সত্যজিৎ রায়কে লেখা আবু ইসহাকের একটি চিঠি

সংগ্রহ ও ভূমিকা : হাসান অরিন্দম

আবু ইসহাকের প্রথম উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৫৫) প্রকাশিত হওয়ার পর উভয় বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর নামটি বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। জানা যায়, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এ-উপন্যাস পড়ে এর ভিত্তিতে একটি ছবি নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। তবে এ-উপন্যাস অবলম্বনে শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহ্উদ্দিন শাকের সূর্য দীঘল বাড়ী নামে যে-চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তা ১৯৭৯ সালে মুক্তি লাভ করে। এটি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের স্বল্পসংখ্যক শিল্পসফল চলচ্চিত্রের অন্যতম। এই ছবির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার অর্জন কথাসাহিত্যিক হিসেবে আবু ইসহাকের পরিচিতির ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত করে। এজন্য ঔপন্যাসিক নির্মাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক গোলাম সাকলায়েন ২১ জানুয়ারি ১৯৮৫-এ লেখা এক পত্রে আবু ইসহাককে জানিয়েছিলেন, ‘আপনার ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ একখানি যুগান্তকারী উপন্যাস, অতএব এর ছবিও ভালো হ’তে বাধ্য যদি দক্ষ কারিগর ও পরিচালকের হাতে পড়ে। আমি ভাবি আপনার এই বই যদি সত্যজিৎ রায় অথবা অনুরূপ কোনো পরিচালকের হাতে পড়তো তাহলে সেটি যে বিশ^বিখ্যাত ‘পথের পাঁচালী’র মতো সুনাম কুড়াতে পারতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ ঔপন্যাসিকের মনেও কিছুটা অতৃপ্তি রয়ে গিয়েছিল। আবু ইসহাক ছিলেন চলচ্চিত্রকার ও লেখক সত্যজিতের বিশেষ ভক্ত। তাঁর আকাঙক্ষা ছিল বিশ্ববরেণ্য ওই নির্মাতার হাত দিয়ে তাঁর একটি আখ্যান চিত্ররূপ লাভ করুক। দ্বিতীয় উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬) গ্রন্থরূপে প্রকাশের পর এর চিত্রায়ণ নিয়েও তিনি আগ্রহী হন। এমনকি এ-উপন্যাসের কাহিনিতে নাটকীয়তা দেখে কোনো কোনো সমালোচক এই মন্তব্য করেন যে, চলচ্চিত্র রূপে সূর্য দীঘল বাড়ী ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি বলে অবচেতনে বা সচেতনভাবেই হয়তো আবু ইসহাক পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসের কাহিনিকে আকর্ষণীয় চলচ্চিত্রের উপযোগী করতে চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, এপিকধর্মী এই আখ্যানে রোমান্স, সংঘাত, বীররস ও মেলোড্রামা পরিলক্ষ্যেত হয়। এর নায়ক ফজল নানা অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছে আর দুই নায়িকা জরিনা ও রূপজানকে যে-রূপে লেখক অংকন করেছেন তা বিশেষ হৃদয়গ্রাহী। সত্যজিৎ রায় পত্রিকায় সূর্য দীঘল বাড়ী সম্পর্কে মন্তব্য করার প্রায় তিরিশ বছর পর আবু ইসহাক তাঁর কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন। লেখক তাঁর পদ্মার পলিদ্বীপ উপন্যাসটি এর আগেই সত্যজিৎ রায়কে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া আবু ইসহাকের অপর এক পত্র থেকে জানা যায়, ছবি নির্মাণের বিষয়ে গৌতম ঘোষের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ করার ইচ্ছা ছিল। আবু ইসহাকের বন্ধু প্রভঞ্জন রায় চৌধুরী ২০ আগস্ট ১৯৯৬-এর পত্রে আবু ইসহাককে জানান, ‘তুই গৌতম ঘোষের কথা লিখেছিস। তাকে ধরার আমার কোনো সুযোগ নেই। কোনোভাবে যোগাযোগ হলে তোকে জানাব। তবে উপন্যাসটি পাঠাতে হবে না। আমার কাছে এক কপি আছে।’

