শব্দ

‘দোর বাল, দেখতে পাচ্ছিস না বাঁড়া, কাঁধে মাল আছে। সরে দাঁড়া।’
‘তোর বাল অত তাড়া কিসের। আমার বাঁড়া এমার্জেন্সি হয়ে পড়েছে। মাইরি, চেপে রাখতে পারছি না। একটু বোঝ বাঁড়া।’
রেলের গ্রম্নপ-ডি পরীক্ষার বইয়ের বান্ডিল কাঁধে। বিট্টু তাই নিয়ে চলে গেল দোকানে। পেচ্ছাপখানার দরজা ঠেলে তাড়াহুড়ো করে সেখানে ঢুকে পড়ল দেবাশিস।
একটু পরেই বেরিয়ে এলো সে। প্যান্টের চেইন আটকাতে আটকাতে বলল, ‘পেয়ে গেলে আর কন্ট্রোল থাকে না, যতক্ষণ মাল বাইরে না বেরোচ্ছে। এখন চাপমুক্ত। কী বলো কাকা?’
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। এখানে গলি-ঘুপচি, পুরনো বাড়ির ভেতরে হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে বইয়ের দোকান নেই। হরিশ্চন্দ্র যে দোকানে চাকরি করেন সেটা পুরনো একটা বাড়ির মধ্যে। ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে অন্ধকার পেরিয়ে দোকানে পৌঁছতে হয়। এখানে কাউন্টার দুটো। বাকি সব গোডাউন। মেইন রাস্তায় তাদের টেক্সট বইয়ের দোকান। গোডাউন থেকে বই পৌঁছে যায়। সেখানেই কাজ করে দেবাশিস, বিট্টু, তাপস, রাজেশরা। ১১টায় ঢোকে, ছুটি সেই সন্ধে ৭টায়।
হরিশ্চন্দ্র চক্রবর্তী মাসছয়েক হলো কাজে এসেছেন। রুপালি পাবলিশার্সে। তাকে কাকা বলে ডাকে অনেকে। এখানকার টয়লেট ব্যবহার করতে আসে বাইরের দোকানের ছেলেগুলো। দিনে কতজন আসে, কার কতবার যেতে হয় – মুখস্থ হয়ে গেছে হরিশের।
‘কাকা বলে সম্মান যখন দিচ্ছই তখন একটা কথা বলি। ওই কথাগুলোই যদি নিজের মাতৃভাষায় বলো ভাইপো, খুব কি ক্ষতি হবে?’
রোগা পাতলা, ঢেউ খেলানো চেহারার দেবাশিস দু-পাটির দাঁতের যতগুলো সম্ভব মেলে ধরল। ‘আরে কাকা বাংলাতেই বলছি, ইংরেজিতে বললে বুঝতে পারতে? মার্কেটে এখন এসবেই বাজার গরম। তুমি বয়স্ক মানুষ, অভ্যেস নেই, তাই চাপ নিতে পারছ না। দ্যাখ না, অটো ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, এমনকি বইপাড়ার লেবারগুলো অব্দি – যাকে বলে আম পাবলিক, সবার মুখেই তো লেগে রয়েছে। না হলো কেউ কথাই বলতে পারবে না।’
‘সবাই বলছে বলে তোমরাও বলবে? নিজেদের আলাদা করবে না!’
‘এই তো কাকা, সুযোগ বুঝে চাপ বাড়াচ্ছ, বলতে বলতে অভ্যেস হয়ে গেছে।’
আর সহ্য করতে পারছিলেন না হরিশ। ‘কাস্টমারকে বই দেখানোর সময় কি খিস্তি দিয়েই বলো?’
