শরফুন ও এক শহরের বৃত্তান্ত

ধরমপুর-দোয়ালিয়া রেললাইন ধরে সরকারি নিচু জমি। বর্ষাকাল বাদেও সারাবছর জল ধরে রাখে এক হাঁটু। ধরমপুর কোর্ট ইস্টিশনের কাছে যেখানে শহিদবেদি দম্ভ নিয়ে দাঁড়ানো, তার পেছনে বেশ কয়েকটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ। চৈত-ফাগুনের হাওয়ায় আগুনমুখার ফুল জলে সাঁতার কাটে। মায়ের কাছে শুনেছিল শরফুন, টাকি মাছের ঝাঁক এমন লালপানা হয়ে শ্যাওলার বুকে আতিপাতি করে মুখ ডোবায়। তাই দেখে সে ভাবে, জলে বুঝি টাকি মাছের ঝাঁক। গিমা-কচু ঝোপের পাশে বসে খ্যাঙরাকাঠির মতো আঙুলগুলো ডুবিয়ে কৃষ্ণচূড়ার ফুল হাতে তুলে কানে গুঁজে দেয়। পেছনে সাগরিকা এক্সপ্রেসের ক্লান্ত ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে হুসহুস শব্দে আস্ত শরীর ঢুকিয়ে দেয় প্ল্যাটফর্মের ব্যস্ত সীমানায়।
ময়লা জামা হড়হড় করে টেনে খুলে মান্দার গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয় শরফুন। চিমসানো উদোম বুক চৈত্রের চরাচরের মতোই খাঁখাঁ। হাঁটুসমান বা কোথাও একগলা জলে কি শরীর জুড়াবে তার? খসখসে হাতের আঙুলগুলো শণের মতো রুক্ষ চুলের গোড়ায় লাঙলের ফলার মতো চষে বেড়ায়। তিরিক্ষি মেজাজে হাতের বস্তাখানা ছুড়ে ফেলে একদিকে। কামারশালার গনগনে আংরার আঁচের মতো হয়ে আছে জলের তলার ঝামা-কংক্রিটের শরীর, ভাঙা ইট-পাথরের খণ্ড। তেতে-ওঠা পৃথিবীর মতো ধরমপুরের এ-নিদাঘ দুপুরে হাঁপিয়ে ওঠা শরফুনের শরীর একটু স্বস্তি খোঁজে।
মৈশাদী থেকে রেললাইন ধরে পুঁটলি হাতে ধরমপুর পর্যন্ত প্রায় মাইলখানেক হেঁটে এসেছে শরফুন। অবশ পায়ে আজ তাকে লালে পেয়েছে। আঙুলের কড়ে গুনে রেখেছে কতগুলো আগুনমুখা মানে কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখেছে সে। শহিদমিনারের কাছে একসঙ্গে গোটাপাঁচেক বড় গাছ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। আর তখনই মনে হলো, গায়ে বুঝি জ্বলুনি লাগলো। আগুনমুখার আগুনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বিড়বিড় করল একবার : আগুন … আগুন …। তারপরই মৃদু হেসে পা ডুবিয়ে দিলো এ নিচু জমির জলের তলায়।
শহরটা বড় অদ্ভুত। কেউ বলে গম্বুজ আর মিনারের, কেউবা বলে মানুষের। মানুষ বলতে বিচিত্রসব মানুষ যারা সবসময় এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায় শ্বাসে-আশ্বাসে। দিনশেষে জীবনের যবনিকা টানে শহরের গলিঘুঁজির কোথাও কোথাও। মানুষের কোলাহলে শরফুন ব্যতিব্যস্ত হয় না। মানুষ হয়েও বিচিত্র মানুষদের থেকে সে আলাদা। ওর মুখে ভাষা নেই, মনের ভেতর শুধু বিড়বিড়ানির ঝড়। ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।’শরফুনের বচন মনে পড়ে। তাই সে দিগভ্রান্ত হয়ে শহর চরে বেড়ায় – যথা ইচ্ছা তথা যা। তাতানো দুপুরে শহরের বিচিত্র মানুষের সামনে উদোম বুকে গা ভেজাতে নামে।
