রেনেসাঁস-মানব সফিউদ্দীন

শামসুল ওয়ারেস

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের পিতামহ শিক্ষিত ও বনেদি এক মুসলিম পরিবারের সন্তান ডা. আমিনউদ্দীন আহমেদ কলকাতার অভিজাত আবাসিক এলাকা ভবানীপুরে নিজ বাড়িতে চিকিৎসাপেশায় নিয়োজিত হন। ভবানীপুরের এ-বাড়িতেই ১৯২২ সালের ২৩ জুন সফিউদ্দীন আহমেদের জন্ম। শিক্ষিত, রুচিশীল ডা. আমিনউদ্দীন আহমেদপাড়ায় বেচু ডাক্তার নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ভবানীপুরে তাঁদের বাড়ির সামনের রাস্তার নাম রাখে বেচু ডাক্তার লেন। সফিউদ্দীনের পিতা মতিনউদ্দীন আহমেদ ছিলেন এক ইংরেজ সাহেবের অধীনে সরকারি ভূমি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার। ১৯২৪ সালে মতিনউদ্দীন চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯২৮ সালে আকস্মিক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। মাত্র ছয় বছর বয়সেই সফিউদ্দীনের পিতৃবিয়োগ ঘটে। ভবানীপুরে সফিউদ্দীনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে। বোন সংগীতচর্চা করতেন। কিশোর বয়সে সফিউদ্দীন সেতার বাদন শিখেছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসন, সাংস্কৃতিক উদারতা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’য়ের নীতিতে তাঁর শৈশব কাটে। তাছাড়া বেঙ্গল রেনেসাঁস ও কলকাতায় নাগরিক সভ্যতার প্রভাবে বিজ্ঞানমনস্কতা, সেক্যুলারিজম ও ইংরেজদের কৃষ্টিতে আকর্ষিত হন। পিতার মৃত্যু ও শৈশবে পিতার অভাব তাঁর হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে, যা কখনো সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি।
পিতার মৃত্যুর পর ভবানীপুরের বাড়ি সফিউদ্দীন ও তাঁর দুই চাচার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সংসারে অর্থাভাব দেখা দেয়। আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে সফিউদ্দীন মায়ের সংসারের প্রয়োজনে টুকটাক কমার্শিয়াল কাজ করতে থাকেন। কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন সফিউদ্দীনের জীবনে উচ্ছ্বাস কমে যায়; কিন্তু তাঁর প্রাণে এক গভীর আবেগের সৃষ্টি হয়। ভাবাবেগের চেয়ে জীবনবোধ তাড়া করে। অজান্তেই যেন তিনি নিজের মধ্যে নিজেই গুটিয়ে যান। জীবনকে উপভোগ করার পরিবর্তে তিনি তাঁর জীবনেরই দর্শক হয়ে পড়েন।
সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯৩৬ সালের ১ জুলাই ভর্তি হন কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে। স্নাতক পাশ করেন ১৯৪২ সালের ২ এপ্রিল। পরিবারের ইচ্ছা ছিল সফিউদ্দীন স্থাপত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু তিনি স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হতে পারেননি। