শহীদ কাদরীর কবিতায় তাঁর মনোভঙ্গি ও আর্তস্বর 

গোলাম কিবরিয়া পিনু

শহীদ কাদরীর কবিতা প্রায় সবই পড়েছি। তাঁর প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থটি বেইলি রোডের এক বইয়ের দোকান থেকে কিনে নিয়ে পড়েছি। আগের কবিতাগুলোও আমার কাছে আছে। তাঁর মৃত্যুসংবাদটি পাওয়ার পর অফিস থেকে ফিরে বাসায় গিয়ে আবার তা বইয়ের সেলফ থেকে নিয়ে পড়তে থাকলাম। কোনো কবি মারা গেলে তাঁর কবিতা আবার কাছে নিয়ে পড়ি। পড়তে-পড়তে কত কী মনে হয় – কবি ও তাঁর কবিতা সম্বন্ধে। অনেক কিছু ভিড় জমায় মসিত্মষ্কে।

শহীদ কাদরী মারা গেলেন নিউইয়র্কে ২৮ আগস্ট ২০১৬, জন্মেছিলেন ১৯৪২ সালে। এমন এক কবি, যাঁর অবস্থান ও জীবনের ব্যাপ্তি এই পৃথিবীর বিভিন্ন ভূভাগে ছিল। কলকাতা শহরের পার্ক সার্কাসে তাঁর জন্ম হয়। কলকাতা শহরে তার শৈশববেলা কাটে। ১৯৫২ সালের দিকে দশ বছর বয়সে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। এরপর প্রায় তিন দশক তিনি ঢাকা শহরে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৮ সাল থেকে প্রবাসজীবনের শুরু। তিনি বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম নিউইয়র্কে বসবাস করেন।

পঁচিশ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে ছাপা হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ উত্তরাধিকার। এরপর ১৯৭৪ সালে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমাকোথাও কোনো ক্রন্দন নেই এবং ২০০৯ সালে কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চারটি এবং এসব গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ১২২টি। ১৯৭৩ সালে বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে একুশে পদক লাভ করেন।

বাংলা কবিতার এই বিশিষ্ট কবি কী কারণে বিদেশে জীবন কাটালেন, তা হয়তো অনেকভাবে বিশেস্নষণ করা হবে। আমি ভাবছি বিভিন্নখানে জীবন কাটানোর পরও তাঁর কবিতার পরতে-পরতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দিগমত্মই উন্মোচিত হয়েছে। এই দেশের ভাষা, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য দিক তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়েছে মূল বিষয় হিসেবে, সেইসঙ্গে যুদ্ধবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদবিরোধী এবং সামরিক-স্বৈরাচারবিরোধী এক ধরনের আমত্মর্জাতিক চেতনাও তাঁর কবিতায় আমরা খুঁজে পাই। আধুনিক ও অগ্রসরমান বোধের কারণে বাংলা কবিতার যে বিকাশমান ধারা আজ মূলধারা হিসেবে অলোকসামান্য হয়ে উঠেছে – তারই অন্যতম কবি শহীদ কাদরী। বিশেষ করে এক ধরনের নিজস্ব বাকভঙ্গি ও বিষয়ের ওপর গভীর পর্যবেক্ষণমূলক  মনোভঙ্গির কারণে তাঁর কবিতা পাঠককে টেনেছে, চমকে দিয়েছে ও অনুরণিত করেছে।

শহীদ কাদরীর ভাষ্য থেকে তাঁর কবিতাসম্পর্কীয় দৃষ্টিভঙ্গি আমরা খুঁজে পেতে পারি, তিনি বলেছেন – ‘একজন বড় কবি এবং একজন ছোট কবির মধ্যে craftsmanship বা skill-এ তফাৎ হয় না। তফাতটা হয় অভিজ্ঞতার বিভিন্ন শেকড় বা রেঞ্জকে  কতখানি স্পর্শ করেছে।… কোনো কোনো কবির প্রয়োজন হয় একটা ভালো কবিতা লেখার আগে দশটা মাঝারি ধরনের কবিতা লেখা।’(শহীদ কাদরী, তাঁর সাক্ষাৎকার, ভোরের কাগজ, ১৩ আগস্ট, ২০০৪)।

