিত্তি করে রচনা। অথবা তা-ও নয়, কবিতার অন্তর্গত আবেদনই তাকে সৃষ্টি করে। যেমন, আমার অনুমান, এখানে। ‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে।’ – এখানে ইঙ্গিতটা যেন স্পষ্ট হয়। একই সর্বনামের দুই রূপে যুবক দুই স্তরে ভাগ হয়ে যায়। বোঝা যায়, সম্পর্কের একাধিক স্তর, পাত্র একাধিক। বিশ্ব ব্যাপারের রঙ্গমঞ্চে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

কথাগুলো অতীতের। বর্তমানে সুরঞ্জনা মৃত। ‘আকাশের আড়ালে আকাশে/ মৃত্তিকার মতো তুমি আজ ॥/ তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।/ সুরঞ্জনা,/ তোমার হৃদয় আজ ঘাস ॥/ বাতাসের ওপারে বাতাস -/ আকাশের ওপরে আকাশ।’ ‘আকাশ’ দুটো সম্ভাবনা মনে জাগায়। এক, দিনের আড়ালে দিন, – ফলে একদিনের আকাশ থেকে আর-একদিনের আকাশ, তার তলে মৃত্তিকায় মিশে সুরঞ্জনা।

অথবা কবি-চৈতন্যে ধরা দেয় মহাবিশ্বে আকাশের সম্ভাবনা। সুরঞ্জনা ছড়িয়ে পড়ে অণুতে-অণুতে। থিতু হয় গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে; কল্পনায় মিশে যায় সেসব। সেসবের ঘাসে-ঘাসে। তবে এ-ধরনের কল্প-প্রতিমা রচনা কবিতায় অভাবিতপূর্ব নয়। সমসময়ে ফরাসি কবি পল এলুআর নাৎসি দখলে অবরুদ্ধ ফ্রান্সকে কল্পনা করে কিছু অবিস্মরণীয় প্রেমের পঙ্ক্তিমালা রচনা করেছিলেন। একই রকম ল্যুই আরাগঁর ‘এলসা’। পরে বাংলায় শামসুর রাহমান তাঁর বন্দী শিবির থেকে এবং দুঃসময়ের মুখোমুখিতেও, এমন কিছু উৎকৃষ্ট পদাবলি নিবেদন করেছেন। তাঁর ‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় – ‘আলিঙ্গনে থরোথরো/ তুমি বলেছিলে,/ ‘আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও/ আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়/ বুকের আড়ালে কিংবা একান্ত পাঁজরে,/ শুষে নাও নিমিষে আমাকে/ চুম্বনে চুম্বনে।’ – এরকম। এখনো পড়লে শিহরিত হই। আছে আরো।

ব্যক্তিতায় নৈর্ব্যক্তিকতা, ঘটনার ইঙ্গিতে কালখ-ের বাস্তবতা চিত্রকল্পনায় অভিনব দূরত্ব-ও-নৈকট্যের যোজনা এবং মন্ত্রতুল্য বাক-সংযম, এগুলোই সাতটি তারার তিমির ও

বেলা অবেলা কালবেলায় জীবনানন্দের চৈতন্যে মনন-প্রতিভার কেলাসন চেনায়। এই সময়ের বিপন্নতাও তাঁকে মুগ্ধ আবেগ থেকে দূরে ঠেলে। রূপসী বাংলার (তখনো ত্রস্ত নীলিমার) কবিতাগুচ্ছ নিয়ে তাঁর দ্বিধা তখন স্বাভাবিকই মনে হয়।

তারপরেও প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রূপসী বাংলা নিষেধের সব প্রতিরোধ ভেঙে ফেলে। তার গভীর গহন একান্ত পদাবলি সব বাঙালির হৃদয়ে সমস্বরে অনুরণন জাগায়। এখনো তাতে বিরাম নেই। অথচ এতে কোনো বিস্ময়ও নেই। যদিও জীবনানন্দের মনন-সঞ্জাত পরিশীলিত সংশয় যে সবটাই অমূলক ছিল এমনও বলা যায় না। এই আপাত বৈপরীত্যের হিসাব মেলাই কী করে?

মনে হয়, ওই তিরিশের দশক থেকে বাঙালির সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনার ওপর দিয়ে যে-ঝড় বয়ে যায় তার প্রকোপ ১৯৫৭-য় যখন রূপসী বাংলা ছেপে বেরোয়, তখন অনেকটা থিতিয়ে আসে। বিপরীত স্রোতের উৎসমুখও যেন খুলে যায়। সবাই যে সমান সচেতন ছিল, এমন নয়। তবে আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাতচল্লিশে দেশভাগ, দুপাশে উদ্বাস্তুর বিরতিহীন ঢেউ অবশ্যই এমন এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছিল, যেখানে গজিয়ে মাথা তুলে খাড়া থাকতে পারে কেবল ‘বিষাদবৃক্ষ’ই। তার ফল তেতো।

ঝাড়ে-বংশে বাড়ার পরিবেশও অনুকূল। কিন্তু সাতান্নয় উদ্বাস্তু-স্রোত তেমন প্রবল নয়। প্রলয়কা-ের পর যারা বাঁচে, তারা থিতু হতে চায়। অনেকে হয়। স্মৃতিকাতরতা প্রবল হতে শুরু করে। সে-স্মৃতি স্বপ্নময়। থাকে তাতে

