শৈশবের বানরেরা কোথায় হারাইয়া গেল

যদিও সায়েন্স ল্যাবের ভিড়মগ্ন রাস্তাঘাট মানুষ এবং নানা কিসিমের (বাস, জিপ, প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, মোটরসাইকেল, রিকশা ইত্যাদি …) যানবাহনে বিপর্যস্ত, যদিও এলিফ্যান্ট রোডের দোকানগুলো শাড়ি, বস্নাউজ, ব্রা, পাঞ্জাবি, বাহারি জুতা, চশমা, ঘড়ি, শোপিসে ঠাসা এবং এসবের প্রাচুর্যে যদিও বানরবিষয়ক ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় তবু আবুল কাসেমের মাথায় এ-ভাবনাই লাফঝাঁপ মারে। এমনকি শৈশবে দেখা সেই বানরনাচ, নাচ-দেখানো লোকগুলোর যন্ত্রবৎ উচ্চারণও তার কানে বাজে।

– এইবার দেহাও তো ভুলু (বান্দরের নাম এ-টাইপের রাখা হয়) মিঞাসাব লাডি আতে কেমনে হাইট্টা যায়।

– দেহাও পরহেজগার নারী কেমনে নমাজ পড়ে।

– দেহাও মাইর খাওনের পরে বউ কেমনে গালো আত দিয়া রাগ কইরা বইসা থাহে …।

এসব কর্মকা- প্রদর্শনের সময় বান্দরটা মোটেও বানর থাকতো না। একেবারে ক্লাসের ফার্স্টবয়ের মতো ঠিকঠাক ও নির্ভুলভাবে সব কসরত অনুকরণ করে দেখাতো। আর খেলা-দেখানো লোকটা নিজ সন্তানের কৃতিত্ব প্রদর্শনের তৃপ্তিতেই যেন দর্শকের দিকে প্রসন্ন চকচকে চোখে তাকাতো। দৃষ্টি যেন বলতো – দেহুন মিয়ারা আমার বান্দরডারে আস্তা একটা মানুষ বানায়া ফালছি …। শৈশবে আবুল কাসেম আজকের মতো আবুল কাসেম ছিল না। কাইস্যা, কাসেইম্যা – নিদেনপক্ষে কাসু। তখন তার বয়স কত আর, আট কী নয়! ঢিলে-হয়ে-যাওয়া প্যান্ট, যা সবসময় তার দুভাগ হয়ে যাওয়া পাছা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিতো। সেই প্যান্ট সামলাতে সামলাতে পাড়ায় আসা বানরখেলা, কী সাপখেলা, ভানুমতির ভেল্কি কিংবা ‘কী চমৎকার দেখা গেল, ঢাহা শহর আইসা গেল’র মতো বায়োস্কোপ দেখার ধান্দায় থাকতো। গরিবঘরের বাপছাড়া ছেলের যা হয় – দড়ি-ছেঁড়া গরুর মতো এদিক-সেদিক ঘুরতো। তার বয়স এখন চলিস্নশের কাছাকাছি। কাসেম সাহেব না হলেও সায়েন্স ল্যাবের ছককাটা ছয়তলা শপিংমলের একটা পাঞ্জাবির দোকানের মালিক সে। সারাবছর বলতে গেলে বিক্রিবাট্টা হয় না। তবে ঈদ পরবে তা পুষে যায়; এই মুনাফায় বছর নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়ে ব্যাংকে সঞ্চয়ও থাকে। রোজার ঈদে সারা ঢাকা শহর ভেঙে লোকজন এখানেই আসে মাস্টারপিস পাঞ্জাবিটা কিনতে। যতই গুলশান, বসুন্ধরা আর ইস্টার্ন পস্নাজা ঘুরুক না, অবশেষে এলিফ্যান্ট রোড সায়েন্স ল্যাবের মোড়-সংলগ্ন লংলা পাঞ্জাবি ওয়ার্ল্ড পাঞ্জাবির আসল বাজারে খোঁজাখুঁজি করেই ঈদের পাঞ্জাবিটা কেনে।

আবুল কাসেম এখন দোকানিদের কাছে কাসেমসাব হিসেবে পরিচিত। কাসেমসাব বেলা ১১টায় দোকানে আসে। অবশ্য এর আগেই তার কর্মচারী কানা মাহবুব দোকান খুলে ঝাড়পোছ করে বওনি করার তালে থাকে। যেদিন কাসেমসাব আসার আগেই ‘বওনি’ হয়ে যায় সেদিন কানা মাহবুবের এক চোখের বলক ওঠা খুশিই তা জানিয়ে দেয়।

