শহিদ কবির : কামনা ও মায়ার খেলা

মইনুদ্দীন খালেদMainuddin Khaled.

বিষয়ের সঙ্গে শিল্পীর আত্মিক সংযোগ না থাকলে শিল্পে সত্য প্রতিষ্ঠা পায় না। শহিদ কবির একথা বিশ্বাস করেন। যে-বিষয় তিনি অাঁকেন তার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের জানা-শোনা ও ওঠাবসা চলে। কবিরের ভাবনার গর্ভে বিষয়টা বেড়ে ওঠে। এজন্য তিনি এসব যন্ত্রণায় কাতরান। সবশেষে শিল্প যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন তার মধ্যে আমরা দেখি মাতৃগর্ভের রক্তিম, পিচ্ছিল, ঘন দেহরস লেপ্টে আছে। সদ্যপ্রসূত সজীবতার বিস্ময় আছে কবিরের শিল্পে।

বড় শিল্পীরা সত্য প্রকাশের ঝুঁকি নেন। তথাকথিত ভব্যতার চাদরে আড়াল করে বিষয়কে তাঁরা চোখ-জুড়ানো শান্তির মতো করে প্রকাশ করেন না। দুঃসহ দুঃখের মানব-অস্তিত্বে যে প্রদাহ হয় এবং বিপুল সুখে হৃদয় যখন উত্তুঙ্গ পাহাড়ে চড়ে তা-ই কবির প্রচলিত ভাষাকে উপেক্ষা করে খুলে বলতে চান। কোনো কুণ্ঠাবোধ তাঁর হৃদয়কে আটকাতে পারে না। তাই তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে পাক-খাওয়া সর্পিল রেখায় এবং দেয়ালের পলেস্তারার মতো বর্ণচাপরে। রেখার ললিত বিস্তারে না গিয়ে এবং বর্ণসুষমার শোধিত সুচিক্কণ রূপের বিপরীতে থেকে আবেগের খরবেগে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন কবির। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীচূড়ামণি ক্লদ মনে সুদীর্ঘ জীবনের শেষ উপলব্ধিতে ঝুলেছিলেন, বর্ণ থেকে উৎসারিত আলো সত্যের এক পিঠ দেখায় মাত্র, কিন্তু পুঞ্জীভূত বর্ণদামে হৃদয়ের অন্তর্গত সমাচ্ছন্ন বোধগুলো আরো প্রকট ভাষা পায়। কবির মনেকে বারবার প্রণতি জানিয়েছেন, মনের আঁকা ছবি বিনির্মাণ করে। এ-শিল্পী ছবির নাম রেখেছেন ‘মনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য’।  ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য-বিরচন’ কবিরের শিল্পীমনের এক বিশেষ প্রবণতা। তিনি আরো অনেক মানুষকেই ছবি এঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শুধু চিত্রশিল্পী নয়, লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্ত এবং লোরকা-নেরুদাসহ আরো অনেক সাধকের বাণী ও সুর কবিরের ভেতরের আগুনকে উসকে দিয়েছে। তাঁদের গানের কলি, কবিতার পঙ্ক্তি ছবির গায়ে লিখে দিয়ে নিজের চিত্রভাষার মাত্রা প্রসারিত করেছেন তিনি।

