রবিউল হুসাইন
শহীদ কাদরীর কবিতা, বলা হয়ে থাকে, নগরজীবনের টানাপড়েন, জটিলতা, সংগ্রাম ও বেদনার বিষয়াবলির অমোঘ দলিল। গ্রামের মানুষ যখন একটু শিক্ষিত হয়ে ওঠে, তখন চাকরি বা ব্যবসা কিংবা নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য শহরে এসে পৌঁছায়। অবশ্য সামাজিক অবিচার, নিপীড়ন, নদীর ভাঙন, বন্যা,মহামারি, ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও এবং গ্রামের সেই প্রাকৃতিক গাছগাছালি, অবারিত শস্যের মাঠ, নদী-বিল-প্রামত্মর আর তার সহজ-সরল মানুষজন আর পায় না। পরিবর্তে পায় শহরের আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর ধরনের একদল মানুষ, যারা সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত – চারদিকে ইটের দালান, কংক্রিটের রাসত্মা, অলিগলিসমৃদ্ধ জনপদ এবং অদ্ভুত জীবনযাপনের জন্যে একটি দানবীয় শহর।
এই পরিবেশে একজন কবি যখন পঙ্ক্তি রচনা করতে উদ্বুদ্ধ হন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় এই শুষ্ক-শুকনো মায়া-মমতাহীন স্বাভাবিক বিষয়গুলো উপস্থাপিত হয়। তখন কবি কাউকে বন্ধু হিসেবে পান না, কাউকে ভালোবাসার জন্যে পান না, সর্বত্র তাঁর সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি। জীবনের সনাতন লক্ষ্য হয়ে পড়ে অনির্দিষ্ট। নাগরিক জীবনটি তখন মূল্যহীনতায় ভোগে, জটিল দিনরাত্রি একঘেয়েমিতে পর্যবসিত হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগে একজন মানুষ অন্যজনকে হিংসা আর বিদ্রূপ করার অনুশোচনাহীন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে। কাউকে অপমানিত বা মনে আঘাত দিয়ে কথা বলে একটুও দুঃখ পায় না – এরকম অমানবিক আচরণে সিদ্ধহস্ত সেই গর্বিত মানুষটি তথাকথিত হাস্যকর একজন আধুনিক এবং নাগরিক জীব হিসেবে পর্যবসিত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবে মানুষটির কার্যকলাপে বা রচনায় তার এই সম্পৃক্ত জীবনশৈলীর ছাপ পড়বে।
শহীদ কাদরীর কবিতায় এই শৈলীরই ছাপ স্পষ্টভাবে পড়েছে। তাঁর দেখার ধরনটিই পৃথক, অন্যদের সঙ্গে মেলে না। এ-দেশের আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি এই জন্য এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রেখেছেন। তাঁর সুঠাম রচনাশৈলী, শব্দ নির্বাচন, কৌণিক দৃষ্টিনিক্ষেপ রীতি, সাবলীলতা ও আপাত-তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কবিতা নির্মাণ এই বিশিষ্টতা অর্জনে সাহায্য করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর বাউন্ডুলে জীবন, আড্ডাপ্রিয়তা, বাড়ি না-ফেরা, এরকম কিংবদন্তির নির্মাণ যদিও এসবের মূল্য কবিতায় কোনো কাজে আসে না, তবু বলা যায়, নির্দিষ্ট করে কারো থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত থাকলে এগুলোতে সিদ্ধহস্ত হয়ে একজনের অভিজ্ঞতা লাভ হয়, যা কবিতা নির্মাণে একটু কাজে লাগে হয়তো।
