শিল্পতত্ত্ব শিল্প-ইতিহাস ও শিল্প-সমালোচনার ধারা

আবুল মনসুর

আমরা যাকে ভিজুয়াল আর্ট বা দৃশ্যকলা হিসেবে অভিহিত করে থাকি তার মধ্যে চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। দৃশ্যকলার ইতিহাস অতিপ্রাচীন। বস্ত্ততপক্ষে মানবজাতির ইতিহাস ও দৃশ্যকলার ইতিহাস প্রায় সমবয়সী, চিত্র ও ভাস্কর্যের চর্চা শুরু হয়েছে বলতে গেলে পৃথিবীর বুকে মানুষের পদচারণার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। বড়-বড় সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে শিল্পকলার বিকাশ বিশেষভাবে সম্পর্কিত। প্রায়শ একটি সভ্যতার উৎকর্ষ বিশেষভাবে ওই সভ্যতাকালের শিল্পকলার  উৎকর্ষ দ্বারা বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর অন্যতম আমাদের এই উপমহাদেশের ভারতীয় সভ্যতা, যার মহিমার অন্যতম প্রকাশ ঘটেছে তার অবিস্মরণীয় শিল্পকীর্তিগুলোর ভেতর দিয়ে। ভারতের প্রাচীন শিল্পকলাকে আজ বিশ্বের শিল্প-ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রাচীনকালে সকল দরবারি শিল্পই রচিত হয়েছে প্রধানত ধর্মীয় আচার ও রাজকীয় মাহাত্ম্য প্রচারের প্রয়োজনে। পুরোহিতকুল ও রাজন্যবর্গ ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রক। এই নিয়ন্ত্রকশ্রেণির রুচিমাফিক এক-এক কালে শিল্পরচনার এক-একটি প্রথা, আঙ্গিক বা শৈলী বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, যাকে আমরা পরবর্তীকালে যুগশৈলী বা আঙ্গিক হিসেবে চিহ্নিত করেছি। শাসক ও পুরোহিতশ্রেণির কঠোর অনুশাসনে এক-একটি কালে শিল্পরচনার এক-একটি ধারা প্রবল হয়ে উঠেছে এবং শিল্পীরা কাজ করতেন ওই বিশেষ শৈলীর গ–র ভেতর ও পরম্পরার ভিত্তিতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রবলতর কোনো শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও তাদের শিল্পশৈলী আরোপ করছে।

এক-একটি কালের গণ্ডির মধ্যে সমাজের নির্দেশকদের দ্বারা ওই কালের বৈশিষ্ট্যম–ত শিল্পনির্মাণের বিশেষ মানদ- ও কারিগরি নিয়ম তৈরি হয়েছে। এগুলোকে ধর্মীয় অনুশাসনের আওতায় এনে রচিত হয়েছে ‘শিল্পশাস্ত্র’। খ্রিষ্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দী জুড়ে রচিত এ-শিল্পশাস্ত্রগুলোই সম্ভবত এ-উপমহাদেশে শিল্পকলাবিষয়ক প্রথম লিখিত কোনো ভাষ্য। তবে শিল্পের অন্য দুটি শাখা কাব্য ও নাটকের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট ‘অলংকারশাস্ত্র’ই ছিল অধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত, এ-সূত্রে ভরতের নাম সর্বাগ্রগণ্য। সম্ভবত ‘অলংকারশাস্ত্র’ থেকেই শিল্পকলার ভারতীয় তত্ত্ব ‘ষড়ঙ্গে’র উৎপত্তি হয়। বাৎসায়ন তাঁর কামসূত্রে ষড়ঙ্গের উল্লেখ করেছেন। শিল্পশাস্ত্রগুলোর কোনো-কোনোটিতে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্র নির্মাণের নিয়ম ও কৌশল সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে এবং শিল্পীকে এই নিয়মের গ–র মধ্যে শিল্পনির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন শিল্পশাস্ত্রগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীর বিষ্ণুধর্মোত্তর গ্রন্থের ‘চিত্রসূত্র’ অংশটি। এতে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্র নির্মাণের নিয়ম-প্রক্রিয়াদি এবং শিল্পের ষড়ঙ্গ বা ছয়টি মৌল দিক বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। চীনেও আলাদাভাবে শিল্পের একটি ষড়ঙ্গ-ধারণা বিস্তারলাভ করে, এটি ভারতীয় ষড়ঙ্গ থেকে কিছুটা ভিন্ন এবং চৈনিক শিল্পরীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। অবশ্য প্রাচীন গ্রিকসমাজে খ্রিষ্টপূর্বকালেই অনেকখানি ধর্মের খবরদারিমুক্ত দর্শনচর্চার যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তাতে প্রসঙ্গক্রমে শিল্প বা শিল্পীরাও (কাব্য-সাহিত্য ইত্যাদিসহ) আলোচনায় এসেছেন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকের গ্রিক দার্শনিক পেস্নটোর সেই বহুল-আলোচিত উক্তি সকলেরই প্রায় জানা আছে, যেখানে তিনি শিল্পস্রষ্টাদের

