শিল্পকলা : সাহিত্যাকাশে এক কণা আলো

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে গত শতকের ছয়ের দশক, সাধারণত যাকে ষাটের দশক বলা হয় – এর গুরুত্ব অপরিসীম; রাজনৈতিক দিকে থেকে যেমন, সাহিত্য-সংস্কৃতির দিক দিয়েও। বলা চলে, ষাটের দশকের গর্ভেই নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়পূর্ব অবস্থান ছিল। ষাটের কবিদের মনে রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা; সাংস্কৃতিকভাবে কথিত সমন্বয়বাদী চেতনা থেকে স্বাতন্ত্র্যকামী চেতনায় নিশ্চিতি প্রবল হয়ে উঠেছিল এবং পরে তা প্রতিষ্ঠাও লাভ করে। আর এ-সময় পার্শববর্তী পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে যেহেতু আধুনিকতার চরম শিখরস্পর্শ করে, বিশেষ করে তিরিশের প্রধান কবিদের অনেকেই যেহেতু লিখছিলেন সে-সময়, চল্লিশের বাংলা কবিতার বাঁক-বদলকারীরা (সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ) যেহেতু তখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত, পঞ্চাশের কবিরাও অনেকে যেহেতু প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন (যেমন : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ), সেহেতু ‘কবিতাশিল্পে’র নিরিখে কবিতাকে শিল্প হিসেবে সৃজনের একটা বোধ ষাটের কবিদের মধ্যে প্রবলভাবে জাগ্রত ছিল। তাই ষাটের কবিতা শুধু যেমন সময়ের অস্থিরতা, আন্দোলন-সংগ্রাম ধারণ করে না, করে হৃৎ-চেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতিটুকু স্পর্শ, তেমনি এ-দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় টেনে আনে দর্শনকেও। বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় আজ যে-দর্শনচর্চা প্রত্যক্ষ বা প্রধান হয়ে উঠেছে, এ-ভূম-লের বিবেচনায় তার সূচনা কিন্তু করেছিলেন ষাটের কতিপয় দুরন্ত কবি। এঁরা সময়কে প্রায়শ অবজ্ঞা করেছেন, ঘাপটি মেরে থেকেছেন কলম-খাতারূপী পুরুষ-প্রকৃতির রতিচাষে অথবা অধীতবিদ্যার সমুদ্র মন্থন করে তুলে আনতে চেয়েছেন কাব্যামৃত – বিষের দায় এঁরা নেন না কিছুতেই, সেটা থাকে অন্যদের কণ্ঠে। যে-কারণে ষাটের বহু কবির কবিতা মনে হবে সময় ও সমাজবিচ্ছিন্ন, গগনপ্রসূত। বুদ্ধদেব বসু-অনূদিত শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা এবং এর ভূমিকা (যেখানে কবিতার ভিন্ন সংজ্ঞারোপ করা হয়েছে) এ-দশকের অনেক কবির প্রায়-মুখস্থ ছিল। তাঁরা কবিতায় গ্রামীণ চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে নগরমনস্কতার প্রতিমা গড়েছিলেন। এখানে প্রথাগত বিশুদ্ধতা বলে কিছু নেই, রিরংসা ঘৃণিত নয়, অবক্ষয় সহ্য হয়। কেননা, ঢাকা তখন গ্রামের শৈশব কাটিয়ে নগরের যৌবনপ্রাপ্ত হচ্ছে। সদ্য যৌবনপ্রাপ্তদের যত দোষ (?) সবই তখন ঢাকায়। বাড়ছে রেস্টুরেন্ট, গাড়ি; বিদ্যুতের আলো ও অন্ধকার; বাড়ছে ইটের প্রকোষ্ঠে কাম-লোভ-অপরাধ। কারণ বারিসুধায় আত্মহারাদের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে শিল্প-কলকারখানা, বাড়ছে বৈষম্য। পশ্চিমে বেশ আগেই ঘটেছে ব্যাপারটি, পশ্চিমবঙ্গে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে, আর বাংলাদেশে ষাটের দশকে এ-ধরনের কথিত নেতিবাচকতাকে ইতিবাচতকতার বাণীবন্ধে কবিতায় স্থান দেওয়া হলো। এ প্রসঙ্গে কণ্ঠস্বর (১৯৬৫) পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় লেখা হয়েছে :
