শেফালি

মহি মুহাম্মদ

লাইনে নতুন একটি মেয়ে এসেছে। চোখ টানে। ডবকা-ডুবকা। ঢলোঢলো ভাব। অনেকের নজর পড়েছে মেয়েটার ওপর। ওর ভাবসাবও ভালো নয়। গত রাতে সাদেক মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে।

লাইনটির নাম হরিশ্চন্দ্র লাইন।

এর শেষ মাথায় কলতলা। ছোট একটি বারোয়ারি টয়লেট। পানির একটা ট্যাপ। পাশে একটা হাউস। পানি এলে সেখানে জমা হয়। ওখান থেকে মগ কেটে পানি ব্যবহার করতে হয়। আশেপাশে অনেক বাড়িঘর, একটার সঙ্গে আরেকটা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে রোদ, বাতাস, জ্যোৎস্না খুব একটা ঢোকে না।

হরিশবাবুর লাইন লম্বায় বাইশ হাত। মুখোমুখি দুই সারি। মাঝখানে সরু গলি। কোনোরকমে একজন মানুষ চলতে পারে। ওপরে টিন, বাঁশের বেড়া, মাটির ফ্লোর। মাটির চুলোয় রান্না চলে। কেউ কেউ স্টোভ ব্যবহার করে। ধোঁয়া সারাক্ষণ কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি লেগেই থাকে। কে আসছে, কে যাচ্ছে বোঝা যায় না। এক অংশে ব্যাচেলর, অন্য অংশে ফ্যামিলি। লাইনের পশ্চিম পাশে বিটিএমসির বন্ধ হওয়া টেক্সটাইল মিল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার পরে একটা নালা, সারাক্ষণ কালচে ময়লা পানি যায় আর দুর্গন্ধ ওঠে ভকভক করে। সম্মুখে আরেকটা নালা আছে। সেটার অবস্থাও একরকম। নালার পাশে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে সারি সারি দোকান। মুদিদোকান, ভাঙাড়ি, চা-দোকান, লন্ড্রি, সেলুন, ক্যাসেটঅলা এসব। তার সামনে রেললাইন। মাঝেমধ্যে বিকট আওয়াজ তুলে ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। মাঝেমধ্যে মানুষ কাটা পড়ে। কুকুর, বেড়ালও পড়ে। মাঝরাতে ঝনঝন করে ট্রেনটা যখন নাজিরহাট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে থাকে, তখন হরিশবাবুর লাইনে লোকজনের হাঁটাচলা কমে আসে।

শেফালির বাবা হাজার টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। ছেলেমেয়ে তিনজন, অসুস্থ বউ আর সে। মোট পাঁচজন একটা ঘরে। দিন না রাত কখনো বোঝা যায় না। নগ্ন লাল বাল্ব অনেক কষ্টে আলো ছড়াচ্ছে। ভোল্টেজ আসা-যাওয়া করে। চারপাশে কালি-ঝুলি। শেফালির বাপ রিকশা চালায়। আগে ছিল বাস্ত্তহারা কলোনিতে। তার আগে নাকি রউফাবাদ বিহারি কলোনিতে। সেখানে নাকি ঘরভাড়া সস্তা ছিল। প্রতি মাসে সাত-আটশো টাকা গুনতে হতো। আর এখানে প্রায় হাজার টাকায় উঠে গেছে। তবে আগের বাসাটা কেমন স্যাঁতসেঁতে ছিল। কী কারণে শেফালিরা আগের বাসাটা ছেড়ে এসেছে তা কেউ জানে না।

এখানে এসে সবার সঙ্গে ভাব করতে ব্যস্ত শেফালি। বিশেষ করে পাশের ঘরের সাদেকের সঙ্গে বেশি বেশি করে কথা বলে। কারণ সাদেক তাকে গার্মেন্টে কাজ পাইয়ে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। ওদের সংসারে টানাটানি দেখে সাদেকের বউ কুলছুমি বলেছে, ‘শেফুরে একখান চাকরি খুঁইজা দাও।’ সাদেক প্রথম পরিচয়ের দিন আড়চোখে দেখেছে। চিকন-চাকন, শক্ত-সামর্থ্য, ঘষামাজা চেহারার মেয়েটি মন্দ নয়। কথাবার্তায়ও দারুণ চালু। বউয়ের অনুপস্থিতিতে সাদেক শেফালিকে ‘তালতো বইন’ সম্বোধন করে। শেফালিও কম যায় না, সেও চোখেমুখে প্রত্যুত্তর দেয়। অল্পদিনেই গার্মেন্টে কাজ দেবে – এ-আশ্বাসে শেফালি সাদেকের কথার ঝাল হজম করে।