ধুস, একটু হলেই পিছলে … সাবধানে আরো সামলে …
নামতে গিয়ে ঠোক্কর খায়; পায়ের নিচে ভাঙা শামুক, ইট-পাথরের ধারালো খণ্ড, পিছলে ওঠা শ্যাওলার পুরু জাজিম। চারদিকে ঝাঁঝালো রোদ্দুর। বিরক্তি ওঠে বেড়ে। কালো পিচ রাস্তায় জলের মরীচিকা। সে-মরীচিকা থেকে ধেয়ে আসে অগুনতি লোভচালিত তামাটে মানুষ। এরা চলতে গিয়ে রিপুর গন্ধ খোঁজে।
ঢোলকলমির ডগায় বসা কালো ফিঙে লেজ উঁচিয়ে শরফুনের শরীর দেখে। খাঁ-খাঁ রুক্ষ শরীর, তবু নারী তো! হেঁটে যাওয়া কয়েকজন শরফুনের শরীর দেখে না, দেখে তপ্ত দুপুরে পদ্ম ফুটেছে যেন। গরম জল, তবু তার স্বস্তি লাগে। পরনের সায়া তুলে ধরে হাঁটুর আরো ওপর পর্যন্ত। শরীর ঠান্ডা হোক আগে। কলমি-শুশনি-হেলেঞ্চার ঝোপের আড়াল থেকে উড়ন্ত ফড়িং তার বুকে হামাগুড়ি দেয়, চোখকুণি মাছ সুড়সুড়ি দেয় খরখরে ঊরুতে।

দুই
দুলাল হাজী চালের কারবারি। কোর্ট ইস্টিশন ছাড়িয়ে লোহার ব্রিজ পেরোলে পালের বাজার। ওখানেই তার পুরনো আড়ত। একসময় তার আড়তে মুনিশ খাটত শরফুনের সোয়ামি তোরাব। দিনে-রাতে দু-বেলা অটো রাইস মিল থেকে যে-চালের বস্তা আসত তাই মাথায় তুলে ট্রাক থেকে নামানো আর গদিঘরের ভেতর পালা করে সাজানো। এই ছিল কাজ।
মাঝে মাঝে শরফুনও দু-হাতে কাজে লাগত তোরাবের সঙ্গে। বস্তার দড়ি ফেঁসে আলগা যে-চাল মেঝেতে গড়াগড়ি দিত তাই ঝাঁট দিয়ে তুলে আলাদা কোঁচড় ভরত শরফুন। দুজনের দিব্যি চলে যেত এক-আধবেলা। কখনো জোগান বেশি হলে আলাদা বস্তায় গুছিয়ে-বাড়িয়ে নিত মহাজনের আড়ালে।
তোরাবের হিসাব সরল টনটনে। মাঝে মাঝে মেটে ইঁদুরের নাম করে দু-চার সের আলাদা সরিয়ে রাখত সে। শরফুনের কাছে গছিয়ে দিয়ে বলত, যা, বাজারের পেছনে এগুলো বেচে দিয়ে আলু-বাইগুন নিস। খুব শখ হলি সুবলের দোকানে খাতির করে কয়েকখানা মরা মাছ চেয়ে নিস। জানিস তো, পেছনের বাজারের নষ্ট-পচা সবজি মাল সবই সস্তায় সের দরে বিকোয়।
শরফুন চুপ থাকলে শাসিয়ে জানায়, একটু বুদ্ধি খরচা করে চলিস মাগি। অমন বস্তায় ভরে পেট উঁচু করে বেরোতি দেখলে মাহাজন কাজে ছাড়ান দেবে। পথে সাবধানে যাবি। খবরদার, বিশ টাকার কমে বেচবিনে। মাহাজনের চোখি পড়লে পায়ে চক্কর খেয়ি কাঁদবি।