 

সকালের চা দোকানে এসেই পান করে কাসেমসাব, চা পেয়ালার কান ধরে সায়েন্স ল্যাবের চৌরাস্তায় চোখ রাখে। তার দোকানের উলটো দিকে পুলিশ বক্স হয়ে ধানম–, ঢাকা সিটি কলেজ, জিগাতলা যাওয়ার ফুটওভার ব্রিজে ওঠার তাক তাক সিঁড়ি। বাস-কাউন্টারগুলোও ওখানে। ছাতা আর টেবিল বসানো কাউন্টারে টিকিট নিয়ে বসে থাকে অসহিষ্ণু চেহারার কিছু লোক। মৈত্রী, তরঙ্গপস্নাস, ফাল্গুন, শ্রাবণ – এরকম সুন্দর নামের বাসগুলোর হেলপার, কন্ডাক্টর আর ড্রাইভারদের হর্নের চিৎকারে জায়গাটা সারাক্ষণ শব্দদূষণে আচ্ছন্ন থাকে। এর মধ্যেই বাসে ওঠার জন্য হবু যাত্রীর ব্যাকুল অপেক্ষা। কাসেমসাব প্রায়ই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করে। এদের মধ্যে দু-চারজন প্যাসেঞ্জারকে সে প্রায় প্রতিদিনই দেখে। পরিপাটি বেশবাস, সুদৃশ্য স্যুট-টাই সত্ত্বেও লোকগুলোর অবয়বে একটা কুতকুতে ভাব লক্ষ করে সে। এমনকি এদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি অন্য যাত্রীদের মতো ঋজু কিংবা টেনশনযুক্ত নয়। এদের অস্থির চঞ্চল অভিব্যক্তিকে শুধু তুলনা করা যায় বাঁদরের সঙ্গে। লোকগুলোর ঘাড়ে বসানো মাথাগুলো অবিকল বাঁদরের মুদ্রায় কুঁইকুঁই করে এদিক-সেদিক ঘোরে। কাসেমসাবের ধারণা, এরা কোনো পণ্যের ভাসমান বিক্রয় ও প্রচারকর্মী। হাতে বহন করা পেটফোলা মজবুত ব্যাগগুলো কখনো এরা কাছছাড়া করে না। এ-লোকগুলোর সঙ্গে পরিচয়ের কোনোরকম যোগসূত্র না থাকলেও এদের ভীষণ চেনা চেনা লাগে। কিন্তু এই রহস্যের কোনো কূলকিনারা পায় না কাসেমসাব। ‘- এই কাইস্যা কতা কানো যায় না তর?’ একটা কর্কশ সম্বোধনে কাসেমসাব ক্রোধে লাল হয়। তাকে কেউ ডাকছে! সে মিস্টার আবুল কাসেম না হলেও কাসেমসাব তো বটে। এলিফ্যান্ট রোডের মতো জায়গায় নিজের দোকান, মিরপুর দশ নম্বরে তার সাড়ে বারোশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। কাইস্যা ডাক এখন বরদাস্ত করা যায় না। তেজি আর চোখা রাগে চোখেদুটো লাল হওয়ার আগেই ভুলটা ভাঙে। ফুটপাতে বসা পান- দোকানদার তার নয়-দশ বছরের ছেলেকে গলার রগ ফুলিয়ে ফুলিয়ে আবারো ডাকছে ‘অ কাইস্যা …’। তবে এ-সম্বোধন ঝট করে তাকে কাইস্যা অথবা কাসেইম্যা বা কাসু পরিচয়ে ঠেলে নিয়ে যায় পেছনে।

ময়মনসিংহের একটা সাদামাটা শহরতলি ‘চুকাইতলা’। এখানেই আবুল কাসেমের জন্ম। বোধোদয় হওয়ার পর থেকে সে শুনে আসছে লোকজন তাকে বান্দরের পোলা বলে ডাকে। কাসেমের মা হওয়ার আগে শুক্কুরি এক বানরওয়ালাকে বিয়ে করে চুকাইতলায় কেবল শোরগোলই ফেলে না, নিজেও পড়ে চরম বিপাকে ।

