শব্দযান

ফড়িং-ঘাসফড়িংয়েরা মরে যাওয়ার পর একটু একটু করে শুকোতে শুকোতে, শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে চিমসে, শুকনো খড় যেন, এমন চেহারা পেতে পেতে হয়ে যায় বিচালির টুকরো। বাঙালরা – দেশভাগের সময়, আগে-পরে পূর্ববঙ্গ থেকে খ্যাদা খেয়ে এপারে – পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় চলে আসা মানুষেরা, যাঁরা – সেইসব পূর্ববঙ্গীয় মানুষদের বেশিরভাগই তো হিন্দু নয়তো বৌদ্ধ – খুব সামান্য হলেও তাঁদের মধ্যে খ্রিস্টান আছেন, তাঁরা চিমসে না বলে উচ্চারণ করেন ‘চামসি’। ‘চিমসে মেরে যাওয়ার’ বদলে ‘চামসি মেরে যাওয়া।’

সুধীর মজুমদার তাঁর সদ্য আশি পেরোন স্মৃতি-বিস্মৃতি, স্মৃতিময়তা, বিস্মরণবেলার তরঙ্গ নিয়ে মাঝে মাঝেই আবিষ্কার করেন কিছু লুপ্ত, প্রায়-হারিয়ে-যাওয়া শব্দাবলি – যেমন তাঁর দাদামশাই দেবরঞ্জন সেন, তিনি গেঞ্জি উচ্চারণ করতেন ‘গঞ্জি’, পায়স-পায়েস – পরমান্নকে বলতেন ‘মিষ্টান্ন’। তাঁর নিত্য নেশা আয়োজনের তামাকপাতা ভাজা, যা কিনা সুধীর মজুমদার – এস মজুমদারের গর্ভধারিণী, দেবরঞ্জনের সাতটি কন্যার মধ্যে তৃতীয়া শিবানী তৈরি করে দিতেন কাঠখোলার নিভু আঁচে। সাত কন্যা, তিন পুত্রের গর্বিত পিতা দেবরঞ্জন। তো শিবানী তামাকপাতা পাড়ার মুদিদোকান থেকে আনিয়ে লোহার চাটুর ওপর শুকনো খোলায় নেড়ে নেড়ে, ভেজে তার সঙ্গে সামান্য ধনের চাল আর মৌরি ভেজে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিতেন। এটাই নেশার অন্যতম উপকরণ দেবরঞ্জনের। সেই শুকনো তামাকপাতাকে দেবরঞ্জন বলতেন ‘শাদা পাতা’। অথচ শুকোনো তামাক পাতা শাদা রঙের নয়, সবুজ রং শুকিয়ে গেলে যেমন হয়, তেমনই কোনো রংধর, পাশাপাশি নিপাট কালো বর্ণেরও পাতা থাকত – কিন্তু দেবরঞ্জনের কাছে সব পাতাই ‘শাদা পাতা’।

এরকম কত কত শব্দ, কথা, বাক্যাবলি, ছড়া, ছিকুলি, পরণকথা-লোককথা – সব একেবারে হারিয়ে মুছে গেল মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যে।

ভিডা-মাডি – হগগল ছাইড়া আইসি, শুধু ভাষাখান জিভ্ভার লগে বসাইয়া আনসি। হেইডা সাড়ুম ক্যান? এমনটা বলতে বলতে যে-কোনো পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু-বৌদ্ধ বাঙালি, তা তিনি ঢাকা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল – অখ- বঙ্গের পূর্বভাগের যে-কোনো প্রামেত্মরই হতে পারেন, তিনি হতে পারেন দেবরঞ্জন সেনও, কিংবা দেবরঞ্জন সেন না হয়ে অন্য কোনো নামধারী কেউ, তাঁর একদা বাড়ি – দ্যাশের বাড়ি শ্রীহট্ট, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, পাবনাও হতে পারে, সেখানে – সেই উচ্চারণ মহিমায় এমন একটা ‘প্রাইড’ – গর্বের জায়গা ছিল।

এই সন্ধ্যা নেমে আসা ধোঁয়াটে অন্ধকারের মধ্যে, যখন ভাদ্র মাসের গরম ও চকিত-আকাশি মেঘ-বৃষ্টি চরাচরকে খানিকটা কর্দমাকার করে তুলতে চাইছে, তখন সাইকেল-রিকশার ভেতর নিজের সাতচল্লিশছোঁয়া স্কুল মাস্টারপুত্র রাহুলের দিকে তাকিয়ে সুধীর মজুমদারের মনে হলো, রাহুলের ধড়ে তার মুণ্ড‍ুটি বসানো নেই। সাঁঝবেলার অতি ছায়াতিপাত, ভ্যাপসা গুমোট, সেই সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পৃথিবী ক্রমশ ক্রমশ – একটু একটু করে ভসভসে প্রেশার কুকার হয়ে ওঠা, তারই ভেতর সাইকেল-রিকশার নিজস্ব গতিময়তায় গতিময় পুলকিত দেবরঞ্জন মনে করতে চাইলেন রাজশাহী থেকে তাদের পূর্বপুরুষের নদীয়ার নবদ্বীপ ধামে আসার স্মৃতি। ১৮৯৯ নাগাদ তাঁরা – মজুমদারদের একটা
ধারা-বংশস্রোত পাবনা থেকে রাজশাহী চলে এসেছিলেন। তারপর ১৯২২-২৩ নাগাদ রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে নবদ্বীপ।

আমরা তো ১৯২২-২৩ নাগাদই মাইগ্রেট করলাম মুর্শিদাবাদ থেকে? এই আলোহীন সন্ধ্যা যাপনে মুণ্ড‍ুবিহীন নিজের আত্মজকে প্রশ্নটা করতে চাইলেন সুধীর মজুমদার।

রাহুল জানে এরপর তার বাবা একই প্রশ্ন – একদম ছকবাঁধা – গতের কথায় পরপর পরপর বলে যাবে। আর সেইসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই তার উত্তরও হবে গতের। বাঁধাধরা।

সুধীর মজুমদার মায়া মজুমদারের তিনটি সমন্তান। দুটি পুত্র, একটি কন্যা। সবার বড় কন্যা সংঘমিত্রা, তারপর তথাগত, সবশেষে রাহুল।

সাতচল্লিশ স্পর্শ করা রাহুল মজুমদার জানে বাবা এখন ব্রহ্মপুর গোষ্ঠতলার মোড়ে নেমে সন্ধ্যা কুটির, শিবির, আলোছায়া, বিশ্রাম – এইসব নামের দোতলা, তিনতলা বাড়িদের খুঁজবে। আর খানিকক্ষণ  খোঁজার পর সেইসব নামের বাড়িদের কাউকেই না পেয়ে হতাশ হয়ে আবারো দাঁড় করান বেতুলের সাইকেল-রিকশায় উঠে অত্যন্ত বিরক্তি খোঁচান কণ্ঠেই বলবে, এবার বাড়ি চল!

