সফেদ আলীর মৃত্যু-সংক্রান্ত জটিলতা

ভয়টা মনের মধ্যে তখনই সেঁধিয়ে গিয়েছিল, যখন দিন থাকতে মালোপাড়া থেকে সফেদ আলীর ফেরা হলো না। মালোপাড়ার কোলঘেঁষে প্রায় কোয়ার্টার মাইলব্যাপী শুধু বাঁশ আর বাঁশ। বাঁশঝাড়ের ঘনত্বের কারণে সূর্য ডোবার আগেভাগে এদিকটায় অন্ধকার নেমে আসে। আর এখন তো রাতের একপ্রহর পেরিয়ে গেছে। শালা মনের সুখে

রাত-বিরেতে কেউ এদিকে আসে? কিন্তু সুভাষ মালো আনিয়ে ছাড়ল। এই একটা দিনই তাকে বাড়ি পাওয়ার সুবিধা। বাকি দিনগুলো হাটবার। মাছের ডালি নিয়ে সুভাষের হাটে যাওয়ার তাড়া থাকে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত দুজনে একসঙ্গে সোনাপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে পড়েছিল। সে হিসেবে সুভাষ তার বন্ধু বটে। কিন্তু টাকার চেয়ে বড় বন্ধু কে আছে? না হলে দুবছর আগে সফেদ আলী যে-টাকা ধার দিয়ে সুভাষের ছেলের জান বাঁচিয়েছিল সে-টাকা ফেরত দিতে এত টালবাহানা কেন? কেনইবা বন্ধুত্বে দাগ ফেলে দেওয়া! তবু যদি টাকাটা আজ পাওয়া যেত!

এসব ভাবনায় আনমনা হওয়ার কারণেই হয়তো সফেদ আলী পা হড়কে একেবারে গর্তে পড়ে যায়। শালার গোম মাইরে খাবার মেম্বার। ভোট মারাতি আইসো এইবার। দ্যাকপানে কত গোমে কত আটা। এত্ত কইরে কলাম রাস্তাডা ঠিক কর। করলে? গজগজ করতে করতে বিক্ষিপ্তভাবে টর্চের আলো ফেলে সফেদ আলী। বর্ষাকালে গরুগাড়ি চলাচলের ফলে রাস্তায় বড় বড় যে-গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো শুকনোর সময়ে এসে খটখটে পাথর। একেকটা গর্ত মৃত্যুকূপ।

পায়ের নিচে রাজ্যের বাঁশপাতা মৃদু মচমচ শব্দে ভেঙে যাচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা লাখো পাখির যে কিচিরমিচির শব্দে পাগলদশা হওয়ার জোগাড় হয় এখন তার উলটো। দু-একটা রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানির শব্দ ছাড়া চারদিক সুনসান। দূরের কোনো বাড়িতে ফুলকিসদৃশ আলো দেখা যাচ্ছে, বাকি নিঃসীম আঁধারে ঢাকা চরাচর।

ঘটনাটি ঘটল গাবতলায় এসে। যে-ভয়টা ভেতরে লুকিয়েছিল ফোঁস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সেটা সশব্দে বেরিয়ে এলো। স্যান্ডেলের ফিতার ফাঁক দিয়ে ছোবল মেরে দিলো হারামি। কিন্তু পায়ে না লেগে ছোবল লাগল স্পঞ্জে। সফেদ আলী সবেগে ঝাড়া দিয়ে সাপকে স্পঞ্জ থেকে ছুড়ে ফেলে। জাত কেউটে। পালিয়ে না গিয়ে ঘুরে প্রচ- বেগে আরেক ছোবল। এবার সরাসরি ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে। তীব্র ভয়ের সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ জেগে ওঠে সফেদ আলীর ভেতর। সাপটি হয়তো আঘাত করতে তৃতীয়বার ফণা তুলেছিল বা পালিয়েই যেত। কিন্তু সফেদ আলী টর্চের আলোয় চিকচিকে ফণা দেখে ফেলে। সে বাঁ পা দিয়ে উদ্যত ফণা সবেগে কুচলে দেয়। সাপটি লম্বালম্বি হয়ে মোচড় খেতে থাকে। সফেদ আলী লুঙ্গি ছিঁড়ে বুড়ো আঙুলের গোড়া আর পায়ের গোড়ালি শক্ত করে বাঁধে। বাড়ি পর্যন্ত হয়তো সে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। সে ভাবল বিষ গোড়ালি ছেড়ে ওপরের দিকে রওনা দিয়েছে। বাঁচার আর কোনো আশা নেই। সুতরাং আলতাবানুর পাশে রাতে যেভাবে সে ঘুমিয়ে থাকে, সেভাবেই রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর সফেদ আলী যে-নিথর শরীরটিকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখল সেটি তার নিজের।