সোয়ামির কথা বড় বাধ্য হয়ে শোনে শরফুন। আঁচলের তলে কোঁচড় ভরা কাঁড়া-আকাঁড়া চালের বস্তা ভরপোয়াতির মতো দেখায়। আর শোন, ফিরার পথে উত্তমের দোকান থিকে আমার জন্যি এক প্যাকেট ইস্টার সিগ্রেট লিয়ে নিবি।
শরফুন সুড়সুড় করে আড়তের পেছন দরজা দিয়ে বাজারের ভিড়ে হারিয়ে যায়। মহাজনের ভয়ে সামনের দরজা ধরে না। সোয়ামির কথা বারবার মনে হয় … একটু বুদ্ধি খরচা করিস মাগি। শরফুন কি বুদ্ধি খরচা করে না? গেল বুধবার হাটে যাওয়ার আগের দিন নারায়ণের শানঘরে গিয়ে বাটখারার পোঁদ অনেকক্ষণ ধরে ঘষেছিল। ওজনে একটু কম হলে প্রতি পাল্লায় দু-মুঠো চাল খোরাকির জন্য তুলে রাখা যাবে। মাঝে মাঝে আর উপোস থাকা লাগে না। কিন্তু, তবু শরফুন উপোস থাকে। ডাঁই করা চালের বস্তার গন্ধ শুঁকে শুঁকে সে উপোস থাকে দিনের পর দিন।
উফ … মাগো … কী আগুন! জলে গলা ডুবিয়ে কৃষ্ণচূড়ার আগুনদেহে তাকিয়ে শরফুন বিড়বিড় করে। জলার ধারের কংক্রিটের বিছানো পথে দাঁড়িয়ে লোকজন উঁকি দেয়। শরফুন গা করে না। ওই তো … খাল পেরোলেই শহিদের উঁচু বেদি। তারপর তা পার হয়ে কালীবাড়ি ছাড়ালে ধরমপুরের লোহার পুল। ওদিকেই তো ছিল দুলাল হাজীর গদিঘর, পালের বাজার। সব কথা মনে পড়ে শরফুনের। এই যে ফাল্গুন-চৈত্রের হুতাশন, পাঁকানো জলে থম-ধরা-হাওয়া সেও তো শরফুনের মতো চোখে-মুখে-বুকে কথা ধরে আছে। মানুষজনের মুখে তাকিয়ে ধাঁধা লাগে তার চোখে।
খোঁচা-খোঁচা শামুকের ধার পায়ে বিঁধে যায়। শিংয়ের পোনা হুল ফোটায় শরফুনের খরখরে পাঁকানো শরীরে। আহ্! কী সুড়সুড়ি গো! পেটে বাঁধা পাঁচ সেরির ভারে একটু পরপর হাঁপি লাগে। অবশ হতে চায় শরীর। বদ্ধ জলা ডিঙিয়ে পাথরের বাঁধানো বেদিতে ভেজা গা নিয়ে বসে শরফুন। ওপরের আগুনমুখা গাছ হাঁ করে চেয়ে দেখে তার ভেজা শরীর। বাঁধানো পেটে হাত দিয়ে ভাবে, বাচ্চাটা খালাস হলে এবার তালমিছরি গোলা জল খাওয়াবে নইলে সরষের মধু। আগের বাচ্চাটা কীভাবে মরল তা শরফুনের ঠিক মনে পড়ে না।

তিন
ধরমপুরের বড় ইস্টিশন সেই প্যাঁচানো ব্যস্ত নদীটার ধারে। কী বিশাল তার প্ল্যাটফর্ম, আকাশজোড়া লোহার ছাউনি। ওখানে বড় বড় রামছাগলগুলো চরে বেড়ায়। কলার খোসা, কাঠবাদাম, কাঁঠাল পাতা যখন যা পায় তাই খায়। শরফুনের মতো। ও দেখে, মানুষদের মতো এ-শহরে কিছু গরুও ঘুরে বেড়ায়। স্বাস্থ্যবান, নোংরা, তবে বেওয়ারিশ। শহরের নোংরা উপচেপড়া ভাগাড়ের কাছে খাবারের খোঁজে এদের ঠাঁই। শরফুনের মাথা ঘোরে, শূন্য পেটে খিদে চাগাড় দেয়। সেও কি ওখানে যাবে? শণ প্যাঁচানো জটা চুল ছাড়িয়ে অমন একটা পাহাড়সমান আবর্জনাস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে সেও তো বেওয়ারিশ। তাদের দলে যে সাদাকালো গাভিটা আছে তার মতো সেও।