রাহুল জানে সুধীর মজুমদার যতটা উৎসাহ নিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন বন্ধুদের বাড়ি খুঁজে নেবেন, আবিষ্কার করবেন বলে, ফেরার পথে – আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফিরে যাওয়ার সময়ে সেই বিপুল উদ্দীপনার গরম কড়াইয়ে কেউ যেন এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছে। বেতুল রিকশা টানার জন্য প্যাডেলে চাপ দিতে থাকলে ফিরতি পথে রাহুলের মনে পড়ে রাজশাহী থেকে মজুমদারদের মূল পস্নট থেকে একটা সাবপস্নট চলে এসেছিল নবদ্বীপ। সেখানে জমি কিনে ঘরবাড়ি,
চাষ-আবাদ। সুধীর মজুমদারের থেকে আট বছরের ছোটভাই অধীর মজুমদার রাজশাহীর মজুমদারদের একটা শাখার শেষ পর্যন্ত নবদ্বীপে চলে আসাকে আসলে গঙ্গাকূলে থাকার বাসনা, পাশাপাশি গঙ্গাহীন দেশে শেষ পর্যন্ত না থাকার ইচ্ছাকেই প্রধান কারণ বলে বলে থাকেন।

আমি তো এসব লিখেওছি দাদা, আমার বইয়ে। আপনি পড়েননি?

রাহুল জানে তার বাবার থেকে পাক্কা আট বছরের ছোট এই কাকাটি রাজশাহীর মজুমদারদের নবদ্বীপ চলে আসা নিয়ে যে শ দুয়েক পাতার কেতাবখানি ফেঁদেছেন, তাতে এসব তথ্য খুব ভালো করেই আছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর মজুমদারদের বংশলেখ, কুলুজি, বংশপঞ্জিও।অধীর মজুমদার ছিলেন স্কুলটিচার, বাংলার শিক্ষক।
অবরে-সবরে সাহিত্যচর্চার অভ্যাস তাঁর ছিল। প্রথমে কবিতা, গল্প। শেষ পর্যন্ত স্থানিক ইতিহাস – নবদ্বীপ চর্চা।মজুমদাররা দীক্ষা নিয়েছিলেন বৈষ্ণবমন্ত্রে। প্রথমে রামমন্ত্র, পরে
কৃষ্ণমন্ত্র। সেও তো এক অতিদীর্ঘ ইতিবৃত্ত।

অধীর মজুমদার এখনো এই বাহাত্তর-তিয়াত্তর বছর বয়সে বেশ খটখটে। রোগা-সোগা মানুষটি এখনো দিব্যি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট – বাস-ট্রাম-মিনিবাসে যাওয়া-আসায় অভ্যস্ত। রাহুলের মনে পড়ল, সুধীর মজুমদারের ফ্ল্যাটের কাছেই তাঁর দোতলা বড় বাড়ি। কাকিমাও স্কুলশিক্ষয়িত্রী ছিলেন। অধীর মজুমদারের রাজশাহী থেকে নবদ্বীপ –   নেপথ্যকথা – এই গ্রন্থটিতে রাজশাহীর মজুমদারদের নবদ্বীপ চলে আসা, জমি কেনা, নতুন বসত – মজুমদারপাড়া তৈরি করা – সব কথা আছে। সেইসঙ্গে গঙ্গার গতিমুখ – স্রোত পরিবর্তনে সমস্ত মজুমদারপাড়ারই গঙ্গাগর্ভে চলে যাওয়া – এই ইতিবৃত্ত রয়েছে। রাহুল জানে, পুরনো বন্ধুদের বাড়ি খুঁজতে – আবিষ্কার করতে বেরিয়ে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই তার বাবা সুধীর মজুমদার একই কথার নতুন নতুন আলাপ-বর্ণনা করা হচ্ছে, এভাবেই নবদ্বীপ, গঙ্গার ভাঙন, মজুমদারপাড়া, বৈষ্ণবমন্ত্রী গোঁসাইজি, দোল-রাস উৎসব, আবার কোনো কোনো দিন রাজশাহী, পাবনা, মুর্শিদাবাদ হয়ে নবদ্বীপ – এই ধারাবাহিকতার মধ্যে রেখে দেন তাঁর কথাযাত্রাকে।

ডক্টর নাগ তো বলেই দিয়েছেন, দেখুন রাহুলবাবু, আপনার বাবার সেই অর্থে – অ্যাজ সাচ কোনো বড় অসুখই নেই। এই বয়সে যতটা সুস্থ থাকা দরকার, তার চেয়ে অনেকটাই বেশি তিনি সুস্থ। প্রেশারটা সামান্য লো-এর দিকে, তা নিয়ে চিমন্তার তেমন কোনো কারণ নেই। কিন্তু মূল যেটা প্রবলেম উনি তো সেভাবে কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। একটু আগেকার ঘটনাই –

অথচ পাস্ট, মানে অতীত মাঝে মাঝেই গড়গড় গড়গড় করে বলে যান। একে কি ডিমেনশিয়া, স্মৃতিভ্রংশ হওয়া, ভীমরতি বা ভীমরথি, যা বয়সকালে একটু বেশি বয়সে হয়, ইদানীং তো নতুন নতুন জীবনদায়ী ওষুধ – লাইফ সেভিং ড্রাগ আবিষ্কারের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেশ অনেকটাই বেড়ে গেছে। শেষের বাক্যবন্ধটুকু মনে-মনে – নিজেরই মনের ভেতর গড়গড় করে – গড়গড়িয়ে বলতে বলতে ডক্টর নাগের মুখের দিকে একবার তাকাল রাহুল।

এসি চেম্বারে শাদা ফুলপ্যান্ট শাদা ফুলশার্ট পরা বছর-চুয়ান্নর ডা. নীলিমেষ নাগ তাঁর মাথার পাতলা হয়ে আসা চুলে ডান হাতের আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে নিজের পিঠটাকে আরামচেয়ারে একটু সোজা করে নিতে নিতে বললেন, এই অসুখের অ্যাজ সাচ তো কোনো মেডিসিন নেই। বিদেশেও রিসার্চ চলেছে এই রোগের ওষুধ বার করবার জন্য। ব্যাপক গবেষণা –

তবে কি আলঝাইমার? সুধীর মজুমদার কি বিস্মরণ-বিভ্রান্তির মধ্যে ঢুকে পড়লেন? নিজের ভেতর এসব জিজ্ঞাসা ফাগুন-চৈত্রের দিশি সজনে ডাঁটা চিবনোর কায়দায় চিবিয়ে নিতে নিতে রাহুল মজুমদার ডা. নীলিমেষ নাগের ক্লিন শেভেন ফরসা, রক্তিমাভ গালের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

কয়েকটা ওষুধ পালটে দিলাম। ভিটামিনটা এসওএস। দেখবেন উনি যেন কোনোভাবেই একা একা বাইরে না বেরোন।

ডা. নাগের সুভাষিতাবলি শুনতে শুনতে রাহুল মজুমদারের মনে পড়ল বছরখানেক আগেও তো বটতলা বাজার থেকে নিয়মিত     মাছ-তরকারি বাজার করে আনতেন বাবা। সেই সঙ্গে সঙ্গে মুদিখানার অল্পস্বল্প মাল।

