শামসুর রাহমান : শিল্পে শহীদ

শহীদ কাদরী

শামসুর রাহমানের প্রয়াণের খবর এখনো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আমি বিহবল এবং বাক্যরহিত। আণবিক বিস্ফোরণের পর আমার সবচাইতে প্রিয় শহর যেন পরিণত হয়েছে একটি বিশাল ধ্বংসস্তুপে। এ-মুহূর্তে স্মৃতিচারণও সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

আমি বিভিন্ন সময়ে বহুবার বলেছি, শামসুর রাহমান আমাদের সাহসের সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, সাতচলিস্নøশে যখন পর্দা উঠলো, উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যখন পেলাম ফররুখ আহমেদ, আবুল হোসেন ও আহসান হাবীবকে। এঁদের কাব্যিক বিকাশ তখন অর্ধপথে, কার্যত অসমাপ্ত। আমরা যারা কোনো এক ব্যাখ্যাতীত কারণে কবিতার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করছিলাম, তারা বাধ্য হয়ে তখন সমগ্র বাংলা সাহিত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরালাম। আবিষ্কার করলাম, সোনার খনির মতো, তিরিশের কবিদের, অর্থাৎ যথার্থ আধুনিক বাংলা কবিতাকে।

এরপর আসছে শামসুর রাহমানের কবিতার কথা। তখন উত্তররৈবিক কাব্যপ্রবাহের বাহন ছিল বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা। এই কবিতা পত্রিকার মাধ্যমেই শামসুর রাহমানকে আমি আবিষ্কার করি। সেই দুপুরের স্মৃতি কখনো ভুলবো না। আমি বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় ডাকপিয়ন এসে হলদে চকচকে খাম দিয়ে গেল। খুলে দেখি কবিতা পত্রিকা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম ‘রূপালি স্নান’। তারপর তিরিশ বছর ধরে পড়েছি তাঁর লেখা আরো অসংখ্য ঐন্দ্রজালিক কবিতা।

আমি ১৯৮২ সালে দেশ ছাড়ি। আসার সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। এরপর তাঁর অনেক বই বেরিয়েছে, আমার হাতে সেগুলো আসেনি। শুধু শ্রেষ্ঠ কবিতার ভিত্তিতে বলতে পারি, তিরিশের পাঁচজনের পর সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে শামসুর রাহমানকে প্রধান কবির আসনটি দিতেই হবে। প্রধান এই কারণে যে, তাঁর কবিতা সমগ্র জীবনকে নানাভাবে স্পর্শ করেছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা ভাষা ও ছন্দের ওপর অনায়াস দক্ষতা। এই প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের শব্দচেতনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সত্যিকার অর্থে যাঁরা তাঁর সমকালীন তাঁদের কাব্যপ্রয়াসের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে, বাংলা ভাষার বিভিন্ন কাব্যরূপ তাঁদের আয়ত্তে আসেনি। বাংলা ভাষার যে অমত্মর্লীন সংগীত, তাও তাঁদের কানে ধরা পড়েনি। কিন্তু শামসুর রাহমানের সবচেয়ে দুর্বল কবিতাও সংগীতবিচ্যুত নয়। এই গুণের ফলে যে-কোনো বিষয়কে তিনি কাব্যে রূপামত্মরিত করতে পারতেন। অনেকেই এখন শামসুর রাহমানের সমসাময়িকতার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা এবং পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততাকে সবিশেষ উলেস্নøখ করে থাকেন। কিন্তু তাঁর সংবেদনশীল মন আরো বহুবিচিত্র বিষয়কে স্পর্শ করেছে। আমার মনে হয়, তিনি যদি রাজনীতি-সচেতন নাও হতেন, শুধু তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোর জন্যেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এমন অনেক কবিতা, যা কিনা আধুনিকতা থেকে উৎসারিত একটি প্রধান স্রোত।

এখন এ-মুহূর্তে শামসুর রাহমান সম্পর্কে আর কী বলব আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমার কৈশোর এবং যৌবন তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কেটেছে। তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে কবি। অন্য কোনো কিছুর প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল না। এ-নিয়ে তাঁকে যথেষ্ট বিব্রতও হতে হয়েছে। তাঁর পিতা চাইতেন তাঁকে বিলেত পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়াতে, শামসুর রাহমান রাজি হননি। সিএসএস পরীক্ষায় বসার জন্যেও পারিবারিক চাপ ছিল, তাও তিনি এড়িয়ে গেছেন। পারিবারিক ব্যবসা ছিল বিশাল, তার সঙ্গেও যুক্ত হননি। বিয়ের পর চাকরিতে ঢুকলেন – রেডিওতে; তারপর মর্নিং নিউজের সাব-এডিটর। এরপর দৈনিক পাকিসত্মান এবং স্বাধীনতার পর রূপামত্মরিত দৈনিক বাংলায় দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। পাকিসত্মান আমলে আইয়ুব সরকার তাঁকে নানারকম প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও শামসুর রাহমান একচুলও নড়েননি। আমাকে একদিন তিনি বললেন, বড় চাকুরে কি লাখপতি হওয়ার কোনো বাসনা তাঁর নেই। এমন কিছুই তিনি করবেন না, যা তাঁর কাব্যচর্চাকে ব্যাহত করতে পারে। অথচ তাঁর সামনে সুযোগ ছিল অবারিত; কিন্তু যে-মানুষ একদিন কী দুদিন না লিখতে পারলে অস্থির হয়ে উঠতেন, তাঁর শ্রম্নতিতে জীবনের অন্য কোনো আহবানই পৌঁছুতে পারেনি। তিনি একবার বলেছিলেন, যদি লিখতে না পারেন তবে আত্মঘাতী হবেন। সে-কথা শুনে আমি আপাদমস্তক শিউরে উঠেছিলাম।

আজ আমার মনে হচ্ছে, যে-একমনস্ক নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি কাব্যচর্চা করে গেলেন, তা একটি দৃষ্টামত্ম হয়ে থাকবে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে কবিযশোপ্রার্থীদের জন্যে। আর আমি অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল বয়ে বেড়াবো এক অনতিক্রম্য শূন্যতা।