লেখকের চোখে দেখাঃসেলিনা হোসেন

সেলিনা হোসেন মূলত কথাসাহিত্যিক, তাই তাঁর মননধর্মী, বিশেষত সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলো, সৃজনশীলতারই অন্যরকম উৎসারণ – এ কোনো আন্দাজি সিদ্ধান্ত নয়, স্বদেশে পরবাসী  বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশকালে তাঁর ভূমিকায় তিনি নিজেই লিখেছেন : ‘মূলত কথাসাহিত্য আমার ক্ষেত্র’ এবং ‘সৃজনশীল লেখক প্রবন্ধ না লিখলে নিজের মানসকে পাঠকের সামনে খুলে দিতে পারেন না।’ এই ভূমিকায় নিজের প্রবন্ধগুলোকে ‘মুহূর্তেক ভাবনার ছিটেফোঁটা বহিঃপ্রকাশ’ উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, লিখিত প্রবন্ধগুলো তাঁর সৃজনশীল লেখকসত্তার মানসভুবনকেই চিত্রিত করেছে। লেখার শুরুতেই এ-কথাগুলো বলার কারণ, ১৯৯৩ সালে প্রবন্ধ বিষয়ে তিনি যে-মত প্রকাশ করেছিলেন আজো তা বদলায়নি এবং বদলানো হয়নি বলেই ২০১৫ সালে প্রকাশিত ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতিকথা  বইয়ের ভূমিকায়ও তিনি সে-কথাগুলো সরাসরি উদ্ধৃত করে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট করেছেন। অবশ্য এ-ধরনের প্রবন্ধের বাইরেও নানা বিষয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, সেগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত ও স্মৃতিনির্ভর গদ্য এবং ভ্রমণ-জার্নালগুলোর কথা বাদ দিলে অধিকাংশ লেখাই সময়ের প্রয়োজনে/ গুরুত্বে নানাবিধ দায় ও দাবি নিয়ে লিখিত, তাই এ-লেখায় সেই ধরনের প্রবন্ধ বাদ দিয়ে শুধু শিল্প-সংবেদনধর্মী প্রবন্ধগুলোই বিবেচনায় রাখা হয়েছে, এতে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি প্রবন্ধে বর্ণিত বিষয়ে প্রয়োজন অনুসারে আলোচকের বক্তব্যও অন্তর্ভুক্ত হবে।

গল্প-উপন্যাসের বাইরে নানা জায়গায় সেলিনা হোসেনের রাজনীতি, নারী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু প্রবন্ধ পড়ে তাঁর সম্পর্কে যে-ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথাগত হলেও সদর্থকই ছিল, কারণ সেখানে তাঁর কল্যাণ-আকাঙক্ষা ও ব্যথিত মনের পরিচয় স্পষ্ট। তবে, যেহেতু এ-ধরনের প্রবন্ধ আরো অনেকেই লিখেছেন, এখনো লিখছেন, তাই তাঁর এসব লেখা সম্পর্কে কোনো উচ্চধারণা তৈরি হয়নি, কিন্তু যেদিন তাঁর প্রথম প্রবন্ধবই স্বদেশে পরবাসীর নামপ্রবন্ধের প্রথম বাক্যকটির ওপর নজর পড়ল, সেদিনই তাঁর পর্যবেক্ষণশক্তির গভীরতায় আলোড়িত না হয়ে পারিনি :

স্বদেশে পরবাসী শব্দদুটো অর্থের দিক থেকে বিপরীতধর্মী হলেও অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনায় কাছাকাছি, ব্যঙ্গে এবং আন্তরিকতায়। ব্যঙ্গ ভালোবাসার, শাসনের চাবুকের, সোহাগেরও। স্বদেশ আমার চিমত্মা-চেতনার, স্বদেশ আমার সাহিত্যের শব্দের।

 

স্বীকার করা উচিত, বাক্যকটি স্বচ্ছ ও সরলরূপে লিখিত নয়, এতে রয়েছে বিমূর্ত চিমত্মার অভিব্যক্তি; তবে এই বিমূর্ততা মূর্ত হয়ে ওঠে আরেকটু এগোলেই, যেখানে তিনি লেখকের দুরকমের পরবাসের কথা জানান এবং এ-ও জানাতে ভোলেন না যে, মনোনিবেশের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে এই পরবাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সাধারণত চক-টানা গ–র ক্ষুদ্র সীমায় বাঁধা থাকে অধিকাংশ মানুষের জীবন, কিন্তু মানুষকে সেই বেড়া পার হয়ে এগিয়ে যেতে হয়, এ-প্রসঙ্গে তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথের শৈশবের কিছুদিনের চক-টানা জীবনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে লিখেছেন, ‘তাঁর ছিল দুরন্ত কৌতূহল’ এবং ‘বাইরকে জানবার এবং দেখবার’ জন্য রক্তে ছিল ভীষণ নেশা, ফলে তারই টানে একদিন ‘তিনি বেড়ি ভেঙেছিলেন’, ‘তার জীবনের কোথাও কোনো গ– ছিল না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি দিগন্তরেখা।’ বেড়ি ভেঙেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ বিদেশে গিয়ে তো পরবাসী হনইনি, স্বদেশেও হতে হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে বেড়া পার হওয়া দূরের কথা, বদ্ধতা ও অপরিচয়ের কারণে অনেক সময় নিজের নিকটতম স্থানকেও মনে হয় অচেনা। সিলেটের জাফলংয়ে ঝরনার ধারে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে, পটুয়াখালীর শেষ সীমান্ত লালদিয়ার চরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখে তাঁর নিজেরও মনে হয়েছে : ‘একি আমারই দেশ?’ এই দেশ/ স্বদেশকে ভালোভাবে চিনে আত্মস্থ করে নিতে গেলে স্বদেশের স্থানে-স্থানে যেমন বারবার যেতে হয় এবং আবার ফিরে আসতে হয় নিজের কাছেও। ‘স্বদেশে পরবাসী’ প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়েছে, এ যেন কোনো বাউলের দেহতত্ত্বের বয়ানই পড়লাম, পার্থক্য এটুকুই – এ ভা-কে জেনে ব্রহ্মা-কে জানার তত্ত্ব নয়, এ হলো ব্রহ্মা-কে জানার পরে দেহভা-কে জানার তত্ত্ব।

