সঞ্জীব চৌধুরী : তিনি ছিলেন বাংলার বব ডলিান

কিছু মানুষ পৃথিবীর বুকে আসে সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার আকাশচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে। তারা ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা বদলে দিতে নিজেকে উজাড় করে নিরন্তর সংগ্রাম করে যায়। নিঃস্বার্থভাবে মুক্তি ও মানবতার বার্তা ফেরি করে পথে-প্রান্তরে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে রুখে দাঁড়ায়। তাঁদেরই একজন হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় দলছুট ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান গায়ক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যাভিনেতা, সাংবাদিক ও কবি। এর বাইরেও তিনি বহুগুণে গুণান্বিত, আরো বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন। সবকিছুর মধ্যে তাঁর অন্যতম গুণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন বিপ্লবী ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, বরং মাথা তুলে বুক চিতিয়ে উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। তাঁকে দেখতে যতটাই গম্ভীর মনে হতো না কেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসবোধসম্পন্ন একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তিনি এতটাই রসিক ছিলেন যে, নিজের মৃত্যু নিয়েও কাছের মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরেও তিনি তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে, প্রকৃত অর্থে যাঁরা বিপ্লবী, তাঁদের এমন স্বভাবের হতেই দেখা যায়। তাঁরা জানেন, বিপ্লবীদের কখনো মৃত্যু হয় না। বিপ্লবীরা ফিনিক্স পাখির মতো বারবার জন্ম নিয়ে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। তিনি সেই বিশ্বাস থেকেই হয়তো বলেছিলেন, ‘টিএসসি চত্বরে কিংবা আজিজ সুপার মার্কেটে আমি থাকবো না, সেটা কী কখনো কল্পনা করা যায়! গিয়ে দেখবেন, আমি সেখানে মস্ত আড্ডা জমিয়ে বসে আছি। জীবনানন্দ দাশের ‘আবার  আসিব ফিরে’ কবিতাটির আদলে আমি আউড়ে যাই, আবার আসিব ফিরে, টিএসসির মোড়ে, হয়তো কোনো এক বিপ্লবীর বেশে।’ সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের চত্বরের নামকরণ করা হয় ‘সঞ্জীব চত্বর’। যদিও তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী কিন্তু তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল বিপ্লব। তাই তিনি গানটাকেই করেছিলেন প্রতিবাদের হাতিয়ার। ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিলে প্রতিবাদী গান গেয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করে রাখতেন। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে বুক চিতিয়ে প্রতিবাদের গান গাইতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁর প্রতিবাদের ধরন তরুণ প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে। তাই সঞ্জীব চৌধুরীকে প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু জমিদার পরিবারে সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম গোপাল চৌধুরী এবং মাতার নাম প্রভাষিণী চৌধুরী। তিনি তাঁর পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে ছিলেন সপ্তম। তবে তাঁদের মূল বাড়ি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে। সেখানকার জমিদার শরৎ রায় চৌধুরী ছিলেন তাঁর পিতামহ। ছাত্রজীবনে তিনি বেশ মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ও এরপরে ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সাংবাদিকতায় পড়ার দরুন পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমেই দৈনিক উত্তরণে কাজ করা শুরু করেন তিনি। এরপর ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, যায়যায়দিন প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকায়ও কাজ করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ফিচার বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে সঞ্জীব চৌধুরী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নব্বইয়ের দশকের আগে সব সংবাদপত্র ভর্তি ছিল শুধু সংবাদ আর সংবাদে। ভোরের কাগজে কাজ করার সময় সঞ্জীব চৌধুরী প্রথমবার ফিচার লেখা শুরু করেন। তাঁর এই পদক্ষেপে সংবাদপত্রের কাটতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলায় তিনি মৈনাক নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দলছুট’ ব্যান্ড। গতানুগতিক ধারার বাইরে ব্যতিক্রমী কিছু গান নিয়ে কাজ করে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যান্ডটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’ অ্যালবামটি সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্থে প্রকাশ পায়। এতে তাঁর লেখা কবিতাগুলোর সংকলন ছিল। এছাড়া ‘আয় আমন্ত্রণ’ হচ্ছে ব্যান্ডটির ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অ্যালবাম। ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর ৪৭তম জন্মদিনে ‘সঞ্জীব উৎসব’ পালনের মধ্য দিয়ে এই অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। এই অ্যালবামের ‘নতজানু’ নামে সর্বশেষ গানটি সঞ্জীব চৌধুরীর নিজের লেখা।