আবু ইসহাক ২২ আগস্ট ১৯৯৪-এর পত্রে বন্ধু প্রভঞ্জন রায় চৌধুরীকে আক্ষিপ করে লিখেছিলেন, ‘এ পর্যন্ত দু’জন পরিচালক উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত করার ব্যাপারে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁরা সম্ভবত অর্থের যোগানদার প্রযোজক এখনও পাননি। এখানকার প্রযোজক ও পরিচালকেরা বিদেশী বিশেষ করে বোম্বের মারদাঙ্গা ও লারেলাপ্পা ছবির কাহিনী জোড়াতালি দিয়ে বা সেগুলির ঘোঁট পাকিয়ে নিজেরাই কাহিনী তৈরি করে নিতে পারে। তাই সাহিত্য-পদবাচ্য উপন্যাসের কাহিনীর প্রতি তাদের তেমন আগ্রহ নেই। অতএব কবে যে উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং তোর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ কবে আসবে বা আদৌ আসবে কি না, সে-সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারছি না।’

আবু ইসহাক ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। গোয়েন্দা বিভাগের এই কর্মকর্তা দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি আশির দশকের শুরু থেকে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র টাইপরাইটারে আর নববইয়ের দশকের শুরু থেকে নিজ হাতে কম্পিউটার কম্পোজ করতেন। উলেস্নখ্য, সত্যজিৎ রায়কে লেখা আবু ইসহাকের চিঠিটি নিজ হাতে টাইপকৃত এবং তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত।

 

আবু ইসহাক               বাড়ি নম্বর ৫  সড়ক নম্বর ১৮                                                      সেন্ট্রাল বস্নক

খালিশপুর হাউজিং এস্টেট

খুলনা, বাংলাদেশ

নভেম্বর ৯, ১৯৮৬

 

শ্রদ্ধাভাজনেষু,

আদাব। আপনাকে চিঠি লিখবার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কিন্তু লিখি লিখি করেও আর লেখা হয়ে ওঠেনি।

গত এপ্রিল মাসে আমার নতুন উপন্যাস ‘‘পদ্মার পলিদ্বীপ’’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আপনাকে একটা কপি পাঠাবার জন্যে বইটার প্রকাশক ‘মুক্তধারা’কে বলেছিলাম। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনাকে এক কপি বই পাঠানো হয়েছে। বইটা আপনি পেলেন কি না, জানতে পারিনি।

আমার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ আপনি পড়েছিলেন, এ সংবাদ আমি পেয়েছিলাম বইটা বেরুবার কিছুকাল পরেই অর্থাৎ প্রায় বছর তিরিশেক আগে।  তারপর ১৯৬৪ সালে আমি যখন করাচীতে তখন সংবাদপত্রের মারফত জানতে পেরেছিলাম, আপনি উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়নে আগ্রহী। তারপর এ সম্পর্কে আর কোনো সংবাদ পাইনি। সম্ভবতঃ ১৯৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্যে ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। পরে বইটির চিত্ররূপ দেন দুজন তরুণ পরিচালক – মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। যদিও পরিচালকদ্বয় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং ছবিটি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে, তবুও আমি পুরোপুরি খুশি হতে পারিনি। আপনার হাতে পড়লে ছবিটি আরো মনোগ্রাহী ও উন্নত মানের হতো বলে অনেকেই বলেন এবং আমিও বিশ্বাস করি। কলকাতা ফিল্মোৎসব ১৯৮২-তে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল। আপনি সম্ভবত সে সময়টাতে ছবিটা দেখে থাকবেন।

আপনার অবসর খুবই কম, বিশেষ করে চলচ্চিত্র ও ফেলুদা’কে নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয় আপনাকে, বুঝতে পারি। (‘শারদীয় দেশ’-এ ‘দার্জিলিং জমজমাট’ পড়লাম। আপনার গল্প বলার ভঙ্গী ও ঝরঝরে ভাষা আমাকে মুগ্ধ করেছে।) ব্যস্ততার জন্য হয়তো আমার বইটা এখনো পড়তে পারেননি। যদি সময় করে বইটা পড়েন তবে খুশি হবো এবং আরো বেশি খুশি হবো যদি বইটা সম্বন্ধে আপনার মূল্যবান অভিমত জানান।

আমি সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে এখন শুধু লেখালেখি নিয়ে আছি। আশা করি আপনি ও আপনার পরিবারের সবাই ভালো আছেন।

অশেষ শ্রদ্ধা অমেত্ম,

বিনীত

স্বাক্ষর

(আবু ইসহাক) ৯.১১.৮৬

 

শ্রী সত্যজিৎ রায়

ফ্ল্যাট ৮,

১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড

কলকাতা-২ r

 