প্রবন্ধটিতে এই তত্ত্বকথা কেন উঠে এসেছে তা আরেকটু এগোলেই বোঝা যায় : ‘এখন আমাদের সামনে তেমন শক্তিমান রাগী কেউ নেই যিনি গদ্যকে নিজের মুঠিতে নিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন কাদার তালের মতো, কেবলই ভেঙে ভেঙে আপন আনন্দের, নিজস্বের, ছন্দের মূর্তি গড়া।’ লক্ষ করি, এজন্য তিনি দায়ী করছেন তরুণদেরকেই, গদ্যের প্রতি যাদের অকারণ ভীতি, যারা ঘুরেফিরে কবিতার কাছেই আশ্রয় খোঁজে। তিনি তরুণদেরকে – বিশেষত তরুণ কবিদেরকে – এজন্যই অভিযুক্ত করেন যে, কারণ এই ক্ষমতা শুধু তারাই অর্জন করতে পারে; কিন্তু তারা পরিশ্রমবিমুখ, তারা ছন্দ থাক আর না থাক দু-চার লাইন গদ্যকবিতা ছাপিয়ে রাতারাতি নাম করার অপচেষ্টা করে, যার ফলে আমাদের সাহিত্যিক পরিম-ল এখন হয়ে উঠছে ক্ষমতার অপচয়ের দৃষ্টান্ত। কথাগুলো তিনি লিখেছেন ১৯৮০ সালে, এরপর আরো তিন যুগ পেরিয়েছে, কিন্তু সেই বক্তব্য এখনকার হিসেবে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় তখন, যখন এর সঙ্গে আরো কিছু কথা যুক্ত করে লেখেন : ‘সমালোচনার নামে এখানে যা চলছে, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধুত্ব রক্ষার খাতিরে পারস্পরিক পিঠ চুলকানি, নয়তো আক্রোশ মেটানোর একধরনের অবিবেচক ঘৃণ্য পদ্ধতি।’ সবকিছুর মূলে হলো এই সমালোচনা, যার [কোমল-কঠোর গ্রহণ-বর্জনের] অভাবে যা ইচ্ছা তা-ই চলে, যার অভাবে পাঠকের – এবং অনেক কবি/ লেখকেরও – এটা বুঝতে অসুবিধা হয় যে, ছন্দ থাকলেও অনেক কবিতা কবিতা হয় না, গদ্য-কবিতাও সবসময় কবিতা নয়, আবার কখনো-কখনো স্রেফ গদ্যও হয়ে ওঠে উৎকৃষ্ট কবিতার নজির। গদ্য যখন ‘পটুয়াখালীর আদিগন্তবিসত্মৃত সমুদ্র, হিমছড়ির বেগবান ঝর্ণা, কাপ্তাই হ্রদের ভীষণ স্রোত, রাঙামাটির পাহাড়ি বাঁক, ভোলাহাটের ধুলো-ওড়া দুপাশের ফণিমনসার ঝোপ’-এ পরিণত হয়, তখন সে-গদ্য কবিতা নয় তো কী?

একসময় কবিতা লিখতেন সেলিনা হোসেন, সেই কবিতা ছাপাও হয়েছে কিছু জায়গায়, তাই উপরোক্ত প্রবন্ধটিকে একসময়ের এক কবিতা-লেখকের পরবর্তী সময়ে গদ্যপরি-লে-চলে-আসার পরোক্ষ কৈফিয়ত হিসেবে ঠাউরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কবিতার প্রতি প্রেমিক-মনোভাব আর সাহিত্যবিষয়ের উচ্চাশাকাতর হৃদয়ের আকুলতা হিসেবে ধরে নেওয়াই সংগত। সেই আকুলতা রয়েছে উপন্যাস বিষয়ে লিখিত ‘নিসর্গের বিন্যাস’ প্রবন্ধেও, যেখানে তিনি দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট  উপন্যাসের নায়ক রাসকলনিকভের কথা উলেস্নখ করে বলেন, যখন সে বোঝে আইন বা সমাজকে এড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় হলো সত্যের উপলব্ধি, তখনই সে উচ্চারণ করে : ‘আই এম গোয়িং টু হ্যাভ মাই পানিশমেন্ট ফর আই থার্স্ট – নট ফর পেস্নজার বাট ফর সাফারিং এন্ড টিয়ারস’, সেলিনা হোসেন লিখছেন, ‘আমাদের এখন দরকার এই লক্ষক্ষ্য পৌঁছুনোর যোগ্যতা অর্জন করা।’ আমাদের – মানে ঔপন্যাসিকদের – যোগ্যতা অর্জনের কথা বলছেন তিনি, এজন্য প্রতিভার আগুনের সঙ্গে পরিশ্রমের দাহ্য পদার্থের সংমিশ্রণ দরকার, তাহলে তার মধ্যে ‘নিসর্গ জনপথ এবং হৃদয়ের নিসর্গের বিচিত্র পৃথিবীর’ হদিস মিলবে। কথাগুলো এই প্রবন্ধের শেষের কথা, এর আগে উপন্যাস বিষয়ে নিজস্ব সংজ্ঞা/ উপলব্ধির কথা জানিয়ে এ-অঞ্চলের উপন্যাসের যাত্রা এবং ঔপন্যাসিকদের প্রবণতাও চিহ্নিত করেছেন। তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু, শওকত ওসমানের জননী, আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা, সরদার জয়েনউদ্দীনের অনেক সূর্যের আশা ও বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী, শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তকসারেং বৌ, জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, রশীদ করীমের উত্তম পুরুপ্রসন্ন পাষাণ, রাবেয়া খাতুনের ফেরারী, দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা উপন্যাসগুলোর উলেস্নখ করে লিখেছেন, এতে ‘জীবনের বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস আছে।’ উদ্ধৃত বাক্যটিতে স্বীকৃতি আছে, কিন্তু সন্তুষ্টি নেই; তিনি রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের কথা বাদ দিয়েও বিভূতি, মানিক ও তারাশঙ্করের উপন্যাসের দুর্ভেদ্য দুর্গের উলেস্নখ করে এই প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা কি তার কাছাকাছি যেতে পেরেছি?’

তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা  ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসদুটি; তাঁর বিবেচনায় প্রকরণ ও আন্তর চরিত্র বিদেশি পোশাকে ম–ত হলেও এর পটভূমি গ্রাম এবং এর উপাদানও লোকজ; ওয়ালীউল্লাহ্ ‘আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক চাহিদায় চমৎকার মিশেল ঘটিয়ে আমাদের উপন্যাসের দু’টো শক্ত খুঁটি স্থাপন করেছেন।’ বোঝা যায়, সেলিনা হোসেনের এই আলোচনায় রয়েছে তাঁর ঔপন্যাসিকসত্তার নিবিড় উপস্থিতি, তারপরও তাঁর সাহস আর নতুন চিমত্মার প্রতি উদার মনোভাব নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কথাটি অন্য ঔপন্যাসিকদের-বিষয়ে-করা মন্তব্য পড়ে যেমন বলছি, বলছি তাঁর ওয়ালীউল্লাহ্কে নিয়ে মূল্যায়নের বেলায়ও – এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিপ্রবণ, অন্য সমালোচকেরা যেখানে ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু উপন্যাসের স্বীকৃতি দিয়ে বিদেশি প্রভাবের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ, তিনি সেখানে গ্রহিষ্ণু; আজকের ঔপন্যাসিকদের বিষয় নির্বাচনের অবাধ স্বাধীনতার কথা চিমত্মা করলে তাঁর মূল্যায়নকে দূরদৃষ্টিপূর্ণ বলাটাই সংগত।

‘সেতু-বন্ধন’ প্রবন্ধটিও উপন্যাস নিয়ে লিখিত, এতে নানা মাধ্যমের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে উপন্যাসের ভাষা, বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে নানা কথা বলেছেন, তবে শেষ পর্যন্ত আঙ্গিকের প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। অন্যত্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসের আলোচনায় বলেছিলেন, উপন্যাসের গঠনশৈলী ঠিক না থাকলে তার সমগ্রতা খ–ত মাত্রায় বিক্ষিপ্ত হয় এবং লক্ষ্যহীন অবস্থায় তার সৌকর্য হারায়। এই প্রবন্ধটির নাম যেহেতু ‘সেতু-বন্ধন’, তাই বিভিন্ন মাধ্যমের গুণ আত্মস্থ করে নিতে পারলে নিজের মাধ্যমের অপূর্ণতা পূর্ণ হয়, এই পূর্ণতার প্রণোদনাই বোধহয় আঙ্গিকে বিশিষ্টতা আনে, তার মাধ্যমে কখনো কখনো শিল্পী বাঁকবদলের গৌরব অর্জন করেন।