চুকাইতলার অধিকাংশ লোক দরিদ্র। পেশায় তারা কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি হলেও এদের কেউই বানরখেলা দেখানোকে জীবিকা হিসেবে নেয়নি। এসব মিস্ত্রি আবার সারাবছরই প্রায় বেকার বসে থাকে। কাজকামের অভাবে এরা তখন তাদের কেরদানি দেখানোর সুযোগই পায় না। তবু তারা ‘বান্দরখেইল’কে মর্যাদাহানিকর পেশা হিসেবে গণ্য করে। ফলে, এলাকার এতিম যুবতী শুক্কুরি বানরওয়ালাকে বিয়ে করায় তারা ভীষণ বিরক্ত ও নাখোশ হয়ে ওঠে। তবে শুক্কুরিকে বেশিদিন এ-লোকের বউ হয়ে থাকতে হয় না। বিয়ের মাসতিনেকের মাথায় ‘ভুলু’ নামক বান্দরের মালিক তার পোষা বানর নিয়ে পালিয়ে যায়। ততোদিনে শুক্কুরির বিবাহিত হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। সে সন্তানসম্ভবা। প্রসবের পর নবজাতককে দেখার জন্য পাড়ার মহিলার দল অতিমাত্রায় কৌতূহলী হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, শিশুটি দেখে তারা তাদের নানা অভিমতও নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে থাকে।

আতরজান থুতনি নাড়ায় – পোলাডা এক্কেরে বান্দরের লাহান …

লেবুর মা মুচকি হাসি মারে – একটা লেংগুর থাকলেই অইত …

বানরের বাচ্চা জন্ম না দিয়েও শুক্কুরি বান্দরওয়ালার বউ থেকে বান্দরের মা বনে যায়। এলাকায় কেউ তাকে আর কাজকর্ম দেয় না। একলা থাকলে যেমন-তেমন সন্তান জন্মের পর একেবারে মরার জোগাড় হয় শুক্কুরির। ক্ষুধার জ্বালায় এলাকার বাইরে বের হয় সে। কিছুদিনের মধ্যেই চুকাইতলাবাসী দেখে শুক্কুরি পুরনো কাপড় বিক্রির ব্যবসা ধরেছে। পাড়াপড়শি আবার কৌতূহলী, ব্যবসার টাকা কোত্থেকে পেল শুক্কুরি? অগত্যা তাদের জানাতেই হয় যে, কালিদাস থেকে টাকা ঋণ নিয়েছে সে। পরহেজগার দরিদ্র এলাকাবাসী এবার প্রচ- নারাজ হয়ে ওঠে। কালিদাস নামক হিন্দুর কাছ থেকে কর্জ করা টাকায় জীবিকা নির্বাহ করে মুছাম্মত শুক্কুরজান ওরফে শুক্কুরি রিজিকদাতা আল্লাহ্কে নাখোশ করেছে! এবার মা ও পুত্রকে একঘরে করা হয়। সে-শিশুপুত্রটি এখন বালক।

আসল মজা হলো চুকাইতলাবাসী বান্দরওয়ালাকে বিয়ে করা যতো অপছন্দ করতো; ততোই পছন্দ করতো বান্দরখেইল দেখতে। এলাকায় ঘনঘন বানরওয়ালাদের দেখা যেতো। কিচলু নামে এক নতুন বানরওয়ালা এলো তার জোড়া-বান্দর লালু-বুলুকে নিয়ে। কিচলু বিগত বানরওয়ালাদের চেয়ে এলাকার দর্শকদের বেশি বিনোদন দিতে থাকে। তার জোড়া-বান্দর মোহাম্মদ আলী ও জো ফ্রেজারের বক্সিং দেখাতো, টান টান দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার চমক দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতো।

শুক্কুরির ছেলে বান্দরের পোলা ততোদিনে নতুন নাম কাইস্যা হিসেবে চুকাইতলায় পরিচিতিলাভ করে। কাইস্যা তার ঢিলে হয়ে যাওয়া প্যান্ট সামলানো ছাড়াও মাঝেমধ্যে কিচলুর জোড়া-বানরের দেখভাল করতো। বিনিময়ে কাসেম পেতো কলা বা বনরুটির টুকরাটা। শুধু খাবারের লোভেই নয়, বরং বানরদুটোর প্রতিও কাইস্যা অব্যাখ্যাত এক মমতা বোধ করতো। যেন লালু-বুলু ওর দুটি ভাই!

