শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের সৃষ্টি

ইংরেজিতে যাকে charismatic leader বলে তাঁদের কথা আমি বইয়ে পড়েছি, তাঁরা কেউ আমার সময়ে বর্তমান ছিলেন না। মাত্সিনি-গারিবল্দি বা জোয়ান অব আর্ক তো সুদূরের বাসিন্দা, আব্রাহাম লিংকন, ডি ভ্যালেরা, লেনিন, মাও জে দংও প্রায় তাই। আরো কত কত নেতা পৃথিবীতে জাতীয়তার অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিয়েছেন – তাঁরা সবাই আমার অস্তিত্বের প্রান্তে, স্মৃতিলোকবাসী। উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধীকেও আমি দেখিনি, যেমন দেখিনি সুভাষচন্দ্রকে, তাঁর ‘নেতাজি’ রূপান্তরে তাঁকে দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। যদিও পণ্ডিত নেহরুকে কয়েকবার দেখেছি, তাঁর সভার ভিড়ে থেকে তাঁর বক্তৃতা শোনার অবকাশ পেয়েছি। শেখ মুজিবকে আমি স্বচক্ষে দেখিনি, এই আমার এক গভীর দুঃখ। কারণ তিনি আমার সময়কার সবচেয়ে সার্থক জনচিত্তজয়ী নেতা, যাঁকে ঐতিহাসিক সমাপতনের জন্য আমার দেখার সুযোগ ছিল, আমার কৈশোর-যৌবনকালের মধ্যে তিনি নেতা হিসেবে পরিণতি পেয়েছেন এবং পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টি করে। বিশ্বাসঘাতকদের হাতে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্যের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডও আমাদের সময়ের মধ্যেই ঘটেছে। জানি না, আমাদের সময় বা অনন্ত সময় সেই বীভৎস আর ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডকে কোনোদিন ভুলে যেতে পারবে কি না। ইতিহাসে নানা গৌরবগাথা তৈরি হয়, আবার তার পাশাপাশি নানা অক্ষয় কলঙ্কের দাগ পড়ে। যারা সেই কলঙ্কের স্রষ্টা, মানুষের গভীর ঘৃণায় তারা কখনো শাস্তি পায়, কখনো পায় না। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তারা চিরকাল কালো দাগেই চিহ্নিত হয়ে থাকে।

যাই হোক, মৃত্যু যতই মর্মান্তিক হোক, তার স্মরণ যতই অনিবার্য হোক, তা জীবনকে কখনো আড়াল করতে পারে না, বরং কখনো কখনো একটা ভিন্ন মহিমা দিতে বাধ্য হয়। হত্যাকারীদের নিশ্চয় এ-ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকে না যে, যাঁকে তারা হত্যা করতে যাচ্ছে তিনি মৃত্যুর দ্বারা আরো পরিব্যাপ্ত দীপ্তি লাভ করবেন। তারা ভাবে, একে হত্যা করা হলো তো একে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া গেল, গোধূলির কালো জলে সূর্যকে নিক্ষেপ করার মতো – এর পরে অন্ধকারে সমগ্র চরাচর ছেয়ে যাবে, আমরা সেই অন্ধকারে প্রেতসাম্রাজ্য কায়েম করব। ইতিহাস বারবার এই দুরাকাঙ্ক্ষাকে উপহাস করে, উপমহাদেশে গান্ধী বা মুজিবের হত্যাকাণ্ডে যেমন দেখা গেছে। কারণ তাঁদের মৃত্যুর পূর্বগামী ছিল এক কীর্তি-উজ্জ্বল বিশাল জীবন, মানুষের জন্য নিবেদিত জীবন। এমন জীবনকেই এ-ধরনের মৃত্যু মহিমান্বিত করে। আরো অনেক রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এই উপমহাদেশেরই, কিন্তু তাঁদের অপকীর্তিময় জীবনও লোকস্মৃতি থেকে লুপ্ত হয়েছে, মৃত্যুও।