স্বদেশে পরবাসী বইয়ে কয়েকজন খ্যাতকীর্তি ব্যক্তির কর্মকা- নিয়ে আলোচনা করেছেন সেলিনা হোসেন, যাঁরা তাঁদের কর্মের জন্য স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, এরা হলেন হারামণির সংকলক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, জাপানি কথাসাহিত্যিক ওসামু দাজাই, সাহিত্যিক আবুল ফজল, কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও
শিল্পী আববাসউদ্দীন। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটির নাম ‘অলিখিত জীবনের ভাষ্যকার’, বোঝা যায় নামটি তাঁর সংগ্রাহকজীবনের দিকটিকে বিবেচনা করেই গৃহীত, হারামণির গানগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি যেভাবে অনলস পরিশ্রম করেছেন তা সত্যি এক দুর্লভ ঘটনা। সেলিনা হোসেন মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আজীবন সাধনার দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে নিজেদের প্রতি ফিরে তাকানোর কথা বলেছেন। হারামণির সংগ্রহ ঘেঁটে পাঠকের উদ্দেশে মহাজনদের চমৎকার কিছু বাণী উপস্থাপন করার পাশাপাশি তিনি আবদুল হাফিজের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, সম্পদের সংগ্রহই শেষ কথা নয়, তারপরও কাজ থেকে যায় : ‘লোকসাহিত্যের আন্তর ধর্মের দিকে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে। শুধু সংগ্রহ, সংকলন এবং উদাহরণসহ সংজ্ঞা নির্ণয় আজ আর কোনো কাজের কথা নয়।’ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সামগ্রিক আলোচনা করতে গিয়ে আবদুল হাফিজের এই উক্তিকে প্রাসঙ্গিক মনে করে তিনি লিখেছেন :

 

১৯২০-২১ সাল থেকে তিনি সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। এখন ১৯৭৮। অর্ধশতাব্দীরও বেশি। অথচ যে অমিত যৌবন ও শক্তিতে কাজে নেমেছিলেন তা শুধু সংগ্রহের বিরাট শলাকায় দাউ দাউ আগুন জ্বালিয়েছে। সে-আগুন পোড়ায়নি প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি চিত্র। তাহলে তিনি দেখতেন ইতিহাস। সে-ইতিহাস নৃতত্ত্বের, অর্থনীতির, সমাজের, ঐতিহাসিক কাল-চেতনার।

 

একদম সত্য কথা, কিন্তু এ-কাজ করবে কে? এজন্য – আবদুল হাফিজের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি দেখিয়েছেন – পরিশ্রম ও প্রতিভা দুটোরই দরকার, সেলিনা হোসেনের মতে, ‘আশ্চর্যজনকভাবে মনসুরউদ্দীন দু’টো গুণের অধিকারী।’ মনসুরউদ্দীন পরিশ্রমী, এ-কথা একবাক্যে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তাঁর বিশাল সংগ্রহকে বিচার-বিশেস্নষণ ও গ্রহণ-বর্জনের জন্য আধুনিক চেতনা ও শীলিত প্রতিভা মনসুরউদ্দীনের ছিল না। তিনি পরিশ্রম করে গানের সংগ্রহ বাড়িয়েছেন, সেই সংগ্রহকে পরবর্তীকালের সংগ্রাহক ও গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘প্রকৃত বাউল গান’ বলে সম্মানিতও করেছেন; তিনি ঘুরে ঘুরে বাউলতত্ত্ব ও বাউল-ফকিরদের বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য সংগ্রহ করে হারামণির ভূমিকায় উপস্থাপন করেছেন, স্থানে স্থানে গানগুলোর বিশেস্নষণেরও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেখানে বিচারশক্তির পরিচয় কম। তা সত্ত্বেও মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন আমাদের জন্য যে-সংগ্রহকাজটি করেছেন, সেই ঋণ অপরিশোধ্য, এ নিয়ে কাঙিক্ষত গবেষণাকাজ সম্পাদিত হলেই শুধু সেই ঋণ কিছুটা পরিশোধ হতে পারে।

ওসামু দাজাইকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটি পড়লে এটি কেন লিখিত হয়েছে তার কারণ খোঁজার ইচ্ছা জাগে। জাপানি এই ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার নিজেকে শিল্পের বিষয়বস্তু করার পাশাপাশি পুরনো বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে নিয়ে উপহাসও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো বোধ আবিষ্কার করতে পারেননি – এ হলো ওসামু দাজাইয়ের প্রতি সেলিনা হোসেনের অভিযোগ। অভিযোগ আরো আছে, একটি আদর্শের প্রতি নিবেদিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর জীবনে এর কোনো প্রতিফলন নেই, তিনি শিল্পের প্রতি আশানুরূপ নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত ছিলেন না এবং আলোচনাটিও শেষ হয়েছে এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে যে, ‘দাজাই ওসামুর প্রদর্শনীর মনোভাব প্রবঞ্চনার শামিল। তাঁর সমগ্র জীবন এ-প্রবঞ্চনার শিকার। শিল্পিত বিবেকের আছে এর কোনো ক্ষমা নেই।’ যে-লেখকের প্রতি এত এত অভিযোগ, তাঁকে নিয়ে লেখার কারণ কী? এই প্রশ্ন তাঁকে কেউ করেছিল কিনা জানি না, তবে পরবর্তী সময়ে এ-বিষয়ে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ওসামু দাজাইকে নিজেকে ‘শিল্পের উপাদান’ করার জন্য আত্মহত্যা করায় তাঁকে ‘ভিন্নমাত্রার লেখক’ মনে হয়েছিল এবং তাঁকে আলোড়িত করেছিল। কিন্তু অভিযোগের পর অভিযোগ পড়ে মনে হয়, এই আলোড়ন আসলে অস্বসিত্মরই নামান্তর, আর তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই লিখিত হয়েছে এই আলোচনা; তবে আমরা, তাঁর পাঠকেরা, এই আলোচনা থেকে এটুকু বুঝে নিতে পারি যে, গল্প ও উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে ওসামু দাজাই যে-দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন, তার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর পছন্দ।

আবুল ফজলকে নিয়ে লিখিত আলোচনাটি অগ্রজের প্রতি অনুজের দায়িত্বশীল মনোভাবের পরিচয় বহন করছে, সে-অর্থে প্রবন্ধের নাম ‘ভূমিকা : অগ্রজের’, তা অর্থময় হয়েছে। লেখাটির শুরু হয়েছে কয়েকটি অলংকৃত বাক্য দিয়ে, কিন্তু আলোচনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে গিয়ে তাঁর প্রবন্ধ সম্পর্কে যে-সদর্থ মন্তব্য করেছেন, তা যথার্থ। তিনি লক্ষ করেছেন, সাতচলিস্নশের পরে যে-কোনো সংকটে তিনি সোচ্চার ছিলেন বলে আমরা – বাঙালি মুসলমানেরা – বহু গস্নানি ও পিছুটান থেকে মুক্তি পেয়েছি। তবে অনেক কল্যাণময় বিষয় ধারণ করা সত্ত্বেও আবুল ফজলের গল্প তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাঁর লেখা পড়ে মুসলমান সমাজের অবস্থার প্রতিফলনের সূত্রে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এর পরও এক্ষেত্রে সফল হননি আবুল ফজল; যে-বিষয়গুণের জন্য তিনি মননশীল ক্ষেত্রে সার্থক, সেই ‘বিষয়’টি প্রবল হয়ে ওঠার কারণে সৃজনশীল ক্ষেত্রে তিনি যে কাঙিক্ষত সার্থকতার পরিচয় দিতে পারেননি, সেলিনা হোসেনের মূল্যায়নে তা নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে।

