রোকেয়ার দ্বৈরথ

মোস্তফা জামান

‘রোকেয়া’ শিরোনামের একক প্রদর্শনীটি রোকেয়ার দুই মেরম্নজাত সৃষ্টির পাশাপাশি দেখানোর প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা চলে। সতেরোতম এই এককে শিল্পী রোকেয়া সুলতানা যেন একটু মৃদুভাষী এবং ভাবপ্রবণ। তবু স্থান-কাল-পাত্রবিষয়ক সচেতনতা তাঁকে যেমন বড় আয়তনে ঢাকার ট্রাফিকজটের মধ্যে তাঁর পরিচিত মা ও মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দেখার সুযোগ করে দেয়, তেমনি নিরাবয়ব সারফেসে যা চিত্রতলে জলবায়ুর চিহ্ন ধারণ করে এমন চিত্র রোকেয়ার মাধ্যম ও দেহাতীত বিষয়-আশয় নিয়ে তূরীয় অভিজ্ঞতা নির্মাণের কামনা প্রকাশ করে। শিল্পীর এই দ্বৈরথ সমর তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল মাত্র – তিনি অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার অতীত বিষয় নিয়ে কাজ করছেন আশির দশকের শেষ দিক থেকে, যখন শামিত্মনিকেতনে পাঠরত অবস্থায় প্রকৃতির প্রামাণ্য দলিলের বদলে প্রথম অনুভূতিময় ভূদৃশ্য এঁকেছেন। চিত্রায়ণ শব্দ দিয়ে যদি তাঁর অভিজ্ঞতা ও কনসেপ্ট-নির্ভর ম্যাডোনা সিরিজের সুরাহা করা যায়, তার অভিব্যক্তিময় ছবিগুলো নির্ভার এবং নির্দিষ্ট জলবায়ু বা প্রতিবেশের আবহ প্রকাশ করে – তাদের মধ্যে বস্ত্তজগতের প্রতি আনুগত্য নেই।

পূর্বাপর আরো অনেক প্রদর্শনীতে রোকেয়া মূর্ত ও বিমূর্ত একই মানসিক সত্মর থেকে নির্মাণ করেছেন, এই প্রদর্শনীতে মানসিক ও জাগতিক – এই দুই ভাগ হয়ে গেছে। ‘এক সময়’ শিরোনামের ম্যুরাল ধাঁচের কাজটি জাগতিক জীবনের খ-চিত্র ছাড়া আর কিছু নয়; অপর দিকে ‘মাটি-বায়ু-জল’ নামের বেশ কয়েকটি একরঙা ছবির মধ্যে দিয়ে মহাজাগতিক শূন্যতা, কিংবা অজানা চৈতন্যের খোঁজ দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। এই দুই বৈপরীত্যকে একের মধ্যে নিয়ে আসার কোনো অপচেষ্টা এই প্রদর্শনীতে লক্ষ করা যায়নি। তবে ছবি সাজানোর ক্ষেত্রে – অর্থাৎ প্রদর্শনী নির্মাণের ক্ষেত্রে – আরো একটু সচেতনতার প্রয়োজন ছিল। উপরোলিস্নখিত দুই যে এক হওয়ার নয়, এ-বিষয় ধর্তব্যে নিয়ে যদি একই মনন ও মর্যাদার ছবিগুলো পাশাপাশি রেখে সিরিজের অনুভূতি তৈরি করা যেত, তবে এই স্বনামধন্য শিল্পীর সার্বিক চরিত্রের মধ্যে যে নানা বৈচিত্র্য রয়েছে তার ক্রমানুগ পাঠ সহজতর হতো।

রোকেয়া সুলতানা ছাপচিত্র থেকে তেল ও অ্যাক্রিলিক ছবি অঙ্কনের দিকে ঝুঁকেছেন। জলরং ও টেম্পেরা এক সময় তাঁর ছবির চরিত্র নির্ধারণে সহায়ক হয়ে ওঠে। নববইয়ের শুরম্নতেই তিনি ওয়াশ পদ্ধতির ব্যবহারে ফ্লুইড ও জলবায়ুময় প্রেক্ষাপট তৈরি করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে তা এচিংয়ে করা ছাপাই ছবিতেও প্রয়োগ করায় সিদ্ধহসত্ম হয়ে ওঠেন। তবে মাধ্যমের কারিকুরির বদলে চিত্রপটের পেলবতা ও জলবায়ুময়তা বাড়াতে তিনি ওয়াশ ও রঙের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার শুরম্ন করেন। নববইয়ের পুরোটা সময় জুড়ে তাঁর পেইন্টার হয়ে-ওঠার স্বাভাবিক বিবর্তন লক্ষণীয়। তিনি মাঝারি ও বড় ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করে বিমূর্ত প্রকাশবাদিতার নিজস্ব এক ধরনও আবিষ্কার করতে সমর্থ হলেন।

বর্তমান প্রদর্শনীর নমুনা যাচাই করে দেখলে বলা চলে যে, যত নমনীয় ও পেলব ভাবের মধ্যে দিয়ে হোক না কেন, নির্বস্ত্তকতাই এখানে সবচেয়ে বাঙ্ময়। বৈচিত্র্যের দিক থেকেও এই আয়োজনের মধ্যে সাদাকালো ও রঙিন এই দুই ধাপে জলীয় বা গ্যাসীয় অবয়ব নির্মাণে শিল্পীর পারঙ্গমতা যে-কোনো দর্শকই টের পাবেন। ‘শিরোনামহীন-১’ যদি জিরো ডিগ্রি চিত্র নির্মাণের বাসনাজাত হয়ে থাকে, ‘জল-মাটি-বায়ু-৪’ ও ‘কসমিক এনার্জি-১ ও ২’ একই ধারার বিবিধ প্রকাশ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কালোয় ঢাকা এসব

