শব্দের চিত্রকলায় সময়ের ছবি

সুব্রত বড়ুয়া

কালো সীমানা

সাদত হাসান মান্টো

ভাষান্তর : জাভেদ হুসেন

প্রথমা, ঢাকা, ২০১৯

১৮০ টাকা

আমরা যারা সত্তরোর্ধ্ব বয়সের পথে চলছি এবং জীবনের অপরাহ্ণবেলা অতিক্রম করছি, সেই আমাদের কারো কারো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় সাতচলিস্নশের দেশভাগ এবং পরবর্তীকালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা অমোচনীয়ভাবে টিকে আছে। এ এমন এক স্মৃতি, যা কিছুতেই ফুরিয়ে যায় না এবং কখনো কখনো আরো বেশি জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে। এই দেশভাগ ও দাঙ্গা উপমহাদেশের বহু মানুষের জীবন ধ্বংস করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে উন্মত্ততা ও হিংসা এবং হত্যার বীভৎসতা। বহু মানুষ এই সংকটকালে দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়েছে আর জীবনের পরবর্তী দিনগুলোতেও

ফেলে-আসা দেশের ছায়া বুকে নিয়ে বেঁচে থেকেছে বা দিনাতিপাত করেছে। নিশ্চয়ই

এ-কথাগুলো নতুন কিছু নয়, কিংবা নয় এমন কোনো কথা, যা আমাদের ভাবনার দিগন্তকে কোনো-না-কোনো সময় স্পর্শ করে না। তবু এসব কথা মনে এলো উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত ছোটগল্পকার সাদত হাসান মান্টোর সিয়াহ হাশিয়ে বইটির জাভেদ হুসেনকৃত বাংলা রূপান্তর কালো সীমানা বইটি পড়তে গিয়ে। উর্দু সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় ঘটে বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকেই। এই সময়ে বাংলা ভাষায় উর্দু গল্পের অনুবাদের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে

যে-কয়েকজনের নাম তাঁরা হলেন – কাজী মাসুম, মোস্তফা হারুন, জাফর আলম, আখতার-উন-নবী, হাসনাইন ইমতিয়াজ প্রমুখ। অনুবাদক তাঁর ‘অনুবাদ প্রসঙ্গে’ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সাদত হাসান মান্টোর সিয়াহ হাশিয়ে গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে এবং মোট বত্রিশটি গল্প ছিল এতে। ফর্মের দিক থেকে এই গল্পগুলো যথার্থই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, কারণ সেগুলো ‘এক লাইন, দুই লাইনের গল্প। কখনো সাত শব্দ, কোথাও বারো শব্দের গল্প। কিন্তু সব গল্পই সম্পূর্ণ।’

অনুবাদক জাভেদ হুসেন গল্পগুলো ভাষান্তরিত করেছেন ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে লাহোর থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণের বইটি থেকে। বইটিতে অনুবাদক শুরুতে জুড়ে দিয়েছেন ‘মান্টোর বিভীষিকার নন্দনত্ব’ নামে একটি রচনা, যেখানে তিনি কিছুটা বিশদভাবে লিখেছেন লেখক মান্টো এবং তাঁর গল্প সম্পর্কে। মান্টোর এই গল্পগুলো মূলত স্কেচধর্মী,

ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণবর্জিত, বেশিরভাগই ইঙ্গিতময় অথচ তীক্ষন ও অন্তর্ভেদী। অনুবাদকের ভাষায় :

‘অনেকগুলো মানুষ লুটপাট, হত্যা আর ধর্ষণে ব্যস্ত। একের পর এক গল্প এভাবে এগিয়ে যায়, যেন হত্যা-রাহাজানির ধূলিঝড়ে চোখ অন্ধ হয়ে আসে।…

‘উন্মত্ততাকে মান্টো কোনো ব্যাখ্যায় ঢাকতে চাননি। কোনো প্রেক্ষাপটে ফেলার ঝামেলাও তিনি পোহাননি। গল্প সরাসরি ঘটনাস্থলে পাঠককে আচমকা টেনে আনে। এই গল্পগুলো একেকটা তীক্ষন সুচের মতো ঢুকে যায়, পাঠক শিউরে ওঠেন।’

জাভেদ হুসেনের সঙ্গে আমরাও একমত যে, কালো সীমানা বইয়ের এই গল্পগুলো যেন অনেকটা ক্যামেরায় তুলে রাখা দৃশ্যের মতো, যেখানে ‘অবিসংবাদিত মান্টো হাজির স্বমহিমায়, তাঁর সব নাটকীয়তা, রক্ত হিম করা রসিকতা, ঝকঝকে সংলাপ, ঘটনার আকস্মিকতা আর হকচকিত করে দেওয়া সমাপ্তি নিয়ে।’

অনুবাদকের এই বক্তব্যের সমর্থনে মাত্র চার লাইনের একটি গল্প উদ্ধৃত করছি এখানে। গল্পের নাম ‘সরি’।

পেট ফাঁক করে দিয়ে নাভি পর্যন্ত নেমে এল ছুরি।

পাজামার ফিতে কেটে গেল।

ছুরি চালানো লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,

‘ছি, ছি, ছি, ছি, মিস্টেক হয়ে

গেছে।’

আশা করি, এই গল্পের বক্তব্য আলাদা করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এই গল্পেও অস্পষ্ট থাকে না মান্টোর রচনার বৈশিষ্ট্য। মান্টো সরাসরি পৌঁছে যান তাঁর বক্তব্যে। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো নাটকীয়তাপূর্ণ ছবি এবং উপযুক্ত সংলাপ কিংবা মন্তব্য যুক্ত হয়। আর এই ইঙ্গিত ও ছবি গল্পের সঙ্গে অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থিত হয়, বাহুল্য কিংবা উচ্চারণ মাত্র নয়। আমাদের মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে – মান্টোর লেখায় শব্দের চিত্রকলা ও নাটকীয় ইঙ্গিতময়তার এই অনন্য বৈশিষ্ট্য কি বোম্বের চিত্রজগতের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কের কারণেই!