কায়েস আহমদের গল্পে

বিষয় ও আঙ্গিক

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ­

শক্তিমান কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমদ (১৯৪৮-৯২) ছোটগল্প রচনায় বিশেষ
কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সমাজ ও সংগ্রাম কিংবা সমাজজীবনের পরিবেশে মানুষ যে অসহায়ত্বের চরম শিকার এই বিশেষ বোধ তাঁর গল্পের মূল বিষয়। নর-নারীর সম্পর্কের বাইরে যে মানুষের আরেকটি জীবন আছে, এবং তা কখনো প্রকাশিত হয় না অথবা মানুষ যেন ইচ্ছে করেই তা ভুলে যেতে চায়, সেই গভীরতম খাদে পাঠকের চিন্তাকে পৌঁছে দেয় কায়েসের গল্প। মানুষকে শুধু মানুষ বলে উপলব্ধি করেই তাঁর গল্প এগিয়ে গেছে মূল গন্তব্যে। পাঠক বিস্ময়ে হতবাক হয় তাঁর গল্পের কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে প্রবেশ করে। কায়েসকে মোটা দাগে বলা যায় সত্যসন্ধানী গল্পকার, তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে সত্যের দুর্লভ অভিনিবেশ-গভীরতা ও সৃজনশীলতা; মানুষ এবং মানুষের কষ্ট-দুর্দশা তিনি যেমন তীক্ষন কলমে তুলে ধরেছেন, তেমনি প্রত্যক্ষ করেছেন বেঁচে থাকার সংগ্রামের বিভিন্ন দিক। তাঁর গল্প সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে জীবনের অনেক গভীরে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, তখন মনে হয় জীবন যেন জাদুকরের হাতের খেলনা, যখন ইচ্ছে হলো খুলে দেখাল কিংবা বন্ধ করে রেখে দিলো জীবনের পাশে। গল্পে আঙ্গিক বা কাঠামোভঙ্গিতে তাঁর দৃষ্টির যে স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব পড়ে তা পাঠককে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। আর তাই তাঁর গল্পে উঠে এসেছে  হতাশা, প্রেমাবেগ এবং সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক ছক। বৈরী পরিবেশে মানুষ যে অসহায়ত্বের শিকার এই বিশেষ উপলব্ধি কায়েসের গল্পরচনার প্রেরণা। গল্পের চরিত্ররা আত্মগত ভাবের দ্বারা প্রভাবিত, কখনো তারা নিজের ভেতর ছাড়া অন্য কোনোভাবে নিজেকে পরিচালিত করতে পারে না, হয়তো এখানেই কায়েসের স্বাতন্ত্র্যবোধ।

তাঁর রচনাসমগ্র যৎসামান্য – ১. অন্ধ তীরন্দাজ (গল্পগ্রন্থ, ১৯৮০), ২. দিনকাল (১৯৮৩), ৩. নির্বাসিত একজন (১৯৮৬), ৪. লাশকাটা ঘর (গল্পগ্রন্থ, ১৯৮৭)। কিন্তু এর ভেতর দিয়েই তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে সমস্যা থেকে গভীরতর সমস্যার পাদদেশে নিজেকে প্রবাহিত করেছেন। স্বল্পসংখ্যক হলেও গুণে-মানে তাঁর গল্প সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর সাহিত্যসম্ভার যতই সামান্য হোক, তিনি কালপুরুষ হিসেবে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে, বিশেষ করে তাঁর ছোটগল্প অবশ্যই একটা বড় আসন দখল করে আছে, যার ভেতর দিয়ে মানবতাবোধ-ভ্রাতৃত্ববোধ যেমন জাগ্রত হয়, তেমনি সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে-বিভেদ, যে-দূরত্ব তা লোপ পায়।

এখানে কায়েসের কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলে ধারণা পাওয়া যাবে তাঁর গল্পবিশ্ব কতখানি সমৃদ্ধ। সময়ের দর্পণে তাঁর ছবি যতই অস্পষ্ট হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যাকাশে তিনি একটি নক্ষত্র – এ-কথা মানতেই হয়।