তৃতীয় স্তরের অনুকারক ও সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য তাঁরই শিষ্য অ্যারিস্টটল গুরুর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেননি, তিনি শিল্পের সংবেদনশীল অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষমতাকে অনুধাবন ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করতে পেরেছিলেন।

সেইসঙ্গে এটিও স্মর্তব্য যে, অতিপ্রাচীনকাল থেকেই দরবারি শিল্পধারার বাইরেও গ্রামীণ লোকসমাজে প্রচলিত ছিল পরম্পরাগত লৌকিক শিল্পধারা, যেটি শাসককুলের অনুশাসনকে সর্বদা তোয়াক্কা করেনি। তবে লোকশিল্পের গুরুত্ব শিক্ষিত সমাজে অনুভূত হয়েছে অনেক পরে, ফলে সে-বিষয়ে লেখালেখির সূচনা একটু পরবর্তীকালেই হয়েছে।

সারা পৃথিবীতেই পুরোপুরি ধর্মীয় গ–র সীমাবদ্ধতার বাইরে শিল্প-ইতিহাস বা সৌন্দর্যজ্ঞান বিষয়ে লিখিত ভাষ্য রচিত হয়েছে আরো অনেক পরে। মনে করা হয়ে থাকে যে, ইতালীয় রেনেসাঁসের সুবর্ণকাল ষষ্ঠদশ শতাব্দীর শিল্পী-ভাস্কর-জীবনীকার জর্জিও

ভাসারি-রচিত লাইভস অব দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট পেইন্টারস, স্কাল্পটরস অ্যান্ড আর্কিটেক্টস হচ্ছে শিল্পকলা বিষয়ে বিশ্বের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এটি ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই কেবল এদেশে শিল্পকলার ইতিহাস বা শিল্পবিচারের লিখিত রূপের চর্চা সূচিত হয়েছে। অবশ্য ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক জুড়ে ভারতে মুঘল শাসনামলে, বিশেষ করে সম্রাট আকবরের সময় থেকে, ইতিহাস রচনার চর্চা সূচিত হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আবুল ফজল মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারের সভাসদ হিসেবে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ আইন-ই-আকবরি। এ-গ্রন্থে অন্য বিবিধ বিষয়ের সঙ্গে, গৌণভাবে হলেও, সম্রাটের দরবারে পা-ুলিপি চিত্রায়ণের সমৃদ্ধ কর্মকা–র উল্লেখ আছে।

শিল্পকলাবিষয়ক লেখালেখির আওতায় অবশ্য অনেক বিষয় এসে যায়, যারা পরস্পর সম্পৃক্ত হলেও আলাদা বটে। এর মধ্যে নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) ও শিল্প-ইতিহাস (Art History) যেমন রয়েছে, তেমনি শিল্পতত্ত্ব (Art Theory) ও শিল্প-সমালোচনাও (Art Criticism) অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি কিছু ভিন্নতাও রয়েছে। এছাড়া খানিকটা দূরবর্তী হলেও পুরাতত্ত্ব আর নৃতত্ত্বের চর্চায়ও শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে নন্দনতত্ত্ব হলো সবচেয়ে প্রাচীন, যা বিশেষভাবে দর্শনভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পকলার সংজ্ঞা,