নিজেকে এভাবে ফেলে যাওয়ার ইচ্ছা হলো না সফেদ আলীর। সে অদূরে তেঁতুল গাছের নিচে অপেক্ষা করতে থাকে। স্বামীকে ফিরতে না দেখে আলতাবানু নিশ্চয় কাউকে না কাউকে খুঁজতে পাঠাবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী! নিজের লাশ তো আর নিজে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। সাপে কাটার আগেও চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। টর্চের আলো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না অথচ এখন সে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এমনকি লাশটির আশপাশে ছোট ছোট পোকামাকড়ের উপস্থিতিও লক্ষ করে। তারা সার বেঁধে সফেদ আলীর কান আর নাকের ছিদ্রে ঢুকছে। পোকামাকড় নাকি আগে থেকে অনেক কিছু বুঝতে পারে। সম্ভবত তারা সফেদ আলীর মৃত্যুর খবর জেনে গিয়েছে।

দুই ব্যাটারির টর্চটা খানিকটা দূরে স্থির হয়ে পড়ে আছে। সেটি এখন আর সফেদ আলীর কোনো কাজে আসবে না। শুধু টর্চলাইট কেন? এই আলো, বাতাস, আলতাবানু, ঘরদুয়ার কিছুই না।

তেঁতুল গাছের পাশে গোরস্তান। সেখানেও দিনের মতো ফকফকা। সফেদ আলী বুঝতে পারে, তার দৃষ্টিশক্তি এবং দৃষ্টিসীমা দুটোই আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে। এমনিতে সে বরাবরই সাহসী তারপরও আগে রাত-বিরেতে গোরস্তানের সামনে দিয়ে যেতে-আসতে গা-টা ছমছম করত। এখন কিছুই মনে হচ্ছে না। বরং মনে হলো গোরস্তানে গিয়ে একবার ঘুরে আসা যায়। দাদা-দাদি, মা-বাবা, সাইফুল চাচা, সফেদ আলীর মৃত আট মাসের কন্যা বেলী আর পূর্বপুরুষের কতশত সদস্য যে শুয়ে আছে এখানে!

মেয়েটার জন্য মাঝেমধ্যে মন খুব কাঁদে। সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল বেলী। এক রাতে বেলীকে মাঝখানে রেখে তারা স্বামী-স্ত্রী ঘুমিয়েছিল। সকালে দেখল মেয়ে নীলবর্ণ, হিমহিম ঠান্ডা। সাপের দেশের মানুষ! দুমাস-ছমাসে দু-একজন মানুষ সাপের দংশনে মরে এই দেশে। হাতে দাঁতের নিশানা চিনতে তাদের ভুল হয় না। বুঝে গিয়েছিল জাতসাপ। সফেদ আলী জানত মেয়ে নেই তবু আলতাবানুর মনের শান্তির জন্য ঈমান ওঝাকে আনা হয়েছিল। দুই সাগরেদ নিয়ে ঈমান ওঝা একদিন একরাত মেয়েকে ঝাড়ল আর সকলকে বুঝ দিলো মেয়ে বেঁচে উঠবে। অথচ এর থেকে বড় মিথ্যা আর হয় না। সফেদ আলীর আর গোরস্তানে যাওয়া হলো না। বরং নিজের লাশটিকে দেখতে থাকে। পা-দুটো বেকায়দাভাবে ঢালে ঝুলছে। লুঙ্গি হাঁটুর ওপর উঠে গেছে। সাদা হাফহাতা শার্টের বাইরে তাগড়া পেশিবহুল হাতদুটো ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে। লুঙ্গিটা ঠিক করে দেওয়া দরকার। পা-দুটো ডাঙায় সোজা করে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সফেদ আলীর আলসেমি লাগে। কী মায়ার শরীর ছিল তার! প্রতিদিন দুবেলা গায়ে লাইফবয় সাবান ঘষে গোসল করত। একবার অন্তত দুই প্যাকেট সানসিল্ক শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করত। এসব নিয়ে আলতাবানু অনেক ক্যাঁচ ক্যাঁচ করেছে। তার ধারণা, বাজারের ফুলকির জন্য সফেদ আলী শরীরে সুগন্ধি মাখে। আলতাবানুর সে-অভিযোগ অবশ্য পুরো মিথ্যে নয়। ফুলকি খুব ডাঁটের মেয়ে। খদ্দের পছন্দ না হলে বসে না।