গতরাতে লোডশেডিং ছিল। যখন পেটের চাপ হালকা করতে শেফালি কলতলায় গিয়েছিল।  ঘুটঘুটে অন্ধকার। টয়লেটে না ঢুকে সে হাউসের পাশে খোলা গোসলখানায় প্রয়োজন সাড়ছিল। বিশ্রি একটা শব্দের কারণে হয়তো কারো পায়ের শব্দ সে শুনতে পায়নি। ভেবেছিল অনেক রাত, লাইনে কেউ জেগে নেই। কিন্তু কখন যে পেছনে সাদেক এসে দাঁড়িয়েছে, সে টের পায়নি। যখন সে উঠে দাঁড়িয়েছে, পাজামার ফিতে বাঁধবে, তখনি সাদেক এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। বলেছে, ‘তালতো বইন একটু পরে বান্দো।’

শেফালি গাঁইগুঁই করেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করবে বলে ভয় লাগিয়েছে কিন্তু মানেনি সাদেক। সে ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে, যেন অক্টোপাস তার শিকারকে একেবারে কব্জা করে নিচ্ছে। সাদেক টাকার কথা কানে কানে বলেছে। অর্থাৎ সে এই কাজের বিনিময়ে টাকা দেবে। শেফালি উত্তর দেয়নি। সাদেক মহাধুরন্ধর শেফালিকে কোনো শব্দই করতে দেয়নি। এভাবে ৩নং হরিশ্চন্দ্র লাইনে গতরাতে ধর্ষিত হয়েছে শেফালি।

সকালে কোলাহলময় লাইন। একফাঁকে শেফালির বুকের খাঁজে ময়লা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ঢুকিয়ে দিয়েছে সাদেক। শেফালি টাকার অস্তিত্ব টের পেয়েছে। আরো টের পেয়েছে সাপের মতো একটা ঠান্ডা হাত। মুহূর্তেই সাদেক তার হিংস্র কামনা, হাতের চেটোয় ছুঁয়ে নিল। নীরব দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে শেফালি তাকিয়ে রইল। আর সাদেক যেতে যেতে বলল, চা-পরোটা কিননা খাইছ। তালতো বইন চিন্তা করিছ না, চাকরি খুঁইজা দিমু।

‘হ, শেফু একটা কাম পাইলে ভালা হইত। এমনে আর থাকুন যায় নি। ঘরের মইদ্দে কতডি মুখ। এতগুলান মুখে খাওন তুলি দেওন কম কতা নি? মানুষটা ত আর পারেন না। কী যে করমু কিছু কইতে পারিয়েন না।’ শেফালির মায়ের মুখে আক্ষেপ ঝরে পড়ে।

শেফালির আক্ষেপ করার কিছুই নেই। গ্রামে থাকতেও দু-একবার অঘটন ঘটেছে। সে-কথাও কখনো শেফালি মুখ ফুটে বলতে পারেনি। প্রভাবশালী হাশেম খাঁর বাড়িতে কাজ করত। ছেলেরা সবাই শহরে থাকে। বাড়িতে থাকে বুড়ো বাপ। কয়েকজন কামলা খাটে দিনে-রাতে। নিশ্চিন্তমনে শেফালিও কাজ করত সেখানে। শেফালি ছাড়াও আরেকজন মহিলা ছিল – নাম ধলার মা। কারো ভাবনায় আসার মতো নয় যে, স্ত্রী-মরা বুড়ো মানুষটি দ্বারা কিছু ঘটতে পারে। বুড়ো মানুষটি নির্দ্বিধায় দুপুরে উদোম হয়ে তার গা টিপতে বলত। বেহায়া-বেশরম বুড়োটাই তার শরীরের আড় ভেঙে দিলো। সব মিলিয়ে তিন-চারবার। তারপর শহরে চলে এলো। বাপ আগে থাকতেই শহরে রিকশা চালাত। গ্রামের ভিটেটুকু চাচার কাছে অনেক আগেই বিক্রি হয়েছে। তাই পেছনে কোনো টান নেই। শেফালির খুব ইচ্ছা ছিল, তার একটা বিয়ে হবে। স্বামী, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা হবে। সে-আশা বুঝি আর সফল হবে না। তবু শেফালি দমবার পাত্রী নয়। একটা কাজ জোটাতে পারলে ওদের সংসারটা ভালোভাবে চলত। না হলে বাবার অল্প টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকাই দায় হবে। শেফালি আরো একটা বুদ্ধি মনে মনে অাঁটে। সাদেকের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে, সেহেতু তাকেও সে বিয়ে করতে পারে। সে মনে মনে ঠিক করে, সাদেককে বিয়ের জন্য চাপ দেবে। হোক সতীনের ঘর, তবু তো বিয়ে হয়েছে বলবে লোকে।

জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে টাকাগুলো বের করে শেফালি। লাল লাল টাকার নোট। যেন কল্পলোকের পরশপাথর, যার কাছে আছে সে-ই ক্ষমতার উৎস। সে নাড়েচাড়ে। হায় রে টেহা, তুইই সব। নিশ্বাস ছাড়ে। লাইনের পুবপাশে বড় একটি নালা। নোংরা আবর্জনা আর মলের পানি কলকল করে যাচ্ছে। তার ওপরে সিমেন্টের স্ল্যাব। সেটির ওপর দিয়েই মানুষজন চলাফেরা করে। নালার পাশেই নসু মিয়ার চায়ের দোকান। দোকানের সামনে পায়ে-হাঁটা পথ। তার পাশে ইটের আইল। তার পাশে রেললাইন। ইটের আইলটা দেওয়ার মানে রেললাইনটা রক্ষা করা। কিন্তু শেফালিকে রক্ষার জন্য কোনো আইল নেই। মিল-কারখানার মানুষ আর রিকশাঅলারা চা-দোকানে সারাক্ষণ আড্ডা মারে। আর নসু মিয়ার আধপুরনো সাদা-কালো টেলিভিশনটায় বাংলা সিনেমার ডায়ালগ ফুল সাউন্ডে বাজতে থাকে।

শেফালি মগ নিয়ে এসেছিল। তিনটা চা আর পাঁচটা তেলু পরাটা নেয়। এখানে সেকা পরোটা হয় না। সকালে-বিকেলে তেলু পরোটা মেলে। কালো লোহার কড়াইয়ে তেলের সঙ্গে ডালডা মিশিয়ে ডুবোতেলে ভাজা হয় পরোটা। সে-পরোটা কাস্টমাররা চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খায়। শেফালি, নসু মিয়ার দিকে টাকা এগিয়ে দেয়। এ-সময় দোকানের মানুষগুলো বাংলা সিনেমা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তার দিকে তাকায়। আর সেই দৃষ্টিতে যে কী আছে, শেফালি তা ভালোভাবে টের পায়। সে টের পায়, পুরুষগুলোর চোখ কামনা আর লালসায় ঠাসা। সে একঝলক টেলিভিশনের দিকে তাকায়। খেমটা নাচ চলছে। আর নানারকম কসরত। এরই   মধ্যে সওদাগর পয়সা ফেরত দেয়। শেফালি চা আর পরোটা নিয়ে ফিরে দাঁড়ায়। দেখে, এক বৃদ্ধ তার পশ্চাৎদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরতেই সে চোখ রাখে সরাসরি বুকের উপত্যকায়। শেফালি গজগজ করে, ‘বুইড়া কববরে যাবিনি?’