এবার দেবাশিস চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। তাদের কাকা বলতেই থাকেন – ‘কলেজ স্ট্রিটপাড়ায় বঙ্কিম চাটুজ্জের গলিতে বসে সারাদিন বই ঘাঁটছ। তারপরও শব্দগুলো কোন বই থেকে যে খুঁজে বার কর তোমরা -’
বিট্টু ফিরে এসে গোডাউন থেকে আরো বই নিচ্ছিল। শেষের কথাগুলো শুনেছে। বই ফেলে রেখে সামনে এলো। ‘মাথা গরম যে কাকা, কী লেকচার ঝাড়ছ, একটু শোনাও।’
হরিশ্চন্দ্র চুপ। সামনে বিট্টু। চোখে লাল ফ্রেমের চশমা, গায়ে হলুদ টি-শার্ট, গ্রে-জিনস, পায়ে সবুজ কিটো, হাতে বালা, কব্জিতে বেশ চওড়া লাল সুতো জড়ানো। মাথার চুলগুলো যে যেদিকে পেরেছে জায়গা করে নিয়েছে।
‘লেকচার কিছু নয়। পাশের কাউন্টারে একজন মহিলা বসে। তোমরা প্যান্টের চেইন খোলো বাথরুমে ঢুকে; কিন্তু আটকানোর আর সময় পাও না। বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধ করতে হয়। সেটাও বলছিলাম।’
পাশের কাউন্টারটা প্রাইমারির টেক্সট বইয়ের। সিজনে ভিড় করে কিছু স্কুলের লোকজন, এজেন্ট, ক্যানভাসার। মালিকের
আসা-যাওয়া আছে। ওরা কিছু ধর্মকর্মের বইও ছাপে। সেই কাউন্টারের রূপা চোখ নামিয়ে নিল। বিট্টুর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ‘শালার বাওয়াল করবে ও, তুমি বাঁড়া কথা শোনাবে সবাইকে?’
এসব কথার ফাঁকে ফস করে বিড়ি ধরিয়ে টান দিতে দিতে সরে পড়ল দেবাশিস।
‘বাড়িতে মা-বাবা, বউয়ের সঙ্গেও কি ওই শব্দ ব্যবহার করো বিট্টু?’
‘এই তো কাকা সেন্টি হচ্ছো। কাজের জায়গায় ওসব মাইন্ড করলে চলে বলো তো? বই নামিয়ে আসছি। দু-মিনিট সময় দাও বস্।’ হরিশ্চন্দ্র শুনতে পাচ্ছেন, চলে যেতে যেতে বিট্টু বলছে, ‘চিল কাকা, চিল।’
হরিশ্চন্দ্রকে শীতল হতে বলা হচ্ছে। চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে মানুষের বিশ্বাস হয় না। ভ্রম ভেবে ভোলার চেষ্টা করে। কিন্তু এ তো ঝেড়ে ফেলাও সম্ভব নয়। ঠিক যেন গল্পেপড়া ডাকাতের দল মাথায় বন্দুক ধরেছে। দেখব না বলে চোখ বন্ধ করে নেওয়ার মতো। কিন্তু কান তো বন্ধ করা যায় না। সিমেন্ট-বালি দিয়ে ঢালাই করাও যাবে না। আরো কতদিন যে কতকিছু শুনতে হবে!
বাড়ির কাছে কেওড়াপুকুর বাজারে কাজ করতেন হরিশ। সবজির আড়তে অ্যাকাউন্টের কাজ। খাতাপত্র সামলানো। কাঁচামাল কত এলো, কত বেরোল দেখা। কে কত পেমেন্ট করছে তার হিসাব রাখা। একবেলার কাজ ছিল। দুপুর ৩টার পর বাড়ি।
চাষিদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো টাটকা সবজিগুলো কত সস্তায় আড়তদারদের এ-হাত ও-হাতে ঘুরছে। ভাবনায় ফেলত হরিশ্চন্দ্রকে। সেই সবজির কিছু তার পেটেও প্রোটিন জোগাচ্ছে। অথচ চাষিরা তাদের প্রাপ্যটুকু পাচ্ছে না। টাটকা সবজি খেয়ে শরীরে শক্তি পেয়েও গায়ের চামড়া মোটা হয়নি হরিশের। মালিককে একদিন বলেই ফেললেন, ‘লোক দেখে নিন।’ তা না হলে হরিশকে সেখানে কালা হয়েই থাকতে হতো। অত খিস্তি সহ্য হচ্ছিল না। খিস্তি তো আর প্রোটিন নয়!