আববাসউদ্দীন যে-সময় গান গাইতে এসেছিলেন সে-সময় মুসলমানদের গান গাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ ছিল, তাঁর বড় মামার কাছেই তাঁকে শুনতে হয়েছে এমন ধমক যে, ‘পাজী ছেলে, মুসলমানের গান গাইতে আছে?’ কিন্তু কোনো বাধাই তাকে দমাতে পারেনি, আববাসউদ্দীনের যৌবন ছিল, সেলিনা হোসেনের ভাষায়, ‘বাঁধ-ভাঙার হাতুড়ি, কণ্ঠে যাদুকরী স্পর্শ। এ-দুয়ের সম্মিলনে তিনি তছনছ করে দিয়েছিলেন সমাজব্যবস্থার আসুরিক অনুশাসন।’ আববাসউদ্দীন তাঁর বই আমার শিল্পীজীবনের কথায় দেশ শিল্পায়িত হলে এখান থেকে পলস্নীগীতি লোপ পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য বলেছিলেন, কিন্তু তা সংরক্ষিত হয়নি, তার তিরিশ বছর পর সেলিনা হোসেন লিখেছেন, ‘আববাসউদ্দীন যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন আমরাও ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।’ এরপর আরো তিন যুগ পার হয়েছে, আমরা এখনো আববাসউদ্দীনের আশঙ্কার নিরসন করতে পারিনি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় প্রকাশের পর উপন্যাসটি নানাভাবে আদৃত হতে থাকে, লক্ষ করি, সেলিনা হোসেনের ‘প্রসঙ্গ : সেই সময়’ প্রবন্ধেও রয়েছে তার স্বীকৃতি,  তিনি ‘দু’খ– সমাপ্ত ৮৯০ পৃষ্ঠার এই শিল্পকর্মটি একটি ঈর্ষণীয় কাজ’ বলে অভিহিত করেছেন।’ তবু এই মুগ্ধতা প্রকাশই এই প্রবন্ধের শেষ কথা নয়, তিনি উলেস্নখ করেছেন এত বড় উপন্যাসে ‘অত্যন্ত নগণ্য এবং তাপর্যহীন’ দু-একটি চরিত্র ছাড়া উলেস্নখযোগ্য কোনো মুসলিম চরিত্র নেই, অথচ এই সময়ে মুহম্মদ মহসীন ওরফে দুদু মিয়া, তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ‘হতোদ্যম কৃষকদের জীবনে নবজীবন এনেছিলেন’ যে-দুদু মিয়া, উপন্যাসে তার উলেস্নখ না থাকলেও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিরুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে গঙ্গানারায়ণের নাম আছে। তিনি সমাচার দর্পণ ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সংকলিত সংবাদপত্রে সেকালের কথার সূত্র উলেস্নখ করে সেই সময়ে ফরায়েজি আন্দোলনের গুরুত্বের উলেস্নখ করে বলেন, ‘আশ্চর্যজনকভাবে একই সময়ের পটভূমিতে রচিত হলেও এ-প্রসঙ্গে উপন্যাসের কোথাও কোনো আলোকপাত নেই।’ এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝে নিতে পারি, সেলিনা হোসেন নিজে যখন কোনো বিশেষ সময়কাল নির্ধারণ করে উপন্যাস লিখতে যাবেন, তখন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে। এভাবে বইয়ের বিভিন্ন আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে তাঁর মানসভুবন, কখনো কখনো প্রাসঙ্গিকভাবে নিয়ে এসেছেন নিজের উপন্যাসের কথা, লেখক হিসেবে তাঁর জীবনের নানা প্রসঙ্গ এবং কখনো কখনো নিজের দেশের কথাও।

‘উপন্যাসের দিগ্বলয় : স্বপ্ন ও বাস্তব’ প্রবন্ধে অন্য দেশের ঔপন্যাসিকদের সংগ্রামশীল চেতনা ও তাঁদের উপন্যাস নিয়ে আলোচনার পাশাপাপাশি সৃষ্টিশীল লেখকের অবস্থান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন সেলিনা হোসেন। এই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকা ও আফ্রিকার উপন্যাস কীভাবে নানা প্রথা ও উপনিবেশের শিকল ভেঙে তছনছ করে আবিষ্কার করেছে তার নিজের শিকড় এবং ঔপন্যাসিকরাও তাঁদের উপন্যাসে নায়ক-নায়িকাদের গৌণ করে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে মুখ্য করেছেন। এসব উপন্যাসের আলোচনার সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিকভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাস কালকেতু ফুলস্নরার কথা এবং দেখিয়েছেন সময়বাস্তবতার কারণে মিথ কীভাবে প্রসারিত হয়ে বতর্মান সময়ের পটভূমির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমরা জানি নগর পরিচালনা করে অভিশাপমুক্ত হয়ে কালকেতু স্বর্গে ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু উপন্যাসে কালকেতু নগরকে কেন্দ্র তার স্বৈরশাসন গড়ে তোলে এবং একনায়কে পরিণত হয়। একসময় জনগণ ফুঁসে ওঠে, তারা মানব-দেয়াল তৈরি করে, কালকেতুর তিরন্দাজদের তির শেষ হয়ে যায়, জনগণ প্রাসাদ আক্রমণ করে এবং পরে তাদের আদালতেই কালকেতু ও ফুলস্নরার ফাঁসি হয়। সেলিনা হোসেন লিখেছেন, ১৯৮৯ সাল থেকে লেখা শুরু করে ১৯৯০-এর নভেম্বর মাসে এসে শেষ করেন কালকেতুফুলস্নরা উপন্যাসটি এবং লেখা শেষ করে এই অস্বসিত্মতে ভোগেন যে, শিল্পের মধ্যে তিনি যে-স্বপ্ন দেখেছেন, বাস্তবে কি তার রূপায়ণ হবে? আমাদের বোঝার বাকি থাকে না যে, কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছেন এবং এও তো দেখেছি যে, তাঁর স্বপ্ন আসলেই বাস্তবে পরিণত হয়েছে কিনা। হন্যমান উপন্যাসের লেখক জয়া মিত্রের ভূমিকার সূত্র ধরে একজন সৃজনশীল লেখকের সফলতা ও ব্যর্থতার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘লেখকের ব্যর্থতাবোধের কোনো সত্য নেই। তিনি ব্যর্থ নন। তিনি একজন সৃষ্টিশীল মানুষ।’ তাই, লেখকের স্বপ্ন যদি কখনো বাস্তবায়িত নাও হয়, কালকেতু ফুলস্নরার লেখকের দেশে যদি স্বৈরাচারের পতন নাও হতো, তবু তিনি ব্যর্থ হতেন না, কারণ এই স্বপ্ন এখানে বাবস্তায়িত না হলেও নিশ্চয়ই অন্য দেশে অন্য কোথাও এর প্রতিফলন ঘটত। নগুগির উপন্যাস পড়তে পড়তে সেলিনা হোসেনেরও এরকম মনে হয়নি যে, তিনি বাংলাদেশের কোনো লেখক নন, তাঁর ভাষায় : ‘ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক, জাতিগত ব্যবধান সত্ত্বেও শুধু ওপরকাঠামোর কারণে কেনিয়া যখন চোখের সামনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে তখন বুঝে যাই যে, উপন্যাস এভাবে পৃথিবীর মানুষকে একসূত্রে গাথছে।’