কী ব্যাপার কেউ এখনো আসছে না কেন? আলতাবানু কি ভেবেছে সফেদ আলী ফুলকির ঘরে? কিন্তু বিয়ের পর সফেদ আলী একটা রাতও আলতাবানুকে ছেড়ে ঘুমায়নি। মেয়েমানুষের গায়ে যে লেবুর ঘ্রাণ থাকে সেটা আলতাবানুকে না চিনলে সফেদ আলী জানত না। এই ঘ্রাণে সাংঘাতিক নেশা আছে। ওর গায়ের গন্ধ ছাড়া সফেদ আলীর ঘুমই আসবে না, এটা আলতাবানু জানে, তাহলে?

বসে থাকতে থাকতে সফেদ আলীর হাই ওঠে। তেঁতুল গাছ থেকে অচেনা কোনো পাখি গুটুরগুটুর শব্দ করছে। বোধহয় এখন তাদের রতিক্রিয়ার সময়। এর কিছুক্ষণ পর দূর থেকে উচ্চকণ্ঠের হাঁক আসে। ভাইজান … সফেদ আলী…। একজন উমেদ আলী। সফেদ আলীর ছোটভাই। অন্যজন বোধহয় দবির চাচা। গঞ্জে যাওয়ার এই একটাই রাস্তা। দুজনের হাতের টর্চ জ্বলছে অথচ সফেদের লাশ দেখতে পাচ্ছে না। সফেদ কাছে গিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে, উমেদ এই যে আমি। কানা নাকি রে! দেহিস না ক্যান? এই যে আমি তোর পায়ের কাছে। দবির চাচা, ঠ্যাকনা মারানি সামনে দেখ, এই তো আমি। লাশটা ঢালুতে থাকায় ওদের চোখে পড়ে না। ওরা পাশ কেটে চলে যায়। সফেদ আলী হতাশ হয়। শালা বিহান পর্যন্ত লাশ এইভাবে পইড়ে পচে গইলে যাবি নাকি?

বেশ ঘণ্টাখানেক পরে ওরা ফিরে আসে। চাচার গলায় উৎকণ্ঠা, জলিজ্যান্ত মানুষটা কি হাওয়া হইয়ে গেল? ও উমেদ, কনে গেল তোর ভাই?

আমিও তো বুঝতি পারতিছিনে চাচা, গেল কনে?

সফেদ আলী চিৎকার করে, ওরে বাল, এই যে আমি। দেকিসনে ক্যান?

উমেদ অস্থির হয়ে নানা জায়গায় টর্চের আলো ফেলছে। সফেদের টর্চলাইটের ওপর উমেদের চোখ যায়। আরে এই তো ভাইজানের টর্চ। ও চাচা, ভাইজানের কী হইছে। কিডা মারিছে?

চুপ কর, অলক্ষণে ছ্যামড়া। দ্যাক খুঁইজে অজ্ঞান-টজ্ঞান হইয়ে পইড়ে রইছে কনে। হায় আল্লাহ, এই তো। মইরে গেছে নাকি? ওরে উমেদ, এরে তো সাপে কাটিছেরে।

তাদের চেঁচামেচিতে ঘুমভাঙা অনেক লোক জড়ো হয়ে অনেক ধরনের আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোন সাপে কাটল। কীভাবে কাটল, কেন কাটল। মুখে মুখে তাদের গবেষণা দীর্ঘ হয়। কেউ দৌড়াল ওঝাকে ডাকতে। চার পাঁচজন ধরাধরি করে সফেদ আলীকে বাড়ির দিকে নিয়ে চলল। সফেদ তাদের কথা খুব কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে। রাজ্জাক আর সবুরের ধারণা সফেদ নেই। মুখে গেজলা উঠে গেছে। জব্বার মানে না। নাহ্, বাচপি। শইল গরম এহনো। নিশ্বাস আইটকে রইছে। সফেদ আলী লুঙ্গি ছিঁড়ে দুই জায়গায় বেঁধে দিয়েছিল, তারা সকলে মিলে আরো দু-জায়গায় বাঁধন দিয়েছে।

তাকে এ অবস্থায় দেখে আলতাবানুর কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভেবে সফেদ আলী কিছুটা উত্তেজিত বোধ করছে। কঠিন মেয়েমানুষ। চোখ দিয়ে পানি পড়বে বলে মনে হয় না। আবার পড়তেও পারে। সফেদ আলী সহসা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