রাহুল সুস্মিতা আর পিউকে নিয়ে পাশেই বড়, নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে যাওয়ার পর, তাও সে তো এগারোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছে বছরচারেক আগে, পিউ বড় হচ্ছে, সুস্মিতাও তাড়া দিচ্ছে – এই ঘুপচি ফ্ল্যাট ছেড়ে বড়সড় কোনো স্পেসে চলে যেতে। ফলে রাহুল-সুস্মিতা-পিউদের এই নতুন ফ্ল্যাটযাত্রা। দুজনে যখন ভালো চাকরি করে, তখন ফ্ল্যাটের লোন-কিস্তি  ইএমআই শোধ করা কোনো ব্যাপারই নয়। আর কম বয়সে রিস্ক তো নেওয়াই যায়, সুস্মিতার যুক্তি এরকমই ছিল। তো সে যাই হোক, নিজেদের ফ্ল্যাট থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে রাহুল-সুস্মিতাদের আবাসন। ফলে সেখানে প্রায় রোজই সুধীর মজুমদার-মায়া মজুমদার। মা-বাবার এই রেগুলার ভিজিট, সবচেয়ে পছন্দ পিউর। কিন্তু হঠাৎই যে কী হলো বাবার! বাড়ি থেকে – ঘরের কোণ থেকে কিছুতেই তাকে টেনে বের করানো যাচ্ছে না। যে-বাবা – রাহুল দেখেছে তার বাবা বাজারে যাওয়া বলতে একরকম পাগল ছিল, মাছ-তরকারি – সবই একটু যেন বেশি বেশি কিনে আনা। সেই বাজারেও আর যেতে চাইছেন না বাবা। বরং বাজারে যেতে বললে বেশ বিরক্তই হচ্ছেন।

সুধীর মজুমদারের নিত্যবাজারের পরিমাণ, পরিমাপ দেখে রাগ করেন মায়া মজুমদার। তাঁর কথায় – মোটে দুজন বয়স্ক লোক! অ্যাত অ্যাত কে খাবে! অনর্থক টাকা খরচ। নষ্ট হবে জিনিসপত্র। সবজি-মাছ তো শুধু বাজার থেকে কিনে বয়ে আনলেই হবে না, সেসব তো ধুয়ে, কেটে, গুছিয়ে রাখতে হবে ফ্রিজে। কাজের লোক আছে তিনজন, দুজন অতিবয়স্ক মানুষের তিনজন কর্মসহায়িকা, এটা একটু বেশি বেশিই – বেশ বাড়াবাড়িই তো মনে হয় রাহুলের কাছে। কিন্তু মা-বাবার যুক্তি – রাতে গরম গরম খাবার পাওয়া যায়। সকালে রান্না করা খাবার গরম করার ঝামেলা নেই। সঙ্গে গরমা গরম চা।

একটা মাইক্রোআভেন কিনে নিলেই তো হয়। রাতের খাবার – ডিনারের জিনিস গরম করা ইজি হবে। সেইসঙ্গে অতগুলো করে ফালতু টাকা, মাস গেলে হাজার -। সকালের রান্না যিনি করেন, তিনি এগারোশো, যিনি বাসন মাজেন, কাপড় কাচেন, ঘর মোছেন তিনি হাজার – আবার রাতের কর্মসহায়িকা, তিনিও এক হাজার, সব মিলিয়ে তিন হাজার একশ। এই টাকাটা ব্যাংকে রাখলে তো থাকত, অন্তত রাতে যিনি রুটি-তরকারি করেন, দুধ গরম করে দেন, চা করেন বারদুই, তাঁর টাকাটা তো বাঁচান যেত অনায়াসেই। মনে মনে হিসাব করে সুস্মিতা। কিন্তু মায়া মজুমদারকে কে বোঝাবে? সেইসঙ্গে পুরোপুরি নয় কোনোভাবেই, আপাতভাবে
মায়া-সমর্থক সুধীর মজুমদার নিজের ভেতরে ভেতরে অন্যরকম কথা বললেও, বাইরে আর-এক রকম বলতে থাকেন। কারণ তাঁর এই দীর্ঘ আয়ুযাপনের মধ্যে সুধীর মজুমদার টের পেয়ে গেছেন – বুঝতে পেরেছেন পারিবারিক-রাজনীতি, পাড়া-রাজনীতি, ক্লাব-পলিটিক্স, রাজ্য ও কেন্দ্রের রাজনৈতিক সমীকরণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি – সবই এক ধরনের, একই সুরে বাঁধা। ফলে দুজনের সংসারে আপাতভাবে শান্তি নামের শহিদস্তম্ভটি ঠিকঠাক বজায় রাখার জন্য মায়া মজুমদারের হ্যাঁ-তে তাঁকেও হ্যাঁ বলতে হচ্ছে। যদিও এস মজুমদার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংসারে দুবেলা রান্নার জন্য দুটি আলাদা আলাদা গৃহকর্ম সহায়িকা ও বাসনমাজা, ঘরমোছা, কাপড়কাচার জন্য সম্পূর্ণ অন্য একজন – পুরোটাই মায়া মজুমদারের বাড়াবাড়ি। অকারণ। অকারণ এই অতিরিক্তর অতিরিক্ত গৃহকর্ম সহায়িকা। কোনোভাবেই যার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু অনেক সময়ই বহু কথা ঢোক চিপে গিলে নিয়ে পরিপূর্ণভাবে হজম করে নিতে হয়। কারণ সেই রাজনৈতিক সমঝোতা, বিরোধ, দূরত্ব ও নৈকট্যের যে চিরকালীন ছবি রামায়ণ-মহাভারতের যুগ থেকে, তাকেই তো এ-কালের পটভূমিতে গ্রহণ করা, এটুকুই মাত্র।

সন্ধ্যাকালীন অন্ধকার লেপনের মধ্যে, সন্ধ্যাকালীন না বলে কি তাকে সান্দ্র-সান্ধ্য অন্ধকারের লিপিমালা বলা যায়? মনে মনে এমন নানা যোগ-বিয়োগ, গুণভাগ করে নিতে থাকে রাহুল – রাহুল মজুমদার।

বাবার এই রোগ  অসুখ তো একেবারে – সম্পূর্ণতই বার্ধক্যজনিত। অন্তত ডা. নীলিমেষ নাগ তো তেমনই বলেন। বয়সকালীন ডিমেনশিয়া – একটু একটু করে ক্ষয়ে, ছোট হতে হতে চুপসে যাওয়া ব্রেন সেলেরা – সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক। সিটি স্ক্যানে ধরা না পড়লে এখন এমআরআই করাতে হয়। আলঝাইমার ডিমেনশিয়া – বেভ্ভুল-বিভ্রম অসুখ, নাকি রক্তে সোডিয়াম-পটাশিয়াম আচমকাই অনেকটা কমে যাওয়া। রক্তে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের গোলমাল, ডাক্তারি হিসাব অনুযায়ী আগু-পিছু হলে বিষাদ আসে। সোডিয়াম কমে গেলে নুন খেতে হবে ভাতের সঙ্গে, ভাতে মেখে, সুধীর মজুমদারের লো প্রেশার, সুতরাং আপাতভাবে ভাতপাতে কাঁচা নুনে ডাক্তারের কোনো আপত্তি নেই। রক্তে সোডিয়াম উন্নতির জন্যে লবণ। পটাশিয়াম স্বাভাবিক করার জন্য ডাবের জল, মুসম্বি। রাহুল এসব জানে, জেনে গেছে ইন্টারনেট-অনুসরণ করে, গুগল সার্চে, সেইসঙ্গে ডা. নীলিমেষ নাগ তো আছেনই।

