শেষ বিকেলের আলো

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

ওই যে, নীল শার্ট কালো ট্রাউজার। ছ-ফুট দু-ইঞ্চি, চওড়া ছাতি – পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি নিশ্চয়। জিমে পাকানো শরীর। পরিষ্কার দাড়ি-গোঁফ কামানো। গাল নীলাভ, পঁচিশ-ছাবিবশ। প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেন থেকে বেরিয়ে দুপাশ ভালো করে দেখে, লেফট-রাইট করে রাস্তা পেরিয়ে, তিনটি ঝুরি নামানো বটগাছের তলায়। পাঁচ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে, টালিগঞ্জ থানার সামনে ফুটপাথে বসা জুতো পালিশওয়ালার দিকে এগিয়ে গেল – ‘পালিশ … তাড়াতাড়ি … ভালো করে …’

পাহাড়ে চড়া যাদের শখ, তাদের কেউ-কেউ ওকে চেনে। ছোটখাটো কয়েকটা অভিযান করে কিঞ্চিৎ নাম হয়েছে ওর। তবে যারা সেলসে কাজ করে, সবাই ওকে চেনে। রঞ্জন মজুমদার। বড় বড় কোম্পানি ওকে পেতে চায়। আপাতত, সে টুইটার মোবাইলের রিজিওন্যাল সেলস হেড। তবু, বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যায়। জুতো এমন কিছু নোংরা হয়নি যে, এখনই জরুরিভিত্তিতে পালিশ করাতে হবে। এতটাই তাড়াতাড়ি, গুছিয়ে বাক্য শেষ করার সময় নেই। বোঝাই যাচ্ছে ও কিছু ভাবতে চাইছে, জুতো পালিশ একটি ফিকির মাত্র। এও বেশ বোঝা যাচ্ছে, জামার ভেতরে মোটা কিছু পরেছে। গরম জামা হতে পারে, যাকে আজকাল চলতি কথায় থার্মাল বলা হয়। কিন্তু চামড়ায় টান লাগলেও, এখনো কলকাতায় এমন কিছু শীত পড়েনি যে, ওইরকম মোটা গরম জামা পরতে হবে। তবে কি রঞ্জনের জ্বর?

পালিশ-বাক্সের কাঠে ডান-পা রেখেই রঞ্জন আবার গলা ছেড়ে বলল, ‘ভালো করে, ভালো করে …’

উত্তর ছুটে এলো, ‘আমি ভালো পারি না, অন্য কোথাও যান।’ ঈশানকোণে আঙুল তুলল পালিশওয়ালা মুচি। তার চোখের জমি সাদা বস্নটিং পেপার, কালচে ঠোঁট দু-টুকরো জোড়ালাগা পাথর!

আগেকার রঞ্জন হলে এখনই পালটা চালাত। ওর টিমের সবাই জানে ক্যাপ্টেনের চালু কথা  – ‘কেউ অপমান করলে সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাট চালাবি। জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের যে-কোনো দোকানের বিরিয়ানি থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের যে-কোনো ঝুপস-এর মিষ্টি গজা সব সামলানো যায়। কিন্তু দেখবি অপমান হজম হয় না, অ্যাসিড হবেই … প্রথমে বুকের ভেতর চাপ, তারপরেই অম্বল … পালটা চালালে চাপ হবে কিন্তু পরেরটা হবে না …’

সেই রঞ্জন আজ এখন হতভম্ব। রাস্তা পার হওয়ার সময়েই মনে হয় তার কেটে গেছে। বারদুয়েক ঠোঁট নড়ল। দূর-নিয়ন্ত্রিত রোবটের মতো পা সরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। সে কি হেলাফেলা করে কথা বলল! অধস্তন সবাইকে সে সম্মান দিয়ে কথা বলে। তাকে সবাই বলে – টিমম্যান, টিম লিডার। এজন্যই তার সাফল্য। যেখানে গেছে, চড়চড় করে সেলস বাড়িয়েছে। তবু কেন ছিটকে বেরোল, ‘পালিশ … তাড়াতাড়ি … ভালো করে … ?’ কিছু কি দাবড়ানি ছিল কথায়? গুণী মানুষের বল্টু একটু ঢিলে হয়। তাই বোধহয় খ্যাঁক করে উঠেছে।

যুক্তি দিয়ে কথাটা ভাবতে পারায় মাথাটা কিছু হালকা। ডান-পা নামিয়ে, লোকটির দিকে তাকাল রঞ্জন। নিচে লুঙ্গি, ওপরে ফতুয়া।  ডানদিকের রগের কাছে কালো দাগ বেশ গভীর। অন্যদিকে তাকিয়ে পথচারীদের উদ্দেশে লোকটি হাঁক পাড়ল – ‘পালিশ, পালিশ …’

অর্থাৎ সে খালি আছে। অর্থাৎ, সে রঞ্জনকে বলতে চায় – বাপু হে, তুমি কেটে পড়ো।

অতএব, শরীর ঠেলতে-ঠেলতে আবার বটগাছের তলায়। এখন তার কী করার কথা ছিল?

রঞ্জন মজুমদারের যখন এমন হুতুলি-কুতুলি দশা, চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল খালি ট্রাম। আকাটের মতো শব্দ
করতে-করতে। দরকার না থাকলেও খালি ট্রামে উঠে পড়া রঞ্জনের শখ। ট্রামের বাঁপাশের সিটে বসে কলকাতা দেখতে দারুণ লাগে। গেট লক্ষ করে ছুটে আসা যাত্রীদের ভঙ্গিও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। আজ সে দাঁড়িয়েই রইল।

বাঁদরওয়ালা গেল শিস দিতে-দিতে – বাচ্চা বাঁদরটি তার কাঁধে, ধেড়ে দুটি রাস্তায় জোরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কলেজ ইউনিফর্ম পরা তিনজন পা ঘষটাতে-ঘষটাতে চলে গেল। হাওয়ায় উড়ে এলো ছেলেটির গলা – ‘মার্কল ট্রি … ক্রিপটোগ্রাফি …’

মেয়েটি হাত নেড়ে বলল, ‘অরফ্যান বস্নক ব্যাপারটা …’

অন্য ছেলেটি বলল, ‘মালার মতো চেইন ফরমেশন করে দিলে …’

বোঝাই যায়, ওরা বস্নকচেইনের ব্যাপারে কথা বলছে। কিন্তু এইসব টুকরো কথার একটিও রঞ্জনের কানে ঢুকল না। বস্ত্তত, সামনের চলমান জগতের সব ঘটনাই সে দেখেছে। আবার দেখেওনি, শোনেওনি।

অথচ, যারা ওকে চেনে সবাই বলবে, দেড় বছর আগেও রঞ্জন এমন অন্যমনস্ক ছিল না। আর কিছুতে না হোক তার মতো কম্পিউটার ওস্তাদ বস্নকচেইন নিয়ে মাথা ঘামাবে না, ভাবাই যায় না।

সে-সময়ের রঞ্জন আজ বলেই বসত  – এই মেয়ে শোনো –

ওরা হয়তো কোনো ক্যাফেতে ঢুকত। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে টুইটার মোবাইলের সেলস হেড বুঝে নিত ওদের দৌড়। সহজ
কথায় বুঝিয়ে দিত মোদ্দা ব্যাপারটা। কথার ফাঁকে বুঝে নিতে চাইত আগামীতে কে সেলস-মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট করলে উন্নতি করবে। আজ কিছুই করতে ইচ্ছে করল না। সে এখানে এসেছে কেন? মনে পড়ছে না। কোথায় যাওয়ার? তাও বুঝতে পারছে না।

ছন্দছুট মনের ভেতরও মানুষের একটা কোনো বোধ কাজ করে, যা খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া মানুষকেও জীবনের দিকে ফেরায়। বিজ্ঞানীরা এখনো তার তল পায়নি। সেই গভীর থেকে বার্তা পেল রঞ্জন। মনে-মনে গুনতে শুরু করল এক-দুই-তিন-চার …

প্রতিটি সংখ্যা উচ্চারণের সঙ্গে বুকের ভেতর শব্দ উঠছে ঢিবঢিব। যেন বাঁয়া তবলায় টোকা দিচ্ছে কেউ! প্রতিটি তালে মাথার আলসেমি খসে-খসে যাচ্ছে। হালকা আলো ফুটতেই শালিকগুলো যেমন উসখুস করে উঠে জানালার গা-ঘেঁষে বেড়ে ওঠা পেয়ারাগাছটার ডালে, ঘেঁটে যাওয়া যুক্তি নড়েচড়ে বসছে। যেন ভোর হচ্ছে খুলির ভেতর! ঠিক তখনই কথাটা গায়ে বিঁধল, ‘… অন্য কোথাও যান।’

পেছন ফিরে আবার যেতেই -, পালিশওয়ালা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। ক্রিমের শিশির ঢাকনা খুলে চোখ সরু করে দেখে নিল ভেতরটা। তারপরেই আঙুল ডুবিয়ে পরখ করল ঘনত্ব।

‘সন্ত রুইদাস বলেছেন, বিকেলে কাউকে ফেরাতে নেই … কোনো খদ্দের পাবে না … ’, যা মাথায় এসেছে বলে দিলো রঞ্জন।

‘আঁ ক্যায়া … ’, শিশিটা হাতেই রয়ে গেল লোকটির। এমন নিয়মের কথা ওর বাপ-চাচা-বড়ভাই-নানা-নানি কেউ কোনোদিন বলেনি। নিশ্চিত ওর মাথা গুলিয়ে গেছে।

গ্রাহ্য না করে বটগাছের তলায় ফিরে এলো রঞ্জন। আর কী আশ্চর্য! ঠিক তখনই –

মধ্যষাট নিশ্চয়ই। শীর্ণ দেহ। পাকা পেয়ারা নাড়াচাড়া করলে যেমন অনুভূতি হয়, এ-ভদ্রমহিলার গালে হাত বুলোলে নিশ্চয় তেমনই শান্ত নিরামিষাশী লাগবে নিজেকে। ত্বকের রং? তিন কাপ প্রথম ফুটের জলে এক-চামচ পাতা চা ঢেলে এক মিনিট রাখার পর তিন-চামচ দুধ ঢাললে যে-রং খুলবে, এ সেই বর্ণ। তামাটে বলা ঠিক হবে না। চুল অধিকাংশই কালো, সামনের কিছু অংশ হঠাৎ রুপোলি। কোমরছোঁয়া। ঠিক মাঝখানে নয়, কিছু বাঁদিকে হেলা সিঁথি। এখন সিঁদুর না থাকলেও, এককালে যে থাকত বেশ বোঝা যায়। কপালে রুপোলি চূর্ণ কেশ। নাকের দুপাশ বেয়ে গভীর বলিরেখা, অথচ কী মসৃণ ললাট। চোখের আয়তনে তেমন কোনো হেরফের নেই যে আলাদা করে উপমা ভাবতে হবে, তবে দৃষ্টির তরঙ্গ নিশ্চয় অন্তর্ভেদী। কারণ, চোখে চোখ রাখলেই ভেতরটা গুরুগুরু করে। চোখের পাতায়-পলস্নবে বিষণ্ণতা লেগে আছে। চায়ের কথা ভাবতেই এদিক-ওদিক মাথা ঘোরাল রঞ্জন। কোনো দোকান নজরে এলো না। ঝুপড়ি-দোকানও নেই। অদ্ভুত অসংসারী এলাকা।

‘ভিক্ষা চাইছি না বাবা … ছেলেবউ রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে … ওই যে বাসস্টপের সামনের বেঞ্চিটায় বসে ছিলাম … বলেছিল সিনেমা দেখে ফেরার পথে নিয়ে যাবে … কিন্তু আর কী আসবে?’ ভদ্রমহিলার গলায় কোনো কাতরতা নেই, দুশ্চিমন্তা লেগে নেই। শান্তগলায় কথা-কটি বললেই যেন চলমান কলকাতার কেউ একজন দৌড়ে এসে ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। তিনি আরো কীসব বলে যাচ্ছেন -।

রঞ্জনের কানে কোনো কথা ঢোকেনি। মুখচ্ছবি দেখেই ছ্যাঁৎ করে ফিরে এসেছে সাড়ে চার, না-না ঠিক পাঁচ বছর আগের সেই বিকেল।

 

দুই

– আপনি কি কবিতা দত্ত বণিক?

– হ্যাঁ, কী ব্যাপার?

– শুনলাম এই বাড়ির একতলা …

– ও আচ্ছা … কী নাম আপনার?

– আপনি কি নাম পছন্দ হলে তবেই ভাড়া দেন?

‘ধ্যাৎ’, ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। মাখনের মতো গালে টোল পড়ল। তখনই দেখা গেল ওর ডান ভুরুর ওপর কাটা দাগ, যা না থাকলে মুখটাকে ঘর সাজানোর পুতুল মনে হতো। বয়স নিশ্চয় ষাট ছুঁয়েছে। তবু গরিমা অটুট।

– তুমি তো বেশ দুষ্টু ছেলে … তোমাকে তুমি বলেই ডাকছি … দোতলায় চলো …

– আমার নাম রঞ্জন মজুমদার … স্প্যারো কমিউনিকেশনসে কাজ করি … মোবাইল … সেলসে …

– হ্যাঁ বিষ্টু, মানে যে-এজেন্টের মাধ্যমে এসেছ, সব বলেছে … না-না ডানদিকে নয় … ভদ্রমহিলা আঙুল তুলে দেখালেন,
‘বাঁপাশে ওই জানালার দিকের সোফাটায় বসো, বিকেলের আলো পড়ুক মুখে … ’

– অ্যাঁ, বিকেলের আলো! মানে এই আলোতে তো কনে দেখা হয় … আপনি ভাড়াটেও দেখেন নাকি?

ভদ্রমহিলা আর হাসলেন না, ‘বসো, বসো … হ্যাঁ ঠিক আছে … কী খাবে, চা না কফি?’

রঞ্জন ঠোঁট নাড়া শুরু করতেই হুকুম চলল, ‘কুসুম দুটো চা নিয়ে আয় …’

উলটোদিকের কাঠের চেয়ারে বসলেন কবিতা দত্ত বণিক। ‘এইবার বলো তোমার ব্যাপার-স্যাপার … নাম তো বলেছো … বাড়ি কোথায়? বাবা-মা? পরিবার? … সব খুলে বলো … আজকাল যা সব হচ্ছে … টেররিস্ট-ফেররিস্ট … পছন্দ হলে তবেই একতলা দেখাব, তারপর আই কার্ড-ফার্ড নেওয়া যাবে …’

একেবারে পুলিশি জেরা শুরু করেছেন ভদ্রমহিলা। অন্য কোনো জায়গা হলে এখনই চলে যেত রঞ্জন। কিন্তু নিউ টাউনের এই অঞ্চল বেশ পরিষ্কার, খোদ কলকাতায় চৌরঙ্গীতে যেখানে তাদের অফিস, তার থেকে টেম্পারেচার অন্তত দু-ডিগ্রি কম। আশপাশ বেশ ফাঁকা-ফাঁকা, হেঁটে আরাম, মোটরবাইক চালাতেও মজা। বাড়িঘরদোরের তুলনায় মানুষ কম বলেই ভাড়াও কিছু কম। পাঁচ থেকে সাত হাজারের মধ্যে এরকম সাড়ে সাতশো-আটশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার দিয়ে শুরু করবে, ঠিক করে নিল রঞ্জন। মুখে বলল, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে, সব বলছি … তারপর আমিও আপনার কথা জানতে চাইব … ঠিকঠাক লাগলে তবেই ভাড়া নেব …’

ভদ্রমহিলা তাকালেন। মনে হয় কথার ধাক্কায় দমবন্ধ হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে চোখ বন্ধ করে রঞ্জন ভেবে নিল তার একুশ বছরের জীবন।

নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে কোনো মানুষ মারা যায় না বলেই কবিতা দেবীর কথা ফুটল, ‘বেশ, আমিও না হয় …’

চায়ে চুমুক দিয়েই রঞ্জন জুড়ে দিলো।

আমার বাড়ি বর্ধমানের কাঞ্চননগরে। কাছেই দামোদর। বর্ষায় এখনো হঠাৎ-হঠাৎ দুকূল ছাপানো জল। বাবা মণীন্দ্র মজুমদার অ্যাডভোকেট। বর্ধমানে নাম আছে। মা মণিমালা, স্কুলে পড়াতেন, দু-বছর আগে কিডনি ফেলিওর … মারা গেছেন। হাই প্রেশার, সুগারও ছিল। আমরা ওখানকারই পুরনো বাসিন্দা। পড়াশোনা মিউনিসিপ্যাল বয়েজ স্কুলে। রাজ কলেজ থেকে বিএসসি – কেমিস্ট্রি অনার্স। বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি। তারপরে কলকাতায় একটা সেলস ম্যানেজমেন্টের ডিপেস্নলামা করছিলাম। এক বছরের কোর্স। কিন্তু ন-মাসের মাথায় স্প্যারোতে এই চাকরিটা পেয়ে গেলাম। প্রথমে ছিলাম জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ। এক বছরের মাথায় সিনিয়র হয়ে গেলাম। তারপরে এই কিছুদিন আগে টিম লিডার, মেন্টর যাই বলুন, হয়ে গেছি। কলকাতায় এরকম চারটে টিম আছে। আমি একটার লিডার। অফিস থেকে মোটরবাইক কেনার লোন দিলো। কিনে ফেললাম। অনেকটা সময় কাটাতে হয় কলকাতায়। ঘোরাঘুরি করতে কাজে লাগে। কদিন আগেও বর্ধমান থেকে যাতায়াত করতাম, এখন আর পারা যাচ্ছে না। অনেক সময়েই লাস্ট ট্রেন ফেল হয়ে যায়। তখন মহা হ্যাপা। অত রাত্তিরে টু-হুইলার চালিয়ে বর্ধমান ফেরা ঝঞ্ঝাট। অবশ্য আমি ট্রেনেই কলকাতা-বর্ধমান করতাম। বাইক রাখা থাকে অফিসের গ্যারেজে। চুরি যাওয়ার ভয় নেই। কলকাতায় এসে সারাদিন ঘোরাফেরা দু-চাকায়। ফেরার সময় গ্যারেজে রেখে নিশ্চিমেত্ম বাড়ি ফেরা। কিন্তু এখন প্রবল চাপ। সেলস টার্গেট বেড়ে গেছে হু-হু করে। সেজন্যেই বাড়ি ভাড়া নেওয়া। এখান থেকে আধঘণ্টায় অফিস পৌঁছনো যাবে। কোনো চাপ নেই …

– চলো একতলা দেখিয়ে আনি … কুসুম চাবি আন … চা খেয়েছ? …

রঞ্জন মাথা নেড়ে উঠতে যাচ্ছিল।

– আরে এখনো তো পড়ে আছে! … বিস্কুট খাও না বুঝি? … ঠিক আছে চা শেষ করে নাও।

ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। সুড়ুত-সুড়ুত দুবার চুমুক দিতেই চা শেষ হয়ে গেল, ‘চলুন …’

 

একতলার ঘর দক্ষিণখোলা। জানালা খুলতেই, খালি মেট্রো রেলে বসার জন্য জোয়ানমদ্দরা যেমন করে, হুড়ুম-দুড়ুম করে ঢুকে পড়ল নেই-আঁকড়া বাতাস। জানালা কাচের। সস্নলাইডিং। বেশ বড়-বড়। ফলে আলো প্রচুর।

– সন্ধের সময় জানালা বন্ধ রাখতে হয় … ওই একটাই অসুবিধা, বড্ড মশা …

ভদ্রমহিলা আরো কী-কী সব বলে যাচ্ছিলেন। রঞ্জন মন দিয়ে ঘর দেখছিল। মোট দুটো শোবার ঘর। পূর্বদিকের ঘরের জানালা খুললেই বাগান। চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করা হয়েছে। এখনো ফুল ধরেনি। ঘরের গায়েই একচিলতে রান্নাঘর। উত্তর-পশ্চিম কোনায় এক ফালি বসার জায়গা। ড্রয়িংরুম বললেই বলা যায়। একটা ছোট ডাইনিং টেবিল কিনলে ওইখানেই বসাতে হবে। বাথরুম একটা নয়, দুটো। একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢোকা যায়। অন্যটি ঢুকতে হবে ড্রয়িংরুমের দিক থেকে। বাইরের লোকের জন্য এই ব্যবস্থা। কাজের লোক রাখলে সেও ওই টয়লেটই ব্যবহার করবে। আজকাল বেশিরভাগ বাড়িতেই এই ব্যবস্থা। কটকটে সাদা নয়, ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবির মতো দেয়াল।

সব মিলিয়ে ঘর পছন্দ হয়ে গেল রঞ্জনের। এর জন্য ছ-হাজার চাইলেও দেওয়া যায়। আবার দোতলায়। আবার বিকেলের আলো মেখে সোফায় বসা।

এইবার সেই কথাটা পাড়তে হবে। এর আগে এমনই কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ হওয়ার পর ওই কথাটা পাড়তেই সব কেঁচে গেছে। এরা সব লেখাপড়া করে ডিগ্রিই হাতিয়েছে শুধু, মনটা আধুনিক হয়নি। যুক্তি দিয়ে বিচার করতেও শেখেনি।

– কী এইবার আমার কথা শুনবে তো?