জোছনা করেছে আড়ি
আসে না আমার বাড়ি
গলি দিয়ে চলে যায় …।
‘কী গান শুনছ কাকা? জোছনা গলি দিয়ে পালাচ্ছে! পালাবে কোথায়! এখন তো সবকিছুই হাতের মুঠোয়। দাঁড়াও, আমি তোমায় একটা গান শোনাই। যৌবনের এনার্জি ফিরে পাবে।’ পেচ্ছাপখানায় যেতে গিয়েও বিট্টু ঘুরে দাঁড়াল হরিশের কাউন্টারের সামনে। মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করল।
‘না থাক, তোর গান শুনে আমার কাজ নেই।’ হরিশ নিজের মোবাইলের ভলিউমটা কমান।
‘তোমার গান শুনে মাথা ধরে যাচ্ছে। তার চেয়ে আমার গান শোনো।’
‘বেগম আখতারের নাম শুনেছিস? সব ক্ল্যাসিকাল গান।’
হরিশের কথার ওপর কথা চাপিয়ে দিচ্ছিল বিট্টু। ‘মিক্কা সিং, অরিজিৎ সিংয়ের গান শুনেছ কখনো?’ মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুল পড়ে ঘোরাফেরা করছে বিট্টুর। ‘ঝাটকা জারাসা/ ম্যাহসুস হুয়া ইয়ে/ লাইফ কি গাড়ি/ কষকে মারা ব্রেক।’
দুটো কানেই হাত উঠে গিয়েছে হরিশ্চন্দ্রের। ‘বন্ধ কর, বন্ধ কর। এ তো মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ।’
বিট্টুর মোবাইলের বাজনার নিচে বেগম আখতারের গলা কাতরাচ্ছে। গান বন্ধ করল না বিট্টু। তবে তারস্বরে চেঁচানিটা মনে হয় কমল। ‘কেন কাকা, তোমার জিনিস শোনাবে আমায়, আমারটা শুনবে না কেন তুমি?’
বাষট্টির হরিশ্চন্দ্রের কপালের চামড়া গুটিয়ে পঞ্চজবা। বয়সের লাবণ্যটুকু উবে গেছে। ‘তোর বা আমার ব্যাপার নয় রে বিট্টু, এ হলো ভালো-খারাপের কথা।’
বিট্টু গরম হতে শুরু করেছে। ‘তোমারটাই যে ভালো, আমারটা নয়, কে বলেছে তোমায়? সত্যযুগের লোক বলে যা বলবে তাই শুনব!’
এবার রাজেশ এসেছে পেচ্ছাপ করবে বলে। ঢোকার মুখে বলে গেল, ‘বুড়ো মানুষটাকে একা পেয়ে গান শোনাচ্ছিস? হ্যা হ্যা হ্যা।’ দরজা ভেজানোর শব্দ এলো।
‘সত্যযুগ মানে?’
