শিল্পাঙ্গন : ধানমণ্ডি থেকে লালমাটিয়া

বরং নগরীর খিড়কি-দুয়ার খুলে নিঃশ্বাসের মহিমান্বিত হাওয়ায়

ওড়াব আমার ঘুম, আমার স্বপ্নের পেখম

– চিত্রকল্পের শব্দভ্রূণে মুগ্ধ বালক

খালিদ আহসান

শিল্পাঙ্গন শুরু করেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা-ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমদ। ১৯৯২ সালের ১৪ মে ধানম–তে প্রদর্শনশালা শিল্পাঙ্গনের যাত্রা। এটি নববইয়ের দশকের শিল্পের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অগ্রজ-অনুজদের শিল্পকলা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয় এই গ্যালারি। গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ায় নতুন ঠিকানায় পথচলা শুরু করে শিল্পাঙ্গন। ৩৪ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে এবারের প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে। গুরুশিল্পী এসএম সুলতান, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী থেকে শুরু করে খ্যাতিমান শিল্পীদের কাজ এ-প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে প্রকাশিত কথায় শিল্পাঙ্গন জানান দেয় এভাবে – ‘শিল্পাঙ্গনই ১৯৯৭ সালে প্রথম এই দেশের মানুষকে ইউরোপীয় মাস্টার পেইন্টারদের প্রদর্শনী উপহার দেয়। ধানম–র ভাড়া করা বাড়িতে নির্মিত একটি গ্যালারির দেয়ালে শোভা পায় পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, ব্রাকসহ সর্বকালজয়ী শিল্পীদের অরিজিনাল পেইন্টিং।’

এভাবে জনরুচির পরিবর্তনে দৃশ্যশিল্পের কারিগরদের প্রত্যক্ষ ভূমিকার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় শিল্পাঙ্গন গ্যালারির মাধ্যমে। ফয়েজ আহমদের অনুপস্থিতিতে শিল্পাঙ্গনের হাল ধরেন গণমাধ্যম-ব্যক্তিত্ব রুমী নোমান। তাঁরই নিরন্তর পথচলায় সাহস জুগিয়েছেন আমাদের অগ্রজ-অনুজ শিল্পীরা। ঢাকা শহরে গ্যালারি তৈরির মতো বাড়ি ভাড়া পাওয়া, সেইসঙ্গে ভাড়ার সংকুলান করে শিল্পকর্ম প্রদর্শনী করা দুরূহ কাজ।

এমন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শিল্পাঙ্গন তাদের এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশে আধুনিক ও বড় পরিসরের গ্যালারি গড়ে উঠেছে শিল্পাঙ্গনেরই হাত ধরে। বলা যায়, শিল্পের বাজার তৈরি, দর্শকদের কাছে শিল্পীদের কাজ তুলে ধরার জন্যে যে-প্রদর্শনী কেন্দ্র প্রয়োজন, সেটির পথ শিল্পাঙ্গনই দেখিয়েছে।

এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম – ‘রিইউনিয়ন’।

প্রদর্শনীতে ১৯৮৯ সালে আঁকা এসএম সুলতানের রেখাচিত্র ‘কলসী কাঁখে নারী’ ছবিতে দেখা যায় পেশিবহুল মানুষের অবয়ব। পটুয়া শিল্পী কামরুল হাসানের রেখাচিত্রের মাধ্যম লিথোগ্রাফ। নারীমুখের সঙ্গে আলংকারিক নকশা, বক ও অনেকগুলো পাখির সমাবেশের মাধ্যমে নকশাধর্মিতা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৯৩ সালে কাইয়ুম চৌধুরী এঁকেছিলেন নারীমুখের রেখাচিত্র। অল্প কয়েকটি রেখার মাধ্যমে দ্রম্নততার সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর কাজ এখনো আমাদের মুগ্ধ করে চলেছে।