ভদ্রমহিলা কথা বললেই সুচিত্রা মিত্রের মতো মাথা ঝাঁকান। একমাত্র তখনই দেখা যায় ডানদিকের চুলের গোছার কিছু অংশে পাক ধরেছে। তিনি যে রুপোলি চুল চাপা দিতে কলপ করেননি, এইটা দেখে স্বস্তি।

– কি, আরম্ভ করি? … চা? … কুসুম আর এক কাপ –

‘আপনার আগে আমার আর একটি কথা বলা দরকার … ’, ওপরের ঠোঁট নিচের ঠোঁটের ওপর চেপে বসেছে। দরকারি কথা বলার সময় রঞ্জনের ঠোঁট এমনই। চোখদুটিও নিশ্চল। প্রতিটি বাক্যের প্রতিক্রিয়া বুঝে, পরের বাক্য গঠিত হবে। সবাই এমনই করে থাকে, তবে রঞ্জন তা অনায়াসে করে। এইজন্যই সে টিম লিডার।

ভদ্রমহিলা ভুরু ওপরে তুললেন, ‘হুঁ … বলো …’

– আমার সঙ্গে আমার বন্ধু নন্দিনী … নন্দিনী রায়চৌধুরী থাকবে … আমারই কাছাকাছি বয়স … দু-এক বছরের বড়ও হতে পারে …

– ও … লিভ ইন -, ভদ্রমহিলার মুখ দেখে বোঝা শক্ত, ব্যবস্থাটা অপছন্দ কি না।

– এর আগে কয়েকটা বাড়ি দেখেছি … এই কথাটা শোনার পর সবাই গুটিয়ে গেছে … এখন আপনি ভেবে দেখুন … ওকে আমি মাসতুতো কি পিসতুতো বোন বলে চালিয়ে দিতে পারতাম; কিন্তু অকারণে মিথ্যে বললে আমার মাথা ব্যথা করে …

– ঠিক আছে ওর প্রোফাইলটা শুনি … ভদ্রমহিলার ভুরু এখনো অর্ধবৃত্ত।

– শিলিগুড়ি হাকিমপাড়ার মেয়ে, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে বটানিতে এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই দ্য ক্যালকাটা ভ্যানগার্ড কাগজে সাংবাদিকের চাকরি পেয়ে গেছে … সাব-এডিটর … এখন থাকে মদন মিত্র লেনে দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি … উইমেনস হস্টেলে থাকতে পারত কিন্তু আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর ঠিক করেছি একসঙ্গেই থাকব –

– বিয়ে করে নিলেই পারো …

– হুম … এখনো তেমন ভাবিনি … অবশ্য আমি বলতেই পারতাম আমরা বিবাহিত … আজকাল অনেক মেয়েই মাথায় সিঁদুর পরে না … কারো অ্যালার্জি হয় বলে পরে না, কেউ-কেউ পছন্দ করে না বলে পরে না, অবশ্য সিনেমা সিরিয়ালে দেখবেন সব মেয়েই মোটা করে সিঁদুর লেপে দেয় সিঁথিতে … সে যাকগে, বলতেই পারতাম … কিন্তু ওই যে বললাম মাথা ব্যথা –

– মেয়ে কেমন?

– বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে তাও বলতে হয় বুঝি?

– নিশ্চয়ই … তোমায় তো আমি দেখতে পাচ্ছি … আন্দাজ করতে পারছি তুমি মানুষটা কেমন … আরেকটি মানুষ থাকবে তার সম্বন্ধে জানতে হবে না? একটা ডিগ্রি, একটা চাকরি কি মানুষের সব?

শক্ত ঘাঁটি, রঞ্জন মনে-মনে বলল। তবু সেলসের লিডারকে তো  হারলে চলবে না। বোঝাতে হবে। বুঝিয়ে মন জয় করবার আনন্দই আলাদা!

– কেমন? … এই আপনারই মতো …

এইটা রঞ্জনের সেলস ট্রিক। ভদ্রমহিলার আত্মবিশ্বাসকে একটু প্রশংসা করে দেওয়া হলো, অহংকারও মালিশ পেল। ‘হ্যাঁ, আপনারই মতো।’

– এসব ঢলানি কথায় কিছু বোঝা যায় না … যা বলছি সোজা জবাব দাও … কেমন?

আর উপায় নেই। মনে-মনে নন্দিনীকে ধ্যান করল রঞ্জন। এই অভ্যাসটা বাবার থেকে পেয়েছে। জটিল কোনো কেসের ব্রিফ শোনার সময় অ্যাডভোকেট মণীন্দ্র মজুমদার চোখ বন্ধ করে নেন। দেখলে মনে হবে কান তো বটেই সবকটি রোমকূপ দিয়েও তিনি গ্রহণ করছেন ঘটনার রক্তরস। ডিক্টেশন দেওয়ার সময়েও একই অবস্থা। প্রতিটি অক্ষর দেহকোষে নির্মিত হয়ে অকস্মাৎ পাতালঘর থেকে বেরোয়। যেন কোনো আচ্ছন্ন রোগী কথা বলছে – এমনই কণ্ঠস্বর!

রঞ্জনও তেমন – ‘নন্দিনী? ও পাহাড়ের চড়াই ভাঙা শেরপার মতো শান্ত, সুন্দর সহজ। ওর চোখ তেমনই গভীর, বহুদূর দেখতে পায় … আবার একই সঙ্গে ও পুরী সমুদ্রের দমকা, হুটোপাটির অতল জল … তেমনই জলপাই রঙের চামড়া -’

‘ঠিক আছে, বুঝেছি … তোমাকেই, মানে তোমাদেরই দেবো …’ কবিতা দত্ত বণিক মন্দ-মন্দ হাসলেন।

রঞ্জনের আরো কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু তিনি থামিয়ে দিলেন – ‘এবার আমার কথা …’

ভদ্রমহিলা এসে বসলেন ডানদিকের সোফায়। একেবারে প্রামেত্ম। এইবারে ওর চোখে-মুখে বিকেলের আলো। চুলে সোনালি রং লেগে গেল। আঁচলের কাছেও দু-তিনটি সোনার বল নেচে চলেছে। জানালার বাইরে রাস্তার ওপারে ঝাঁকড়া শিরীষ গাছটাকে একঝলক দেখতেই –

‘আমি এখানে একা থাকি মানে এই নয় যে, নষ্টবিয়ে অথবা অবিবাহিত।’

ডিভোর্সের জবরদস্ত বাংলা করেছেন তো ভদ্রমহিলা – নষ্টবিয়ে! মনে-মনে ভাবল রঞ্জন।

‘ও মানে নীলকণ্ঠ বণিক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। একেবারে হিসাব মানা ভদ্র। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। মাথায় চকচকে টাক। হঠাৎ দেখলে মনে হবে চুল কামিয়েছে পরিষ্কার করে। কার্গো শিপে। বছরে দুবার ঘুরে যায়। কখনো একমাস, কখনো পনেরো দিন। এখন সুয়েজে আছে। একটি সমন্তান হয়েছিল, কন্যা, কিন্তু সাত মাসের মাথায় মেনিনজাইটিস -’

– হ্যাঁ ঠিক আছে … বুঝেছি … কারো গলায়-মুখে কান্না চলে এলে হতভম্ব লাগে। বিশেষত, তিনি যদি হন সুন্দরী মহিলা। রঞ্জন তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে … এই ঘর আমার পছন্দ, নন্দিনীরও হবে, তাছাড়া ও আমাকেই ঘর খোঁজার ভার দিয়েছে … আমি হ্যাঁ করে দিলে ও না বলবে না … কবে আসব?’

– এই মাসের তো আর মাত্র পাঁচদিন বাকি, সামনের মাসের এক তারিখ এসো … চাইলে এ কদিনের মধ্যে মালপত্র রেখে যেও …

– তাহলে তো খুব ভালো হয় –

– আচ্ছা এবার ভাড়া –

– তোমাদের কি মাসে ছয় দিতে অসুবিধা হবে?

রঞ্জন চমকে গেল। কী করে ওর মনের কথার নাগাল পেয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা! মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও … মানে ওইরকমই -’

– ও তাই বুঝি … একবার স্থিরচোখে দেখে নিলেন কবিতা দত্ত বণিক, ‘তাহলে ঠিক আছে …’

ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। রঞ্জনের সংকোচ হচ্ছিল, ‘আপনি আবার … আমি ঠিক চলে …’

– তুমি বিকেলের আলো নিয়ে কীসব যেন বলছিলে … জানবে এরকম বিকেলের আলো ঠোঁটে মেখে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না … তুমিও না, আমিও না …

ভদ্রমহিলা সদর বন্ধ করে দিলেন।

 

সেই কবিতা দত্ত বণিক কি আজকের এই ছেলেবউ-ছুট প্রৌঢ়া? যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সময়ের থেকে দ্রম্নত ছুটছেন। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।

– রাত কাটানোর মতো কোনো জায়গায় নিয়ে যাবে বাবা …

কবিতা দেবীর কোনো ছেলে ছিল না। ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর দু-বছর হয়ে গেছে। এর মধ্যে ছেলে হলেও তার বউ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু এই মহিলার সঙ্গে কবিতা দত্ত বণিকের আশ্চর্য মিল। এতটাই, কবিতা দেবীর কপালের কাটা দাগটা খোঁজার চেষ্টা করল রঞ্জন। নাহ্, এই প্রবীণার কপালে কোনো দাগ নেই। তবু মনে হলো, কপালের বলিরেখার মধ্যে লুকিয়ে নেই তো দাগটা।

 

‘স্যার গলদ কিয়া, মাফ কর দিজিয়ে …’

সেই পালিশওয়ালা। চোখ-মুখ একেবারে ফাঁদে পড়া বগা। শরীরের প্রান্তরেখা সব ভেঙে চুরমার। মুখের কুটিলরেখা সব সরল। ওর মুখে বিকেলের আলো!

– চলিয়ে … পালিশ …

এখনো অবধি কেউ আসেনি পালিশ করাতে। অথচ অন্যদিন অনেকে আসে এই সময়। সামনের আকাশছোঁয়া বাড়ির দারোয়ান থলে ভর্তি করে আনে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের ছোট-ছোট জুতো। তাতে কালি-ক্রিম দুই-ই কম লাগে, খাটনিও কম। আজ একটা থলেও আসেনি। ফলে, পালিশওয়ালা ভড়কে গেছে। ভাবছে রঞ্জন নিশ্চয়ই জামা-প্যান্ট পরা কোনো মুনি-ঋষি! অথবা পিরসাহেব।

– চলিয়ে স্যার … তুরন্ত হো জায়গা …

– শুন, এ-মাঈজি রাত কো কঁহা ঠ্যাহরেঙ্গে? জরাসা শোচো … চোখের ইঙ্গিতে দেখাল রঞ্জন।

পালিশওয়ালা বিভ্রান্ত। না, বিভ্রান্ত বললে ঠিক বোঝানো যাবে না। লোকটি পুরো ঘেঁটে গেছে। একবার বিড়বিড় করল, ‘রহনেকা জায়গা …’

পরক্ষণেই রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে উলটোদিকে ছুট।

 

তিন

নন্দিনী বাঁদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ওপরের ঠোঁট নিচের সহোদরাটিকে জড়িয়ে নিবিড়। একেবারে পরিপাটি। মাথার তলায় বালিশ। কোমর অবধি হালকা চাদর। সুখী নিশ্বাসে ভরে আছে সারাটা ঘর। সকালবেলায় এমন দৃশ্য দেখলে পুণ্য হয়। চল্লিশ সেকেন্ড ভালো করে নন্দিনীকে দেখল রঞ্জন। তারপর ওর দিকে এগিয়ে গেল। বাঁহাতে পিঠে চাপড় দিয়ে সুর করে বলল, ‘এই যে নন্দিনী ম্যাডাম উঠে পড়ুন …।’ ডান হাতে ধরা চায়ের কাপটা বিছানার শিয়রের টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল নিজের কাপটা আনতে। দুটো কাপ একসঙ্গে আনতে গেলেই চলকে পড়ে। সে হাতেই আনো বা ট্রে-তে বসিয়েই আনো, চলকাবেই।

কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকেই, যা ভেবেছিল রঞ্জন, নন্দিনী ওঠেনি। কাপটা টেবিলে রেখে আবার ডাকল, ‘এই যে এন আর সি, ওঠো, উঠে পড়ো …’

এই যুগটাই সংকোচনের। সহকর্মীরা নন্দিনী রায়চৌধুরীকে সংক্ষেপে ডাকে এন আর সি। রঞ্জন মজুমদারও তাই আর এম।

এবার আওয়াজ এলো, ‘উঁ … উম … উহ্ … আরেকটু …’

– না না ওঠ … দেরি করে গেলে কচুরি-জিলিপি কিছুই পাবি না …, নন্দিনীর কপালে মাথায় আঙুল বুলিয়ে দিলো রঞ্জন। ডানদিকের গালে আলতো চুমু খেল, ‘উঠে পড় লক্ষ্মী মেয়ে …’

পিঠে হাত রেখে আস্তে-আস্তে ওকে বসিয়ে দিয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো, ‘এই নে, চা খা …’

চোখ খুলল নন্দিনী। কাপে হালকা চুমুক দিলো, ‘বাহ্ …’

রঞ্জনের সকালটা ভরে গেল। ‘ভালো?’

নন্দিনী দুবার মাথা দোলাল, ‘এই একটা কাজ তুই ভালোই পারিস …’

– পারিই তো … তাছাড়া আজ চা দিবস, ভালো করতেই হবে … একেবারে সত্যজিৎ রায়ের বিজ্ঞাপন মেনে চা বানিয়েছি …’

নন্দিনী হাসল। ঘুমজড়ানো হাসি – ‘অমনি একটা বলে দিলি … সত্যজিৎ রায়ের -’

– আরে! সত্যি … ওঁর করা চায়ের বিজ্ঞাপনের অনেক ডিজাইন আছে … এখন যেটার কথা বলছি তা চা বানাবার পদ্ধতি নিয়ে … ফলো দ্য রুল অব ফাইভ টু মেক আ পারফেক্ট কাপ অব টি …

নন্দিনীর চোখ এবার পুরো খুলে গেছে, ‘এত সুন্দর গল্প বলিস যে, বোঝা মুশকিল ঢপ দিচ্ছিস কি না …’

– আচ্ছা তোকে দেখাচ্ছি -, রঞ্জন মোবাইল খুলে বিজ্ঞাপনটি উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু দু-তিন মিনিট চেষ্টার পরেও পাওয়া গেল না। ‘এইখানে সিগন্যালটা ঠিক আসছে না।’

‘হুম … আর আসবেও না’, নন্দিনী দুষ্টু-দুষ্টু হাসল। রঞ্জনের কথা বিশ্বাস করেনি।

– তোকে ঠিক দেখাব … দুজন মহিলা গোলটেবিলে বসে … একজন টি-পট থেকে চা ঢালছেন, অন্যজন, টেবিলে দু-কনুই ভর করে বসে, চা ঢালা দেখছেন … আসলে সেই সময় সেন্ট্রাল টি-বোর্ড চা জনপ্রিয় করতে এমন অনেক বিজ্ঞাপন করেছে … সত্যজিৎ রায়, অন্নদা মুন্সী এরা দুজনেই ডিজাইন করেছেন –

– ও তাই বুঝি … খুঁজে পেলে দেখাস তো … ভালো ফিচার হয়।

‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছ-বছর পরের বিজ্ঞাপনের হেডিং – ‘সুখে ও … দুঃখে চা-ই একমাত্র নির্ভর’ … ওই বিজ্ঞাপনের কপির শেষ লাইন – আজ পৃথিবীকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাওয়ার অভিযানেও চা-ই আপনার সহায় হোক …’, বলতে-বলতে নিজের কাপটাও নাটুকে ভঙ্গিতে এগিয়ে ধরল রঞ্জন।

এইবার নন্দিনী মেনেছে – ‘এইটা জোগাড় কর, লিখব …’

‘হ্যাঁ, লেখ … ভালো হবে … চল এবার উঠে তৈরি হয়ে নে, ঘুরে আসি … আমিও মুখে-চোখে একটু জল দিয়ে নিচ্ছি …’,

 

অন্যদিনের থেকে রোববার এই কারণেই আলাদা যে, একমাত্র এই দিনই চারপাশের গাছগুলোকে ভালো করে লক্ষ করা যায়। যেমন সকালে হেঁটে ফেরার সময় রঞ্জন দেখেছে কাঠবাদাম গাছের পাতায় কত ধুলো জমেছে। এ-অঞ্চলে ধোঁয়াধুলো কম তবু এত ধুলো! মধ্য কলকাতার গাছগুলোর তাহলে কী অবস্থা! তখনই দেখেছে, পেয়ারাগাছের পাতার আড়ালে টিয়াপাখি ঠোঁটের আরামে পেয়ারায় ঠোক্কর দিচ্ছে। বুলবুলি আকারের, কুচকুচে কালো কিন্তু পেটের কিছু অংশ সাদা, সেই অচেনা পাখিটার ছবিও তুলেছে রঞ্জন সকালে।

মোবাইলে তোলা ছবিটা দেখেই নন্দিনী বলল, ‘এটা তো দোয়েল …’

ও  ইতোমধ্যে সালোয়ার-কামিজ পরে তৈরি। রঞ্জন তো রেডি ছিলই। ওরা টু-হুইলার চেপে চলে গেল চিৎপুর। জোড়াসাঁকোর কাছে একটা দোকান খুব প্রিয়। বাইক দাঁড় করিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসতেই দোকানের ছেলেটা বলল, ‘নমস্তে জি … গুড মর্নিং …’

ছেলেটার বাবা থাকলে এসব কিছু বলে না। গম্ভীর মুখে রুটিনমাফিক চারটে করে কচুরি দেয় দুজনকে। সঙ্গে আলুর তরকারি। আলুর পিঠে খোসা লেগে থাকে। কচুরি শেষ হলে চারটে করে জিলিপি। অতগুলো জিলিপি খেতে না চাইলে কোনো কোনো দিন নন্দিনী আগাম বলে দেয় দুটো দেওয়ার জন্য।
কচুরি-জিলিপি খাওয়ার পর ইচ্ছা হলে ওরা সোজা গঙ্গার ঘাটে যায়। অথবা অন্য কোনো দিকে। কখনো এয়ারপোর্ট ধাবায় চলে যায়। কখনো চিড়িয়াখানায়। দক্ষিণেশ্বর-বেলুড়ও ঘুরে এসেছে। একবার তো সোজা কোলাঘাট চলে গিয়েছিল। কদিন আগেই চন্দননগর। রাস্তার ধাবায় খাওয়া সেরেছিল সেবার। মোটমাট বেশি বেলা হয়ে গেলে ওরা খেয়েই ফেরে। কোনো-কোনো রোববার এরই মধ্যে সিনেমা দেখতেও ঢুকে পড়ে। কখনো-সখনো নাটকও। আজকাল জেলার নাটক খুব উন্নতি করেছে। কল্যাণী আর বালুরঘাটের
দলদুটি তো দারুণ।

নন্দিনী চারটে জিলিপিই খেল। চায়ে প্রথম চুমুকটা দিতেই যেন মনে পড়ে গেল – ‘এই আর এম শোন, চল আমরা গড়ের মাঠে যাই, একটু গড়াগড়ি খেয়ে যাব বিধান সরণির সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে … একটা অনুষ্ঠান আছে … গান হবে … কিছুক্ষণ শুনে খেতে যাব … আজ চাইনিজ খেতে ইচ্ছে … নতুন কোনো জায়গা ভেবে নে -’

নন্দিনী বাঁধা গৎৎর বাইরে চলতে ভালোবাসে। এইজন্যেই তো ওকে এত ভালো লাগে। ওর কথা শেষ হতে-না-হতেই রঞ্জন বলল, ‘ভাবতে হবে না, যাব এলিয়ট রোড … এক চীনা পরিবার তাদের বাড়িতে খাওয়ায় … এটা কোনো দোকান নয় … চাউ মিয়েনটা ফাটাফাটি …’

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে-হতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। ফেরার সময়, নন্দিনী মনে করে কবিতা দত্ত বণিকের জন্য এক প্যাকেট চাউ মিয়েন নিয়ে নিল। ওর সঙ্গে ভদ্রমহিলার খুব ভাব। রঞ্জন একটু দূরত্ব রাখে। নন্দিনীর মতো মাসিমা-ফাসিমা ডাকতে পারে না। বলে, ম্যাডাম বা মিসেস বণিক।

বাড়ি ফিরতে সোয়া পাঁচটা। তারপর একটু গড়িয়ে নিল দুজনেই। রাত্তিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করল না কারোরই। রঞ্জন বলল, ‘এন আর সি চল বিরিয়ানি খেয়ে আসি …’

নন্দিনী নাক কোঁচকালো, ‘ইচ্ছে করছে না রে …’

– কেন? পেট ভার? আমার তো কখন সব হজম …

– না ঠিক ভার নয়, তবে বিরিয়ানি খাবার মতো চনমনেও নয়।

– তাহলে মাংসের ঝোল-রুটি?