পুরনো ঢাকার বিশাল পুরনো বাড়িতে বসবাসরত কিছু নিম্নবিত্ত হিন্দু পরিবারের মানবেতর জীবনযাপনের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে ‘লাশকাটা ঘর’ গল্পে। নাগরিক জীবনের নানা পাওয়া-না-পাওয়া থেকে যে-যন্ত্রণা যে-দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি, তা এখানে স্পষ্ট চিত্রায়িত। কালীনাথ গল্পের প্রধান চরিত্র হলেও একটা সময় নিজে আর প্রধান থাকেনি, আশপাশের অনেক চরিত্র সেখানে ভিড় করে, তাদের যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ চিত্রিত হয়, তার স্ত্রী গিরিবালা এবং নিশিকান্ত-হৈমবতী, সমাজতন্ত্রবাদী মনতোষ মাস্টার-জয়া বা বাসুদেব-সর্বাণী ঘটনা পরম্পরায় গল্পে একাকার হয়ে যায়। দারিদ্রে্যর ভিত বড় বেশি আলগা হয়, গল্পে দেখা যায় শেষরাতে সদর দরজা খুলে অন্ধকারের ভেতর কালীনাথ হারিয়ে যেতে চেয়েছিল, কারণ তার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই, রাতদিন গিরিবালার অভাবের বয়ান বড় অসহ্য লাগে; কিন্তু মৃত্যু বড় কঠিন, এখানে সবাই যেন একেকজন জীবনযোদ্ধা, কেউ কারো জন্য সময় দেয় না, নিন্দা করে আড়ালে, কামনা-বাসনাবঞ্চিত সব মানুষ, অস্থির সময়ের ভেতর ছুটছে অথচ তারপরও হোঁচট খেয়ে ফিরে আসছে খুঁটিতে রশি বাঁধা গরুর মতো, তার সীমান্ত ওইটুকুই বরাদ্দ। নাগরিক জীবনের অসাধারণ একটি গল্প ‘লাশকাটা ঘর’। এখানে সবাই সবার মাথা খাচ্ছে, সবাই সবার জীবন ছিন্নভিন্ন করছে, তারপরও সবাই নির্ভীক, একটা ঘোর, একটা অমানিশা সবাইকে মাতাল করে রেখেছে।

দারিদ্র্য যে কী ভয়াবহ তা কায়েস ভালোভাবেই জানেন, কারণ তাঁর জীবন দারিদ্রে্যর কশাঘাতে জর্জরিত ছিল; ভয়াবহ সেই দারিদ্র্য তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়, সেইসঙ্গে আছে প্রামিত্মক মানুষের হাহাকার, নষ্ট রাজনীতি এবং সেই নষ্ট রাজনীতির সঙ্গে মিশেছে দেশভাগের মতো কঠিন আরেক বিষয়, যে-বিষয় নিয়ে তিনি কলম ধরেছেন শক্ত হাতে। দেশবিভাগ মানে ছন্নছাড়া জীবন, সে-জীবনের শিকার তিনি নিজেই। জন্মভূমি, নিজের দেশ, নিজের মাতৃস্নেহ ছেড়ে তাঁকে যে চরম দুঃসহ জীবনের খেয়া পাড়ি দিতে হয়, তারই চিত্ররূপ তাঁর গল্পে বারবার এসেছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে।

কয়েকজন হতাশাগ্রস্ত যুবকের কাহিনি কায়েস তুলে ধরেছেন ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ গল্পে। কাজ নেই, জমিজমা নেই, অথচ ঘরে বউ-ছেলে বা মা-বাপ রয়েছে; কিন্তু জীবন নির্বাহের কোনো অবলম্বন নেই। সগু-পচা-নিতাই এবং নাড়ু গল্পের প্রাণ, তারা জীবনের গভীর সত্যকে উপলব্ধি করে ফেলেছে এবং তাই সামন্তবাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, যতরকম পাপাচার-দুনম্বরি কাজ থেকে শুরু করে রেশন-মাল পাচার সবই করে তারা। বলাই মাইতির অঞ্চলের প্রধান হওয়ার আকাঙক্ষা তীব্র। সে-কারণে আরেক ধনাঢ্য ব্যক্তি বিজয় খড়ুইকে হত্যার জন্য চার যুবককে ভাড়া করে সে। বলাইয়ের অনেক টাকা। অন্যদিকে চার যুবকের কোনো টাকা নেই, কাজ নেই, জমি নেই, জীবন তাদের স্থির হয়ে আছে, অসামাজিক কাজে লিপ্ত হলেও প্রকৃতি তাদের সম্মুখে বাধা সৃষ্টি করে বসে আছে। এ-গল্পে নিগূঢ় সত্য জ্যোৎস্নার আলোর মতো ফুটে উঠেছে। সেখানে রাত্রিকাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, বেঁচে থাকা তাদের কাছে যন্ত্রণাবিদ্ধতা মনে হয়, মরে যেতে ইচ্ছে করলেও মরে যেতে পারে না, তাই সগুকে ভারি বিশ্রী দেখায়, কাঁদতে থাকা একজন মানুষকে চাঁদের জ্যোৎস্নায় অবিকল একটা ঘোড়া মনে হয়, এভাবেই গল্পে জীবনের ঈষৎ আলো দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে চাঁদ আলো না ছড়াক, রাত্রির তিমির অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রাখে সমস্ত অবয়ব।