এভাবে লেখকের কাজ নানাভাবে অর্থময় হয়ে ওঠে, তাই একজন লেখকের করণীয় সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। ‘শিল্পের খনন : লেখকের দায়’ প্রবন্ধে তাই তিনি বলেন যে, একজন লেখক তাঁর লেখায় নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করে ক্ষান্ত হবেন, নাকি সক্রিয়ভাবে সংগ্রামে শরিক হবেন, তা তাঁর নিজের ব্যাপার, এজন্য কোনো শর্ত নেই, এ-বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকলে বরং সৃষ্টিশীল লেখকের ক্ষতি হয়। এছাড়া একজন লেখকের দায়ের প্রশ্নে অবস্থানগত দিকটাও বিবেচ্য, কারণ সব স্থানের সমস্যা ও আবেদন সমান নয়। এরপরও লেখকের মৌল দায়িত্ব হিসেবে তিনি যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, তাঁর ভাষায় : ‘লেখকের মৌল দায়িত্ব হলো ভালো লেখা। নিজের প্রতি সৎ থেকে নিজের অনুভবকে শক্ত মেরুদ- দেওয়া লেখকের কর্তব্য। তিনি যেন কখনো পরগাছা না হন, অন্যের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাসত্ব স্বীকার না করেন।’

সেলিনা হোসেনের আলোচনায় তাঁর সৃজনশীল লেখকসত্তার নিবিড় উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, যার ফলে তাঁর প্রবন্ধগুলোর অনেক মন্তব্যই অভিজ্ঞাননির্ভর/ বাস্তবসম্মত ও আকর্ষণীয় মনে হয়। হয়তো এই কারণেই কারো কারো কাছে তাঁর আলোচনাগুলো অনাকর্ষণীয় মনে হতে পারে, তা যার যার রুচি ও বিবেচনার বিষয়, কিন্তু তিনি তাঁর এ-ধরনের প্রবন্ধ বিষয়ে তাঁর অবস্থান একাধিক জায়গায় স্পষ্ট করেছেন। ‘ছোটগল্পের সংকট’ প্রবন্ধে ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ তৎকালীন সময়ে উত্থাপিত এরকম একটি জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে তিনি তাঁর গল্পকারসত্তার আকুলতার কথা এভাবে জানিয়েছেন :

গল্প বলতে চাই একজন নিঃসঙ্গ মানুষের – আটষট্টি বছর বয়সে যাকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। গল্প বলতে চাই, যার কাছে প্রেম এবং ফসল অভিন্ন, যেখানে ভালোবাসা এবং ঘৃণা একই সমান্তরালে অবস্থান করে। গল্প বলতে চাই নগ্ন, ক্ষুধার্ত মানব-মানবীর – কলার মান্দাস যাদের জীবনের দীর্ঘ পাড়ির সম্বল; ভাতের সানকির স্বপ্নে যাদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। ভুলতে পারি না বিত্তবান পিতার বখে-যাওয়া ছেলেটির অনুতপ্ত কান্না। একজন নারীর গল্প বলতে চাই, যে-নারীসত্তায় তীব্রভাবে সচেতন, যার কাছে যৌনচাহিদার সঙ্গে সমত্মানের পিতৃত্বের অধিকারের প্রশ্ন এক নয়।

তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি তাঁর নিজের গল্পকারসত্তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ঠিক কী বলতে চান। আসলেই পৃথিবীতে গল্পের শেষ নেই, কিন্তু গল্প তো তাঁর মতে, জয়নুল আবেদিনের বিদ্রোহী ষাঁড়ের মতো, যে-বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের নতুন মাটি আবিষ্কারের জন্য একরোখা। তাই যদি মনে হয় ছোটগল্প মরে যাচ্ছে, এজন্য তিনি এর দায় পাঠকের ওপর চাপিয়ে দিতে নারাজ, এর দায় লেখকদের, সরবে না লেখার জন্য – আরো স্পষ্টভাবে বলতে চাইতে যোগ্যভাবে লিখতে না পারার জন্যই এই অবস্থা। ‘ছোটগল্পের সংকট’ প্রবন্ধটির প্রকাশকাল বইয়ে উলিস্নখিত সাল অনুযায়ী ১৯৯২, এর কাছাকাছি সময়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ প্রবন্ধটিও ছাপা হয়, তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনো একটি সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে একরৈখিক আলোর মধ্যে তাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করার শর্তটি পালন করা সৃজনশীল লেখকের পক্ষে দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে।’ কারণ সমাজে প্রবল ভাঙচুর চলছে এবং সেখানে নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগের ফলে ‘মানুষের গভীর ভেতরের রদবদলের পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছোটগল্পের শরীরেও পরিবর্তন’ ঘটছে। এভাবে ছোটগল্পের নানা সমস্যা ও সংকট তুলে ধরার পরও শেষ পর্যন্ত ইলিয়াস আশাবাদী, তাঁর মতে, হাতেগোনা কয়েকজনও যদি মানুষের এখনকার ধাক্কা-খাওয়া বা পরিবর্তনকে উপযুক্ত শরীরে উপস্থাপনের দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন ‘তাতে ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব।’ এরপর তো আরো দুই যুগ অতিক্রান্ত এবং দেখা যাচ্ছে গল্প এখনো মরে যায়নি, হাসান আজিজুল হকও তাঁর ‘ছোটগল্পে থাকা
না-থাকা’ প্রবন্ধে উলেস্নখ করেছেন, ‘আমি যদি মরে না যাই তবে গল্প লেখার ইচ্ছে কখনোই আমার মধ্যে মরে যাবে না।’  গল্প যে মরে যাবে না, সে-বিষয়ে আশাবাদী সেলিনা হোসেনও, তাঁর মতে, যতদিন মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, শোষণ-নির্যাতন-সংগ্রাম থাকবে, ততদিন ছোটগল্প থাকবে। তাঁর মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি যাদের নিয়ে গল্প বলতে/ লিখতে আগ্রহী তাদের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা জড়িত আর সেই অভিজ্ঞতার চাপেই তিনি লিখছেন, ভবিষ্যতেও লিখবেন গল্পের পর গল্প।