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ফাইন আর্ট বিভাগে ভর্তি হতে বলে। তিনি তাই করেন। পারিবারিক রক্ষণশীলতায় চারুকলার প্রতি অনীহা, তাই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। চারুকলা অধ্যয়নে মন বসে না, শ্রেণিকক্ষে প্রায়ই উদাসীন থাকেন। এই সময়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষক শিল্পী আবদুল মঈন এগিয়ে আসেন। তাঁকে কাউন্সেলিং করে ও শিল্পের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে শিল্প চর্চা ও শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন। সফিউদ্দীন ক্রমেই চারুকলা অধ্যয়নে নিষ্ঠ ও থিতু হন। সেইসঙ্গে প্রিয় শিক্ষক আবদুল মঈন তাঁর হৃদয়ের এক বিরাট অংশ অধিকার করে নেন। ১৯৩৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের কাজ নিয়ে শিল্প-প্রদর্শনীতে তেলরঙের একটি চিত্রের জন্য সফিউদ্দীন তৃতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এটি ছিল তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম পুরস্কার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কয়েকদিন পর ওই বছর ১৬ মার্চ মাত্র ২৪ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষাগুরু আবদুল মঈন মারা যান। মঈন স্যারের মৃত্যুতে সফিউদ্দীন ভেঙে পড়েন। তাঁর কাছে সবকিছু শূন্য মনে হতে থাকে। তখন সফিউদ্দীনের বয়স মাত্র সতেরো। হৃদয়ে প্রচন্ড আবেগ, কিন্তু কারো সঙ্গেই আর তেমন করে ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি। স্বল্পভাষী, নিভৃতচারী, জীবনের প্রতি নির্মোহ সফিউদ্দীন মানুষের প্রতি নন, যেন এক ধরনের বিমূর্ত মানবিকতায় আবিষ্ট হতে থাকেন। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে চিত্রকলা।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সময়ে শিল্পী সফিউদ্দীন নিবিড়চিত্তে সৃষ্টি করেন একগুচ্ছ চিত্র। ছুটিতে বিশেষ করে পুজোর ছুটিতে সতীর্থদের নিয়ে ছবি অাঁকার জন্য চলে যেতেন বিহারের সাঁওতাল পরগনায় মধুপুরে বা জেসিডি, গিরিডি, চাইবাস ও দুমকায়। মধুপুরের পাহাড়, শুষ্ক ভূমি ও বৃক্ষরাজি; সাঁওতালদের সরল অকৃত্রিম জীবনধারা তাঁর চিত্রকলায় আশ্চর্য দ্যোতনায় ধরা পড়ে। ১৯৪৬ সালে তেলরঙে অাঁকা চিত্রসমূহে তিনি দুমকার ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন। শালবনে দূর থেকে দেখা কিছু মানুষ কিংবা সাধারণ ঘরবাড়ি। এসব চিত্র তিনি এঁকেছেন স্টিল লাইফ বা জড়জীবন অাঁকার নির্লিপ্ততায়। কিন্তু রোদের আলো ও ছায়ার অপূর্ব খেলায় এসব চিত্রে প্রকৃতি তার সবটুকু আবেগ নিয়ে সরবে ধরা দেয়। ১৯৪৬-এ অাঁকা দুমকার তৈলচিত্রগুলিতে এবং ড্রাই পয়েন্টে অাঁকা ‘শান্তিনিকেতন থেকে দেখা দৃশ্যে’ প্রকৃতি বিশাল, চিরন্তন ও অমোঘ। ১৯৪৬ সালে অাঁকা ‘সাঁওতাল রমণী’ (উড এনগ্রেভিং), ১৯৪৭-এ অাঁকা ‘মেলার পথে’ (উড এনগ্রেভিং) ও ১৯৪৮-এ অাঁকা ‘ময়ূরাক্ষীর ধারে’ (তেলরং) চিত্র তিনটি তুলনামূলকভাবে কাছে থেকে অাঁকা। তবু সাঁওতাল রমণীদ্বয় চিত্রে শিল্পীর উপস্থিতি টের পাচ্ছে না, মেলার পথে গাছের আড়াল থেকে অাঁকা এবং ময়ূরাক্ষীর রমণীদের পেছন থেকে অাঁকা। সফিউদ্দীন এসব চিত্রেও সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এক দর্শক। শুধু আকার, আকৃতি ও আলো-ছায়ার বিশ্বস্ত (অবজেকটিভ) উপস্থাপনাই যেন তাঁর কাজ। চিত্র যেন নিজ থেকেই সম্পূর্ণ হয়ে ধরা দেবে। সফিউদ্দীনের এই নির্মোহ নির্লিপ্ততাই তাঁর আধুনিকতা। এসব চিত্রে আবেগের উচ্ছ্বাস নেই, আছে জীবনের বাস্তবতা। অথচ কী গভীর জীবনবোধে আক্রান্ত হই আমরা দর্শকরা। এসব চিত্রে আছে নিশ্চুপতার শব্দ, কালোত্তীর্ণ আবহমানতা ও জমাটবাঁধা আবেগ। ‘মেলার পথে’ চিত্রটি অনবদ্য ও অসাধারণ। কৌশলগত নিপুণতা, খুঁটিনাটি ডিটেল, নিখুঁত ড্রইং, পরিচ্ছন্নতা, বস্ত্তগত প্রামাণ্যতা, আলো-অাঁধারের প্রচন্ডতা ও জীবন্ত উপস্থাপনার জন্য ২৫ বছর বয়সে অাঁকা ‘মেলার পথে’ শিল্পী সফিউদ্দীনের জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম।
দেশভাগের আগের কয়েক বছর ছিল শিল্পী সফিউদ্দীনের জীবনের স্বর্ণযুগ। ১৯৪৫ সালে ‘কবুতর’ (অ্যাকুয়াটিন্ট) চিত্রের জন্য অ্যাকাডেমিক প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, ১৯৪৬ সালে দুমকাভিত্তিক ছবির জন্য দ্বারভাঙা মহারাজা-প্রবর্তিত শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও অ্যাকুয়াটিন্টের জন্য একাডেমী অব ফাইন আর্টস পুরস্কার তাঁকে বিশিষ্ট চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি ১৯৪৬-৪৭ সালে দিল্লিভিত্তিক অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালেই প্যারিসের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে ইউনেস্কো-আয়োজিত ভারতের প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে এক প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্র প্রদর্শিত হয়। উদীয়মান নবীন শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদ তখন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওই বছর অধ্যক্ষ অতুল বসুর প্রেরণায় তিনি সরকারি আর্ট স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
১৯৪৬ সালে সফিউদ্দীন আহমেদ যখন সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ঠিক তখনই কলকাতায় দাঙ্গা ও দেশ বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙার বিভীষিকা তাঁকে ভীষণভাবে আহত করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি ভগ্ন হৃদয়ে তিন পুরুষের স্মৃতিবিজড়িত ভবানীপুরের বাড়ি, কলকাতা শহর ও আর্ট স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের গড়া ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শুরু হয় পূর্ব বাংলায় আধুনিক চিত্রকলা-আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু আর্ট কলেজে একনিষ্ঠ শিক্ষকতা ও পাশাপাশি শিল্পসৃষ্টি। ১৯৫৬ সালে প্রিন্ট মেকিংয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি তেলরঙে বেশকিছু চিত্র নির্মাণ করেন। এসব ছবির মধ্যে ১৯৫২ সালে অাঁকা ‘ধানঝাড়া’, ১৯৫৪ সালে অাঁকা ‘শূন্যঝুড়ি’ ও ‘শরবতের দোকান’ এবং ১৯৫৬ সালে অাঁকা ‘সূর্যমুখী’ ও ‘কাঠমিস্ত্রি’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘ধানঝাড়া’ ও ‘সূর্যমুখী’ চিত্রদুটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী কাজ। তুলির প্রচ্ছন্ন ও বলিষ্ঠ অাঁচড়, রঙের কনট্রাস্ট ও চিত্রগত বাস্তবতা চিত্রদুটিকে অত্যন্ত শক্তিশালী চিত্রকলায় পরিণত করেছে। বাকি তিনটি (শূন্যঝুড়ি, কাঠমিস্ত্রি ও শরবতের দোকান) চিত্রে সফিউদ্দীন এই প্রথম ত্রিকোণ ও আয়তাকার জ্যামিতিক কাঠামোর মধ্যে