চিত্র এমন এক মহাজাগতিকতাকে সামনে নিয়ে আসে, যা আত্মানুসন্ধানের সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার মেলবন্ধন ঘটায়। ‘জল-মাটি-বায়ু-৪’ শিরোনামের কাজটি অপরাপর কাজগুলোর মতোই ‘ট্রেস’ বা ছায়া অবলম্বনে বৃহত্তর সত্য নির্দেশ করে। এই কাজগুলোর মধ্যে দিয়েই রোকেয়া আত্মপরিচয়, এমনকি মাতৃপরিচয়-পরবর্তী সৃষ্টি ও সৃষ্টিবিষয়ক বিস্ময়বোধের মধ্যে থিতু হন। এই বিশ্বে তিনি নিজেও অশরীরী – কারণ শরীর পূর্বে ও পরে মহাকালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফলে ছায়া বা সামান্য আলামতের রোকেয়া শিল্পী হিসেবে মাতা ও কন্যার বেড়ে ওঠা ও জীবনযুদ্ধের যে পরম্পরা তৈরি করেছেন, তার নিমিত্তেই তাঁর প্রথম পরিচিতি ও খ্যাতি। এই জাতের ছবির সূচনা ছাপাই ছবির মধ্যে দিয়েই। বিশেষত মাতা ও তাঁর শিশুকন্যার রোমান্টিক চরিত্রায়ণ অথচ বাসত্মব পরিক্রমণের গাথা ব্যক্তিগতকে জেন্ডার ভাবনা দিয়ে শিল্পী

নগরগাথায় পরিণত করতে পেরেছেন। এই পারঙ্গমতার মধ্যে দিয়েই শিল্পী রোকেয়া নিজের ভাষ্য ও ভাষার ভিত তৈরি করে নিয়েছেন। এরই বিবর্তনের ধারায় দুই পরিণত নারী, ডানাওয়ালা নারী তাঁর ছবিতে বিষয় হয়ে উঠেছে। এখানে সবচেয়ে জরম্নরি যে-বিষয় – তা হলো মানবী অবয়ব নির্মাণে রোকেয়ার শিশুসুলভ অঙ্কন প্রক্রিয়ার প্রয়োগ, এটি তাঁর কাজকে যেমন নিজস্ব মাত্রা দিয়েছে, তেমন গাথা নির্মাণের বা গল্প বলার সহজ পথটিও বাতলে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রোকেয়া গাথা গড়েন সামান্যের প্রয়োগে – তাঁর ছবি মূলত চিত্রজ গুণের মধ্যে দিয়েই ভাষ্য তৈরি করে, ফিগারের নাটকীয়তা এতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ‘ফেরেসত্মা-১’ শিরোনামের হালকা ওয়াশ ও রেখায় অাঁকা উলম্ব কম্পোজিশনে এর প্রমাণ মেলে।

যে নব্য ধাঁচের চিত্রকল্পের সূত্রে রোকেয়া এক যুগ ধরে বোধি ও বোধবিষয়ক তাড়না প্রকাশ করে আসছেন, তার সামান্য অাঁচ এই প্রদর্শনীতে লক্ষ করা গেছে। ম-ল ও প্রাকৃতিক পরিম-ল – এই দুইয়ের সমন্বয়ে রোকেয়া বুদ্ধকে স্মরণ করেন। পরম যা, তা যে আনন্দময় এই সত্য তিনি জানেন। ফলে স্বর্ণালি বরণের যে-ছোঁয়া তিনি তাঁর ‘বোধিসত্ত্ব’ নামের কাজে ছড়াতে সমর্থ হয়েছেন তা মনোরম ফর্মের ফুল, লতার উপস্থিতিতে আরো প্রাণময় হয়ে ওঠে। প্রাণায়াম বা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের যে তূরীয় চর্চা এরই সঙ্গে যেন স্মৃতিকাতরতা মিশিয়ে শিল্পী বুদ্ধের স্মৃতিচারণে বা স্মরণে সজাগ হয়ে উঠেছেন – এমন অনুভব করা যায়। নান্দনিকতা এখানে সারফেসের সৌন্দর্য পার হয়ে বিষয়বস্ত্তর উপলব্ধিতে ব্যয়িত হয়েছে বলা যায়।

তবু রোকেয়ার এই প্রদর্শনী গুরম্নত্বপূর্ণ কিছু ঘাটতির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন ম্যাডোনা সিরিজের আরো জোরালো উপস্থিতি এটিকে সকল সফল শিল্পকর্মের নমুনানির্ভর প্রদর্শনীতে পরিণত করতে পারত। যদিও ‘ম্যাডোনা-৫’-এর মতো ২০১৩-তে করা লিথোগ্রাফ এখানে সংযোজিত হয়েছে, তবু এই সিরিজের পরিণত আরো অনেক কাজে উপস্থিতি রোকেয়ার আপন নামের এই প্রদর্শনীর শ্রীবৃদ্ধিতে সাহায্য করত বলে মনে হয়।

প্রাক্কথনের মধ্যে দিয়ে শিল্পী খুবই কাব্যিক কিছু ভাবনা দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। শুরম্নতেই ‘হাজার মাইল’ জুড়ে আপন চুলের বিসত্মার আশা করেছেন শিল্পী। এমন রোমান্টিকতার চিত্রজ বহিঃপ্রকাশ হয়তো আগামীতে তাঁর চিত্রতলকে আরো নানান কাব্যরসে উত্তপ্ত করে তুলবে, এমনটা আশা করা যায় এই সদা নবীন মনের অধিকারী পরিণত শিল্পীর কাছে।