সাহিত্যকে যাঁরা অনুভব করতে চান শততলে শতপথে; আঙ্গিকের জটিলাক্ষরে, চিমত্মার বিচিত্র সরণীতে; কটু স্বাদে ও লোনা আঘ্রাণে; সততায় শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে, অনুভূতিতে ও পাপে; মহত্ত্বে ও রিরংসায়; উৎকণ্ঠায় ও আলিঙ্গনে, ‘কণ্ঠস্বর’ সেইসব পদপাতবিরল তরুণদের পত্রিকা।
কণ্ঠস্বরকে চেনাবার জন্য নয়, ষাটের দশকের একটি প্রধান কবি-গোষ্ঠীর কাব্য পরিচয় প্রদানের জন্য উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করলাম। লক্ষণীয়, একটি মাত্র বাক্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার-বৈচিত্র্য এবং বহুমুখী প্রকাশাগ্রহ। এককথায় : চমৎকার! ষাটের কবিতার ভাষাতেও এ-গুণ পাওয়া যাবে। কবিরা এ-সময় অস্তিবাদী জীবনচেতনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, নীতিবাদের প্রথাগত ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, রোমান্টিকতার প্রচলিত ও চল্লিশীয় ধারণাকেও ছিন্ন করেছেন। এঁদের অনেকে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন ‘স্যাড জেনারেশন’ বলে এবং সে-সূত্রেই স্মরণ করি, কবি বুলবুল খান মাহবুব ১৯৬৩ সালে স্যাড জেনারেশন নামে একটি ছোটকাগজও প্রকাশ করেন। তাই এ-কথা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, পরিশুদ্ধ অর্থে ষাটের কবিরা বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় ব্যাপকভাবে দর্শনচর্চা আরম্ভ করেন। আর যাঁরা কবিতায় দর্শন প্রয়োগ নিয়ে ভেবেছেন, তাঁরাই কবিতার আঙ্গিক নিরীক্ষাতেও ব্রতী হয়েছেন। যে-কারণে ষাটের দশকে আঙ্গিকগত দিক থেকে কবিতা হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক : কবিতায় গদ্য ও লিরিক দুই-ই আদৃত হয়, দীর্ঘ কবিতার জন্ম নেয়, কবিতায় উঠে আসে বিস্ময় আর নাট্য-প্রবণতা। শব্দচয়নে বিশুদ্ধবাদী ছুঁৎমার্গ সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়, প্রতীক ও চিত্রকল্পগুলো তৈরি হয় মূর্ত বা বিমূর্তের আধারে।
বাংলাদেশের বাংলা কবিতার পালাবদলে ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন জন্ম থেকেই যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তার সূচনাটা গত শতকের ছয়ের দশকে। কবিতায় এর প্রকাশ ঘটেছে বেশি, কিন্তু চিমত্মাচর্চাটি ছিল ভেতরে ভেতরে। বিশেষ করে দর্শনচর্চা ও প্রকাশে লেখককুল এ-সময় অগ্রগামী হন। প্রবন্ধে এর খানিকটা প্রতিবিম্ব দেখা যায়। অবশ্য এরও মঞ্চে-নেপথ্যে ছিলেন ষাটের কবিকুল। এ-দশকের আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে, যদি পরিচয়ে না আনা যায় সেই স্ফুলিঙ্গ বা ইস্ক্রাগুলো। ১৯৫০ সালের ২১ মার্চ (চৈত্র, ১৩৫৬) আবদুর রশীদ খান ও আশরাফ সিদ্দিকীর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল নতুন কবিতা নামে এক সংকলন। তেরোজন তরুণ কবির বাষট্টিটি কবিতার সংকলন ছিল এটি। ‘ভূমিকা’য় সম্পাদকদ্বয় আশা নিয়ে বলেছিলেন : ‘সাহিত্যপথের নতুন যাত্রীদের কাব্যসৃষ্টির খতিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের আজাদী-উত্তর যুগের কাব্যের পথনির্দ্দেশ – যেহেতু ‘নতুন কবিতা’ পূর্বপাকিস্তানের প্রথম কাব্য-সংকলন।’ কিন্তু কী আশ্চর্য, ইতিহাসের খাতিরেই আজ শুধু নতুন কবিতার নাম কিছুটা মনে করতে হয়, অন্য কারণে নয়। এ-সংকলনে যাঁদের কবিতা স্থান পেয়েছিল এবং যে-কারণে ‘পূর্বপাকিস্তানের আজাদী-উত্তর যুগের কাব্যের পথনির্দেশ’ বলে খানিকটা গর্বও ছিল সম্পাদকদের – স্মরণ করি তাঁদের নাম : হাবীবুর রহমান, মুফাখ্খারুল ইসলাম, মনোজ রায়চৌধুরী, চৌধুরী ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান, মযহারুল ইসলাম, মোহাম্মদ মামুন, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। এই তেরোজনের মধ্যে অধিকাংশই উত্তরকালে কবি হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন; অনেকের নাম হারিয়ে গেছে আর দশজন মানুষের মতো, মহাকালের গর্ভে, এখনই। সম্পাদক আশরাফ সিদ্দিকী, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ শেষতক কবিতা লিখলেও স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে তাঁরা স্মৃতির চোরাবালিতে। এঁদের মধ্যে একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম শামসুর রাহমান; খানিকটা উল্লেখযোগ্য হাসান হাফিজুর রহমান। নতুন কবিতার পর প্রায় এক দশক খুঁড়িয়ে চলে এ-ধারা। কিন্তু ষাটের দশকেই পস্নাবন; শুধু পস্নাবন নয়, সুনামি। এ-দশকে ঢাকাকেন্দ্রিক ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনই প্রকাশিত হয়েছে পঁচিশের বেশি! এর মধ্যে কোনোটি পরে নিয়মিত সাহিত্যপত্রে রূপান্তরিত হয়। স্বীকার্য যে, মোহাম্মদী বা সওগাত বা মাহে-নও এ-সময়ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেখানে তারুণ্যের স্বাধিকার-প্রমত্ততা ছিল অনুপস্থিত। প্রথাগত সংস্কার আর মুসলমানিজম ভেতরে ভেতরে লালন করতেন এগুলোর সম্পাদক-প্রকাশকগণ। তাঁরা চাইতেন ‘মুসলমান সাহিত্যিক’ বানাতে, আধুনিকতার খোলসে পুরে দিতে চাইতেন পাকিস্তানের শাঁস। সমকাল এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম, কিন্তু ভাবধারা থেকে এটাকেও বাদ দেওয়া যায় না। কারণ, এর সম্পাদক হাতে তুলে নিয়েছিলেন মাস্টারির বেত। কোনো লেখা বের হলে লেখক বর্তে যেতেন – ভাবটা এমনই ছিল তখন। এ বর্তে যাওয়াটা কী? এলিটের সিল। সমকালে লেখা ছাপা হলে এলিট কবি বলে মান্য হতেন কবিরা। লেখক, বিশেষ করে কবিদের সহমর্মী ও আনুকূল্য লাভ করতে গিয়ে সিকান্দার আবু জাফর নিজে বড় কবি হতে পারলেন না। পারলেন না পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমানও। অথচ, একসময় বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত ও টিকে ছিলেন তৎকালীন কবিদের প্রিয় নাম ‘হাসানভাই’। আজ হাসান হাফিজুর রহমানের নাম একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রম্নয়ারীর সম্পাদক ছাড়া অন্য কারণে, কিংবা কবি হিসেবে খুব কি মনে পড়ে পাঠকের?
ষাটের দশকেই সূচিত হলো নতুন ধরনের সাহিত্যিক সংঘবদ্ধতা। এর আগে এ-ধরনের সংঘের পেছনে ‘ইজম’ মুখ্য ছিল, ষাটের দশকে ইজম নয় ইন্ধন, বলা যায় প্রণোদনা মুখ্য হয়ে এলো। লিটল ম্যাগাজিন সপ্তক (১৯৬২), স্বাক্ষর (১৯৬৩), যুগপৎ (১৯৬৩), বক্তব্য (১৯৬৩), স্যাড জেনারেশন (১৯৬৩), কণ্ঠস্বর (১৯৬৫) ইত্যাদি প্রকাশিত হলো নতুন কাব্যভাবনা লালন করে। এ-প্রসঙ্গে আমি কবিতাকেন্দ্রিক লিটল ম্যাগাজিনের একটু বিসত্মৃত উল্লেখ করব এজন্যে যে, এগুলোর সম্পাদক ষাটের দশকের কবিকুল। যেমন : স্বাক্ষরে বিভিন্ন সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, ইমরুল