বিট্টু উত্তেজিত। ‘মানে তোমরা। সত্যযুগ কবেই শেষ। কলি চলছে। তারপরও আয়ু শেষ হয় না। তার শাস্তি আমরা কেন ভুগব?’ নিজের কথায় নিজেই খুশি হলো বিট্টু। হেসে নিল খানিকটা।
‘সাদা-কালো যুগের লোক তোমরা। আধুনিক কায়দায় মানাতে পারছ না। শুধু ওই এক কথা – আমাদের সময়, আমাদের সময়।’ গান বন্ধ করে গোডাউনে গিয়ে ঢুকল বিট্টু।
টেবিলের ওপর কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবছিলেন হরিশ। বিট্টুর কথা শুনে যেন পাথরের মূর্তি।
উত্তর না পেয়ে বিট্টু বই নামাতে নামাতেই ভেতর থেকে বলল, ‘বেশি বলে ফেললাম? সরি বস্।’ একগোছা মহাভারত কাঁধে চাপানো। রাজশেখর বসুর। চলে গেল সে। মহাভারত ওদের বই নয়। বিট্টুর মালিক মহাভারতের এজেন্ট।
১২টা-৬টা ডিউটি হরিশের। যে প্রকাশকের কাছে তিনি রয়েছেন তারা গল্প-উপন্যাসের বই ছাপে। সারাদিন তেমন কোনো কাজই নেই। কোনোরকমে সময় কাটানো। মাঝেমধ্যে বিল করা। কিন্তু বিক্রি তেমন নেই। সপ্তাহে দুটো-তিনটে দিন বাইরের বড় কাউন্টারগুলো সিস্নপ দিয়ে বই নিয়ে যায়। বিকেল ৪টার পর বিল করে নিয়ে টাকা তুলতে যান হরিশ। পায়চারিও হয়ে যায়।
কলেজ স্ট্রিটে কাজের ফলে কতগুলো সুবিধে হয়েছে হরিশের। সবজির আড়তের আগে তিনি কাজ করতেন একটা সিল্ক স্ক্রিন প্রিন্টিং ইউনিটে। হার্টের গোলমাল ধরা পড়ায় সেটা ছেড়ে দিতে হয়। তবে এখানকার ডিউটি শেষ হওয়ার পর তিনি চেনা কয়েকটা জায়গা থেকে অর্ডার ধরেন। ভিজিটিং কার্ড, হ্যান্ডবিল, খাম ছাপিয়ে দেন। পুরনো প্রেস থেকেই। সে বাবদ হাতে বাড়তি কিছু টাকা আসে।
এসবের বাইরে একটা শখও আছে হরিশের। পত্রিকা বার করেন। লিটল ম্যাগাজিন। বছরে একটা। নতুন উঠে আসা লেখকদের জায়গা করে দেন। কবিতা, গল্প খুব যত্ন করে ছাপান। কিন্তু এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, ছাপিয়ে কিছু হচ্ছে কী? পড়ছে কেউ? আর পড়ছে যদি তাহলেই-বা হচ্ছেটা কী?
‘বাড়ি যাবেন না কাকু?’ পাশের দোকানের রূপা ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
‘হ্যাঁ যাব তো, ক’টা বাজল?’ ঘড়ি দেখলেন হরিশ। ‘ওরে বাবা, ৬টা বেজে গেছে।’ হাতের বইটা র‌্যাকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। দোকানের বইগুলো উলটেপালটে রোজ একটু একটু করে পড়েন হরিশ। এটাও বাড়তি পাওয়া গিয়েছে এখানে।
শাটার নামিয়ে তালা লাগিয়ে দিলো রূপা। ‘আজো তো আপনার মালিক এলেন না।’
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে হরিশ বললেন, ‘এসে আর কী হবে। মার্কেটের অবস্থা তো দেখছ। যাতায়াতের ভাড়াই তো ওঠে না।’
রূপা দাঁড়িয়ে ছিল হরিশের জন্য। তিনি বললেন, ‘এগোও মা তুমি, আমার একটা কাজ আছে রাজাবাজারে।’
‘কাল তো দোল, ছুটি। পরশু দেখা হচ্ছে তাহলে? চলি।’ রূপা বেরিয়ে গেল।
রূপাকে খুব স্নেহ করেন হরিশ। নিজের মেয়ের চেয়ে বছরচারেকের বড় হবে এই মেয়েটা। শান্ত স্বভাবের। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রোজগার করছে। বরের টিফিন গুছিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে বের করে দিয়ে নিজে বেরিয়ে আসে কাজে। যাওয়ার সময় ফেরে একসঙ্গে। বর অপেক্ষা করে রাস্তায়।
শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হরিশ। হোঁচট খেলেন বড় রাস্তায় এসে। রাজেশের দল ধরল তাকে। ‘চললে কাকা?’