দুই

না, শেখ মুজিবের মৃত্যুকে নিয়ে এত বেশি কথা বলার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। আমরা বলতে চেয়েছি তাঁর জীবনের কথা। সে-জীবন ইতিহাসবদ্ধ তারিখচিহ্নিত জীবন নয়, সে-জীবনের বিকাশ ও প্রাপ্তি সম্বন্ধে আমাদের ব্যাখ্যার কথা। কিন্তু সে-কাজ করতে গেলে মুজিব আর তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের ওই নৃশংস হত্যাকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না, তা বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাবি, এই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল শেষ হিসেবে?

আমার এ-লেখাটি শুরু করেছি একটি প্রশ্ন দিয়ে, এ-নিবন্ধে সে-প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে আসবে। তা হলো, কী করে দক্ষিণ এশিয়ার এক প্রান্তিক ভূখণ্ডে এমন এক charismatic leader তৈরি হয়? আমি মুজিবের জীবনী যত পড়ি, যত ছবি দেখি, তার মধ্যে এ-প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। আগেকার দিনের এ-ধরনের নেতারা সাধারণভাবে আসতেন অভিজাত ঘর থেকে – সেইসঙ্গে ব্যারিস্টার, বিলেতফেরত, আরো কত কী। অনেকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত পিতার পুত্র। মওলানা ভাসানীর মতো কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য ছিলেন, যাঁরা কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রমই। মুজিব এসবের কিছুই ছিলেন না। তিনি ফরিদপুরের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। হ্যাঁ, তিনি দীর্ঘদেহী, সাধারণভাবে লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো তাঁর আকৃতি নয়। তাঁর কণ্ঠস্বর বজ্রবৎ, তাও নিশ্চয়ই সেই মহত্ত্ব তৈরিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এটা তো একদিনে হয়নি। যখন তিনি কলকাতায় ছাত্রনেতা ছিলেন, তখন কি তাঁর সম্ভাবনা কারো স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়েছিল? পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান আমলের প্রায় প্রথম থেকেই পশ্চিমবঙ্গবাসীদের, এবং কিয়দংশে বৃহত্তর ভারতবাসীদের সচেতন একটা অংশ ওই ভূমিখণ্ডের মানুষদের প্রতিবাদ ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে নানা প্রতিক্রিয়ার খবর বিচ্ছিন্নভাবে রেখেছে, ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলন আর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনায় বিশেষভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে, ১৯৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের জয়েও খুশি হয়েছে। তারপর সামরিক শাসনের আরোপ, রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ইত্যাদির পথ বেয়ে সমস্ত আন্দোলন কীভাবে রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করছে, তাও হয়তো ভারতের অনেকে লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবকে কখন থেকে লক্ষ করতে শুরু করলাম আমরা। আমি জানি ভাষা-আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, পরে ১৯৫৪-র নির্বাচনে তো ছিলই। কিন্তু প্রথমে সোহরাওয়ার্দী এবং পরে মওলানা ভাসানীর সহকারী বা সেনাপতি হিসেবে তাঁর পরিচয়, প্রথমদের তুলনায় একটু গৌণ পরিচয়ের মধ্যে তাঁকে দেখি, ইংরেজিতে যাকে বলে second fiddle, সেরকম কিছু হিসেবে। আমার জানতে ইচ্ছে করে, তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ভূখণ্ডে এবং অন্যত্র – যে এই যুবকটি অন্যরকম, এই ঘোড়া অনেক দূর দৌড়োবে, এবং একদিন অন্যদের অনেকটা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে, নিজের একক, প্রায় নিঃসঙ্গ মহিমা লাভ করবে? হয়তো পেরেছিলেন, আমি সেসব নথিপত্র বা সাক্ষ্য দেখার সুযোগ পাইনি। তাই আমার মুজিব সম্বন্ধে ইতিহাসবোধ কিছুটা সরল ও দুর্বল। আমার বিচারে ভুলত্রুটি থাকাই সম্ভব। আমি হয়তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক না দেখে দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে যাব।