শিল্প-উপভোগ, সুন্দরের সঙ্গে এর সম্পর্ক, শিল্পের অন্তর্নিহিত গুণাবলি ইত্যাকার মোটামুটি শিল্পের কিছু চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিবেচনার আওতায় চিত্র-ভাস্কর্য ছাড়াও সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, নাট্যকলা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি শিল্পের সব কার্যক্রমই এসে পড়ে। অন্যদিকে শিল্পতত্ত্ব হলো একটি বিশেষ সময়কালে একটি বিশেষ অঞ্চলে শিল্পকলা-বিষয়ে প্রচলিত মত, ধারণা, শৈলীর প্রচলিত রীতি, যা ওই সময়ের ধর্ম-রাজনীতি-মূল্যবোধ ইত্যাদির মাধ্যমে নির্মিত হয় এবং স্থান থেকে স্থানান্তরে ও যুগ থেকে যুগান্তরে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাল ও মুঘল অনুচিত্র একই দেশ ভারতবর্ষে চর্চিত হলেও এদের আঙ্গিক-প্রকরণ-প্রকাশশৈলী একেবারেই ভিন্ন, অর্থাৎ এ দুটি চিত্রধারা স্বতন্ত্র দুটি যুগের ভিন্ন দুটি শিল্পতত্ত্বের আলোকে অবয়ব লাভ করেছে। শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে যিনি কাজ করেন তাঁর বিচরণ প্রধানত চিত্র ও ভাস্কর্যে, বড়জোর এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় স্থাপত্য। শিল্প-ঐতিহাসিক একটি বিশেষ শিল্পকর্ম বা ইতিহাসের একটি পর্যায় বা যুগের শিল্পকর্ম যাচাই করেন, এ-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণাদি পরখ করেন। এ-কাজে তিনি তৎকালীন শিল্পতত্ত্বের সাহায্য নেন। তাঁর কাজ শিল্পকর্মটি বা শিল্পধারাটির জন্য ইতিহাসের পরম্পরায় যথার্থ স্থানটি নির্দিষ্ট করা, এর গুণগত বিচার করা নয়। গুণগত মান নির্ণয়ের কাজটি

হচ্ছে শিল্প-সমালোচকের দায়িত্ব। নন্দনতাত্ত্বিকের মতোই

শিল্প-সমালোচকের বিচরণ শিল্পের সকল শাখায়। তাঁর নির্দিষ্ট কর্মটি হচ্ছে একটি বিশেষ মাধ্যমে সম্পাদিত একটি বিশেষ শিল্পকর্মের বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিচার এবং শিল্পের মাপকাঠির নিরিখে এর গুণগত অবস্থান নির্ণয়। এছাড়া পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিকরাও তাঁদের বক্তব্যের সহায়ক হিসেবে শিল্পকর্মের আলোচনা করে থাকেন।

আধুনিক শিল্প-ইতিহাস বা শিল্প-সমালোচনা বলতে যা বোঝায় তার চর্চা এ-উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলেই সূচিত হয়েছে। প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের দ্বারা ইংরেজি ভাষায়। পরবর্তীকালে দেশি লেখকরা লিখতে শুরু করেন, প্রথমে ইংরেজিতে, এবং পরে ক্রমশ মাতৃভাষায়। প্রথম দিকে পুরাতত্ত্ববিদরাই প্রাচীন স্থাপত্য ও তার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট চিত্র ও ভাস্কর্য বিষয়ে লিখেছেন – এঁদের মধ্যে জেমস ফার্গুসন, বুখানন হ্যামিলটন, জন মার্শাল, আলেকজান্ডার কানিংহাম, ডি.আর. ভা-ারকর, কে.এন. দীক্ষিত, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অগ্রগণ্য। তবে ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত অজন্তা চিত্রাবলির ওপর জর্জ গ্রিফিথের দ্য পেইন্টিংস ইন দ্য বুড্ডিস্ট কেভস অব অজন্তাকেই সম্ভবত একজন য়ুরোপীয় শিল্পবেত্তা-রচিত ভারতীয় শিল্পকলা-বিষয়ে প্রথম মৌলিক প্রামাণ্য গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। পরবর্তীকালে ই.বি. হ্যাভেল, ডবিস্নউ.জি. আর্চার ও তাঁর স্ত্রী মিলড্রেড আর্চার, পার্সি ব্রাউন, স্টেলা ক্রামরিশ, আর.ডবিস্নউ. স্কেলটন, ডেভিড ম্যাকক্যাচনসহ আরো অনেক য়ুরোপীয় শিল্পবিদ ভারতীয় ও বাংলার শিল্পকলা এবং লোকশিল্পের বিবিধ বিষয় নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। এখনো ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পকলা পশ্চিমা প–তদের অনেকেরই বিশেষ আগ্রহের বিষয় এবং এ-বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থাদি রচিত হয়ে চলেছে।