তাঁর এই অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে ছোটবেলা থেকেই, ‘সোনালি ভুবন’ শীর্ষক আত্মজৈবনিক রচনার মধ্য দিয়ে জানতে পারি – এক বর্ণাঢ্য শৈশব ছিল তাঁর। বাবার নেশা ছিল মাছ ধরা, নেশা ছিল পাখি শিকারেরও, চাকরি করতেন রেশম কারখানায়, হাজারো বসনির বাড়িতে ঘুরতেন – এসব ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতেন তিনি, এতে বাবাও কোনো আপত্তি করতেন না। করতোয়া নদীর পাশে গ-গ্রাম নামক গ্রামে বেড়ে উঠেছেন তিনি, সেখানকার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, বালুচর, খেয়াঘাট, গাছগাছালি, মিষ্টিআলুর খেত প্রভৃতি স্থানে ঘোরার ‘অবাধ স্বাধীনতার সঙ্গে কৌতূহলী জিজ্ঞাসার অনাবিল সামঞ্জস্য ঘটেছিল বলে অভিজ্ঞতার আশ্চর্য সমৃদ্ধি অনেক ঘাটতি পুষিয়ে দিয়েছিল।’ বোঝা যায়, কেন তিনি বলতে পারেন ‘সামাজিক দিক থেকে মহিলা হবার কারণে আমাকে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি’, তবে তিনি ‘লেখক’ না ‘লেখিকা’, এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে তর্ক করতে হয়েছে তাঁকেও। অনেকে এমন অভিযোগ করেন যে, মহিলাদের রচনায় কিছু ফেমিনিন দুর্বলতা থাকে, যা তাদের রচনাকে আকর্ষণহীন করে রাখে; তিনি তা স্বীকার করেও বলেন, জীবনের নানা ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতার কারণে এমন দুর্বলতা মহিলাদের লেখায় হয়তো একটু বেশিই থাকে, তবে এমন দুর্বলতা অনেক পুরুষ লেখকের রচনায়ও যে তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে অবাধ স্বাধীনতা আর বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার কারণে লেখালেখির শুরু থেকেই এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন সেলিনা হোসেন। কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে যার সাহিত্যজীবন শুরু, একসময় এই অভিজ্ঞতার কারণেই তাঁর মনে হলো, ‘যেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাতাসিরা, ফটিকচাঁদেরা – সমত্মান, সংসার ইত্যাকার হাজারো ঝামেলার গোঁজামিলে। অল্প কথায়, ইঙ্গিতে, প্রতীকে, উপমায় তাকে কি ধারণ করা যায়?’ যে-অভিজ্ঞতা থাকলে একজন সৃজনশীল কথাসাহিত্যিকের লেখা পূর্ণতা পায়, তা আছে বলেই তাঁর উপন্যাস ও গল্প সমৃদ্ধ হয়েছে, সেইসঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে মননশীল লেখাও। এ-প্রসঙ্গে উলেস্নখ করা যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের নিরুপম যাত্রা নিয়ে লিখিত ‘জীবনানন্দ দাশের ‘নিরুপম যাত্রা’র ধ্বনি ও চিত্র’ আলোচনাটির কথা, মনোজগতে কবিতা লেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রকৃতিনিবিড় চেতনা একাত্ম না থাকলে কোনো আলোচকের পক্ষেই এমন সংবেদনময় আলোচনা লেখা সম্ভব নয়।

নিরুপম যাত্রা নামক পঁচিশ পৃষ্ঠার এই লেখাটিকে – যেটি ১৯৮৪ সালের শারদীয় প্রতিক্ষণে গল্প হিসেবে প্রকাশিত হয় – সেটিকে গল্প না উপন্যাস বলা যায়, প্রথমেই এই প্রশ্ন তুলে এবং আয়তনকে বিবেচনায় রেখেও, ক্যানভাসের বিশালত্ব ও জীবনবোধের গভীরতার কারণে একে উপন্যাস হিসেবে ধরে নিয়েই আলোচনাটি শুরু হয়েছে।
গ্রাম-শহরের দ্বৈত সম্মিলনে তৈরি এই ক্যানভাসে ‘গ্রামের প্রকৃতি এবং জীবনপ্রবাহের খ- খ- দৃশ্যের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে এক অর্থবহ সামগ্রিকতা।’

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র প্রভাত, যে তার ছয় মাসের ছেলেকে গ্রামে রেখে চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসে, কিন্তু চার বছর পরে গ্রামে ফেরার উদ্যোগ নিয়েও শেষপর্যন্ত আর গ্রামে ফিরে যেতে পারে না। এই ছেলে গ্রামে কী করছে শহরে বসে তা মনে মনে কল্পনা করে প্রভাত, এই ভাবনায় প্রকৃতির যে-রূপ ফুটে ওঠে তাতে রূপসী বাংলার কবিকে মনে করিয়ে দেয়, এই পর্যবেক্ষণ সেলিনা হোসেনের – নিঃসন্দেহে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ। আসলে শুধু রূপসী বাংলার কবি হিসেবেই নেয়, যে যে বিষয়-আবহ নিয়ে জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবিসত্তা গড়ে উঠেছে তার উপস্থিতি জীবনানন্দের সব গল্প-উপন্যাসেই কমবেশি রয়েছে, তবে এতে এর চেয়েও প্রবলভাবে নানা ভঙ্গিমায় যা উপস্থিত, তা হলো জীবনানন্দ দাশের আত্মজীবন। এ-কথাটি অবশ্য আলোচক বলেননি, না বললেও মূল্যায়নের ক্ষতি হয় না, বরং তিনি যখন উপন্যাসটিকে বাস্তব ভিত্তি দান করার জন্য নিম্নোক্ত মন্তব্যটি করেন, তখন তা আমাদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট না করে পারে না :

এ-উপন্যাসের প্রবহমানতা এভাবে ক্রমাগত একটি অন্তর্গত বোধের ভেতরে সচল থাকে। মনে হয় নায়ক বুঝি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত এবং রূঢ় বাস্তবের সংঘর্ষে হতাশাগ্রস্ত। কিন্তু আসলে তা নয়। ক্রমাগত রূপান্তরে ভেতরে পরিবর্তিত হতে থাকে জীবনের অনুভব – এর ভেতর দিয়ে বয়ে যায় সম্পর্কের স্পন্দন, কালিক স্পন্দন এবং
প্রকৃতি ও মানবসম্পর্কের আবহমানকালের সেই বোধ যা টিকিয়ে রাখে সভ্যতা।

