শিল্পাঙ্গনে কারু তিতাসের একক প্রদর্শনী স্মৃতির জোনাকি

নিমগ্ন তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে, নক্ষত্রের

ওপারে কী আছে ভাবি। এই যে এলাম

সব ছেড়েছুড়ে…

তবু আসতেই হ’ল, টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে, শামসুর রাহমান

 

নিজের ভেতরে এক গুমোট স্মৃতি অব্যক্ত থেকে যায় সবারই। তিতাসেরও তাই। তিতাস খুব ভোরের আকাশ দেখেন না, কারণ দীর্ঘ রাত জেগে থাকার পর তিতাসের চোখে ভোর আবছা হয়ে আসে। তেল, জল, অ্যাক্রিলিক, পেনসিল – সব মাধ্যমেই তিতাস স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

তিতাসের কাজ একটা ঝাপসা হয়ে আসা অনুভূতি তৈরি করে দেয়। স্মৃতি যেমন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। একবার এ-নগরের বাইরে মফস্বল শহরে তিতাস বেড়াতে গেলেন। ভাঙাচোরা পথঘাট, রিকশার সারি চলছেই। তাঁর স্মৃতিতে মফস্বল শহর গেঁথে আছে। সে মফস্বল ধরা দেয় চারকোল বা কাঠকয়লার অাঁকিবুঁকিতে। গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া পথ থেকে কিছুটা আলো দর্শক অনুভব করতে পারেন। কারু তিতাস ছবির বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেন। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, সৃষ্টির যন্ত্রণাকে তিনি আত্মস্থ করেই ক্যানভাস গড়েন।

কারু তিতাস নিজের সম্পর্কে বয়ান করেন এভাবে – দিনশেষে মানুষকে বোধহয় নিজের কাছেই ফিরে যেতে হয়। নিজের ভেতরেই তৈরি হয় একের পর এক দৃশ্যপট। সেখানে দেখা হয় বিচিত্র মানুষের সঙ্গে। এই বিচিত্র মানুষ আর প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝ থেকে কারু তিতাস ছবির বিষয় বাছাই করেন। তাঁর ক্যানভাস বাস্তবধর্মী দৃশ্যানুভূতির চেয়ে খানিক ব্যতিক্রম। সরাসরি আলোকচিত্রের আদলে বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম গড়েন না। অর্ধবিমূর্ত ধাঁচে বিষয়ের বর্ণনা দেন। কখনো কখনো কাজের মাঝে জ্যামিতি হাজির করেন। এর কারণ হিসেবে বলা যায় – প্রত্যেক বিষয়ের মধ্যেই প্রকাশিত অথবা অপ্রকাশিত জ্যামিতি রয়েছে। এই জ্যামিতিকে ছবির বিষয়ের মাঝে তিনি হাজির করেন। তাঁর অাঁকা ‘স্মৃতির দুয়ার’ ছবিটি নিয়ে কথা বলা যায় এভাবে – স্মৃতি সবসময় পুরনোকে মনে করায়। এখানে একটি ভঙ্গুর দরজাই শেষ কথা নয়। দরজা আমাদের যেমন আগলে রাখে, নিরাপত্তা দেয়, তেমনি দরজার সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বও হয়ে যায়। এই জড়বস্ত্তটির সঙ্গে কীভাবে যেন ওই ঘরে বসবাস করা সব মানুষের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সেটি একসময় পুরনো হয়। খসে পড়তে চায়। ঘুণপোকা বাসা বাঁধে। পাশ থেকে ভেঙে যায়, রোদ এসে তার টুকরো আলো আটকে দিয়ে যায়, এসবই স্মৃতি। কারু তিতাস আত্মকথনকেই এখানে চিহ্নিত করেছেন। রং বা দ্যুতিময় রঙের বিন্যাস গুরুত্ব পায়নি। এখানে বিষয়ের সঙ্গে শিল্পীর মমত্ববোধ গুরুত্ব পেয়েছে।