ভারতীয় শিল্প-প–তদের অনেকেই শুধু ইংরেজিতে লিখেছেন, আবার অনেকে প্রথমদিকে ইংরেজি রচনায় অভ্যস্ত থাকলেও পরবর্তীকালে মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেউ-কেউ শুধু বাংলাতেই লিখেছেন। যেসব ভারতীয় শিল্পবেত্তা এ-কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথম দিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কে.এন. দীক্ষিত প্রমুখ ছাড়াও নলিনীকান্ত ভট্টশালী, ও.সি. গাঙ্গুলী, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, সি. শিবারামমূর্তি, মুলকরাজ আনন্দ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। ভারতীয় শিল্পকলাকে বিশ্বদরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব আনন্দ কেন্টিশ কুমারস্বামী। ড. গোলাম ইয়াজদানির সম্পাদনায় ১৯৩১-৫৫ সালে চার খ– প্রকাশিত অজন্তা চিত্রমালার সুবৃহৎ অ্যালবাম তখনকার প্রেক্ষাপটে একটি যুগান্তকারী কাজ। পরবর্তীকালে ইংরেজিতে বি.এন. গোস্বামী, কে.জি. সুব্রহ্মণ্যন, পার্থ মিটার, গীতা কাপুর, গোলাম মহম্মদ শেখ উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।

বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম শিল্পকলাবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন শ্যামাচরণ শ্রীমানি। ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত শ্রীমানীর গ্রন্থ সূক্ষ্ম শিল্পের উৎপত্তি ও আর্য্যজাতির শিল্পচাতুরী এ-কারণে বাংলার শিল্প-ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক স্মারক। সূচনাপর্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেশচন্দ্র সেন, অরবিন্দ ও নীহাররঞ্জন রায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরিমাণে স্বল্প হলেও বাংলাভাষায় শিল্পকলা বিষয়ে লিখেছেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথ তো সর্ববিষয়েই কিছু না কিছু মৌলিক ভাবনার পরিচয় রেখেছেন, চিত্রকলাও এর বাইরে নয়। তবে শিল্পকলা-বিষয়ে বাংলাভাষায় এখনো শ্রেষ্ঠতম লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার শিল্প-প্রকৃতি নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রণিধানযোগ্য কাজ করেছেন সরসীকুমার সরস্বতী, ও.সি. গাঙ্গুলি, আর.ডবিস্নউ. স্কেলটন, স্টেলা ক্রামরিশ, বি. সান্যাল, যোগেশচন্দ্র বাগল, অজিত ঘোষ, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, জয়া আপ্পাস্বামী, এস.এস. বিশ্বাস, কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, ডেভিড ম্যাককাচিওন, সুকুমার সেন, দেবলা মিত্র, প্রণবরঞ্জন রায়, শোভন সোম, কমল সরকার, সন্দীপ সরকার, মনসিজ মজুমদার, মৃণাল ঘোষ, তপতী গুহঠাকুরতা, সত্যজিৎ চৌধুরী প্রমুখ। শিল্পীদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের পর বাংলাভাষায় শিল্পকলা-বিষয়ের সেরা লেখক অবশ্যই বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। এছাড়া নন্দলাল বসু, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, অতুল বসু, পরিতোষ সেন প্রমুখ শিল্পীও শিল্পকলা-বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।

বাংলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে হলেও এ-কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন নলিনীকান্ত ভট্টাশালী ছাড়া আহমদ হাসান দানি, এফ.এ. খান, এ.বি.এম. হোসেন, নাজিমুদ্দিন আহমেদ, এনামুল হক, এ.বি.এম. হাবিবুলস্নাহ, মুখলেসুর রহমান, তোফায়েল আহমদ, আ. ক. ম. যাকারিয়া, এ.কে.এম. শামসুল আলম, পারভীন হাসান প্রমুখ। শিল্প-আলোচনা সূচিত হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ্, সৈয়দ আলী আহসান, সাদেক খান, আলমগীর কবির, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের হাতে। আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, হাশেম খান প্রমুখ শিল্পী শিল্পকলা-বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। নাম উল্লেখ না করেই বলা যায়, তরুণতরদের অনেকেই শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণা ও শিল্প-সমালোচনার কাজে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন।