যে-পার্থক্যের কথা বলছেন, তা সবার চোখে ধরা পড়ার কথা নয়, ক্রমাগত রূপান্তরের ভেতরে পরিবর্তিত যে-জীবন-অনুভবের কথা বলছেন তাতে জীবনানন্দের আত্মজীবনের অনেকটাই উপস্থিত, সে-কথা বিবেচনায় আনলে, জীবনানন্দের জীবনব্যাপারের তথ্যাদি জানার পর এবং জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে লাবণ্য দাশের মনোভাব ও তাঁর স্মৃতিলেখা পড়ে ফেলার পর, উপন্যাসে বারবার স্ত্রীর দোষ ধরার ব্যাপারটিরও একটা প্রসঙ্গসূত্র পাওয়া যায়। এমনিতে বোঝা যায় যে, নিরুপম যাত্রার বিষয়ের সঙ্গে লেখকের দূরত্ব অনেকাটা স্বেচ্ছানির্মিতই – ওরহান পামুক একেই ঔপন্যাসিকের অন্যতম উপভোগ্য বিষয় বলে মনে করেন, অর্থাৎ এ হলো চরিত্রগুলোর জায়গায় নিজেকে স্থাপন করার সময় নিজেকে বদলে ফেলার উপভোগ্যতা। এভাবেই দূরত্বটা তৈরি হয়; তবে এখানে, উপন্যাসের বিষয়ের সঙ্গে জীবনানন্দের জীবনবিষয়ের যতটা দূরত্ব, এ-দুটি চরিত্রকে আলাদা করে দেখলে, প্রভাত ও কমলার মনোভাবের নৈকট্য তার চেয়েও বেশি। বাস্তবজীবনে স্বামীর নানা অসফলতার জন্য স্ত্রীর যে-মনোভাব তৈরি হতে পারে, কমলারও সেটা হয়েছিল, সমত্মান-শাশুড়িসহ গ্রামে কষ্টকর বসবাসের বাস্তবতায় তা থাকা আরো স্বাভাবিক, এই অবস্থায় তিনি লেখেন, ‘প্রভাত তেমন পুরুষ যে নারীকে ঠিকমতো দেখতে শেখেনি। স্ত্রীর প্রতি সে নিজে শ্রদ্ধাশীলও নয়।’ এমনটি লেখার আরো কারণ হলো, কুকুরের নিঃসঙ্গতার প্রতি প্রভাত সংবেদনশীল হলেও স্ত্রী কমলার প্রতি তার কোনো মমতা নেই। প্রভাতের মনোভাব মূল্যায়নে তাঁর মন্তব্য অযথার্থ, তা বলা যায় না, তবু জীবনানন্দের কবিসত্তার প্রতি দুর্বলতাবশত তাঁর স্বভাবের জায়গায় প্রভাতকে দাঁড় করালে আমাদের মূল্যায়ন খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়ে। জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে তাঁর বাড়িতে অনেক বিখ্যাত লেখকের উপস্থিতি দেখে জীবনানন্দ দাশের লেখকখ্যাতি-বিষয়ে উদাসীন/ অজ্ঞাত লাবণ্য দাশ যেভাবে সচকিত হয়েছিলেন, তাতে তার জায়গায় কমলাকে দাঁড় করিয়ে প্রভাতের বর্ণনা যদি মনে করি যে, ‘কমলার তো বিশেষ কোনো ব্যাকুলতা নেই মনে – সে কেমন বিমুখ উদাসীন গোছের মেয়েমানুষ’, তাহলে কি তাকে খুব দোষ দেওয়া যাবে? জীবনানন্দ-লাবণ্যের দাম্পত্যের আলোকে প্রভাত-কমলার দাম্পত্যকে বিচার করার ব্যাপারটিতে যদি কারো আপত্তি থাকে বা কেউ যদি এতে অতিভাবনার পরিচয় খুঁজে পান, তাহলে আরেকজন আলোচক গৌতম সেনগুপ্তের মূল্যায়নটিও পড়ে দেখা যেতে পারে :

এ-গল্পের শুরুতে দেখা যায় যে, শিক্ষিত বেকার প্রভাত চার বছর বাদে দেশে ফিরবে। ফিরবেই ফিরবে। দেশের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার মা ও স্ত্রীর চিঠি। এখানেও একটা অদ্ভুত বৈপরীত্যের মধ্যেই এই দুটি চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও গল্পে তারা চরিত্র হিসেবে আসে না একবারও। তার স্ত্রীর চিঠি ‘রক্তাক্ত লড়াইবাজ চিলবধূর মতো’। ‘খোকা কত বড় হল?’ জানতে চাইলে উত্তর আসে, কুন্দর চিঠি পেলাম আজ; তার স্বামী তো কলকাতায় গিয়ে ছ-মাসের মধ্যেই রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে কতো বড়ো চাকরি জোগাড় করে নিল আর তুমি কিছুই পারলে না।’ এর পাশাপাশি তার মার চিঠি এক অদ্ভুত মমতার স্পর্শ নিয়ে আসে তার কাছে।

তারপরও, এই দুধরনের বিবেচনাকে একজন নারীলেখকের সঙ্গে অন্য পুরুষলেখকের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য বলে ধরে না নিয়ে, বরং জীবনানন্দ দাশের লেখার বহুস্বর-স্বভাবী গুণের উলেস্নখ করাটাই সংগত। এই ধরনের লেখা পাঠক-সমালোচক উভয়কে নানাভাবে ভাবায়, গৌতম সেনগুপ্তকে একভাবে ভাবিয়েছে, সেলিনা হোসেনকে ভাবিয়েছে অন্যভাবে, হয়তো দুই ভাবনাই ঠিক, আবার পরে অন্য কেউ হয়তো অন্যভাবে ভাববেন। কাফকার লেখা সম্পর্কে এরকমই বলেছিলেন আলবেয়ার কামু, বলেছিলেন, সমাপ্তির অভাব ও ভাষা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত না হওয়ার কারণে ব্যাখ্যার পরেও কখনো কখনো অন্যতর ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রয়ে যায়, তখন আবার পড়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, কামুর মতে, এটাই চেয়েছিলেন কাফকা। জীবনানন্দও সেরকম চাইতেন কিনা জানি না, তবে সেলিনা হোসেন নিরুপম যাত্রাকে যেভাবে একটি শিল্পকর্মের ক্যানভাস হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন তাতে বহুমুখী ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নের সম্ভাবনাটাই স্বীকৃতি পেয়েছে; তিনি লক্ষ করেছেন এ-উপন্যাসে মানুষ ছাড়াও প্রাণী ও গাছের ওপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এরা না থাকলে ক্যানভাসে রঙের বিন্যাস ঠিকমতো হয় না, তখন বোঝা যায় এই সমালোচক ঔপন্যাসিকের জাতিনিরপেক্ষ বা সবাইকে একভাবে দেখার ভঙ্গিটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এই কারণে ঔপন্যাসিকের আপাতনির্মম ঔদাসীন্যও প্রশ্রয় পেতে পারে। একবার যেখানে স্ত্রীর চেয়ে কুকুর কেতুর প্রতি মমতা প্রকাশের কারণে প্রভাতকে দায়ী করেছিলেন, আবার তিনিই যখন কেতুর প্রতি তার বাঙ্ময় অনুভবের কারণে উপন্যাসটি তাৎপর্যময় হয়েছে বলে উলেস্নখ করেন, তখন এর জন্য আলোচককে দায়ী না করে ঔপন্যাসিকেরই তারিফ করব।

