লোক-পরম্পরায় স্বাধীন মঞ্চগান

১৯৭১।

বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটল এক পালাবদল। পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্জিত হলো সাংস্কৃতিক অধিকার। বহুধারা সংস্কৃতির পথে প্রতিষ্ঠিত হলো মঞ্চের নাট্যচর্চা। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে মঞ্চনাট্যের পালে লাগল নতুন ঢেউ। বহুবিচিত্র সে-মঞ্চ প্রকাশে গানের ব্যবহারে বারবার এসে মিলল লোকজ-পরম্পরা। মঞ্চনাট্যে লোকগানের সে-বিস্তারে কখনো মাঝিমাল্লার সরিৎবিহার, কখনো বাউল-বৈরাগীর সহজিয়া, কখনো ফকির-দরবেশের অধ্যাত্ম, কখনো সুফি-কাওয়ালির চারণ, কখনোবা পির-গাজির দোদুল ছন্দ। স্বাধীন মঞ্চের যুগবদলের পালায় বহুনিরীক্ষায় সহজাত হলো লোকগানের পরিযায়ী মনন। কখনো সুরের টানে কখনোবা কাব্যের ধ্যানে লোক-পরম্পরার বহুবর্ণ প্রকাশ পেল মঞ্চের সুরলিপিতে। নাট্যকার নির্দেশক গীতিকার সুরকারের যূথ-মানসমিলনে মঞ্চগানের ভিন্ন সংলাপ রচিত হলো মঞ্চের আলোয়।

নদীমাতৃক বাংলার জোয়ার-ভাটার টানে গড়ে ওঠে ‘ভাটিয়ালি’ গানের ধারা। মাঝিমাল্লার সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ আর ভক্তি-ভালোবাসার সরল সৌন্দর্যে মূর্ত হয়ে ওঠে সে-গান। একসময় কাজী নজরুল ইসলামের ভাটিয়ালি – ‘আমার গহীন জলের নদী’ বা ‘আমার এ নাও যাত্রী না লয়’তে মুখর হয়েছিল সাবেক বঙ্গরঙ্গ মঞ্চ। সে-পরম্পরায় স্বাধীনোত্তর মঞ্চে গানের ভিন্ন ব্যবহার মামুনুর রশীদের নাটক ওরা কদম আলিতে। নাট্যে বোবা কদমের লড়াই আপাতদৃষ্টিতে শিশু তাজুকে ঘিরে হলেও তা আসলে সমাজের এক যুদ্ধবিধ্বস্ত চেহারা। সে-যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। গায়েনের মঞ্চগানের ভাটিয়ালিতে তারই আভাস।

মাঝি চলরে উজান বাইয়া, মাঝি চলরে উজান বাইয়া …

হাঙ্গর কুমির পাশে ফিরে নর রক্তের লালা ঝরে

ও ভাই ‘ভয় করো না চালাও জোরে’ বাদাম দাও উড়াইয়া

মাঝি চলরে উজান বাইয়া।

স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যকাররা শিকড়সন্ধানী অভিলাষে মেলে ধরেছেন লোকজীবনের কাহিনি। দেশের নব্য-সামাজিক মূল্যবোধে নাট্যগভীরে গড়ে উঠেছে সমকালীনতা। লোকনাট্যের গীতিময় ভাষ্য সম্বল করে সৈয়দ শামসুল হক রচনা করলেন নুরলদীনের সারাজীবন। নাট্যকারের চেতনায় :

নুরলদীনের সারাজীবন-এ আমি পাশ্চাত্যের রক মিউজিক্যাল নাটকের গঠন কৌশলে আমাদের ময়মনসিংহ গীতিকার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছি …

ডিমলাতেহে আছে রাজা গৌরীমোহন চৌধুরী

কিষাণ কারিগরের গলায় মারিল তাই ছুরি।

স্বাধীন মঞ্চে তাঁর পরবর্তী কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়তে সৈয়দ শামসুল হক শোনালেন ‘রুদ্র সূর্যের উত্তাপ নিয়ে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার রণজয়ী’ আলেখ্য। নাট্যকার, কাব্যসংলাপ গেঁথেছেন গ্রামীণ জীবনের প্রকাশ, প্রতীক আর পরিবেশ ঘিরে। মঞ্চায়নের স্বার্থে নাট্যের ছান্দিক সৈয়দ শামসুল হক গানের সহায়তা নিয়েছেন আস্কার ইবনে শাইখের। নাট্যকারের কাব্যভাষ্যে পাঁচালির বনেদি বুনোটে পঞ্চগানের সেতু গড়লেন গীতিকার শাইখ – উল্টা বিধান কেন গোঁসাই