আজ রাতে চাঁদ নেই। সফেদ আলী সব দেখতে পাচ্ছে; কিন্তু অন্ধকারে সমস্যা হচ্ছে ওকে যারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। বারবার হোঁচট খাচ্ছে তারা। শালার চেয়ারম্যান, প্রতি ভোটের আগে ওয়াদা করে এবার বিদ্যুৎ আসবেই। কিন্তু ভোটের পরে পানির বোতলে ফচ করে না। এক কিলো দূরের সোনাপুরগঞ্জে সাত বছর আগে বিদ্যুৎ এলেও এ-গ্রামে সেই অন্ধকার। নিকিরিপাড়া, জেলেপাড়ার কত ঘরে আর বিদ্যুৎ নেবে? এজন্য হয়তো বিদ্যুতের লোকদের এ-গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়ার আগ্রহ নেই।

একসময় ওরা নিকিরিপাড়ায় চলে আসে, যেখানে সফেদ আলীর ঘর। এই পাড়ায় প্রায় সব ঘর গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো ঘরের সামনে আরেক ঘর। মাঝখানে একজন মানুষ যাওয়ার মতো রাস্তা। একপুরুষ থেকে ভিটেবাড়ি তেতাল্লিশ পুরুষে বাটোয়ারা হয়ে গেছে। তবে সফেদ আলীর পরদাদা, দাদা দুজনেই একলা পুরুষ ছিল। ফলে ওদের দুই ভাইয়ের এজমালি ভিটে বেশ বড়। উমেদ বিয়ে না করায় ভিটে ভাগ হয়নি। উমেদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগে; কিন্তু বিয়ের প্রতি ওর এত অনীহা কেন, সেটা সফেদ আলী ভেবে পায় না। উমেদ আলীর সঙ্গে আলতাবানুকে জড়িয়ে পাড়ায় একবার কানাকানি হয়েছিল। সফেদ আলীর কানেও এসেছিল সে-কথা। সফেদ আলী পাত্তা দেয়নি। তার সুখের সংসারে আগুন দেওয়ার লোকের অভাব নেই এ-পাড়ায়।

ঘরের পেছনে সরু কালিকাসিন্দুর নদী। সামনে উঠোন। গোল উঠোনটাকে আলতাবানু এত সুন্দর করে লেপে রাখে যে, পূর্ণিমার রাতে সেটাকে রুপোর থালার মতো মনে হয়। দক্ষিণমুখো চারচালার টিনের ঘরটি সফেদের। তার ওপাশেই উমেদ আলীর ঘর। রান্নাঘরের সঙ্গে চারদিক খোলা একটা ঘর আছে। আলতাবানু বলে হাওয়া ঘর। গরমের রাতে তারা এ ঘরেই ঘুমায়। জাতিতে নিকিরি সফেদ মাছের ব্যবসা ভালো বোঝে, ফলে সাধারণ জেলের তুলনায় বেশ সচ্ছল পরিবার তার।

ভেতর বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। সফেদ আলী অনেকগুলো নারীকণ্ঠের মধ্যে থেকে আলতাবানুর কণ্ঠ আলাদা করতে পারে না। দবির চাচা বাড়িতে নিশ্চয় মৃত্যুর খবর দিয়েছে। উঠোনে ঢোকার আগেই আলতাবানু দৌড়ে এসে সফেদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করছে। উঠোনভর্তি লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে কেউ একজন পাটি বিছিয়ে রেখেছে। সফেদ আলীকে সেখানেই শুইয়ে দেওয়া হলো। গাঁয়ের মানুষ জানে, সাপে কাটা মানুষের হায়াত-মউতের ঠিক নাই। তাই আর তাকে ঘরে তোলা হয় না।

সফেদ আলী প্রত্যেকের মুখের দিকে আলাদাভাবে লক্ষ করে। সেখানে উপস্থিত বেশিরভাগ পুরুষের চেহারায় বিপন্নতার ছাপ স্পষ্ট। তারা হয়তো বুঝতে পারছে না কান্নাকাটি করার মতো ঘটনা ঘটে গেছে কি না। সামদানী চাচি এক গ্ল­াস পানি এনে কয়েকবার বিড়বিড় করে তাতে ফুঁ দিয়ে সফেদ আলীর শরীরে ছিটিয়ে দেয়। সফেদ আলী একটু ক্ষুণœ হয় এতে। কারণ সামদানী চাচি কুফরি কালাম করে। মুর্দার গায়ে এভাবে কুফরি কালামের পানি ছিটিয়ে চাচি সফেদ আলীকে পাপের ভাগী করছে।