খেলা দেখিয়ে কিচলু তার বানর নিয়ে চলে গেলে পাড়ার শিশু-কিশোরেরা কাসুর পেছন পেছন হাঁটতো –

বান্দর বান্দর ভেচকি

তর নানিরে দেখছি …।

এতে ঢিলা প্যান্টের বালক কাসেম রাগ করতো না, বরং কলা ও বনরুটি খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে হাসতো।

কিচলুর চেয়ে বানরগুলোর সাথেই কাইস্যার বেশি সখ্য দেখা যায়। বানরের মালিক পেশাব করতে গেলে কিংবা মসজিদে কখনো নামাজে ঢুকলে নিশ্চিন্তে কাসেইম্যার জিম্মায় লালু-বুলুকে রেখে যেতো। কখনো ক্লান্ত বোধ করলে কারো বাড়ির দাওয়ায় সংক্ষিপ্ত ঘুমও সেরে নিত। এ-বিষয়ে ছেলেটার প্রতি তার পুরো ভরসা ছিল। লালু-বুলুর প্রতি কাসেমের দরদ খেয়াল করেছে কিচলু। চুকাইতলাবাসী বলাবলি শুরু করে – কাইস্যা বান্দরের ভাষাও বোঝে। এমনকি দু-একজন দাবি করে তারা নিজের চোখে কাসুকে বান্দর দুটোর সঙ্গে হাত নেড়েচেড়ে কথা বলতে দেখেছে। বানরওয়ালার প্রাক্তন স্ত্রী আবুল কাসেমের মায়ের তো আর বান্দর নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না। স্বামী তাকে বিপাকে ফেলে চলে গেলে  সংগত কারণেই এ-পেশার প্রতি তার জন্মায় তীব্র ঘৃণা। চোখের সামনে ছেলের বান্দরওয়ালা হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখে শুক্কুরি শঙ্কিত হয় – ‘নাহ্, এইহানে আর থাহন নাই।’ এলাকা ছেড়ে শুক্কুরি শহরের এক বস্তিতে ওঠে। ব্র্যাকের স্কুলে হাতেখড়ি হয় কাইস্যার। স্কুলেই সে তার আসল নামটার মালিক ‘মো. আবুল কাসেম’ হওয়ার সুযোগ পায়। শুক্কুরজানের পুরনো কাপড়ের ব্যবসাও চলে কালিদাসের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকায়। ভালো মুনাফার মুখও সে ইতোমধ্যে দেখতে শুরু করে।

কাসেম এখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ঋণ শোধ করার জন্য কালিদাসের অফিসে যাওয়ার সময় একদিন শুক্কুরজান ছেলে আবুল কাসেমকেও সঙ্গে নেয়। তার ভাবনায় আসে – ‘ছেড়াডাও একটু-আধটু জানুক, লায়েক হউক।’ মা হিসেবে শুক্কুরি এ-প্রত্যাশা করতেই পারে। কাসেম অফিসে ঢুকে ঋণ প্রদানকারী অফিসের সাইনবোর্ডটা পড়ার কৌতূহল বোধ করে ‘কারিতাস একটি দেশীয় সাহায্য সংস্থা’। শুক্কুরি আসলে কারিতাস থেকেই ঋণ নিয়েছিল।

শুক্কুরজান একসময় পুরনো কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে নতুন থান কাপড়ের কারবার শুরু করে। বস্তি ছেড়ে ভাড়া নেয় মধ্যবিত্ত পাড়ার একটি দুই রুমের বাসা। পড়ালেখার পাশাপাশি কাসেম মাকে ব্যবসায় সাহায্য করে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর কাসেম আর উচ্চশিক্ষায় উৎসাহ পায় না। পুরোদমে ব্যবসা শুরু করে।

বান্দরখেইল ক্রমশ লোপ পেয়ে এলেও কিছু বানরওয়ালা আজো পোষা বানরের কৃতিত্ব প্রদর্শন করে জীবিকা চালায়। আবুল কাসেমের চোখ এখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো খেলা দেখে। ছেলের এ-কা-কারখানায় শুক্কুরজান আবার আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। – ‘আর মমিসিং না!’ এ-ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য একদিন সব হিসাব চুকিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঢাকার ট্রেনে উঠে পড়ে শুক্কুরি। কাসেম সবসময়ই শুক্কুরজানের অনুগত। প্রভুর কাছ থেকে অনুকরণ শেখা বানরের মতো সেও মাতৃ-আদেশ যথাযথ পালন করে।

ঢাকায় এসে মা-বেটা ওঠে কামরাঙ্গীরচর। ফুটপাতের জাঙ্গিয়া-গেঞ্জি ব্যবসায়ী আবুল কাসেম কঠোর শ্রমে একদিন হয়ে ওঠে সায়েন্স ল্যাবের ‘রোদেলা শপিংমলে’ পাঞ্জাবির দোকানের মালিক। ১৯৮০ থেকে ২০১৩ – দীর্ঘ সময় ধরে আন্তরিক চেষ্টায় কাইস্যা এরই মধ্যে আবুল কাসেমসাব হয়ে ওঠে। এ সময়ে কত ঘটন-অঘটন!