কায়েসের গল্পে জীবন উঠে আসে সাবলীলভাবে, এখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, সবাই যেন সবার কষ্টে ভারাক্রান্ত, আর তাই গল্পগুলো শুধু গল্প হয়েই থাকেনি, জীবনের খ-টুকরো হয়ে গেছে।

দু-বন্ধু জগন্নাথ বারুই ও হরিদাস। হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে অন্ধ জগন্নাথ গান গায় আর হরিদাস নতুন হাঁড়িটির মুখ পেটের ওপর রেখে দু-হাতের আঙুলে ভারি সুরেলা বোল তুলে তাল-লয় ঠিক রাখে। দু-বন্ধুর মধ্যে চমৎকার সৌহার্দ্য যেমন আছে আবার ঝগড়া বা মারামারিও হয় কখনো-সখনো। তারপরও দুজন
সুখে-দুঃখে একে অপরের কাছাকাছি থাকে, এতেই যেন ওদের অধিক আনন্দ। ‘দুই গায়কের গল্প’ প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। গল্পের শেষে নকশাল পার্টির সঙ্গে পুলিশের যে সংঘর্ষ হয়েছিল তার বর্ণনা আছে। গান যেমন মানুষের প্রাণকে মোহিত করে তেমনি গানই দূরের মানুষকে কাছে এনে দেয়, গান দিয়েই পাঠক চিনতে পারে জগা-হরিকে। গোঁয়ার-গোবিন্দ কানা হলেও তারও ভালোবাসা ছিল; কিন্তু সে ভালোবাসা পালিয়ে গেছে
মাস-ছয়েক ঘর করে গ্রামের এক ছেলের সঙ্গে। এদিকে সব থাকলেও জগা পথের রাজা হতে চায়, বদ্ধ কোনো সীমামেত্ম থাকতে চায় না, গানের সুরের ইন্দ্রজালে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে ফেরে আপন ভুবনে। এই গল্পে জীবনের কঠিনতম মানে খুঁজে পাওয়া যায়।

‘খঞ্জ রোদে শালিক ফড়িং’ গল্পে যৌনতার একটু রেশ বেশ ভালোভাবে রয়েছে, সেই সঙ্গে ভায়োলেন্সের উপস্থাপনা। গোবরকুড়ানির সঙ্গে সঙ্গম করতে গিয়ে ছেলেটি মাটি-কাঁপানো ট্রেনের আওয়াজ শোনে এবং সে-ট্রেনের চাকায় মানুষের মু-ুহীন শরীর থেঁতলে পড়ে আছে, যার একটা চোখ অক্ষত হয়ে রেললাইনের গায়ে থেঁতলানো চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। গল্পের দৃশ্যবর্ণনা বেশ মন ছুঁয়ে যায়। কাব্যিক বলা যায়; কিন্তু তারপরও এক নিশ্বাসে পড়ার আগ্রহ কমে না। যেন মানবিকতা স্পর্শ করে, যার ভেতর দিয়ে দারিদ্র্য প্রত্যক্ষ করা সম্ভব, যেমন মানুষের মরার জন্য কি কারণের অভাব! কেন মানুষ মৃত্যুকে গ্রহণ করে, শেষাবধি মৃত্যুই যেন তার ভবিতব্য, অভাব-দারিদ্র্য ছাড়াও মানসিক-শারীরিক কারণে জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণা পুঞ্জীভূত হয়, তখন সে জীবনকে তুচ্ছ ভেবে নিজেই তার পথকে মসৃণ করে।

পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থিদের নির্মমতার কথা বর্ণিত হয়েছে ‘মহাকালের খাঁড়া’ গল্পে। নকশাল বাহিনীর নিষ্ঠুরতার একটা বীভৎস চিত্র এ-গল্পে পাওয়া যায়। ভরত কোলের ছেলে সুরেনকে বলি হতে হয়। শ্রেণিশত্রম্ন বলে নকশাল বাহিনী গলাকাটা চলছে-চলবে প্রচার করে, আর সুরেন তাদের রোষানলে পড়ে। ‘মহাকালের খাঁড়া’ গল্পটি আমাদের জীবনের নানা সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করে, যার ভেতর দিয়ে অনেক গভীরে পৌঁছে যায় আমাদের চেতনা। ভরত কোলে রাতারাতি ধনী হয়েছে চোলাই মদের কারবার আর বেআইনি ব্যবসা করে। তিনতলা বাড়ি, জমিজমা এবং আরো নামহীন ব্যবসাপাতি, যা লোকের চক্ষুশূল হয়েছে। বরাবরই সতর্ক থেকেছে এবং ছেলে সুরেনকে সতর্ক করেছে। কিন্তু তার কথাকে কখনো পাত্তা দেয়নি ছেলে। ঝন্টু ড্যাগার দিয়ে সুরেনের পিঠে আঘাত করে। এখানেই শেষ নয়, সে সুরেনের পুরুষাঙ্গেও ড্যাগার দিয়ে পোঁচ দেয়। তার পরের কাজ সারে হরি-সুদীপ-অনাদি। রাত সাড়ে বারোটার দিকে নতুন বাঁশের খাটিয়ায় শুয়ে মানুষের কাঁধে চড়ে সুরেন বাড়ি ফেরে। তার লাশ ঘিরে উৎসাহী মানুষের হল্লা। ভূমিকাহীন অসহায় কয়েকশো মানুষের মধ্যরাতের এই সমাবেশ সত্যিই গ্রামবাসীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় মুহূর্তে। হ্যাজাকের আলোয় ভরত কোলের অশ্রম্নময় মুখম-ল চকচক করে জ্বলে, পোয়াতি বউ এবং মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে, নকশাল বাহিনীর শ্রেণিশত্রম্ন খতম চলছে-চলবে পোস্টার পড়ে দেয়ালে দেয়ালে, মানুষ নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে। এভাবেই গল্পে একটা চিত্র বর্ণিত হয়েছে, যা মানুষ, নিসর্গ, রাত্রিকাল – সমস্ত চরাচরকে ছিন্নভিন্ন করে।

কায়েস আহমদের লেখায় মানবতা যেভাবে ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই বিস্মিত করে পাঠককে। এক্ষেত্রে বলা যায় ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ গল্পের কথা। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মভিটের সন্ধানে গিয়ে কায়েস ভ্রমণপিপাসুদের মতো শুধু চোখ-কান বন্ধ করে নয়, একেবারে সজাগ রেখে তাবৎ বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছেন। জীবন যে কতখানি সজীব তার একটা ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায় এ-গল্পে। বিশেষ করে ওই অঞ্চলের সব থেকে বয়স্ক মানুষ রমণী মুখুজ্জের বাড়ি গিয়ে হতবাক হন তিনি। প্রাচীন অট্টালিকার  ধ্বংসসত্মূপের মতো বাড়িতে ঘোলা চোখে বৃদ্ধ বসে আছেন, আর তাঁর ছেলে বিমল বাপের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন, বাপ মরলে বউ-সন্তান নিয়ে ভারতে চলে যাবেন। এদেশের পাট চুকিয়ে কেন চলে যাবেন – তার কোনো সঠিক উত্তর নেই। রমণী মুখুজ্জে ঘাটশিলার স্টেশনমাস্টার ছিলেন  ব্রিটিশ আমলে। তার ছেলে বিমল একসময় ঢাকার লায়ন সিনেমার বুকিং ক্লার্কের কাজ করতেন। এভাবেই গল্পে স্মৃতি-স্মৃতি কিছু কথা উড়ে এলেও মানিকের ভগ্ন বাস্ত্তভিটা বিমলের অসহায়ত্বের কাছে কেমন যেন মেকি হয়ে যায়।

জেলেপাড়ার কয়েকজন হতদরিদ্র মানুষের কথা বলা হয়েছে ‘পরাণ’ গল্পে। জেলেদের জীবনের ভালো-মন্দ দিক এতে প্রতিফলিত হয়েছে। জেলেদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ছবি এবং বিচিত্র জীবনাচরণের দৃশ্য ফুটে উঠেছে এ-গল্পে। দেশ স্বাধীন হয়, মেঘলালদের জীবনে উন্নতি হয় না, বরং বারদশেক ডাকাতি হওয়ায় জেলেপাড়ার মানুষের চোখের ঘুম হারিয়ে যায়। নিরন্ন এসব মানুষের গল্পগাথা-জীবন আমাদের দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত করে। দেশ স্বাধীন হলেও সংখ্যালঘুদের ভীতি এতটুকু কমেনি, বরং ডাকাত পড়লে ঘরবাড়ি ফেলে জীবন রক্ষার্থে পালিয়ে যায়, তবু দেশ ছাড়ে না, মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। জীবন যেন এখানে শুধুই প্রদীপ; একটু বাতাসে নিভে যাওয়ার যে-আতঙ্ক তার কামড় বড় বেশি ভাবিয়ে তোলে, অথচ পারে না মাটির মায়া, পরিচিত পরিবেশ এবং চেনাজানা মানুষদের ছেড়ে যেতে। বদ্ধ একটা আঙিনায় গুটিকয়েক মানুষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে, অপেক্ষা যেন তাদের আর শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু মান যায়, ইজ্জত যায়, কুয়াশায় ঢাকা রাত্রি নামে, শিশিরে জমে মানুষের চাপা ফিসফাস, সমস্ত গ্রাম যেন স্তব্ধ হয়, পাহারারত মানুষের চোখের সামনে নতুন পর্দা পড়ে; কিন্তু উত্তেজনা কমে না।