ইদানীং, বেশ কয়েক বছর হলো রাহুল লক্ষ করেছে সেই অর্থে কোনো ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আর হয় না। ডাক্তারকে দিনে রাতে – যখনই কল দাও বাড়িতে কল দিলে ডাক্তারবাবুরা আসতে চান না। তাঁরা বেশিরভাগই হাসপাতাল নামের বড় বড় নার্সিং হোমে চেম্বার করেন। রোগীর সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম সূত্রে। আসলে চিকিৎসাবিদ্যা ডাক্তারি যে পেশা হিসেবে খানিকটা সেবামূলক, সেটাই হয়তো – সেই ধারণাই ইদানীং ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

আগেকার দিনে আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও একটু সম্পন্ন আধাসম্পন্ন – সমৃদ্ধিময় পরিবারে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান প্রায় অবধারিত। জন্ম থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত জীবনে এইসব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান অবশ্যম্ভাবী। বিশ্বাস, নির্ভরতা ও গর্বের সঙ্গে এটাও উচ্চারিত হতো বেশ জোরের সঙ্গেই, ডক্টর অমুক আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান – পারিবারিক চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কও পারিবারিক। পেশেন্ট তখনো পেশেন্ট পার্টি হয়ে ওঠেননি। কেউ কেউ তো এমন বিশ্বাসে ভর করে বাঁচতেন, অমুকের অমুক ডাক্তারের হাত-ধোয়া-জল খেলে রোগী ভালো হয়ে যাবে, তা সে যত কঠিন আর গোলমেলে অসুখই হোক না কেন!

যথেষ্ট বয়স্ক পেশেন্টের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও খুব মন দিয়ে অংশ নিতেন বেশিরভাগ ডাক্তারবাবু। পরে নিয়মভঙ্গ – মৎস্যমুখীতেও। এটা তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ছিল। সুধীর মজুমদার এইসব সাত-পাঁচ নিয়ে খুবই ভাবেন। সেইসঙ্গে ভাষার ব্যবহার আর প্রয়োগও, তাঁর মাথার মধ্যে খেলা করতে থাকে। ডাক্তারবাবু, আপনার হাতধোয়া-জল খেলেও অসুখ ভালো হয়ে যাবে, এই যে বাক্যবন্ধটি, তা তো বহু বছরই শোনা যায় না। কারণ কম্পাউন্ডার যুগ শেষ হওয়ার পর মিকশ্চার-পুরিয়া ইত্যাদির দিন, কাচের তৈরি ওষুধের শিশির গায়ে গঁদের আঠায় সাঁটা শাদা কাগজের দাগ মেপে লালচে, সবুজ সবুজ ওষুধ খাওয়া – খাওয়ানোর কালখ- শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তো ‘ডাক্তারবাবুর হাতধোয়া-জল’ – এই বাক্যবন্ধটি ছিল। কিন্তু তা ক্রমে উধাও হতে হতে একেবারে নিরুদ্দেশে – যাকে বলে ভ্যানিশ! এক্কেবারে ভ্যানিশ!

এই যে, পাবনা থেকে রাজশাহী – মজুমদারদের বংশধারার একটি ধারার চলে আসা, তারপর রাজশাহী থেকে মুর্শিদাবাদ। আর মুর্শিদাবাদের পর নদে জেলার নবদ্বীপ। সেখানে গঙ্গাকূলে একটু একটু করে গড়ে তোলা মজুমদারপাড়া, কৃষ্ণমন্ত্রী, বিষ্ণুমন্ত্রী বৈষ্ণব-গোঁসাইজিরা – মোহান্তমহারাজ, তাঁদের গড়ে তোলা পাট, শ্রীপাট, পাটবাড়ি – তারপর একসময় গঙ্গাভাঙনে সবই নদীগর্ভে, সলিল গ্রাসে। পাকাবাড়ি, দালানকোঠা, মন্দির, অন্য অন্য দেবস্থান, শ্রীপাট, পাটবাড়ি, চাষের জমি, ফুলের বাগান, পাঠশালা, চতুরষ্পাঠী, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা – সবই সুরধনীর গেরুয়া-সর্বগ্রাসী ঘোলা জলের তরঙ্গ-দোলায় দুলতে দুলতে দুলতে একসময় কিছু স্মৃতি বুদ্বুদ মাত্র। এভাবেই তো একদা সমৃদ্ধ জনপদ, ফসলের ক্ষক্ষতের ওপর দিয়ে নদী বয়ে যায়।

যেমন কি না বেতুলের সাইকেল-রিকশার গড়িয়ে যাওয়া চাকার লৌহ শলাকায় – লোহার কাঠিতে স্পোকে দিনাবসানের প্রথম সান্ধ্য অন্ধকার জড়িয়ে নিতে নিতে সন্ধ্যাকুটির, শিবির, আলোছায়া, বিশ্রাম – এইসব বাড়ি, দোতলা, তিনতলা, একতলা বাড়িরা – সবাই তো নিরুদ্দেশে। পুরনো গৃহসজ্জা ভেঙে ভেঙে
আকাশ-খাবলান হাঁই হাঁই খিদেঅলা হাইরাইজ উঠছে, উঠে যাচ্ছে পরপর।

অমুক টাওয়ার, তমুক টাওয়ার, তুসুক হাউজিং এস্টেট। পাড়া – বলতে গেলে পাড়া কালচার প্রায় পুরোটাই উঠে গিয়ে  ফ্ল্যাটসংস্কৃতি, বস্নকসংস্কৃতি। সুধীর মজুমদার সেই স্মৃতি তো মনেও করতে পারলেন না, নাকি পারলেন, নবদ্বীপের মজুমদারপাড়ার পাশের পাড়া, ভট্টাচার্যপাড়ায় – মুখে মুখে যা ভচ্চাজ্জিপাড়া, সেখানে সাত পুরুষের বসবাসী স্নেহাকর ভট্টাচার্য ব্রহ্মপুর গোষ্ঠতলায় তাঁর বাবার তৈরি করান গোধূলিবেলা নামের তিনতলা বাড়িটিতে থাকতেন। ব্যাংক-চাকুরে স্নেহাকরের বড়ভাই স্নেহশীল, ছোটভাই স্নেহময়। তিন ভাইয়ের মধ্যে স্নেহাকর মেজো। ওদের দুই বোন স্নেহশীলা আর স্নেহলতা। তার মধ্যে অতি গৌরবর্ণা, খয়েরি বেণি, সামান্য নীলাভ চোখের প্রকৃত সুন্দরী স্নেহলতাকে মনে মনে বহু বছর আকাঙক্ষা করেছেন সুধীর। কিন্তু বাস্তব তো সুধীর মজুমদারকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিক্ষা দিয়েছে। এসব কথা ভাবলে এখনো কোনো ফসিল হয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস তাঁকে তাড়িত করে।

