রেলব্রিজে একা

হারিসুল হক
আস্তে আস্তে কমে আসছে চোখের জোর।
বাঁ-চোখে অত আর ভালো দেখতে পাই না
ক্রমে ক্রমে ডানটাও যাবে হয়তো বা
(যাবার কি কোনো রোডম্যাপ, দিনক্ষণ ঠিকঠাক থাকে)
আর অত দেখেই কী লাভ সুনীলদা – শুধু কষ্ট শুধু কষ্ট
সহস্র বঞ্চনার নদী আমাদের ঘিরে
বসতবাড়ির উঠোন জুড়ে খালি উইঢিপি
অরণ্যে একাকী কাক মগডালে ঠোঁট  ফাঁক করে
– কথা বেরোচ্ছে না

অত দেখে কী লাভ কী লাভ
দেখাতেই যত বিপত্তি দাদা, না দেখাতে কোনো গোল নেই
না আছে বচসার ভয়, না থাকে মনোকষ্টের দহন
সত্যি বলতে কী, চোখ থাকা মানেই অনাহূত দেখা
আর দেখা মানেই আলবত মুসিবত

ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে জলার আয়তন, ভূমির খাদ-উপখাদ
সরষের হলুদ উপবন, ধানের গর্বিত শীষদানা
মানুষের বিস্তার ও মমত্ববোধ
ধীরে ধীরে কূল ছেড়ে পাল তোলে আরদিকে ঘাড় ফিরিয়েছে
সহমর্মিতার পানসি।
হ্রদ থেকে, বিল থেকে, ঝিল থেকে উধাও হচ্ছে বিশ্বাসের
নেতানো বীরুৎ

দেখতে দেখতে বিশ্বাসের ভিতটা কেমন যেন নড়বড় হয়ে যাচ্ছে
দেখতে দেখতে চেনা স্পর্শগুলো অচেনা হয়ে যাচ্ছে
দেখতে দেখতে …

আজকাল স্বপ্নের মধ্যে আমি দেখতে পছন্দ করি
(দৃষ্টির খর্বত্ব স্বপ্ন দেখাতে কোনো প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে না)
দেখি স্বর্ণকায় এক বিশাল মাছ কালনি নদীর মধ্যিখানে
নিশ্চল ভেসে – মূর্তির মতো, সুস্থির ভাস্কর্যের মতো
হাজারো প্রশ্নজাগানিয়া পাহাড়ের মতো

দেখি একটি সজল রেখা এঁকেবেঁকে বেঁধে দিচ্ছে মাতাল নদীপাড়
গ্রামের ছায়াময় আঁচল ঘেঁষে। এখনো ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি রাজপুত্র আর
তার পঙ্খিরাজের প্রতীক্ষায় গল্পের সুতো কাটছে সময়ের চরকায়।
দেখি একটি বেগবান বাছুর খড়ের গাদায় অহেতুক গুঁতোগুঁতি করছে
আর লালচোখো গোঁয়ার মোষ লাউয়ের মাচান ঘেঁষে মুখে গোঁ-গোঁ
ফেনা তুলছে

এইভাবে ছবির পর ছবি, ঢেউয়ের পর ঢেউ – ভাসে আর ডোবে
আকাশ কিনারায়।

ভাবনার উপরে ভাবনার তিনসিঁড়ি আকাশ
আমাকে জীবন থেকে ছশো মাইল দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
আজকাল আমি আর চোখ মেলে তাকাতে চাই না
ভাবনার লাটিম ঘোরে পূর্ব-পশ্চিম ব্যাপে

সম্পূর্ণ বান্ধবহীন আপনি – কেন তবে রেলব্রিজে একা?

১৫-১১-২০১২