ডান হাত দিয়ে নোংরা বোতামহীন ছেঁড়া জামার ভেতর হাত গলিয়ে দেখে তার মাইগুলো ঠিকঠাকমতো আছে কি না? গতকাল থেকে বুকের বাঁপাশের মাই ফুলে বড্ড টনটন করছে। হাত দিয়ে মাংসল পিণ্ডটা বের করে আনে একবার। কামড়ের দাগ বসানো। খিকখিক করে হাসতে গিয়ে মুখটা কুঁচকে আসে আবার। গা ঘিনঘিনে শরীরে তপ্ত দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদ্দুর। সকলেই জানে, শহরটা সুউচ্চ মিনার আর সুরম্য অট্টালিকার মতো আলো-ঝলমলে গম্বুজের।
আগের বাচ্চাটা মরেছিল ছ-মাসের মাথায়। কোমরে তাগা হাতে মাদুলি বেঁধে রাস্তি শাহের দরগায় মানত ঠুকে চেয়ে নিয়েছিল খোদার কাছ থেকে। দুইজনার সংসারে আরেকখানা নতুন মুখ। দুলাল হাজীর আড়তে কাজ করে ততদিনে কিছুটা অবস্থা ফিরেছিল তোরাবের। তবু দুধের বদলে একদিন আটা গুলে মুখে দিয়েছিল তালমিছরির সঙ্গে। সইতে পারেনি। দুদিন পেট ছাড়ল টানা।
সদর হাসপাতালের আউটডোরে লাইন দিয়ে কাজ ফেলে বারান্দায় বউকে নিয়ে শুয়েছিল তোরাব। কিন্তু, পেট আর ধরল না। একদিন বিকেলে বাচ্চার কচি বুকখানার পাঁজর কখানা হাঁপরের মতো ওঠানামা শুরু করলে তোরাব আছাড়ি-পিছাড়ি করে। ফিরে এসে যখন সোনার কাছে গেল কয়েকটা নীল ডুমো মাছি ভনভন করছিল মুখের ওপর। খোদার কাছ থেকে চেয়ে আনা মানিক দুদিনেই শেষ। মনের দুঃখে শরফুন তখন মিটমিটিয়ে হাসে।
সে খোকনের বাপ ছিল দুলাল হাজী। একদিন সন্ধ্যায় কী যে হলো, হলুদ ডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে রোজকার মতো শরফুন এসেছিল আড়তে। সন্ধ্যাবেলা ট্রাক আসার কথা ছিল মালেকের অটো রাইস মিল থেকে। ওটাও শহরের অন্যধারে বিসিক না ফিসিক কী যেন বলে ওখানে। শরফুন শুনেছে। পালের বাজারের ভিড় ঠেলে আসতে ম্যালা রাত হয়ে যায়। মহাজনও ছিল তার গদিতে। এশার ওয়াক্ত সম্পন্ন করে ঝিমুচ্ছিলেন তিনি। তাকে চা-পানি এগিয়ে দিয়ে, দোকান ঝাঁট দিয়ে, বস্তা থেকে ছড়ানো চালগুলো ঝাড় দিয়ে আলাদা করে রেখেছিল শরফুন। দু-একবার চোখ উঁচিয়ে তাকিয়েছিল দুলাল হাজী। শরফুন গা করেনি। তোরাবসহ আড়তের বাকিরা কোথায় জানি গিয়েছিল। বাজারের বিদ্যুতের খাম্বায় হঠাৎ বিকট শব্দ। কোথায় নাকি গণ্ডগোল হয়েছে। তারপর বিজলি বন্ধ।
শরফুনের এসব ভাবলে বুকের ধুকপুকানি বাড়ে। আবছা অন্ধকারে দেখে, একটা কালো শকুনের ছায়া। আতরের এক দমক ঝাঁঝালো খোশগন্ধ – মানে চোখে সুরমা লাগানো দুলাল হাজী। নধর চাঁদখানা কাস্তেচরা পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা হচ্ছিল কদিন ধরে। বাকিসব ঠিকঠাকমতোই ছিল। তার পাঞ্জাবির গায়েও আতরের কড়া সুবাস, মুখে-চুলেও তাই। দুটি শক্ত হাত সোনালতার মতো জাপটে ধরে এক হাত মুখ চাপা দেয় তার।