স্নেহাকরদের বাবা শুদ্ধশীল ভট্টাচার্য, মা চন্দ্রকলা। শুদ্ধশীল ছিলেন সংস্কৃত-প–ত, সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি ব্যাকরণ তাঁর কণ্ঠস্থ। বাংলা ব্যাকরণের সন্ধি, সমাস, প্রত্যয় – কৃৎপ্রত্যয়, তদ্ধিত প্রত্যয়, পাণিনি ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাইয়ের নানা ব্যাকরণ সূত্র – সবই তাঁর হাতের হরীতকী, এই হাতের হরীতকী শব্দটি স্তাধৃত আমলকী – করতলে রাখা আমলা এই শব্দবন্ধটির বদলে কেমন চমৎকার ব্যবহার করলেন সুধীর মজুমদার আর করে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালেন, সাবাশী দিলেন নিজেকেই।

গোধূলিবেলা-র সন্ধানে একদিন রাহুলকে নিয়ে সন্ধ্যার খানিক আগে আগে বেতুলের পা-প্যাডেলে চলা রিকশায় বেরিয়েছিলেন সুধীর। বেতুল সুধীরের এই বাড়ি-খোঁজার স্বভাব খুব ভালো করেই জানে।

গরমের শেষ বিকেল।

শ্রাবণের আকাশ মেঘাম্বরী হয়ে চুপচাপ ঘাপটি মেরে আছে।

কোথাও অ্যাতটুকুন বাতাস নেই।

সুধীরকে নিজের সাইকেল-রিকশায় চাপিয়ে বেতুল বেশ আস্তে-ধীরেই প্যাডেল করছে। আজকাল – বেশ কয়েক বছরই হয়ে গেল সাইকেল-রিকশার সিট বেশ সংকীর্ণ। দুজন মানুষ পাশাপাশি বসে যাওয়া-আসা করাই তো বেশ শক্ত ব্যাপার। তারপর যদি তারা সামান্য স্বাস্থ্যবান-পৃথুল – সাধারণ জনমুখে যা মোটা, মোটাসোটা বা মোটাগাটা, তাই যদি হয়, তাহলে তো একেবারে যাকে বলে সর্বনাশের মাথায় পা, নয়তো সর্বনাশের মাথায় বাড়ি – এই যে দুটি বাক্যবন্ধ – ‘সর্বনাশের মাথায় পা’ অথবা ‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি’, তা আজকাল আর কেউ তেমনভাবে ব্যবহারই করে না। কেন করে না? চারপাশটা কি অ্যাত তাড়াতাড়ি – অতি দ্রম্নত বদলে গেল?

সুধীর মজুমদার প্রায়ই মনে মনে তাঁর দ্যাশের প্রায় বিলুপ্ত ভাষা টিয়াপাখিটি, নয়তো ময়না হয়ে বারে বারে উচ্চারণ করতে থাকেন মনের মধ্যে।

আকাশ লাইথ্যাইনা কথা

আগুরি আগুরি কথা

ছন চোর – ইত্যাদি প্রভৃতি।

আকাশ লাইথ্যাইনা কথা কইস না অর্থে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলিস না। আগুরি আগুরি কথা বলতে অশুভ কথা বলা, ছন চোর – মানে শণ চোর। পাট যেমন, তেমনই শণের চাষ হতো অখ- ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গে। সেই শণ থেকে দড়ি, খুব শক্ত রশি – ঘাটে নৌকো বাঁধার জন্য, এমনকি ফাঁসির দড়িও নাকি তৈরি হতো শণেরই, অনেক পরে মোম-মাখান ম্যানিলা রোপ – এইসব তথ্যভাণ্ডার সুধীর মজুমদারের অর্জন – খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেল থেকে, নৌকো রাখার ঘাট কথাটি মনে হলেই পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কথা মনে পড়ে যায় সুধীরের। পাশাপাশি ‘আমার ঘাট হয়েছে বাপু’, ‘ঘাট মানছি’ – এই ধরনের শব্দচাতুরী, যা কিনা প্রবাদবাক্য হিসেবে যথেষ্ট প্রচলিত অখ-বঙ্গের পূর্বভাগে নয়, পশ্চিমবঙ্গে। এইসব প্রায় অপ্রচলিত কথা – শব্দবন্ধ, প্রবাদ, বাক্যাবলি নিয়ে নিজের মনের ভেতর ঝাঁকানি দিতে থাকেন সুধীর মজুমদার। একই বঙ্গদেশের পূর্ব ও পশ্চিমভাগে ভাষা, শব্দপ্রয়োগ, রসিকতার মাত্রা ও সেই অনুযায়ী কথা-প্রহার, কথন আলাপ – সবই বদলে বদলে যায়, স্বাভাবিকতায়। এমনকি লোকায়ত নানা নিতকিত, আচার-আচরণ – সবই তো স্বভাবে স্বতন্ত্র।

এমন হওয়াই তো বাস্তবানুগ। এরকম ভাবনার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সুধীর মজুমদার নিজের মনে মনেই খানিকটা স্বস্তি বুনে নেন। বুনতে থাকেন। সকালে সব থেকে বেশি প্রচারিত বাংলা দৈনিকের শব্দছকটি ঠিকঠাক সব মিলিয়ে দিতে পারলে মনে অদ্ভুত এক খুশি আর স্বস্তি বোধ করেন সুধীর। আনন্দ নয়, খুশি, মস্তি, – শব্দের এই অমোঘ প্রয়োগ, শক্তি তাঁকে শুধু বিস্মিতই করে না, খানিকটা যেন বোকাও বানিয়ে দিতে থাকে। সুখ, স্বস্তি, সোয়াস্তি, শান্তি এইসব শব্দের – প্রতিটি উচ্চারণেরই আলাদা আলাদা – স্বতন্ত্র অর্থ আছে – সুখ, শান্তি – এই শব্দ দুটির মধ্যে দূরত্ব যোজন যোজনের। সে-কথা সুধীর মজুমদার  জানতেন খুব ভালোভাবেই। নিজে শারীরিকভাবে যথেষ্ট সুস্থ ও সক্ষম থাকার সময় সুধীর মজুমদার অখ-বঙ্গের পূর্ববঙ্গ থেকে কিছু শব্দ তাঁর মস্তিষ্ককোষে জমিয়ে জমিয়ে স্মৃতিভাণ্ডার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। যেমন –

চঙ্গ – মই

চুঙ্গা – কৌটো

ব্যাশ-কম – বেশি-কম

আখা – উনোন

পাটা-পুতা – শিল-নোড়া (পাটা-শিল, পুতা-নোড়া)

হাবলাইসা – হাঘরে

স্যাবা দেওয়া – প্রণাম করা

পাকঘর/ আশখাল – রান্নাঘর

পাক-করা – রান্নাকরা

হাগাবাড়ি – পায়খানা (মূলত বরিশাল জেলায় এই শব্দটির

ব্যবহার ছিল)

ফাল দেওয়া – ক্ষতি করা

ঠিকি দেওয়া – সত্মূপ করে রাখা

ঠিরি – সত্মূপ

ভাদাইমা – অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত কথা বলে – বেশি বকে