এ-প্রদর্শনীর তেপ্পান্নটি কাজের বেশিরভাগ জলরঙে অাঁকা। সব কাজে বাস্তবধর্মী আচরণের দেখা না মিললেও বিষয়ের সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগ স্থাপন অনেকটা সহজ বলা যায়। নদীর ঘাটে জটলাগা নৌকার সারি থেকে শুরু করে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ইনানি বিচে বিকেলে বেঁধে রাখা নৌকার বহর দর্শককে কাছে নিয়ে যায়। বিষয়ের সঙ্গে দর্শকের একধরনের যোগাযোগ তৈরি করে দেয়। তিতাসের ছবিতে স্থিরতা পাওয়া যায় না। সবকটি ছবিতে একধরনের গতি বা ছুটে চলা দেখা যায়। কারু তিতাস ছবিতে নির্দিষ্ট কিছু রং ব্যবহার করেন। ধূসর, কালো, সাদা, খুব অল্প করে নীল ও উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন।

বিশেস্নষণের জন্য তিতাসের কাজকে তিনটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া যায়। ‘অন্তর্যাত্রা’ শিরোনামে এ-প্রদর্শনীর মোট কাজের সংখ্যা তেপ্পান্ন হলেও বড় কাজ বারোটি। অন্যান্য কাজের আকৃতি বা মাপ নানা রকমের। এতে প্রদর্শনীর মধ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। বিভিন্ন মাপের কাজে দর্শক নানাভাবে ছবির রস-আস্বাদন করতে পারে। ছোট কাজের মধ্যে একধরনের সূক্ষ্ম মিনিয়েচারধর্মী আচরণ রয়েছে। তিতাসের বেশিরভাগ কাজ ঊর্ধ্বমুখী। আড়াআড়িভাবে ক্যানভাস বেছে নেওয়ায় বিষয় বর্ণনায় অতিসাধারণ বলা যায়। এ-প্রদর্শনীতে তিনটি মাধ্যমের পাশাপাশি পেনসিলে অাঁকা দু-একটি কাজ দেখা যায়। পেনসিলের কাজে আলো-ছায়া আর পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ করায় মনোযোগী হতে দেখা যায় শিল্পীকে। দৃশ্যশিল্পের দর্শকের কাছে বাস্তবধর্মী উপস্থাপন-কৌশল বেশ জনপ্রিয়। বাস্তবধর্মী শিল্পকর্মের নির্মাণ-পদ্ধতি অনুসরণ করে তিতাস নিজস্ব করণরীতি গড়ে তুলেছেন। ফলে তাঁর কাজগুলো স্বতন্ত্র একটি ধরনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই স্বকীয়তা নির্মাণ করতে গিয়ে তিতাস ঘুরে এসেছেন নানাবিধ করণ-প্রকরণের পথে। গত শতকের নববই দশকের শেষভাগে কারু তিতাস তাঁর কাজ দর্শককে প্রথম দেখিয়েছেন। সে-সময়কার কাজের করণকৌশল, উপস্থাপন-রীতি ছিল ভিন্ন। ভিন্ন আঙ্গিকে তিনি নিজেকে নির্মাণ করতে চান। এমন ধারণা সে-সময় থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। প্রাচীনকালে দরবারি শিল্পীদের চর্চায় একধরনের রীতি বা প্রথা চালু ছিল, যেটি দরবারের বাইরে এসেও সাধারণ মানুষের মাঝে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। সেসব শিল্পকলা ছিল বাস্তবধর্মী শিল্পকলা। এখানে কারু তিতাস ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত ছবির নির্মাণরীতিকে অনুসরণ করেছেন। যে-রীতিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ধরনই দৃশ্যমান।