ওঝা এখনো এসে পৌঁছায়নি। ছেলেটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ঘুমুচ্ছে। লোকজনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের যে গুঞ্জন ছিল সেটা থেমে গেছে। কেমন থমথমে ভাব। সফেদ আলীর মন ক্রমেই বিষণœ হয়ে উঠছে। গোয়ালের পাশে হাঁস-মুরগির খোপে টিনের চাল। সেই চালে মাধবিলতা ফুল তারার মতো ফুটে আছে। কিছু গোলাপি, কিছু সাদা। বাতাসে মাধবিলতার ডাল টিনের ওপরে ঘষা খেয়ে সরসর আওয়াজ তুলছে। সফেদ আলী সেই শব্দ কিছু সময় শোনে। আগেও শুনত। সেই যখন মায়ের কোলে ছোটটি ছিল। মা এই গাছগুলো কবে লাগিয়েছে সফেদ আলী জানে না; কিন্তু এই শব্দ তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যায়।

পাটির পাশে কে একজন কুপি রেখে গেল। বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের চিমনি ঘোলা।

হঠাৎ সম্মিলিত মানুষের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। ওঝা বারেক আলী এসে গেছে। এ-তল্লাটের নামিদামি ওঝা। কথিত আছে, সে তিনদিনের সাপে কাটা মরা মানুষকে জীবিত করতে পারে। তার মন্ত্রে এত শক্তি যে, পদ্মগোখরা পর্যন্ত সাতদিনের রাস্তা পেরিয়ে এসে বিষ তুলে নিয়ে যায়। এসব এলাকায় সাপের ওঝার অভাব নেই। তবে বারেক আলীকে সবাই আনতে পারে না। তার রেট বেশি।

দুই ভাই কফিল এবং মফিল বারেক আলীর শিষ্য। তারা ছায়ার মতো ওস্তাদকে অনুসরণ করে। বারেক আলী এসেই কাজে লেগে পড়ে। সে গম্ভীর হয়ে সফেদ আলীর শরীর ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে। তার হাতে হলুদ রঙের গুঁড়ো। বারেক আলী সেই গুঁড়ো দিয়ে সফেদ আলীর চারপাশে একটি বৃত্ত রচনা করে। সফেদ আলী জানে এর নাম লক্ষ্মণ রেখা। ওঝার দল ছাড়া কোনো মানুষ বা প্রাণীর এর ভেতরে প্রবেশ নিষেধ।

সূর্যের চাইতে বালু তপ্তের মতো অবস্থা। কফিল-মফিল প্রায় ধাক্কা দিয়ে লোকজন সরাতে থাকে। সরেন সরেন বাতাস বন্ধ করবেন না। লক্ষ্মণ রেখার মধ্যে কেউ পা রাখবেন না। ঋতুবতী, বিধবা মা-বোনেরা উঠোনে থাকবেন না। কারো শরীরে তাবিজ-কবজ থাকলে সে চইলে যান। না হলে তাবিজ কাইটে যাবে।

বাড়ির কে আছেন? কফিল হাঁক দেয়।

এই যে আমি।

উমেদ এগিয়ে আসে।

চিকিৎসার কাজে আমাগো কয়েকটা জিনিস লাগব। এই ধরেন, তাজা নিমের ডাল। পাত্তা শুদ্ধা আনবেন। মান্দার কাঁটা, কাঁসার বাটি, লালসালু কাপড়। তাত্তাড়ি করেন। খানিকটা সাদা কাপড় আইনেন। মানি কাফনে যে-কাপড় থাকে।

হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একেকদিকে একেক লোক ছুটে যায়। ওস্তাদ চোখ বন্ধ করে সফেদ আলীর মাথায় হাত রেখে অনুচ্চস্বরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করে, ওস্তাদ, জান আছে?

ওস্তাদ কিছু বলে না কিন্তু মফিল চিৎকার করে, থামেন সব, কেউ কোনো কথা কবেন না। ওস্তাদকে কখনো মুর্দা ছুঁইতে দেখছেন?

মফিল তুলা রাশির জাতক। সে হাত চালান দিয়ে বিষ কোন পর্যন্ত উঠেছে সেটা নির্ণয় করবে। সফেদ আলী বহুবার এই দৃশ্য দেখেছে। হাত চালানোর জন্য ওস্তাদ যে-মন্ত্র পড়ছে সেটাও প্রায় সফেদ আলীর মুখস্থ।

থুরু বুরু বিষ

থুরু বুরু খাস

থুরু বুরু খাইয়া বিষ

বশ্যা হইয়া যাস, দোহাই মা পদ্মা

দোহাই ঈশ্বর করণী

দোহাই মোনাইসা দেবী

ছু ছু ছু

ওস্তাদ মন্ত্র পড়ে সফেদ আলীর সাপে কাটা জায়গায় তিনবার থুথু ফেলে তারপর মফিলের হাতে চাপড় দেয়। থুথুতে সফেদ আলীর শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে।