অবশ্যই একটা সময় এলো, যখন তাঁর ওই নেতৃত্বের সম্ভাবনা আর সম্ভাবনামাত্র রইল না, তিনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ছাড়িয়ে গেলেন, বাকিরাই তাঁর সশ্রদ্ধ অনুরাগী বা অনুগামী হয়ে পড়ল। মওলানা ভাসানীর মৃত্যু একটা পরিসর তৈরি করল অবশ্যই। কিন্তু সেই পরিসরে স্থান নেওয়ার জন্য তো অন্যরাও ছিলেন।

আমার এ-লেখা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনীর পুনরাবৃত্তি করবে না, সে-ক্ষমতা আর উদ্দেশ্য আমার নেই। তা আমার চেয়ে অনেক যোগ্যভাবে অন্যরা করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, আমি এতে যে পর্যালোচনার দায় গ্রহণ করেছি তা অনেকের কাছে ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল, তাই বিতর্কিত মনে হতে পারে। তবু একটা ব্যক্তিগত আখ্যান নির্মাণ করতে চাই, কারণ সেটাই আমার সাধ্যের মধ্যে আছে বলে আমি মনে করি।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পক্ষে শেখ মুজিব নামক এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সম্যক অর্থ বুঝে উঠতে পারা কঠিন। কারণ পশ্চিম বাংলা তাঁকে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেনি, আর খবরও তত রাখেনি যে, পূর্ববঙ্গে, তারপর পূর্ব পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দী আর মওলানা ভাসানীর পার্শ্বচর হিসেবে কোন এক দীর্ঘদেহী ফরিদপুরের সন্তান কীভাবে কাজ করছেন, কীভাবে নিজেকে নির্মাণ করছেন আর নিজের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। কখন তাঁর স্বপ্ন অন্যদের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা থেকে চূড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে গেল, কয়েক বছরের পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোকে ছাড়িয়ে চলে গেল, কখন মুজিব আসল মুজিব হয়ে উঠলেন। সকলের নেতা, নেতাদের নেতা, যখন তাঁর কণ্ঠস্বরে সমগ্র জাতি সাড়া দিয়ে গর্জে উঠল।

পশ্চিম বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ সম্বন্ধে খবর নিশ্চয়ই বেরোত, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, সামরিক শাসন জারি, রবীন্দ্র-শতবর্ষের সময় নানা বিধিনিষেধ এবং পরে নানা রাজনৈতিক খবরও আসত। কিন্তু আমি জানি না, পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী আর লেখাপড়া-জানা উদ্বাস্তুরা ছাড়া সে-খবরে ‘সাধারণ’ মানুষের কতটা উৎসাহ ছিল – সেই সাধারণ মানুষ যারা পূর্ববঙ্গকে দীর্ঘদিন ‘পাকিস্তান’ বলেই জানত।

