Songon soronong

সংঘং সরণং গচ্ছামি?

আমার কাছে নরেশ গুহ নামটা প্রথম এসেছিল বাংলার ‘সবচেয়ে সুরেলা’ কবি হিসেবে। দুরন্ত দুপুর। সিগনেট সংস্করণ। চমৎকার ছাপা। তন্বী এক কবিতার বই। আমাদের সেই বয়সের চোখের স্বপ্ন। সঙ্গী বই ছিল নীরেন্দ্র চক্রবর্তীর নীল নির্জন। এই দুই বইয়ে আমার কৈশোর তখন ভরে ছিল। বন্দীর বন্দনা আমি হাতে পেয়েছি কিছুটা পরে। একে আমাদের তখনকার ছোটো মফস্বল শহর, প্রায় পাড়াগাঁ বলাই ভালো। কোথায় বইয়ের দোকান, কোথায় পত্রপত্রিকা, কোথায় কী। তাছাড়া তখনকার উদ্বাস্ত্ত দিন। চালচুলোর চিন্তায় গুরুজনদের দিনরাতের ঘুম উধাও। তারই মধ্যে আমরা দু-ভাই, আমি আর আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো আমার এক খুড়তুতো দাদা। এর কথা আমি টুকটাক আগেও এখানে-সেখানে বলেছি। সে আজ নেই। তখন আমাদের সারাটা দিন এবং সমস্ত রাত্রি কাটত একসঙ্গে। সাহিত্যে আমার হাতেখড়ি, হয়তো তারই কাছে। সে হয়তো জীবনে ‘সফলতা’ যাকে বলে তা পায়নি। কিন্তু সাহিত্য ভালোবাসা বলতে কী বোঝায় তা আমি তাকে দেখে শিখেছি। সে তখন নিজের উদ্যমে জোগাড় করে আনত টুকরো কথা। আমরা তখন ওইসব নিয়েই মেতে থাকতাম। স্কুলের মধ্যেও, প্রায় গোপনে, নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো, অল্প দু-চারজনকে নিয়ে গড়ে তোলা গিয়েছিল প্রায় যেন এক গুপ্ত সমিতি। আমরা তখন বড়ো হচ্ছিলাম।
বিভাব সংস্করণে টুকরো কথা যেদিন হাতে এলো সেদিন ঝাঁপিয়ে এসেছিল এইসব স্মৃতি। আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে। কিছুই কি নেই বাকি। কী জানি।
একদিন আমরা যেন আচমকা বড়ো হয়ে গেলাম। ১৯৫৬। যাদবপুর। আমরা কয়েকজনে যাদবপুরের আনকোরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নাম লেখালাম। দল বেঁধে তা নয়। প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো আলাদা আলাদা কারণে। একসঙ্গে গিয়ে একই খালেবিলে মিশে যাওয়া। শহরের অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন শতবর্ষ পালনের তোড়জোড় চলছে। আর আমরা কিনা ওই উটকো ৮বি বাসস্ট্যান্ডে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলেছি। বন্ধুবান্ধবের মুখে তখন এসব কথা শুনতে হয়নি তা নয়। ঠাট্টাতামাশা আরো কতই ছিল। তা থাক। কিন্তু আমাদের কোনো আপশোস ছিল না। চলতে ফিরতে পথেঘাটে কাদের দেখছি আমরা। ওই ৮বি বাসেই বসার সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলেছেন বুদ্ধদেব বসু। ছোটোখাটো চেহারার মানুষ। ধরবার রডটাও ভালো করে হাতে পাচ্ছেন না। আমাদের চোখে পড়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে বসার কথা বললে নরম গলায় প্রত্যাখ্যান করছেন। আমরা একটু জোর করে ওঁকে বসিয়ে দিচ্ছি। ক্লাস নিচ্ছেন সুশোভন সরকার। ঘরের এক ধার থেকে আর এক ধারে পায়চারি করতে করতে ছিমছাম বাক্যে বিশেস্নষণ করে চলেছেন ইউরোপের ইতিহাস। একটু বিমর্ষ মুখে হেঁটে চলেছেন ধুতি পাঞ্জাবি পরা অজিত দত্ত। মালতী, তোমার মন নদীর স্রোতের মতো চঞ্চল উদ্দাম; মালতী, সেখানে আমি আমার স্বাক্ষর রাখিলাম। এমনকি প্রায় অন্য জগতের বাসিন্দা রূপবান সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও পাওয়া যাচ্ছে আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে তাঁর গাড়িতে ওঠার মুখে। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু-চার কথা বলে নেবার অসুবিধে নেই। আমরা যে ওঁর বিভাগের কেউ নই, তাতে কিছু এসে যেত না। আজকের সাব্অলটার্ন ইতিহাসখ্যাত রণজিৎ গুহকেও তখন আমরা পেয়েছি হাতের কাছে। ধুতি ও খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবিতে। আমরা ভাগ্যবান। আরো পেয়েছি। তখনকার সবচেয়ে প্রবীণ প–ত মানুষ সুশীলকুমার দে। গিলে করা ধুতি পাঞ্জাবিতে সুশোভিত। ওইসব মস্ত বইয়ের লেখকদের যে এরকমভাবে বারান্দায় হাঁটাচলা করতে দেখা যায় এবং যখন-তখন স্যার, এটার মানে কী, ওটার মানে কী জিজ্ঞাসা করা যায়, এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। আমাদের এই মাস্টারমশায়েরা তাঁদের মনীষা ও প্রতিভায় কেউ আমাদের কাছে সুদূর ছিলেন না। আর আমাদের বিভাগের উজ্জ্বল তরুণ অধ্যাপক ছিলেন অমর্ত্য সেন। তখনো তিনি প্রধানত সম্ভাবনা। নরেশ গুহকে আমি চাক্ষুষ পেয়েছি এই পরিম-লে। সেই প্রথম। তারপরে নানাভাবে, নানা স্তরে পেয়েছি তাঁর স্নেহ।