তবে মনেতে স্থির থাকেননি কবির। যেহেতু বোধগুলো তাঁর উজিয়ে আসে – পরিমার্জনাহীন ভাষা পেতে চায় – তাই এক্সপ্রেশনিজম হয় শিল্পীর গন্তব্য। এক্সপ্রেশনিজম তাতানো- চৈতন্যের কথা বলে। এই ইজম কোনো কিছু লুকাতে চায় না। দুঃখকে সত্যনিষ্ঠ করে জোরাল ভাষায় প্রকাশ করে। দৃষ্টি যখন বস্ত্তর ওপর নিক্ষিপ্ত হয় তখন মুহুর্মুহু চাবুকপেটার মতো রেখা অথবা অসংখ্য সর্পিণীর মতো ধাবমান রেখায় ছবি হয়ে যায় তপ্ত-অস্তিত্বের স্বরলিপি। ওই জ্বালার আগুনে প্রজ্বলিত অন্তর কঠিনকে গলিয়ে করে তরল এবং সেই তরল দাহ্য বলে সৃজনস্পৃহায় তাতে আগুন ধরে যায়, আবার নরম তরলকে পুড়িয়ে কয়লাও বানিয়ে ফেলে সৃজন-তাপিত সেই অন্তর। এই রসায়ন আমরা দেখি ভ্যান গঘের ছবিতে। ভ্যান গঘ নামক আশ্চর্য শৈল্পিক মশালের আলোয় নিজেকে পোড়াতে চেয়েছেন শহিদ কবির। তারপর এই রীতির আরো নবীন সাধকের সাধনার পথ মাড়িয়েছেন শিল্পী। স্পেনীয় তাপিয়েজের ক্যানভাসে কাতালানের মাটি লেপে দেওয়ার কৌশল, বারসেলোর রঙের বিরামহীন প্রয়োগে বস্ত্তকে পুঞ্জীভূত রঙে প্রকাশ এবং জার্মানির কিফারের মিশ্রমাধ্যমে রচিত যুদ্ধরত স্বদেশের নিরুদ্ধ রোদনময় স্পেস, এসবই কবিরকে শিল্পে নতুন দিগন্ত খুঁজে পেতে সহায়তা দিয়েছে। এই শিল্পীদের নিও-এক্সপ্রেশনিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

নদী-নালা, বিল-ঝিলে আর ঝাড়-জঙ্গলের বাংলাদেশের জীবনের যে এক নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব আছে তা জয়নুলই প্রথম জানান দিয়েছিলেন কৃষি-বাংলার নানা দৃশ্য এঁকে। প্রকৃতিতে সংগ্রামশীল কর্মিষ্ঠ জীবনকে জয়নুল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কাদামাখা জীবন তিনি বলিষ্ঠ রেখায় এবং স্বল্প রঙের প্রয়োগে নাঙ্গাভাবে প্রকাশ করেছেন। জয়নুলের মতোই এ-শিল্পী মসৃণতার বিপরীতে গিয়ে প্রকৃতি ও জীবনের প্রখর সজীবতাকে উচ্চকিত করে প্রকাশ করেছেন। জয়নুলের গভীর আস্থা ছিল গ্রামবাংলার জীবনের প্রতি। যে-জীবনের সঙ্গে আজন্ম বেড়ে উঠেছেন তিনি সে-জীবনই ছিল তাঁর শিল্পের উৎস। এজন্যই তাঁর শিল্পে সত্যনিষ্ঠ সুন্দরের প্রকাশ এমন সচ্ছল হয়েছে। কবিরও যে-বিষয়ের সঙ্গে বসবাস করেছেন তাকেই অাঁকতে চেয়েছেন। সঙ্গলিপ্সা তাঁর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রবল। ক্ষুধা, কাম ও মমতা রসের সংমিশ্রণে প্রকৃতি ও মানুষের দেহ বিশ্লেষণ করলেও কবির শেষ পর্যন্ত খুব বেশি ব্যক্তিক; বিশেষ এক অন্তর্গূঢ়তার মর্মর আছে তাঁর কাজে। চুম্বনে-আলিঙ্গনে-সঙ্গমে নখ-দন্তের আশ্লেষে বিক্ষত মানব-চৈতন্যের এক দশা রূপায়িত হয়েছে কবিরের শিল্পে। অবচেতনের অন্ধকার গুহায় ঢুকে গিয়ে এ-শিল্পী প্রাগৈতিহাসিক নিয়মে আদিম কামগন্ধময় সত্তার স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছেন তাঁর কাজে। তাঁর কামনাও আদিম, মায়া-মমতার বোধও আদিম। তিনি টোটেমিক ধ্যানে মাটি, জল ও আকাশকে পূজা করেন। একই সঙ্গে ফুল, শিশু, নারী, যৌনতা, দারিদ্র্যস্পৃষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং তুচ্ছকে আদর করেন, ফেলনাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। যাকে কবির চেনেন না, জানেন না, তাকে তিনি কখনো অাঁকেন না। তাঁর পক্ষে তাকে শিল্পরূপ দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা বিষয়ের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কটাই কবিরের শিল্পের উপজীব্য। শিল্পের এই রসদ তিনি কুড়িয়ে আনেন অনেক কষ্টে বেড়ে ওঠার লতার শীর্ষদেশের পুষ্প থেকে, শিশুর নিষ্পাপ মুখ মায়ার তুলিতে ছুঁয়ে-ছেনে, পথবাসী সর্বহারা সংক্ষুব্ধ বৃদ্ধের দুচোখের আগুন থেকে, প্রান্তবাসিনী রূপবালার মাংসল ঠোঁটে রঙিন রসসিক্ত তুলি ছুপিয়ে, তেরছা চোখে তাকিয়ে থাকা আনত নারীদেহের স্তনের গুরুভারের জৈবিকতা পুরুষালি কামনার তুলিতে পরখ করে।