হাতে এক আনা-দু আনা পয়সা নয়, চকচকে টাকার গন্ধ। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল – লোভ দেখিয়েছিল – কিছু কসনি শরফুন, অনেক টাকা দিবানে। তোর মন চায় যত, চাল নিয়ে যাস ঘরে। তারপর বুকে জাপটে ধরতেই ডুরে শাড়ি গড়াগড়ি খায় হাতে। শরফুন তখন একরত্তি চড়ুইছানা।
টাকা নয়, আমায় ছেড়ে দিন। তোরাব জানতি পারলে …
… ঘণ্টা করবে।
আস্তে আস্তে হাজী সাহেবের দু-হাত শরফুনের মাই চেপে ধরে, দলাইমলাই করে শরীরে শরীরে ঘর্ষণ তোলে অনেকক্ষণ, আগুনমুখার আগুন তোলে। সে-আগুনের হলকা নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে শরফুনের ঘাড়ের কাছে আছড়ে পড়ে। শরফুন চেঁচালে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে – এমন হুমকিও দেয় হাজী। সে চুপ করে যায়। তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত আকাশে আর চাঁদ দেখেনি শরফুন। অন্ধকার চোখে সয়ে গেলে সায়ার গিঁট বেঁধে নেয়। তারপর বুকের আঁচল ঠিক করে টাকা হাতে বের হয়ে এসেছিল শরফুন।
কাকের বাসায় কোকিলের ছা। চুপ থেকে থেকেই কোকিলের ছা-টা পেটে বাড়ল। আর সেই উঁচু পেটে হাত বুলাতে বুলাতে তোরাব কান পেতে বলত, আমার ব্যাটার পজিশন কী তাই মালুম করছিরে মাগি। দাঁড়া আগে দেখি, ওর বুকের ধুকপুকি কেমন শোনা যায়! তুই কি শুনতে পাচ্ছিস ওই ছোট্ট যন্তরটার শব্দ? ভয়ে নিজের ভেতর আরো সেঁধিয়ে যেত শরফুন। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখে কোনো রা কাড়ত না আর। ওদিকে ফিসফিস করে একমনে কথাই বলে যেত তোরাব।

চার
একটা কমলা রঙের রোদ সারাদুপুর শরফুনকে বিবশ করে রেখেছিল। সেটা মিইয়ে এখন ঘিয়ে রং হয়েছে। কেমন মোলায়েম, মাখনের মতো। হাওয়াও দিচ্ছে ফুরফুরে। সাদা বেদির শক্ত চাতাল একটু শীতল হয়েছে। চোখ যায় ওপরের আগুনমুখার ছায়ায়। পাঁচখান স্তম্ভ কেমন সেজদা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখপানে চেয়ে। নিরুত্তর, ভাষাহীন। দেখে শরফুনের ভালোই লাগে। কারণ দীর্ঘকাল ধরে সেও তো শহরের ইট-পাথরের মতন অমন বোবা হয়ে আছে।
দুলাল হাজীর আড়তের সে-ঘটনার কয়েকদিন বাদে ট্রাক থেকে উলটে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল তোরাবের। মহাজন তাকে কাজ থেকে ছাড়ান দেয়। আর পাঁচ কান হওয়ার ভয়ে হাতে কিছু টাকা গুঁজে শরফুনকেও দূর-দূর করে খেদিয়ে দিলো হাজী। সরকারি অফিস হতে চেয়ে-চিন্তে কয়েক বান টিন জোগাড় করে দুলালীর চরে যে-ঘর ছেয়েছিল একচালা, সেটাও চলে গেল সেবার মস্ত নদীটার ক্ষুধায়। বেনো জলের হু-হু থাবা গুটিয়ে গেলে মাঠের কচু-ঘেচু সব মরে সাফ। শাপলা-শুশনি-কলমি কিছুই নেই খেয়ে বেঁচে থাকার। শরফুনের শরীর শুকিয়ে হলো ইন্দুরের মতো।