শহীদ কাদরীর শেষ কবিতার বই আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-এর শেষ কবিতার নাম ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। এ-কবিতায় কী আর্তবেদনায় কবি তাঁর শিকড়ে ফিরতে চেয়েছেন, এই শিকড়ের অনুষঙ্গ জীবনের শেষ বয়সে এসে বিদেশে অবস্থান করেও ভুলতে পারেননি! এমন স্পর্শমান বেদনাময় আকুতিনির্ভর কবিতা পাঠককে আর্দ্র করে তোলে গভীরভাবে। তিনি লিখেছেন –

আমার মতন ভ্রাম্যমাণ এক বিহবল মানুষ

ঘরের দিকেই

ফিরতে চাইবে

হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে সুস্থ

সহজ এবং স্বাভাবিক।

আমার নিজস্ব ঘরে প্রতিষ্ঠিত হব বলেই

আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েছিলাম একদা

আমার আজন্ম-চেনা গৃহচ্ছায়া থেকে –

আমার প্রথম কৈশোরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরে।

কী সহজ ও খোলামেলা অনুভূতি। নিজের বেড়ে ওঠা ভূগোল থেকে দূরে চলে গেলেও যে একধরনের বিচ্ছিন্ন বেদনার অনুভূতি বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন, সে-কথা কবি এ-কবিতার শুরুতে ওভাবে বলেছেন। তারপর এ-কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে বলেছেন –

তারপর থেকেই – ব’লতে পারো, শুরো

হয়েছে আমার,

উত্থানে-পতনে ভরা (এক পা এগিয়ে যাওয়া এবং

দু’পা পিছিয়ে আসা) এক অমত্মহীন নক্ষত্রবিহীন

যাত্রা।

কবির জীবনে উত্থান-পতন হয়েছে, যা অনেকটা স্বাভাবিক এই জীবনে। কিন্তু শিকড়-বিচ্ছিন্ন জীবন কত বেদনার ও কষ্টকর, এই অনুভূতি প্রবলভাবে কবিকে যেন কষ্টে ভিজিয়ে তুলেছে বারবার। সে-কারণে তিনি বলেছেন – ‘এক অমত্মহীন নক্ষত্রবিহীন যাত্রা’এর  কথা, যার কণ্ঠলগ্ন হয়ে কোনো আলো যেন খুঁজে পান না কবি। এক ধরনের বিষাদমগ্নতা আমরা খুঁজে পাই।

এই দীর্ঘ কবিতার মধ্যে কবি যেন সাক্ষ্য দেন এভাবে –

তোমরা বিশ্বাস করো

ছয় বেহারার পালকিতে আমিও

চেপেছি একদা এবং ‘হুমনা হুমনা’

করতে করতে সেই গাঁয়ের নদীর

কিনার অবধি

পৌঁছে

‘পৃথিবীকে মায়াবী নদীর তীরে এক দেশ বলে

আমারও হয়েছে মনে’

কিন্তু আমি

সেখানে আমার গাঁ কিংবা শহর

কিংবা বাড়ি কিছুই এখনো খুঁজে পেলাম না।

এক ধরনের আত্মগস্নানি নিয়ে আকুলিবিকুলি বুক-চাপড়ানো কষ্ট কবির মধ্যে যা জেগে ওঠে, তা তো এই সময়ের শিকড়-বিচ্ছিন্ন একজন ব্যক্তিরই পরিবেদনা।

এই কবিতার শেষে কবি উচ্চারণ করেছেন –

এতএব বলছি, আবারো বলছি :