কবির মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। মধ্যবিত্ত একধরনের পরিশীলিত রুচি নিয়ে জীবনযাপন করেন। কবির এই রুচিকে কারসাজি মনে করেন। রুচির ওই পরিশীলনে জীবনের সত্য আড়াল করা হয়। তাই মুখোশ খুলে ফেলে প্রান্তিকজনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন শিল্পী। তাঁর ছবির মডেলরা বস্তিবাসী নারী, চরবাসী হতদরিদ্র নদীভাঙা উদ্বাস্ত্ত, আত্মীয়পরিজনহীন জন্ডিস আক্রান্ত একটি একা মানুষ, পাপপঙ্কিলতামুক্ত এক সরলা গারো বালিকা, কাঠমান্ডুতে দেখা এক বিহারি শরণার্থী, বীণা নামের যৌনকর্মী প্রমুখ। এসব প্রতিকৃতি রচনার সময় কবির মানুষের প্রত্যঙ্গের বিশেষ জায়গা ডাগর করে প্রকাশ করেছেন। যৌবনভারে আনত বিহারি শরণার্থীর ছবিটির ভরকেন্দ্র তার স্তন, রূপবালা বীণার পুরু লাল ঠোঁট কামনার এরিয়েল, বস্তিবাসী নার্গিসের ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে নিতম্ব ও উত্থিত স্তনের ভারসাম্য বিশেষ মনোযোগে অাঁকা হয়েছে। গারো বালিকার পুরো অবয়বটাই অমল মনের স্বচ্ছ দর্শন।

কামার্ত কবির আবার সেবকের মনোভঙ্গিও প্রকাশ করেন। তিনি ফুলকে শুধু ভালোবাসেন না; আহত ফুলগাছের সেবা-শুশ্রূষার জন্য গভীর গরজ আছে তাঁর মনে। আপন কন্যার একটি ফুলগাছের ফেটে যাওয়া ডাল তিনি ওষুধমাখা ব্যান্ডেজে জোড়া দিয়েছেন। তিনি মানুষের কষ্টকেই শুধু অাঁকেন না। গাছের কষ্টও তাঁকে কষ্ট দেয়। একদিকে কবির কামনা-কাতর, অপরদিকে সেবক। শুধু মানুষের সেবা করেন না তিনি, বৃক্ষেরও পরিচর্যা করেন। প্রকৃতির ধ্বংস দেখে কাঁদেন। দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রদর্শনমালা বেঙ্গল গ্যালারিতে উপস্থাপিত কবিরের সাম্প্রতিক কাজে পরিবেশ-সচেতন শিল্পীমনের প্রকাশ সহজেই চোখে পড়ে। লম্বাটে টেবিলের একটিতে রাখা হয়েছে এক তোড়া ফুল। ফুলগুলো মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফুলগুলোর এই বন্দিত্ব কবিরকে কষ্ট দেয়। তাই তিনি ছবির নাম দিয়েছেন, ‘চলো প্রকৃতিকে মুক্ত করি’। অপর একটি ছবিও একই কম্পোজিশনে আঁকা। এ ছবির নাম ‘এখনই প্রকৃতি-হত্যা বন্ধ কর’। এই কাজে একটি সাদা ফুল, যার পাপড়িমন্ডলের ভেতর থেকে গর্ভকেশর বেরিয়ে এসেছে, তার সবুজ শক্ত বোঁটা ধারাল ছুরির আঘাতে কেটে রাখা হয়েছে। এই যে পরিবেশবাদী বাণী সম্প্রচার করলেন শিল্পী রূপকের ভাষায়, তা একান্তভাবে বোধগম্য। রূপকে ভেঙে বিশ্লেষণ করে বোঝারও দরকার নেই। আমরা সাদা চোখের দৃষ্টিপাতেই বুঝতে পারি নিসর্গ আমাদের অযত্নের শিকার, আমরা তাকে বন্দি করেছি, হত্যা করেছি। কবিরের ছবি বোঝার জন্য বুদ্ধিতে শান দিতে হয় না। হৃদয়ের আবেগ দিয়ে তা বোঝা যায়। অনেক ছবিতে প্রহেলিকা আছে। কিন্তু সেই প্রহেলিকার গ্রন্থিমোচনের জন্য কোনো বিশেষ বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। আঁখিতারার আলোতেই তার রহস্যভেদ সম্ভব।

‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ – সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই অবিস্মরণীয় ক্ষুধার্ত কবিতাকে চিত্ররূপ দিয়েছেন কবির। নাম দিয়েছেন ‘সুকান্তের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য’। তাঁর এই কাজে পোড়া জীবনের পুরাতত্ত্ব আছে। সুকান্তের এই কাব্যচরণ যেমন চাঁদপিয়াসী রোমান্টিক কবিমনের বিরোধাভাস বা অ্যান্টিথিসি বা আজকের তত্ত্বের আলোকে যাকে বলা যায় ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ। কবিরের ছবিটিও রিয়ালিজম ও এক্সপ্রেশনিজম গুণসংবলিত এক স্বচ্ছ বিবৃতি। এতে কোনো রোমান্টিসিজমের কুজ্ঝটিকা নেই; কোনো প্রহেলিকা-জালে জড়ায়নি কবিরের মন। তপ্ত তাওয়ার আগুন জ্বালার সাক্ষী এই পোড়া রুটি; তাওয়া আর রুটি শিল্পীর তপ্ত চৈতন্যের ভাষ্য।

শিল্পে মায়ার বিভ্রম থাকে। অনেক বাধা ও হেঁয়ালি থাকে। কবির তাঁর এই বাস্তববাদী ধারার ছবিতে ওই শৈল্পিক বিভ্রমকে অগ্রাহ্য করছেন। মাটির চুলায় ভাত রাঁধা হচ্ছে। হাঁড়ি, মাটির চুলা, আগুনের হলকা, সব মিলেমিশে রহস্যমুক্ত নিপাট বাস্তবতার প্রকাশ। চিরচেনা দৃশ্যকে কোনো কারুকাজে মন্ডিত না করে সত্যের সহজ প্রকাশ ঘটাতে চান কবির। মাটির চুলায় গনগনে আগুনে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি কি জীবনের স্বাদকেই প্রকাশ করে শুধু! তা তো জঠর জ্বালারই উতোল প্রকাশ। এভাবে একান্ত বাস্তবদৃশ্যেও তিনি শিল্পের রহস্যের ইঙ্গিত রেখে গেছেন। চুলায় চাপানো ভাত ও পোড়া রুটি এঁকে জীবনের মৌল চাহিদার আবেদনকে বিঘোষিত করেছেন শিল্পী।

