শিল্পীর চিরপ্রস্থান

জানতাম তিনি অসুস্থ এবং বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার মাঝরাতের কিছুটা আগে (২০ মে, রাত পৌনে ১২টা) দুঃসংবাদটি পেলাম। ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো অনলাইন নিউজপোর্টাল ও প্রিন্ট ভার্সনগুলো দেখতে গিয়ে জানলাম, অপরাজেয় বাংলার অমর শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ আর নেই। ঘুম কেটে আমার চোখের পাতায় নেমে এলো বেদনার পুঞ্জীভূত মেঘমালা এবং গুচ্ছ-গুচ্ছ স্মৃতির অসংখ্য মায়াবী রুমাল।

নববইয়ের দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে তাঁকে পেয়েছিলাম। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। কাঁধ পর্যন্ত লম্বিত। লম্বা, একহারা শরীর। টিকালো নাক। শানিত চেহারা। অনেকের মধ্যেও তাঁকে চেনা সহজ। তাঁকে শনাক্ত করা আরো সহজ ছিল সিলেটি উচ্চারণ ও টানে সরল বাংলা ভাষার সার্বক্ষণিক ও সাবলীল ব্যবহারের জন্য। তিনি ছিলেন সবার মধ্যে আলাদা একজন; অনন্যসাধারণ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বর্ণাঢ্য মানুষেরা শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। প্রফেসর আর.আই. চৌধুরী, সিকান্দার খান, আলী ইমদাদ খান, অনুপম সেন, হামিদা বানু, মুর্তজা বশীর, জিয়া হায়দার, হায়াত হোসেন, মনিরুজ্জামান আরো কতজন! সমাজবিজ্ঞান বা হিসাববিজ্ঞান অনুষদের জন্য আলাদা ভবন তখনো তৈরি হয়নি। পুরনো কলাভবনে বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলো ছাড়া অন্যসব বিভাগের ক্লাস আর শিক্ষকদের বসার জায়গা নির্ধারিত ছিল। বিজ্ঞান অনুষদের ছিল আলাদা ভবন। পুরনো কলাভবনে অনেক চাপাচাপি ছিল। আর ছিল স্থান সংকুলান-সমস্যা। তারপরও সবার মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণ উন্মাদনায় সেসব দিন ছিল অনেক বেশি আন্তরিক, রঙিন এবং প্রাণবন্ত। সবার মধ্যে যোগাযোগ আর আদান-প্রদান ছিল নিবিড় ও হৃদয়ছোঁয়া।

আমার কর্মক্ষেত্র কলাভবনের তিনতলার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে; যাতায়াত করি প্রথমতলার চারুকলা বিভাগের পাশ দিয়ে। চারুকলায় তখন শিল্পকলা ও নাট্যকলা নামে দুটো গ্রম্নপ ছিল। এখন অবশ্য অনেক আলাদা বিভাগ ও স্বতন্ত্র ইন্স্টিটিউট হয়েছে। তখন নাটকের দিকগুলো দেখতেন জিয়া হায়দার ও রহমত আলী। শিল্পকলার মধ্যে প্রিন্টিং, পেইন্টিং, গ্রাফিক্স, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভাগ সামলাতেন মুর্তজা বশীর, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আবুল মনসুর, মিজানুর রহিম, ফয়েজুল আজিম জ্যাকব ও তরুণতম ঢালী আল মামুন। সকালে ক্লাসের ফাঁকে কিংবা দুপুরে খাবারের সময় নানা বিভাগে কর্মরত শিক্ষকদের সবাই মিলিত হতাম টিচার্স লাউঞ্জে। আড্ডা, আলোচনা, কথা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদিতে চারপাশ ভরে থাকতো। নিত্য-অনুভব করতাম বহমান আলোর বন্যা।

নিজের লেখালেখির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পী ও সাহিত্যিক ঘরানার অধ্যাপকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে বিলম্ব হয় না। ততদিনে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ছড়ানো-ছিটানো সহকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতেই হয়। পেশাগত যোগাযোগ ও সম্পর্কের বাইরেও কারো কারো সঙ্গে হার্দিক সংযোগ সাধিত হয়। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ তেমনই একজন। ঋজু, অকপট, প্রতিবাদমুখর চরিত্রের জন্য তিনি শুধু আমারই নন, সবার শ্রদ্ধা, সমীহ ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তাঁকে ভালোবাসার ও পছন্দ করার লোকের অভাব ছিল না ক্যাম্পাসে।