এমন কেউ, ফালতু লোক

স্বীকার খা – স্বীকার কর

কিরা খা – দিব্যি দে

ছাওয়াল/ পোলা – ছেলে

মাইয়া – মেয়ে

নাসা – নাক

কাইন – কান

হোগা – পোঁদ

গোয়া – পোঁদ

হ্যাডা – পুংজননাঙ্গ

হেডি – স্ত্রীজননাঙ্গ

খাউজ্জান – চুলকান

অসইভ্যের নাজির – খুব অসভ্য

সাউয়া – স্ত্রীযৌনাঙ্গ

খাইসে – খেয়েছে

মারসে – মেরেছে

খেউরি – গোঁফ-দাড়িকাটা – কামানো

লবণ – নুন

ডাইল – ডাল

পাক করা – রান্না করা

মরিচ – লঙ্কা

কাচামরিচ – কাঁচালঙ্কা

কইতর – কবুতর

মেকুর – বেড়াল

কুত্তা – কুকুর

কাউয়া – কাক

খেউকান – কুকুরের করুণ ডাক

বেঙ্গু/ ভ্যাক – ব্যাঙ

সাপে খাইসে – সাপে কেটেছে/ সাপে কামড়েছে

বাইগন – বেগুন

ঝিঙা – ঝিঙে

বাপের ঠাকুর – অতি আদরের জন

জবর – জোরাল

খিজালতি – বদমাইশি/ খিজালতি বুদ্ধি – শয়তানি বুদ্ধি

খাইস্ট্যা – বজ্জাত

আদাড় – আস্তাকুঁড়

জম্বুরা – বাতাবি লেবু

হাতদাও – কাটারি

বঠি – বঁটি/ বঠিদাও – বঁটি

বঠি – চ্চচড়ি

ভারালি – থোড়

যামু না – যাব না

খামু না – খাব না

এভাবেই সুধীর মজুমদার প্রায়-হারানো পূর্ববঙ্গীয় লবজ – ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুরের ভাষা কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিজস্ব নোট বইয়ে সংগ্রহ করতে থাকেন। তাঁর সংগ্রহের তালিকায় অখ- বঙ্গের পুবভাগের নোয়াখালী, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম বাইরেই থেকে যায়।

সুধীর রঞ্জন লেখেন –

বখখিলা/ বখিল – কৃপণ

ডর – ভয়

ডহর পানি – অল্প জল

দ্যাখন – দেখা

পুরান – পুরনো

কুইট্টা – কেটে

ছেইচ্যা – ছেঁচে

ডমফাই – বড় বড় কথা। হামবড়াই

কুমইড় – কুমড়ো

ক্ষীরা – শসা

তেলাপোকা – আরশোলা

মোখা – মুখ

দরিয়া – সমুদ্র

বাত্তি – আলো

ফুডা – ফুটো

হুড়ুম – মুড়ি

চিড়া – চিড়ে

ছেরি – ছোট মেয়ে

ছ্যারা – ছোট ছেলে

ছ্যামড়া – ছোট ছেলে

ছেমড়ি – ছোট মেয়ে

মারস না – মারিস না

পাও – পা

মাংঠামো – ঢং করা

ঘোরন – ঘোরা

তড়াতড়ি – তাড়াতাড়ি

নাও – নৌকো

ছ্যাপ – থুথু

আরশি – আয়না

ত্যাল – তেল

নাইরেল – নারকেল

ঠাইরেন – ঠাকরোন

আজি-মা – ঠাকুমা

খুড়ি-মা – কাকিমা

খুড়ামশায় – কাকা

ছালা – চটের বস্তা

থাবড় – থাপ্পড়

গুয়া – সুপুরি

থোতমা – মুখ

কাম সারসে – কম্ম সারা হয়ে গেছে

আদাড়ের আঠি আদাড়ে – পুনরায় আগের অবস্থায় ফেরা

সইলতা – সলতে

বাইতাসলুই – নেংটি ইঁদুর

বগা – পুরুষ বক

বগী – স্ত্রী বক

ভাইস্তা – ভাগ্নে (ভাতিজা)

ভাস্তি – ভাগ্নি (ভাতিজি)

ফুডানি – ফুটানি

তেলকাইষ্ঠা – তেলচিটে

ছল্লিবল্লি – প্রতারণা

হান্দাইয়া দিসে – ঢুকিয়ে, ঠুসে দিয়েছে

ঠাইস্যা ধরসে – ঠেসে ধরেছে

চাইপ্যা ধরসে – চেপে ধরেছে

ডাটকলা – লবডঙ্কা

এরকম আরো-আরো বহু কথা লিখেছেন সুধীর মজুমদার তাঁর নোটবইয়ে। ইদানীং প্রায়ই বেতুলের রিকশায় একমাত্র পুত্র সমভিব্যহারে গোটা গোটা বাড়ি, বন্ধু-বান্ধবের তৈরি করা বিলীয়মান পাকাবাড়ি – সব খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে, ভয়ানক হতাশ হয়ে, হতাশাজনিত ক্লান্তি ও উদ্বেগ আক্রান্ত চাপ সামলাতে সামলাতে খানিকটা অস্থিরতাজনিত উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করতে করতে একসময় বিছানায় সম্পূর্ণ এলিয়ে পড়েন সুধীররঞ্জন।

আসলে দিন-তিনেক আগে, না থাক – এখনই বলার কোনো ইচ্ছেই নেই এস মজুমদারের। বরং তিনি স্কুলে যেতে যেতে আরো কয়েকটি পূর্ববঙ্গীয় শব্দ বাতাসে উড়ে বেড়াতে দেখতে পান।  যেমন টাকা – ট্যাহা। এরকম শব্দ তো আরো আছে –

চিক্কুর পারা – চিৎকার করা

ভোদাই – বোকা

মুরগি ক্যারক্যারায় – মুরগি ডাকে

আন্ডা – ডিম

ব্যাবাক – পুরোপুরি

মিটমিটা – মিটমিটে

এইসব শব্দমঞ্জীর তাঁর স্মৃতিগুহায় – গহবরে রঙিন, ডানা থেঁতলান প্রজাপতি হয়েই উড়তে থাকে। সুধীররঞ্জন মজুমদার হাতে করে বারবার সেই পাখনা থেঁতলে যাওয়া ভাষা প্রজাপতিদের ধরতে চেষ্টা করেন, দুহাতের দশ আঙুল দিয়ে স্বপ্নের মধ্যে অথবা স্বপ্নঘোর জাগরণ পথে সুধীররঞ্জন মজুমদার আবিষ্কার করেন তাঁর দুহাতের চেটো, তালু, আঙুলে আঙুলে প্রজাপতি পাখাদের আলগা রং। সুধীররঞ্জন দেখতে থাকেন প্রজাপতি পাখনার রঙিন মুদ্রালিপি রংচং – সবটাই তাঁর হাতের দশ আঙুল আর তালুতে লেগে লেগে ক্রমশ ফ্যাকাশে, বিবর্ণ, রংহীন হয়ে যাচ্ছে। তারপর একসময় বর্ণিল প্রজাপতিরা তাদের ওড়াই পাখনাসমেত সম্পূর্ণ বিবর্ণ হয়ে গেলে সেই ছোট স্বপ্ন, বড় খোয়াবের টুকরো – সব একসঙ্গে চলে যেতে থাকে চোখের বাইরে।