কথাটা খুব আস্তে বলে সে। তবে বুড়ো বোধহয় বুঝতে পারে, তাই সে অস্ফুট শব্দে বলে, ‘বেয়াদ্দপ মাইয়া’।  শেফালি গা করে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে আসে।

সম্ভবত আশপাশে খবরটা রটে গিয়ে থাকবে। কোন খবরটা? যে-রাতে সাদেক ওর দুই বন্ধুকে লাইনে নিয়ে এসেছিল। রাত অবধি চলেছিল ওদের তাসের আড্ডা। মাঝেমধ্যে ওদের কথাবার্তা গুলির শব্দের মতো লেগেছিল। লাইন নির্জীব হয়ে পড়লে বিড়াল-পায়ে চলে এসেছিল শেফালি। ওদের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা আর চা খাওয়ায় মেতে উঠেছিল। সাদেকের বউ কুলসুমি না থাকায় আরো সুবিধা হয়েছিল। যখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায় আর চারপাশ অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখন শেফালিকে আবার দেহ দিতে হয়। একে একে তিনজন। একটা ঘরের মধ্যে যখন শেফালি তিনটি পুরুষের সঙ্গে উলঙ্গ হয়ে কাটায়, তখন তার মাথায় ঘোরে শুধু টাকার কথা। সাদেকের ভাবসাব দেখে মনে হয়েছিল সে মোটা অঙ্কের দাঁও মেরেছে। ফ্রেশ মাল পাইয়ে দেবে বলে বন্ধুদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আরো বেশি খসিয়েছে। বন্ধুরা বিদায় নিলে সাদেক তার দিকে এক হাজার টাকা এগিয়ে দিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে টাকাটা অতর্কিতে সে সাদেকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কড়কড়ে আরেকটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে এনেছিল।

‘চার্জটা একটু বেশি লইলা না তালতোভাই?’

সাদেক ধরা পড়া ইঁদুরের মতো মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, ‘পথ দেহাইলে চার্জ দিবা না?’

শেফালি টাকাটা ফেরত দিয়ে বলেছিল, ‘লও আজকা, বেশি লও, আর লইও না, কষ্ট করমু আমি আর তুমি বেশি বখরা নিবা, হেইডা মানন যায় না।’

সাদেক মুহূর্তে শেফালিকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। নির্দয়ভাবে বুকদুটো মুচড়ে দিয়ে তার পৌরুষত্ব জাহির করেছিল। শেফালি সায় দিয়ে আস্তে করে নিজেকে মুক্ত করে ফিরে এসেছে। তারপর কলতলায় জল ফেলার শব্দ শোনা যায়। সাফ-সুতরো হয়ে শেফালি ঘুম দেয়। কেউ জানতেও পারল না, ৩নং হরিশ্চন্দ্র লাইনে গতরাতে কী ঘটে গেল।

প্রচন্ড কোলাহলে শেফালির ঘুমটা ছুটে যায়। তখনো চোখে ঘুমের আঠা লেগে আছে। গা-হাত-পায়ে ব্যথা। মনে হচ্ছে কে যেন তার শরীরটাকে তন্দুর রুটির কাঁইয়ের মতো মথিত করেছে। টিনের চালায় ভ্যাপসা গরম। তেল-চিটচিটে বালিশটা অসহ্য অনুভূতি ছড়াচ্ছে। অবিরাম খই ফোটার মতো বিশ্রী গালাগাল কানে তালা লাগায়। নাজমুলের মা চিল্লাচ্ছে। কান পেতে সে শুনল। কাল রাতে সাদেকের ঘরে বাইরের মানুষ এসেছে। রাতেরবেলা ওরা চেঁচিয়ে কথাবার্তা বলেছে। মদ খেয়েছে, আরো কত কী। বুড়ি নাকি ঘুমোয়নি। সেসব কথাবার্তা সে মাইকের মতো স্বরে সবাইকে জানান দিচ্ছে। ব্যাপারটা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়, কে বা কারা রাতের অন্ধকারে নাজমুলের ঘরের সামনে হেগে রেখে গেছে।

‘হাগা-মুতের গন্ধে দম বন্ধ হই আইয়ে, মাগো মা! কত্তুন যে হিয়াল-কুত্তা-বিলাই আই পইড়ছে, জানি না। দুই উগ্গা নডিও আই ভিড় জমাইছে।’