অন্যদের কাছে তো বটেই, এই সাধারণ মানুষের কাছেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রবল বিস্ফোরণের মতো এসে পড়ল। এ এমন একটা বিচিত্র মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে সর্বাধিনায়ক উপস্থিত নেই, তিনি আছেন সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, সেখানে দেশবাসী নিয়ত তাঁর প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা নিয়ে আছে। আমার কেন যেন ভাবতে ইচ্ছা হয়, তাঁর এই মৃত্যুসম্ভাবনা – যা তিনি নিজেও অসীম সাহসের সঙ্গে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন – তা ছিল এই মুক্তিযুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ‘যদি আমাদের নেতার মৃত্যুও হয়, আমরা তাঁর স্বপ্নকে ছিনিয়ে নেব, তাঁকে বিজয় উপহার দেব।’ ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে অবিস্মরণীয় ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন, তা-ই যেন তাঁর উপস্থিতির বিকল্প হয়ে ছিল তাঁর দেশবাসীর কাছে, তার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের দিগন্ত থেকে দিগন্তে। কারান্তরাল থেকে তাঁর নীরবতাই যেন সেই অব্যাহত অনাহত গর্জন হয়ে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস মথিত করে রেখেছিল। লক্ষ মৃত্যু, বিপুল ধ্বংস ও লাঞ্ছনা, তার মধ্য থেকে বিজয় নিষ্পন্ন বাংলাদেশের মানুষ, পৃথিবীর বুকে সবুজ ক্ষেত্রে লাল সূর্যের এক দুর্জয় জাতীয় পতাকার জন্ম হলো। হ্যাঁ, এই জয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল, বাংলাদেশ তা স্বীকার করতে কখনো কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু এ-যুদ্ধ ছিল বাঙালির নিজস্ব যুদ্ধ, এ-বিজয়ে তাদের ভূমিকাই মহৎ অর্থ পেয়েছে।

‘বিজয়’ কথাটির মধ্যেই যুদ্ধের একটি অনুমান আছে। এই বিজয় একটি জাতিসত্তার এক গৌরবময় সংগ্রামের পরিণাম। ‘যুদ্ধ’ কথাটা অবশ্য রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধ রূপক ছিল না, আক্ষরিক অর্থে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মরণপণ যুদ্ধ ছিল, তাতে তিরিশ লাখের মতো বাঙালি মৃত্যুবরণ করেছে, অজস্র সামাজিক সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রম লুট হয়েছে – গদ্যময় নিষ্ঠুর যুদ্ধের যা সাধারণ ঘটনা বা casualty হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। এই বিজয় প্রসঙ্গে একটু অন্য কথা দিয়ে শুরু করি।

ভারতের (নিশ্চয়ই বাংলাদেশেরও) অনেক বাঙালির মধ্যে কখনো কখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সর্বকালের সেরা বাঙালি’ আখ্যাটি নিয়ে একটু সংশয় তৈরি হয়। তাঁরা অন্যান্য মহিমাধর বাঙালির কথা, যেমন রবীন্দ্রনাথের কথা, তুলে ধরেন এই নামের পালটা দাবিদার হিসেবে। তাঁরা হয়তো জানেন না যে, ২০০৪ সালে বিবিসির বাংলা বিভাগের আয়োজিত এই নামের যোগ্য বাঙালি সম্বন্ধে আমন্ত্রিত একটি গণমত সমীক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিল এবং এই শিরোপা জয় করে নিয়েছিল। এই ঘটনা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিপুলসংখ্যক বাঙালির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ব্যাপ্ত ও অভ্রান্ত প্রমাণ।

আমি নিজে এই অর্থে তাঁকে সর্বকালের সেরা বাঙালি বলে মনে করি যে, তিনি বাংলাভাষীদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নির্মাণ করে গেছেন। সেদিন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক বন্ধুবর শামসুজ্জামান খানের একটি বক্তৃতায় শুনলাম যে, দার্শনিক হেগেলই এই যুক্তিটি প্রথম উচ্চারণ করেন। এ-কথা সংগত এবং এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অনন্য।

পৃথিবীর ইতিহাসে একক মানুষের অবিস্মরণীয় নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এই প্রথম, হয়তো এই শেষ। অবশ্যই ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬১, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ – এই বছরগুলো ধরে ধাপে ধাপে তৈরি পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ইতিহাস, তিনি স্বয়ং যে ইতিহাসের নেতা এবং অংশ ছিলেন, তাঁকে সাহস আর আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তাঁর স্বোপার্জিত শক্তি আর অধিকারে। কিন্তু আগেই বলেছি, এ-যুদ্ধ প্রায় একটা proxy war. তিনি উপস্থিত নেই অথচ তাঁর উপস্থিতি সর্বত্র। তাঁর মুখে-চোখে, শরীরের প্রতিটি দৃপ্ত ভঙ্গিতে, কণ্ঠস্বরের বজ্রনিনাদে তাঁর আত্মবিশ্বাস প্রতি মুহূর্তে বিচ্ছুরিত হতো, তা তাঁর শ্রোতাদের উন্মাদ করে তুলত।