ফেলে-আসা পূর্ণতার বেদনাও।

পাশাপাশি এই বাংলায় যা ঘটে চলে, তাতে থাকে স্বপ্নভঙ্গের, বিশ্বাসভঙ্গেরও, নির্দয় আঘাত। বায়ান্নোয় ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলন নতুন রাষ্ট্রে নতুন সম্ভাবনার শিকড়-সুদ্ধ ধরে টান মারে। রাষ্ট্রক্ষমতার দখলদারদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ পদে পদে বুঝিয়ে দিতে থাকে তার বীভৎস অকার্যকরতা। এখানেও মানুষ পেছন ফিরে তাকায়। ভাবতে শুরু করে, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল’। ভাষা-আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি পরিচয়ের দিকে চোখ ফেরাবার কথা তাদের মাথায় একটু একটু করে দানা বাঁধতে থাকে।

অতএব ভবিতব্য জীবনানন্দের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে চলে। রূপসী বাংলার সমাদর সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়। এখনো তা তুমুল বহমান। অবশ্য শুধু এই কারণেই নয়। এর আবেদন অকপট হৃদয়ের কাছে অবশ্যই। তবে কাব্যগুণেও এ উৎকৃষ্ট। এবং তা স্বতঃস্ফূর্ত। নইলে একটা ঘোরের ভিতরে থেকে মাত্র দু-তিন দিনে এমন সৃষ্টি, যা পূর্ণাঙ্গ ও অবিকল্প, বলা চলে, প্রায় অসাধ্য। অন্তর্জাত প্রেরণার ভূমিকা জীবনানন্দও স্বীকার করেছেন। তবে সাধারণত প্রয়োজনীয় শর্ত হলেও (সুধীন্দ্রনাথ এমনটি মানতে নারাজ) এ যথেষ্ট নয়। কবি-মনীষা এর পরেও প্রচুর ভাবনাচিন্তা, অণুবীক্ষণ ও পূর্ণদৃষ্টির অবলোকন দাবি করে। রূপসী বাংলা কিন্তু জীবনানন্দের এই মাপকাঠি ও অনুশীলনের ধারায় ব্যতিক্রম। পা-ুলিপি প্রায় পুরোটাই এক বলকে হয়ে ওঠা। যেন সবটাই অন্তর্জাত প্রেরণার ফল। জানা যায়, এমনটি ঘটেছে কোলরিজের ‘কুব্লা খান’, রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ও নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বেলায়। কিন্তু গোটা কাব্যগ্রন্থ, এবং প্রায় পুরোটাই ‘সনেট জাতীয়’, যার আছে নিজস্ব সংগতির শর্ত, এভাবে কোনোটি সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কবিতা রচনায় এই কবির স্বঘোষিত শর্ত ভেঙেই এ তাঁকে অমর করেছে।

জীবনানন্দের নিজস্ব মূল্যায়নকে রূপসী বাংলা আর-এক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাঁর ‘কবিতার কথা’য় পড়ি, ‘কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তিত হওয়া দরকার; কিন্তু সেই পরিবর্তন আনবে কে? সেই পরিবর্তন হবে কি কোনোদিন?… যখন দেখি তথাকথিত সভ্যতা কোনো এক দারুণ হস্তিজননীর মতো যেন বুদ্ধি-স্খলিত দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে-প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাথ ও ময়দান ভরে ফেলেছে, তখন মনে হয় যে-কোনো সূক্ষ্মতা, পুরনো মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির বিরুদ্ধে, যা পুরনো প্রদীপকে যে অদৃশ্য হাত নতুন সংস্থানের ভিতর নিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে, তবে এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্যে শুধু – সকলের জন্যে নয় – অনেকের জন্যে নয়।’

এই কাব্যের আস্বাদনেই কি আমাদের মনে হয় না, তাঁর প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত সব সময়ে যথার্থ নয়? আমরা কি এক পুরনো প্রবাদ নতুন করে স্মরণ করব, – ‘পর্বত যদি তোমার কাছে না আসে, তুমি পর্বতের কাছে যাও।’

শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে রূপসী বাংলার অবস্থান কোথায়, এ-প্রশ্ন অর্থহীন। কারণ বিভিন্ন কাব্যের মান বিচার

দেশ-কাল-রুচিভেদে ভিন্ন-ভিন্ন। তবে এ-কথায় কি আপত্তি ওঠার কোনো কারণ আছে যে, ছয় দশক ধরে রূপসী বাংলা সব বাঙালি পাঠকের সবচেয়ে আদরের? ‘দীক্ষিতে’র সঙ্গে জনগণেশও যদি পূর্ণ

তৃপ্তি পায়, তবে তাতে কোনো কাব্যের মান খাটো হয় না, বরং বাড়ে।

 

সহায়ক

১. জীবনানন্দ দাশ, রূপসী বাংলা (যে-কোনো স্বীকৃত প্রকাশন)।

২.         জীবনানন্দ দাশ, কবিতার কথা (সিগনেট)।

৩.        জীবনানন্দ দাশ, শ্রেষ্ঠ কবিতা (নাভানা, কলকাতা)।

৪.         উত্তরাধিকার, জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ সংখ্যা), বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১৯৯৯।

৫.        সৌভিক রেজা, ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবনানন্দ কাব্য বিশ্লেষণের ধারা’, উপরিউক্ত।

৬.        আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পাদক), ভূমিকা, রূপসী বাংলা, অবসর, ঢাকা, ২০১৪।

৭.         আবুল হাসনাত (সম্পাদক), শামসুর রাহমান রচনাবলি, প্রথম খ-, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭।

৮.        ভূমেন্দ্র গুহ, আলেখ্য : জীবনানন্দ, অবসর, ঢাকা, ২০১১।