এবার মনে হচ্ছে আঙুলটা তার দিকে তাক করা।

নাজমুলের মায়ের এহেন কথায় শেফালির গা জ্বলে। গায়ের চামড়া চোতরাপাতা দিয়ে কে যেন ডলে দিয়েছে। এমন জ্বলুনির ভাব নিয়ে সে এক লাফে বিছানা ছাড়ে। ঘরে কেউ নেই। মা বোধহয় ঝগড়া দেখছে। মইফুলি কোথায় কে জানে! ভাই নিশ্চয়ই খেলতে গেছে। ঘরের কোণে থালায় পরোটা আর পাশে চা ঢাকা। একবার উদোম করে দেখল সে। শক্ত হয়ে গেছে পরোটা। তার পরও এগুলোই খেতে হবে। তার আগে পেটের চাপ খসাতে হবে। দরজার ঝাপ টেনে দিয়ে কলতলার দিকে চলল সে। দেখল নাজমুলের বউ উদোম শরীরে পানি ঢালছে। পাত্তা দিলো না সে। পাশ দিয়ে গিয়ে বদনা ভরে ভেতরে ঢুকে গেল। নাজমুলের বউ গজর-গজর করছে।

‘লাগে য্যান রানী আইছে। মা গো, বেডি আইত কেমনে দশটা লতিক ঘুমায়।’

শেফালি বিশ্রি একটা শব্দ করল ভেতর থেকে। মনে মনে বলল, ‘বুইজতি, যদি তিন বেডার ঠাপ খাইতি?’

একটু সময় নেয় সে। ততক্ষণে সাদেকও এসে ভিড় লাগিয়েছে। নাজমুলের বউ শব্দ করে বলে, ‘সাদেকভাই বাতরুমে যাইব।’

ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, ‘ব্যাচেলরগো হেইহানে যাইতে কন।’ বাথরুম ব্যাচেলরদের জন্যে একটা, ফ্যামিলিদের জন্যে একটা। মোট দুইটা বাথরুম হরিশচন্দ্র লাইনে। অবশ্য ১নং ও ২নং-এ এই সমস্যা নেই। ৩নং সবার শেষে হয়েছে, তাই এর দুরবস্থা। পুরুষরা মাঝেমধ্যে ফ্যামিলি-বাথরুম ব্যবহার করে। সাদেক ভেবেছিল এই সময় এখানে কেউ থাকবে না। নাজমুলের বউ আওয়াজ দিলো, ‘হেই বাতরুমে যান।’ সাদেক চলে যায়।

শেফালি বের হয়ে আসতেই নাজমুলের বউয়ের ছিটানো পানি লাগে। মেজাজটা গরম তেলের মতো ফুটতে থাকে। মুখে কুৎসিত একটা গাল লেগেই থাকে – ‘নডির ঘরে নডি’।

নাজমুলের বউ আরো দ্বিগুণ ক্ষেপে ওঠে।

‘আই নডি ন-অ, তুই নডি। রাইতের বেলা কাম-করি দিনের বেলা হুতি থাছ। আমরা হেরুইম্মা বেডি ন-অ।’

শেফালি অাঁতকে ওঠে। রাতের বেলা কাজ করেছে ও, নাজমুলের বউ জানল কেমন করে? নাকি আন্দাজে ঢিল মেরেছে। সে মোক্ষম অস্ত্রটা ছোড়ে, ‘রাইতের কাম তো আমনে না করেন।’

‘নাউজুবিল্লাহ আস্তাগফিরুল্লাহ। হেতি কিয়ারে কয়? এক্কেবারে আসল খানকিয়ে না।’

ঠিক এই সময় নাজমুলের মা এদিকে আসছে দেখে শেফালি তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে। বাপরে বাপ! বিশালদেহী মহিলা। গলা তো নয়, যেন মাইক। রাস্তায় গিয়ে মানুষকে জানাবে – তখন কোন ঝামেলা থেকে কোন ঝামেলা হবে বলা যায় না। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নেই। কপাল পুড়তে পারে। রউফাবাদ কলোনি থেকে সবাই ওদের তাড়িয়েছে। না জানি আবার এখান থেকেও তাড়ানি খেতে হয়। এই ভয় বুকে নিয়েই থাকতে হয়।

চিমসে পরোটা আর ঠান্ডা চা নিয়ে বসল সে। ঠিক সে-সময় ওর মা ঘরে ঢুকল।

‘উঠছস নি?’

‘হ’

‘দুরফুরে কী রাইনবি?’

‘কিছু নাই?’

‘আলু দুগা আছে।’

‘ফেরিঅলা আইলে মাছ কিনুম।’

‘রাস্তাত লইট্যা মাছ বেচের দেই আইলাম।’

‘দাম জিগাইছেন নি?’