শহীদ কাদরীর কবিতা মূলত দুই ধরনের। একটি নৈর্ব্যক্তিক, নির্লিপ্ততার ব্যক্তিগত নৈকট্য ও দূরাগত বোধের স্পষ্ট বা অস্পষ্টতা যেগুলোর সঙ্গে একজন তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের ইচ্ছা ও চিমত্মার বহুলাংশে মিল গড়ে ওঠে যা স্বাভাবিক শাশ্বত, সাবলীল ও সামগ্রিক। তিনি দেখা শুরু করেন অনুপুঙ্খভাবে ভেতর থেকে উলটে-পালটে ওপর-নিচসহ দশ দিক দিয়ে। এরকম অনেক কবিতার শুরুতে সনাতনী ছন্দ বা বিষয়ের ক্লিশে দিকটির প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে একটি পরিপূর্ণতার লক্ষ্যে নতুন এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। তাঁর অন্য আর এক ধরনের কবিতা আছে, যা তাঁর একামত্ম ব্যক্তিগত বহুল প্রচলিত প্রেম-ভালোবাসার কবিতা।
শহীদ কাদরীর প্রেমের কবিতার চেয়ে সাবলীল নির্লিপ্ততার কবিতা অনেক আকর্ষণীয় এবং সৃষ্টি হিসেবে অনবদ্য। এখানে প্রকৃত কবিকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে-তুলনায় তাঁর প্রেমের কবিতা অগভীর এবং অসমাপ্ত। কেননা, একজন আধুনিক নাগরিক কবির কাছে নর বা নারীর প্রেম এত মূল্য পেতে পারে না। নারীকে পাওয়ার জন্যে একজন কবির এই হাস্যকর হা-পিত্যেশ হয়তো তাঁর অগভীর বোধের অসম্পূর্ণতার পরিচায়ক।
আমরা জানি, বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল শ্রম এবং চেষ্টা এই অসার্থক এবং নর-নারীবিষয়ক পঙ্ক্তি দিয়ে ঠাসা, যে-ঐতিহ্য এখন পর্যমত্ম চলছে যা মনে হয় এক গুরুত্বহীন আবিষ্কারের শব্দ-গুদামঘর ছাড়া কিছু নয়। জানি না কখন, কবে এবং কোন সাহিত্য-শ্রমিকের দল এসব শব্দের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য এক মহান দায়িত্ব পালনে আবির্ভূত হবেন। অবশ্য এই বিষয়ে ভিন্নমত ও বিতর্ক থাকতেই পারে।
ঢাকা শহরকে এমনিতেই একটি গ্রাম বলা হয়। পৃথিবীর অন্য বড় বড় শহরের তুলনায় এই শহরের নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহুজাতিক বা কসমোপলিটান রূপবৈচিত্র্যে বিকশিত হয়ে ওঠেনি আজ পর্যমত্ম। এরকম একটি অসম্পূর্ণ শহরের একজন কবি তিনি। দেশভাগের জন্য নিজের জন্মভূমি ছেড়ে উদ্বাস্ত্ত হয়ে আসা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, এপারে ভাষা-আন্দোলন, থিতু হতে হতে দীর্ঘ সেনাশাসন, স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ, অগণিত শহীদের রক্তক্ষয়ী আত্মোৎসর্গ, বিদেশ গমন, প্রেম-ভালোবাসা আর দেশের জন্য সবসময় চরম ও পরম আকাঙক্ষা এবং মৃত্যুর আগ পর্যমত্ম দেশে না ফেরা – এসবের মধ্যে বিসত্মৃত, বিধৃত ও বিবর্তিত আজীবন কলকাতা, ঢাকা, বার্লিন, বোস্টন ও নিউইয়র্কে বসবাসকারী একজন সৃষ্টিশীল কবি। হাজার অনুভূতিসম্পন্নই হোন না কেন, তাঁকে একজন নাগরিক কবি হিসেবে অভিহিত করতে মনে প্রশ্ন জাগে। তাই এমতাবস্থায় শহীদ কাদরীকে একজন পরিপূর্ণ নাগরিক কবি না বলে নাগরিক-চেতনার একজন প্রথম সারির উন্মেষকারী কবি বলে পরিচিহ্নিত করতে পারি। বলা যায়, শহীদ কাদরী যদি প্রেমের কবিতাগুলো না লিখে শুধু নৈর্ব্যক্তিক কবিতার কবি হিসেবে পরিচিত হতেন, তাহলে কবি হিসেবে আরো