চৌধুরী, প্রশান্ত ঘোষাল, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ। স্যাড জেনারেশন সম্পাদনা করেছেন বুলবুল খান মাহবুব; প্রতিধ্বনি (১৯৬৪) সম্পাদনা করেছেন ফারুক আলমগীর; কণ্ঠস্বর সম্পাদনা করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ; কালবেলা (১৯৬৫) সম্পাদনা করেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হায়াৎ মামুদ; শব্দরূপ (১৯৬৫) সম্পাদনা করেছেন সাযযাদ কাদির, মাহবুব সাদিক; বিপ্রতীপ (১৯৬৭) সম্পাদনা করেছেন ফারুক সিদ্দিকী; হে নক্ষত্রবীথি (১৯৭০) সম্পাদনা করেছেন হুমায়ুন কবির; বহুবচন (১৯৭০) সম্পাদনা করেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা, শাহনূর খান; শিল্পকলা (১৯৭০) সম্পাদনা করেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবদুস সেলিম – এরকম আরো নাম সংযোজন করা যায়। এঁরা প্রায় সবাই কবি, দু-একজন আবার দর্শনমুখর গদ্যরচনায় আগ্রহী ছিলেন। তবে সবাই ছোটবড় একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বা অনুষঙ্গী হিসেবে কাজ করেছিলেন। কণ্ঠস্বর লিটল ম্যাগাজিন থেকে নিয়মিত সাহিত্যপত্রে পরিণত হয়ে দীর্ঘ জীবন লাভ করে, এক দশকের বেশি সময় টিকে ছিল। আর কোনোটি দু-তিন বছরের বেশি টেকেনি, কোনোটি দু-সংখ্যা মাত্র! এই পত্রিকাগুলোর সম্পাদক এবং কবিগোষ্ঠী কবিতায় আধুনিকতার যে-সূত্রসন্ধান করলেন তা জীবনানন্দীয় ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশাগ্রস্ত হয়ে নয় অথবা নয় সুভাষীয় ‘ফুল ফুটুক আর না-ফুটুক, আজ বসন্ত’র মতো সমাজবাদী দর্শনে নিমজ্জিত হয়ে। এঁরা পরোক্ষকে গুরুত্ব দিলেন বেশি, প্রত্যক্ষ মাত্রই লেখার বস্ত্ত, সে-কথা মানলেন না সেভাবে। সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যের মেজাজ এঁরা গ্রহণ করলেন সরাসরি পশ্চিম থেকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নয়।
আমরা আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবদুস সেলিম-সম্পাদিত শিল্পকলার সংখ্যাগুলো নিরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছি। ঢাকার ১১৬৪, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে প্রকাশক ইউনুস আলির নামে এটি প্রকাশ হতো। মূলত ‘গদ্যপত্রিকা’ হিসেবে প্রকাশিত শিল্পকলা কালের প্রবাহে আজ ‘বিরল’ হতে বসেছে। অথচ, ষাটের দশকের রেশ ধরে সত্তরের দশকের সূচনাবর্ষে পত্রিকাটি প্রকাশ হয়েছিল। সম্পাদকদ্বয় মনে করতেন, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় ব্যক্তিমনের রংবেরংই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কোনো সমতা খোঁজার অর্থ নেই বা নেই কথিত রাজনীতির উত্থানপতনের সঙ্গে যোগ। দুজন সম্পাদক পৃথক সম্পাদকীয় লিখেছিলেন এর দ্বিতীয় সংকলনে। দুজনেই ব্যাপারটি লিখেছেন নিজ নিজ ভাষায়, এভাবে : আবদুল মান্নান সৈয়দ – ‘ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য ঘুচিয়ে, মানুষকে শুধুমাত্র রাষ্ট্র-অর্থনীতি-সমাজচক্রের প্রসবিত ফল ভেবে, মানবকে এক-একটি নকশা দাঁড় করিয়ে যাঁরা তার ভবিষ্যৎভাবনা ও কল্যাণকামিতায় ব্যস্ত ও চিমিত্মত তাঁদের বুঝতে পারি না। বিংশ শতাব্দীর ভিতরসন্ধ্যায়ী শিল্পসাহিত্য আর-একবার অসংশয়িতভাবে প্রমাণ দাখিল করেছে : তার সত্যিকার গন্তব্যে পৌঁছোতে হলে মানুষকে যাত্রা করতে হবে সমষ্টির রলরোলে নয় – ব্যষ্টির বিজন পথে, নিজের ভিতর দিয়ে, নিজের ভিতরে খুঁড়ে খুঁড়ে।’