আমার এ-প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের এক অনুগামী আবিদ খানের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে যায়। আবিদ খান আইএনের ‘বিচার’-এর পর মুক্তি পান এবং পরবর্তী কংগ্রেস সরকার স্বাধীনতার পরে তাঁকে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়, সম্ভবত তিনি কানাডার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও হয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তাঁকে এ-কথাগুলো বলতে শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যে, ÔI have seen and worked with many great men in my life. I’ve seen Mahatma Gandhi, Pandit Nehru and many others. But there was only one man on whose words I could die. And that was Netaji. (আমি অনেকে মহৎ মানুষকে দেখেছি, তাঁদের সঙ্গে কাজও করেছি। আমি মহাত্মা গান্ধীকে দেখেছি, দেখেছি পণ্ডিত নেহরু আর অন্য অনেককে। কিন্তু শুধু একজনের কথাতেই আমি জীবন দিতে পারতাম। তাঁর নাম নেতাজি)।’ আমার ধারণা, সুভাষচন্দ্রের পর এই উপমহাদেশে আর একজন মাত্র নেতাই এসেছিলেন, যাঁর সম্বন্ধে বহু লোক এই একই কথা ভেবেছে, এবং শুধু ভাবেনি, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, ‘সংকট-আবর্ত মাঝে দিয়াছে সে বিশ্ব বিসর্জন, নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি, মৃত্যুর গর্জন শুনেছে সে সংগীতের মতো।’ তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কৃতিত্ব আমি ছোট করে দেখছি না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁরাও চিরস্মরণীয়, কিন্তু বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা’ নামেরও অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই, আর কারো নয়। ‘জাতির পিতা’ আর ‘বঙ্গবন্ধু’ নামদুটির মধ্যে কিছুটা অসংগতি থাকলেও।

তিন

আমি গুগল থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি আর একবার শুনছিলাম। লক্ষ করলাম, তাঁর সভায় এসে পৌঁছোনোর আগেই তাঁর আওয়ামী লীগের সহকর্মীরা স্লোগান দিচ্ছেন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ কিংবা ‘শেখ মুজিবের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এই সভায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক অসামান্য বক্তৃতার শেষে তিনি নিজেই উচ্চারণ করবেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ বক্তৃতার মাঝখানে মনে হয় তিনি একটা সার্বিক অসহযোগের কথা বলছেন, বলছেন পাকিস্তানকে বয়কটের কথা। সাতদিনের হরতাল, সরকারি কর্মচারীরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে, পাকিস্তানকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ, রেডিও-টেলিভিশনে বাংলাদেশের খবরই থাকবে, পাকিস্তানের নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা পয়সাও যেন পাকিস্তানে না যায়। কিন্তু শুধু এ-ধরনের নাগরিক অসহযোগ নয়, তিনি বারবার বলছেন ‘যুদ্ধে’র কথা। গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সংগ্রাম পরিষদ’ও গড়ে তোলার কথা বলছেন। আন্তরিকতায়, আবেগে, ক্রোধে, প্রজ্বলন্ত শপথ আর সংকল্পে, স্বরগ্রামের উচ্চনিচ নাটকীয়তা, মুখ-চোখ-হাতের বীরত্বব্যঞ্জক সুস্পষ্ট অঙ্গভাষায় এমন বক্তৃতা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই উচ্চারিত হয়েছে। আমি লেনিনের কোনো বক্তৃতা শুনিনি, বিদেশে থাকার সময় ডিজনিল্যান্ডে লিংকনের গ্যাটিসবার্গ বক্তৃতার একটি যান্ত্রিক পুনর্গঠন শুনেছিলাম, কিন্তু শেখ মুজিবের বক্তৃতার সঙ্গে তার তুলনা হয় না। এ-বক্তৃতায় শুধু বীরত্ব নয়, নিজের আর দেশবাসীর ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস নয়, শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানিদের প্রতি প্রবল ঘৃণা নয়, দেশের প্রতি যে গভীর মর্মগ্রাহী ভালোবাসা উচ্চারিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে হৃদয়-নিংড়ানো স্বপ্ন নির্মিত হয়েছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। সংগতভাবেই এই বক্তৃতা এক যোগ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। আব্রাহাম লিংকনের সেই গ্যাটিসবার্গ অ্যাড্রেস বা রুশ বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তে লেনিনের উদ্দীপনাময় আহ্বানদের সঙ্গেই তার স্থান।