একটি প্রেমের গল্প ‘অন্তলীন চখাচখী’। পল্টু ও দোলার মধ্যে মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। দোলা চলে গেলে পল্টুর মনে প্রেমের তৃষ্ণা জাগ্রত হয়। অন্যদিকে দোলার মনে বিচিত্র মোহের সৃষ্টি হয়। প্রেম-প্রকৃতির মধ্যে যে-সৌন্দর্য, সে-সৌন্দর্যের চিত্র গল্পে প্রতীয়মান। প্রেম প্রধান প্রসঙ্গ; কিন্তু ওই প্রসঙ্গেই এসেছে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার নানা টানাপড়েন – আপাত বাস্তবতার অন্তরালবর্তী বিষাক্ত মৃত্যুর হিলহিলে সাপ এঁকেবেঁকে অনুভূতির ভেতর দিয়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ ফণা তুলে ছোবল মারে, আবার অন্তরালে চলে যায়। মৃত্যু এবং তীব্র বেগে ছুটে যাওয়া – এ দুটো জিনিস আসে এবং যায় কায়েসের গল্পে। গল্পের ভাষা-শব্দচয়নে নতুনত্ব বিদ্যমান, আঙ্গিকে লক্ষ করা যায় চমৎকারিত্ব ফুটিয়ে তোলার মুন্শিয়ানা। প্রতীকী গল্পের অস্তিত্বটি মানবাকৃতির অচেনা শরীরের ভেতর অন্বেষণ করতে হয়।

‘গগনের চিকিৎসা তৎপরতা’ বিকৃতমস্তিষ্ক গগনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, যে-প্রশ্ন মানুষ আদিকাল থেকে আজ অবধি করে আসছে, ওষুধে রোগ সারে কি না, মূলত ভাতের কষ্ট-দারিদ্র্য অর্থাৎ অর্থনৈতিক কারণে মানুষ যে সত্যি সত্যিই পাগলে পরিণত হয় তারই রূপ দেখতে পাওয়া যায় এ-গল্পে। বীরেন ডিগ্রি ছাড়া ডাক্তার হলেও জনসেবায় সে দিবানিশি প্রাণ বিসর্জন দেয়, স্ত্রী হিমানী পছন্দ না করলেও সে স্নান-খাওয়া-নাওয়া-আরাম ভুলে ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-শীতকে তোয়াক্কা না করে ছুটে যায় রোগীর সেবায় দূরদূরামেত্ম, রাতে-দিনে। এতে লাভ তো দূরের কথা মানুষের দৈন্যের কারণে ওষুধের পয়সাও ফেরত আসে না। একদিন হিমানী বলে, ‘ডাক্তারি তোমার নেশা না কি পেশা!’ বীরেন কোনো উত্তর দিতে পারে না। এদিকে হতদরিদ্র গগন নিজের কষ্ট-যন্ত্রণা অসুখ মোচন করার জন্য মলম চায়, যে-মলমের ভেতর দিয়ে কায়েস তাঁর গল্পটিকে একটি নির্দিষ্ট ছকে উপনীত করেছেন। ভাষা-ব্যবহার বা বাক্যবিন্যাসে, শব্দচয়নে গল্পটি এক অনবদ্য সৃষ্টি, এ-কথা মানতেই হয়।

বেশ ছোট আকারের গল্প ‘যাত্রা’। অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ পাওয়া যায় এ-গল্পে। ট্রেন থেকে নেমে আসা মানুষটির মনে হলো, বুঝি ভুল স্টেশনে নেমে পড়েছে। ঘনকালো রাত, তার সম্মোহনী শক্তির দ্বারা লোকটি যাত্রাপথ পরিবর্তন করলে রহস্যময় এক জগতে নিয়ে চলে যায়। শরীরী অচেনা মানবাকৃতির অস্তিত্বটি প্রতীক হিসেবে অবতীর্ণ করলেও গভীর বিশেস্নষণে দেখা যায় পরাবাস্তব উপাদান কায়েসের নতুন ধারার গল্প সংযোজন। এ-গল্প পাঠে স্পষ্ট বোঝা যায়, কায়েস আহমদের গল্পের চরিত্রগুলো আত্মগত ভাবের দ্বারা প্রভাবিত, অবচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ গল্পের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বিস্ফোরিত হয়েছে, সেই সঙ্গে জীবনপ্রবাহের বোধ শিল্পায়িতভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