কারু তিতাস বিষয় হিসেবে বেছে নেন প্রকৃতি ও তাঁর আশপাশের পরিবেশকে। বিভিন্ন সময়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে তিনি স্মৃতিতে গেঁথে রেখেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য। বিষয় হিসেবে নির্মাণ করেন সেসব স্মৃতিচিহ্ন, যা তাঁর মনের মাঝে গেঁথে আছে। উলেস্নখযোগ্য ছবি হলো – ‘মফস্বলের স্মৃতি’, ‘সকালের আলো’, ‘সমুদ্র যাত্রা’, ‘বিকেলের ইনানী’, ‘বৃষ্টি, জল ও জীবন’, ‘ফুলের কাছে’। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা ছবির বিষয়কে আত্মস্থ করে তিতাস ক্যানভাসে একরকম গল্প বলেন। গল্পে গল্পে দর্শকের সঙ্গে তিতাসের যোগাযোগ তৈরি হয়।

তিতাসের ক্যানভাসে একধরনের বুনট হাজির হয়। মসৃণ চিত্রতলের ওপর বিষয় বর্ণনা করে নেওয়াকে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এ-প্রসঙ্গে তিনটি কাজের কথা উলেস্নখ করা যায় – ‘বৃষ্টি’, ‘আমায় যে পিছু ডাকে’ ও ‘স্মৃতির দুয়ার’। তিনটি কাজই অ্যাক্রিলিক রঙে করা। উলস্নম্ব আকৃতির জমিনের ওপরের অংশে গাঢ় নীলের স্তর ভেদ করে দেখা দিয়েছে আলট্রা মেরিন বস্নু। ‘আমায় যে পিছু ডাকে’ ছবিটি একেবারে গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে উদয় হওয়া কিছু স্মৃতিচিহ্নের কথা মনে করায়। ইউরোপীয় চিত্রকলায় অভিব্যক্তিবাদী ধারায় রচিত শিল্পকর্মে দেখা যায় মানুষের মননে চলতে থাকা সূক্ষ্ম অনুভূতির দৃশ্যায়ন। শিল্পের এ-পর্যায়কে চূড়ান্ত রূপ বলা যায় না। কারণ সৃষ্টির সমাপ্তি বলে কোনো কিছু নেই। শিল্পীর সৃষ্টির আকাঙক্ষা নিরন্তর, সাধনাও নিরন্তর। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রামেত্ম শিল্পীদের অন্তর্গত অনুভূতির প্রকাশ চলতেই থাকবে। তিতাসের ‘আমায় যে পিছু ডাকে’ ছবিতে অতীতের কিছু সময়ের চিহ্নের উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে গুমোট কালো ছায়া ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে ত্রিকোণ, চতুষ্কোণ, লালরঙা চিহ্ন। এই চিহ্নগুলোই অতীত কিংবা উৎসব। শিল্পী জীবনের উৎসবকে হাজির করেছেন।

এ-প্রদর্শনীর আধাবাস্তব রীতিতে গড়া আরো একটি ছবি – ‘জল ও জীবন’। এতে অনেক দূরে মিলিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে জলের সখ্য তৈরি হয়েছে। শিল্পী এ-ছবির বিষয় তৈরি করেন নদীর এপার থেকে। অনেক দূরে নদী পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষগুলো জলের সঙ্গী হয়ে আছে। এ-ছবিটি সে-কথাই বলে।

তিতাসের ছবির কয়েকটিতে বৃষ্টি হাজির হয়েছে। বৃষ্টিমাত্রই শিল্পীর কাছে উৎসব। জলের এ-ধারা বেয়ে ক্যানভাসে বৃষ্টির গল্প বারবার হাজির হয়েছে। অনেকগুলো বৃষ্টি শিরোনামের কাজের মাঝে গাঢ় নীলরঙা আকাশের মাঝে লাল-কালো দুজন মানুষের হেঁটে যাওয়াকে বৃষ্টি উদ্যাপনের মানুষ মনে হয়।

তিতাসের সবকটি কাজের মাঝে একটুখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে দেয়ালে কাজের বিন্যাস। পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে এ-আয়োজনকে আরো গুছিয়ে করা সম্ভব হতো।

‘অন্তর্যাত্রা’ শিরোনামে কারু তিতাসের এ-প্রদর্শনী শিল্পাঙ্গনে গত ১৬ ফেব্রম্নয়ারি শুরু হয়ে শেষ হয় ২ মার্চ।