‘হত্তর-আশি টিয়া হইব।’

‘চাই, আই যাই লই আনি।’

শেফালি উঠে দাঁড়ায়। মা আস্তে আস্তে ডাকে, ‘এরে শেফু হুন।’

থমকে দাঁড়ায় সে। বুকের ভেতর ভয়ের স্রোত নামে। যদি কোনো খারাপ খবর হয়।

‘কী?’

‘চাইছ, সাবধানে কইলাম। ব্যাক কিছুর একটা সীমা আছে। এই শহরে টিগি থাগন বউত কটিন।’

তার মনে শঙ্কা। মা কি তবে কিছু টের পেয়েছে! পাক। কী করবে? চাকরির চেষ্টা তো কম করেনি। যেখানেই যায় পুরুষগুলো তার শরীরটা ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। যতদিন রথ আছে দু-পয়সা কামাই করে নেবে। তারপর কী হয় দেখা যাবে।

মায়ের একটা কথা কখনো ভুলতে পারে না সে। সেদিন ঘরে কিছু ছিল না। বাবা রিকশা চালাতে পারেনি। খিদের চোটে ছোট ভাইবোন কাঁদছিল। তখন মা তাকে উদ্দেশ করে বলছিল, ‘নডিগিরিও জোটে না তোর।’ এই কথাটা সব সময় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। চোখ বুজলেই কথাটা তাকে দংশন করে।

নসু দোকানদারও যে তার কাস্টমার হবে – সে ভাবতে পারেনি। রাতেরবেলা চলে এলো। সাদেক আগেই বলেছিল। শেফালি কিছুক্ষণ ঢং করল। ইনিয়ে-বিনিয়ে নারীর ষোলোকলা দেখিয়ে ধরা দিলো। তারপর পাঁচশো টাকা খসিয়ে নিল। ভেবেছিল নসু মিয়ার কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে; কিন্তু বড় আঘাতটা পেল সে সকালে, চা আনতে গেলে। সে যেন অস্পৃশ্য। নসু মিয়া অনেকদূর থেকে তাকে চা আর পরোটা দিলো। তার দোকানের কিছুর সঙ্গে লাগলে খেঁকিয়ে উঠল। হায়রে পুরুষ! বলে আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। বীর্যপাত করার পরে পারলে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে পবিত্র হয়।