আমি তো সরাসরি ওঁদের ছাত্র নই। তবে আমার বন্ধুদের মধ্যে মানব, অমিয়, নবনীতা, প্রণবেন্দু সবাই ওঁদের ছাত্রছাত্রী। বিশেষ করে মানবের সুবাদেই বোধহয় আমি নরেশদার স্নেহ পেয়েছি, অনেকটাই মনে হতো আমার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি।
আমাদের ছাত্র বয়স কেটে গেল। তার পরে কেমন করে যেন একে একে আমরা পড়াবার বেলাতেও এসে সবাই যাদবপুরে জুটে গেলাম। তখন তো আর্টস্ ফ্যাকাল্টিতে আমি রীতিমতো নরেশদার সহকর্মী। হয়তো আমরা মাঝেসাঝে বেয়াড়াপনাও করেছি। একটা সময়ে তিনি তো আমাদের ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন। তখন কোনো ব্যাপারে টানাপোড়েন হয়নি তাও নয়। তবে তাতে কিছু এসে যায়নি।
নরেশদা তখন যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছেন। বুদ্ধদেব ততদিনে বিভাগের অতীত ঐতিহ্য। অমিয় তাঁর একান্ত সহায়। বিভাগের টুকিটাকি কাজ শেষ হয়নি বলে অমিয় নরেশদার সঙ্গে আটকে আছে। আমরা পাশের ঘরে অপেক্ষা করছি। শেষ বেলায় সন্ধের আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরব। এ-দৃশ্য এখনো স্মৃতিতে পরিষ্কার। নরেশদার কবিতা পাঠকেরা তাঁর কবিতার কথা ভুলতে বসেছে। কবিতা লিখছেন কিনা জানা নেই, ছাপছেন না বেশি, প্রায় ছাপছেন না বললেই চলে। যাদবপুরের কাজে নিজেকে অনেকখানি জড়িয়ে ফেলেছেন। হয়তো একটু বেশিই। তা নিয়ে আমাদের মতো দু-একজনের হয়তো কিছু খুঁতখুঁতিও ছিল। যাঁর হাতে কবিতা আছে, তিনি কেন ওইসবে অতটা, … এই আর কি। ওঁকে তখন সে-কথা বলার প্রশ্নই ছিল না, তাঁর সঙ্গে সে-সম্পর্ক একেবারেই নয়।
দরজা একদিন অল্প একটু ফাঁক হলো এক দুপুরে। নরেশদার বসার ঘর ছিল দোতলায়। সে-ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়েই আমাদের দু-বেলা ওঠানামা। আমরা চারতলার বাসিন্দা। আমার কবিতা পত্রিকার দু-একটা পুরোনো সংখ্যা দেখা দরকার। তেমন কিছু ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও এসব ব্যাপারে খুব সংকোচের কোনো কারণ ছিল না। আমি একদিন ওঁর ঘরে ঢুকে বললাম আমার দরকারের কথা। বললেন, কোন কোন সংখ্যা? আমি বোধহয় একটা চিরকুটে লিখেই নিয়ে গিয়েছিলাম। চিরকুটটা হাতে নিয়ে বললেন, বুদ্ধদেবের পরিভাষা সংকলন। আসলে আমি তখন বাংলা পরিভাষা নিয়ে একটা দুটো লেখার চেষ্টা করছিলাম। বুদ্ধদেব বসু একসময়ে মূলত সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক কিছু পরিভাষা সংকলন ও নির্মাণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো করেই ছিলেন। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় সংকলিত হতো আরো নানা বিষয়ের পরিভাষা। তা এইসব নিয়ে তখন আমার বেশ কিছুটা সময় কেটেছিল। এইসব করতে করতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে মিলেমিশে পরিভাষা নিয়ে আরো কিছুটা সময় কাটানো গিয়েছিল একসময়ে।
বুদ্ধদেবের পরিভাষার কাজ নিয়ে আমার আগ্রহ শুনে কিছুটা ভুরু কুঁচকে ওঁর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন সেদিন। বললেন, কত রকমের কত কাজ এঁরা করেছিলেন, বলুন। আমি বললাম, আপনার বাড়িতে বসেই যেটুকু কাজ আমি করে আসব। একটা দিন ঠিক হলো।