নন্দিনীর চোখ চকচক করে উঠল, ‘কোথায় পাবি?’

– আছে, আছে জায়গা আছে … তুই থাক, আমি নিয়ে আসছি …

‘ওলে ওলে কী ভালো ছেলে’, নন্দিনী চুমু ছুড়ে দিলো।

রাত্তিরেও জমিয়ে খাওয়া। খাওয়ার পরে বাসন ধোয়া, রান্নাঘরের টুকিটাকি গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব নন্দিনীর। ঘরদুটিতে বিছানা করা, মশারি খাটাবার কাজ রঞ্জনের। কখনো-কখনো একটা ঘরেই বিছানা হয়। মশারিও। তবে তা সাধারণত শনিবার। তখন একটা খাট পুরো লাগে না, অর্ধেক খাটেই দুজনে ধরে যায়। খাটের কোনায়, ঘরের দেয়ালে ওদের পূর্ণস্বর, অর্ধস্বর, চন্দ্রবিন্দু সব ধাক্কা খেতে-খেতে নেচে বেড়ায়। বাতাসের প্রতিটি অণু-পরমাণু আনন্দ নামের বায়বীয় বস্ত্তর ঔরসে অমত্মঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এই সময়েই রঞ্জনের মনে হয়, সে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট ঘুরে আসতে পারে। নন্দিনীর মনে হয়, উত্তরবঙ্গের চা-বাগান শ্রমিক আর নারী পাচার চক্র নিয়ে একটা বড় বই লিখে ফেলা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়।

রঞ্জন বলল, ‘গুড নাইট।’ ওর হাতে শহীদুল জহিরের নির্বাচিত উপন্যাস।

রাত্তিরে ওদের দুজনেরই অভ্যাস বই পড়া। পড়তে-পড়তে ঘুমোনো।

নন্দিনী হাসল, ‘তাই? গুড নাইট? চা খাবি না?’

এর মানে যে চা খাওয়া নয় রঞ্জন ভালোই জানে। ও হাসল – ‘এই চা-টাও আমি ভালোই বানাতে পারি, কী বল?’ তারপর দুটো ঘরই অন্ধকার।

ওদের রোববার এমনই নিয়মছাড়া কাটে। এই একটা দিনকে ওরা তারিয়ে-তারিয়ে, চেঁচে-পুঁছে উপভোগ করতে চায়। প্রতি রোববারে নতুন মজা।

সোম থেকে শনি ওদের দেখলে বোঝাই যাবে না, এত আনন্দ পাবার ক্ষমতা দুজনের।

সকালে হাঁটার সময়েই রঞ্জনের মাথায় ঘুরতে থাকে রিটেল আউটলেটের চেহারা। যে-দোকানগুলোর বিক্রি কমছে তার নামগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। সাহু ট্রেডিং, শম্পা ইলেকট্রনিকস – দুটোই সুজয়ের এরিয়া; বিধান মোবাইল সার্ভিস, মৃদুলের; গণপতি সেলস আর মোবাইল সলুশনস অনন্য। অফিসে গিয়েই সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। রঞ্জনের হাঁটার গতি বেড়ে যায়।

ঘরে ফিরেই দ্রম্নত চা বানিয়ে নন্দিনীকে ডাকে। এক ডাকেই উঠে পড়ে মেয়েটা। হুস-হুস করে চা শেষ করে ঘর-লাগোয়া টয়লেটে ঢুকে পড়ে। রঞ্জনও তিন চুমুকে চা শেষ করে ভ্যানগার্ডের পাতা উলটে নেয়। নন্দিনীর কোনো লেখা বের হলে ওপর-ওপর চোখ বোলায় একবার। রাত্তিরে ভালো করে পড়বে বলে সরিয়ে রাখে।

নন্দিনী হাঁক দেয়, ‘ব্রেকফাস্ট …’

খাবার টেবিলে দুধ-কর্নফ্লেক্স, কলা, ডিমসেদ্ধ। মাখন পাউরুটি। টেবিলের কোনায় বড় পাত্রে কলা, আপেল, নাশপাতি রাখা থাকে। ওরা দুজনেই জেলা থেকে এসেছে বলে ফল খেতে ভালোবাসে। শহরের ছেলেমেয়েরা তেমন একটা ফল খায় না আজকাল।

খেয়েই তৈরি হয়ে নেয় রঞ্জন। যেদিন সকাল-সকাল যাওয়ার থাকে নন্দিনীর, রঞ্জন ওকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যায়। সোমবার যেতেই হয়। কারণ ওইদিন ফিচার নিয়ে আলোচনা হয় এডিট মিটিংয়ে। মিটিং শুরু হয় তাড়াতাড়ি। অন্যদিন সাড়ে এগারোটা-বারোটাতেও অফিস গেলে চলে। যাওয়ার আগে বাড়িতে বসেই ল্যাপটপ ঘেঁটে প্রস্ত্ততি নিয়ে নেয়। দেশ-বিদেশের ই-পেপারগুলো পড়ে।

অফিসে গিয়েই রঞ্জন টিমকে নিয়ে বসে। দুর্বলতাগুলো ধরে – দেখ আমাদের প্রোডাক্ট হলো সার্ভিস … আমরা মোবাইল যন্ত্রটা বেচছি না, বিক্রি করছি কানেকশন … আজকাল সবাই দাম কমাতে-কমাতে এমন জায়গায় গেছে যে, সবারই অফার হরেদরে এক … আমাদের সেলস বাড়াতে গেলে কাস্টমারদের বুঝতে হবে … রিটেলগুলোকে বোঝাতে হবে প্রোডাক্ট ভালো করে বোঝাও … মিথ্যে আশ্বাস দিও না … আর লোকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো … যারা করপোরেট অ্যাকাউন্ট দেখছ, তাদের দায়িত্ব নিয়মিত কোম্পানিগুলো ভিজিট করা … সে তোমায় ডাকুক বা না ডাকুক তবু ঘুরে আসতে হবে … এভাবেই রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে …

এরপরে দলবল রাস্তায় নামে। রঞ্জনও যায়, তবে আগে থেকে টিমকে জানায় না কোথায় যাবে। সবাই সতর্ক থাকে এজন্য।

যেদিন বেলা করে বেরোয় নন্দিনী, কাজের মাসির সঙ্গে দেখা হয়। কী-কী রান্না হবে বলে যায়। অন্যদিন মাসি নিজের মতো বাজার করে এনে রান্না করে, ঘর মুছে, থালাবাসন ধুয়ে, ফ্রিজিডিয়ারে খাবার ভরে রেখে যায়। চাবি রাখা থাকে দোতলার মাসিমার কাছে। অবশ্য চাবিওয়ালাকে দিয়ে আরো একজোড়া চাবি করানো হয়েছে। যার একটা নন্দিনীর ব্যাগে, অন্যটা রঞ্জনের পকেটে। রাত্তির করে ফিরলে মাসিমাকে আর বিরক্ত করতে হয় না।

 

কোনো-কোনো দিন অবশ্য সবকিছু এমন মসৃণ ঘটে না। একটু খরখরে হয়ে যায়।

রাত্তিরে ফিরতেই নন্দিনী বলল, ‘নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখবি … ’

রঞ্জন তাকিয়ে রইল।

– কতবার বলেছি চান করবার পর তোয়ালে শুকোতে দিয়ে যাবি, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখবি … তা না, বিছানায় ভেজা তোয়ালে, ঘরের কোণে নোংরা জাঙিয়া লটপট করছে …

রঞ্জনেরও দিনটা ভালো যায়নি। বিকেলবেলায় ন্যাশনাল সেলস হেড মুম্বাই থেকে ফোন করে ঝাড় দিয়েছে, আরো ভালো করতে হবে পারফরম্যান্স। মাথাটা গরমই ছিল, তবু শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘একদিন হয়ে গেছে … এমন করছিস -’

‘একদিন? একদিন?’ দুবার দুরকম ঝোঁক দিয়ে উচ্চারণ করল নন্দিনী।

– অন্তত দু-তিন মাস এই চালাচ্ছিস … আমি কিছু বলি না বলে –

এবার রঞ্জনও খেপে গেল, ‘তোকে তুলতে হবে না, আমারটা আমি বুঝে নেব …’

‘কী বললি!’ নন্দিনীর চোখমুখ লাল, ‘এখন তো বলবিই … প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে তোর রোয়াব বেড়ে গেছে … যা-যা ওইসব মস্তানি অফিসের জুনিয়রদের দেখাস … গাড়ি কেনার পর থেকে ভাবছিস কী একটা হলাম … আরে ওইরকম গাড়ি কলকাতায় হাজার একটা লোক রোজ কিনছে …’

প্রমোশনের কথা তুলে খোঁটা দিচ্ছে! একবারও ভাবল না, গাড়িটা যেদিন কিনেছে, ওকে নিয়ে কতটা চক্কর মেরেছে সেদিন। কী সব কথা – রোয়াব বেড়ে গেছে! টু-হুইলারটা বিক্রি করে পেল তিরিশ হাজার। নন্দিনীর কুড়ি ছিল। দুটো যোগ করে যা হলো তাই দিয়ে নন্দিনীর জন্য কেনা হলো স্কুটি। এইগুলো কেমন বেমালুম ভুলে গেল! অহংকার আমার হয়নি, হয়েছে তোর। এসব কথা মনে-মনে বলল রঞ্জন।

মুখ দিয়ে ছিটকে বের হলো – ‘তুইও তো বেড়ে গেছিস প্রেস ক্লাবের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে ঢোকার পর থেকে … এখানে যাচ্ছিস ওখানে যাচ্ছিস … টিভিতে মুখ দেখাচ্ছিস … সব ব্যাপারে প–ত … এখন আবার দিল্লিতে উইমেন্স প্রেস ক্লাবের মেম্বার হওয়ার চেষ্টা … ভাবছিস কী হলাম -’

বলেই খারাপ লাগল। রাগ ব্যাপারটা আদতে নিজেকেই পোড়ায়। নন্দিনী তেড়েফুঁড়ে আরো অনেক কিছু বলছিল। কানে না তুলে, চুপচাপ জামাকাপড় বদলিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল রঞ্জন। ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ যেন ডাকছে – ‘খাবি আয়।’ কিন্তু ওই পর্যন্তই। চোখে আবার ঘুম এসে গেল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল নন্দিনী চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে, ‘গুড মর্নিং …’ ওর ঠোঁটে গরম চায়ের ধোঁয়া ওঠা হাসি। গতরাতের কষাকষির কোনো লেশ নেই কোথাও। তখন এভাবেই তো মিটে যেত সব।

একদিন কোনো কারণে কাজের মাসি আসেনি। নন্দিনী বাড়ি ফিরে, ফোন করে বলেছিল রাতের খাবার নিয়ে আসার কথা – ‘বাড়িতে কিচ্ছু নেই, চাইনিজ, তড়কা-রুটি যা পাবি নিয়ে আসবি।’

সেদিন রঞ্জনেরও কাজের চাপ। এ-কাজে-ও-কাজে খাবারের কথা বেমালুম ভুলে গেল। বাড়ি ঢুকতে-ঢুকতে সাড়ে দশটা।

– কী রে, কী আনলি?

– কী আনব বল তো?

নন্দিনী শান্ত চোখে তাকিয়ে। তখনই মনে পড়ল, ‘এ হে একদম ভুলে গেছি … এই রে এখন কী হবে …’

এবার নন্দিনী গম্ভীর। ‘কোনো দায়িত্ববোধ নেই তোর … আজকাল আর ভরসা করা যায় না তোকে …’

ধাক্কা খাবার মতো কথা এবং এর কোনো জবাব হয় না। মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে গেল রঞ্জন। কী করে যে ভুলে গেল সব! আজকাল কেন যে এমন ভুল হচ্ছে! অথচ আজকে একটা দেওয়ার মতো খবর রঞ্জনের পকেটে। টুইটার মোবাইলের অফার লেটারটা আজই পাওয়া গেছে। জোনাল হেড, মাইনেও সব মিলিয়ে প্রায় থার্টি পারসেন্ট বাড়বে। ভেবেছিল ঘটা করে, নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করবে খবরটা, বলবে – এবার আমরা বিয়ে করতে পারি; কিন্তু সব ঘুলিয়ে গেল।

‘খেতে আসা হোক …’, নন্দিনীর গলা। গম্ভীর ভাব কাটেনি।

খাবার টেবিলে গিয়ে রঞ্জন অবাক। পেস্নটে সাজানো আট-দশটা স্যান্ডউইচ! দুজনের পক্ষে যথেষ্ট।

এক কামড় দিয়েই বোঝা গেল টুনা স্যান্ডউইচ। ‘তুই বানালি?’

– ভেবেছিলাম রোববার ব্রেকফাস্ট করব, এক কৌটো টুনা আজই কিনেছিলাম … তোর অপূর্ব মেমারির জন্য আজই খুলে ফেলতে হলো …

রঞ্জন উচ্ছ্বসিত, ‘সত্যি দারুণ বানিয়েছিস … তুই আমার দুর্ভিক্ষের ধর্মগোলা …’

– কী বললি? ধ … ধ … ধর্মগোলা? … হা-হা, ফুসফুস খালি করে হেসে উঠল নন্দিনী।

– হ্যাঁ …, অপ্রস্ত্তত মুখে, মৃদু গলায় দু-তিনবার ধর্মগোলা উচ্চারণ করল রঞ্জন।

 

– কী ধর্ম-ধর্ম বিড়বিড় করছ বল তো?

ওই কবিতা দত্ত বণিক-মার্কা মুখের ভদ্রমহিলা আশ্চর্যরকমের শান্ত। ‘যদি আমায় রাখলে তোমার কোনো অধর্ম হয়, রেখো না … না হয় থানাতেই জমা করে দাও আমায় …।’ যেন থানাতে জমা করলেই ওর সব সমস্যার সমাধান।

– না-না আমি অন্য কথা ভাবছিলাম … আপনি অত উতলা হবেন না, কোথাও না হলে আমি যেখানে থাকি, নিয়ে যাব …

ভদ্রমহিলাকে নিয়ে অত কিছু ভাববার নেই। অন্য সমস্যা রঞ্জনের। এই তিনটে ঝুরি নামান বটগাছের তলায় সে যে
দাঁড়িয়ে আছে, তা ঠিক। সামনে দিয়ে বাস-ট্রাম-অটো-ট্যাক্সি এবং জনতা যে নিজের নিয়মে চলে যাচ্ছে, তাও ঠিক। ওর গাড়িটা যে সুইস পার্ক নার্সিংহোমের সামনে রাখা, বেশ মনে আছে। কিন্তু এখন যে কী করার, মাথায় আসছে না। অথচ, কিছু একটা কাজ  নিশ্চয় আছে।

চার

এই রাস্তায় বাড়িঘর প্রায় নেই। দোকানঘর রয়েছে কিছু। কিন্তু তাদের মধ্যে ব্যবধান অনেক। মসৃণ রাস্তা এক দৌড়ে সোজা একশ মিটার দূরের দেবদারু গাছটাকে ছুঁয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে উধাও। বাঁকের মুখ থেকেই বিকেলের আলো নেবাতে-নেবাতে এগিয়ে আসছে সন্ধে।

এতক্ষণে রঞ্জনের খেয়াল হলো, এ তো সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ নয়। তবে এ কোথায় এসে গেল? চট করে বোঝা গেল না, কোন অঞ্চল। উলটোদিকে পান-সিগারেটের দোকান। আলো জ্বলছে। সাধারণত, পানের দোকানে সাইনবোর্ড থাকে না। কিন্তু এ-দোকানে আছে – দিলীপ’স পান শপ। বোর্ডের তলায় সিগারেট কোম্পানির নাম। এই ধরনের ভিনাইল বোর্ড ওরাই বানিয়ে দেয়। ভেতরে লাইট থাকে। রাত্তিরে বেশ ঝলমল করে। দোকানে কোলড ড্রিংকস আছে। বোতলে ভরা শুদ্ধ জলও! কিন্তু সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম লেখা নেই। রাস্তার বাঁদিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, দু-দিক ভালো করে দেখে তবে রাস্তা পেরোতে হবে। সন্ধের মুখে আচমকা মোটরবাইক এসে পড়লে চাপ আছে।

দোকানের সামনে যেতেই লোকটি ভুরু তুলল,‘হ্যাঁ বলুন?’