এখন ইনকাম ভালো হচ্ছে। তাই দুঃসাহসটা দেখিয়ে ফেলল শেফালি। পাঁচ কেজি জিলাপি এবাদতখানায় পাঠিয়ে দিলো। খেয়ে সবাই দোয়া করল। শেফালিও ভাবল আর কিছু টাকা জমলে সে এসব দেহের কারবার ছেড়ে দেবে। ছোট্ট একটা পান-সুপারির দোকান দেবে সে। দরকার হলে দেহের জন্য বান্দা কাস্টমার রাখবে। হা-হা-হা করে নিজে নিজেই হাসল সে। সে-হাসির কোনো শব্দ হলো না। এ এলাকার বড় মাস্তান তার খদ্দের। রুস্তম। কালা মইষের মতো চেহারা। দেখলে সবাই কাঁপে। পরপর দুই রাতে এসে গেছে। তবে শালাকে সামলানো মুশকিল। তার ওপরে জানোয়ার গেলে বাংলা মদ। ভকভক করে গন্ধ বেরোয়। তাতে কী, শালা জাতে মাতাল তালে ঠিক। পেতে হবে তার ষোলোআনা। ছিঁড়েখুঁড়ে পেতে চায়। অসহায় হয়ে পড়ে সে। চিন্তা থাকে শুধু পকেটের দিকে। শরীর নোংরা হলে জল দিয়ে সাফসুতরো করে। এখন মাঝে মাঝে সন্ধের পর বের হয় সে। সাদেক ওকে রিকশায় চড়িয়ে নিয়ে যায় জিইসির মোড়ে। এখন ওটা চাটগাঁইয়াদের স্বর্গরাজ্য। সন্ধের পর কেমন জমজমাট হয়ে বসে। সে-হিসেবে থ্রিস্টার হোটেলের পাশে উড়ো কয়েকজন অপেক্ষা করে। কাস্টমার মিলে যায়। সে-আশাতেই শেফালির এদিকটায় আসা। এখন ইনকামটা ভালো। তাই পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি আছে। টাকা না থাকলে কারো মুখে হাসি থাকে না। তাই শেফালি এই টাকাকে ধরার জন্য নতুন চিন্তা করে।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখটা গোমড়া। গতরাতেই সে খবরটা পেয়েছে। কাজটা চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়। রাতের এগারোটা-বারোটা করে যেতে হবে। ভোর হওয়ার আগেই চলে আসবে। রেট ভালোই, এর আগে এমন রেট সে পায়নি। চার-পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে পাঁচ হাজার টাকা। তবে পাঁচজনকে সেবা দিতে হবে। সাদেক রিকশায় পৌঁছে দেবে। আবার ভোর হওয়ার আগেই নিয়ে আসবে। যখন রাতের অন্ধকার মেঘের সহায়তায় গাঢ় হলো, যখন লোডশেডিংয়ের আওতায় পড়ল চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা – তখন শেফালি পৌঁছল। সাদেক ফোনে কল দিলো। একজন এসে নিয়ে গেল চার দেয়ালের ভেতরে। খাবার-দাবার ভালোই দিলো ওরা। কিন্তু পাঁচজনের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়াল। শুধু তাই নয়, একজন জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে স্তন পুড়িয়ে দিলো। শেষের জন করল আরো নির্দয় আচরণ। বীর্যপাত শেষ হলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাথি চালাল। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে সে আগে পড়েনি। মনে ভাবল সে, না, এখান থেকে চাপ দিয়ে আরো টাকা বের করতে হবে। প্রস্রাবের মতো হলুদ পানিতে গলা ভিজিয়ে শরীরটাকে উষ্ণ করে, আরো কিছু টাকা বেশি নিয়ে শেফালি বের হয়ে এলো। অন্ধকারের মধ্যে দেখল, সাদেক দাঁড়িয়ে আছে বাদামগাছের নিচে। কোনোরকমে সে টলোমলো পায়ে রিকশায় উঠল।

সাদেক তখন জিজ্ঞেস করল, কি রে, অবস্থা মনে লয় ভালা না? শেফালি বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল, ‘চালা মাগিরপুত।’

ব্যথায় কঁকাতে থাকে সে। সাদেক খুব আন্তরিকতা দেখায়। তখন শেফালি বলে, ‘খানকির পুতে আমার বুনির মইদ্যে সিগারেটের আগুন দিছে।’

সাদেক বুঝতে পারে ওর অবস্থা; কিন্তু জিজ্ঞেস না করে পারে না।

‘কাইলগা বাইর হবিনি?’

‘না।’

‘তয়?’

‘আরো তিন দিন লাগব। অষুদ লাগব।’

‘ঘরে আছেনি?’

‘নাই।’

শেফালির এ-ধরনের আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। ওই লোকটি ছিল হিংস্র। সাদেক তাকে ইঙ্গিতে বলেছিল। সে বোঝেনি। চাবুক দিয়ে পেটাতে শুরু করে তাকে। তারপর রক্তাক্ত করে আদর করতে শুরু করে। বাপের জন্মেও এমন ঘটনা শোনেনি। সে আরো দু-একজনের সঙ্গে কথা বলেছে। কেউ এমন কথা শোনেনি। শরীর নেওয়ার আগে চাবুক দিয়ে পেটাতে হয়। বাপরে বাপ! একেবারে বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছিল। তার ওপরে শুয়োরটা রাস্তাও চেনে না। ওলটাপালটা কাজ করে। ইচ্ছা হয়েছিল হারামজাদার সাধের জিনিসটাকে ব্লেড দিয়ে পুঁচিয়ে দেয়। পারেনি।

রিকশা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় চলতে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে আরো দেরি আছে। ৩নং হরিশবাবুর লাইন এখনো জাগেনি। আবছা কুয়াশায় ঢেকে আছে রেললাইন। মনে হচ্ছে রেললাইনটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে।

 