ক্যাম্পাসে বা তাঁর বাসায় নিয়মিত যোগাযোগ ও আড্ডা-আলোচনায় মিলিত হয়ে লক্ষ করেছি, তাঁর মধ্যে বিরাজমান প্রবল দ্রোহ। কোনো অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজন বা অঞ্চলপ্রীতি তিনি মোটেও বরদাশত করতেন না। অনেকের মতো মিনমিনে প্রতিবাদ করে দায় সারতেন না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সংক্ষোভে ফেটে পড়তেন। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতেন। প্রয়োজনে আইন-আদালতের আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। আমার মনে হয়েছে, মজ্জাগত দিক থেকে আপাদমস্তক প্রতিবাদী ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে ‘অপরাজেয় বাংলা’র মতো প্রতিবাদমুখর-দ্রোহী ভাস্কর্য নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনাবহুল সে নির্মাণকালের পরতে পরতেও নানা কাহিনি রয়েছে। সেখানেও তাঁর দ্রোহ ও সংক্ষোভ লুক্কায়িত থাকেনি। শিল্পীর স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার প্রশ্নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই আপসহীনভাবে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি বেশকিছু শৈল্পিক কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতেও তাঁর অনেক নান্দনিক শিল্পকর্ম রয়েছে। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই তিনি ভুল সমালোচনা বা অন্যায় হস্তক্ষেপকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছেন। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে আরোপিত পরামর্শ বা কারো বায়না নয়, শিল্পীর স্বপ্ন, কল্পনা ও স্বাধীনতাই যে শেষকথা, এ-বিশ্বাস তাঁর পুরোপুরিই ছিল এবং সে-বিশ্বাসের বাস্তবায়নে তাঁর ছিল অনমনীয় দৃঢ়তা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তেমন শির-উঁচু-করা উদাহরণ অনেক ক্ষেত্রেই রেখেছেন। এই শক্তপোক্ত মেরুদ–র জন্য তিনি মানুষ হিসেবে বিশিষ্টতা এবং সবার শ্রদ্ধা ও মর্যাদা অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চার ইতিহাসে তাঁর নাম অবশ্যই অমস্নান হয়ে থাকবে এবং সেটা থাকবে সবার চেয়ে আলাদাভাবে। তাঁর ঐতিহাসিক ও বিশিষ্ট শিল্পকর্মগুলো এবং অনন্য ব্যক্তি-চারিত্র্যের কারণেই তিনি সবার মধ্যে আলাদা ও অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন। থাকবেন বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসের স্বর্ণালি অংশ হয়ে।

দ্রোহীশিল্পী আবদুল্লাহ খালিদকে যাঁরা কাছ থেকে অন্তরঙ্গ আলোকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, কতটা অবৈষয়িক, উদাসীন, আনমনা ও আবেগপ্রবণ ছিলেন তিনি। জীবনযাপনে রোমান্টিক ও বোহেমিয়ান ধরনের ছিলেন; ছিলেন বেখেয়ালি। আর ছিলেন প্রচ- মুডি। না বললে না, হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, এমনই ছিল তাঁর চারিত্রিক দৃষ্টান্ত। চেপে ধরে বা তদবির করে তাঁকে দিয়ে কিছু করানো ছিল অসম্ভব। অথচ অন্তর্গত সত্তায় তিনি ছিলেন সরল, শিশুর মতো, প্রাণখোলা। সবার সঙ্গে মিশতেন না। যাদের সঙ্গে মিশতেন, হৃদয়-মন উজাড় করেই মিশতেন।