শিল্পকলার মতোই শিল্প-আলোচনাও বিভিন্ন সময়কালের পরিধিতে বিবিধ রূপ পরিগ্রহ করেছে। প্রাচীন ধর্মাশ্রিত শিল্পশাস্ত্রের কথা বাদ দিলেও ষোড়শ শতকের পশ্চিমের ভাসারি বা প্রাচ্যের আবুল ফজলের রচনারীতি থেকে আজকের শিল্প-আলোচনা যোজন-যোজন দূরে সরে এসেছে। ভাসারি বা আবুল ফজলের রচনায় প্রধানত তৎকালীন শাসককুলের স্তাবকতার আলোকেই শিল্পকলার মূল্যায়ন করা হয়েছে। ভাসারি প্রধান শিল্পীদের আলোচনায়, বিশেষত মিকেলেঞ্জেলো প্রসঙ্গে, বারবার ঐশ্বরিক প্রতিভার জয়গান গেয়েছেন। ঐশ্বরিক না হোক, শিল্পসৃষ্টির ক্ষমতা যে একটি জন্মগত প্রতিভার বিষয় এবং এর অনুপ্রেরণা আসে জাগতিক অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো অতীন্দ্রিয়লোক থেকে, এমন ধারণা কিন্তু বহু শতাব্দীজুড়েই মানুষের মনে দৃঢ়নিবদ্ধ ছিল। রেনেসাঁস-পর্বে পেস্নটোর মতবাদ আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এ নিও-পেস্নটোনিজম ছিল বেশ কল্পনাবিলাসী। অবশ্য আলবার্তি, লিওনার্দো, ড্যুরর প্রমুখ চিন্তক, যাঁরা সরাসরি শিল্পনির্মাণে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের রচনায় তাঁরা শিল্পের কল্পনাবিলাসের চেয়ে প্রায়োগিক প্রাসঙ্গিকতার প্রতি অধিক দৃষ্টি দিয়েছেন। অন্যদিকে এমনকি ঊনবিংশ-বিংশ শতকের দার্শনিক বেনিদেত্তো ক্রোচে ১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ এস্থেটিকে শিল্পসৃজনের প্রণোদনাকে ইনটুইশন বা অভিজ্ঞতা ও বিচারবহির্ভূত সজ্ঞাত অনুভূতি থেকে প্রাপ্ত বলে ধারণা ব্যক্ত করেছেন। আমাদের দেশেও আনন্দ কুমারস্বামী, ই.বি. হ্যাভেল, অরবিন্দ ঘোষ, সিস্টার নিবেদিতা প্রমুখ ভারতীয় শিল্পের দৃশ্যগত শিল্পগুণের চেয়েও এর আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ও ব্যঞ্জনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

অষ্টাদশ শতকের আগে পাশ্চাত্যে শিল্পতত্ত্ব পৃথক আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি, এটি ছিল দর্শনের একটি অংশ। মূলত শিল্পতত্ত্ব বা সৌন্দর্যতত্ত্ব কোনোটিই দর্শনচিন্তার প্রভাবমুক্ত ছিল না। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ দার্শনিক হবস, লক, স্যাফটব্যারি, হিউম, বার্ক প্রমুখ ব্যবহারিক-দার্শনিক চিন্তাবিদ আলাদাভাবে শিল্পের মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও ফলাফল নিয়েও ভেবেছেন। অষ্টাদশ শতকের জার্মান দার্শনিক বমগার্টেনকে আধুনিক সৌন্দর্যচিন্তার জনক বলা হয়। বমগার্টেনের পর দর্শন ও নন্দনতত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আরেক জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। সৌন্দর্যতত্ত্বকে অধিবিদ্যক জগৎ থেকে পৃথক করে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়নের ধারা প্রবর্তন করেন আরেক জার্মান ফ্রেডরিখ হেগেল। পরবর্তীকালে মার্কস ও লেনিন এ-দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্পকে বিবেচনার বিষয়ে অবদান রাখেন। এঁরা ছাড়াও শোপেনহাওয়ার, কিয়ের্কেগার্দ, নিৎশে, গ্যাডামার ও আরো অনেক দার্শনিক শিল্প ও সৌন্দর্যতত্ত্ব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