পুরো চিত্রগত বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জ্যামিতিক অনুশাসন মেনে তিনি আধা বিমূর্ত রীতিতে লাইন, ফর্ম ও কড়া রঙের ব্যবহার করে ছবি তিনটিতে বিশুদ্ধ নান্দনিকতা সৃষ্টি করেন। কলকাতায় থাকাকালীন তেলরঙে অাঁকা চিত্রগুলোর চেয়ে ঢাকায় এ-পর্যায়ে অাঁকা তেলরঙের কাজগুলো আরো বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিণত। তাছাড়া ১৯৫২ সালে অাঁকা ‘জীবনের প্রতিচ্ছবি’ (উড এনগ্রেভিং) চিত্রে গুণটানা মানুষের ফিগারে বক্ররেখার সমন্বয়ে বিশেষ শ্রান্ত ভঙ্গি ও সাদা কালো কনট্রাস্টের সঙ্গে নানা ধরনের টেক্সচারের মিশ্রণ এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইউরোপে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিত্রকলা চর্চার ঐতিহ্যবাহী সব নিয়ম-কানুন ভেঙে নতুন নতুন তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই সময়ে চিত্র নির্মাণে প্রকৃতি বা বস্ত্তর চক্ষুষ্মান বাস্তবতার হুবহু চিত্রায়ণ সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়। কিউবিজম (১৯০৮-১৮), ফিউচারিজম (১৯০৯-১৬), সুপরাম্যাটিজম (১৯১৩-২০), ডাডা (১৯১৬-২৩), ডিস্টেইল (১৯১৭-৩১), স্যুররিয়ালিজম (১৯২৪-৬৬) ইত্যাদি শিল্প-আন্দোলনের মাধ্যমে ইউরোপীয় চিত্রকলার চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যায়। এসব আন্দোলনে ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও রাশিয়া অগ্রণী ভূমিকা নিলেও ইংল্যান্ডের ভূমিকা ছিল নগণ্য। ভারতবর্ষ ব্রিটিশ কলোনি হওয়ার কারণে এসব প্রগতিশীল সমকালীন ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা, ইংল্যান্ডের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কলকাতা পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, হ্যাভেল অনুপ্রাণিত ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রবর্তিত নব্যবঙ্গীয় স্কুলের রক্ষণশীলতা ও ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অনুরাগের ফলে কলকাতার শিল্পচর্চায় সমকালীন ইউরোপীয় চিত্রকলার কোনো প্রভাব পড়েনি। কলকাতা ও সর্বভারতীয় চিত্রকলার এ-অনগ্রসরতা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মান অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের ধারায় ছবি এঁকে তিরিশের দশকের প্রথম দিকে কলকাতায় চিত্রপ্রদর্শনী করেন এবং ভারতীয় শিল্পীদের সমকালীন পশ্চিমের আধুনিক শিল্পের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সফিউদ্দীন ক্রমশ বুঝতে পারেন যে, সম্পূর্ণ বাস্তববাদী শিল্প অতীতের বিষয়বস্ত্ত এবং এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তার আগে ইউরোপীয় শিল্পকলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হওয়া প্রয়োজন। তাই তিনি সম্পূর্ণ নিজ খরচে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৫৬ সালে লন্ডন পাড়ি দেন এবং শিক্ষা ও শিক্ষা সফর শেষ করে ১৯৫৯ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। লন্ডনে সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে শিক্ষা গ্রহণকালে ছাপচিত্রের জন্য জগদ্বিখ্যাত শিল্পী হেটারের চিত্রকলা ও চিন্তাধারার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন। লন্ডনে শিক্ষার ফলে ছাপচিত্রের বিভিন্ন কৌশলে তিনি পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞ হন এবং বিমূর্ত চিত্রের ধ্যান-ধারণা রপ্ত করেন।