অসুখটা যে কীভাবে বেঁধে গেল বুঝতে পারল না সে। শুধু শুধু ডাক্তারদের ওপর চোটপাট করল। বলল, ‘হেতারা কি মাগির ডাক্তর নি? হের লাই অষুদে কাম অয় না। মাগির ডাক্তার অইলে কওন ভালা হই যাইতাম।’

আস্তে আস্তে চেহারা শুকিয়ে গেল। চেহারায় মলিনভাব এলো। কাশিটা ভালো হলো না। ঘা-পাঁচড়া লেগে রইল। স্যাঁতসেঁতে বিছানায় দিনের পর দিন পরে রইল শেফালি। সাদেক এখন আর কাছে ভেড়ে না। ও এখন মইফুলিকে নিয়ে ব্যস্ত; কিন্তু কে মানে কার কথা। বলেছিল শেফালি, মুখঝামটা মেরেছে মইফুলি। বলেছে, ‘ওসুখে মরি যাছ, তার পরও শতানি কমে না। এইবার খেমা দে। চুপচাপ করি হুতি থাক, নাইলে মরি যা। প্যাটপ্যাট করবি না।’

এরপরে বলার আর কিছুই থাকে না শেফালির। শামুকের মতো পড়ে থাকে। চারটা ভাতের জন্য ছটফট করে। না খেতে পেয়ে ওর অবস্থা আরো করুণ হতে শুরু করেছে। ক্ষিদের এত কষ্ট আগে কখনো বোঝেনি। মা আর সহ্য করতে পারে না। বিরক্ত হয়। বাবা বলেছে, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। সে শুনেছে, বাবা বলছিল, ‘নডিগিরি করনের সময় খেয়াল আছিল না। অন আঙগোরে জ্বালায় কা?’

এ-কথা শোনার পর নীরবে চোখের জল ফেলেছে সে। কত্তো টাকা এনে মা-বাবা দুজনের হাতে তুলে দিয়েছে। তাদের হাসিমাখা মুখ এখনো চোখে ভাসে। ভাবে, কোথাও চলে যাবে। কিন্তু শক্তিতে কুলায় না। মাথা চক্কর দেয়। নোংরা নর্দমা থেকে গন্ধ উঠে আসছে। পায়খানার গন্ধে দম আটকে আসছে। একটু মুক্ত বাতাসের জন্য প্রাণটা হাঁসফাঁস করে। বাতাসও পায় না। মনে হচ্ছে এ-পৃথিবীতে বাতাসও কিনতে হবে। আজ মৃত্যুর দুয়ারে এসে মা ডাক শোনার জন্য বড় অস্থির হয়ে উঠল শেফালি। কী করল সে। বেশ্যাদের কি মা হতে নেই? একবার একজন সাংবাদিক লেখকের বাসায় গিয়েছিল; কিন্তু সেই ভাইজানটা কিছুই করল না। খালি নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করল। ভেবেছিল অন্তত তার উলঙ্গ দেহটা দেখবে। তাও দেখল না। উলটো সে উলঙ্গ হতে চাইলে এসে তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো। সেদিনই প্রথম শেফালির মা হতে ইচ্ছে করেছিল। সে ভেবেছে, এই ভাইজানকে দিয়েই সে মা হবে। কিন্তু হয়নি। তার ইচ্ছার কথাটা সে বলেছিল কিন্তু তিনি শুনলেন না। বললেন, পরে জানাবেন। পরে আর দেখা হয়নি।

এ-অবস্থায় ধুঁকতে ধুঁকতে মরে গেল শেফালি। যে-রাতে শেফালি মরল, সে-রাতে ওর ছোট বোন মইফুলি ভেগে গেল।  রুস্তম ওকে কোথাও নিয়ে গেছে। সমস্যা হলো, মৃত শেফালিকে নিয়ে। একজন বেশ্যা নারীকে কেউ দাফন করতে এলো না। তা ছাড়া তার কোনো জানাজাও হবে না বলে জানিয়েছে মুন্সিভাই। ওর মা আর ছোট ভাইটা মৃত শেফালিকে নিয়ে কী করবে, বুঝতে পারছে না। বাবাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ৩নং হরিশ্চন্দ্র লাইনে ছোটখাটো একটা ভিড় লেগে রইল।

নাজমুলের মা ফিসফিসিয়ে কাউকে বলল, ‘হেতিয়ে বেইশ্যা আছিল।’