চার

আমার যেটা বিস্ময় লাগে, এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক পরশাসন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে মধ্যবিত্ত ইতিহাস, তাতে সামরিক বিকল্পের কথা প্রথমদিকে আদৌ ভাবা হয়নি। সিপাহি বিদ্রোহ অবশ্যই ব্যতিক্রম, কিন্তু উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ইতিহাসের মূলধারার মধ্যে তা অনেক পরে গৃহীত হয়েছে, বাঙালি ও অন্য ভারতীয় মধ্যবিত্তরা তার থেকে নিজেদের দূরে রাখতে যত্নশীল ছিল। ১৮৮৫-র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বা ১৯০৬-এর মুসলিম লীগ – কেউ স্পষ্ট করে সামরিক বিকল্প অবলম্বনের কথা ভাবেনি, সে-কথা আপনারা সকলেই জানেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে যেসব মহান বিপ্লবী আত্মদান করেছেন, তাঁদের সমিতিগুলোও ব্যাপক সামরিক বিকল্পের জন্য প্রস্তুত হতে পারেনি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যখন কংগ্রেসের সদস্য হওয়ার জন্য কিছু লোক অনুরোধ করতে গিয়েছিল, তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, দেশের জন্য দরকার হলে তারা তরোয়াল ধরতে পারবে কি না। তারা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রথম একটি সামরিক বিকল্পের সন্ধান দেয়, কিন্তু তাও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এলাকায় এবং এক মহান ব্যর্থতার দ্বারা চিহ্নিত। একমাত্র রাসবিহারী বসু এবং সুভাষচন্দ্র বসু উপমহাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের এই বিকল্পটির কথা অনেক বড় আকারে ভেবেছিলেন, কিন্তু তার হৃদয়বিদারক পরিণতির কথাও আমাদের অজ্ঞাত নয়।

সকলেই এটা লক্ষ করেছেন যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে নেতাজির অবলম্বিত পন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা মিল আছে। সামরিক বিকল্প ছাড়াও দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি গভীরভাবে দায়বদ্ধ (সুভাষচন্দ্রের ফাসিস্ত বাহিনীর সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে, শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু – এই প্রাচীন নীতিটি তার মূলে)। আর দুজনেই হিন্দু ও মুসলমানের, সমস্ত ধর্ম আর সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি স্থাপনে বিশেষভাবে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু দেশের মাটিতে সংগ্রামের সুযোগ না পাওয়ায়, অনুগত ও ভক্ত আজাদ হিন্দের সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র সফল হতে পারলেন না, সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মানুষের এবং ভারতের মিত্রবাহিনীর সমর্থনে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার গৌরব লাভ করলেন।