আবদুস সেলিম – ‘আসলে শিল্প জিনিষটাই সাধারণ নয়। এক বিশেষ শ্রেণী এদের সৃষ্টিকর্তা তুল্যদর্শী সম্প্রদায়ের জন্যে। আর্থিক ব্যাপারে সাম্যবাদ কার্য্যকরী, কিন্তু শিল্পবোধের ব্যাপারে নয়। শিল্পকে আমরা তাই এ থেকে দূরে রাখতে চাই।’
আবদুল মান্নান সৈয়দ পরোক্ষভাবে যে-কথাগুলো বলেছেন, আবদুস সেলিম সেখানে বলেছেন – স্পষ্ট করে : শিল্পকে তাঁরা বহুজনের সামবায়িক নির্মাণচেষ্টা থেকে দূরে রাখতে চান। এটিই ছিল শিল্পকলা প্রকাশের ভ্রূণচিমত্মা। দেশে যখন স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপলাভ করেছে, যূথবদ্ধতায়ই মানুষ যেখানে খুঁজেছে মুক্তির পথ; এমনকি শিল্পসাহিত্যেও সমাজবাদীধারা ছিল বেগবান – সেখানে শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি ও উপভোগে সমষ্টি নয় ব্যক্তিকে মুখ্য-আধার বিবেচনা করে পত্রিকা প্রকাশ এবং তা চালিয়ে যাওয়া কম সাহসের ছিল না! শিল্পকলার সংখ্যাগুলো সামনে রেখে একটি সূচিপত্র তৈরি করা যাক। বলে রাখা ভালো, এর প্রায় সব লেখাই প্রবন্ধ। সামান্য কয়েকটি কবিতা বা অন্য লেখা আছে। কৃতসূচিপত্রে প্রবন্ধগুলোর শিরোনামের পাশে কিছুই লেখা নেই; তৃতীয় বন্ধনী দিয়ে প্রবন্ধ বাদে অন্য লেখাগুলোর পরিচয় দেওয়া আছে, যাতে লেখার চারিত্র্য বোঝা যায় :
প্রথম সংকলন : ফাল্গুন ১৩৭৬
সাহিত্য ও অশস্নীলতা – আবদুস সেলিম
অবসিত ছন্দ – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
শিল্পে লোকায়িত অনুজ্ঞা – শামসুল আলম [সাঈদ]
চলচ্চিত্র ও আমরা – কাজী মেজবাহ ইকবাল
চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রদর্শক – জামাল খান
এলোমেলো নাট্যপ্রাসঙ্গিক – আবদুল মান্নান সৈয়দ
দ্বিতীয় সংকলন : চৈত্র ১৩৭৬
‘সন্ধ্যাসঙ্গীতে’র রবীন্দ্রনাথ – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
লরেন্সীয় স্বাতন্ত্র্য – আবদুস সেলিম
কাফ্কা : তাঁর প্রথম উপন্যাস – মফিজুল আলম
জাঁ-পোল সাঁৎর্-এর জীবনবেদ – আবদুল মান্নান সৈয়দ
আলেকজান্ডার বস্নকের প্রতীক ধারণার বিবর্তন – হুমায়ুন কবির
পল ক্লি ও তাঁর উদ্ভাবনশীলতা – কাজী মেজবাহ ইকবাল
জঁলু গদার জীবন, শিল্প ও প্রতিশ্রম্নতি – মুহম্মদ খসরু
আর্থার আদামভ – মাহবুবুল আলম
সম্পাদকীয় এক – আবদুল মান্নান সৈয়দ
সম্পাদকীয় দুই – আবদুস সেলিম
তৃতীয় সংকলন : কার্তিক ১৩৭৭
সাহিত্য ও সাহিত্য – আবদুল মান্নান সৈয়দ
সাহিত্য ও ইতিহাস – আতাউর রহমান খান
সাহিত্য ও ধর্ম – আবদুস সেলিম
চিত্রকলা ও সাহিত্য – কাজী মেজবাহ ইকবাল
চলচ্চিত্র ও সাহিত্য – আলমগীর রহমান
নাটক ও সাহিত্য – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
চতুর্থ সংকলন : ফাল্গুন ১৩৭৮
গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত জীবনানন্দের কবিতা [পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রিত কবিতা] –
নতুন বিতর্কে – প্রশান্ত ঘোষাল
শুদ্ধতম কবি – আবদুল মান্নান সৈয়দ
চিত্রকলায় পরাবাস্তববাদ – মূল : নরমান শ্লেনফ; অনুবাদ : আবদুস সেলিম
ধ্রম্নপদী সঙ্গীত ও অসুরাহত বাংলাদেশ – ইকবাল আহসান চৌধুরী
আলা রেনে প্রসঙ্গে – ইয়াসিন আমিন
যাত্রা প্রসঙ্গে – আসাদ চৌধুরী
ই. এম. ফস্টার – আবদুস সেলিম