সাদত হাসান মান্টোর জন্ম ১৯১২ সালে (১১ মে) পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার সমরালায়। তাঁর স্কুলজীবন শুরু অমৃতসরে। স্কুলে ভালো ছাত্র ছিলেন না কখনো। ম্যাট্রিক পাশ করার পর রোজগারের ধান্দায় নেমে পড়েন। এই ধান্দার সূত্রেই জড়িয়ে পড়েন জুয়া আর মদে এবং ভিন্ন জগতের সঙ্গীদের সাহচর্যে। নিজের পরিবার কিংবা পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কোথাও কোনো মিল ছিল না এই জগতের। মান্টো অবলীলায় অন্ধকারময় এই জীবনের কালো ছায়ার বৃত্তে নিজের জায়গা খুঁজে পান। আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় এ-সময়, যা পরবর্তীকালে তাঁর গল্পের ভুবনে জায়গা করে নেয়। এই সময়েই বারি আলিগ এবং আতা মহম্মদ চিহতির সঙ্গে পরিচয় এবং লেখালেখির জীবন শুরু। বাইশ বছরের লেখকজীবনে লিখেছেন বাইশটি ছোটগল্পের বই, একটি উপন্যাস। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে রেডিও নাটকের সাতটি সংগ্রহ, তিনটি প্রবন্ধ সংকলন এবং দুটি চেনা মানুষদের স্মৃতিকথা। তাঁর লেখা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। মাত্র তেতালিস্নশ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৫৫ সালে (১৮ জানুয়ারি), লাহোরে।

১৯৪৮ সালের ৭ জানুয়ারি মান্টো করাচি হয়ে পাকিস্তানের লাহোর চলে যান। তাঁর পরিবার আগেই লাহোরে চলে গিয়েছিল এবং তাঁরা মান্টোকে সেখানে চলে যাওয়ার জন্য বলছিলেন। এভাবে পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় জীবিকার দিক থেকে মান্টো সংকটের সম্মুখীন হন। বোম্বের চিত্রজগৎ ছিল তাঁর জীবিকার প্রধান উৎস। সে-তুলনায় লাহোর তাঁর জীবিকার্জনের জন্য সেরকম কিছু ছিল না। লাহোরের চলচ্চিত্র জগৎ তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে এবং চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট সবাই বুঝতে পারছে যে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তার সম্ভাবনা অনেক; তবে তার জন্য সময়ের দরকার। অত বেশি সময় দেওয়ার অবস্থায় মান্টো তখন ছিলেন না। অথচ সংসার চালানোর সংগতিও তখন ফুরিয়ে আসছে। এ সময় প্রিয় বন্ধু ইসমত চুগতাইকে লেখা তিনটি চিঠিতে তিনি বোম্বে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে তাঁকে সাহায্য করার অনুরোধও জানিয়েছিলেন। এদিকে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপানোর ব্যাপারেও তাঁর সমস্যা হচ্ছিল। মান্টোর এই সময়ের জীবনযাপনের বর্ণনা তুলে ধরেছেন জাভেদ হুসেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তার উদ্ধৃতি :

‘বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়েন মান্টো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে নাছোড়বান্দার মতো টাকা চান, পরে লিখে শোধ করে দেবেন। এমন হিসাবে তো পত্রিকা চলে না। সম্পাদক কাগজ-কলম এগিয়ে দিয়ে বলেন – মান্টো সাহেব, কিছু একটা লিখে দিন। মদ আর বাজার খরচের টাকার জন্য দুশ্চিন্তিত লেখক সদ্য দেখা দাঙ্গার গল্প লিখে দেন কাঁপা কাঁপা হাতে। সেই গল্প কখনো কেবল এক লাইন, বেশি হলে পৃষ্ঠা দেড়েক। এভাবে লেখা বত্রিশটি গল্প নিয়ে ১৯৪৮ সালে বের হয় সিয়াহ হাশিয়ে, মানে কালো সীমানা। এই নাম দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে কালো সীমান্ত, নতুন দেশের বর্ডার, মান্টো যাকে কালোই বলতেন। আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোক সংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপা হয়, সেই কালা সীমানা।’ অনুবাদকের এই ব্যাখ্যা, মনে হয়, যথাযথ।

এ বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে যুক্ত করা হয়েছে ‘কাফনের গলা’ নামে সাদত হাসান মান্টোর একটি লেখা, যা তিনি লিখেছিলেন ১৯৫১ সালের ২৮ অক্টোবর। এই লেখাটি ছাপা হয়েছিল মান্টোর গল্পগ্রন্থ এজিদের পরিশিষ্ট হিসেবে। সংযোজনটি ব্যক্তি মান্টো ও লেখক মান্টোকে বুঝতে পারার জন্য মূল্যবান সহায়তা হতে পারে।

কালো সীমানার গল্পগুলোর অনুবাদ সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। বাঙালি পাঠকদের সাদত হাসান মান্টোর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ করে দেওয়ায় অনুবাদক জাভেদ হুসেনকে ধন্যবাদ।