ছোটবেলা থেকেই সংগীতানুরাগী ছিলেন তিনি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সংগীতের সঙ্গেই ছিল তাঁর পরিচিতি। তাঁর প্রিয় গায়কের তালিকায় ছিলেন বব ডিলান, পিংক ফ্লয়েড, অ্যাল স্টুয়ার্ট প্রমুখ। তাঁদের গানগুলো সঞ্জীব চৌধুরীকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। সংগীতের পাশাপাশি সঞ্জীব চৌধুরীর মধ্যে কাব্যপ্রতিভাও ফুটে উঠত প্রায়ই। নিজে কবিতা লিখতেন আবার আবৃত্তিতেও বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন। শুধু কবিতাই নয়, বেশকিছু ছোটগল্পও লিখেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা গল্পগ্রন্থ রাশ প্রিন্ট আশির দশকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সেরা গল্পগ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত হয়। আহমদ ছফাও সঞ্জীব চৌধুরীর লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনিতে নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। এক্ষেত্রে যেন তিনি একজন সব্যসাচীই ছিলেন। সুখের লাগিয়া নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাও জমা পড়ে তাঁর অর্জনের ঝুলিতে। কবি ফরহাদ মজহারের কবিতা থেকে করা গানে সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠ আমাদের উপহার দিয়েছে এক ব্যর্থ গভীর প্রেমের গান, ‘এই নষ্ট শহরে, নাম না জানা যেকোনো মাস্তান’। এছাড়া টোকন ঠাকুর, সাজ্জাদ শরিফ, জাফর আহমেদ রাশেদ ও কামরুজ্জামান কামুর কবিতাতেও সুরারোপ করে গান গেয়েছেন সঞ্জীব চৌধুরী। কবিতাপ্রেমী এই গায়ক জানতেন কী করে প্রিয় কবিতাগুলোকে রূপ দেওয়া যায় প্রিয় গানে। তাঁর গানের বেশিরভাগই ছিল নিজের লেখা কবিতা থেকে করা। ২০১০ সালের একুশে বইমেলায় মোট ৪৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় সঞ্জীব চৌধুরীর গানের কবিতা। বাংলাদেশের লোকসংগীত, সুফিবাদ ও সুফিগানের প্রতি তাঁর ছিল এক অন্যরকম টান। তাঁদের যে সুরসাধনার জায়গা, সেটিকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সাধনার সে-স্তরে পৌঁছতে হলে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে বলে তিনি মনে করতেন। সিলেটের মরমি গায়ক হাছন রাজার গান ছিল সঞ্জীবের খুব প্রিয়। বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটি তাঁর অনুমতি নিয়ে সঞ্জীব গেয়েছিলেন। মূলত তিনি গানটি গাওয়ার পর শাহ আবদুল করিমের এই গানটি রাতারাতি জনপ্রিয়  হয়ে ওঠে। সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : ‘চোখ’, ‘আমি তোমাকেই বলে দিবো’, ‘চল বুবাইজান’, ‘আমাকে অন্ধ করে’, ‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া’, ‘রিকশা কেন আস্তে চলে না’, ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি’, ‘হাতের উপর হাতের পরশ’, ‘আমি ফিরে পেতে চাই’, ‘বায়োস্কোপ’ প্রভৃতি।