– কোলড ড্রিংকস …

একগাদা নাম বলে গেল দোকানদার।

– অরেঞ্জ কি লেমন, যে কোনো একটা … ঠান্ডা নয় কিন্তু …

চোঁ-চোঁ অর্ধেক বোতল শেষ করে ফেলল রঞ্জন। তারপর বোতলটা খালি বোতলের ট্রেতে রেখে খুব কায়দা করে একটা সিগারেট ধরাল। প্রথম ধোঁয়াটা ছেড়েই – ‘এই রাস্তাটা কতদূর …’

– সোজা বাসমত্মী … যাবেন নাকি? সোজা চলে যান …

অর্থাৎ রঞ্জন আমির আলি অ্যাভিনিউর বদলে এসে গেছে বাসমত্মী হাইওয়ে! এই নিয়ে পঞ্চমবার হলো।

কী যে হচ্ছে! মাস তিনেক হলো এই ব্যারাম শুরু হয়েছে। প্রথমবার তো যাবার কথা ছিল বাগবাজার, চলে গেল চিড়িয়ামোড়। তখন ভেবেছিল, অন্যমনস্ক থাকায় বাগবাজার পেরিয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার তো যাবার কথা ছিল ভবানীপুর, কী করে বারাসাত চলে গেল! তৃতীয়বার – রাজাবাজার যেতে মৌলালি! তারপর, সেলস কনফারেন্সে বাংলাদেশে গিয়ে তো কেলেংকারি। তিনদিনের মিটিং, মাঝে একদিন ছুটি। শুক্রবার। ভেবেছিল দুপুরবেলায় যাবে নাজিরাবাজার – হাজির বিরিয়ানি খেতে। কিন্তু, আশ্চর্য, ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারকে বলবার সময় মুখ দিয়ে বেরুল – ‘মুন্সীগঞ্জ …’ কেন হলো? ওর মাথায় কী ঘুরছিল – ‘হাট বসেছে শুক্রবারে, মুন্সীগঞ্জে পদ্মাপারে।’ তবে আনমনে গিয়ে পড়লেও, সেবার আশ মিটিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়া গিয়েছিল। ইলিশের ডিমও। শুধু মাছভাত। অপূর্ব খাওয়া।

তিন বছর আগের ঘটনা হলেও এখনো পদ্মাপারের দোকানটির নাম মনে আছে। বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এখনো স্পষ্ট – আল মদিনা হোটেল, সাইনবোর্ডের মাথায় ছোট অক্ষরে লেখা, বিসমিলস্নাহির রাহমানির রাহিম। নিচে ঠিকানা – রাণীগাঁও, শিমুলিয়া পরিবহন টার্মিনাল, ভিআইপি ফেরিঘাট, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ। ‘… ভাত ১ পেস্নট ১৫ টাকা … মুরগ পোলাও ১ পেস্নট ১৫০ টাকা … ইলিশ ভর্তা ১ পিছ্ ৩০ টাকা, ইলিশ মাছ ভাজা ১ পিছ্ ৮০/ ১২০ টাকা, ইলিশ ডিম ১ পিছ্ ১০০/ ১৫০/ ২০০ টাকা, সরিষা ইলিশ ১ পিছ্ ১০০ টাকা … নদীর পাংগাস ১ পিছ্ ২২০ টাকা, চাষের পাংগাস ১ পিছ্ ৭০ টাকা …’ পাঙাশের দাম মনে আসতে সেদিন যে উপমা ভেবেছিল, আজো তাই মনে এলো – নদীর পাঙাশ হলো জাত সেলসম্যান আর চাষের মাছ হলো গুঁতিয়ে-ককিয়ে জাতে তোলা বেচুবাবু! এইজন্যেই জাত সেলসম্যানের দাম চাষের ফলনের থেকে তিনগুণ বেশি।

আগের ঘটনা ঠিকঠিক মনে পড়লেও আবার কী করে রাস্তা ভুল হলো! বাসমত্মী হাইওয়েতে সন্ধে নেমে গেছে। দ্রম্নত সিগারেটের  শেষটান দিয়ে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সোজা নিউ টাউন।

ল্যাপটপে টাইপ করতে-করতে নন্দিনী বলল, ‘আজকাল নিশ্চয় অন্যমনস্ক থাকছিস … এতো ভাববার কিছু নেই … ইচ্ছে হলে একটা মেডিসিনের কোনো ডাক্তার দেখিয়ে নে … অনেক সময় লিভারে প্রবলেম থেকে মেমারি গ-গোল হয় …’

নন্দিনী তেমন কিছু পাত্তা দিলো না। রঞ্জনের খারাপ লাগল। ওর উচিত ছিল ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা। এক আধবার তো নয়, পাঁচ-পাঁচবার এমন হলো। হ্যাঁ এ-কথা ঠিক যে, কাজের চাপে আজকাল রঞ্জন হঠাৎ-হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে পাঁচবার!

তবু নন্দিনীর কথামতো মেডিসিনের ডাক্তার দেখান হলো। হাজার রকম পরীক্ষা! অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া গেল না। লিভার তো একেবারে চাঙ্গা। ডাক্তার বললেন, ‘একমাত্র ওষুধ সতর্ক থাকা …’

আবার একদিন ভুল। যাবার কথা লেকটাউন, চলে গেল লেক গার্ডেনস!

রঞ্জন সতর্ক ছিল। বেরোবার সময় কতবার যে মনে-মনে লেকটাউন-লেকটাউন বলেছে তার ঠিক নেই। তা হলে কী করে হলো এমন? ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল পার্ক স্ট্রিট থেকে পরমা আইল্যান্ড অবধি ঠিক গিয়েছিল, তারপর বাঁদিকের জায়গায় ডানদিক ঘুরে সোজা চলে এসেছে লেক গার্ডেনস। ভাবতে গিয়ে এও মনে হলো, যখন কোনো চেনা জায়গায় যাওয়া হয়, ভেতরের কেউ তো গুগল ম্যাপের মতো রাস্তা দেখায় – এইবার বাঁদিক নাও, দুশো মিটার সোজা গিয়ে ডান দিক …

এমন তো নয় রঞ্জনের খুলির মধ্যের ওই চালকটি গ-গোল করছে? সে-ই সব দিক-দিশা সব ঘেঁটে দিচ্ছে?

 

কদিন সতর্ক থাকতেই ধরে ফেলল রঞ্জন। যাবার কথা ছিল পার্ক সার্কাস। কিন্তু কেউ যেন অনবরত ওর কানের কাছে ফিসফিস করছে। সোজা-সোজা। একশ মিটার গিয়ে বাঁয়ে। ওইদিকে গেলে তো ধর্মতলায় চলে যাবে! রাস্তায় বেরোলেই ফিসফিসানি বাড়ে। কেউ যেন ওকে চালাচ্ছে!

এইবার নন্দিনী বুঝল। সব শুনে রঞ্জনকে আপাদমস্তক দেখে নিল। মাথা নাড়ল দু-বার। কাকে যেন ফোন করল। তারপর আবার মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক হয়ে গেছে, পরশু তোকে নিয়ে যাব -’

 

নেমপেস্নট দেখেই বোঝা গেল ডাক্তার দেবব্রত সাহা মনোরোগের চিকিৎসক। তার কী মনের অসুখ হয়েছে না কী! খুব রাগ হলো নন্দিনীর ওপর – সাংবাদিকদের নিয়ে এই এক সমস্যা, নিজেদের সবজামন্তা ভাবে, সবকিছুর হিসাব দিয়ে দেবে। আর কোনো কিছু হিসাবে না মিললেই সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম।

– ‘এখানে আনলি কেন? আমার কী …’

ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে চুপ করতে বলল নন্দিনী, ‘একটু ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে …’

একটা ছেলে, বছর চবিবশ-পঁচিশ, ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে বেরোতেই ওদের ডাক পড়ল। ডাক্তার ভদ্রলোক পেঁপে সেদ্ধর মতো ফর্সা, বেঁটেখাটো, গোলগাল। নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘বুঝলেন, হেঁচকি ওঠা থামালাম।’ এমনভাবে কথাটা বললেন, যেন এই কাজের জন্য ওর নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত।

 

গল্পটা এইরকম – যে-ছেলেটা নন্দিনীরা ঢোকবার আগেই ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, মোহাম্মদ ইয়াসিন, বাংলাদেশের পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা। গত কয়েকমাস ধরে তার লাগাতার হেঁচকি উঠছিল – মিনিটে ষাট-সত্তরবার। সকলে স্নায়ুরোগ ভেবে চিকিৎসা করছিল বলে কাজ হচ্ছিল না। এটা একশভাগ মানসিক সমস্যা। ডাক্তার সাহা ওকে সারিয়ে তুলেছেন।

– তিনমাসের জন্য ভর্তি হওয়ার কথা বলি। আগের সব ওষুধ বন্ধ করে সাতদিন পর নতুন ওষুধ চালু করি। বোঝাতে থাকি হেঁচকির সঙ্গে শরীরের কোনো সম্পর্ক নেই। আড়াই মাসের মতো চিকিৎসা হয়েছে। এখন নববইভাগ সেরে গেছে। শুধু দুপুরে আর রাতে খাওয়ার সময় হেঁচকি ওঠে। ওইটাও আস্তে-আস্তে চলে যাবে …

ডাক্তার বললেও তার সমস্যা যে মানসিক, কিছুতেই মানতে পারছিল না রঞ্জন। নন্দিনীর উচিত ছিল আরো মন দিয়ে সমস্যাটা বোঝা। তা না করে ও একটা সহজ রাস্তা বেছে নিল – মনের ডাক্তার। ফুঃ!

ওষুধ খেলে ঘুম পায় খুব। সজাগভাব নষ্ট হয়। এইভাবে সেলসের কাজ করা যায় নাকি! ওষুধ বন্ধ করে ভেতরে-ভেতরে সজাগ হতে শুরু করল রঞ্জন। তাছাড়া মনের কোন অংশ থেকে যে ভুলভাল ফিসফিসানি আসছে তাও তো সজাগ থেকে ধরা দরকার। সেইদিনই ঠিক করেছিল, নন্দিনী নয়, ডাক্তার সাহা নয়, সে নিজেই নিজেকে ঠিক করবে।

 

‘রহনে কা জা’গা মিল গয়া সাব …’ সেই পালিশওয়ালা। মুখের পেশিগুলি পর্যন্ত আনন্দে নাচানাচি করছে!

এতক্ষণে রঞ্জনের খেয়াল হলো, লোকটার নামটাই তো জানা হয়নি।

– আরে তু নে কামাল কর দিয়া … তেরা নাম কেয়া?

– লছমন দোসাদ …

‘তুমি আমার নামও জিজ্ঞেস করনি …’, মুখ ঘোরাতেই ভদ্রমহিলা। বটগাছের ঝুরির তলায়। মুখে বিকেলের আলো। ‘আমার নাম সুহাসিনী … সুহাসিনী হালদার …’, প্রৌঢ়ার গলায় কৌতুক, ‘দেখেছ, তুমিই চিমন্তা করছিলে … কেমন ব্যবস্থা হয়ে গেল …’

রঞ্জন গ্রাহ্য করল না। মনে-মনে গুছিয়ে নিল সব। সুহাসিনী হালদার বলছেন, তার ছেলে-বউ এই বাসস্টপের শেডের চেয়ারে তাকে বসিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে, কাছেপিঠেই কোথাও। বলেছে তারপরে নিয়ে যাবে।

– আচ্ছা আপনার মনে হচ্ছে কেন, ছেলে আর আসবে না?

– কাগজে মাঝে-মাঝে খবর বেরোয় দেখো না, ছেলে হাওড়া স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে কিংবা মেয়ে মা’র সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার পর দুর্গাপুর কিংবা আসানসোলের কোনো থানার সামনে ফেলে চম্পট …

এমনভাবে বললেন ভদ্রমহিলা, এসব যেন রোজকারের ঘটনা। উনি স্বাভাবিক গলায় বললেও রঞ্জনের অস্বস্তি হচ্ছিল। সে কোনোরকমে বলল, ‘আপনার ছেলের ভুলে যাওয়ার অসুখ নেই তো?’

‘না না ছেলে মাকে ছেড়ে পালাতে পারে, ভুলবে কেমন করে?’, সপ্রতিভ, শান্ত মুখ। যেন পিথাগোরাসের থিয়রেম বলছেন!

 

 

পাঁচ

ক্লাবটার নাম বর্ষা স্মৃতি সংঘ। বৈশাখী স্মৃতি সংঘ হয়, হৈমমত্মী সংঘও দেখা যায়। শরৎ স্মৃতি, ফাল্গুনী ক্লাব তো জলভাত – বোধহয় পাড়ায়-পাড়ায় একটা করে আছে। দেখা যেত না বর্ষা আর শীত। বর্ষা স্মৃতি তো পাওয়া গেল। কলকাতার জলবায়ুর যা অবস্থা, খুব তাড়াতাড়ি শীত স্মৃতি সংঘও দেখতে পাওয়া যাবে।

ছিটের বেড়া কিংবা দর্মার নয় একেবারে ইট, কাঠ, সিমেন্টের ক্লাব। স্থাপিত ১৯৪৮। সদ্য চুনের প্রলেপ লেগেছে। ভেতরের হলঘরের ছবিটা এইরকম – পশ্চিম দেয়ালে এলইডি টিভি সাঁটান। এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। দু-ফুট ওপরে ঘড়ি। উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে স্টিল আলমারি। পাশের শোকেসে একঝাঁক ফলক, যাকে ছেলেরা মেমেন্টো বলে থাকে। পূর্বদিকে ক্লাবে ঢোকার দরজা। দক্ষিণ দিকে লাগোয়া আর একটা ঘর আছে। যার পাশেই ‘টয়লেট’। আশপাশে যে-হারে একতলা-দোতলা ভাঙা পড়ে আকাশছোঁয়া উঠছে, অচিরেই এই পুকুরপাড়ের ক্লাবের দম আটকে যাবে। তবু, তা মেনে নিয়েও, পাড়ার কোনো ডাকাবুকো ছেলে হয়তো প্রোমোটরকে ধরে-করে ক্লাবের চেহারার বদল ঘটিয়েছে। অবশ্য পাড়ার এই জাতীয় ক্লাব এখন সরকারের থেকে খোরপোশ পায়।

হলঘরের ঠিক মাঝখানে লাল পস্নাস্টিকের চেয়ারে বসে সুহাসিনী হালদার। তাকে ঘিরে বসে পাঁচজন উঠতি ছেলে। তিনজনের ছেঁড়া জিনস, দুজনের কালো ট্রাউজার্স। আর লাল শাড়ি কালো পাড় শ্যামলা যুবতী। ওর মুখ তেল-চকচকে। অবশ্য তেল না হয়ে  ক্রিম-চকচকে বলাটাই নিরাপদ। কারণ, তেল হলে আরো বেশি চকচক করত। এদের পেছনে দাঁড়িয়ে লছমন।

বিরাট কোহলি ব্যাট চালাতেই পাঁচটি ছেলেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করল, ‘ছক্কা …’ লছমনের দিকে ফিরে একজন বলল, ‘এই লাফা …।’ লছমনও গুনে-গুনে ছবার লাফ মারল।

লাল শাড়ি চিৎকার করল, ‘ওই দ্যাখ অনুষ্কার মুখে কী হাসি …’

সুহাসিনীও হাততালি দিলেন – ‘হাসবেই তো, বিয়ে করবার পর বরের তেজ বেড়ে গেছে, হাসবে না?’

এরপরেই বিজ্ঞাপন বিরতি।

সেই ফাঁকে একজন জিনস বলল, ‘মাসিমা, আপনি শুধু আজকের রাত নয়, এখন যে ক’দিন খেলা চলবে, এখানেই থেকে যান … আপনি থাকলেই বিরাট ছক্কা মারছে …’

সুহাসিনীর শরীর নড়ল। চোখ বড়-বড়। পাতলা ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ছোঁয়া। রাজি কিনা বোঝা গেল না। নিশ্চিত করবার জন্য কালো ট্রাউজার্স মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ মাসিমা, থাকতেই হবে … কোনো প্রবলেম নেই, থাকবার ঘরও আছে …’, দক্ষিণের ঘরটি দেখাল কালো ট্রাউজার্স। ‘ইন্ডিয়াকে জেতাতে হবে তো … তাছাড়া, পরের সপ্তাহেই ময়দানে আমাদের মিটিং। হুইল চেয়ারে বসিয়ে আপনাকে নিয়ে যাব … সব ক’টা টিভি চ্যানেলে আপনার ছবি দেখাবে … পুরো জমে ক্ষীর …’

‘কী যে সব হাতিঘোড়া বলিস! আমার মতো বুড়িকে দেখাবে! ধ্যাৎ …’ মুখে এমন বললেও বেশ বোঝা যায় মনে-মনে খুশি হয়েছেন ভদ্রমহিলা।

কালো ট্রাউজার্স সেটা লক্ষ করল – ‘আরে মাসিমা, পাকা চুল তো কী হয়েছে? আজকাল কত ইয়ং মেয়ের পাকা চুল থাকে … সব সেলুনে গিয়ে রং করায় …’

সুহাসিনী মাথা নাড়লেন – ‘ওইসব বুঝি না, আমার কথা হলো, যার নাম ভাজা চাল তার নাম মুড়ি, যার মাথায় পাকা চুল তারই নাম বুড়ি …’

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই যে ঢুকল, তাকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল – ‘এই তো চিকুদা -’

পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। মাথায় পুরো টাক। কিন্তু বয়স বেশি নয়। পঞ্চাশে হেলান দিয়ে থাকা চল্লিশ হবে। অথবা পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেললেও অনায়াসে একে আটচল্লিশ বলে চালান যায়। মুখে চর্বি লেগেছে। এইজন্যই ছোট চোখ আরো কুতকুতে দেখায়। নেতার মতো চেহারা নয় কিন্তু তবু সবাই একে কেন চিকুদা-চিকুদা করে দাঁড়িয়ে উঠল, প্রথম ধাক্কায় বোঝা গেল না।

চিকুদা হেসে দু-হাত তুললেন। যেন বরাভয় দিচ্ছেন। ‘তারপর … চিয়ার্স বন্ধুগণ … কী হচ্ছে?’ গলার আওয়াজ ইচ্ছে করেই খাদে নামানো। নেতাদের এমন করতে হয়। এখনো লোকে গভীর-গম্ভীর কণ্ঠস্বরকে মান্য করে।

চোখের ইঙ্গিতে সুহাসিনীকে দেখালেন ভদ্রলোক।

করপোরেশনের পাইপ ফেটে জল বেরোবার মতো গলগল করে লাল শাড়ি কালো পাড় বলতে শুরু করল, ‘মাসিমাকে ওর ছেলে রাস্তায় বসিয়ে কেটে পড়েছে …’

‘গুড …’, চিকুদা পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন। ‘মাসিমা আপনি বলতে থাকুন কেসটা কী? আমার দিকে তাকিয়ে বলুন … অনিমা তুই এই মোবাইলের ভিডিও ক্যামেরায় সব রেকর্ড কর … কলকাতা সারাদিনকে দেবো, ওরা দেখাবে … ভাবতে পারছিস এক ঝটকায় আমাদের বর্ষা সংঘ পুরো হিরো …’

‘চলুন একবার ট্রায়াল দিয়ে দেখা যাক … অনিমা রেডি? আমি আর মাসিমা দুজনেই যেন ক্যামেরায় …’ চিকুদার কথা শেষ হতে না হতেই ক্রিম-চকচকে মুখ বলল, ‘ওকে … নিন এইবার শুরু করুন …’

ক্যামেরা চালু হতেই সুহাসিনী কাঁদতে শুরু করলেন – ‘আমাকে … আমাকে আমার ছেলে পথে বসিয়ে পালিয়েছে … একটার জায়গায় দুটো ট্যাংরা মাছ খেয়ে ফেলেছি সেইজন্য … বউয়ের ভাগেরটা … কী টেনশন, কী টেনশন … ভাবতেই পারছি না … কী করব … ট্যাংরা মাছ যে ভালোবাসি … ডিম ভরা ট্যাংরা …’

‘বাহ্ হেভি হচ্ছে … ব্যাপক …’, চিকুদা খুব খুশি, ‘দেখিস দেখাবার পর কী হয় … টেলিকাস্ট করা অবধি মাসিমাকে এখানেই রাখ -’ অনিমা নামের মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়াল। ‘একেবারে জমে আম-দই …’, চিকুদাকে দেখে ক্রিম-চকচকে মেয়েটি হঠাৎ যেন সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে!