পাঁচ

আমি জানি না, বঙ্গবন্ধু এই সামরিক বিকল্পটির কথা কবে থেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই তাঁর উৎস খুঁজে বের করবেন। অবশ্যই পাকিস্তানিদের ঔদ্ধত্য, বারবার কারাদণ্ড আর তাঁর প্রতি নিক্ষিপ্ত অসম্মান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে বিপুল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর প্রকাশ্য বিরোধ আর প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়ায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা তাঁকে সহিষ্ণুতার শেষ সীমায় ঠেলে দিয়েছিল। তাছাড়া ১৯৬৯-এর বিদ্রোহের ব্যাপক জনসমর্থন, আইয়ুব খানের অপসারণেও তিনি নিশ্চয়ই উৎসাহ পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি যে, ১৯৬৬-তে আগরতলা মামলায় কারারুদ্ধ হওয়ার আগে তিনি যখন ৬ ধারার একটি প্রস্তাব রচনা করেন তার ৬ নম্বর ধারাতেই তিনি বাংলাদেশের জন্য পৃথক মিলিশিয়া (নাগরিকদের সৈন্যবাহিনী) এবং আধাসামরিক বাহিনী দাবি করেছিলেন। তখনই কি তাঁর মনে হয়েছিল যে, বাঙালিদের একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াতেই হবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই দেবেন – কিংবা হয়তো দিয়েছেন, আমি ঐতিহাসিক নই বলে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ভাষণে আমরা আর কোনো দ্বিধা দেখি না তাঁর – ‘আমরা রক্ত দিয়েছি, আরও রক্ত দেব’ বলে ডাক দেন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র বাঙালিকে, হাতে যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, এবং ওই যে গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা উচ্চারিত হয়, তখন থেকেই স্বাধীনতার সামরিক যুদ্ধক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক মতামত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের খুব অনুকূল ছিল না। আমেরিকা স্পষ্টতই বিপক্ষে ছিল, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন এক নৌবহর পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একটা হুমকি-প্রেক্ষিত তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, আমরা আরেকটা ‘বাস্কেট কেস’ (‘ভিক্ষাপাত্র হাতে রাষ্ট্র’) চাই না। চীনও, এখন যতই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিক হোক, প্রথমদিকে খুব উৎসাহ দেখায়নি। মধ্যপ্রাচ্য নানা সংশয় নিয়ে উদাসীন, এমনকি বিরক্ত ছিল। এই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে যুদ্ধের বিকল্প গ্রহণ করা সহজ ছিল না।

সামরিক পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের এই মুক্তিসংগ্রামের চারটি পর্যায়ের কথা বলেন, ২৪ মার্চ থেকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ একটি, যখন বিচ্ছিন্ন চেষ্টাগুলো সংহত হয়নি, দ্বিতীয় পর্যায় জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ – যখন অসংলগ্নতার মধ্যে সংহতি আনা হয়, সামরিক পুনর্গঠন চলে, গেরিলা যুদ্ধের নীতি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধে তীব্রতা সঞ্চারিত হয় আর প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়, আর ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় শেষ বিজয় অর্জন করে। এই সমগ্র ইতিবৃত্তে মুজিব কোথায়? না, পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দি। আমরা ইতিহাসের কাছে এই কারণে কৃতজ্ঞ যে, ভুট্টো বা ইয়াহিয়া তাঁকে হত্যা করতে সাহস করেনি, তা তারা সহজেই করতে পারত। কিন্তু বন্দি শেখ মুজিব হয়তো হয়ে উঠেছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে লক্ষগুণ শক্তিশালী।

লক্ষ-কোটি মুজিব তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে, তাঁরই আহ্বানে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে হাজির না থেকেও যে আস্তে আস্তে এই যুদ্ধ পরিচালিত, সংগঠিত এবং সফল হলো, এর মূলে নিশ্চয়ই ছিল কারারুদ্ধ মুজিবের জ্বলন্ত দেশপ্রেমের প্রেরণা।