– ১৯৮০ – সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হন।

– ১৯৯০ – গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন।

– ২০০৮ – বিপুল ভোটে শেখ হাসিনার নির্বাচনী বিজয়।

– ২০১৩ – রানাপস্নাজা ধসের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বেলা ১১টায় আবুল কাসেমসাব এসে সকালের প্রথম চা-পেয়ালা হাতে দোকানের সামনে দাঁড়ায়। আজ যেন ঢাকা শহরে কী হয়েছে! ভয়াবহ যানজটে সায়েন্স ল্যাব স্থবির। প্রতিটি বাসে উপচেপড়া ভিড়। বাস-কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমাণ যাত্রীর দীর্ঘ লাইন। বনশ্রীগামী একটা ‘তরঙ্গপস্নাস’ থামতে না থামতেই ওঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পণ্য বিক্রয়কর্মীদের (আনুমানিক হলেও কাসেমসাব এ-ভাবনাকেই প্রশ্রয় দেয়) দুজন অসম্ভব পারদর্শিতায় বাসের হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়ে এবং ঝুলন্ত অবস্থাতেই তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে। ওদের এই লটকে থাকা ভঙ্গিতে বানরের মুদ্রা প্রকটিত হয়ে উঠলে আবুল কাসেম ওদের পশ্চাতদেশে সত্যিকারের একটা লেজ দেখার প্রত্যাশায় তীক্ষন দৃষ্টি দিয়েও ব্যর্থ হয়। বাকি দুজন পণ্য-বিক্রেতা দু-তিন লাফে রাস্তা পার হয়ে এপাশের  ফুটপাতে এসে কলা-বিক্রেতার ভ্যানগাড়িতে হামলে পড়ে। বলা বাহুল্য, কাসেমসাব লোক দুজনের প্রতি একধরনের চৌম্বকীয় আকর্ষণ বোধ করলে তাদের কাছাকাছি না গিয়ে থাকতে পারে না। ডজনখানেক কলা সাবাড় করে ওরা তখন কলার মূল্য পরিশোধ নিয়ে তর্ক করে।

– কলার দাম তুই দিয়া দে লালু।

– না রে বুলু ভাংতি নাই। এইবারের মতো তুই চালায়া দে।

বিস্মিত কাসেমসাব কৌতূহল দমনে অপারগ হয়ে ওদের সঙ্গে যেচে কথা বলে – ‘ভাইসাবরার বাড়ি কি মমিসিং? চিনা চিনা লাগতাছে?’ কাসেমের দিকে দৃষ্টি পড়তেই লালু-বুলু উচ্ছ্বসিত হয়ে লাফিয়ে ওঠে। এতে রোদেলা শপিংমলের সামনের ফুটপাতে লুপ্তপ্রায় বান্দরখেইল প্রদর্শনের একটা আমেজ ফুটে ওঠে। বুলু নামক পণ্য-বিক্রেতা আবুল কাসেমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে – ‘বান্দর বান্দর ভেচকি …।’ বাকিটা শেষ করে অপর পণ্যকর্মী লালু – ‘তর নানি রে দেখছি …।’ ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো তড়পায় কাসেম – ‘তাইলে তুমরাই কি … কিন্তু সেইটাই বা হয় কেমনে …!’ বুকের মধ্যে অব্যাখ্যাত দরদ অনুভব করে কাসেম। ওপাশের কাউন্টারে আরো একটা ‘তরঙ্গপস্নাস’ এসে দাঁড়িয়েছে। বিক্রয়কর্মী দুজন চোখের পলকে চলমান গাড়ির ফাঁক-ফোকরে বাস কাউন্টারে ফিরে যায় লাফাতে লাফাতে। তারপর অসামান্য দক্ষতায় প্রচ- ভিড়-উপচানো বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলে যায়। হতবিহবল আবুল কাসেম ওরফে কাইস্যা আকুল হয়ে ভাবে, ‘আমার শৈশবের প্রিয় বান্দরেরা কুথায় হারাইয়া (কল্পনায় সাধু-চলিতের মিশ্রণ দূষণীয় নয়) গেল অথবা আসলেই কি তারা হারাইয়াছে?’