 

এতক্ষণ সবকিছু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল রঞ্জন। আর পারল না – ‘তা কী করে হবে? এখন যদি ওর ছেলে বাসস্ট্যান্ডে খুঁজতে আসে?’

চিকুদা ঘাড় বেঁকিয়ে রঞ্জনকে একবার দেখে সামনের কালো ট্রাউজার্সের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। নিশ্চয় জিজ্ঞাসার ভঙ্গি ছিল চোখে। কালো ট্রাউজার্স সাততাড়াতাড়ি বলল, ‘ও আর এই লছমনই তো মাসিমাকে নিয়ে এসেছে …’

নেতার গলা বেরিয়ে এলো – ‘ছেলেকে ফুটিয়ে দেবেন, আগে সারাদিন খবর করবে, তারপর মা ফেরত পাবে ছেলে -’

‘তার আগে আপনাকে ফুটিয়ে দেব …’, রঞ্জনের মুখ দিয়ে  বাক্যটি বের হলেও সে মোটেই এমন বলতে চায়নি। যেমন দাপট নিয়ে শব্দকটি ছুটে গেল, তেমন ওজন তো তার গলায় সচরাচর থাকে না!

অনিমা ছুটে এলো, ‘কেন ঝামেলি পাকাচ্ছেন? … যান না …’

‘আপনি ভাগুন, আপনার মুখের থার্ড ক্লাস ক্রিমের গন্ধ মোটেই পছন্দ নয় …’ এই কথাটাও রঞ্জন বলতে চায়নি, কিন্তু বেরিয়ে গেল!

অনিমা তো বটেই চিকুদারও মুখ ঝুলে গেছে। তবু সহজে দান ছাড়বার পাত্র নয়। ‘কী বললেন! জানেন আমি কে? আমি জন্মভূমি পার্টির -’

‘সে আপনি যে-পার্টিরই হোন, আমিও খবর কলকাতা পত্রিকার সম্পাদক … লিখে দেব জন্মভূমি পার্টির সহ-সম্পাদক জোর করে এক অসহায় মহিলাকে আটকে রেখেছেন … তার সম্পত্তির লোভে …’ পকেট থেকে টুইটার মোবাইলের আই-কার্ড বের করে দেখাল রঞ্জন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে আবার পকেটে পুরে নিল। চিকুদার এখন যা খিচুড়ি দশা রঞ্জনের পরিচয়পত্রটি খতিয়ে দেখবার মতো মন নেই। সহ-সম্পাদক এই কথাটা শুনতে যতটা ভালো লাগছে, কাগজে কেচ্ছা বেরোবার খবরে নেতা ততটাই ত্রস্ত।

জিনস পরা ছেলেটি রঞ্জনের দিকে ফিরল, ‘না মানে আপনিই তো …’

ক্রিমের অপমানে অনিমা রেগেই ছিল। জিনসের দিকে ফিরে বলল, ‘অত নরম করে বলার কী আছে … আমরা যা ভালো বুঝেছি তাই করেছি।’ কথা শেষ করেই সমর্থনের আশায় চিকুদার দিকে তাকাল। ‘তাই না চিকুদা?’

হঠাৎ সুহাসিনী উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমি এখানেই থাকব … এখানেই ভালো … আর বাড়ি যাব না।’ এমনভাবে বললেন যেন খুঁজে পেতে জায়গাটা উনিই জোগাড় করেছেন।

জিনস বলল, ‘দেখছেন তো … আপনি আর লছমন আনলেও উনি এখানেই থাকতে চাইছেন …’

কালো ট্রাউজার্স বলল, ‘অত সহজ নয় ব্যাপারটা … তার মানে উনি স্বেচ্ছায় এখানে থাকতে চাইছেন, ছেলে রাস্তায় বসিয়ে গেছে তাতে ওর কোনো দুঃখ নেই … পেপারে বেরিয়ে গেলে প্রচুর বাওয়াল হবে … থানা পুলিশ … তাই না চিকুদা?’

সতেরো বছর রাজনীতি ঘষটান চিকুদা এমন জটিল গিঁট দেখেননি। এগোলেও বিপদ, পেছোলেও। এদিকে সবাই তার সমর্থনের আশায় ‘তাই না চিকুদা, তাই না চিকুদা’ করে যাচ্ছে।

পরিস্থিতি আরো ঘোরালো। চিৎকার শুনে আশপাশ থেকে আরো অনেকে জুটে গেছে। সবাই কোনো না কোনো পক্ষে। সবাই তেতে উঠেছে। এইবার মনে হয় চেয়ার ছোড়াছুড়ি হতে যাচ্ছে। কাঠের চেয়ার হলে আহতের সংখ্যা বাড়ত, পস্নাস্টিকের চেয়ারে মনে হয় অতটা হবে না।

 

– স্যার … আভি তুরন্ত চলিয়ে …

রঞ্জন চমকে ফিরে তাকাল। লছমন হাসল, ‘চলিয়ে, শু পালিশ করনা বাকি হ্যায় …’

‘বাঃ’, রঞ্জন মনে-মনে তারিফ করল। এর হবে। চারপাশে যতই হট্টগোল থাকুক, এই লোকটা নিজের লক্ষ্যে স্থির। সেলস পারসনদের এরকমই হওয়া উচিত। টার্গেট ভুললে চলবে না।

– চলিয়ে স্যার …, লছমন হাত ধরে টানল।

– দাঁড়াও, প্রথম চেয়ারটা ছোড়া হোক, তারপর …

 

 

ছয়

বর্ষা সংঘ থেকে সুইস পার্ক দূরে নয়। গাড়ি খুঁজে পেতে কোনোই অসুবিধা হলো না। বাঁদিকে একটা হলুদ ট্যাক্সি ফুটপাথ ঘেঁষে অচল। ড্রাইভার হয় খেতে, নয় বেড়াতে গেছে। উইন্ডস্ক্রিনে যা ধুলো নোংরা, মনে হয় বেশ কিছুদিনের জন্য বেড়াতেই গেছে। ট্যাক্সির সামনে একটা রিকশা আড়াআড়ি দাঁড় করান, তার পরেই রঞ্জনের ফোর ফোর এইট ফোর।

ড্রাইভিং সিটে বসে রঞ্জন বাঁদিকের দরজা খুলে দিলো। ‘আ যাও …’

লছমন লজ্জায় কাঁচুমাচু। ‘স্যার হম পয়দল …’

কোনো জবাব না দিয়ে রঞ্জন সানগস্নাসটা পরে নিল। বলল, ‘বৈঠো …’

আর কোনো কথা না বলে সড়সড় করে উঠে এলো লছমন।

সুহাসিনীর গলায় ‘কী টেনশন, কী টেনশন’ উচ্চারণ ভুলতে পারছিল না রঞ্জন। তাদের বাড়িতেও একসময় টেনশনের কাল কেটেছে। ভদ্রমহিলা কীরকম সুর করে বললেন – ভাবতেই পারছি না! আরে মশাই, নন্দিনীর সঙ্গে যে এমন দম আটকানো ঝগড়া হবে, প্রথম-প্রথম কি ভাবা গিয়েছিল? ভাবা যায় না, অনেক কিছুই প্রথমটায় ভাবা যায় না। ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল সেই সন্ধের কথা –

তারিখ তো ভোলার নয়। ১৯ জানুয়ারি। রঞ্জনের জন্মদিন। ঠিক ছিল ওইদিন দুজনে বেরিয়ে চিনেপাড়ায় খেতে যাবে। সেইমতো সব বলে রেখেছিল জানাচেনা এক রেসেন্তারাঁয়। এই দোকানে শ্রেডেড ল্যাম্বটা দারুণ বানায়, ফ্রায়েড প্রনটাও ভালো। জন্মদিন জানাতে ওরা স্পেশাল কেকেরও ব্যবস্থা করেছিল। অন্যান্য ড্রিংকস আছে কিন্তু ওয়াইন নেই। অথচ নন্দিনী ভালোবাসে। এইজন্য, ওইদিন অফিস থেকে ফেরবার পথে নিউ মার্কেটে থামল রঞ্জন। বিদেশি ওয়াইন কিনতে হবে। দু-হাজার টাকার মতো দাম, তবু …। নন্দিনী ভালোবাসে যে!

ঘরে ঢুকতেই রঞ্জন দেখল নন্দিনী তৈরি হচ্ছে।

– কী রে! এখনই রেডি? …

টপের বোতাম লাগাতে-লাগাতে নন্দিনী বলল, ‘শোন না … তোকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম … আজ যাওয়া যাবে না রে -’

– কেন? …

– একটা ডিনারে যেতে হবে … সেমি অফিসিয়াল …

রঞ্জন চুপ। নন্দিনীই ব্যাখ্যা করল – ‘আসলে রাস্কিন বন্ড আসছেন … ওর সঙ্গে একটা টাইম ম্যানেজ করবার চেষ্টা করছি … যদি পেয়ে যাই তাহলে একটা হাজার দেড়েক শব্দের ফিচার নাবিয়ে দেব -’

কী আশ্চর্য মেয়ে! যার সঙ্গে সময় ঠিক করা আছে বহুদিন ধরে, তাকে উপেক্ষা করে, তার জন্মদিন পাত্তা না দিয়ে এ ছুটছে এমন একজনের কাছে যার সঙ্গে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টই করা নেই!
মনে-মনে ভাবল রঞ্জন। অভিমানের বাষ্প জমেছিল গলায়। বুকের ভেতরে সাঁইসাঁই ঠান্ডা হাওয়া। জিভ শুকিয়ে শুকনো কাঠ।

‘বুঝলি তো ক্যারিয়ারের ব্যাপার, কিছু মনে করিস না  -’, নন্দিনী বেরিয়ে গেল।

সেদিন ঘরের আলো নিবিয়ে গভীর রাত অবধি জেগে ছিল রঞ্জন। রাত এগারোটায় উঠে পাশের ঘরে গেল। আলো জ্বালল। নন্দিনী ফেরেনি। ওর বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে হাংরি টাইড। তাকে ড্যান ব্রাউন, সলমন রুশদি, পলো কোহেলো। ওয়েবস্টার ডিকশনারিও আছে। কিন্তু বন্ড নেই। এক লাইন না পড়েও মেয়ে গেছে ওর ইন্টারভিউ করতে! জার্নালিস্ট হলে কিছু না জেনেই বুঝি সবজামন্তা হতে হয়! অথচ মেয়েটার ঠাকুরদার বাবা না কে যেন রাজকৃষ্ণ রায়চৌধুরী যিনি রস্কোর কেমিস্ট্রি প্রাইমার অনুবাদ করেছিলেন – সচিত্র রসায়ন শিক্ষা। সে-বই এনে দেখিয়েছিল নন্দিনী। ভদ্রলোক ফেরাস সালফেটের বাংলা করেছিলেন চতুরমস্নল গন্ধ-লৌহ! সে-যুগের তুলনায় অত্যন্ত সাবলীল অনুবাদ। সেই বাংলাও আজ কত পালটে গেছে। যে হারে বাংলা পালটেছে তার থেকে অনেক দ্রম্নত পালটে গেছে নন্দিনী। সে আজকাল আর সামান্য জিনিসে আনন্দ পায় না, অল্পেতে খুশিও হয় না।

এইভাবেই সে-রাতে রঞ্জনের যাবতীয় অভিমান, দুঃখ, ক্রোধ সমস্ত মিলেমিশে এক বত্রিশ কেজির গ্যাস সিলিন্ডার হয়ে দাঁড়াল। সিলিন্ডারের গায়ে অদৃশ্য কালিতে লেখা – দাহ্যবস্ত্ত।

আবার একদিন দেখা গেল নন্দিনীর সঙ্গে অভিজ্ঞানের খুব ঘনিষ্ঠতা। মাঝেমধ্যেই ওর সঙ্গে বেরিয়ে যায়, রাত করে ফেরে। ফিরলে স্পষ্ট দেখা যায় ওর মুখে তৃপ্তি লেগে আছে। ও ফোন করলে নন্দিনী ছেলেভোলানো গলায় কথা বলে। রঞ্জন সাবধান করেছিল বহুবার – ‘দ্যাখ ওকে আমি চিনি, স্প্যারোতে আমার কলিগ ছিল, জুনিয়র … ও কিন্তু ভীষণ মিথ্যে কথা বলে … ফাঁসিয়ে দেবে -’

– তোর কি হিংসে হচ্ছে? আমি যা করছি বেশ করছি … আমারটা আমি ম্যানেজ করব, তোকে ভাবতে হবে না …

আবার কষ্ট, আবার অভিমান, দুঃখ, ক্রোধ। এবং আবারো গ্যাস সিলিন্ডার।

এতকিছুর পরেও রঞ্জন নিজের দায়িত্ব দেখাতে ভোলেনি। তেইশে মার্চ নন্দিনীর জন্মদিন। ওকে নিয়ে ঘুরে এসেছিল পার্ক স্ট্রিট। কন্টিনেন্টাল খেয়েছিল সেদিন। কেক কাটার অনুষঙ্গ তো ছিলই। আজ বোঝে ভালোবাসা নয়, দায়িত্ব দেখানোর উদ্দেশ্যেই করেছিল সবটা। তুমি আমার ওপর যত্নবান না থাকতে পার,
কথার খেলাপ তোমার কাছে জলভাত। আমি কিন্তু কথা রাখি। আজ আমারও অফিসের কাজ ছিল জরুরি। হেড অফিস থেকে ন্যাশনাল সেলস হেড এসেছে কলকাতায়। সারাদিন মিটিংয়ের পর রাত্তিরে ডিনার। হেডের কাছাকাছি থাকলে, ওর বোকা-বোকা রসিকতা শুনে হো-হো হাসলে নম্বর বাড়ে। কিন্তু সেই ডিনারে আমি থাকিনি নন্দিনী। কারণ, আমার কথার খেলাপ হবে। নন্দিনী যখন বেকড ফিশ খাচ্ছে, ফিশ আ লা ডায়না খেতে-খেতে নিজের মনে এমন কথাই ভেবেছিল রঞ্জন। অতএব, খাওয়া হলো ঠিকই, আনন্দের কথাও হলো দু-চার, কিন্তু জমাট অভিমান কমল না, বেড়েই গেল। একবারও তো ভেবে দেখল না মেয়েটা, কতটা ম্যানেজ করে রঞ্জন আজ ওকে নিয়ে খেতে এসেছে। তুমি পারতে ক্যারিয়ারের জায়গায় এমন স্যাক্রিফাইস করতে?

সমস্ত রাগ-দুঃখ-অভিমানকে তীর বানিয়ে নন্দিনীর দিকে ছুঁড়ে চলল রঞ্জন। যখনই ওর কথা মান্যতা পায় না, কিংবা সে নন্দিনীর তরফ থেকে উপেক্ষা পায়, তীরের ফলায় বিষ মাখিয়ে নেয় – শুধু ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার। শুধু নিজের কথা ভাবা। দেখিস জীবনে তুই কোনো বন্ধু পাবি না। তুই যেমনভাবে প্রত্যেককে কাজে লাগিয়ে সিঁড়ি টপকাচ্ছিস, একদিন পা ফসকাবে। মারা যাবি হুমায়ুনের মতো।

ক্রমশ ওদের দু-কামরার ফ্ল্যাট ভরে উঠল অবিশ্বাসে, অসম্মানে। সম্পর্কে অবিশ্বাস ঢুকে পড়লে, আর কী বাকি থাকে? অসম্মান জমে উঠলে সম্পর্ক সুস্থতা হারায়। তখন সম্পর্কের একশ চার জ্বর। বাড়ির মধ্যে ক্রমশ জমে একশ-দুশো বত্রিশ কেজির গ্যাস সিলিন্ডার! যার গায়ে অদৃশ্য অক্ষরে লেখা – দাহ্যবস্ত্ত, সাবধান!

 

একদিন বিস্ফোরণ ঘটল।

সেদিনও একসঙ্গে বেরোবার। নন্দিনীকে নিয়ে বর্ধমানে যাবে রঞ্জন। বাবার কাছে। রাত্তিরে থেকে যাবে ওইখানেই। নন্দিনী গেল না। টিভিতে কোন এক টক শোতে ডাক পড়েছে – রেশন ব্যবস্থা কি তুলে দেওয়া উচিত? পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা। রঞ্জনের মাথা গরম হয়ে গেল। কী বোঝে মেয়েটা রেশন ব্যবস্থার যে কথা বলবে? সব ব্যাপারে থাকা চাই। টিভিতে মুখ না দেখালে কী চলে না? ওপরের মাসিমা ভালো বলে-বলে ওর ল্যাজটা আরো মোটা করে দিয়েছেন। কিছুদিন না মুখ দেখালে মাসিমা জিগ্গেস করবেন, ‘কি গো টিভিতে ডাকছে না আর?’ নন্দিনী আদিখ্যেতা জড়ানো গলায় বলবে, ‘ডাকছে না আবার … মাঝে-মাঝেই ডাকে, আমিই তো কাজের চাপে যেতে পারি না …’

বর্ধমান না যেতে পারার খবরটা বাবাকে জানিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে ছিল রঞ্জন। মাঝে একঝলক টিভি দেখে নিয়েছে। নন্দিনীর
কথাও শুনল। ও বলছে, এ-ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। যুক্তিহীন কথা। তুই জানিসই না রেশনিং ব্যবস্থা চালু করবার উদ্দেশ্য কী? এখনো এ কত গরিব মানুষের কাজে লাগে। না জেনেই ফড়ফড় করে যাচ্ছিস। বেশ বাজে। অবশ্য অন্যরা ওর থেকেও খাজা।

টিভির আওয়াজ কমিয়ে বই পড়ছিল রঞ্জন। রেজি ডেব্রের আনডিজায়ারেবল এলিয়েন

নন্দিনী ঢুকল, ‘কী রে দেখলি? … কেমন?’

– খুব খারাপ … কিছু বুঝিস না, বলতে যাস কেন?

তর্কটা রেশনিং দিয়ে শুরু হলেও অচিরেই সীমানা পেরোল।

– তুই ক্যারিয়ারিস্ট … ধান্দাবাজ … অত্যন্ত স্বার্থপর …

– তার মানে? ক্যারিয়ারিস্ট আমরা সবাই … তুই গাড়ি কিনলি কেন? স্ট্যাটাস বাড়াবার জন্যই তো –

– তোর মনে হলো না বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, যাওয়া উচিত ছিল আজ … তুই নিজের ছাড়া কিচ্ছু বুঝিস না … অপরচুনিস্ট …

‘তোর সঙ্গে কথা বললে দম আটকে আসে আমার, তুই আমার সব ব্যাপারে মাথা গলাস … কী খাব তুই ঠিক করবি, কী পরব তুই বলে দিবি, কোথায় যাব কার সঙ্গে কথা বলব কী বলব সব তুই ঠিক করে দিবি … আমার দম আটকে আসে … এ-বাড়িতে আমার দম আটকে আসে -’ বলতে-বলতে নিজের ঘরে চলে গেল নন্দিনী।

বিষমাখানো তীর যোজনা করল রঞ্জন – ‘যা না অভিজ্ঞানের সঙ্গে ঘুরে আয় … শরীর-মন সব খুশি হয়ে যাবে …’ নিজের ঘর থেকেই চিৎকার করে বলেছিল কথাটা। বলেই নিজের বিছানা গুছোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

কয়েক সেকেন্ড পরেই নন্দিনী ছুটে এলো। পেছন থেকে এসে ধাঁই করে ওয়েবস্টার ডিকশনারিটাই বসিয়ে দিলো রঞ্জনের পিঠে। রঞ্জনও ছুড়ে মেরেছিল হাতের বইটা। কিন্তু কোথায় হার্ড বাউন্ড ওয়েবস্টার, নাইনটিন থার্টিফোর এডিশন আর কোথায় কৃশকায় রেজি ডেব্রে!

সে-রাতে সবকটা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছিল। একের পর এক। এ-আগুন এমন, পৃথিবীর কোনো দমকলের সাধ্য নেই তাকে নেবায়।

তিনদিনের মধ্যে রঞ্জন অন্য জায়গায় চলে গেল। নন্দিনীকে কিছু না বলেই। এক লাইনের একটা এসএমএস করে দিয়েছিল শুধু – লেটস পার্ট কম্পানি। প্রথমে উঠেছিল সুকিয়া স্ট্রিটের একটা বাড়িতে। খোঁজ পেয়ে নন্দিনী এসেছিল। বলেছিল – ‘কোথায় পালাবি? ঠিক তোকে খুঁজে বের করব … চল ফিরে চল …।’ তখনো রাগ পড়েনি রঞ্জনের। মাথা নেড়ে ‘না’ বলেছিল। ‘কেন? … কেন যাবি না?’ কোনো উত্তর দেয়নি এ-কথার। কথায় কথা বাড়ে। হয়তো ওর তরফেও কিছু সত্য আছে যা রঞ্জন বুঝতে পারছে না। সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার প্রধান অসুবিধা – জলাভাব। রাত্তিরে ফিরে স্নান করা রঞ্জনের বহুদিনের অভ্যাস। এইখানে তা হচ্ছে না। এমন সময়েই পেয়ে গেল রাজা রাজবলস্নভ স্ট্রিটের বাড়ির সন্ধান …

– স্যার আ গয়া … রুকিয়ে …

রঞ্জন চমকে তাকাল। হ্যাঁ, সেই বটগাছের তলায়! এতক্ষণ অন্যমনস্কভাবে গাড়ি চালিয়েছে। ডান-বাঁদিক করেছে অভ্যাসে, নিশ্চয় ব্রেকও কষতে হয়েছে কয়েকবার, তবু ঠিকঠাক এসে গেল। আশপাশ একই রকম। কিছুক্ষণ আগে যা দেখে গিয়েছিল তার মধ্যে একটাই সংযোজন – ভুট্টাওয়ালা। তোলা উনুনে ঢিমে আঁচে ভুট্টা পোড়াচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন। গাড়ি সোজা করে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড় করাতে-করাতে দরজা খুলে টুক করে নেমে গেল
লছমন। যেন ট্রেনিং পাওয়া বাঁদর! রঞ্জনের ভুট্টা খেতে ইচ্ছে করছে। পালিশওয়ালাকেও দেওয়া দরকার।

ওকে ডাকতেই –

লছমন ফিরে তাকাল। আচাভুয়া মুখ। কড়ে আঙুল তুলে বলল, ‘স্যার … এক মিনট … আভি আ রহে …’

 

সাত

নিজেকে কোনো-কোনো সময় শিকারি মনে হয়। সেই পশ্চিম মঙ্গোলিয়াতে অলটাই পাহাড়ের শিকারি। যারা ঘোড়ায় চেপে শিকারে যায়। সঙ্গে থাকে সোনালি ঈগল। নিয়মিত ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তাকে। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শিকারি।  মাথায় কানঢাকা পশমের টুপি। পরনে চামড়ার পোশাক। ডান হাতে সোনালি ঈগল। তার চোখে ঠুলি। শিকারির মেয়ে পাহাড়ের পায়ের কাছে, ঘোড়ায়। তারও সর্বাঙ্গে গরম পোশাক। ডান বাহুমূল অবধি ঢাকা চামড়ার দস্তানায়। ট্রেনিং চলছে। পাহাড় চূড়ার শিকারি ঈগলের ঠুলি খুলে দিলো। ঘোড়ার পিঠে বসে মেয়ের তীক্ষন ডাক – ‘উর্র্ … ক্যা … উর্র্ … ক্যা …’ ঈগল উড়তে শুরু করেছে। বিশাল ভারী ডানায় বাতাস কেটে ঈগল নেমে আসছে মেয়ের দিকে। এই সময় ঈগলের দিকে তাকানো নিষেধ, মেয়ের চোখে আঘাত লাগতে পারে। ঈগল এলো, ডানা গুটিয়ে বসল মেয়ের ডান বাহুতে। মেয়ে তৈরি, তৈরি ঈগলও। এবার শিকারের শুরু। ঘোড়ায় চলেছে মেয়ে, কপকপ কপকপ। দক্ষিণ বাহুতে ঈগল। হঠাৎ দূরে দেখা গেল লাল শিয়াল – রেড ফক্স। দৌড়ে পালাচ্ছে। ঘোড়া ছুটিয়ে ধরা শক্ত। মারাও সহজ নয়। ঈগলের ঠুলি খুলে লেলিয়ে দেওয়া হলো। দুরন্ত ঈগল অচিরেই পৌঁছে গেল লক্ষ্যবস্ত্তর কাছে। ধারাল নখে বিদ্ধ শিয়াল। টুঁটি চেপে তীব্র ঠোক্কর। ঈগলের নখে আহত শিয়াল আর বেশি কিছু করবার আগেই পৌঁছে গেছে শিকারি। তার কাজ এখন সহজ। ঘোড়া থেকে নেমে ছুরি চালিয়ে স্তব্ধ করে দিতে হবে লাল শিয়ালকে। তারপর বস্তাবন্দি করে ঘোড়ায় ঝুলিয়ে নিতে হবে শিকার। এমনভাবেই শিকার করা হবে করসাক ফক্স, পাহাড়ি ভেড়া আর খরগোশ। জন্তুর মাংস-ছাল সবকিছুই কাজে লাগে পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার এই আড়াইশো ঘর শিকারিদের। মাংসের কিছুটা ভাগ নিশ্চয়ই পাবে সোনালি ঈগল।

 

ভালো করে ভেবে রঞ্জনের মনে হলো সে শিকারি নয়, সোনালি ঈগল। তার কাজ ঠুলি খুলে গেলে আজ্ঞাবহের মতো শিকারের দিকে ছুটে যাওয়া। কী এক অনিবার্যতায় সে এইসব শিকারির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে!

কানের কাছে কেউ যেন সকাল থেকে ক্রমাগত ফিসফিস  করে মন্ত্রণা দেয়। একদিন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে গড়িয়াহাটের দিকে যাচ্ছে। একটা নতুন রিটেল আউটলেট খুলেছে। একবার
দেখে আসা দরকার পোস্টার ড্যাংলার সব ঠিকঠাক লেগেছে কিনা। একটা গেস্না-সাইনও তো লাগাবার কথা। হঠাৎ কানের কাছে কেউ ফিসফিস করল – বাঁদিক, বাঁদিক … পেট্রোল পাম্পের কাছে দাঁড় করাও। দাঁড়াল। খয়েরি শার্ট পরা একটা লোক এগিয়ে এলো। হাতে ব্রাউন পেপারের খাম। পেটমোটা। বলল, ‘এই যে এইটা …’ লোকটা মিলিয়ে গেল পাশের রাস্তায়। তারপর ‘ডানদিক-বাঁদিক সোজা’ এইসব নির্দেশ দিতে থাকল কেউ। রঞ্জন সম্মোহিতের মতো গাড়ি চালিয়ে যে-বাড়ির সামনে পৌঁছল, তার রং হলুদ। তিনতলা। সবুজ জানালা। পুরনো দিনের গরাদ। ওইখানে কেউ একজন এসে চিঠি নিয়ে যাবার পর ঘোর কাটল। বোঝা গেল তপসিয়াতে হাজির হয়েছে। ওর তো এখানে আসার কথা ছিল না! কেন এলো?

 

আবার একদিন এমনই নিশি-পাওয়ার মতো ঘুরতে-ঘুরতে পৌঁছে গেল ঝাউতলা রোড। গাড়ি রেখে নামতে বলল কেউ। একটা
পলেস্তারা-ওঠা বাড়ির দোতলায় নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। মাঝবয়েসি একটা লোক ভালো করে দেখল রঞ্জনকে। লোকটার চোখে সুরমা। তীব্র চাহনি। চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। চোখ একটু নামাতেই দেখা গেল গোঁফ নেই, দাড়ি আছে। রঞ্জন ভালো করে দেখল লোকটাকে – এর দাড়ি নকল। এরকম যাত্রাপার্টির মতো সেজেছে কেন?

লোকটা বলল … ‘যা বলছি কর, আলস্নাহপাকের দোয়া মিলবে…’

রঞ্জন মাথা নাড়ল… ‘একটা কথা, আপনি কি যাত্রা করেন? … শাহজাদা দারাশুকোর পার্ট? তাই দাড়ি লাগিয়েছেন?

–  ‘খামোশ …’, দারাশুকোর ভুরু কুঁচকে গেল। মনে হচ্ছে রেগে গেছে। কিংবা নাটকের সংলাপও হতে পারে, ঝালিয়ে নিচ্ছে। যাই হোক ওকে ঠান্ডা করবার জন্য রঞ্জন বলল, ‘না মানে আমিও তো একটু-আধটু অভিনয় করতাম … তাই ভাবছিলাম আপনারও বোধহয় আজকে কোথাও শো … ও বুঝেছি আপনি সিরিয়ালের জন্য
মেক-আপ …’

মাঝপথ থেকে দারাশুকো বলল, ‘যা বলটু নিয়ে যা … এ পারবে …’

 

এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য একতলা বাড়িতে গেল ও আর বলটু। সেখানে একটা ঘরে সাতজন। ভয় পাওয়া ছাগলের মতো মুখ। খালি গায়ে সিল্কের চাদর, কপালে চন্দনের ফোঁটা। প্রত্যেকের মাথায় ছ-ইঞ্চি লম্বা টিকি। বলটু একটা কাঁচি দিয়ে বলল, ‘এদের টিকিগুলো কেটে দাও …’

টিকি কাটাতে আর কি অসুবিধা। রঞ্জন ফটাফট কেটে দিলো। যখন ঘোর কাটল, দেখল ঝাউতলা রোডে গাড়ির মধ্যে বসে আছে। একে দিবাস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারত রঞ্জন যদি না পরদিনের কাগজে ওই টিকিছাঁটা লোকগুলোর ছবি বের হতো। হ্যাঁ, এই লোকগুলোকেই তো রঞ্জন দেখেছে আগের দিন। কাগজ এও লিখেছে যে, এইসব দাঙ্গা বাধাবার কায়দা। কী বিপদের কথা!

একমাস পরে বিকেল চারটেয় আবার ফিসফাস। আবার সম্মোহনযাত্রা। দোতলা বাড়ির ছাদে বসান হলো রঞ্জনকে। হঠাৎ একজন এলো। নিশ্চয়ই ষাট পেরিয়েছে। মাথা পুরো সাদা। ফলে তামাটে মুখ কালচে দেখায়। ভদ্রলোকের চোখ গেল ছাদের কোণে – ‘এ কী ওই জঞ্জালের বস্তাটা ছাদে কেন? এই যে বাবা রঞ্জন ওই ছাদের পশ্চিমে ভাগাড়। একতলায়। ভাগাড়ে ফেলে দাও না বস্তাটা, প্লিজ। কাল করপোরেশনের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে … তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলছি … অনেক কথা আছে।’ ভদ্রলোক ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীদের মতো দেখতে। উনি এগিয়ে এসে রঞ্জনের মাথায় হাত রাখলেন। কীসব মন্ত্র পড়তে থাকলেন বিড়বিড় করে। শেষে বললেন, ‘যাও ফেলে এসো … তুমিই পারবে, তোমার মধ্যে কালীঠাকুর ভর করেছেন … বল, বল … জয় কালী …’

‘জয় কালী …,’ রঞ্জন বস্তাটা তুলল। বেশ ভারী। আন্দাজে বুঝল ভেতরে ভাঙা ইট, জানালার কাঠ এই জাতীয় কিছু আছে। নিশ্চয়ই কোনো ঘরে রাজমিস্ত্রি লেগেছে। ছাদের আলসে বেশ উঁচু। বস্তাটা তুলে তার ওপর রাখতেই হাঁফ ধরে গেল। কিন্তু এইভাবে বেশিক্ষণ রাখা যায় না এমন বেয়াদব বস্তা। খালি গড়িয়ে ছাদের দিকে চলে আসতে চায়! দু-হাত দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিলো রঞ্জন – ‘যা ভাগাড়ের মাল ভাগাড়ে যা …’

পেছন ফিরে দেখে কেউ নেই। সেই ষাট বছরের বৃদ্ধ হাওয়া। নিচ থেকে হলস্না শোনা যাচ্ছে। রঞ্জন একতলায় নেমে এলো। একদল ছেলে ওর পাশ দিয়ে ওপরে উঠে গেল ‘কোন শালা ফেলল, ধরতে পারলে ছাল ছাড়িয়ে নেব’ এইসব বলতে-বলতে।

টিভিতে রাতের ‘কলকাতা রাউন্ডআপ’-এ জানা গেল। খিদিরপুরে ইট-লোহা ভরা বস্তার আঘাতে পাঁচজন আহত। একজনের অবস্থা সংকটজনক। বাড়ির ওইদিকে রমজান মাসের বাজার বসে। নামাজশেষে অনেকে যখন বাজারের দিকে যাচ্ছে, তখন বস্তাটা ওপর থেকে পড়ে। মাঝখানে একটা মোটা লোহার রডে ধাক্কা খেয়ে বস্তাটা পড়ায় তার গতি কিছু কমেছে, পূর্ণগতিতে পড়লে ভয়ংকর কা- হতো।

এরপরে যা হলো আরো মারাত্মক। টুইটার মোবাইল একটা নতুন স্কিম আনবে। নিয়মমতো মুম্বইয়ের অফিস থেকে প্রোডাক্ট নোট আগে রঞ্জনকে পাঠানো হলো। কনফিডেনশিয়াল নোট। দারুণ কনসেপ্ট। এই প্রিপেড স্কিমে আনলিমিটেড কল আর এসএমএসের ব্যবস্থা আছে। টাকাও সামান্য। দারুণ হিট হবে এই স্কিম। রঞ্জন মতামত লিখে মেল করে দিলো। পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে বাজারে এসে যাবে তাদের এই প্রিপেড স্কিম। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার আগেই, পনেরোই আগস্ট স্প্যারো কমিউনিকেশনস বাজারে ছেড়ে দিলো ফ্রিডম কল নামে প্রিপেড স্কিম। যে-প্রোডাক্ট রঞ্জনকে পাঠানো হয়েছিল গোপনীয় বলে, কী করে হুবহু সেই জিনিস বাজারে এসে গেল ওদের আগেই! আরো আশ্চর্য শুধু কলকাতাতেই স্প্যারো ছেড়েছে এই স্কিম! কী করে হলো? এ-অফিসে রঞ্জন ছাড়া তো আর কেউ জানে না এই প্রোডাক্টের খবর!

হঠাৎ মনে পড়ল সাতদিন আগের সন্ধের কথা – ওকে ফিসফিস করে নিয়ে যাওয়া হলো উড স্ট্রিটের এক অফিসে। টাই পরা এক ভদ্রলোক কম্পিউটার এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও প্রোডাক্ট নোটটা লিখে ফেল তো … দেখি কেমন পড়া মুখস্থ করেছ  … ডিটেলে লেখবার দরকার নেই, হাইলাইটসগুলো লিখে দাও, তাহলেই চলবে।’

সে লিখেছিল সব। তারপর ঘোর চলে গেলে দেখল নিজের চৌরঙ্গী অফিসেই বসে।

এই কথা তো আর হেড অফিসের লোককে বলা যায় না। সে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে। নিজের কোম্পানির খবর রাইভ্যাল কোম্পানিকে দেওয়া কোনোমতেই ক্ষমার যোগ্য নয়। যেহেতু রঞ্জনের সুনাম প্রচুর তাই কেউ ওকে সন্দেহ করল না। শুধু  সাবধান করা হলো – বলে দেওয়া হলো, ওর সেক্রেটারি বা জুনিয়র কেউ যেন কোনোমতেই ওর কম্পিউটারে হাত না দেয়। অর্থাৎ মুম্বই অফিস ওকে সন্দেহ করছে না ঠিকই কিন্তু প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাপু হে তুমি ধেড়িয়েছ, এবার সাবধান হও।

সেদিনই রঞ্জন ঠিক করেছিল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অনেকদিন আগে নন্দিনীর মাধ্যমে সাইবার সেলের কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই আলাপ টিকে আছে এখনো। দেখা করে সব গুছিয়ে বলতে হবে। এতদিনে ফিসফিসের একটা অংক বুঝতে পেরেছে। সে যদি সোনালি ঈগল হয় তবে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি তাকে চালায় একদল শিকারি। আবার সন্ধে ছটা-সাড়ে ছটা থেকে দশটা-এগারোটা অবধি তার দখল নেয় অন্য আরেক দল। ওই যে মাঝে এক ঘণ্টার ছুটি, তার মধ্যে কিছুটা ঘোর কেটে যায়। নিজস্ব চিমন্তাশক্তি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে আসে। আবার মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে বোঝে, সে নিজের মতো ভাবছে। কারণ, এক-আধদিন নন্দিনীর জন্য কষ্ট হয়। মনে হয়, হয়তো তার ভুল ছিল কোথাও।

 

গগন কাঁপান আওয়াজ তুলে একটা মোটরবাইক ছুটে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। আরোহী এক বাইশ-তেইশের ছেলে। হেলমেট নেই, মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা। এরা ইচ্ছে করে সাইলেন্সর পাইপ খুলে রাখে! আওয়াজ তুলে যাওয়ায় নাকি বেশ দাপট। কী যে ভাবে এরা নিজেদের!

চারদিক ভালো করে দেখে নিল রঞ্জন। লছমন এখনো আসেনি। কোথায় যে চলে গেল! দেখাল কড়ে আঙুল, হয়তো বড় পেয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে একটা ভুট্টা কিনল রঞ্জন। কামড় দিয়ে দানাগুলোকে মুখের ভেতর নিতেই অপূর্ব লাগল। গরম ভুট্টা। কচি। ভালো করে লেবু, নুন মাখান। ভুট্টা খেতে-খেতে ফুটপাথে পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করতে-করতে ভাবতে পারলে চট করে কোনো সূত্র পাওয়া যায়।

আট

সবটা শুনে ওসি সাইবার সেল সুনীল তলাপাত্র বলেছিলেন, মন শক্ত রাখুন, আমাকে খবর দিন, আপনার ব্রেন হ্যাক করা হচ্ছে। তিনটে কথাই ভদ্রলোক বললেন এক নিশ্বাসে। একই সুরে। কথার মধ্যে কোনো ওঠাপড়া নেই।

প্রথম দুটো উপদেশ মামুলি। কিন্তু তিন নম্বরটা ভাববার। রঞ্জন বলল, ‘ব্রেন হ্যাক করা যায় নাকি?’

– কদিন আগে আমিও এমনটাই ভাবতাম, কিন্তু কয়েকটা অদ্ভুত কেস দেখবার পর এখন মনে হয় কেউ বা কারা ব্রেন হ্যাক করছে –

– কেসগুলো কীরকম?

– প্রায় আপনার মতো … কানের কাছে হঠাৎ কেউ যেন ফিসফিস করে বলল বাঁদিকে নয় ডাইনে, আপনি ডানদিকে চলতে শুরু করলেন … ব্রেন হ্যাকিং মানে হচ্ছে টেকনোলজির হেল্প নিয়ে আপনার মস্তিষ্কের কন্ট্রোল নিয়ে নেওয়া …

রঞ্জন অবাক – ‘এইরকম হয় নাকি!’