অষ্টাদশ শতকের জার্মান লেখক জে.জে. উইংকেলম্যানকে আধুনিক শিল্প-ইতিহাস ও সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ মনে করা হয়। পাশ্চাত্যে এ-বিষয়ে অসংখ্য প–তজন অবদান রেখেছেন। এঁদের সবার নাম উল্লেখ করা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। হেইনরিখ উলফ্লিন, আর.জি. কলিংউড, লিও টলস্টয়, ক্রিস্টোফার কডওয়েল, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, ক্লাইভ বেল, মার্টিন হেইডেগার, জন রাস্কিন, রজার ফ্রাই, পেস্নখানভ, গিয়র্গ লুকাচ, আর্থার ডান্টো, ই.এইচ. গমব্রিখ, হেনরি ফসিলন, হার্বার্ট রিড, এরউইন প্যানোফ্স্কি, ফ্রেডেরিখ আনটাল, সুসান সনটাগ, থিওডর অ্যাডর্নো, জন বার্জার, ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ প্রমুখ এ দীর্ঘ তালিকার অল্প কয়েকটি নাম মাত্র।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে য়ুরোপের শিল্পকলা ধর্মের নিয়ন্ত্রণমুক্ত দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবজগৎকে রূপায়িত করার দিকে ঝুঁকতে থাকে। রিয়ালিজম ও তার উত্তরসূরি ইমপ্রেশনিজম এই পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইমপ্রেশনিজম-পরবর্তী সময়ে শিল্পচর্চার ধরনে যে বৈপস্নবিক পরিবর্তনসমূহ ঘটতে থাকে শিল্প-আলোচনা অনেক সময় সে-তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। শিল্পের অতিলৌকিক অনুপ্রেরণা তত্ত্বের বিপরীতে একটি রোম্যান্টিক ভাববাদী শিল্পদর্শন বহুকাল চলেছে, যেখানে জীবন ও অভিজ্ঞতার বাইরে শিল্পীর সজ্ঞাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ‘সাবলাইম’ বা মহিমান্বিত-পরম-উলস্নাস বা অভিভূত-অনুভূতির মধ্যে শিল্পের সার্থকতা নির্ণয় করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাস্তবতাবাদী শিল্পদর্শন শিল্পের সাবজেকটিভ প্রেরণার চেয়েও শিল্পবস্ত্তর অবজেকটিভ অবলোকনকে অধিক মূল্য দিয়েছে। মার্কসীয় শিল্পদর্শন একে আরো সামাজিক বস্ত্তবাদের আলোকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছে। ফর্মালিস্ট বা আঙ্গিকবাদীরা এবং অ্যানালিটিক্যাল বা বিশ্লেষণবাদীরা শিল্পের স্বরূপ খুঁজেছেন তার আঙ্গিক, নির্মাণ ও উপস্থাপনের মধ্যে। আবার মডার্নিজম বা আধুনিকতাবাদ শিল্পের একটি সার্বভৌম, বৈশ্বিক ও সমন্বিত রূপ কল্পনা করেছে।

একেবারে সাম্প্রতিককালের পোস্ট-মডার্নিস্ট ধারণায় শিল্প প্রকাশমান স্থানিক বৈশিষ্ট্যে, নানান খ–ত রূপে ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্র-বিবিধতায়। অন্য সব তত্ত্বে শিল্পকে একটি অক্ষয়, চিরায়ত ও মহীয়ান সৃষ্টি রূপে দেখার যে-প্রবণতা রয়েছে পোস্ট-মডার্নিজম তার বিপরীতে শিল্পকে দেখতে চায় ক্ষণস্থায়ী, প্রাত্যহিক ও মহত্ত্বের অভিধাবর্জিত রূপে। এই পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে সমসাময়িককালে শিল্প-আলোচনা আবারো তার সমকালের শিল্পরূপের সহযাত্রী হয়ে উঠছে।

ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্প-আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের এসব ভাবনা ও ধারণার প্রভাব পড়েছে। আনন্দ কুমারস্বামী, ই.বি. হ্যাভেল, অরবিন্দ ঘোষ, নিবেদিতা প্রমুখের অধ্যাত্মবাদী শিল্পদর্শনের বিপরীতে অবনীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ রোম্যান্টিক-ভাববাদী শিল্পভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। এঁদের পরবর্তী লেখককুল মূলত পশ্চিম-প্রভাবিত বাস্তবতাবাদ ও বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কেউ-কেউ মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পকে যাচাই করারও প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গেও নবীন

শিল্প-আলোচকরা নতুনতর দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালির শিল্পকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন, যেখানে পশ্চিমের আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় যেমন মেলে, তেমনি নিজেদের উত্তর-ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে সমসাময়িক দৃশ্যকলাকে অবলোকনের একটি প্রয়াসও লক্ষ করা যায়।