সত্যসন্ধানী গবেষকের উপস্থাপনা

রণজিৎ মল্লিক

ঢাকার বুদ্ধদেব বসু
সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রথমা প্রকাশনী
ঢাকা, ২০১১

৩৬০ টাকা

কবি বুদ্ধদেব বসুকে (১৯০৮-৭৪) নিয়ে অজস্র বই লিখিত হয়েছে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বড় বড় সংকলন বেরিয়েছে অনেক আগে। তদুপরি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের অনেকদিকই অজানা রয়ে গেছে। বুদ্ধদেব বসুর জীবনের সেই অজানা অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে সত্যসন্ধানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের ঢাকার বুদ্ধদেব বসুতে। যদিও বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষের (১৯০৮) কিঞ্চিৎ পরে, ২০১০-এ প্রকাশিত, তদুপরি ‘এই বই বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর প্রতি একজন ঢাকাবাসী হিসেবে’ গবেষকের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায়, বুদ্ধদেব বসুর অবদান অপরিসীম এবং ঐতিহাসিক। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকবাদী আন্দোলনের তিনি প্রধান পুরোহিত। অনেক রকম অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায় এবং হয়েছেও : কবিতার শিক্ষক, সম্ভ্রান্ত রোমান্টিক, আধুনিক ইত্যাদি। কিন্তু এসব অভিধা এবং আলোচনা-সমালোচনায় বুদ্ধদেব বসুর একপাশে একটি চিত্র পাওয়া যায়, বিশেষত ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসুর কতকগুলো মানবীয় ত্রুটি অলক্ষিত থেকে গেছে অথবা সকলেই সজ্ঞানে সেসব ত্রুটি এড়িয়ে গেছেন। ঢাকার বুদ্ধদেব বসুতে সৈয়দ আবুল মকসুদ কবিকে কোনোভাবেই খাটো না করে বরং তাঁর চরিত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অাঁকতে প্রয়াসী হয়েছেন কবি এবং মানুষ বুদ্ধদেব বসুর ভালো-মন্দের মিশেলে। বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘উপক্রমণিকা’র প্রথম বাক্যেই বলা যায়, অত্যন্ত নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে সৈয়দ আবুল মকসুদ কোনো প্রকার ভনিতার আশ্রয় না নিয়েই শ্রদ্ধার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অবস্থান চিহ্নিত করেছেন – ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের বৃত্তের বাইরে – তাঁদের সমসাময়িক অথচ অব্যবহিত-পরবর্তী – বাংলা সাহিত্যে ‘তিরিশের কবি’ বলে যারা পরিচিত, তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)-র জীবনানন্দ দাশের পরেই এবং তিনি বহুমুখী ও বহুপ্রজ।’ (ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, পৃ ১৩)। বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু একটি মাত্র বাক্যবন্ধনে লেখক যেভাবে বুদ্ধদেব বসুকে চিহ্নিত করেছেন তাতে সপক্ষ-বিপক্ষের মারমুখী কূটচাল নেই। বরং যা রয়েছে তা হলো, একজন নিষ্ঠাবান গবেষকের নির্ভার নিরপেক্ষতা।