বিজন চৌধুরীর বাস্তবধর্মী রেখাচিত্রের বিষয় নারী ও পুরুষ। গাঢ় মোটা রেখার সাহায্যে আঁকা পরিবারের আবহ বোঝা যায় কাজটিতে। আবুল বারক আলভীর লিথোগ্রাফের বিষয় জ্যামিতি। পুরো চিত্রতলকে চারভাগে ভাগ করে কালো কালিতে ছোপছোপ বুনট তৈরি করেছেন শিল্পী। আবদুল মান্নানের আঁকা রবীন্দ্রনাথের  প্রতিকৃতিতে আলোছায়ায় রবীন্দ্রনাথের মায়াবী মুখ ফুটে উঠেছে। আবদুস শাকুরের বেহুলার প্রতিকৃতিতে আলট্রামেরিন বস্নু রঙের ব্যবহারে লোকজ গল্পের চরিত্র স্পষ্ট। অলকেশ ঘোষের পানাম নগরী আমাদের অতীতের কথা মনে করায়। অলকেশ ঘোষ বাস্তবধর্মী ছবি নির্মাণ করেন, সঙ্গে আমাদের দেন জলরং দেখার আনন্দ। স্বচ্ছ জলরঙে গড়ে ওঠা প্রকৃতির রূপ-স্নিগ্ধতা অলকেশ ঘোষের কাজে উপস্থিত। আহমেদ শামসুদ্দোহা আমাদের বাস্তবধর্মী প্রকৃতি এঁকে দেখান সূক্ষ্ম অনুধাবনের মাধ্যমে। এ-প্রদর্শনীতে রাখা তাঁর কাজটি জলরঙে আঁকা। বীরেন সোম সত্তরের দশকে রেখাপ্রধান কাজে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। এখানে ২০১৬ সালে আঁকা নৌকায় বসা ফুল-হাতে নারীর রেখাচিত্র দেখা যায়। ফরিদা জামানের অ্যাক্রিলিকে করা নারী, হামিদুজ্জামান খানের কালো চিত্রতলে আঁকা মুখের অভিব্যক্তি মুগ্ধ করে। জামাল আহমেদের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুকোলে নারী ছবিটি ২০১৮ সালে আঁকা। শিশুকোলে এক মায়ের সুদূর নীলিমায় তাকিয়ে থাকা দর্শককে শূন্যে নিয়ে যায়।

শিল্পী মনিরুল ইসলামের কফি ও মারবেল ডাস্ট দিয়ে আঁকা ক্যানভাসের চিহ্নসমূহে পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার দেখা মেলে।

প্রদর্শনীতে রাখা অন্য শিল্পীদের মধ্যে শিল্পী মারুফ আহমেদ, রফিকুন নবী, মো. মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ ইকবাল, নাজলী লায়লা মনসুর, রোকেয়া সুলতানা, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রেজাউন নবী, রুহুল আমিন কাজল, শহিদ কবীর, সৈয়দ লুৎফুল হক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, শিশির ভট্টাচার্য্য, শেখ আফজাল ও তরুণ ঘোষের কাজ শিল্পাঙ্গনের নতুন অভিযাত্রাকে গতি দিয়েছে।

বাস্তবধর্মী, নিরীক্ষাধর্মী, প্রতীকবাদী, রঙের ফর্মের নিরীক্ষা সবরকমের কাজের সমাবেশ দেখা যায় শিল্পাঙ্গনের নতুন ভেন্যুর প্রদর্শনীতে। এ-প্রদর্শনী একটি বিশেষ কারণে গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি হলো – একটি গ্যালারি কি করে অনেক পথ হেঁটে হেঁটে বেঁচে থাকে। গ্যালারির পথচলার সঙ্গে কিভাবে শিল্পীরা যুক্ত হয়ে থাকেন – এ-সাধনা শুধু কি শিল্পের জন্যে? তা আমরা বলতে পারি, মানুষের কাছে শিল্পের বার্তা দেওয়ার জন্যেই নিরন্তর পথচলা।

রাজধানীর ২/৮ লালমাটিয়া, বস্নক ডিতে গত ১৬ নভেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ২৯ নভেম্বর।