সারাবিকেল শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেয় শরফুন। ওখান থেকে উঠে কাঁচা রাস্তা ধরে আশ্রমের দিকে এবার এগোয়। মোলায়েম হাওয়া দিচ্ছে। একটা সাদা বক ঢ্যাঙা পায়ে কোত্থেকে উড়ে এসে বসে খালের ধারে। যা, হুস … দূর হ। সাদা দেখে শরফুনের গা গুলায়। মাথা ঘোরে। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ে। গাছগাছালির ছায়া কম আশ্রমের কাছে। শুধু মানুষ আর মানুষ। এরা কী খোঁজে? তবু এখানেই তালগাছে ঠেস দিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ে শরফুন।
তোরাবের নিরুদ্দেশের পর প্ল্যাটফর্মের বটতলার নিচে পলিথিনের ঝুপড়ি তুলে প্রথমে ঠাঁই নিয়েছিল শরফুন। কী আশ্চর্য, চারদিকে কত অজানা মানুষে ভর্তি। তারাও শরফুনের মতো ঠাঁই নিতে এসেছে এখানে-ওখানে। নদীর ধারে ইস্টিশনের কাছে কীসের জন্য জানি বড় বড় লোহার চোঙ এনে রাখা হয়েছিল। সেখানে অনায়াসে দুপাশে ছালা টানিয়ে শরফুনের স্থায়ী সংসার শুরু হলো আবার। সেখানে বুকের ধুকপুকানি, কথার ফিসফিসানিতেও কেমন গমগম করে শব্দ হতো। ভয় ছিল একটাই, চোঙটা যদি গড়িয়ে যায় নদীতে?
তোরাবহীন শরফুনের উচ্ছন্নের জীবনে একটা অনির্দিষ্টতা লেপ্টে ছিল বরাবর। ছিল শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার শংকা, ভয়, অনিরাপত্তা। রাতের বেলা প্ল্যাটফর্মের এ-মাথা ও-মাথা যখন রেলপুলিশের সেপাইগুলো হুইসেল ফুঁকে চলত কখনো দু-একবার উঁকিও দিয়েছে শরফুনের লোহার চোঙে। ছালা সরিয়ে কাছ ঘেঁষতে চেয়েছিল একটু খাতির করে। সেদিনও সে মুখে কোনো রা কাড়েনি।
চোঙের ধারেই একদিন তাহাজের সঙ্গে আলাপ। সঙ্গের ইতরটার নাম মনে নেই। দুটোই জিআরপির সেপাই। শরফুন এদের মুখ চেনে। দিনের নীল পোশাকে তাদের দেখে বরাবরই ডর করত তার। সেদিন সে নদীর কুঁচো চিংড়ি, কলমির কচি ডগার সঙ্গে একটু নুন-লংকা ছিটিয়ে সেদ্ধ করছিল মাটির উনুনে। কখন যে তাহাজ আর সঙ্গের ঢ্যাঙা চামচাটা এসে চোঙের ধারে দাঁড়িয়েছে শরফুন টের পায়নি।
মুখে শিস দিয়ে তাহাজ বলে, কীরে নাম কী তোর? নতুন দেখছি এখানে।
শরফুন রা কাড়ে না।
ফিচিক করে তারপর ফোড়ন কাটে ঢ্যাঙাটা; সরকারি চোঙে থাকিস – আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে সংসার পেতেছিস। ভাতার আছে, নাকি রাত হলে খেপ দিস?