‘ফজর আলীর গল্প’ পাঠকের বোধের জায়গায় নাড়া দেয়। গরিবের চেয়েও গরিব মানুষের একটা গল্প, যার তিন মেয়ে এক ছেলে, স্ত্রী নিয়ে সংসার; কিন্তু নিদারুণ খরা মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। তখন তার জীবন-জীবিকা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু ফজর আলীর বউ জমিরন, যার বাবা এক হাজার এক টাকা দেনমোহরে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে, সে কি না বাঁশ ফাঁড়ার মতো গলায় বলে, ‘নিজের মাগছেলেকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দেবার মুরোদ নেই, সে-মানুষের আবার সংসার করার শখ কেন?’ এই কথায় ফজরের আত্মসম্মানবোধে চরম আঘাত লাগে। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। তার বাপ-দাদা-পরদাদা এভাবে দেখলে সবাই তো বিয়ে করেছে, তারা কেউই এমন কোনো মহাপুরুষ ছিল না, তার বাপেরও বাঁধা কোনো কাজ ছিল না, ঘরামির কাজ করত অথবা যখন যা পেত করত, তাই বলে মা তো কোনোদিন স্বামীকে এমন কথা বলেনি। ফজর আলী ভাবতে পারে না। নিজের মধ্যে অন্যরকম তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। একসময় সে গোরস্তানে গিয়ে অনেক খুঁজে বাপের কবর পায়। তারপর চন্দ্রবোড়া সাপটিকে পাশের কবরের পচা বাঁশ দিয়ে ফণার ওপরে সজোরে মারে। একটা জিজ্ঞাসা, একটা ক্ষিপ্ততা তাকে মুহূর্তে উন্মাদ করে তোলে, সাপটি মরে যায়, তারপরও দমাদ্দম পেটাতে থাকে, মনের ক্ষোভ-আক্রোশ যেন মেটে না। গল্পে দেখা যায়, এভাবেই মানুষের সঞ্চিত কষ্ট-দুঃখ বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসে, তখন সে দাঁতাল শুয়োরের মতো হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চমৎকার একটি গল্প ‘নচিকেতাগণ’, উত্তম পুরুষে রচিত। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে গল্পটির আঙ্গিক নির্মিত। ছোটভাই দীপু মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, তাই রাইফেলধারী সৈনিকেরা বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জিপে করে। মুখোমুখি বসে আছে, শহরের যাবতীয় দৃশ্য দেখছে, আগেও দেখেছে; কিন্তু এখনকার দেখার মধ্যে পার্থক্য যে পরাধীন হয়ে শহর দেখা। তারপর মিলিটারিরা তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়, সেখানে দেখে আরো অনেককে নিয়ে আসা হয়েছে, যাদের কাছে বিভিন্ন স্বীকারোক্তি নেওয়ার পরিকল্পনা চলে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের একটা চরম মুহূর্তকে গল্পে বন্দি করেছেন কায়েস। স্বাধীনতার আকাঙক্ষায় একদিকে সমগ্র জাতি উদ্বেলিত, অন্যদিকে আতঙ্ক গ্রাস করছে সবাইকে। মৃত্যুভয়, ভারী বুটের শব্দ আর রাইফেলের দানবতায় সমগ্র জাতি ভীত হলেও আকাশে সোনার চাঁদ উঠবে, সে-অপেক্ষায় নিমজ্জিত জাতি। গল্পে দেখা যায় দীপুর ভাইকে ধরে আনলেও আলাদা ঘরে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি, তবে করবে, সে অপেক্ষায় আছে, অথচ আর সবাইকে একে একে প্রতি রাতে প্রশ্ন করছে, অত্যাচার করছে, একদিন তার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়। এই শব্দের মধ্য দিয়ে গল্পটির যবনিকা পড়লেও পাঠকের বুঝতে এতটুকু বিলম্ব হয় না যে, তারপর মিলিটারিরা তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্মমভাবে অত্যাচারের জন্য নিয়ে যাবে, সেখান থেকে ফিরে আসা-না-আসা সবই ভবিতব্য বই তো কি!

কায়েস গল্প লেখেন না, গল্পের আঙ্গিকে দৃশ্য চিত্রায়িত করেন, সেই ছবি পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে, পাঠক বিমুগ্ধ হন। বাস্তবতার নিরিখে কায়েস যে জীবন-জগৎ তুলে এনেছেন এবং শিল্পসম্মতভাবে নির্মাণের যে নিজস্ব স্টাইল এবং প্রকরণগত নতুন চিন্তাভাবনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন তাতে সার্থক ও সফল হয়েছেন, এখানেই খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।