মফিলের হাত চলতে চলতে সফেদের ডান পায়ের হাঁটুর ওপরে এসে থামে। অর্থাৎ বিষ এখন এই পর্যন্ত।

ওস্তাদ উপস্থিত লোকজনকে সামনে রেখে বলে –

ভাই সকল, বিষ কোমর অবধি উঠে নাই। কিন্তুক জাত কেউটে কাটছে। খুব কঠিন বিষ। নামাইতে গিয়া আমার জান কবজ হইয়ে যাইবে। কিন্তুক আল্লাহ-রসুল সাক্ষী, মা মনসার দিব্যি, বারেক আলী জান কবুল কইরা হইলেও রোগীর শরীর থেইকে বিষ নামাইয়াই ছাড়বে।

ওস্তাদের এই ঘোষণায় জনতা চিৎকার করে সায় দেয়।

অল্পসময়ের মধ্যে মান্দারের কাঁটা, নিমের ডাল, সাদা কাপড়, লালসালু সবকিছু চলে আসে। সাপে কাটার জায়গায় মান্দারের কাঁটা ফুটিয়ে রাখা হয়। ওস্তাদের দ্রুত তালের মন্ত্রের সঙ্গে দুই সাগরেদ নিমের ডাল দিয়ে সফেদ আলীর শরীরে পেটাতে থাকে। সফেদ আলীর এতে খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু করার কিছু নেই। সে মনোযোগ দিয়ে মন্ত্র শোনে,

হাটের বিষ ঘাটের বিষ অজগর কালকুটের বিষ

শঙ্খনী, পদ্মিনী আর যত বিষধরের বিষ

যদি তুই সফেদ আলীকে না ছেড়ে যাস

তবে কামরূপ কামাখ্যার মা মনসার মাথা খাস।

কিছু সময় পরপর তুলা রাশি হাত চালান দিয়ে দেখছে বিষ কতদূর নামল। প্রায় দুই ঘণ্টা ঝাড়ার পর মফিল ঘোষণা দিলো বিষ হাঁটুর কাছে নেমে এসেছে।

উঠোনের লোক কমছে না, বরং বাড়ছে। দূর-দূরান্ত থেকেও লোক আসছে। সকাল অবধি হয়তো এই উঠোনে আর লোক ধরবে না। ভিড়ের মধ্যে সুভাষকে দেখতে পায় সফেদ আলী। সে খুব বিমর্ষ। হয়তো সফেদ আলীর এই পরিণতির জন্য নিজেকে দায়ী ভাবছে। এসব তন্ত্রমন্ত্রের সময় নারীদেরকে কাছে আসতে দেওয়া হয় না বা তারা নিজেরাই লজ্জায় আসে না। এখানেও তেমন কোনো নারী নেই, শুধু উমেদের ঘরের কোণে চার-পাঁচজন নারী জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের মুখের ওপর লম্বা ঘোমটা। ফলে তাদের কাউকে সে চিনতে পারে না। তবে শাড়ির রং দেখে সফেদ আলী আন্দাজ করে তারা সকলে বয়স্কা।

গণ্ডির বাইরে থাকায় এবং আলোর স্বল্পতার কারণে সফেদ আলীর চেহারায় কোনো পরিবর্তন এলো কি না, নীল রঙের জায়গায় রক্ত লাল হলো কি না সেটা লোকজন ঠাহর করতে পারে না।

কিন্তু সময় যত বাড়তে থাকে সফেদ আলীর মনে হলো ওস্তাদের মন্ত্রের গতিও বাড়ছে। সফেদ আলী ফকফকে আলোয় তার কপালে ঘামের ফোঁটা দেখতে পাচ্ছে।

এর অনেক সময় পর যখন ভোরের আলো ফোটে তখন গ্রামের কিছু ভদ্রলোক আসতে শুরু করে। কাজিপাড়ার বদি কাজী। মোড়লপাড়ার রব্বানী আরো কিছু শিক্ষিত গণ্যমান্য মানুষ। তারা এসে অন্য কথা বলে। রব্বানী তো গণ্ডি না মেনে সরাসরি সফেদ আলীর শরীরের কাছে চলে আসে। সফেদ আলীর হাত, নাক-বুক ইত্যাদি পরীক্ষা করে ঘোষণা দেয়, এ তো মারা গেছে। এসব ভণ্ডামি রাখেন আপনারা। ঝাড়ফুঁক বন্ধ করেন। দাফনের ব্যবস্থা করেন। যতসব কুসংস্কার। উপস্থিত জনতা স্পষ্টতই সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং দুদলে ভাগ হয়ে যায়। একদল ঝাড়ফুঁকের পক্ষে, অন্য দল দাফনের পক্ষে।