‘হ্যাঁ ভাই। আজকের মতো ডিউটি শেষ।’
‘বেশ আছ কাকা। মালিক তো আসে না, যখন খুশি আসছ, যখন খুশি বেরোচ্ছ।’
‘কেন ভাইপো, এখন তো ৬টাই বাজে।’
‘যাও যাও। তোমারই তো সময়।’
হরিশ কথা না বাড়িয়ে উলটো পথে রওনা দিলেন। আজ এক জায়গায় তার কিছু খাম আর বিল-বই ডেলিভারি দেওয়ার আছে। ছাপাখানা থেকে নিয়ে ক্লায়েন্টের কাছে যেতে হবে।
এ-সময় পাঞ্জাবির ভেতরে লোমের গোড়াগুলো জেগে উঠল হরিশ্চন্দ্রের। মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলোও ফুরফুর করছে হাওয়ায়। বসমেত্মর হাওয়া বইছে। কলকাতায় ঋতু আসে আর চলে যায়। শহরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। মানুষ কি তার খেয়াল রাখে! সবাই তো ব্যসত্ম। এসব হাওয়া বড্ড বেকার।
বাস, অটো, মোটরসাইকেলের ধোঁয়া। হর্নের ঠেলায় কলকাতা যেন উত্ত্যক্ত। বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকলেন হরিশ। রাজাবাজারের গলি তো নয়, মেয়েদের কিতকিত খেলার ঘর। সারাক্ষণ
লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে হাঁটতে হয়। ভ্যান-রিকশা আর ম্যাটাডোরগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে, একে অন্যের পেছনে লেগে রয়েছে। গাড়ির মালিক লোক সব ওপরে বসে জর্দা দেওয়া পান, গুটখা চিবোচ্ছে আর
এদিক-ওদিক পিক ছড়াচ্ছে। কলকাতাটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছে। কিছু বলতে যাও, রক্ষক্ষ নেই। মুখের ভাষা শুনলে নিজের কান লজ্জা পেয়ে যাবে।
বাড়ি ফিরতে রাত ৯টা হয়ে গেল হরিশের। কলিংবেল বাজালেন। দরজা খুলে দিলেন প্রতিমা। ‘রাত হলো?’
‘ব্যাগটা রাখো। মাম্পি কোথায়?’ মেয়ের খোঁজ করেন হরিশ।
‘টিউশন সেরে ফিরতে দেরি হয়েছে। ওই ঘরে, বিছানায়।’ হরিশের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন প্রতিমা। ‘কী হয়েছে? এরকম চটে আছো কেন?’
বাথরুম থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে এলেন হরিশ। বসার ঘরের কপালে চেয়ার-টেবিল জোটেনি। একটা তক্তপোশ রাখা। বসে পড়লেন তিনি। বাপের রেখে যাওয়া এক কাঠা জায়গা। দুটো ঘর বানাতে পেরেছেন। এই হলো মেয়ের ভবিষ্যৎ। মাম্পি পড়াশোনা শেষ করে টিউশন করছে। স্বাধীনভাবে থাকতে চায়। চাকরিতে ঢোকা মানে অন্যের গোলামি। মেয়ের কথা শুনে হাসেন হরিশ।
প্রতিমা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ‘কী গো, কিছু বলছ না যে।’
‘আরে ওই মোড়ের মাথায় বসন্ত উৎসব না কী চলছে। গুচ্ছের চোঙা আর বক্স গাঁক গাঁক করছে। তার ওপর ছেলেগুলো মদ খেয়েছে বোধহয়, জামা খুলে মাথার ওপর ঘোরাচ্ছে। বলতে গেছি, এই মারে কি সেই মারে।’
ভয় পেয়ে যান প্রতিমা। ‘এত লোক পাড়ায় থাকে, কারো অসুবিধে হচ্ছে না, কাজ থেকে ফিরেই ওদের সঙ্গে লাগতে হলো তোমার!’ বরের পাশে বসে পড়লেন প্রতিমা।
বিছানা ছেড়ে নেমে এসেছে মাম্পি। ‘তুমি ঠিক করেছ বাবা। কেউ কিছু বলে না বলেই দিন দিন বাড়ছে ওরা।’
‘তুই থাম।’ মেয়েকে ধমক দেন প্রতিমা। ‘রাতবিরেতে ফিরিস। তুই কী বুঝবি আমার চিন্তা!’