নির্ধারিত দিনে সকালবেলায় সত্যেন দত্ত রোডের ফ্ল্যাটে গেলাম। আমি আগেও দু-একবার গেছি সেখানে এ-কাজে সে-কাজে। আমাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। দেখলাম টেবিলের পরে কবিতার নির্দিষ্ট দুটি খ- বের করে রাখা আছে। চা এলো। সঙ্গে আহার্য ও টুকিটাকি এলো। চা খেতে খেতে নরেশদা কথা বলে যাচ্ছেন। নানা বিষয়ে। যাদবপুরের প্রসঙ্গ তো ছিলই। রাজনীতির কথা ছিল। যুবকদের আদর্শবাদ নিয়ে মায়ার টান ছিল, তবে রাজনীতির ওই ধরনটা অনেকেরই পছন্দ ছিল না। সেসব কথা এলো। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, এই সেস্ন­vগানের সমস্যা নিয়ে কথা হলো। ওঁর নিজের মনের যে-ধরন সেখানে গান্ধী-চিন্তার জায়গা যে অনেকখানি সে কথা এলো অকপটে। আমাদের এখানে এ-কথাটা সহজ আলাপচারিতায় এতো অকপটে আসা খুব সহজ কথা নয়। বাঙালির মনে গান্ধীর জন্য খুব বিসত্মৃত জায়গা আজো তৈরি হয়নি। নরেশদার কথা, যতটুকু বোঝা যায়, অনেক আলাদা। তিনি তো চরকাও কাটতেন একসময়ে। তা এই ধরনের কথা, এক কথা থেকে আর এক কথায় গড়িয়ে চলেছে। গান্ধী নিয়ে ওঁর মনে অনেক নরম জমি তৈরি হয়েছিল। সবই যে সেদিন এক সকালে বুঝতে পেরেছি তা অবশ্যই নয়। পরেও অনেকদিন ধরে টুকরো টুকরো কথায় ছোটোখাটোভাবে একটু একটু করে বুঝেছি।
অন্য এক আসরে ওঁর মুখে একবার শুনেছিলাম গান্ধী হত্যার দিনের একটা কথা। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি। সেদিনের বিকেল-সন্ধের স্মৃতি আমারও মনে খুব পরিষ্কার আঁকা আছে আজো। শীতের বেলা, সন্ধের মুখোমুখি রেডিয়োর ঘোষণা মারফত সবাই জেনেছে জেনেছে অন্ধকার নেমেছে চারিদিকে। আমার মনে ধরা আছে এই ছবিটা। সব যেন কেমন থমকে আছে। এ-ও ঘটল। সবাই যেন কিরকম একটা ঘোরের মধ্যে চলছে ফিরছে। নরেশদা সেদিন সন্ধ্যায় ছিলেন কবিতা ভবনে। বুদ্ধদেবের সঙ্গে। কথাবার্তা হচ্ছে টুকটাক। বুদ্ধদেব হঠাৎ ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। নরেশদা একা বসে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। খানিকটা বাদে বুদ্ধদেব ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এলেন। হাতে একটা কাগজ। পড়তে দিলেন। নতুন কবিতা। অসম্ভব আজীবন শোক করা। গোটা কবিতায় ধ্রম্নবপদের মতো প্রশ্ন ছিল, তারপর? সব কিছুর পরেও থাকে –
… আবার জ্বালা, বাঁচার ভীষণ জ্বালা, যার
যন্ত্রণায় ঘরকন্না গুঁড়ো হয়, রাজত্ব ধুলোয় মেশে,
কাঁপে মন্ত্রী, গৃহিণী, মজুর;
ক্ষমাহীন এই বাঁচা আবার পাঠাবে প্রশ্ন, যার
উত্তর দিতেই হবে : তখন? …তখন?
‘৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮’ নামের এই কবিতার তারপর, তখন, এইসব আটপৌরে শব্দের অন্তর্গত যে-সন্ধান তা নরেশদারও মর্মের কথা ছিল বলেই মনে হয়। আস্তে আস্তে একটু একটু করে, অনেকদিন ধরে, নানা ভাবে, নানা প্রসঙ্গে, আদৌ কোনো ধারাবাহিকতা ছাড়াই, সেই সন্ধানের কিছু পরিচয় পাবার সৌভাগ্য হয়তো আমার হয়েছে।
তা সেদিনের সেই সকালবেলার গল্পটার খেই আবার ধরি। আমি তো গেছি ওঁর ওখানে বসে আমার কাজটা করে আসব বলে। সত্যি বলতে কবিতা-র বাঁধানো খ- ওঁর বাড়ি থেকে নিয়ে এসে আমার বাড়িতে বসে কাজ করার কথা আমার মাথাতেও আসেনি। আর এলেও সে-কথা বলার সাহসে কুলোত না। উপরন্তু এ-কথাও ঠিক যে, কবিতা পত্রিকার ব্যক্তিগত সংগ্রহের বাঁধানো খ- ওইভাবে চাওয়া যায় না, এটুকু বোঝার মতো বড়ো হয়ে গেছি তখন। তাই আমার মধ্যে উশখুশ ভাব কিছু দেখা দিয়ে থাকবে। অন্তত নরেশদার নজরে কিছু একটা পড়েছিল মনে হয়। তিনি এক সময়ে সহজ গলায় বললেন, আপনার এখানে তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই, বই নিয়ে গিয়ে বাড়িতে ঠান্ডা মাথায় কাজ করবেন। আমি বুঝলাম এবং হাঁফ ছাড়লাম। বললাম, ঠিক আছে, আমি দিন দুয়েক বাদে বাড়িতে এসেই দিয়ে যাব। তিনি বললেন, না, না, এতদূর আসতে হবে না। যাদবপুরে দিয়ে গেলেই হবে। আমার পক্ষে আর কী চাইবার থাকতে পারে। আমি তখন যাদবপুরেই থাকি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর ঘরের পাশ দিয়ে সব সময়ে যাতায়াত করি। তা সেদিনের সেই সকালবেলায় বেশ খানিকক্ষণ গল্প হলো ওঁর সঙ্গে। বুদ্ধদেবের প্রসঙ্গ অনেকখানি জুড়ে ছিল সেদিনের গল্পে। এরকম কথাবার্তার সুযোগ তো আর দু-বেলা আমাদের হাতে আসে না। তাই আমিও মনে হয় প্রশ্রয় পেয়ে আবোলতাবোল বলেছিলাম অনেক কথা। একটা কথা তো মনেই আছে। হয়তো কিছু প্রগল্ভতা ছিল সে-কথায়। বুদ্ধদেবের প্রতি আমার প্রথম আকর্ষণের কথা বলেছিলাম। সে একেবারে ছেলেবেলায়। ঘটনাচক্রে সেই স্কুলবয়সেই কীভাবে ওঁর পরস্পর উপন্যাসটা হাতে এসে গিয়েছিল আমার। আমি যে কী টানে পড়ে গিয়েছিলাম ওই লেখাটাতে। সে-কথা