ওস্তাদ কিঞ্চিৎ গোস্সা হন। তিনি বলেন, ভাইসব, আমি বলতেছি রোগী বাঁইচা আছে। সাপে কাটলে সাতদিন পর্যন্ত জান থাকে শরীলে। আপনেরা কি চান রোগী সুস্থ হইয়া উঠুক? যদি চান তো আমি চিকিৎসা চালাই যাব বাকি ওপরে আল্লাহ আর মা মনসা ভরসা। আর না চাইলে আমি চললাম।

এবার জনতা দ্বিধান্বিত হয়। তারা সহসা কিছু বলতে পারে না তারপর সমস্বরে বলে, আমরা চাই রোগী সুস্থ হোক। আপনি চালাইয়া যান।

গোলাম রব্বানী কোনো কথা না বলেই স্থান ত্যাগ করে। ফলে আবারো পূর্ণোদ্যমে মন্ত্র চলতে থাকে।

সফেদ আলী খেয়াল করল আজ কেউ গরুর খাবার দিলো না। রাঙ্গি গাই হাম্বা হাম্বা করছে সেদিকে কারো দৃষ্টি নেই। মুরগির খোপে হাঁস-মুরগির যুদ্ধ চলছে। সফেদ আলী হতাশ হয়। এটা কেমন কথা! একজন মানুষের মরে যাওয়া আর বেঁচে থাকার সঙ্গে অবলা প্রাণীকে অভুক্ত রাখার কী সম্পর্ক?

বেলা বাড়ে। মানুষ বাড়ে। ওস্তাদ-সাগরেদের মুখে ফেনা জমে গেছে। রাত জাগার লাল চোখ, শ্রান্তি। মানুষের চোখে-মুখে হতাশার ছায়া। কারণ সফেদ আলীর শরীর নীল থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। তুলা রাশির হাত সফেদ আলীর পায়ের গোড়ালিতে বিষ আবিষ্কার করেছে প্রায় দু-ঘণ্টা আগে। কিন্তু তার নিচে আর বিষ নামে না। বিষ নামলে তো সফেদ আলী উঠে বসার কথা।

এমন সময় মৌলভি সাহেব এলেন। এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি। ধরমপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফেদ আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে রায় দিলেন, সফেদ আলী আর নেই। তার কথায় উপস্থিত জনতার তেমন কেউ দ্বিমত করল না। তিনি পরামর্শ দিলেন উপজেলা সদরের জেনারেল হাসপাতালে নিতে। মারা যাওয়ার পরও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কেন সে ধরনের প্রশ্ন অবশ্য কেউ করল না। যেহেতু মৌলভি সাহেব বলেছেন, হাসপাতালে নিতে হবে।

উমেদ আলীর বন্ধুরা সফেদ আলীর শরীরকে চ্যাংদোলা করে ভ্যানে তুলে উপজেলার দিকে রওনা দিলো। উঁচু-নিচু, ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর তারা হাসপাতালে হাজির হয়। সফেদ আলী আগে কখনো এই হাসপাতালে আসেনি। আসার দরকারই পড়েনি। আজ এখানে এসে মনে হলো বহু মানুষ তার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের শরীর নেই। একবার ইকবাল দাদাকেও দেখল মনে হলো। ইকবাল দাদা তাকে খুব আদর করত। কত বছর আগে মরেছে মনেও নেই।

বারান্দায় লোহার টেবিলে সফেদ আলীকে শোয়ানো হয়েছে। পরির মতো সুন্দর একটা মেয়ে তার শরীরের ওপর ঝুঁকে কীসব যন্ত্র লাগিয়ে পরীক্ষা করছে। মেয়েটির শরীর থেকে অদ্ভুত সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। আলতাবানুর শরীরের থেকেও অনেক বেশি নেশা এই ঘ্রাণে। সফেদ আলীর মনে হলো, মরার পর এই একটা লাভ হলো, জানতে পারল সব মেয়ের শরীরেই আলাদা ঘ্রাণ থাকে। সে সিদ্ধান্ত নিল বারেক ওঝা যদি তাকে বাঁচাতে পারে তবে সে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবে। মুসলমান পুরুষ, চারটে বিয়ে করতে পারে। আর তার টাকা-পয়সারও অভাব নেই।

কিছু সময় পরীক্ষার পর মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলল, স্যরি, রোগী অনেক আগেই মারা গেছেন। আপনারা আগে নিয়ে এলেন না কেন?