যদিওবা ঢাকার বুদ্ধদেব বসু; তবু এই বই বুদ্ধদেব বসুর ঢাকা-পরবর্তী কলকাতার জীবনের কিছু অমূল্য অজানা অধ্যায়কেও সংক্ষিপ্তাকারে, প্রামাণ্য তথ্যের আলোকে উপস্থাপন করেছে। গবেষণাগ্রন্থ বটে, তাই বলে নিরেট আর নিরস তথ্যের পরিবেশনা মাত্র নয়, বরং বইয়ের পরতে পরতে রয়েছে গল্পের আমেজ যা পাঠককে করে তোলে ততোধিক কৌতূহলী, তাকে নিয়ে চলে সামনের পানে। সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মননশীল বিশ্লেষণ আর তাঁর বলার ধরন একই সঙ্গে খুলে দেবে পাঠকের মনের জানালা এবং তাকে দেয় গ্রন্থপাঠের অপরিসীম অনির্বচনীয় এক আনন্দ। তিনটি পরিশিষ্ট এবং উপক্রমণিকাসহ মোট পনেরোটি অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর বাল্য কৈশোর যৌবন আর প্রৌঢ় জীবনের বিচিত্রসব ঘটনা। একই সঙ্গে উঠে এসেছে সমসাময়িক অনেক কবি-লেখকের জীবনকাহিনি। সুতরাং একই পাঠ মানে ঢাকাবাসী একজন লেখকের জীবনকাহিনি নয়, বরং তা বাংলা সাহিত্যের একটি সোনালি অধ্যায়কেই অবলোকন করা।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর জীবনের একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল পর্ব কাটিয়েছেন ঢাকায় – পুরানা পল্টনে। তাঁর আত্মজীবনী আমার যৌবনে ঢাকার পুরানা পল্টন তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রজীবন ধরা দিয়েছে অতুলনীয় স্মৃতিমেদুরতায়। ১৯৩১-এ তল্পিতল্পাসহ ঢাকা ছাড়ার পরে বুদ্ধদেব বসু শেষবার কখন ঢাকা এসেছিলেন তা নিয়ে যখন তিনি নিজেই স্মৃতিভ্রষ্ট সেখানে সৈয়দ আবুল মকসুদ ইতিহাসের নানা অলিগলি হাতড়ে সঠিক তথ্যের আলোকে বর্ণনা করেছেন বুদ্ধদেব বসুর ‘ঢাকায় শেষ সফর’। তাঁর ভাষায়, ‘প্রকৃত ঘটনা হলো, তিনি এসেছিলেন ১৯৫০-এর ১৩ আগস্ট দুপুরে এবং কলকাতা ফিরে যান ১৫ আগস্ট দুপুরে। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ঢাকা সফর।’ (ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, পৃ ১৪৩) বুদ্ধদেব বসুর কল্লোলিত যৌবনের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও প্রগতি সম্পাদনা, ঢাকায় নজরুলের সান্নিধ্য লাভ, নজরুলের সঙ্গে রানু সোমদের (প্রতিভা বসু) পারিবারিক অন্তরঙ্গতা, সজনীকান্ত দাশ ও তাঁর শনিবারের চিঠির দলের সঙ্গে বুদ্ধদেব গোষ্ঠীর তুমুল সাহিত্যিক বিরোধিতা, পূর্ববাংলার লেখকদের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পর্ক ইত্যাদি সব কৌতূহল-জাগানিয়া এবং পাঠকমনের তৃষ্ণা মেটাবার মতো সব বিবরণ তো রয়েছেই; সেসঙ্গে এও দেখানো হয়েছে যে, বুদ্ধদেব বসু কেবল একজন নিষ্ঠাবান সম্পাদক ও তরুণ লেখকদের অকপট উৎসাহদাতা ও পরামর্শদাতাই ছিলেন না, তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন ‘অকৃতজ্ঞ’। বুদ্ধদেব বসুকে প্রেরণা এবং প্রতিষ্ঠা লাভে সহায়তা করতে যেসব ব্যক্তি ছিলেন অকুণ্ঠ তাঁদের অনেককেই তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে। সৈয়দ আবুল মকসুদের ভাষায় : ‘কত মানুষের শারীরিক বর্ণনা দিয়েছেন, কারও কারও মুদ্রাদোষগুলোর নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু তাঁর অনেক হিতাকাঙ্ক্ষীর এবং যাঁদের কাছে তিনি ঋণী, তাঁদের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছেন।’ তাঁর এই ভুলে যাওয়ার কারণ যে একেবারেই অনিচ্ছাকৃত তা নয়; বরং বুদ্ধদেবের মধ্যে একধরনের উন্নাসিকতা ছিল – ছিল চিনতে না-পারার সচেতন প্রবণতা। না হলে মুন্সীগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠের বিপর্যয় থেকে উদ্ধারকারী পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহের ‘অত্যন্ত খ্যাতিমান কবি’ যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যকে (১৮৯০-১৯৭৫) বুদ্ধদেব স্মৃতিকথায় ‘তুচ্ছভাবে উল্লেখ করতেন না।’ বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কবিতার বই মর্মবাণী যিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রকাশ করেছিলেন, সেই গঙ্গাচরণকে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ জানাচ্ছেন যে, বুদ্ধদেব বসুর কাব্যগ্রন্থ বন্দীর বন্দনা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলে তাঁর কবি-খ্যাতি জোটে। কলকাতার বিখ্যাত ডি এম লাইব্রেরির গোপাল মজুমদার কাজী নজরুল ইসলামের অনুরোধে বন্দীর বন্দনা প্রকাশ করেন। ‘কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে নজরুলের ঋণ কোথাও স্বীকার করেন নি।’ যদিও ‘স্মৃতিকথামূলক প্রচুর লেখায় তিনি অনেক ‘মানুষের কথা নিষ্প্রয়োজনেও বলেছেন।’ সৈয়দ মকসুদ বুদ্ধদেব বসুর ‘একটুখানি সংকীর্ণতারও পরিচয় পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুখ্যাত অধ্যাপক ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ও তার মুখপত্র শিখা গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা আবুল হুসেনের প্রতি বুদ্ধদেব বসুর উপেক্ষামূলক মনোভাবে। অবশ্য বুদ্ধদেব বসুর এসব সীমাবদ্ধতাকে সৈয়দ আবুল মকসুদ কোনোভাবেই আত্মকেন্দ্রিকতা বা স্বার্থপরতার পর্যায়ে দেখতে রাজি নন – ‘বুদ্ধদেব যে খুব আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর ছিলেন তাও নয়।’ বরং সৈয়দ মকসুদ এজন্যে বুদ্ধদেবের বিশেষ ব্যক্তিগত মানসিক বৈশিষ্ট্য (idiosyncracy) দায়ী বলে মনে করেন – ‘কিন্তু তাঁর এক এক ধরনের মনতাত্ত্বিক সমস্যা ছিল : ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বাইরে অন্যের অবদান ও ঋণ অকপটে স্বীকার করতেন না।’ (ঢাকায় নজরুল সান্নিধ্য, পৃ ১০২)।
ঢাকার বুদ্ধদেব বসুতে কবি বুদ্ধদেব বসুর যে-প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে তা কোনোভাবেই একপেশে নয়, বরং পূর্ণাঙ্গত ভেতর-বাহির, সংকীর্ণতা-উদারতা মিলিয়ে এমন এক ছবি যেখানে বুদ্ধদেব বসুর শ্রুত আর কল্পিত মিথ থেকে উঠে এসে ধরা দেন সত্য আর বাস্তবের আলোকে। সত্য অপ্রিয় হলেও সত্যি। মকসুদ প্রিয় মানুষের প্রিয় সত্যের সঙ্গে অপ্রিয় সত্যটাকেও সমান নিষ্ঠার সঙ্গে উপস্থাপন করে গবেষকদের কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ গবেষক-সমালোচক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্টের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। সম্ভবত এ-বিষয়টি সৈয়দ আবুল মকসুদকে সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ গবেষণার কাজে আরো বেশি আগ্রহী করে থাকবে। তিনি লক্ষ করেছেন – ‘বাংলা ভাষার সৃষ্টিশীল লেখকেরা তো বটেই, যাঁরা গবেষণা করেন ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন, তাঁরা যেন আরো বেশি প্রথাগত। ঘনিষ্ঠ লেখকদের সম্পর্কে তাঁরা নিষ্প্রয়োজনেও দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রশংসায় পঞ্চমুখ – critical insight তাঁদের নেই। পরস্পরের পিঠ চাপড়ানোর একটা ভাব বাংলা সাহিত্যে আগাগোড়াই আছে – গোত্রভুক্ত লেখকদের মধ্যে তা আরো প্রকট।’ (পৃ ১৬১) যে-সজনীকান্ত বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে স্মর্তব্য হয়ে আছেন পরশ্রীকাতরতার প্রামাণ্য প্রতিমূর্তি হিসেবে, যাঁর শনিবারের চিঠি নামক ‘শরাঘাত’ থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, তাঁর প্রতিভারও তারিফ করেছেন গবেষক – ‘সজনীকান্তেরও এক ধরনের প্রতিভা ছিল, তা অশুভ কাজে অপচয়িত না হলে তিনিও বাংলা সাহিত্যে অনেকটা অবদান রাখতে পারতেন।’ (শনিবারের চিঠি : ঢাকার বুধু বোস, পৃ ১১২)।
সাহিত্যে অশ্লীলতার আমদানিকারক এবং তার বিপণন ও পরিবেশনের অভিযোগে বুদ্ধদেব বসুকে কম যাতনা সহ্য করতে হয়নি। সমসাময়িক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত এর কারণ। তাঁর লেখায় যৌনতা প্রচলিত বিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং সেসঙ্গে ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসুরও একটি চরিত্রহীন, লম্পট, কামুক প্রতিমূর্তি লোককল্পনায় গড়ে উঠেছিল। আর সে-কারণে ‘অনেক শিক্ষিত লোকও তাই বন্ধমূল ধারণাবশত তাঁর গল্প উপন্যাস থেকে দূরে থাকতেন।’ অর্ধশতাব্দীর আগে গড়ে ওঠা সে ইমেজের ভগ্নাবশেষ যে আজো টিকে থাকতে পারে কোনো কোনো মহলে তা বিচিত্র নয়। অথচ ব্যক্তিজীবনে বুদ্ধদেব বসু মোটেও ওরকম ছিলেন না। সমসাময়িক এবং তৎপরবর্তী বিদ্বৎজনের বয়ানে সৈয়দ আবুল মকসুদ দেখিয়েছেন – ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসু ছিলেন পরিশীলত এবং নীতিবান, ‘সৎ ও চরিত্রবান’ একজন মানুষ। সাহিত্যে যৌনতা বা অশ্লীলতার (copmology) প্রতিক্রিয়াশীলতার ব্যাপারে গবেষকের সুবিবেচিত মন্তব্য লক্ষণীয়। তিনি একে ‘অপরিণত ও অনাধুনিক সমাজের কুললক্ষণ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। সমাজ ও সাহিত্যের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়টি সুগভীর মনস্বিতায় ধরা পড়েছে সৈয়দ মকসুদের দৃষ্টিতে – ‘পাঠক যেখানে এতটা পিছিয়ে থাকে – সংস্কারে আবদ্ধ থাকে – সেখানে লেখকও পিছিয়ে থাকতে বাধ্য। … সামনের নতুনত্বে বা আতিশয্যে পাঠক যে সমাজে মূর্ছিত হয়, সেখানে নতুন কোনো বড় জিনিস সৃষ্টি হওয়া দুরূহ।’ এবং লেখকের মতে, ‘সেকালে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মান এবং তার পাঠকের মেধার মান সমান্তরাল ছিল বলেই বিশ ও তিরিশের দশকে মহৎ সাহিত্য অতি সামান্যই সৃষ্টি হয়েছে।’ (ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, পৃ ১১৪-১১৫)।
পূর্ববঙ্গের লেখকদের সঙ্গে, বিশেষত প্রতিভাবান তরুণ লেখকদের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর অন্ত্য একটি আন্তরিক সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরেছেন গবেষক। অনেক সমালোচক রয়েছেন যাঁরা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির একটি সংকীর্ণ গলি থেকে বুদ্ধদেব বসুকে বিচার করে থাকেন। তাঁদের জন্য এ-বইটি অবশ্যপাঠ্য। বিশেষ করে ‘পূর্ব বাংলার লেখকদের সঙ্গে সম্পর্ক ও বিবিধ প্রসঙ্গ’ অধ্যায়টি (পৃ ১১৯-১৪২)। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে শামসুর রাহমানের প্রথম আলাপের বিবরণ সংবলিত ‘প্রথম আলাপ : বুদ্ধদেব-শামসুর রাহমান’ (পৃ ১৫৫-১৫৯) অধ্যায়টিও এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ‘বুদ্ধদেব ঢাকা ও পূর্ব বাংলার প্রেমিক ছিলেন না। ঢাকার প্রতি তাঁর কোনো বিশেষ মোহ ছিল না।’ কেবলই ‘স্মৃতিকাতর ছিলেন’ (?) তাঁর যৌবনের পুরানা পল্টন নিয়ে, তদুপরি এ-কথা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ঢাকার স্মৃতি যত আবেগের ঐশ্বর্যে আর ঐকান্তিকতায় বর্ণিত হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবনে তা বাংলা সাহিত্যের আর কোনো লেখকের কলমে ধরা পড়েনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন বলে ওই শ্রেণির সমালোচকেরা বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগের মোটা অঙ্গুলি তোলেন তাঁদের জানা প্রয়োজন, স্বভাবগতভাবেই বুদ্ধদেব বসু ছিলেন রাজনীতিবিমুখ মানুষ – ‘সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর জীবনের মূল – বস্ত্তত একমাত্র ব্রত।’ আরেকটি কারণ তাঁর অগভীর রাজনৈতিক চিন্তা। সৈয়দ আবুল মকসুদ যেমনটি লিখেছেন – ‘বুদ্ধদেব বসুর রাজনৈতিক চিন্তা সুগভীর নয়, রাজনীতি নিয়ে কথাও বলেছেন কম, ওই এলাকাটি তাঁর নয় বলে নিজেই স্বীকার করতেন।’ (পৃ ১৩৭)। এ-কথা সত্য যে, বাংলাদেশের লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ‘তাঁর সমর্থন প্রার্থনা করেছেন’ এবং ‘তিনি কোনো আগ্রহ দেখাননি।’ সৈয়দ মকসুদের অনুমান, ‘হয়তো বিষয়টি ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনা করে তিনি এড়িয়ে গেছেন।’ (পৃ ১৪০) তবে দক্ষিণপন্থী পন্ডিত নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর মতো অথবা অতিবামপন্থীদের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে তিনি লেখালেখি করেননি, তিনি ছিলেন নিস্পৃহ। এই নিস্পৃহতাকে বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব রাজনীতি দর্শনসঞ্জাতও বলা যায়। যে-কারণে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার বিষয়বস্ত্ত (রাজনীতি) তাঁর পছন্দ হয়নি। সুকান্ত যে ‘রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয়’ করছেন সেজন্যে বুদ্ধদেব দুঃখ প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, ‘…কবি হওয়ার জন্যই জন্মেছিলেন সুকান্ত, কবি হতে পারার আগেই মরলো সে। দ্বিগুণ দুঃখ হয় তার জন্য।’ (পৃ ১৫০) ‘ঢাকায় শেষ সফর’ অধ্যায়েও বুদ্ধদেব বসুর রাজনীতিবিমুখতা নিয়ে অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ, ঘটনাবহুল আলোচনা করা হয়েছে এ-বইয়ে যা পাঠককে রাজনীতির বুদ্ধদেব বসুকে বুঝতে সহায়তা করবে।
বুদ্ধদেব বসু সগৌরবে নিজেকে ভাবতেন ‘ভারতীয়’ এবং ‘হিন্দু’। এ-তথ্য যেমনি দিয়েছেন গবেষক, যুগপৎ এ-কথাও বলেছেন যে, ‘হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তাঁর কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না।’ গবেষকের মতে, ‘তিনি রক্ষণশীল ছিলেন না।’ বুদ্ধদেব বসু যে অসাম্প্রদায়িক, মানবিক গুণসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে পশ্চিম বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের মিলনের একমাত্র ক্ষেত্র হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তাঁর চিহ্নিতকরণের মধ্যে। এক চিঠিতে লিখেছেন তিনি, ‘রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে এখনও একটি মিলনের ক্ষেত্র আছে আমাদের, একটিই আছে, একটি মাত্র। সে-ক্ষেত্র আমাদের সাহিত্য, আমাদের ভাষা। একমাত্র সাহিত্যই সেই শ্রীক্ষেত্র, যেখানে জাতিভেদ নেই, দেশে দেশে সীমান্তরেখা নেই, মানুষে মানুষে ভেদচিহ্ন নেই।’ একই পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দু মুসলমান উভয়েই যে বাংলাভাষা বলে, এই কি তাদের ঐক্যের অলক্ষ্য পরিচয় নয়?’ (পৃ ১৩৪-১৩৫)। বস্ত্তত বুদ্ধদেব বসু নিজেকে যে ‘সগৌরবে’ ‘হিন্দু’ এবং ‘ভারতীয়’ ভাবতে ভালোবাসতেন তা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়; এ হিন্দুত্বের বোধ তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক শেকড়ের অপরিহার্য উপাদান। ছোট মেয়ে রুমিকে লেখা এক পত্রে এ-বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন – ‘ভারতবর্ষ এবং হিন্দু ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমি আমার নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি না। ‘হিন্দু’ ‘সাম্প্রদায়িক’ কিছু ভাবিস না – তোর এলিয়ট যে অর্থে হিন্দু আমিও সে অর্থেই এবং এলিয়ট যে কারণে শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টান, আমিও সে কারণেই শেষ পর্যন্ত হিন্দু।’ (ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, পৃ ১৪২)।
ঢাকার বুদ্ধদেব বসুতে সৈয়দ আবুল মকসুদ বুদ্ধদেব বসুকে মূলত একজন ‘প্রথাগত বাঙালি মধ্যবিত্ত’ হিসেবেই দেখিয়েছেন। তিনি তার ‘দোষ-গুণ-সীমাবদ্ধতা’ নিয়েই ছিলেন স্বয়ম্ভর আর সমুজ্জ্বল, একজন নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক। এবং, বলা বাহুল্য, ‘প্রথাগত বাঙালি মধ্যবিত্ত’ হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক।
সর্বোপরি, পরিশিষ্ট-১-এ গ্রন্থিত বুদ্ধদেব বসুর একডালি ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ পাঠককে এনে দেয় নতুন স্বাদের আহ্লাদ। পরবর্তী পরিশিষ্টদ্বয়ে ‘ঢাকায় থাকাকালীন রচিত ও প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থাবলি’র তালিকা এবং এ-গবেষণার কাজে ‘নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জী’র বিশদ তালিকা দিয়ে লেখক ধীমান পাঠকের কৌতূহলই কেবল নিবৃত্ত করেননি, পরবর্তী নিষ্ঠাবান গবেষকের জন্যও রেখে গেছেন এক অমূল্য পাথেয়। ‘তথ্য নির্দেশ’ পর্বে অধ্যায়ওয়ারি তথ্যসূত্র এবং সর্বশেষ বর্ণাঢ্য ‘নির্ঘণ্ট’ দেখে পাঠকের বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না এই ভেবে যে, গবেষকের প্রস্ত্ততি এবং প্রজ্ঞা কত ব্যাপক ও গভীর।
কাইয়ুম চৌধুরীকৃত ধূসর কালো সাদা আর জলপাই-হলুদরঙা যৌবনের বুদ্ধদেব বসুর সপ্রতিভ মুখমন্ডল সংবলিত প্রচ্ছদে অনায়াসেই দৃষ্টি আটকে যায়। মুখ যেমন মনের কথা বলে তেমনি প্রচ্ছদও যেন বলে দেয় বইয়ের কথা। অফসেট কাগজে প্রচ্ছদহীন ঝকঝকে মুদ্রণ আর পাকা বাঁধাইসহ জ্ঞানপিপাসু এবং অনুসন্ধিৎসু গ্রন্থপ্রেমিকের সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই ঢাকার বুদ্ধদেব বসু। 