মুনীর চৌধুরী – আবদুল মানণান সৈয়দ
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা – সেলিম সারোয়ার
সম্পাদকীয়
পঞ্চম সংকলন : বৈশাখ ১৩৭৯
তখন ও এখন [পুনর্মুদ্রিত প্রবন্ধ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘প্রভাতসঙ্গীত’-এর রবীন্দ্রনাথ – আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
শুদ্ধতম কবি – আবদুল মান্নান সৈয়দ
আধুনিক চিত্রকলা প্রসঙ্গে – কাজী মেজবাহ ইকবাল
ব্রিটিশ ভাস্কর্যের সাম্প্রতিক বিকাশ – মূল : নর্বার্ট লিনটন; অনুবাদ : আবদুস সেলিম
আজকের চলচ্চিত্র – ইকবাল আহসান চৌধুরী
কৃষ্ণ থিএটার – আবদুল মান্নান সৈয়দ
আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসান : ওঁরা দুজন – শাহাবুদ্দীন আহমদ
আনোয়ার পাশা : ব্যক্তিমানুষ – কোরবান আলি
বাংলাদেশের শিল্পকলা বিষয়ক প্রথম প্রস্তাব – আলমগীর রহমান
কলকাতার একটি নাটক ও অন্যান্য কথা – দাউদ হায়দার
বসমেত্মর সুর – আবদুস সেলিম
সম্পাদকীয়
ষষ্ঠ সংকলন : জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯ (জুন ১৯৭২)
গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত নজরুলের কবিতা [পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রিত কবিতা] –
উড়োনচ– কবিনটেশ : ছন্দ তাঁর – আবদুল মান্নান সৈয়দ
রেনোয়াঁ এবং ফলবতী মহিলারা – আতাউর রহমান খান
ব্রিটিশ ভাস্কর্যের সাম্প্রতিক বিকাশ – মূল : নর্বার্ট লিনটন; অনুবাদ : আবদুস সেলিম
ইদানীং চলচ্চিত্র : বিক্ষিপ্ত ভাবনা – মাহবুব জামিল
প্রসঙ্গ : নাটক – রামেন্দু মজুমদার
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ : কৃতী-অকৃতী – সিকদার আমিনুল হক
ক্রোড়পত্র : একগুচছ কবিতা [বিভিন্ন কবির কবিতা] –
মাঝরাতে রূপালি চাঁদ; একটি যথার্থ ভালোবাসা; চাঁদের ভেতরে একজন – দাউদ হায়দার
দুঃখের ভাঙন; নিঃসঙ্গ ভাষণ; ক্ষণিক – আবুল হাসান
একদিন অপু; নেমো না নদীর জলে; অপুকে – শাহনূর খান
কবিতা, আমার রাধা; ঘাতকের সন্ধানে একজন; প্রেমিকা – সেলিম সারোয়ার
তুমি; স্বর; পহেলা বৈশাখ ১৩৭৯ – আবদুল মান্নান সৈয়দ
ভেনাসের প্রতি; দুটি অসমাপ্ত কবিতা – মূল : স্যাফো; অনুসরণ : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
দুঃখের প্রতি; গ্রহ; সংক্ষেপ – মূল : পাবলো নেরুদা; অনুসরণ : আবদুস সেলিম
সম্পাদকীয়
সপ্তম সংকলন : পৌষ ১৩৭৯ (ডিসেম্বর ১৯৭২)
ভারতীয় ছবি [দুষ্প্রাপ্য প্রবন্ধ পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রণ] – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হুমায়ুন কবিরের অপ্রকাশিত কবিতা –
কৈশোরিক; বৃষ্টির অরণ্যে এস; নিবেদিতা; রক্তগত ভয়; পানশালায় সন্ধ্যা
শব্দই ঈশ্বর – মুহম্মদ নুরুল হুদা
কাম্যু, তাঁর আলজিরিয়া – নুরুল করিম নাসিম
চিত্রারোপিত আধুনিকতা – ওমর শামস্
স্থাপতিক নন্দনতত্ত্ব – ইফতিখারউদ্দিন মোহাম্মদ চৌধুরী
সুনীল কলেস্নালে চলচ্চিত্রের কালোত্তরতা – ফারুক আলমগীর
মুহূর্তের নাট্যচিমত্মা – আবদুস সেলিম
প্রাসঙ্গিকী –
বঙ্গদর্শন : জন্মশতবর্ষ [অংশ-বিশেষ সংকলিত] – রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
যামিনী রায় : তাঁর ছবি – সিকান্দার আমিনুল হক
কবি মেহেরুন্নিসা – আবদুল মান্নান সৈয়দ
কয়েকটি কবিতা [সংকলিত কবিতা] – আবুল কাশেম
শিল্পে স্বাভাবিকতা – সবিহ উল আলম