ঠিক তখনই দুলাল হাজীর কথা মনে হয়। আর কী যেন হয়! শরফুন চেঁচিয়ে ওঠে। হারামির পো … মেয়েছেলে দেখলে গা চুলকোয়। আমারে ক্যান বিরক্ত কইরছিস? দূর হ, এইখান থেকে।
থাম। চিল্লাচিল্লি করে মেজাজ খারাপ করাসনে। সোজা হয়ে যাবি। বুকের কাপড় সরিয়ে খুব ফাল পাড়ছিস। চল আজ, কাইল দেখবনে মাগির জেদ।
তারপর লাঠি দিয়ে শরফুনের দলা পাকানো পুঁটলিতে খুঁচিয়ে খিস্তিমুখে চলে যায় দুজন যেদিক থেকে এসেছিল তার উলটোদিকে।
শরফুনের বুক ঢিপঢিপ করে, বুকের ভেতর কে যেন খামচায়। প্ল্যাটফর্মের ঠিকরে আসা আলোর মাঝেও প্রবল অন্ধকার ঝুপ করে এসে পড়ে লোহার চোঙঘরের বাইরে-ভেতরে। নদীর ধারের নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে দুটো কুকুর ডেকে যায় ঘেউ ঘেউ … ঘেউ ঘেউ … ঘেউউউ …

পাঁচ
অযাচক আশ্রমের উলটোধারে নেশায় পাওয়া তালগাছের নিচে পিঠ ঠেকিয়ে সেই কখন থেকে বসে আছে শরফুন। ঝিম ধরে মাথা নিচু করে। একটা নেড়ি কুত্তা ওর হাতের পুঁটলির কাছে বারবার নাক এনে শুঁকছে। ঘষছে। দুজন সাধুপুরুষ আশ্রমের গেট ডিঙিয়ে ওর পাশ ধরে নিরুত্তাপ হেঁটে যায় – যেন শরফুন কেউ নয়।
আজ যেন বোবায় পেয়েছে সকলকে। আগেই বলেছি শহরটা উঁচু উঁচু ইমারতের, বিচিত্রসব মানুষের আর তাদের রিপু দমনের সাময়িক করণকৌশলের পবিত্রতম মিনারের – কাচকাটা সুদৃশ্য গম্বুজের। বিকেল গড়িয়ে হুড়মুড় সন্ধ্যা নেমে যায়। শরফুনের ধ্যান ভাঙে না।
আগসন্ধ্যার আকাশে কাকেদের হল্লা। তাদের চিৎকারে ঘরে ফেরার জন্যে আনন্দ নাকি দুঃখ ঠিক বোঝা যায় না। ঝিমিয়েপড়া সন্ধ্যার মধ্যেও কেবল সুনসান হাহাকার। ওই যে আজান হয়ে গেল, ওতেও কি দুঃখ?
তলপেটের কাছে হাত দিয়ে সে তার খোকার নড়নচড়ন টের পায়। চনমন করে ওঠে পেট। মন চায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে তক্তাপোষে তোশক পেতে শোয়। লোহার চোঙের ভেতর যে সংসার ছিল – চোঙের জীবন, ওখানে আর যেতে চায় না শরফুন। ঘুম আসে না। শরীরে খিঁচুনি এসে পেটটা টনটন করে ওঠে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় মুখ। চোখ বন্ধ করে। সারাশরীরে শিরশিরানি খেলে যায়। রোম খাড়া হয়। ঘামে অবশ হয়।
ধ্যান ভেঙে চারদিক তাকিয়ে একটু নিরাপদ জায়গা খোঁজে। নেড়িটা গন্ধ শুঁকে চলে গেলে মাথার নিচে পুঁটলিটা রেখে শরফুন সটান শুয়ে পড়ে। হঠাৎ যন্ত্রণায় পা দুটো খালি ধুলোয় ঘষে, দু-পা চেগিয়ে দু-হাতে খামচে ধরে একরাশ দূর্বা। এ-যন্ত্রণা কীসের? গর্ভবেদনা নয় তো?