সত্তরের দশকে লালনের দর্শনে চেতনাকে স্নিগ্ধ করে তরুণ কবির তুলি ধরেছিলেন। লালন মরমি ও বিদ্রোহী। জাতপাতের ভেদে খন্ড-বিখন্ড মানবসমাজ তাঁকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানের তথাকথিত শাস্ত্রীয় নিয়মনীতিকে অগ্রাহ্য করে গান গেয়েছেন। বাউল লালন প্রান্তে অবস্থান করে কেন্দ্রে হানা দিয়েছেন। মানবতার মশাল হাতে গোঁড়ামির অন্ধকার দূর করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে বাউল সংঘ এবং গ্রিসে কোরাস; – দুই-ই বিবেকি মন্দ্র উচ্চারণে জাতপাতের কালিমা মুছে মানুষের অন্তরকে স্নিগ্ধ করতে চেয়েছে। কবিরের মধ্যেও ওই লালন-দর্শনের আলো পড়েছে। এ-শিল্পী হয়তো রাজপথে এসে প্রতিবাদ করেন না, কিন্তু মানুষের কষ্টে তিনি শুধু কাঁদেন না, রাগও প্রকাশ করেন। কবির যে বর্ণজোট বা কালার স্কিমে চিত্রতল ও বিষয় উপস্থাপন করেন তা অনেকটা ভ্যান গঘের অগ্নিময় বর্ণের মতো। তাতে পরস্পরবিরোধী রং, বিশেষ করে লাল, হলুদ, কালো, নীল ও ক্ষয়াটে সবুজের প্রয়োগে সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। চিত্রতল হয়ে উঠেছে সংক্ষুব্ধ অস্থির শিল্পী-হৃদয়েরই স্বয়ংপ্রকাশ। কখনো তাল তাল রং চাপিয়ে বিষয়কে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে চান কবির। আলোর চেয়ে অন্ধকার তাঁর প্রিয়। তামস পরিধিতে বিষয়কে আটকে রেখে নিজের অবচেতনের স্বরূপ কী তা-ই বোধহয় বোঝাতে চান শিল্পী।

শিল্প মানুষের রচনা। মানুষ প্রকৃতিকে নকল করে। প্লেটো থেকে পিকাসো পর্যন্ত সবাই প্রায় এ-কথাই বলেছেন। তবু শিল্পে বিষয়কে সত্যনিষ্ঠ করে রাখতে চায় মানুষ। কৃত্রিমতা তাকে পীড়া দেয়। কবিরও চান চিত্রপটে অাঁকা বিষয় বিভ্রমশূন্য হয়ে প্রকাশিত থাক। এজন্য ইমেজের ড্রইং এবং আলো-ছায়ার দোলাচল কবিরের পছন্দ নয়। রং, বালি, খুদকুঁড়া, খর-বন লাগিয়ে বস্ত্তগত সত্যতায় তিনি বিষয়কে বিশেষ উপস্থাপনা দিতে চান। তিনি অপছন্দ করেন দ্বিতল পটে ত্রিমাত্রার বিভ্রম।

বিভ্রম ও ধাঁধার বিপরীতে অবস্থান নিলেও কবির ভালোবাসেন মানুষের সম্পর্কের মায়া। মানুষের জীবনের স্পর্শহীন বস্ত্ত শিল্পীকে আকর্ষণ করে না। ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে তিনি নিবিড় মায়ার শিল্পী। ছবিটির নাম ‘আশ্রয়’। জুতাজোড়ার একটি জুতা শিশুর, অন্যটি বয়স্ক মানুষের। শিশুর জুতা লাল, বড় জুতাটি কালো। একটিতে আদর আর অন্যটিতে নিশ্চিত আশ্রয়ের দ্যোতনা। দুটি বিষম আকারের জুতাই মানব-সম্পর্কের রহস্য প্রকাশের জন্য কবিরের কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। এখানেই শিল্পীর পর্যবেক্ষণ, এখানেই অন্তর্চক্ষুর আবিষ্কার। এই রহস্যকে খুঁজতে হলে পাহাড়ে চড়তে হয় না, সমুদ্রেও যেতে হয় না, গৃহাঙ্গনেই তা পড়ে আছে। দীন-হীনের প্রতি, তুচ্ছের প্রতি বিশেষ দরদ আছে বলে খুব সহজেই কবির বিষয় আবিষ্কার করে ফেলেন। পিকাসো যেমন বলেছিলেন, ‘আমি খুঁজি না, পেয়ে যাই।’