শরতের অনুভূতি : চেতনায় প্রতিচ্ছবি – শরীফুল কাদির
সম্পাদকীয়
অষ্টম সংকলন : বৈশাখ ১৩৮০ (এপ্রিল ১৯৭৩)
বাংলাদেশের কবিতা : ষাটের কবি – আবদুস সেলিম
সঙ্গীত ও বাস্তব – মূল : আই. রাজকিন; অনুবাদ : আহমদ ইয়াকুব জামিল
স্থপতিকে সঙ্গীতানুরাগী – ওয়াহিদুল হক
এক থেকে অনেক থেকে পুনশ্চ এক – গুরুদাস ভট্টাচার্য
রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি উৎসব প্রসঙ্গে – মোকাররাম হোসেন
প্রাসঙ্গিকী –
একুশ একটি উৎসব – আবদুস সেলিম
সাহিত্যের সামগ্রিক সচলতা – অসীম সাহা
শিল্পযাপন – আবদুল মান্নান সৈয়দ
সম্পাদকীয়
ক্রোড়পত্র : কবিতাগুচ্ছ
আমরা কেউ কারো জন্যে – সেলিম সারোয়ার
সরল প্রশ্ন; স্বীকারোক্তি – আসাদ চৌধুরী
লাওৎ-সে পড়ার পর; শরীরী শংখিনী – সিকদার আমিনুল হক
দীপ ও প্রদীপ; মাধবী বিষাদ প্রতিমা – রফিক আজাদ
কেবল যাবার থাকে – হাবীবুল্লাহ সিরাজী
স্ফুলিঙ্গ ১৯৭০ – আবদুল মান্নান সৈয়দ
মাত্র আটটি সংখ্যা প্রকাশ পায় শিল্পকলার; তাও আবার তিন বছরে। বছর এবং প্রকাশিত সংখ্যার অনুপাত বিবেচনা করলে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা এটি নয় নিশ্চয়। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে-পরে – অন্যভাবে বললে, একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পূর্ব ও উত্তরকালে নবরাষ্ট্রের সাহিত্য-সংস্কৃতির রূপরেখাটি নির্মাণে বেশ প্রভাবক ভূমিকা নিয়েছিল শিল্পকলা। গতানুগতিকতার বৃত্ত ভেঙে শিল্পের আকাশকে বিশ্বময় উন্মুক্তকরণে এবং এতে তরুণ লেখক, চিন্তক ও শিল্পবোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধকরণে শিল্পকলার ভূমিকা ছিল অত্ম:সলিলার মতো। সাতচল্লিশের ভারতভাগের পর পাকিস্তানবাদী সাহিত্যচিমত্মার অপ্রশস্ত নালায় ভাসতে থাকে সে-সময়ের সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য-সংস্কৃতি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন সেই নালা থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে খানিকটা স্রোতমুখী সরোবরে ধাবিত করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু তাকে বিশ্বমুখী উত্তাল সাগরে নিতে পারেনি। শিল্পকলা অপ্রশস্ত নালা থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বিশ্ববীক্ষার আলোকে ঊর্মিমুখর সমুদ্রে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পেরেও ছিল। অবশ্য এটা শুধু শিল্পকলা করেছিল তা নয়। সপ্তক (১৯৬২), স্বাক্ষর (১৯৬৩), যুগপৎ (১৯৬৩), বক্তব্য (১৯৬৩), স্যাড জেনারেশন (১৯৬৩), প্রতিধ্বনি (১৯৬৪), কণ্ঠস্বর (১৯৬৫), কালবেলা (১৯৬৫), শব্দরূপ (১৯৬৫), বিপ্রতীপ (১৯৬৭), হে নক্ষত্রবীথি (১৯৭০), বহুবচন (১৯৭০) – এসব লিটল ম্যাগাজিন বা সাময়িক পত্রিকাও এর কৃতিত্ব দাবিদার।
শিল্পকলার লেখকদের পরিচয় এবং এতে প্রকাশিত লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, পত্রিকাটি একঝাঁক লেখকতৈরিতে সহযোগ স্থাপন এবং লেখক ও পাঠকের মনে সাহিত্য-সংস্কৃতি কেন্দ্রিক চিমত্মার বহুদ্বার উন্মোচন করেছে। বিষয় হিসেবে শুধু সাহিত্য নয় – চলচ্চিত্র, নাটক, ইতিহাস, ধর্ম, চিত্রকলা, যাত্রা, ভাস্কর্য, সংগীত, নন্দনতত্ত্বসহ আরো কিছু ছিল এখানে। তাও আবার গতানুগতিক শংসাসূচক আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না শিল্পকলা। ধ্রম্নপদী বা