সেই রাত্তিরে জিআরপির ঢ্যাঙা সেপাইটা হুমকি দিয়ে যাওয়ার একদিন বাদেই শরফুনের ওপর হামলা হয়েছিল। সে-রাতের বৃত্তান্ত দেখেছে লোহার ধুমসি বগিগুলো; আর নির্ঘুম প্ল্যাটফর্ম, বুড়ো বটের পাতা, ধরমপুরের আকাশ-বাতাস-নদী-তারা। চোঙের ভেতর হঠাৎ টর্চের আলো এসে পড়ে, আলো থির হয় ওর চোখের মধ্যে – বুকের মাঝে। ধস্তাধস্তিতে চিনেছিল মুখ, আলোয় দেখেছে ধারালো ছোরার ফলা। সেই রাত্তিরের বিছুটির জ্বালা, নখের আঁচড়ের খামচির জ্বালা, আজ দুপুরের শিংয়ের গুঁতো সব একাকার হয়ে আছে শরীরে। শরফুনের লাজ ছিল না সেদিন। রাতে ফোটা শালুকের মতো শেষে শরীর ধুয়ে এসেছিল নদীর জলে ডুব দিয়ে। ফিরে এসে কেঁদেছিল ভেউ ভেউ করে। ও পরানের সোয়ামি গো … আমায় মাফ দিস গো …। আর ভাবছিল সমগ্র চরাচরজুড়ে অনন্ত অন্ধকার নেমে আসুক, যেন কেউ তার কান্না দেখতে না পায়।
দু-পায়ে রাজ্যের শক্তি এনে চ্যাগানো পা দুটো সোজা করে আবার উঠে বসে শরফুন। কাছাকাছি টঙের ধারে বেশকিছু লোকজন নিচু স্বরে কথা বলছিল। কানের ভেতর শ্রবণশক্তি থম ধরে গিয়ে তার চারদিকে অসার নিস্তব্ধতা নেমে এলেও এদের কথা শুনতে পায় সে। এদের সে প্রায়ই দেখতে পায়। শহরের জ্ঞানী মানুষেরা ফিসফিসিয়ে আড্ডা দেয় এখানে। কাছ দিয়ে দুজন মানুষ চলে গেল। এরা শহরের বড়কর্তা। কারণ এদের দেখে বাকি সকলে বেশ সমীহ করে।
যন্ত্রণায় গোঙাতে গিয়ে শরফুনের ডাক নিচু হয়ে যায়। তাই কেউই তার ডাক শুনতে পায় না। ওগো আশ্রমের সিদ্ধপুরুষ, কাতারভাঙা ধ্যানমগ্ন মুসল্লি, শহরের জ্ঞানী মানুষ অথবা মুখোশপরা রক্ষাকর্তা – কে কোথায় আছো গো, আমার খোকা আসছে পৃথিবীতে। ওগো এক পায়ের তালগাছ, তোর দুটো আঁটি পুঁতেছি সেই লোহার চোঙের ধারে। এক পুরুষে রোপে তাল, অন্য পুরুষে করে পাল, তারপর যে সে খাবে, তিন পুরুষে ফল পাবে। আমার খোকাকে সেই তালমিছরির জল খাওয়াব …। ওগো, খালের জল, তুই তো নদীর ছা; ওগো দখিন হাওয়া, তুই কি এক ছিলিম বয়ে যাবি নিরুদ্দেশে? আমার সোয়ামি যেখানে আছে। আমার খোকা আসছে। একটু খবর দিবি গো …
কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যার এক্সপ্রেস ট্রেন ইস্টিশনের দিকে ছুটে যাবে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে তখন শরফুনের নোংরা কালো সায়া কোমর থেকে খসে পড়ে। পা দুটো জড়ো করে বুকের কাছে টেনে এনে এবার সে দাঁড়িয়ে গেল। যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে হলো, যন্ত্রণায় কয়েক খণ্ড হয়ে যাবে শরীর। তলপেটে ধপধপ লাথি পড়ছে। শরীরের সুড়ঙ্গপথে এক অচেনা মানুষের মতো ওর খোকার আগমন। দূরে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলে শহরের সকলে দেখল পুব দিক থেকে একটা ধাঁধানো হলুদ আলো শরফুনের শরীরে এসে পড়ছে। গম্বুজ-মিনারে ঢাকা শহরের বুকে তার বেঢপ নগ্ন শরীরটা সেদিকেই ছুটছে।