আজ আর বলে বোঝাতে পারব না। এইসব কথা একটু তপ্ত আবেগে ওঁকে বলেছিলাম সেদিন। মুখে প্রশ্রয়ের হাসি রেখে সবটুকু শুনেছিলেন। বলেছিলেন, ও বই অত কম বয়সে আমিও পড়িনি। এখন ভাবতে গিয়ে মনে হয় আমি বুদ্ধদেবের কবিতায় পৌঁছেছিলাম সত্যিই বোধহয় একটু দেরিতে। ওই যে গল্পের বই পড়ার ঝোঁকে তখনকার উপন্যাস পড়া। আমার বেশ মনে পড়ে একটা খাতা ছিল আমার। তাতে বাছা বাছা লাইন, গোটা প্যারাগ্রাফ, টুকে টুকে রাখতাম। যাতে পরে পড়া যায়। তখনকার পড়া কোনো বইতে মালিকানা নিজেদের ছিল না। পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনা। তার চেয়ে বেশি কিছু ভাবার স্তরে আমরা তখনো পৌঁছোইনি।
ওই যে ‘তারপর’, ‘তখন’ ইত্যাদি। এর একটা ধরন মোটামুটি অল্প বয়স থেকে আমাকে বেশ পেয়ে বসে এটা টের পাই। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে এর প্রকোপ থেকে আমি অনেকদিন পর্যন্ত মুক্তি পাইনি। তারও পরে নিজের মতো এক রকমের একটা ব্যবস্থা বোধহয় করে নিতে হয়েছে নিজের মনের মধ্যে। আমার সেই ব্যবস্থায় অনেক আপাতবিরোধী, আপাত অসংগত জিনিসকে একসঙ্গে ঠাঁই দিতে হয় নিজের মনে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমারও কুণ্ঠা কাটেনি। প্রায় লোকলজ্জার ভয়ে মুখ লুকিয়ে চলতাম যেন। তারপর কোনো এক সময়ে একটু একটু করে জড়তা যেন কাটতে থাকল। তখন অন্তত খেলাচ্ছলে মুখ ফুটে বন্ধুবৃত্তের মধ্যে হয়তো সেসব অসামাজিক কথা তুলেছি মাঝে মাঝে। তাতে যে বিপত্তি কখনো হয়নি তাও নয়। তবে তা সত্ত্বেও আমার জগৎ যে এখনো একেবারে বন্ধুশূন্য হয়নি সে আমার বন্ধুদেরই চিত্তের উদারতা বলতে হবে। নইলে আমাকে তাঁদের এতদিন সহ্য করার কথা নয়। তাঁদের সেই উদারতার সুযোগ নিয়ে আজো সেরকম বেয়াড়া একটা কথা একটুখানি তুলব ভাবছি। নরেশদার প্রসঙ্গটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছি। করছি কারণ আর এক দুরন্ত দুপুরে এই প্রসঙ্গটা পর্যন্ত প্রায় যেন তাঁর কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। প্রায় বলছি এই জন্য যে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি সেদিন। সেই অসমাপ্ত দুপুরের গল্পে পৌঁছোবার জন্য এত সব ভণিতা করতে হচ্ছে আমাকে।
বুদ্ধদেব বসু যেমন নরেশদার, তেমনি অমিয় চক্রবর্তীও নরেশদার। শুধু সম্পাদনার সুবাদেই বলছি না কথাটা। অমিয় চক্রবর্তী আমাদের বড়ো হওয়ার সময়ের গোটা পর্ব জুড়ে প্রবাসী। দেশান্তরী এই কবি বিষয়ে আমাদের আগ্রহ কিছু কম না। তুলসীতলায় দীপ জ্বালে মেজবৌ, এই ছবি অবশ্যই আমাদের গ্রাস করে। বেশ খেয়াল করি কথাটা যে, এই ছবিই প্রকারান্তরে আবার ফিরে আসে ১৯৭৭-এ নরেশ গুহ-সম্পাদিত অমিয় চক্রবর্তীর কবিতাসংগ্রহের ভূমিকায়। ‘যাবার সময় কত দূরে জানি না, কিন্তু এই বেলা বলতে চাই ভূমিকা আমার শুধু এই। যা লিখেছি তারই মৃত্তিকায় গড়া প্রদীপ রইলো, আরো দু-সন্ধ্যা তুলসীতলায় জ্বলুক। যদি আমার ভাগ্যে থাকে।’ মায়াময় এই বিষাদের সামনে যে-কোনোরকম উদ্যত প্রশ্নও থমকে যাবে। নইলে মনুষ্যজন্মের প্রতি আস্থা রাখাই শক্ত হবে। আমাদের বড়ো হবার সময়ে এই অমিয় চক্রবর্তীকে তো আমরা হাতের কাছে চোখের সামনে তেমন করে পাইনি। যা যতটুকু তাঁকে পেয়েছিলাম তখন সে তাঁর লেখাপত্রে আর অন্য কারো কারো কাছে শোনা কথায়। যেমন আমাদের একজন মাস্টারমশায় ছিলেন, তিনি দীর্ঘদিন মার্কিন দেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছিলেন আমাদের মতো কিছু অপোগ-দের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে। নিজে অল্প বয়স থেকে বিদেশে ছিলেন বলে তাঁর বাংলা ভাষার ভিত নড়বড়ে থেকে গেছে, তাই কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিত থাকতেন। তিনি আমাদের একটা কথা বলতেন, ‘জানো তো, একে বাংলা ভালো জানি না, তায় একটা সময়ে ওখানে যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হতো তার মধ্যে ছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। ওঁর সামনে বাংলা বলতে এত সংকোচ হত তাই ইংরেজিই বেশি বলতাম। ফলে আমার বাংলা আরো কাঁচা থেকে গেল।’ অমিয় চক্রবর্তীর সুচারু বাংলা কথনের কথা আরো অনেকের কাছে শুনতে পেয়েছি আমরা ততদিনে। বুদ্ধদেবের সেই স্মৃতিও ততদিনে আমাদের পরিচিত। ঈষৎ আক্ষেপের সুরে বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বড়ো কিছু রচনার অধিকারী মানুষ তো ছিলেন তিনিই। অথচ তেমন কোনো রচনাকর্ম তিনি রেখে গেলেন না সে-বিষয়ে। বুদ্ধদেব এমন কথা বলতে গিয়ে মনে ভাবছেন বস্টনের রেলস্টেশনে বসে কফির কাপের সামনে অবিরল ধারায় রবীন্দ্রনাথের কথা বলে চলেছেন অমিয় চক্রবর্তী। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই।
এ হেন অমিয় চক্রবর্তীকে আমাদের যাদবপুর পর্বে অনেকবার শোনার সুযোগ পেয়েছি আমি। সে নরেশদারই জন্যে। অমিয় চক্রবর্তী দেশে এলেই নরেশদা যাদবপুরে তাঁর একটা দুটো বক্তৃতার ব্যবস্থা করতেন। সেইসব আসরে ইংরেজি বাংলা দুরকম বক্তৃতাই শুনতে পেয়েছি অমিয় চক্রবর্তীর। এর আগে যেসব লোককথা শুনেছি ওঁর কথনরীতি বিষয়ে তা অতরঞ্জিত ছিল না মোটেই, এটুকু বলাই চলে। একটা বক্তৃতার কথা আজো খুব মনে পড়ে। আমাদের বন্ধু ও তখনকার সহকর্মী দীপক মজুমদার ওঁকে সেদিন জর্জরিত করেছিল প্রশ্নবাণে। প্রশ্নের তীক্ষনতা ছিল, অসম্মানের অশুচিতা ছিল না। দীপককে যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন দীপক এরকম ক্ষেত্রে কী কা-ই না করতে পারত। ওর ওই চমৎকার ভরাট গলায় স্বচ্ছন্দ বাক্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিচেছ অমিয়বাবুর দিকে নিঃসংকোচে। এবং আলোচনা আদৌ অসংগত নয়, তাই আলোচনার নিয়ামক হিসেবে নরেশবাবুকে হস্তক্ষেপও করতে হচ্ছে না। ব্যাপারটা ছিল পাস্তেরনাক প্রসঙ্গে। ততদিনে কবিতা পত্রিকার পাতায় বুদ্ধদেব-অমিয় চক্রবর্তী বিতর্ক আমাদের মনে যথেষ্ট ঢেউ তুলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বুদ্ধদেবী ভাষায় অমিয় চক্রবর্তীর ‘যূথচারিতা’-য় খুব মনের সায় পাইনি। বোধহয় ওইরকম কাছাকাছি সময়েই হবে, বিষ্ণু দে-র কবিতায় পাস্তেরনাককে ‘একলষেঁড়ে’র ঘরে দেখার কথা আমার মনে অন্তত কোনো সহযোগী সুর তোলেনি। সোজা কথায় ড. ঝিভাগোকে কোনো মতলবি লেখা বলে দেখতে চাইছি না আমরা তখন। সোভিয়েত তন্ত্রের কোনো সমালোচনা মানেই আকাশ ভেঙে পড়ল, এই সংস্কার তখন আর আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখতে পারছে না। পাস্তেরনাককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার পেছনে মতলব থেকে থাকতেও পারে। এরকম থাকেই। এমনকি এসবের অনেক আগে বারট্রান্ড রাসেলকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিলে লেখক নিজে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, তাও কিনা সাহিত্যে! সে যাই হোক। আমরা ড. ঝিভাগোকে শুধু এই আবর্তের মধ্যে দেখতে চাইনি কখনো। আমরা তার আগে সোভিয়েতের ২০তম পার্টি কংগ্রেস ও নিসত্মালিনীকরণ প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এসেছি। গড্ দ্যাট ফেইল্ডের কথা জেনেছি। এমনকি দীপক চৌধুরীর পাতালে এক ঋতুও ততদিনে আমাদের চেনা জগতের অন্তর্গত। ফলে সোভিয়েত তন্ত্রের কোনো সমালোচনা মানেই আকাশ ভেঙে পড়ল, এই সংস্কার তখন আর আমাদের আচ্ছন্ন করতে পারছে না। তাছাড়া পাস্তেরনাকের কবিতা এবং গোটা উপন্যাসের শৈলী কোনো ছিদ্রান্বেষীর অছিলা বলে আমাদের মনে হয়নি। এসব নিয়ে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমাদের একটু পার্টিঘেঁষা বন্ধুদের সঙ্গে অনেক তর্কবিতর্ক করেছি আমরা। এদিকে গত শতকের মধ্য ষাটের দশক থেকে সত্তরের সময়বৃত্তে অমিয় চক্রবর্তী সহজ পরিক্রমায় পৌঁছে যেতে পারছেন ‘আহত পুড়ন্ত ভিয়েতনাম’ পর্বে। তা নিয়ে কিসিংগারের সঙ্গে ওঁর নিভৃত সংলাপের কথাও উঠে আসছে যাদবপুরের বক্তৃতায়। তাই সেদিনের পাস্তেরনাক তর্কে আমাদের মন ঝুঁকে আছে দীপকের দিকে। অমিয় চক্রবর্তী মূল আলোচনায় সেদিন কথা বলেছিলেন টিএস এলিয়ট ও রবার্ট ফ্রস্টকে নিয়ে। এই দিনটার কথা আরো মনে আছে এক নঞর্থক কারণে। আলোচনা ও তর্ক শেষ হতে সন্ধ্যা অনেকখানি গড়িয়ে গেল। তখনকার পুরোনো বিবেকানন্দ হল থেকে আমাদের বাড়ি ফিরতে স্বভাবতই খানিকটা দেরি হয়েছে। আমি তখন থাকতাম কলেজ স্ট্রিটে। বাস থেকে নামতে নামতে দেখি দোকানপাটের শাটার নামানো। চারিদিকে একটা অস্বাভাবিক ত্রাসের আবহাওয়া। কলকাতায় সেদিন দাঙ্গা লেগেছিল। সেই রাত্রেই কলাবাগান বস্তির আগুন, বন্দেমাতরম্ ধ্বনি, রাদুর দোকানের লুটপাট ইত্যাদি ইত্যাদি। এক রাত্রের মধ্যে কলকাতা শহরটা নরক হয়ে গেল, আমাদের চোখের উপরে। এই সেই চৌষট্টির দাঙ্গা। সূত্রপাত হজরতবাল মসজিদে মহম্মদের স্মারক চুল খোয়া যাবার গল্প। কিসের থেকে কী হয়, কী হতে পারে।