উল্টা বিধান কেন গোঁসাই

পারের কড়ি আমরা গুনি

মজা লোটে জগাই মাধাই

উল্টা বিধান কেন গোঁসাই।

ক্ষয়িষ্ণু সমাজজীবনে ভাসমান খড়কুটো-জনতার সতত সংলাপে রচিত হলো নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের মঞ্চনাট্য এখনও ক্রীতদাস। বস্তির আলো-আঁধারিতে নানাস্তর চরিত্রের নিত্য-খেউড়ে গড়ে ওঠে এ-নাট্যের প্রেক্ষাপট। নাট্যকারের নিরীক্ষায় –

নগরীর নিয়ন আলোর পাশাপাশি আছে বস্তির অন্ধকার। এখানে এক ভিন্ন জগৎ। এখানকার মানুষগুলো এক মানবেতর জীবনযাপন করে। অথচ সবারই একদিন ঘর ছিল, চাষের জমি ছিল, ছিল গ্রামের আর দশটা মানুষের মত বাঁচার অবলম্বনগুলো। কিন্তু আজ তারা ছিন্নমূল।

এমন পরিপার্শ্বে নাট্যকারের রচনায় বস্তি-ভূমে শোনা যায় মস্তানদলের কাওয়ালি গান। মঞ্চগানে নাট্যকারকে সহযোগ দেন আবদুল হাই আল হাদী –

আল্লা তোমার লীলাখেলা কে বুঝিতে পারে

কেউবা থাকে দালান কোঠায় কেউবা পথের ধারে।

ধনীর ঘরে জন্ম নিলে না চাহিতে সবই মিলে

আলালের ঘরের দুলাল আমরা কেন হইলাম না

রেললাইনের বস্তি পাইলাম আর তো কিছু পাইলাম না।

মইনুল আহসান সাবেরের উপন্যাস কেউ জানে না অবলম্বনে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন মঞ্চস্থ করলেন দ্যাশের মানুষ। নাট্যকারের বয়ানে –

উপন্যাসে সাবের অত্যন্ত কুশলী হাতে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অরাজক পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মারুফ নামের এক বীর বাঙালির পরিবারের চরম দুর্দশা ওই উপন্যাসের কাহিনীকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। মূলতঃ এই পরিবারটিকে কাঠামো হিসেবে ধরে নিয়ে ‘দ্যাশের মানুষ’ নাটকটির শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। … নাটকটির প্রেক্ষাপট প্রকৃত প্রস্তাবে ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিরাজমান স্বৈর-পরিস্থিতি। … যথাসময়ে মানুষ গর্জে ওঠে, স্বৈরশাসকের ভিত্তিমূলে প্রচ- আঘাত হানে এবং সাধারণ মানুষের বিজয়কে সমুন্নত করে।

ধ্বস্ত দ্যাশের মানুষের জাগরণের উদ্দেশে সুফি-দরবেশের সাথ-সংগতে গীত হয় মামুনের পঞ্চগান :

যায় যায় বাংগালীর ভাগ্য চইলা যায়

আইজ-ও যায় – কাইল-ও যায়

ভাসানী মাওলানার সফেদ পাঞ্জাবী যায়

আসাদের শার্ট যায়

ফেব্রম্নয়ারীর একুশ যায়

মার্চের ছাবিবশ যায়।

ইতালির কবি ওভিদ ‘মেটামরফোসিস’ কাব্যে যে পৌরাণিক রূপান্তরের কথা বলেছেন, তাকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন নাট্যকার সেলিম আল দীন কিত্তনখোলা মঞ্চনাট্যে। টাঙ্গাইল জেলার একাংশ আর যমুনার পূর্বতীরস্থ বিস্তীর্ণ ভূখ- নাট্যের পটভূমি। নাট্যকারের জবানিতে :

যমুনা ও বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে ধ্বংস ও সৃষ্টির যে লীলা নাটকের যথার্থ আঙ্গিক তো সেখানে। রৌদ্রে নুনে রক্তে ঘামে সে জীবন হয়ে ওঠে আমাদের নাট্যবস্ত্ত।

তালুকনগরের সাধক শিল্পী আজহার বয়াতির আদলেই নাট্যকার গড়ে তোলেন এই নাট্যের প্রধান চরিত্র মনাই বয়াতিকে। মনাইয়ের ভনিতায় মঞ্চগানের রূপ নেয় আজহার বয়াতির রচনা :