কাছে থেকে দেখেছি শিল্প ও কবিতার প্রতি অমত্মঃপ্রাণ ছিলেন তিনি। ভালো শিল্পকর্ম ও কবিতার সমঝদারিতে মোটেও কসুর করতেন না। প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম মায়া ও ভালোবাসা। চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগে তাঁর বাসায় অসংখ্য ক্যাকটাসের সংগ্রহ ছিল। বারান্দায়, ড্রয়িংরুমে, খোলা জায়গায়, মাটিতে বা ঝুলন্ত ক্যাকটাসে ভরে ছিল তাঁর পুরো বাড়ি। বহু প্রজাতির, বহু ধরনের ক্যাকটাস তিনি সংগ্রহ করে সযত্নে লালন করেছেন। অনেকবার তাঁর বাসায় গিয়ে দেখেছি, তিনি এবং কুলসুম ভাবি শতশত ক্যাকটাসের পরিচর্যা করছেন। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তিনি এসব কণ্টকাকীর্ণ উদ্ভিদকে। কাছে নিয়ে একটা একটা করে দেখাতেন। বোঝাতেন, কোনটা কোন প্রজাতির, কোনটা কোন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছেন, কোনটার পরিচর্যা কীভাবে করতে হয়। ক্যাকটাস ভালোবেসে তিনি যেন উদ্ভিদবিজ্ঞানকেও ভালোবেসে ফেলেছিলেন। একজন বিজ্ঞ উদ্ভিদবিজ্ঞানীর মতোই তিনি বুঝিয়ে বলতেন গাছগুলো সম্পর্কে। আমাদের সামনে স্বাচ্ছন্দ্যে উন্মোচিত করতেন উদ্ভিদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত অপূর্ব রহস্য।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে বহু দিনের বহু স্মৃতির মধ্যে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি অমলিন হয়ে আছে। ১৯৯৬ সালে আমি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বইয়ের নাম ঠিক করি আমার সামনে নেই মহুয়ার বন। তখনকার ছোট্ট ক্যাম্পাসে আমার গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ চাপা থাকে না। বাংলা বিভাগের ভূঁইয়া ইকবাল বা ময়ূখ চৌধুরীর সঙ্গে আমার বই নিয়ে আলাপের কিছু অংশ তিনি হয়তো শুনে থাকবেন। একদিন শিক্ষক লাউঞ্জে আমাকে পেয়ে ডেকে নিলেন, ‘আপনি কবিতার বই বের করছেন?’ আমি সলাজ সম্মতি জানাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরাসরি বললেন, ‘আপনার পা-ুলিপিটি দ্যান, পড়ে দেখি।’ আমি তখন সর্বশেষ পরিমার্জনা করে পা-ুলিপি নিয়ে ঢাকা রওনা হওয়ার অপেক্ষায়। বললাম, ‘ক’দিন পরেই বই হয়ে বের হবে। ছাপানো বই-ই না হয় দেবো।’ তিনি রাজি হলেন না। পা-ুলিপিই দেখতে চাইলেন। আমি লাউঞ্জ থেকে উঠে আমার রুম থেকে পা-ুলিপি এনে তাঁকে দিলাম।

পরদিনই দুপুরবেলা আবার লাউঞ্জে পেয়ে আমাকে ডাকলেন। কাছে যেতেই কোনো ভনিতা ছাড়া সরাসরি বললেন, ‘ভালো লিখেছেন। আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ আমি করব।’ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। কথা বলতে পারি না। তাঁর মতো একজন বড় ও গুণী শিল্পী নিজে থেকে আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করতে চাচ্ছেন, এ তো আমার পরম পাওয়া। আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আমি বাকরুদ্ধ।

আমার এবং অনেকেরই জানা আছে, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ সাধারণত বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন না। অনেককেই তাঁর পিছু নিতে দেখেছি প্রচ্ছদের জন্য। তিনি অবলীলায় তাদের ফিরিয়ে দিতেন। জীবনে চার-পাঁচটির বেশি বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি করেননি। এ-তথ্য তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তিনি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রচ্ছদ করেছেন, ভাবলেই শিহরিত ও রোমাঞ্চিত হই।

তখন কম্পিউটারের এতটা প্রচলন ও সহজলভ্যতা ছিল না। মধ্যনববইয়ের দশকের প্রচ্ছদশিল্প পুরোটাই ম্যানুয়েল ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি একটি চিত্রকর্মসহ নিজের হাতের লেখা নামপত্র দিয়ে চমৎকার প্রচ্ছদ তৈরি করেন। এবং আমাকে সঙ্গে করে আন্দরকিল্লার এক ছাত্রের অফিসে গিয়ে প্রচ্ছদের কিছু টেকনিক্যাল কাজ সম্পন্ন করে আমার হাতে তুলে দেন। আমি অভিভূত হয়ে দীর্ঘক্ষণ প্রচ্ছদটির দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেকক্ষণ পর আমি প্রচ্ছদের সম্মানী প্রসঙ্গ তুললে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘টাকার জন্য এই প্রচ্ছদ আমি করিনি।’ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আমার ভেতরটা আর্দ্র হয়ে এলো।

তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে শেষরাতের ঘুমন্ত পৃথিবীতে আমার লেখার অক্ষরগুলো বারবার বেদনার্ত হয়ে উঠছে। আলোছায়ার রহস্যময়তায় তাকিয়ে দেখি, নিথর বুক সেলফের এক কোণে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ-অংকিত আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমার সামনে নেই মহুয়ার বন। গভীর মমতায় বইটি টেনে নিলাম। হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। টুপটাপ শব্দে রাতের নির্জনতা ভেঙে ক’ফোঁটা অশ্রম্ন ঝরে পড়ে অমলিন প্রচ্ছদে। আমি আঙুলের স্পর্শে আমার বইটির সর্বাঙ্গে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের জীবন্ত স্পর্শ পাই। প্রিয়জন, আমাদের অদেখা ভুবনে আপনি ভালো থাকুন। সুখী ও কল্যাণময় হোক আপনার অনন্ত যাত্রা। r