– দেখুন, স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এ-ধরনের ঘটনা ঘটানো কতটা সম্ভব আমার ঠিক জানা নেই … মাথার ভেতর আলফা বিটা গামা ডেল্টা এইসব নানান রশ্মির তরঙ্গ পাঠান যায়, এগুলো দিয়ে আমাদের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব … এমনকি কোনো গন্ধ দিয়েও ঘুমন্ত মানুষের মগজের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন ইসরায়েলের এক মহিলা বিজ্ঞানী … এখন এই যে এতরকম রশ্মি মাথায় ঢুকছে তাকে যদি বাইরে থেকে মনিটর করবার  পদ্ধতি এসে যায়, তাহলে তো আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব … হয়তো সেই পদ্ধতি এসে গেছে, আমরা কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তা বুঝতে পারছি না –

– তাহলে আপনি বলছেন এটা ডিপ্রেশন বা ওই জাতীয় কিছু নয় –

‘একেবারেই নয়, আপনার মতো পজিটিভ মানুষের ডিপ্রেশন?’ মাথা নাড়লেন তলাপাত্র সাহেব। ‘হয় না যে বলছি না, কিন্তু এটা অন্য ব্যাপার … বললাম না এমন কেস আমি আরো দেখেছি, নয় নয় করে কুড়ি-বাইশটা তো হয়ে গেল …’

তলাপাত্র সাহেব চুপ করে গেলেন। রঞ্জনও কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঘরটাও নিস্তব্ধ। দরজায় সবুজ পর্দা। আজকাল দরজায় পর্দা প্রায় দেখাই যায় না। টেবিলে যে-গেলাসে জল রাখা, অমন মোটা কাচের গস্নাসও আজকাল বাজারে মেলে না।

– … দেখুন যে কেসগুলো আমার কাছে এসেছে তার সত্যি-মিথ্যে জানি না, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে ভিকটিমের মস্তিষ্কের ওয়েভলেন্থকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে হ্যাক করে কন্ট্রোল করা হচ্ছে … এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে বলেই মনে হয় … কারণ কে হ্যাক করছে তার খোঁজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব …

– বুঝলাম … কিন্তু আমার ভীষণ মুড সুইং হচ্ছে … হাসতে-হাসতে হঠাৎ কান্না পেল, কোনো কারণ নেই তবুও … আবার, এই গাড়ি চালাচ্ছি হঠাৎ একটা কুকুরকে চাপা দিয়ে দিলাম, ইচ্ছে করেই …

তলাপাত্র সাহেব মৃদু হাসলেন। ‘শুধু হাসিকান্নার ব্যাপারটা বললে ভাবা যেত, নন্দিনীর সঙ্গে থাকেন না এখন, হয়তো ওর কথা মনে পড়ায় … কিন্তু, কুকুর … আসলে ব্রেন হ্যাকিং মানে আমাদের স্নায়ুর ওপরও দখল পাওয়া, সেইজন্যই মাথা ঘুলিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে সেই মুহূর্তের জন্য -’

– তাহলে তো এমনভাবে কাউকে দিয়ে অপরাধও করান যেতে পারে?

– একজ্যাক্টলি … তখন যার মস্তিষ্ক অন্যের দখলে, সে-রোবট  … একে টেকনিক্যাল সম্মোহনও বলতে পারেন … তাকে দিয়ে নানান ক্রাইম করান যায় … সুবিধা হলো যে হ্যাক করছে সে ধরা পড়ছে না …

– তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায়? … কীভাবে নিস্তার পাওয়া যাবে? … এখন আমাকে দিয়ে যদি কোনো বড় অপরাধ করান হয়? … আপনি তো জানেন আমি … এ তো খুব চক্করে পড়লাম …

ওসি সাইবার সেল ডান হাত তুললেন, ‘শান্ত হোন আমি আপনার কেসটা টপ প্রায়োরিটি লিস্টে রাখছি … চেষ্টা করছি আপনাকে কভারে রাখবার, একজন সাইলেন্টলি আপনাকে ফলো করবে এখন কদিন … আর যেই আন্দাজ পাবেন কারা এইসব করছে, ইমিডিয়েটলি জানাবেন …’

একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন তলাপাত্র সাহেব, ‘এই মোবাইল নম্বরে ফোন করবেন … আর প্যানিক করবেন না, ঠিক কোনো কিছু উপায় বেরোবে …’

 

নমস্কার করে ওসির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল রঞ্জন। বাড়ি ফিরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে ছিল। ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে। মানুষের মাথার ভেতরটা বিচিত্র, কত জটিল
শিরা-উপশিরা-স্নায়ুতন্ত্র-ঘিলু! সেই জটিল ব্যবস্থাটাকে চালনা করছে বাইরের কেউ! ভাবা যায়! নন্দিনীর কথাও মনে হচ্ছিল। হুট করে খুব তো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলি। বুঝলি না, বুঝতে চাইলিই না ব্যাপারটা কত সিরিয়াস। আমাকে এমন একলা ফেলে কোন সুখে দিন কাটাচ্ছিস। চোখে জল এসে গেল রঞ্জনের।

 

আজো এই শেষ বিকেলের আলোয়, তিনটে ঝুরিনামা বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে, সামনের গাড়ি-প্রবাহ দেখতে-দেখতে যেই নন্দিনীর কথা মনে এলো, সেদিনের মতো আজো নিঃশব্দ অশ্রম্নপাত। শীতের হাওয়া বয়ে গেল বুকের মধ্যে। বুক ভেসে গেল চোখের জলে। সে একা-একা নৌকা বেয়ে চলেছে, কোথাও কোনো কূলকিনারা নেই। খারাপ লাগছে, অসহায় লাগছে সব ঠিক, কিন্তু হারবে কেন? যদি একবার হার বারবার লড়, বারবার লড়, বারবার … লড়তে হবে। নো পাসারন। এক ইঞ্চি এগোতে দেওয়া নয় মন খারাপকে। একবার নাক টেনে, দুবার গলা খাঁকারি দেবার পর একটু সুস্থ লাগল।

 

সুনীল তলাপাত্রের কথা শুনে প্রথমটায় খানিক মুষড়ে পড়লেও ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে রঞ্জন নিজেই খোঁজখবর শুরু করে দিয়েছিল। যত পড়ছে তত অবাক।

নিউরোটেকনোলজি কত এগিয়ে গেছে! ফিলিপ লো একটা অদ্ভুত যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন – আই ব্রেন – এর সাহায্যে পক্ষাঘাতের রোগী যারা কথা বলতে পারে না, তাদের মনের কথা জানা যায়। কদিন আগেই টরন্টো ইউনিভার্সিটির ড্যান নেমরোডভ ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফিকে কাজে লাগিয়ে মনের কথা জানবার ব্যবস্থা করেছেন। কেউ একজনের মুখ গভীরভাবে কল্পনা করছে, তার শরীরে লাগান নানান তার, ইসিজি করবার সময় শরীরে যেমন লাগান হয় কতকটা সেই রকম। নেমরোডভ বলছেন, ভাবুন, ভাবুন, আরো গভীরভাবে ভাবুন তার মুখ, চোখ, কানের গড়ন, নাকের খাড়াই …। বানান যন্ত্র বিশেস্নষণ করে চলেছে লোকটির ব্রেন ওয়েভ, কম্পিউটারে ফুটে উঠছে যার কথা কল্পনা করা হচ্ছে তার চেহারা! এইসব তো ঘটছে পৃথিবীতে! এই যন্ত্র লালবাজারে বসান হলে দারুণ হয়। এতদিন গোয়েন্দা বিভাগের কোনো শিল্পীকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী, বর্ণনা শুনে-শুনে অপরাধীর ছবি আঁকতে হতো, এখন যন্ত্র করে দেবে সেই কাজ। করে দেবে দ্রম্নত এবং নিখুঁত।

নিউরোটেকনোলজির বাড়বাড়মেত্মর বিপদও আছে। বিদেশে মাইন্ড হ্যাকিং আর ব্রেনের তথ্য চুরির বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মীরা তো সবাইকে বোঝাতে শুরু করেছে। নিউরোটেকনোলজির বিপদ নিয়ে সজাগ করতে নেমে পড়ছে তারা। ওরা বলছে, মনের কথা এমনভাবে জেনে যাবার কল করলে, মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা বা নিজস্ব গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকবে না। ভালো কাজের উদ্দেশ্যে করা হলেও বজ্জাতরা তো চিরকালই তাকে বদমাইশির কাজে লাগায়।

 

আজ রঞ্জনও এই বদমায়েশদের শিকার। প্রথম শিফটের পর প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চলল, এখনো দু-নম্বর শিফটের ডাক আসেনি। ফলে, ঘোর অনেকটাই কেটে গেছে। এই যে ভুট্টা খেতে-খেতে এতটা নিজের মতো চিমন্তা করতে পারল, কম কী! অলক্ষ্যে তাকে ঘিরে ধরেছে কিছু বজ্জাত। ধরুক, সে জাল কেটে বেরোবেই। কীভাবে? ভাবতে হবে। ভাবলেই মনের জোর বাড়ে, সমাধানের রাস্তা বেরিয়ে আসে। এই যেমন পড়ন্ত বিকেলে, বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে মাথায় এলো, একবার শ্যামবাজারের ডিলারের কাছে যাওয়া খুব জরুরি, কেন সেলস কমে গেল বোঝা দরকার।

 

গাড়ির দিকে এগোতেই লছমনের গলা – ‘কঁহা যা রহে, পহলে জুতা তো উতারিয়ে …’

লোকটা হাসছে। পেট খোলসা হলেই এমন নিশ্চিন্ত হাসি আসে।

 

 

নয়

অন্যদিনের মতো আজো সে সকাল নটায় রাজা রাজবলস্নভ স্ট্রিট থেকে বেরিয়েছিল। মানিকতলায় একটা বড় ডিলার আছে। তার সঙ্গে দেখা করে অফিস যাবে। কিন্তু ওই যা হয় – মাঝপথ থেকে ঘুরতে শুরু করল। বাঁদিক, ডানদিক, সোজা দুশো মিটার গিয়ে বাঁদিকে। মাথার মধ্যে গুগল ম্যাপ খুলে কেউ যেন তাকে ফিসফিস করে পথনির্দেশ দিয়ে চলেছে। এইসব সময় রঞ্জন চোখ বন্ধ করলেও অ্যাপ ক্যাবের মতো রাস্তার ম্যাপ দেখতে পায়। ইউ হ্যাভ রিচড ইয়োর ডেস্টিনেশন –

যে-বাড়ির ভেতরে গেল, বাইরেটা ভাঙাচোরা কিন্তু ভেতর  ঝকঝকে। মেঝেতে মার্বেল, দেয়ালে দামি সাদা রং, ঘরের আলো অবধি ভেবেচিমেত্ম লাগান। উজ্জ্বলতা অকারণে বেশি নয়, কমও নয়। যে-ছেলেটা রঞ্জনকে সদর খুলে দিয়েছিল, বৈঠকখানায় বসিয়ে, ভেতরে কাউকে খবর দিতে গেছে। এই যে এতটা নিজে-নিজে লক্ষ করে সবটা বুঝতে পারছে ঘোরের মধ্যেও, তা ভেবে মনটা আরাম পেল। নিজস্ব জোরের জায়গাটা ফিরে পাওয়া হলো শীতের রাতে বহুকাল ধরে সঙ্গে থাকা তুলোর লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়া! যে-সোফায় রঞ্জনকে বসান হয়েছে, বেশ দামি – ইতালির তৈরি বললেও বিশ্বাস হবে।

বিশাল ঘর। হলঘরই বলা যায়। উলটোদিকের সোফার অবস্থান প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে। বাইরে পায়ের আওয়াজ –

যে লোকটা ঢুকল, টাই স্যুট। নীল চোখ। সত্যি নীল, না কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়েছে – এমন মার্জিত আলোয় বোঝার উপায় নেই। তবে মাথায় যে উইগ পরেছে তা স্পষ্ট। হঠাৎ মনে এলো এই লোকটা সেই ঝাউতলা রোডের বাড়ির দাড়িওয়ালা নয়তো, যে বলেছিল আলস্নাহপাকের দোয়া মিলবে? ওই লোকটারও, এর মতো, চোখের পাতা আর ভুরুর মাঝখানে ছোট আঁচিল ছিল। খুবই ছোট, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায়। খোলস ছাড়ালে লোকটা হয়তো টেকো গোপাল ভাঁড়, কিন্তু আপাতত, সব মিলিয়ে লোকটাকে বেশ নায়ক-নায়ক লাগছে। এতটাই, ওর একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে করল রঞ্জনের। কিন্তু অচেনা লোককে হুট করে কী ছবি তোলার কথা বলা যায়? তবু সে উঠে দাঁড়াল।

লোকটা রঞ্জনকে একবার দেখে নিঃশব্দে হাসল। ওকে বসবার ইঙ্গিত করে নিজে ধপ্ করে বসে পড়ল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল মোবাইল চেক করতে।

সুযোগ এসে গেল একটু পরে। অন্য আর একজন ঢুকতেই, টাই-স্যুট বলে উঠল হাই নীল –

নীল যার নাম, বেঁটে গোল আলুর মতো চেহারা। মুখের ডানদিকে কাটা দাগ। রং টাই-স্যুটের মতো পরিষ্কার নয়, আবার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলাও যাবে না। এ এমন বর্ণ যার কোনো লিখিত বিবরণ দেওয়া শক্ত, অসম্ভবই বলা যায়।

টাই-স্যুট বলল, ‘সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে … মাথাটা চেক করে নিও কোনো ইমেজ বসে গেছে কিনা …’

গোলআলু চোখ পিটপিট করল – ‘বসে গেলেই বা কী? রিমুভ করে দেবো …’

 

ওদের কথার ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝতে পারছিল না রঞ্জন। এইটুকু বুঝেছিল আজ কোনো বড় জাতের খেলা খেলতে চাইছে ওরা তাকে নিয়ে। আজ কোনো বড় কিছু শিকার করবে ওরা, তাদের পোষা সোনালি ঈগলকে লেলিয়ে!

ওরা দুজনে যখন কথা বলছে, নিজের মোবাইল দেখতে শুরু করল রঞ্জন। অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। পাঁচটা মেসেজ সেলস বাড়বার। দুটো চিমন্তার – বজবজ আর শ্যামবাজারে সেলস কমছে, হুহু করে। এদের হাত থেকে নিস্তার পেলে একবার শ্যামবাজারে যেতেই হবে।

মাথা তুলেই রঞ্জন বুঝল, হাতের নাগালে সুযোগ। ওরা দুজন হাত নেড়ে কথা বলছে। এত গভীর আলোচনা, ওদের কোনো নজর নেই তার দিকে। ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলো ক্যামেরাটা। ফ্ল্যাশ অফ। আলোর ঝলকানিতে ওরা ঘাবড়ে যেতে পারে। এইবার সাবধানে বোতামে চাপ। একবার, দু-বার, তিনবার। নায়কের ছবি উঠেছে, বেঁটেরও।

 

আলোচনা শেষ। ওদের কাজ শুরু। রঞ্জনকে বসান হলো কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে। মাথায় বুকে লাগান নানান তার। কীসব পরীক্ষা হলো। বস্নাড প্রেশার মাপা হলো। রঞ্জনের বরাবর একশ কুড়ি-আশি থাকে। তাই-ই পাওয়া গেল।

এর পরে ওর জামা খুলে পরিয়ে দেওয়া হলো জ্যাকেট। জ্যাকেটের তলায় ধাতব হাতল। ‘এটা কী?’ জিজ্ঞাসা করেছিল রঞ্জন। টাই-স্যুট বলল, ‘ওটা না জানলেও চলবে …।’ বেঁটেটা হাসল – ‘তোমার মন লাগাম ছেঁড়া উন্মত্ত অশ্বের ন্যায় ধাবমান … চিত্ত সুস্থির কর … সুস্থির … নাহলে মোক্ষলাভ হবে কী করে?’ লোকটা খিক-খিক করে হাসল। অন্য সময় এমন হাসি দেখলে রঞ্জন হাত চালিয়ে দিত, কিন্তু আজ হাত উঠছে না। পাহাড়ের মতো ভারী। মাথাও ওদের বশে। রঞ্জন মনের জোর ফিরে পেতে চেষ্টা করল প্রাণপণ। নিজের মস্তিষ্কের ওয়েবলেন্থ পালটে ফেলতে হবে। নন্দিনীর ওপর আগে খুব রাগ হতো, ঘৃণা হতো মারাত্মক। এখনো রাগ হয় কখনো, কিন্তু ঘৃণা হয় না আর। তার মানে নিজেকে পালটান যায়। চিমন্তাকে বাগে আনা যায়। স্ববশে আনা যায় প্রবৃত্তিকে।

প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেনের বাড়ি থেকে বেরোবার পর থেকেই ফিসফিস – সোজা পশ্চিমে চল … হ্যাঁ, দাঁড়াও … এইবার রাস্তা পার হও, সাবধানে … দৌড়তে যেও না, বিপদ হবে … রাস্তা পার হয়ে পশ্চিমদিকের ফুটপাথে ওঠ … ওই বটগাছের তলায় দাঁড়াও … একটু পরেই ধুতি পরা এক ভদ্রলোক আসতে পারেন, তাকে দেখলেই গাড়ি চালিয়ে অন্য জায়গায় সটকে পড়বে, কিন্তু যদি খাকি শার্ট পরা কেউ এসে বলে …

তারপরেই ফট করে আওয়াজ। ফিউজ উড়ে গেলে এমন হয়। ফিসফিস বন্ধ। তাহলে কি প্রথম শিফট শেষ? ঘড়ি দেখল রঞ্জন। নাহ্ এখনো তো হাতে অনেক সময়। হয়তো ওদের লাইনে কোনো গ-গোল …

সেই থেকেই তো এই তিনটে ঝুরিনামা বটগাছের তলায়। রঞ্জন বেশ বুঝতে পারছে বিপজ্জনক অপরাধীদের এই চক্রটা তাকে দিয়ে মারাত্মক সব কাজ করাতে চাইছে। এরকম হলে তলাপাত্র সাহেব বলেছিলেন খবর দিতে। এখনই কি খবর দেবে? না আরেকটু অপেক্ষা করে দেখা যাক ওরা ঠিক কী করতে চায়? এই যে জ্যাকেটটা পরে আছে এতে কী আছে হিরোইন, না আরডিএক্স? যাই থাক, দুটোই বিপজ্জনক। একটা নেশায় খতম করে, অন্যটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। ওরা যে ঠিক কী করতে চায়, জানতে কৌতূহল হচ্ছে খুব। আজ নন্দিনী থাকলে ওকে বলা যেত। অবশ্য বলেই বা কী? নিশ্চয় কোনো মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত আবার। রঞ্জনের কান গরম হয়ে গেল। মেয়েটা সব ব্যাপারে প–তি দেখায়। একটু নাম হবার পর থেকেই ওস্তাদি বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আর এইসব চিমন্তা করে নিজের মন খারাপ করবে না রঞ্জন। দুবার গলা খাঁকারি দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করতেই হাতটা কারো গায়ে লাগল।

– ‘স্যার কেয়া শোচ রহে … জুতা …’, লছমন পালিশের বাক্সটা গাড়ির কাছেই নিয়ে এসেছে।

 

দশ

বিকেলের আলো কমে এসেছে। তবু লছমন ছাড়বার পাত্র নয়, পালিশ করবেই। জুতো ছেড়ে, রবারের চটি পরে রঞ্জন দাঁড়িয়ে। একবার ব্রাশ বুলোবার পর এখন লছমন মন দিয়ে ক্রিম মাখাচ্ছে। আজকাল রাস্তার লাইটের তেজ কম নয়। ফুটপাথের প্রতিটি দাগ এখন স্পষ্ট দেখা যায়। এই যেমন কিছুক্ষণ আগে একটা আহত আরশোলা যে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ড্রেনের দিকে গেল, মন দিয়ে লক্ষ করল রঞ্জন। বিদ্যাসাগর মশায় একালে থাকলে ফুটপাথে বসে লেখাপড়া করতে খুব কিছু অসুবিধা হতো না মনে হয়। মাঝে-মাঝে সুলভ শৌচাগারও ঘুরে আসতে পারতেন। অবশ্য কিছু খুচরো পয়সা সঙ্গে রাখতে হতো।

এই জায়গার একটাই অসুবিধা – নো পার্কিং বোর্ড লাগান। তাতে বিদ্যাসাগরের কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়, কিন্তু রঞ্জনের হচ্ছে। আজকাল ট্রাফিক আইন খুব কড়া। ধরলেই হাজার টাকা ফাইন করে দেয়। এদিকে ট্রাফিক সিগন্যাল খারাপ হয়ে গেছে। সার্জেন্ট মশাই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি সামলাচ্ছেন। এতবার হাত তোলা নামান করতে গেলে তো কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা হয়ে যাবে! ভদ্রলোককে একটু রিলিফ দেওয়া দরকার।

রঞ্জন সোজা চলে গেল সাদা কুর্তার সামনে। ‘স্যার একটু আসবেন আমার সঙ্গে প্লিজ’, কথা শেষ করেই তার
বহু-পরীক্ষা-উত্তীর্ণ হাসি ভাসিয়ে দিলো। পুলিশের লোক সব সময় প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করে – ‘কোথায়?’