লন্ডনে থাকাকালীন ও ঢাকায় ফিরে এসে তিনি ছাপচিত্রের বিভিন্ন কৌশলে (এনগ্রেভিং, কপার এনগ্রেভিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট, সফট গ্রাউন্ড অ্যাকুয়াটিন্ট, এচিং, মিশ্র মাধ্যম ইত্যাদি) তাঁর ছাপচিত্র নির্মাণ করেন। এসব ছাপচিত্রে দুটি বিপরীতমুখী বক্ররেখার বহুবিধ ব্যবহার, উজ্জ্বল মৌলিক রং (লাল, হলুদ ও নীল) ও কালো রঙের কনট্রাস্ট এবং জটিল জ্যামিতিক প্যাটার্নের মধ্যে তিনি তাঁর বক্তব্য ও বিষয়বস্ত্তকে নির্মাণ করেন। ১৯৫৯ সালে অাঁকা বন্যা ও সেতু পারাপার এবং ১৯৬৪ সালে অাঁকা মাছ ধরার জাল, বিক্ষুব্ধ মাছ ও নীল জল নামে ছাপচিত্রগুলো এ-সময়ে তাঁর চিত্রগত বিমূর্ত রচনার ও চিন্তাধারার স্বাক্ষর। সফিউদ্দীন, যাঁর বাস্তবধর্মী কাজে সারল্য ও বিষাদের ব্যঞ্জনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিরাজ করে, তাঁর পক্ষে তাঁর নতুন কাজে সম্পূর্ণ জ্যামিতিক অনুশাসন মেনে নেওয়া ততো সহজ ছিল না। তাই তিনি জড়তা ও আড়ষ্ট ভাবকে এড়াতে সরলরেখার জ্যামিতিক আশ্রয় না নিয়ে বক্ররেখার জ্যামিতি ব্যবহার করেন এবং বিপরীতমুখী বক্ররেখার দ্বারা তৈরি ইলিপ্টিক্যাল ফর্মে মাছ, নৌকা, চোখ ইত্যাদি আকার তাঁর চিত্রে সহজেই সন্নিবেশ করেন। পাশাপাশি তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চারকোল ও ক্রেয়নে বেশকিছু ড্রইং করেন, যেখানে তিনি বক্র ও সরলরেখার বিভিন্ন সুবিধা, অসুবিধা ও সম্ভাবনা স্টাডি করেন তাঁর নিজের প্রস্ত্ততির জন্য এবং এ-কারণেই এসব ড্রইং তিনি প্রদর্শনীতে কখনো দেননি। ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’ তাঁর একটি আন্তর্জাতিক মানের অনবদ্য কাজ। এ চিত্রে ফর্মের জটিলতা আছে কিন্তু বাহুল্য নেই; গতি আছে কিন্তু চাঞ্চল্য নেই; সাদা-কালো ও রঙের পরিমিতি; বিশুদ্ধতা; নিখুঁত কম্পোজিশন ইত্যাদি তাঁর পারফেকশনিস্ট চরিত্রের সুন্দর বহিঃপ্রকাশ।
দুমকায় রিয়ালিস্টিক তৈলচিত্রে তিনি যেমন পশ্চিম বাংলার শুকনো স্থলভাগের প্রকৃতি বিষয়ক কাজে তার উদাস-একাকিত্ব ও আধ্যাত্মিকতার সরল চেতনা বিধৃত করেছেন, তেমনি জলের দেশ পূর্ববাংলার চিত্রকর্মে তিনি মাছ, নৌকা, জল, বন্যা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে জ্যামিতিক জটিলতায়, উজ্জ্বল ও কালো রঙের ব্যবহারে জীবনের অব্যক্ত রহস্য উন্মোচনের প্রয়াসী হয়েছেন। সফিউদ্দীনের সুফিমন তাই আবার ফিরে গেছে রঙের বাহুল্যকে বাদ দিয়ে, শুধু সাদা ও কালোয় ১৯৯৪ সালে চারকোল ও ক্রেয়নে অাঁকা ড্রইংগুলোতে।
১৯৫৮ সালে সফিউদ্দীন এচিং, এনগ্রেভিং ও অ্যাকুয়াটিন্টের মিশ্রণে তৈরি করেন ‘জলের নিনাদ’ চিত্রটি। এ চিত্রে সলিড ও ভয়েডের কম্পোজিশনে সফিউদ্দীনের নিজস্ব সংগীতধর্মী ভাষার ব্যবহার আছে। কিন্তু চিত্রটি কৌশলগতভাবে অনবদ্য হলেও যথেষ্ট ডেকোরেটিভ বা সাজসজ্জাময় হয়ে যাওয়ায় তিনি এ-পদ্ধতিতে আর কোনো চিত্র রচনা করেননি।