নরেশদার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে যাদবপুরে এক দুপুরে দরজা একটু ফাঁক হওয়ার কথা বলেছিলাম। সেই দরজা আর একটু বেশি করে খুলল ওঁর শামিত্মনিকেতন পর্বে। ওই সময়টা আমারও শামিত্মনিকেতনে খুব যাতায়াত ছিল। মাঝে মাঝেই যেতাম আমরা সপরিবার। তখন নরেশদাকে বেশ অন্যভাবে অন্যসুরে পেয়েছি আমরা। তখন আমরা এও জেনে গেছি যে, আর্মি অ্যান্ড নেভি-র আচার নরেশদার প্রিয়। চিনুদি তখন আমাদের খুব কাছের মানুষ। আমরা হয়তো হুট করে গিয়ে পড়েছি শামিত্মনিকেতনে। কোনো বন্দোবস্ত না করেই। পূর্বপলিস্ন গেস্ট হাউসে থাকতে চাই। কিন্তু সরাসরি আমাদের মতো বহিরাগতদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেই। দু-পা এগিয়েই তখনকার নরেশদার বাসস্থান। সোজা গিয়ে ওঁকে বলতেই উনি ফোনে বলে দিলেন গেস্ট হাউসের কর্তাদের আর আনুষ্ঠানিকতার জন্য চিঠি লিখে দিলেন আমাদের হাতেই। আমরা কয়েকদিন থেকে এলাম শামিত্মনিকেতনে। এমন হয়েছে একাধিকবার। উনি এসে গেস্ট হাউসের ঘরে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবরও নিয়ে যেতেন।
ওখানে, ওঁর ওই পূর্বপলিস্ন­র বাড়িতে বসে, পরে নিজের যে-ছোটো বাড়ি বানালেন, যে-বাড়ির না-লেখা নাম ‘খোয়াই’, সে-বাড়ির বারান্দায় বসেও অনেক কথা বলার ও শোনার সুযোগ পেয়েছি আমরা। সেসব কথাবার্তা প্রায়ই আটপৌরে সীমা পেরিয়ে যেত, পৌঁছে যেত ওই ‘তারপর’ ও ‘তখনে’র তেপান্তরে। মনে আছে এমনিভাবে একদিন ওই পূর্বপলিস্ন­র বাড়ির উঠোনে মোড়া পেতে বসে কথা হচ্ছিল। আমরা দু-তিনজনে ছিলাম সেদিন। ওই বাড়ির দেওয়ালের ধার দিয়ে বড়ো হয়ে উঠছিল ওঁর নিজের হাতে লাগানো গোলমরিচের লতা আর তেজপাতা। আর নরেশদা কথা বলে যাচ্ছিলেন খুব অন্তর্গত ভঙ্গিতে। একটা কথায় একেবারে চমকে উঠেছিলাম আমি। ‘একটা জন্ম কিছু নয়, বুঝলেন, একটা জন্মে কিছু হয় না।’ তাই কি জাতকের কল্পনা, তাই বুদ্ধত্বের সাধনা জন্ম জন্মান্তরের সাধনা। তাই কি দামিনীরও সাধ মেটে না এক জীবনে।
আর এক দুপুরের কথা বলে কথা শেষ করি। সেদিন দুপুরে সত্যেন দত্ত রোডের বাড়িতে। দুপুরে নয় ঠিক, আসলে সকালে। দিনটা ছিল কালীপুজোর দিন। দুপুর বিকেলের পরে বাজির চোটে বেরোনো যাবে না, তাই কথা হয়েছিল সকালের দিকে যাব। কি একটা ছোটোখাটো কাজ ছিল সে আর এখন ঠিক মনেও নেই। সকালেই গিয়েছিলাম। চিনুদির হাতের চা-টা যা হবার সবই হয়েছিল নিয়মমতো। তারপরে কথায় কথায় কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কী তা আমি আজো জানি না। নরেশদা নিজেকে খুলে ধরছিলেন। তার মধ্যে যে কত কথা ছিল। ছোটোবেলার কথা, বড়ো হওয়ার কথা। আবার সেই দেশভাগ ও গান্ধী হত্যার কথা। ওঁর চারুচন্দ্র কলেজে পড়ানোর কথা। লেকের মিলিটারি ক্যাম্পের কথা। অবিরল ধারায় উঠে আসছিল সেসব কথা। মানুষের ঘোলাটে চোখের কথা ওই অল্প বয়সেই ওঁর চোখে কীভাবে ধরা পড়েছিল তার একটা গল্প বলেছিলেন। তখন পড়াচ্ছেন চারুচন্দ্র কলেজে। ওই কলেজের ছাত্ররা তখন বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকেই দেশভাগে আহত পরিবারের সন্তান। তা এইসব ছাত্রকে আরো একটু জানবার বোঝবার তাগিদে নরেশদা নিজের মতো একটু সমীক্ষা ধরনের কাজ করতেন ওই ছাত্রদের মধ্যে। ছাত্রদের পারিবারিক আর্থিক সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিচয় পাবার জন্য তাদের খোঁজখবর নিতেন। নিজের মতো সেসব পরিচয় নিজের খাতায় লিপিবদ্ধ করেও রাখতেন। ফিসফাস কথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর আসল মতলবটা কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তো। এইসব কথা বলতে বলতে আমাদের ভ্রষ্ট রাজনীতির কথা এসে গেল। এলো দলীয়তার কথাও। অনিবার্যভাবে এলো বুদ্ধদেব বসুর কথা, অমিয় চক্রবর্তীর কথাও। অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ওঁর আচমকা চলে যাওয়া গান্ধী দর্শনের আশায়। ভিড়ের ট্রেনের অভিজ্ঞতা। ভ্রূক্ষেপহীন অমিয়বাবুর কোনো মতে ওপরের একটা বার্থে শরীরটাকে একটুখানি স্থাপন করেই বইয়ে মগ্ন হয়ে যাওয়া। এইরকমের অনেক কথা এলো, জীবনে সংগতি অসংগতির কথাও। সব কিছু যে মেলানো যায় না জীবনে এই ধরনের কথাও এলো।
সংগতি, অসংগতি, দলীয়তা, গোষ্ঠীজীবন ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমার মনে বরাবর এসে পড়ে সংঘের কথা, একেবারে বৌদ্ধ সংঘের কথাই। ত্রিশরণ এই পথের তৃতীয় শরণ নিয়ে আমার চিরকালের একটা সংশয় রয়ে গেছে মনে। বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি, এ তো দুই ধারণার আদর্শের দিকে যাবার কথা। কিন্তু সংঘং সরণং গচ্ছামি। এ তো একেবারে নিটোল এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দিকে যাওয়া। বড়ো সংশয় লাগে। আমার তো অমন স্বদেশি সমাজ কল্পনাতেও নেতৃত্বের প্রশ্নে একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়। ভাবতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথ কি নিতান্ত সহজ মনেই একজন নেতার কথা ভেবেছিলেন তাঁর ওই সমাজের জন্য, নাকি খানিকটা দোটানায়। কাজ চালানো গোছের একটা ব্যাপার। মূল কথাটা ছিল আত্মশক্তির সাধনা। বাইরের কোনো চালিকাশক্তি, তা সে যত মহৎ প্রতিভাধর শক্তিই হোক না কেন, তা আত্মশক্তির বদলি হয়ে ওঠে কেমন করে। বুদ্ধবাণীতেও কথাটা ছিল আত্মদীপ হবার ব্রত। সেখানে সংঘের হাতে অতটা তুলে দিয়ে বুদ্ধই কি নিশ্চিমেত্ম নির্বাণযাপন করতে পারেন। এখুনি আমাকে স্যাক্রিলেজের অভিযোগে অভিযুক্ত করে লাভ নেই। বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বে সংঘের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। আর আমি সে-প্রশ্ন তুললেই বা কী আর না তুললেই বা কী। কার তাতে কী এসে যায়। আমার কথাটা ওই আত্মশক্তি বা আত্মদীপের ব্রত নিয়ে। সে-ব্রতের সঙ্গে সংঘদর্শন কতদূর সহযোগী হতে পারে। সংঘজীবনের সেই যূথচারিতার কথায় আমাদের আবার ফিরে আসতেই হবে। সবাই মিলেমিশে থাকার কথাটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত জরুরি। তার একটা আন্তরিক সমৃদ্ধির দিকও হয়তো উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত অবদমিত হয়ে পড়ে কিনা এই প্রশ্নে আমাদের সংশয় কাটে না। এবং সেই পাস্তেরনাক বিতর্কের দিনে এ-কথাটা আমার কাছে হয়তো অত পরিষ্কার ছিল না। ওই যে ব্যক্তির অবদমিত হওয়ার কথা বলছি, তা যে সব সময়ে বাইরে থেকে, ওপর থেকে চাপানো সংঘের অনুশাসনের জন্য তা নাও হতে পারে। এমন হওয়া কি একেবারে অসম্ভব যে ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্বে রক্তক্ষরণের মধ্যেই অনুশাসিত সংঘযাপন জেগে উঠতে থাকে নিজেরই মধ্যে। অনেক সময়ে আমাদের সমাজজীবনে যে জিনিসকে আমরা সংস্কার বলে চিনে থাকি।
এত কথা এইভাবে নিশ্চয় হয়নি তখন। কিন্তু এসবের কিনার ঘেঁষেই চলছিল আমাদের কথাবার্তা। বেলা বেড়ে চলেছে। সামাজিক বিধিবিধানের সব নিয়মকানুন আমরা ততক্ষণে বেমালুম টপকে গেছি। চিনুদির উৎকণ্ঠা আমি বুঝতে পারছি। আমার নিজের বাড়ির উদ্বেগ, তাও আন্দাজ করা কিছু শক্ত না। প্রায় বেকসুর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার মতো একটা ব্যাপার আর কি। হয়েছে আমাদের এরকম বেশ কয়েকবার। আমি দু-একবার ইতোমধ্যে বলেওছি নরেশদাকে, আপনার খাওয়া-দাওয়া দেরি করে দিলাম। তিনি তাতে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে শেষ বেলায় এমন একটা কথা বললেন, আমি আবার সোজা হয়ে বসলাম। তিনি প্রায় আচমকাই বললেন, ‘অভিসার’ কবিতা নিয়ে কিছু লেখবার ইচ্ছে আছে ওঁর। ‘আশ্চর্য একটি কবিতা’, ওঁর চেনা মুদ্রায় নিচু গলায় কথাটা বলে চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। আমি বললাম, মানে সন্ন্যাসী উপগুপ্ত। ঘাড় নাড়লেন, আরো দু-একবার অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, ‘আশ্চর্য কবিতা, ভারি আশ্চর্য কবিতা।’