স্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং ক্ষুরধার হয়ে বিরাজ করতেন। কেননা, প্রেমের গীতল চরিত্রের ওইসব নারীবিষয়ক পঙ্ক্তিমালা আজকাল গানের বিশাল জগতের গীতিকাররাই লিখে থাকেন এবং সেই জগৎ কবিতার মতো হোক পৃথক। তাই কেউ যদি প্রেমের কবিতা রচনা করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তাহলে নজরুল, দ্বিজেন, রজনীকামত্ম, অতুলপ্রসাদ ও রবিঠাকুরের মতো সুর দিয়ে সেগুলোর ওপর আরো স্পষ্ট ও গীতিধর্মিতা আরোপ করে এক ভিন্ন অধ্যায়ে অমত্মর্ভুক্ত করার প্রয়াস পেতে পারেন। কবিতার শুদ্ধ রাজ্যে এগুলোকে না জড়ানোই ভালো। এভাবে উৎকট আবেগসর্বস্ব নর-নারীপ্রেমের মতো দেশপ্রেম এবং ঈশ্বরপ্রেমবিষয়ক কবিতার বেলায়ও প্রাগুক্ত মতামত পোষণ করা যায়।
শহীদ কাদরীর তাই বোধহয় তাঁর বহুল পরিচিত নাগরিক আধুনিক চরিত্রটি কিছুটা আবেগী প্রেমের কবিতাগুলো রচনা দ্বারা অভিন্ন থাকেনি। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, যাঁরা আধুনিক নাগরিক কবি তাঁদের পক্ষে কি প্রেমের কবিতা লেখা ঠিক নয়? না, এরকম ধরাবাঁধা নিয়ম কবিতার ক্ষেত্রে কখনোই চলে না। আধুনিক কবিরা প্রেমের কবিতা অবশ্যই লিখবেন তবে একজন আধুনিক নাগরিক কবির পক্ষে বোধকরি তা খুব বেমানান। কেননা, সেটা করলে কবির নাগরিক চরিত্রের নির্লিপ্ততাকে ক্ষুণ্ণ করে ফেলা হয়। নগরজীবনের জটিলতা নর-নারীর প্রেম দিয়ে মুছে ফেলা যায় না। একজন নাগরিক ও আধুনিক মানুষ প্রেমিক বা প্রেমিকাকে কাছে পেলেন বা পেলেন না যা খুবই স্বাভাবিক, তাই বলে মন, চেতনা ও বোধকে ক্ষত-বিক্ষত করে ছেলেমানুষি আহাজারিসমৃদ্ধ পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি রচনা করে যাওয়া বোধহয় তাঁর আধুনিক নাগরিক চরিত্রের পরিপন্থী হয়ে ওঠে।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবিব্যক্তিত্ব হিসেবে শহীদ কাদরীর এই গঠনমূলক ভিন্ন মতামত থাকা সত্ত্বেও তাঁর কবিতার অমিত বেগবান শক্তি সম্বন্ধে আমরা চিরকালই উৎসুক ও শ্রদ্ধাশীল থাকব।
কবি শহীদ কাদরী আজ আমাদের মধ্যে নিঃশূন্য শূন্যতায়। তবে তিনি সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতায় তাঁর কবিতায় তাঁর সৃষ্টিতে। ষাটের দশকে কী করে বিস্মৃত হই সেই ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন, রেক্স, মেরিন্ডা, গুলসিতান রেসেত্মারাঁ, বার, পুরনো ঢাকার সংবাদ আপিস। সারারাত ধরে মাহমুদুল হক বটুভাই, বেলালভাই, রফিক আজাদ, আবুল হাসনাতের সঙ্গে ঢাকার রাসত্মায়-রাসত্মায় ঘোরা। শহীদ কাদরীর সঙ্গে শিক্ষামূলক আড্ডা, অনিকেত জীবনযাপন, সোভিয়েত ইনফরমেশনে ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরি, সংবাদে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি কলাম, বিদেশের সাহিত্যপাঠ, তাঁর বন্ধুপ্রিয়তা, উদার মন-মনন, বিদেশে উদ্বাস্ত্ত জীবন এবং এই বাংলার মাটিতে প্রাণহীন ফিরে আসা।
তাঁকে অভিবাদন জীবনের জীবনমুখী কবিতায় আজীবন!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.