১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে তিনি ‘একুশে স্মরণে’ ও ‘একাত্তরের স্মৃতি’ নামে দুটি এনগ্রেভিং চিত্র তৈরি করেন। চিকন লাইন দিয়ে অাঁকা চোখের ফর্ম বারবার ব্যবহার করে চিত্রতল জুড়ে ছড়ানো-ছিটানোভাবে সাজিয়ে তিনি চিত্রদুটির কম্পোজিশন নির্মাণ করেন। এই ছাপচিত্র দুটিতে ষাটের দশকে অাঁকা মোটা দাগ ও ঠাসা বুনটের অনুপস্থিতি সহজেই ধরা পড়ে। ‘একুশে স্মরণে’ চিত্রে একটি মুখের প্রোফাইল ও ‘একাত্তরের স্মৃতি’ চিত্রে একটি নারী ফিগার অস্পষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চিত্রদুটি মনস্তাত্ত্বিক ও প্রতীকী ভাষায় রচিত। চিত্রদুটিতে সিপিয়া রঙের তল বিষয়বস্ত্তর ইতিহাস-ভিত্তি রচনা করেছে। সফিউদ্দীন ঠাসা বুনোট অথবা ছড়ানো-ছিটানো উভয় ধরনের কম্পোজিশনেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
আশি ও নববইয়ের দশকের বেশিরভাগ কাজে সফিউদ্দীন মোটাদাগে বৃত্তাকার কম্পোজিশন, বিভিন্ন তলের ব্যবহার ও কনট্রাস্টিং রঙের ব্যবহার থেকে সরে এসে সরলরেখা, মৃদু বক্ররেখা, হালকা রং ও ফ্ল্যাট বা একতলের চিত্র নির্মাণে নিয়োজিত হন। এই সময়ে তেলরঙে অাঁকা ‘কালো মাছ’ (১৯৮৪)। ‘জড়জীবন-৩’ (১৯৮৭), ‘বন্যা-১’ (১৯৮৮); ‘সূর্য গাছ ও মেয়ে’ (১৯৮৯), ‘শরবতের দোকান-২’ (১৯৮৮), ‘আপেল ও গাড়ি’ (১৯৯৩), ‘লাল ও সবুজ’ (১৯৯৪) এবং ‘মাছ ও জাল’ (১৯৯৬) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দ্বিমাত্রিক, ফ্ল্যাট এসব চিত্রে বিশুদ্ধ বিমূর্ততা প্রাধান্য পেলেও পারিপার্শ্বিক জীবনের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। রঙের ক্রোম, টেক্সচার, ফর্মের বিন্যাস, রঙের হালকা কনট্রাস্ট বা হারমোনি, জটিল অথচ শান্তভাব এসব চিত্রে সফিউদ্দীনের শৈল্পিক ধীশক্তি ও ক্ষমতার আশ্চর্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাঁর চিত্রকলা এই একই ধারায় বিকশিত হয়ে আরো বেশি ধীর, প্রশান্ত, নমনীয় ও উদার ভাব গ্রহণ করে।
সফিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন নির্মোহ, নিভৃত, লাজুক অথচ প্রাণবন্ত, আশাবাদী, সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ এক সৃজনশীল জাত শিল্পী। তিনি ছিলেন এক মহান শিক্ষক। তিনি ছিলেন পরিশীলিত, রুচিবান, স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী ও প্রগতিশীল এক অভিজাত রেনেসাঁস-মানব। কলকাতা থেকে নির্বাসিত হয়ে ঢাকায় বনবাসে এসে পেয়েছেন নির্বাণ। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল, আত্মসম্মানবোধে সচেতন, নীতিবান ও শৃঙ্খলাবদ্ধ এক চিরসবুজ সুফি কবি। তিনি ছিলেন ভার্সেটাইল ও গিফটেড। সফিউদ্দীনের তুলনা শুধু সফিউদ্দীনের সঙ্গেই সম্ভব।
শিল্পী সফিউদ্দীনকে দূর থেকে বহুবার দেখেছি। কাছে যাওয়ার কোনো প্রসঙ্গ পাইনি। তবু দূর থেকেই তাঁর স্নেহধন্য চাহনি দেখেছি, বুঝেছি হৃদয়ের তাপ। মহান শিল্পী সফিউদ্দীনের মৃত্যুতে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পশিক্ষা, শিল্পচর্চা ও শিল্প-আন্দোলনের ইতিহাসের দীর্ঘ প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। 