সঞ্জীব চৌধুরীর রাজনৈতিক বোধ অনেক গভীর ছিল। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং এই সংযুক্তি আরো প্রবল হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তিনি এর সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে ওঠে। হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটির চিন্তাভাবনার গভীরতা ছিল। সবার সঙ্গে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রবণতা ছিল। খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন যে-কোনো মানুষের সঙ্গে। যেকোনো আড্ডায় তিনি হয়ে উঠতেন মধ্যমণি। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিবাদী বক্তৃতার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রাবস্থায় সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ বহুবার আলোড়িত হয়েছে তাঁর কণ্ঠের কবিতা ও বক্তৃতায়। তাৎক্ষণিক গান লেখার পর তাতে তখনই সুর বসিয়ে তিনি রাজপথ কাঁপাতেন স্বৈরাচার পতনের গানে গানে। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ও কণ্ঠের মহিমা – এ দুইয়ে মিলে যেন আন্দোলনের ভাষায় কথা বলত সমন্বিত সুরে। ক্লান্তি তাঁকে থামায়নি সেদিন, শ্রান্তি তাঁকে করতে পারেনি কাবু। সুরের ঝংকারে মেতে উঠেছেন ছাত্রবিপ্লবী এক গায়ক তরুণ সঞ্জীব চৌধুরী। পেশার তাগিদে এবং নেশার প্রেষণায় তিনি বহু কাজই করেছেন, কিন্তু কখনো সমঝোতা করেননি নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে। তিনি বিশ্বাস করতেন সাম্যবাদে, একদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে এই সমাজে, এই আশা ছিল তাঁর মনে। মানবতার ভোগান্তির কারণ হিসেবে বিদ্যমান সকল সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। শ্রেণিসচেতন এই সমাজে সঞ্জীব চৌধুরী এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি এক নিমেষেই নিজেকে শ্রেণিচ্যুত করে ফেলতে পারতেন। তিনি সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, মিশতে পারতেন তাদের মতো করে। জমিদারবংশের ছেলে হয়েও তাঁর মধ্যে ভুলেও কোনোদিন ফুটে ওঠেনি উঁচু শ্রেণি সম্পর্কে অনুকম্পা।

হবিগঞ্জ জেলা শহরের পিটিআই রোডের কাছেই সঞ্জীব চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস। তিনি মাঝেমধ্যে হবিগঞ্জে বেড়াতে আসতেন। যখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র, তখন প্রীণন ব্যান্ডের ভোকালিস্ট প্রদীপ দাদার মাধ্যমে সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কলেজে পদার্পণের পর তাঁর সঙ্গে বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে। তখন তিনি সারাদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তবে নিজ জেলা শহরে এলে অতি সাধারণের মতো চলাফেরা করতেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতেন। পরিচিত কাউকে দেখলে ডেকে কুশল বিনিময় করতেন। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ হাইস্কুলের বারান্দায় বসে জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিতেন, গান গাইতেন। তখন মনেই হতো না তিনি যে দেশের একজন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। ঢাকায় গেলে সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জের বন্ধুরা মিলে আজিজ সুপার মার্কেটে যেতাম সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে আড্ডারত সবার সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলতেন, ‘এরা আমার হবিগঞ্জের ছোট ভাই। একেকটা জলজ্যান্ত প্রতিভা।’ তাঁর কণ্ঠস্বর এখনো শুনতে পাই। এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মিষ্টি হাসি। তাঁর সঙ্গে খুব অল্প কিছু সময় কাটিয়েছিলাম, সেটাই আমার কাছে অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। তাঁকে কাছে থেকে দেখেছিলাম বলেই বলতে পারি, তিনি যে কতটা উদার মনের মানুষ ছিলেন। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মাঝরাতে মৃত্যুবরণ করেন।

এক যুগ চলে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীবিহীন, তবু মনে হয়, আমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে বাংলার বব ডিলান কিংবা প্রিয় সঞ্জীবদা হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।