১৯৯৯ সালে [শ্রাবণের আড্ডার পক্ষে] মাসুদুল হক, খালেদ হোসাইন ও রবীন আহসানের নেওয়া সাক্ষাৎকারে সেলিনা হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি সব লেখকের জন্য একজন অসাধারণ সমালোচকের অপেক্ষায় আছি। তাঁরাই লেখককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। এবং তারাই লেখকের ভেতরে কোনো সারবস্তু আছে কিনা, সেটা বলে দেবেন। বলবেন এই যে, এই লেখক, এই তাঁর ধারা। এর মধ্য থেকেই নতুন তত্ত্বটি বেরিয়ে এসেছে।’ সেই ১৯৯৯ সালেই জীবনানন্দ দাশের এই উপন্যাসটি নিয়ে অন্তরঙ্গ আলোচনাটি লিখেছিলেন তিনি, এই আলোচনাটি পড়তে গিয়ে বারবার তাঁর সেই আকাঙক্ষার কথাটাই মনে পড়ছে। মন্তব্য প্রদানকালে সমালোচকের আদর্শ হিসেবে তিনি ঠিক কাকে কল্পনা করেছিলেন জানি না, ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাস : রূপ-রূপান্তর’ প্রবন্ধে মিখাইল বাখতিন উলেস্নখ করেছিলেন, তাই তাঁর কথা মনে রেখেও বলতে পারেন। অন্যত্র, ‘উপন্যাসের বিন্যাস’ প্রবন্ধে দস্তয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের নায়ক রাসকলনিকভের সত্য উপলব্ধির ওপরে জোর দিয়েছিলেন সেলিনা হোসেন, মিখাইল বাখতিন এই উপলব্ধিকেই বলেছিলেন ‘অস্বার্থপরতা’ – খুনি এবং বন্ধকের ব্যবসায় জড়িত একজনকে লুট করা সত্ত্বেও রাসকলনিকভের যে-অস্বার্থপরতা, বাখতিন তা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন দস্তয়েভস্কির শিল্পীসত্তাকে গুরুত্ব দিতে পেরেছিলেন বলে। এমন সমালোচনার জন্য সমালোচককে কি শুধুই সমালোচক হলেই চলে? তার চেতনায় সৃজনশীল সাহিত্য রচনার অভিজ্ঞতা থাকলে তো খুবই ভালো, না    থাকলেও বাখতিনের মতো দর্শন-জ্ঞান এবং একাধিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি না থাকলে অন্তরঙ্গ আলোচনা সম্ভব নয়। হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, ‘সমালোচনাকে প্রথমে শিল্প এবং সাহিত্যের স্বশাসন এবং স্বয়ম্ভরতা মেনে নিতে হবে’, এমন সমালোচনা যিনি করবেন তিনি নিজে সৃজনশীল সাহিত্যের অন্তরঙ্গ হতে বাধ্য, কারণ তা মেনে এগোতে গেলে সমালোচকের যোগ্যতা বিষয়ে আমাদেরও এমনতর উচ্চাকাঙক্ষী না হয়ে উপায় নেই। এ-বিষয়ে সেলিনা হোসেনের মন্তব্য পড়ে মনে হয়, একজন সমালোচকের কাছে তিনি যা কামনা করেন, তাতে সমালোচককে তিনি ব্যাপক স্বাধীনতা দিতে রাজি, কিন্তু সেক্ষেত্রেও, সেই ‘অসাধারণ’ সমালোচককে পেতে গেলে তাঁকে উচ্চাকাঙক্ষীই হতে হবে। আমাদের এখানে যারা সৃজনশীল লেখক, তাঁদের অনেকেই সমালোচনাসাহিত্যকে নিজের সৃজনশীল সাহিত্যের পরিপূরক হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত, তাঁরা নিজেকে মননচর্চায় পুরোপুরি নিয়োজিত করতে অনাগ্রহী। সেলিনা হোসেন নিজেও সেরকম ভাবেন, না হলে জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসের যে-আলোচনাটির সূত্র ধরে কথাগুলো বলছি, সেটি লিখেছিলেন ১৯৯৯ সালে, তার আগে এবং স্বদেশে পরবাসীর প্রবন্ধগুলো লেখার পরে এরকম কয়টি প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি? অথচ এরই মধ্যে নানা বিষয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলোর গুরুত্ব স্বীকার করেও বলছি, এসব বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার লোক বাংলাদেশে অনেকেই আছেন, কিন্তু এখানে শিল্প-সংবেদনধর্মী প্রবন্ধ লেখার লোকের খুবই অভাব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল শুধু ভাষার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারেননি, না হলে সালমান রুশদি, ভিএস নাইপল, হোলিও করতেজার যে-খ্যাতি পেয়েছিলেন, ঠিকমতো অনূদিত হলে তিনিও সেরকম খ্যাতির অধিকারী হতেন, তাঁর মতে, ‘তাঁর উপন্যাসের অন্তর্গত স্রোত বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক উপন্যাসসমূহের সঙ্গে তুলনীয়।’ উদ্ধৃত বাক্যটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৮৪ সালে, এরপরও ওয়ালীউল্লাহ্কে নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ আলোচনা তিনি লেখেননি। ওয়ালীউল্লাহ্ সম্পর্কে এমন উচ্চধারণা আরো অনেকেই পোষণ করেন, তারপরও তাঁকে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা কি হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের নম্বর-কুড়ানো আলোচনার কথা বলছি না, আমাদের অগোচরে কোথাও কোথাও সেটা হলে হতেও পারে, বলছি না সৃজন-বেদনাহীন সমালোচকের নিরেট আলোচনার কথাও, আমরা চাই অন্তর্দৃষ্টিময় আলোচনা। কিন্তু সে-আলোচনা কে করবে? তাঁর আরেক প্রিয় ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্তের বাঘারু চরিত্র নিয়ে একাধিক জায়গায় মন্তব্য করলেও উপন্যাস নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা লেখেননি, লেখেননি তাঁর অন্য প্রিয় ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেনকে নিয়েও, অথচ তাঁর আগ্রহের যে-জায়গা, তাতে, দেবেশ রায়ের মানুষ খুন করে কেন এবং অভিজিৎ সেনের রহুচ-ালের হাড়বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর উপন্যাস নিয়ে লেখার যোগ্য ব্যক্তি তিনিই। বিষয় ও যাপন-অভিজ্ঞতাগত কারণে তিনি লিখতে পারতেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসদুটি নিয়েও, কিন্তু লেখেননি। একজন সৃজনশীল লেখককে যে এরকম মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখতেই হবে তা নয়, বিশেষ করে সৃজনশীল সাহিত্যে তাঁর যে নিরন্তর অংশগ্রহণ, তাতে তাঁর প্রতি এরকম প্রত্যাশা করাটাও হয়তো ঠিক নয়, তবু যিনি লাতিন আমেরিকার উপন্যাস নিয়ে এত পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লেখেন, যিনি জাপানি লেখক ওসামু দাজাইকে নিয়ে একটি পৃথক আলোচনা লিখতে পারেন, তাঁর কাছে এমন আশা করাটা অমূলক নয়। যে-আলোচকের আলোচনায় একজন ঔপন্যাসিকের/ শিল্পীর মনের গোপন ইচ্ছে বা শিল্পকর্মের আপাত স্থিরচিত্রগুলো এভাবে পঠিত হয় :

আরো অসংখ্য গাছ, ঝোপ, বুনোফুল, আগাছার উলেস্নখ আছে উপন্যাসের ক্যানভাসজুড়ে। এসব প্রাকৃতিক চরিত্র উপন্যাসের ক্যানভাসকে ব্যাপক এবং গভীর করছে। তাদের ভেতর দিয়ে নানা অর্থ বেরিয়ে আসে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে।

তাঁর মূল্যায়নে একটি সৃষ্টিশীল রচনা কতটা প্রাণবন্ত, বহুস্বরিক ও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারবে, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। এছাড়া তাঁর নিজের বইয়ের আলোচনা পড়ে সেখানে কাঙিক্ষত বিষয় অনালোচিত থেকে যায় বলে তিনি যে-সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, তার একটা পরোক্ষ সমালোচনা বা আলোচনার একটা দৃষ্টান্তও তো হয়ে উঠতে পারে তাঁর এসব মূল্যায়ন, তাতে লেখক-পাঠক-সমালোচক সবারই উপকার হবে।