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেলের মুখে উঠে পড়লাম। জানা হলো না, কোন দিক থেকে ঠিক কী লেখার কথা ভাবছিলেন নরেশদা। জানি না, সত্যিই কিছু লিখেছিলেন কিনা কখনো। চিনুদির বা মণির হয়তো কিছু জানা থাকলেও থাকতে পারে। জানি না।
নরেশদার সেদিনের দুপুরের অন্তর্মুখী উচ্চারণটা আমার মনে থেকে গেছে সেই থেকে। আর এই কবিতা আমাকে টেনেছে স্কুল বয়স থেকে। আমরা স্কুলের রবীন্দ্রজয়মত্মীতে নিজেদের পরিকল্পনা অনুসারে অভিনয় করেছি শ্রীমতীর কবিতা আর সন্ন্যাসী উপগুপ্তের কবিতা। আজ কৃতজ্ঞ লাগে এ-কথা ভেবে যে, আমাদের মাস্টারমশাইরা বাধা তো দেনই নি, উপরন্তু আমাদের ভাবনাকে নিজেদের ভাবনা দিয়ে আরো পোক্ত করে তুলতেও চাননি। আমাদের ত্রম্নটি-বিচ্যুতি শোধরানোর জন্যও খুব উদগ্রীব হয়ে ওঠেননি। নিশ্চয়ই সব ব্যাপারটা খুব কাঁচা হয়েছিল, তা হোক। সেই থেকে আজ এত বছর কবিতাগুলো রয়ে গেছে আমার সঙ্গে। ওই ‘অভিসার’ কবিতা নিয়ে নরেশদারও অনেক দিনের লেখার ভাবনা। কী হতে পারে সে-ভাবনা। ঠিকমতো জানা হয়নি সেদিন। পরেও আর অবকাশ আসেনি কখনো। সাধে কি আর বলে সত্যিকার পাবার মতো জিনিস একবারের বেশি পাওয়া যায় না। এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
বাসবদত্তা একদিন ছিলেন যৌবনমদে মত্তা। সেদিন ছিল শ্রাবণরাত্রি। নটীর অভিসারের পথে পা পড়েছিল মাটিতে ঘুমন্ত সন্ন্যাসী উপগুপ্তের গায়ে। নারী লজ্জা-জড়ানো গলায় সন্ন্যাসীকে সেদিন ডেকেছিল তার ঘরে যেতে। সন্ন্যাসীর তখনো সময় হয়নি। কাজের চাপে তাঁর ফুরসত হয়নি, তা নয় কিন্তু। ‘এখনো আমার সময় হয় নি,/ যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনী -/ সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে’। সন্ন্যাসীর কি তাহলে তলে তলে একটা প্রস্ত্ততি চলছিল তখনই? ‘এখনো আমার সময় হয় নি’, কিন্তু সময় একদিন হবে, আর তার জন্য তিনি প্রহর গুনছেন, নাকি আরো একটু বেশি, নিজেকে তৈরিই করে নিচ্ছেন তিনি? তৈরি করলে কিসের জন্য? শুধু সংঘের বাঁধন টুটে যাবার আশঙ্কার কথা হতে পারে না। তাতে একেবারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠবে কেন। এ ভাঙন সম্ভবত আরো ভয়ানক। বা হয়তো তা কোনো ভাঙনই নয়, তা হয়তো নতুন কোনো বীজের উদ্‌গম। সন্ন্যাসীর মধ্যে কি ব্যক্তি জেগে উঠতে চাইছিল। সেই প্রস্ত্ততির অপেক্ষায় থেকে তিনি বাসবদত্তাকে কথা দিচ্ছেন, সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে। নটীর অভিসার সেদিন মিলে যাবে সন্ন্যাসীর অভিসারে।
অন্যদিন, সেদিন চৈত্রের সন্ধ্যা। বাতাস আজ আকুল, রাসত্মার ধারের গাছে গাছে মুকুল। দিকে দিকে বকুল পারুল রজনীগন্ধা। প্রকৃতি প্রস্ত্তত। বাঁশির মন্দ্র স্বর মদির, পুরবাসী গেছে মধুবনে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। নির্জন পথে সন্ন্যাসী একা চলেছেন। একেবারে বলে কয়ে এ কি তাঁর অভিসার রাত্রি। সেখানে যে মিলন সন্ন্যাসীর জন্য অপেক্ষা করে আছে তা রোগমলিন। জীর্ণ শরীরের শুশ্রূষা সন্ন্যাসীর উপযুক্ত ধর্ম বটে। কিন্তু তাই বলে এই উত্তর, ‘আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা।’ এ কি শুধু সেবাধর্মের কথা। সে তো নৈর্ব্যক্তিক। সংঘজীবনেই তা ধারণ করা সম্ভব। ‘আজ সময় হয়েছে, আমি এসেছি বাসবদত্তা’, এ তো সংঘ ভেদ করে উঠে আসা উদ্‌গত ব্যক্তির এক উষ্ণ নিবিড় উচ্চারণ।
জানি না নরেশদার মনে কী ছিল। জানা হয়নি সে-কথা। সেই অসমাপ্ত কথাতেই কথা শেষ করি।

স্বীকৃতি : অহর্নিশ পত্রিকা-আয়োজিত নরেশ গুহ স্মারক বক্তৃতা, ২০১৯-এর একটু-আধটু শোধরানো ও একটু বাড়ানো পাঠ। এই বক্তৃতায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য উদ্যোক্তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।