এই রকম – এই ধরনের স্বপন সুধীররঞ্জন দেখেছেন আগেও। সেই স্বপ্নজোয়ারে রংদার পাখিদের ডানায় ডানায় অ আ ই ঈ, ক খ গ ঘ ঙ। সুধীর কিছুতেই তাঁর এই বর্ণযাপনকে আয়ত্তে রাখতে পারেন না নিজের। অক্ষরেরা উড়ে যায়, দূরে দূরে – দূ-র-দূরামেত্ম – কোন নিরুদ্দেশে।

ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ওঠেন সুধীররঞ্জন মজুমদার।

এর আগেও দু-একবার এমন যে হয়নি এমন তো নয়। অর্থাৎ হঠাৎ বেতুলের রিকশা প্রায় জোর করে থামিয়ে একরকম যাকে বলে প্রায় লাফ দিয়ে নেমেছেন রিকশা থেকে। তখন ভাদ্রের দমবন্ধ করা সন্ধ্যা। দীর্ঘবেলা গড়িয়ে গিয়ে চারপাশে ঘনায়মান অন্ধকার।

আজকাল – আজকাল নয়, বহু বছরই হিন্দু-বাঙালি বাড়িতে সন্ধ্যার মুখে মুখে শঙ্খধনি-উলুধ্বনি অতীত – বিশেষ করে
শহরে-শহরাঞ্চলে। সন্ধ্যাবাতি-সান্ধ্যপ্রদীপ প্রজ্বলন, ধূপধুনো – সবই নিরুদ্দেশযাত্রায়। ধর্ম – নিছক ধর্মাচরণ না ভেবে একে লোকাচার ভাবলে ক্ষতি কী?

সমবয়সী – প্রায় সমআয়ুর বন্ধু – পরিচিতদের তৈরি করা পুরনো বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বিফলকাম – সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন সুধীররঞ্জন। বাড়ি ভেঙে তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটের চেহারাটাই তো বদলে গেছে। শিবির নাম বদলে হয়েছে বস্নু টাওয়ারআশাভবন, বিশ্রাম, গোধূলিবেলা – সবই একে একে নিভেছে দেউটির দলে। আশাভবন হয়েছে সানন্দ অ্যাপার্টমেন্ট, বিশ্রাম অনায়াসে হয়ে গেছে শাইনিং হেভেন। আর গোধূলিবেলা হয়েছে গ্রিন ভিউ

এক সন্ধ্যায়, তখন তো বাইরে টিপটিপ টিপটিপ বৃষ্টি। সমস্ত আকাশ, চরাচর জুড়ে এক অলীক মেঘময় শূন্যতা। বেতুলের টানা রিকশা থেকে প্রায় লাফ দিয়ে নেমে সুধীররঞ্জন ফ্ল্যাটের – কোনো ফ্ল্যাটবাড়ির আলোকময় অন্ধ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে, যেহেতু চারতলা বাড়ি, তাই কোনো ওঠানামার যন্ত্র – লিফ্ট নেই, দরজায় দরজায় – সমস্ত ডোরবেলঅলা, আই হোল, সিসিটিভিসমেত দরওয়াজার সামনে সুধীররঞ্জন দাঁড়াচ্ছেন। নেমপেস্নট দেখছেন, তারপর যে-নাম – নামান্তর, নামাবলি খুঁজছেন প্রাণপণে, সেই নামভাব না পেয়ে তিনি তো দু-একটা ক্লোজডোর ধাক্কিয়ে, পিটিয়েও ফেলেন। যেমন কিনা তাঁদের কৈশোরকালে – কিশোরবেলায় বন্ধ হয়ে       থাকা – ভেতর থেকে কাঠের ভারি খিল দেওয়া বা লোহার হুড়কো তোলা দরজা খোলানোর জন্য প্রাণপণে – জোরে জোরে বাইরের কড়া নাড়ানাড়ি, লোহার কড়া নাড়ান, নয়তো লোহারই তৈরি ওজনদার লোহার শিকল পেটাপেটি, তাতেও না খুলে গেলে দরজা ধাক্কান – পুলিশও তো মাঝরাত, নয়তো শেষরাতে এভাবেই সদর দরজায় আঘাত করে, করাঘাত, তো সুধীররঞ্জনের সেই সশব্দ দরজা ধাক্কানোর পর আই হোল অথবা সিসিটিভির ছায়াছবি, ছবিতে ঠিক লোক নয়, এমনটি ভেবে আর কীভাবেই বা ওয়াচম্যান এদের অ্যালাও করে, এইসব ভদ্র চেহারার ভিখিরিদের, মনে মনে এইসব নয়-দশ, বিশ-পঁচিশ ভেবে নিয়ে বন্ধ দরওয়াজার ওপারে থাকা কেউ নিজঘরের অর্গল মুক্ত করেন না, দরজা খোলেন না।

এর ফলে সুধীররঞ্জনের মনঃকষ্ট, মনোবেদনা – মনখারাপ, মনবিষাদ বেড়ে ওঠে আরো। হালফিলের ভাষায় চাপ তৈরি হতে থাকে মনের ওপর। আর আজো বেতুলকে যখন নিজের দুপায়ের জোরে প্যাডেল করার বদলে মোটর লাগান রিকশা নেওয়ার কথা বলছে রাহুল, তখনই আশাদীপ, নয়তো আশাভবন, বিশ্রাম কিংবা গোধূলিবেলার সামনে ভয়ানক বিপজ্জনক কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে এড়াতে মাটির দিকে ঝোঁক খেয়ে, সামান্য ঝুঁকে অনেক কষ্টে নিজের চলার গতি বাড়াতে চাইলেন সুধীররঞ্জন মজুমদার। কোন বাড়ির সামনে বাসক অথবা ঢোলকলমির বেড়া, কার বাড়ির চারদিকে ফালি  বাঁশ-বাখারি আর রাংচিতা – বাঘবারান্ডার বেড়া ঘেরা, কোন বাড়িতে নয়নতারা ঝোপ, এক-আধটা ধুতরো, নয়তো আকন্দগাছ, গেরস্তের উঠোনে নিজস্ব স্বাভাবিকতায় চরিত্রগুণেই বেড়েছে তারা, একই সঙ্গে সামনের উঠোনে বাঁশের খুঁটি আর ছ্যাঁচাবেড়া দেওয়া টালির চালের রান্নাঘর, বড়সড় ফলসা গাছ, যেখানে – যার নিচে বিদায়ী চৈত্রবেলায় বোঝাই হয়ে থাকে ভেলভেটি আস্তরসমেত ফলসারা, তাদের চারদিক ঘিরে লাল লাল পিঁপড়ে, ফল-ঠোকরান কাক, বুলবুল, দোয়েল – এসব টুকরো টুকরো ছবি-স্মৃতি অনমেত্মর ঘোর হয়ে ভেসে উঠতে চায়। ভেসে উঠতে থাকে সুধীররঞ্জনের মস্তিষ্ক-গভীরে। এই মনে রাখারাখি, ভোলাভুলি, ভুলে যাওয়া, বিস্মরণ নিয়েই সুধীররঞ্জনের ক্লেশ-ক্ষোভ-কষ্ট।