– এই তো সামনে … ওই যে লাল গাড়ি, নো পার্কিং বোর্ডের তলায় রাখা … ওইখানে

‘আপনার গাড়ি? ওই নো পার্কিংয়ে … আবার আমায় ডেকে দেখাচ্ছেন …’, ভদ্রলোক কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন।

– দেখিয়ে রাখলাম … কারণ হঠাৎ দেখলে আপনি খুব দোটানায় পড়ে যেতেন … ট্রাফিক সামলাবেন না বেআইনি পার্কিং ধরবেন … তাই না? আর তাছাড়া আপনার হাত ব্যথা করছে না? তখন থেকে দেখছি একা-একা লড়ে যাচ্ছেন –

সার্জেন্ট সাহেবের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘হ্যাঁ তা অবশ্য …’

‘এইজন্যই তো ডাকলাম … আপনি এক কাজ করুন … আমার গাড়িতে বসুন … একটু বিশ্রাম করুন … আসলে আজ আমার বিবাহবার্ষিকী … আমরা ঠিক করেছি এইদিন আমরা দুজন পরোপকারী লোককে আনন্দ দেবো। আমার কাজ একজনকে খুঁজে বের করে তার মন ভালো করে দেওয়া। আমার বউ খুঁজবে অন্যজনকে। রাত্তিরে দুজনে দুজনকার গল্প শোনাব …’ মুহূর্তের মধ্যে এমন একটা বিশ্বাস করবার মতো গল্প বানিয়ে ফেলতে পেরে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল।

ট্রাফিক পুলিশের গলা নরম, ‘ও আচ্ছা বুঝলাম … কিন্তু ট্রাফিক সামলাতে হবে -’

‘ভাববেন না, লছমন সামলে দেবে …’, জুতোয় ক্রিম লাগাতে থাকা লছমনকে দেখাল রঞ্জন।

– অ্যাঁ …

– কেন পারবে না? জুতো পালিশ করবার মতো দুরূহ আর্টিস্টিক কাজ পারছে আর গাড়ি সামলাতে পারবে না … আমি তো কতবার দেখেছি, রাস্তায় পুলিশ নেই, ছেঁড়া জামা পাগল রাস্তা সামলাচ্ছে … মার্সিডিজ চালক অবধি ওই পাগলের হাত-পা নাড়া মেনে গাড়ি চালাচ্ছে … কলকাতার ড্রাইভাররা পাগলের কথা শোনে আর এই লছমনের হাত নাড়া মানবে না …?

এমন অকাট্য যুক্তির তোড়ে সার্জেন্ট সাহেব আগের বারের মতোই বললেন, ‘হ্যাঁ তা অবশ্য … তবু …’

– ভরসা না হলে আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একবার সবকটা দিকের ফ্লো প্র্যাকটিস করিয়ে দিন …

– হ্যাঁ তা অবশ্য করা যায় …

লছমন দাঁড়িয়ে গেল। এবং পেরে গেল। যাকে বলে লেটার মার্কসসহ পাশ। কারণ শুধু ট্রাফিক সামলান নয়। তার
ফাঁকে-ফাঁকে পালিশের কাজটাও করে যাচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণের গাড়ি চালু করেই একবার ছুটে এসে পালিশ করে গেল। পূর্ব-পশ্চিম চালু করে আরেকবার। ডান পাটি আগেই হয়েছিল, বাঁ পাটিটাও এমন করে শেষ হলো। আবার কালি লাগান। শুকনো। তারপর আবার পালিশ।

ইতিমধ্যে সার্জেন্ট সাহেব গাড়ির পেছনের সিটে এলিয়ে বসেছেন। রঞ্জন ওকে একটা বিয়ারের ডিববা ধরিয়ে দিয়েছে। ভদ্রলোক প্রথমটায় লজ্জা-লজ্জা মুখ করে ‘এখন ডিউটিতে আছি’, ‘এখন খাওয়া কি ঠিক’ ইত্যাদি বলবার চেষ্টা করছিলেন। রঞ্জনের অনুরোধের চাপে সেসব মনের বাধা উড়ে গেছে। উনি যতক্ষণ গাড়িতে, নো পার্কিং জোনে গাড়ি রাখার জন্য ফাইন হবার ভয় নেই।

লছমন গাড়ি সামলাচ্ছে। ও উত্তর থেকে দক্ষিণ যাবার জন্য হাত দেখাতেই তামাকের গন্ধ পেল রঞ্জন। ডানে-বাঁয়ে মাথা ঘোরাতে কাউকে দেখা গেল না। অতএব এর উৎস পূর্বদিকে অর্থাৎ তার পেছনে। হুট করে মাথা না ঘুরিয়ে পার্স বের করে সামনে ধরল। মানিব্যাগের ভেতরে একটা ছোট আয়না লাগান আছে। চুল আঁচড়ানোর কাজে লাগে। তা দিয়ে খুব সহজেই দেখা গেল। তিরিশের চৌকাঠে পা দেওয়া এক যুবক ফুটপাথের ভুট্টাওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে। নীল শার্ট, কালো ট্রাউজার্স। হাতে সিগারেট। রঞ্জন কান খাড়া করল।

… ভদ্রমহিলাকে দেখেছ? বয়স হয়েছে … ষাটের ওপর … সামনের দিকে পাকা চুল …

ভুট্টাওয়ালা মাথা নাড়ল, ‘ম্যায় নে তো আভি-আভি দুকান খুলা … নেহি দেখা …’

এইবার যুবক রঞ্জনের সামনে।

– আচ্ছা একটা কথা … আপনি কী আমার মাকে মানে … প্রায় পঁয়ষট্টি বছর … সামনের দিকে –

– পাকা চুল … সাদা শাড়ি, তার জমিতে কালো ফুলছাপ, কালো পাড় … সুহাসিনী হালদার …

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ … দেখেছেন? … আপনি আমার মাকে চেনেন?’, একবার ডান-বাঁদিক দেখল যুবক, ‘উনি কোথায়?’

– বর্ষা সংঘ ক্লাবে আছেন …

– বর্ষা সংঘ মানে লেক গার্ডেনসের দিকের ক্লাবটা?

– হুম … কিন্তু শুনলাম … আপনি নাকি ওকে বাসস্ট্যান্ডের প্যাসেঞ্জার শেডে বসিয়ে পালিয়ে গেছেন …

– উফফ … আবার সেই এক কথা … ছ-মাস হলো এই ব্যারাম ধরেছে … এর আগে কাউকে কিছু না বলে দুবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন … প্রত্যেকবার ওই এক কথা … ছেলে ওকে পথে বসিয়ে পালিয়েছে … কী যে করি …

– ডাক্তার দেখান … মনোরোগ চিকিৎসক … ডাক্তার দেবব্রত সাহা … গুগল সার্চ করলেই নম্বর পেয়ে যাবেন … ভালো ডাক্তার … একজনের লাগাতার হেঁচকি উঠছিল সারিয়ে দিয়েছেন …

– কিন্তু হেঁচকির সঙ্গে আমার মা-র! … মা-র তো হেঁচকি –

– জানি … কিন্তু উনিও তো লাগাতার একই কথা বলে যাচ্ছেন … আপনার বদনাম হচ্ছে …

যুবক ঠিক বুঝতে পারল না রঞ্জন ঠাট্টা করছে কিনা। রঞ্জন নিজেও বুঝল না কেন তার মুখ দিয়ে এমন কথা বের হলো।

অপ্রস্ত্তত ভাব কাটাতে সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘… কিন্তু আর দেরি করবেন না, তাড়াতাড়ি যান … আপনার মা তো ওইখানেই মানে ওই বর্ষা সংঘ ক্লাবেই থাকবেন ঠিক করেছেন …’

– সে কী? …

– তাই তো … ওকে রাখার ব্যাপারে ক্লাবের ছেলেদের খুব উৎসাহ … ওরাই টিভির লোক ডেকে খবর করতে চলেছে আপনার মাকে নিয়ে … শিগগির যান … আপনি থাকেন কোথায়?

– প্রতাপাদিত্য রোড … সামনে … ওই তো ব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা …

– ঠিক আছে … আপনি এখন পা চালান …

যুবক হন্তদন্ত হয়ে দৌড় লাগাল।

 

সামনে দিয়ে একটা ট্রাম চলে যেতেই রঞ্জনের মোবাইল বেজে উঠল। অচেনা নম্বর।

– হ্যালো … হ্যালো কে? …

খুব হালকা আওয়াজ আসছে। মোবাইলের ভলুম বাড়িয়ে রঞ্জন আবার বলল, ‘হ্যালো কে?’

– হ্যাঁ আমি রঞ্জন, রঞ্জন মজুমদার বলছি … আপনি কে?

বাইরের আওয়াজ ঢেকে দিচ্ছে ওপারের কণ্ঠ। রঞ্জন দু-পা এগিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসল। জুতো জোড়া নিয়ে লছমনও হাজির।

অতএব গাড়ির পেছনের সিটের দৃশ্যটা এইরকম – রাস্তার দিকের বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট চিলড বিয়ার পান করে চলেছেন। ওর গায়ে হেলান দিয়ে রঞ্জন। ডেক চেয়ারে শোবার ভঙ্গিতে চটি পরা পা দুটো ফুটপাথের দিকের খোলা দরজায় মেলে ধরেছে। লছমন খুব সন্তর্পণে চটি ছাড়িয়ে জুতো পরাচ্ছে। তার ইচ্ছে দু-পাটি পরাবার পর, নরম কাপড় দিয়ে আরেকবার বুলোবে। যাকে বলে ফাইনাল টাচ।

এমনই প্রেক্ষাপটে রঞ্জনের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। শুধু রঞ্জন নয়, স্পিকার চালু হবার কারণেই হোক অথবা ভলুম পূর্ণমাত্রায় করবার জন্যই হোক, শোনা যাচ্ছে ওপারের কণ্ঠটিও।

– ‘হ্যাঁ, বলুন বলুন আপনি কে,’ নারীকণ্ঠ।

– বললাম তো আমি রঞ্জন … রঞ্জন মজুমদার …

– কি রে রঞ্জু … কেমন আছিস?

ওর ডাকনামটাও জানেন ভদ্রমহিলা!

– রঞ্জু … চিনতে পারলি না তো? হা-হা … আমি নন্দু … নন্দিনী … নন্দিনী রায়চৌধুরী।

রঞ্জনের কথা আটকে গেল। এত বছর পর নন্দিনী ফোন করছে! কিন্তু কতক্ষণ আর আটকাবে। খালি জলের পাইপে প্রথম খেপের জল আসতে যা দেরি। এসে গেলে তা শব্দ করতে-করতে বেরোয়।

– আরে নন্দু ডার্লিং … কেমন আছিস রে তুই … কতদিন যে তোকে দেখিনি … সেই টুনা স্যান্ডউইচ … কতদিন খাইনি … রবিবারের কচুরিও নয় … আয় না রে একদিন –

– তুই এখন কোথায়?

‘এখন … এখন …’ চারপাশটা একবার দেখে নিল রঞ্জন, ‘এই তো প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেনের উলটোদিকে যে বটগাছ, তিনটে ঝুরি নেমেছে … তার তলায় …’

– আহা … কী সুন্দর ডিরেকশন! … বটগাছ তিনটে ঝুরি –

– কেন প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেন বলিনি? … গুগল ম্যাপ খুলে দেখ, পেয়ে যাবি …

– আরে ইডিয়ট, আরো দু-একটা ল্যান্ডমার্ক বল …

– এখানে লছমন দোসাদ বলে একজন আছে, ভালো পালিশ করে, সেও নামকরা –

‘ও মশাই বলে দিন না টালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনে … ভদ্রমহিলা আসতে চাইছেন আর আপনি তখন থেকে হলুদ সিগন্যাল দিয়ে খেলিয়ে চলেছেন … এইবার গ্রিন দিন, না হলে ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যাবে যে …’

ওপার থেকে ভেসে এলো, ‘এ মক্কেল আবার কে? দাঁড়কাকের মতো গলা …’

রঞ্জন হেসে ফেলল – ‘নারে ভদ্রলোক ভালো, নো পার্কিং জোনে আমাকে প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়াতে দিয়েছেন … এখন আমার গাড়িতে বসে একটু জিরোচ্ছেন … কাজের যা ধকল … ওনার নাম …’ এইরে নামটা তো জানা হয়নি। দ্রম্নত ঘাড় ঘোরাল।

‘শুভঙ্কর সেন …’, নামটা বলেই সার্জেন্ট সাহেব বড়সড় ঢেকুর তুললেন। বাতাসে বিয়ারের গন্ধ ভাসতে থাকল।

– শুনলি তো?

– হুম … তোর সেই গাড়িটাই আছে … ফোর ফোর এইট ফোর? … না নতুন কোনো মডেল? ফোন নম্বর তো পালটে গেছে …

– না না সেইটাই …

– শোন তুই অপেক্ষা কর, আমি আসছি … কোথাও যাবি না …

– কেন?

– সুনীল তলাপাত্র ওসি সাইবার সেল, আমায় সব বলেছেন … তুই তো ঝামেলায় পড়েছিস … ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে যাবি … উনিই তো তোর এই নতুন নাম্বার দিলেন –

– হুম … হ্যাঁ, আজ সকালের কাজটা হয়ে গেছে … অপেক্ষা করছি বিকেলেরটার জন্য –

– তুই কোত্থাও যাবি না … আমি না পৌঁছন পর্যন্ত ওয়েট কর ওইখানেই … আমি আসছি রে …

রঞ্জন নিশ্চিমেত্ম গাড়ি থেকে নামল। ডিকি থেকে আরো দুটো বিয়ারের ক্যান বের করে সার্জেন্টকে দিলো – ‘নিন … পকেটে ভরে ফেলুন … কাজ সেরে বাড়ি ফেরবার পথে বাদাম-বাদাম করে মেরে দেবেন …’

সার্জেন্ট গাড়ি থেকে নামলেন, ‘স্যার আপনি খুব ভালো মানুষ … আপনার বান্ধবীকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়ি আসবেন … উনি না আসা পর্যন্ত এখানেই গাড়ি থাক … লছমনকে বলে দিচ্ছি ও আপনার জন্য চা-টা এনে দেবে …’

এইজন্যই কলকাতাকে এত ভালো লাগে। এখানে পুলিশ পর্যন্ত প্রেমিকের পাশে দাঁড়ায়। ছোটখাটো বেনিয়মে ছাড় দেয়।

 

আলো আরো কমেছে, তবু কী মোহময় এই আকাশ। হালকা সোনালির সঙ্গে কমলা রং মিশে যেন গুয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা ছবি! অনচ্ছ এই জলরঙের ছবি কী মানুষ আঁকতে পারে? হয়তো পারতেন অবনীন্দ্রনাথ। এবং অবশ্যই গগনেন্দ্রনাথ। এই মায়াবী আলোয় সব কেমন গঙ্গা-যমুনা মিশে গেল! ছেলে মার সন্ধান পেল, লছমন তার পালিশের লক্ষ্যপূরণ করল – আবার একদিনের জন্য ট্রাফিক পুলিশ সেজে তার কী আনন্দ! চিকুদার সঙ্গে অনিমার ঘনিষ্ঠতা নিশ্চয় আরো বাড়বে, সার্জেন্ট সাহেব কাজের মধ্যে একচিলতে ফুর্তির ফাঁক পেয়ে গেলেন। নন্দিনী খুঁজে পেল রঞ্জনকে। এখন একটাই কাজ বাকি।

গাড়ির মধ্যেই জামা খুলে ভেতরের জ্যাকেটটা শরীর থেকে ছাড়িয়ে নিল। এ হিরোইন, আরডিএক্স যাই হোক রঞ্জনের কিছু এসে-যায় না। ডিকিতে রাখা খুলে পুরনো খবরের কাগজে জড়িয়ে নিতেই বেশ নির্দোষ দেখাল প্যাকেটটা। কলকাতার মস্ত সুবিধা, ময়লা ফেলার একটা আদিগঙ্গা আছে। তা স্থানে-স্থানে নির্জন। এবং তা কাছেই। হাঁটতে-হাঁটতে ওইখানে গিয়ে আড়াল করে এই পাপের মাল বিসর্জন দেওয়া খুবই সহজ। আদিগঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে মনে হলো, কাজটা এতটাই সহজ, রাম-শ্যাম-যদু-পাঁচু যে-কেউই করতে পারে। তাহলে আর সে রঞ্জন কেন? অতএব, কিনারা থেকে ফিরে আসতে হলো। ফেরার পথে লছমনের হাতে দিলো প্যাকেটটা – ‘সাবধানে রেখ, আমার বন্ধু সুনীলবাবু কিছুক্ষণের মধ্যে এসে নিয়ে যাবে …।’ তারপর টেক্সট পাঠানোই বাকি  –

তলাপাত্র সাহেব, আজকে ওরা আমাকে বড় কাজে লাগাচ্ছিল। এখনো পারেনি। সাদা গুঁড়ো ভরা একটা প্যাকেট দিয়েছিল, যা লছমনের কাছে রেখে যাচ্ছি। যে দিয়েছিল তার ছবিও পাঠালাম। বাড়ির ঠিকানা বুঝতে পারিনি, তবে রহিমুদ্দিন লেন, নিশ্চিত। লছমনকে খুঁজে পাওয়া অসুবিধা হবে না। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাশেই বসে। না পেলে ফাঁড়ির কাছে যে ট্রাফিক সার্জেন্ট আছেন আজ, শুভঙ্কর সেন, ওর থেকে জেনে নেবেন …।

কিছুক্ষণ পর, আবার দ্বিতীয় মেসেজ – ‘আর হ্যাঁ, সম্ভব হলে লছমনকে সাহসিকতার পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করবেন। সম্মান পেলে এইসব মানুষ অনেক কিছু করতে পারে।’

ব্যস, এইবার মন ঠান্ডা। আর কোনো চিমন্তা নেই। নন্দিনী আসছে। সমস্ত লাল আলো সবুজ করতে-করতে নন্দিনী এগিয়ে আসছে রঞ্জনের দিকে। মস্তিষ্কের ওয়েবলেন্থও যেন বদলে গেছে। রঞ্জন নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট করল। সে যাবে উত্তরে – শ্যামবাজার। নন্দিনী যে আসছে? চলুক, নন্দিনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলা চলুক।

গাড়ির আওয়াজ শুনে লছমন ছুটে এলো, ‘স্যার আপকা তো ঠ্যাহরনা থা …’

অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিলো রঞ্জন। লছমনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, ‘টা টা …’