আমি যুদ্ধের এতসব হিসাব যে বুঝি তা নয়। কিন্তু শেখ মুজিব যে এক আশ্চর্য সাহস আর দূরদর্শিতায় আরো কিছু বাঙালির মতো উপমহাদেশের দ্বিতীয় একটি স্বাধীনতা সংগ্রামে সামরিক বিকল্পের কথা ভেবেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে ‘কাপুরুষ’ বলে চিহ্নিত বাঙালিকে এক সামরিক জাতিতে পরিণত করেছিলেন, তাই ভেবে বিস্মিত থাকি। আর জয় থেকেও তিনি বঞ্চিত হননি। সেখানেই বাঙালির বিজয়ের এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রথম সূত্রটি তৈরি হয়।

ছয়

আমি গত পাঁচ-ছয় বছরে অন্তত চারবার বাংলাদেশের বিজয় দিবসে বাংলাদেশেই, ঢাকা মহানগরে উপস্থিত ছিলাম। এ যেন আরেক একুশে ফেব্রুয়ারি। সারাদিন ধরে দেশজুড়ে উৎসব, গানে-স্লোগানে মনে হয় ওই ভূখণ্ডের আকাশের ঊর্ধ্বসীমা পর্যন্ত উল্লাস ছড়িয়ে যায়। ছোটরা সবুজের মধ্যে লাল সূর্যের পতাকা নিয়ে পথে পথে মিছিল করে, নানা স্থানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় (শহিদ মিনারে এরকম একটি অনুষ্ঠানে একবার আমিও উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম), অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা জাতীয় পতাকার রঙের পোশাক পরে পথে বেরিয়ে পড়ে, গালে তুলি দিয়ে জাতীয় পতাকাসহ আরো নানা নকশা আঁকে – সমস্ত দেশটাই যেন উৎসবে মেতে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ বিকেলে নানা বিচিত্র নির্মাণ নিয়ে (মাথার ওপরে ছড়ানো বিশাল কুমির, উড়ন্ত ঈগল পাখি, রয়াল বেঙ্গল বাঘ, অজস্র মুখোশ) ঢাক-ঢোল-কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে বিশাল মিছিল বের করে (এই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, যা নববর্ষেও হয়, তা সম্প্রতি ইউনেস্কোর অস্থায়ী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে) – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আর বাংলা একাডেমি ঘেঁষে এগিয়ে চলা নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ জনসমুদ্র হয়ে যায়। সারাদেশে উৎসব হয় – আমি প্রতিবছরই সারারাত তরুণ কণ্ঠের অক্লান্ত গান শুনেছি। মনে হয়েছে সারাদেশ গান গাইছে, মুক্তির গান, বিজয়ের গান।

এই উৎসব সরকারি উৎসব নয়, জনসাধারণের উৎসব। কোনো সরকারি প্ররোচনা নেই, উৎসাহদানের প্রকট চেষ্টা নেই – জনসাধারণ নিজে এই বিজয় উৎসবের দায় যেন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। আমাদের ভারতে স্বাধীনতার যে-উন্মাদনা এখন আর দেখা যায় না, বাংলাদেশে তা এখনো জ্বলজ্যান্ত বেঁচে আছে। বিজয় দিবসের এই উৎসবে মুক্তিযুদ্ধের আলো আর প্রেরণা জেগে আছে। যতদিন এই উৎসব দেশের মানুষের উৎসব থাকবে, ততদিন নানা শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত থাকবে। এই দেশ, যা ঘটনাচক্রে আমার জন্মভূমি, বাংলাদেশের জনগণ আর তার অনুগামীদের সঙ্গে মূলত শেখ মুজিবের নির্মাণ, যে-দেশ এখন পৃথিবীর সংশয় উত্তীর্ণ হয়ে, নিজের ভেতরকার বিরুদ্ধতাকে নিরস্ত করে, বিপুল প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভেতরে-বাইরে, শরীরে-সংস্কৃতিতে, নির্মাণে-সৃষ্টিতে আমি সেই অগ্রগতি দেখে রোমাঞ্চিত হই। শেখ মুজিবের প্রেরণা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা বাংলাদেশের সব সংকটের রক্ষাকবচ হয়ে আছে।