আমি ভ্রাম্যমাণ

কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঘরের দিকেই – পদব্রজে।

আধিক্লিষ্ট হওয়ার পরও – সেই ঘর হয়ে উঠেছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় আরো ভিন্ন ও অন্যরকমের। পাঠককে এক অর্থ থেকে আরো অর্থ খুঁজে নেওয়ারও সুযোগ করে দেয়। কবি একই কবিতায় বহুবিধ বোধ উসকে দেন, তা হয়ে ওঠে ভাবনার বিন্দু-বিন্দু নিয়ে আরেক বিস্ময়। শহীদ কাদরীর কবিতা আপাতত মনে হয় সহজ-সরল ও বর্ণনামূলক; কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে চমকে উঠতে হয় তাঁর কবিতার পঙ্ক্তির চমৎকারিত্বে! ঘোরও লাগে। এমনি অভিনব তাঁর কবিতা।

আর একটি কবিতা ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর’। এই কবিতায় কবি তাঁর পক্ষপাত কীসে তা স্পষ্ট করেছেন – এই থেকে কবির জীবন দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয় একজন দৃঢ়চেতা ও আধুনিক মানুষ হিসেবে। এই কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন –

প্রেম থেকে অপ্রেমে

ধর্ম থেকে ধর্মান্ধতায়

প্রগতি থেকে প্রতিক্রিয়ার মধ্যযুগীয় আবর্তে

চুম্বন থেকে চুম্বনহীনতায়

জীবনের ওপারে কোনো অমত্মহীন কফিনে

এই যে নির্বাসন

আমার কাম্য নয় আর।

অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের চেয়ে কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-এর কবিতাসমূহে কবির অভিমান ও আর্তস্বর বারবার বিয়োগবিধুর হয়েছে, কখনো-বা হয়ে উঠেছে তপ্ত বা উপতাপিত, তারপরও তাঁর কবিতা কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা জাগায়। সত্যসন্ধানেও অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে।

কবির উচ্চারণ ও অভিমান :

দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকি ভরা

এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা

দিগমেত্মর শামত্ম দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে –

তাই এই দীর্ঘবাস।…

একরোখা এক জন্মান্ধ প্রতিক্রিয়া আজ

সওয়ার হয়ে প্রগতির পিঠের ওপর

দারুণ মসৃণভাবে এগিয়ে চলেছে –

আর্তনাদ আর রক্তপাতে-ভরা অন্ধকার-প্রিয়

মধ্যযুগের দিকে তাই পরবাস। (‘তাই এই দীর্ঘ পরবাস’)।

এ-কবিতায় কেন তিনি পরবাসে তা তাঁর যুক্তিতে তুলে ধরেছেন। অবশ্য সবার কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে, তা হয়তো হবে না। কেননা অনেক কবি উলিস্নখিত বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও পরবাসে যাননি, কেউ হয়তো ভালো এবং আরো নিরাপদ সুযোগ পেয়েও যাননি! এইখানে কবির বিবেচনাবোধ মানতে হবে, তা হয়তো তিনি বলেননি কিন্তু পাঠক হয়ে আমরা তা গ্রহণ করতে পারি বা নাও পারি। তবে, এই কবিতায় কবির সংবেদনাকে আমরা প্রশ্ন করেও এক ধরনের কৌতূহল ও চিহ্নযুক্ত ইশারা অনুভবে টেনে আনতে পারি।

আমারও মনে প্রশ্ন জাগে, তাঁর স্বল্পলেখা ইচ্ছে করে কিনা? জানি না! নাকি জীবনের বহুবিধ কারণে আরো বেশি লেখা হয়ে ওঠেনি, তাও হয়তো আমরা সেভাবে বলতে পারব না। তবে, আরো কবিতা, আরো অন্য ধরনের লেখা তাঁর কাছ থেকে পেলে আমরা  হয়তো আরো আমাদের পাঠস্পৃহা মেটাতে পারতাম। উলেস্নখ করেছি  এই লেখায় তাঁর ভাষ্য, তাতে তিনি যেমন বলেছেন বড় কবিদের অভিজ্ঞতার রেঞ্জ বড় হয়, কবিও তখন বড় হন, যদি কবিতায় সার্থকভাবে টেনে আনতে পারেন তাঁর সেই অভিজ্ঞতা। এই কবির ক্ষেত্রে তাঁরই ভাষ্য থেকে আমরা তাঁর কবিতা মূল্যায়নের দিগমত্ম উন্মোচন করতে পারি।