আলো-ঝলমল সিঁড়িরা মুহূর্তে মুহূর্তে অন্ধ অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ছুটতে থাকে সুধীররঞ্জনের সামনে। কোনোভাবেই নিজের বাবার শরীর অথবা মনের নাগাল পায় না রাহুল মজুমদার। ওয়াচম্যান – ছোটবাড়ি – চার-পাঁচতলা চিলতে খোপবাড়ি, নয়তো হাউজিং – যাই হোক না কেন, সেখানে তো কেয়ারটেকার, ওয়াচম্যান – সিকিউরিটি গার্ড থাকেই। তারা প্রায় সবাই তো সুধীররঞ্জন মজুমদারকে নানা সময়ের অভিজ্ঞতায় বেশ ভালোই চিনে গেছে। সুধীররঞ্জন – বাবার সঙ্গে ছেলে রাহুল তো থাকেই। বাবা বোধহয় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ইস্ক্রুপ ঢিলে – তারকাটা পাবলিক হয়ে গেছে, সেটাই ছেলের সমস্যা। তবু তো ছেলে
সময়ে-অসময়ে বাপকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে রিকশায় ঘুরে ঘুরে তার অন্যায় আবদার মেনে নেয়। কি না পুরনো বাড়ি দেখবে, বন্ধুদের,  পরিচিতদের। ছাই দেখবে। ওরে বাবা, এখন সব ফেলাটবাড়ি, কমপেস্নক্স। আর ফেলাট হলো বলেই তো আমরা অ্যাতগুলো লোক চাকরি পেলাম। আমাদের চাকরি হলো। ইনকাম – আয়-ইনকামের জায়গা তৈরি হয়ে গেল। রোজগার বাড়ল।

অন্ধকারে অন্ধকার আর জোরে জোরে – দ্রম্নত নেমে এসে ছাতা মেলে দেয়। সেই ছত্রীখোলা আঁধারিমার ভেতর আকাশে অনেক অনেক ফুটিফুটি তারা। সেই তারারা মাঝে মাঝেই মরে যাচ্ছে কত সহজে। তাদের কেউ কেউ টুপটাপ টুপটাপ খসে পড়ছে সুধীররঞ্জনের দুচোখের ওপর। পড়তে পড়তে পড়তে তারা অনায়াসে স্মৃতিফণা – স্মৃতিকণা নয়, স্মৃতিফণা হয়েই মিশে যাচ্ছে সুধীররঞ্জনের দুচোখে, কানে।

সুধীররঞ্জন শুনতে পাচ্ছেন শঙ্খধ্বনি, হারমোনিয়াম সামনে নিয়ে বসা কোনো বালিকা অথবা কিশোরী কণ্ঠে কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের নিশ্চিন্ত আলাপ। বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা … এমনই ছিল কি সেইসব সাংগীতিক লাইন। নয়তো নজরুলগীতির ছন্দময় দুলুনি। কে গায়? কারা গায়? এদের সকলকেই তো চেনেন, জানেন সুধীররঞ্জন; কিন্তু নাম মনে পড়ে না কারওরি। নাহ্, কারো নাম, কোনো ব্যক্তি-নাম ধীরে ধীরে অথবা জোরে, ফুটে ওঠে না সামনে। বরং এমন অবস্থায় তাঁর মাঝে মাঝেই মনে হয় তিনি কোনো মৃত, পরিত্যক্ত নগরীতে আছেন। হেঁটে যাচ্ছেন পম্পেই অথবা সাকেতের ভেতর দিয়ে।

দূরে কোথাও কি হরি ধ্বনি দিতে দিতে বল হরি, হরি বোল, বল হরি, হরি বোল খুব চিৎকার করে বলতে বলতে শ্মশানযাত্রীরা মিলিয়ে গেল, গড়িয়া শ্মশানের পথে। তাদের ছড়ানো খই-পয়সা – পয়সারা অধিকাংশই বাতিল – চার আনা, আট আনা, যূথিকাপুষ্প – জুঁই ফুল আর আকাশ থেকে খসেপড়া তারা – নক্ষত্রমালিকা হতে হতে দূরে চলে যেতে চাইল কোনো মৃত্যু নির্জনতায়।

শত আলো ঝলমলানি সত্ত্বেও অন্ধ, অন্ধকার মাখান পরণকথার অজগরবৎ সিঁড়িরা সুধীররঞ্জনকে গিলে ফেলতে – সম্পূর্ণ গ্রাস করতে চাইছে।

হোয়াট আ সিলি জোক – সিলি – অবনকশাস ইনসিডেন্ট। আপনার ফাদার কেন রোজ রোজ এসে দরজায় নক করে? দরজা ধাক্কায়! এবার তো আমরা পুলিশে খবর দেবো। ওয়াচম্যানদেরও আমরা সাসপেন্ড করাব, ওদের কোম্পানিকে বলে – কমপেস্নন করে। কোনো ডিউটিজ্ঞান নেই – এরকম লোক রাখে কেন।

নাহ্, ওদের কোনো দোষ নেই। আমতা আমতা করে বলে রাহুল। তারপর সামান্য পজ দিয়ে বলতে থাকে – আসলে ওরা বাবাকে চেনে। বাবার তো এটাই প্যাশান। এটাই ডিসঅর্ডার – গোলমাল – কষ্টও বটে। পুরনো বাড়ি, বন্ধুবান্ধব, জায়গা খুঁজতে খুঁজতে বাবা আনন্দ পান। নইলে ভীষণ চাপ তৈরি হয়। স্ট্রেস।

এটা কোনোভাবেই ডিসঅর্ডার নয়, ডিজিজ। ডিজিজ। অসুখ। ভালো করে ডাক্তার দেখান – ডক্টর কনসাল্ট করান। সাইকিয়াট্রিস্ট। আপনার বাবা হয় মেন্টাল পেশেন্ট, নয়তো পারভার্টেড, বদমাইশ। ঝানু বদমাইশ। সামলে রাখুন বাবাকে। নইলে বড়সড় কোনো কেলেংকারি হয়ে যাবে একদিন। তখন আর সামলাতে পারবেন না।

দরজা বন্ধ হয়ে যায় সশব্দে।

অন্ধ-তামসময় সিঁড়ির কোণে কোণে লুকানো, থ্যাঁতলানো, রংচটে যেতে যেতে ক্রমে, বর্ণহীন – সম্পূর্ণ বিবর্ণ প্রজাপতিরা ঝাঁকবেঁধে উড়তে উড়তে উড়তে রাহুল মজুমদারকে ঢেকে ফেলতে থাকে একটু একটু করে। তাদের হিংস্র, তীক্ষন দাঁত গজিয়ে যায় কোনো নিজস্ব বিভ্রমে। তারা রীতিমতো কামড়াতে থাকে রাহুলকে। সেই প্রজাপতি-কফিনের ভেতর নিজেকে একটু একটু করে শ্বাসশূন্য হয়ে ওঠায় বাধ্য করতে করতে করতে রাহুল মজুমদার একসময় বাতাসহীন হয়ে যায়। তার ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা সুধীররঞ্জন মজুমদারের হাত কেমন করে যেন শিথিল হতে হতে, একসময় সম্পূর্ণ – ছটকে যায় পুরোপুরি।