নবদর্শনের আলোয় ব্যাখ্যা বা চ্যালেঞ্জের অভিপ্রায়ে লেখকেরা এখানে লেখনী ধারণ করেছিলেন। প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখা হিসেবে ছাপা হয়, আবদুস সেলিমের ‘সাহিত্য ও অশস্নীলতা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। আর প্রবন্ধের প্রথম শব্দ ‘সমকামিতা’! পরিশুদ্ধ যৌনতাও আপাতদৃষ্টে ‘লজ্জাকর’ বলে রাখঢাক করা সমাজে এমন বিস্ফোরক প্রবন্ধ দিয়ে আত্মপ্রকাশ বিস্ময়ের নয় কি? শুধু কি বিস্ময়? সাহসেরও! শিল্পকলা সাহসী পত্রিকা। বড় নয়, ক্ষুদ্রাবয়ব; প্রথম সংখ্যা সব মিলিয়ে মাত্র চবিবশ পৃষ্ঠার। কিন্তু অন্তর্গতভাবে বারুদধারী! কবিতা, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি নিয়ে বৈশ্বিকপ্রেক্ষায় ছোট ছোট বিস্ফোরক উপস্থাপনা। সব লেখার পেছনেই আছে বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শনের পরাকাষ্ঠা। প্রবন্ধরচনার প্রচলধারাও ছিন্ন; চ্যালেঞ্জটা এখানেও। দর্শন, বিশেষ করে পাশ্চাত্যদর্শনের প্রতি একটি বাড়তি ঝোঁক ছিল পত্রিকাটির। তাই লরেন্স, কাফ্কা, সার্ত্রে, জঁলু, আলা রেনে, রেনোয়াঁ, পল ক্লি, ফস্টারসহ অনেকের সাহিত্য ও চিত্রকলা নিয়ে একাধিক লেখা ছাপা হয় শিল্পকলায়। শুধুই কঠিন দর্শনতাড়িত ছিল না এর লেখাগুলো। কিছু মুক্তগদ্য ছাপা হয়েছে, যেগুলো অসাধারণ। যেমন : ওয়াহিদুল হকের ‘স্থপতিকে সঙ্গীতানুরাগী’, আবদুস সেলিমের ‘বসমেত্মর সুর’, গুরুদাস ভট্টাচার্যের ‘এক থেকে অনেক থেকে পুনশ্চ’ ইত্যাদি।
শিল্পকলা পরে পৃষ্ঠাসংখ্যায় বড় হয়েছে; প্রাসঙ্গিকী, কবিতা ইত্যাদি নামে কিছু বিভাগও যুক্ত হয়েছে এতে। চতুর্থ সংখ্যা থেকে বিষয় হিসেবে স্কেচও ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কয়েকটি কবিতাও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। ফলে, শুধু ‘গদ্যপত্রিকা’র চারিত্র্যটি আর ঠিক থাকেনি। এর তৃতীয় সংকলনটি বেশ আকর্ষণীয়, পরিকল্পিতও বটে। আত্ম:সম্পর্ক ও বৈপরীত্য খোঁজার চেষ্টা আছে সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদির মধ্যে। পাকিস্তানি শাসনামলে প্রকাশিত এটিই শেষ সংখ্যা। মুক্তিযুদ্ধের কারণে সংগতই দীর্ঘবিরতি পড়ে পত্রিকায়। এই পত্রিকার মাধ্যমেই আবদুল মান্নান সৈয়দের দুটি উল্লেখযোগ্য রচনার সূচনা ঘটে : একটি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে লেখা শুদ্ধতম কবি গ্রন্থ; অন্য রচনাটি কাজী নজরুল ইসলামের ছন্দ নিয়ে, যা তাঁর নজরুল ইসলাম : কালজ কালোত্তর গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পকলা নাটক প্রযোজনার দিকে যেমন এগিয়েছিল, তেমনি গ্রন্থ প্রকাশের কেন্দ্রও হয়ে উঠেছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বই মাতাল মানচিত্র ও গোলাপ বাগানে লাশ; শাহজাহান হাফিজের কবিতাগ্রন্থ সংগোপন স্বপ্ন; ইউনুস আলি-সম্পাদিত কবিতা-সংকলন শব্দশিল্প ইত্যাদি। আসলে, শিল্পকলা ধূমকেতুর মতো সাহিত্যাকাশে আলো দিয়ে আবার দ্রম্নতই যেন নিভে গেল। কিন্তু এতে যে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটল, যে-বহুবর্ণিলতা তৈরি হলো তার প্রভাবে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি হলো উজ্জ্বলতর, অমারজনিতে পেল পথ চলার দিশা। সৃষ্টির গগনে যেন এক কণা আলো এই শিল্পকলা। এই আলো হয়ে ওঠাতেই এর সার্থকতা।