আমি কোন সাধনে পাব রে তোরে

আমার মনের মানুষ রতন। …

মনাই কয় দিন বয়ে যায়

দেও মোরে চরণ।

মধ্যযুগের বাংলার নাট্য-আঙ্গিক আর মঙ্গলকাব্যের উপাখ্যানের মেলবন্ধনে সেলিম আল দীন রচনা করেন মঞ্চনাট্য কেরামত মঙ্গল। মানুষের মঙ্গল কামনায় বিশ্ববিধাতার জয়গান ঘিরে মঙ্গলকাব্যের উন্মেষ। নাট্যের নামচরিত্র কেরামতের আরাধ্য আদমসুরত। কেরামতকে পথের নিশানা দেয় আদমসুরত। নির্যাতিত পশুসমাজের আধুনিক আর্ত-নিবেদন এই মঞ্চনাট্যের আধার। গ্রামীণ জীবনের ঘেরাটোপে মঞ্চে ঠাঁই নেয় পাবনার প্রচলিত আঞ্চলিক গান :

আনন্দ আনো সুন্দরী তার নাকে নড়ে সুনা, তৈলত ভাজিয়া তুলে শাল শৈলের পোনা।

শুধু মৌলিক কাহিনিতেই নয়, অনুবাদ-নাট্যেও মিলল দেশজ লোকগানের সহযোগ। ধর্মীয় ফরমানে –

যিনিই বিধর্মীর সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে স্বকর্ম প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই গাজি।

তাই ধর্মপ্রচারকদের মাহাত্ম্য বন্দনায় আর পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনায় রচিত হয় গাজির গান :

জীবনের দুঃখ দেইখা খোদার আর সয় না তর,

কলির শ্যাষে জন্ম নিল গাজি পীর পয়গম্বর।

এমনই গাজির গানের সংযোজন হলো বিশ শতকের শেষ দশকের মঞ্চনাটক দর্পণে। আলী যাকেরের রূপান্তরে স্বাধীন বাংলাদেশে শেক্সপিয়রের হ্যামলেট অবলম্বনে মঞ্চস্থ হলো এ-নাট্য। রূপান্তরীর দাবি :

এ দর্পণ মানবমনের। এ যেন কবি Coleridge-এরই কথা ‘It is we who are Hamlet’।

কাহিনির অমিত্মম পর্বে নাট্য-মধ্য-নাট্যে মূল-অনুসারী মৃত্যুদৃশ্যের মূকাভিনয়ের রূপান্তরে নতুন সুরের ভাষ্য মিলল বদলি-মঞ্চগানে। দেশের সমতায় পরিবেশ-পরিস্থিতির আখ্যান-ব্যাখ্যায় সঙ্গী হলো লোকায়ত গাজির গান :

হারে পরথমে বন্দনা করি আল্লাহ্ নিরঞ্জনে

তারপরে বন্দনা করি দয়াল ভগবানে।

তারপরে বন্দনা করি ওস্তাদের চরণ

কাহিনী এক রোমাঞ্চকর করিব বর্ণন।

আজকে গানে বলবো যে এক সত্য করুণ কাহিনী

চোরের দশদিন সাউধের একদিন এই কথা সবাই জানি।

রুশ নাট্যকার নিকোলাই গোগোলের দ্য গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর সোলায়মানের রূপান্তরে হলো ইন্সপেক্টর জেনারেল। দেশভেদে আপনভূমের প্রেক্ষাপটে প্রকাশ পেল সরকারি আমলাবাজির নগ্ন চেহারা। সঙ্গী মঞ্চগানে তির্যক ব্যঙ্গ। ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে’-র ছাঁচে সোলায়মানের রচনা :

আল্লাহ হিম্মত দে সাহস দে

ত্যাল মারিতে।

জায়গা মত মারতে পারলে

খাঁটি সরষার ত্যাল

হাজার চুরি করার পরেও

খাটতে হয় না জ্যাল।

বলরাম প–তের নাট্য-অবলম্বনে সৈয়দ জামিল আহমেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে সোলায়মানের রূপান্তর তালপাতার সেপাই। এই মঞ্চনাট্যের গানে সোলায়মান বাউল-ফকিরির যুগলবন্দিতে রচনা করলেন মানবজীবনের
অমিত্মমগাথার মর্মবাণী :

আমি তীর্থে যাব, তীর্থে যাব

সোঁদা মাটির গন্ধ লব।

আমি করব সিনান নিমের জলে

চন্দন মেঘ মোর কপোলে

আমি সেজেগুজে উঠব খাটে

চলব পথে বরের বেশে।

মঞ্চায়নের পূর্ণাবয়ব নয়। লোক-পরম্পরায় ছড়ানো-ছিটানো কিছু মঞ্চগানের নির্মাণ-সম্ভারে স্বাধীন দেশের বহমানতায় শুধু ‘পাবলিক এন্টারটেইনমেন্ট’ নয়, বাঙালি জীবনের এ এক সুলুক-সন্ধান-শিকড় অন্বেষণ।