এবার বউয়ের ওপর চটে যান হরিশ। ‘ওকে বকে কী হবে। দোষ তো ওর নয়। সময় আটকে পড়েছে কিছু খারাপ লোকের মধ্যে। তারা না করে গুরুজনদের সম্মান, না রাখে মাতৃভাষার মান।’
রাতের খাওয়া সেরে একচিলতে বারান্দাটায় পায়চারি করছিলেন হরিশ। সবজির আড়তে কাজ ছেড়ে চলে এসেছিলেন একদিন। সেখানে মালিক আর কর্মচারী একই শব্দ বোঝে। সেই ভাষাতেই কথা বলে তারা। হরিশ সেখানে বেমানান। কিন্তু বইয়ের দুনিয়ার লোকেরা আলাদা হবে এমন আশা কেন করছেন হরিশ! তারাও তো এই সময়ের।
ভাবতে ভাবতে ছ্যাঁকা খেলেন হরিশ। আঙুলের ফাঁকে চেপে রাখা বিড়ির আগুন।
বারান্দা থেকে একটু দূরে বাজার লাগোয়া ফাঁকা জায়গাটা আবর্জনায় ভর্তি। পুরোটায় একসময় বাজার বসার কথা ছিল। তা না হয়ে গুটিকয়েক দোকান বসে এখন। বাকি জায়গা বাজারের লোকই নোংরা করে ফেলেছে। পচা আলু, পেঁয়াজের খোসা, পোকালাগা বেগুন আরো সব জিনিস ফেলে রোজ। পাশেই একটা রাধাচূড়া গাছ। হলুদ ফুলে বৃথাই নোংরা ঢাকার চেষ্টায় সে। গাছটার নিচে জংপড়া লোহার টিউবওয়েল। বাজারের লোক জল নেয়। চাতালটা কেউ পরিষ্কার করে না। শ্যাওলায় কালচে।
হরিশ দেখতে পেলেন, কলের পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাচ্চা একটা কুকুরছানা আর একটা বেড়াল দুটো পা ওপরে তুলে লাফালাফি করছে। এদের চেনেন তিনি। এখানেই ঘোরাফেরা করে। আজ তাদের মাথার ওপর একটা কাক আর একটা মথ ছোট-বড় ডানায় হাওয়া কাটছে। কাকটাকেও এর আগে দেখেছেন হরিশ, দিনের বেলায় বেশি থাকে না; কিন্তু রাতে এসে কলটার মাথায় বসে থাকে। মথটা কোথা থেকে এলো? সে কখনো বেড়ালটার, কখনো কুকুরটার কপালে বসছে। কাকটাও যেন ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মথটাকে নকল করছে। বেড়াল আর কুকুরছানাটা তাদের ধরার চেষ্টায় আরো উঁচুতে ওঠার চেষ্টা করছে। ধাঁধা লেগে গেল হরিশ্চন্দ্রের। চোখের পাতা পড়ছে না তার। এমন তো আগে দেখেননি কখনো।
বিড়ির আগুন নিভে গিয়েছে কখন। আঙুলের ফাঁক গলে খসে পড়ল। দুটো হাত গ্রিলে ঠেকিয়ে ঝুঁকে পড়লেন হরিশ। কোনো ভাষা নেই, কোনো শব্দ নেই, তবুও কীভাবে আনন্দ পাচ্ছে ওরা! ভাষা জানা প্রাণীগুলোর শব্দ কি ওদের কানে পৌঁছয়?
কুকুরছানাটার মাথায় মথ বসেছে … বেড়ালটার মাথায় কাক …। বেড়ালটার মাথায় মথ বসেছে … কুকুরছানাটার মাথায় কাক। আবর্জনার মধ্যেও খেলে চলেছে। খেলতে খেলতে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে ওরা।