ভাইজান বলে উমেদ আলী ডুকরে কেঁদে ওঠে। সফেদ আলীর মন খুব খারাপ হয়। সেটা নিজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে নাকি উমেদের কান্না শুনে বুঝতে পারে না।

হাসপাতালে যাওয়ার সময় সঙ্গের যুবকদের মধ্যে যে আশা-উদ্দীপনা ছিল ফেরার পথে তার কিছু দেখা গেল না। তাদেরকে হতাশ আর অতিবিষণœ মনে হতে লাগল। হয়তো তারা উমেদের বন্ধু বলেই সমব্যথী ছিল।

সফেদ আলীর বাড়ি বা বাড়ির আশপাশে যারা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিল তারা দেখল সফেদের শরীর ডোরাকাটা বিছানার চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা। সেদিকে চোখ যাওয়ার পর অনেকেই স্থান ত্যাগ করে। কারণ সফেদ আলীর মৃত্যু সকল উত্তেজনার ইতি টেনে দিয়েছে। আলতাবানু আলুথালু বেশে সফেদের শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র একটা রাত, তাতেই আলতাবানুর শরীর ভেঙে দিয়েছে। সুন্দর শরীর নিয়ে আলতার বড় অহংকার। সফেদ আলী হাসার চেষ্টা করে। বলে, আলতা, শরীর এমনই। মিশে যাবে একদিন মাটির সঙ্গে।

আলতার এই আচরণে উপস্থিত মুরব্বিরা কেউ কেউ নাখোশ হন, রেগে যান, মহিলাকে সরাও। মুর্দা এখন পরপুরুষ। পরনারীর ছোঁয়া পাপ। কিন্তু আলতাবানু সেটা গ্রাহ্য করল না। সফেদ আলীর ইচ্ছা হলো ওকে দুহাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না।

এতক্ষণে সফেদ তার তিন বছরের ছেলে রাজনকে দেখতে পেল। আলম তাকে কোলে নিয়ে সফেদকে দেখায়, ওই দেখ, তুমার আব্বা। ভালো করে শেষবারের মতো দেখে নাও বাজান। রাজন কী বুঝল কে জানে। সে খলখল করে হেসে বলল, আব্বা ঘুমায়।

সফেদের মন খুব ভারাক্রান্ত হচ্ছে এসব দেখে। সবকিছু সে দেখতে পাচ্ছে কেন, সেটাও বুঝতে পারছে না। তাহলে কি সে আসলেই বেঁচে আছে?

সফেদের লাশ আবার উঠোনের পাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বারেক ওঝা, কফিল, মফিল এখনো স্থান ত্যাগ করেনি। হয়তো শেষ দেখতে চায় বা পাওনার টাকা চাইতে পারছে না তাই অপেক্ষা করছে। একজন মৃত মানুষের ঝাড়ফুঁকের জন্য টাকা চাওয়াটা কঠিন।

লাশের গোসল, জানাজার তোড়জোড় চলছে।

চুলায় গরম পানি টগবগ করে ফুটছে। তাতে বরইয়ের পাতা। আতর-লোবানের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। কাফনের কাপড় চলে এসেছে। সফেদ আলী সবকিছু দেখছে কিন্তু কোনো ভাবান্তর নেই। সে এখন সব ভাবার ঊর্ধ্বে।

মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন। মুর্দার গোসলের লোক ঠিক হয়েছে। ঘরের পেছনে কাপড় দিয়ে ঘিরে মুর্দার গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা গোসল করাতে এসেছেন সফেদ আলী তাদের সবাইকেই চেনে, তবু অস্বস্তি লাগে। তার শরীরের গোপন সব মানুষের সামনে আজ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

নকিবর চাচা গায়ের শার্ট খুলে এক চিৎকার দিলেন, আরে সফেদ তো বাঁইচে আছে! এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে ছুটে এলো। ইমাম সাহেব গায়ে হাত দিয়ে বললেন, আল্লাহর কী কারিশমা দেখ! শরীর তো তাজা।

এরপর আর কথা চলে না। কিছু সময়ের মধ্যে পুনরায় বিষ নামানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো। তবে নতুন পন্থায়। উঠোনের ঠিক মাঝখানে সফেদ আলীর শরীরটিকে কাফনের কাপড় পরিয়ে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারখানা সফেদ আলী ধরমপুরগঞ্জ থেকে কিনে এনেছিল। পুরো নিকিরিপাড়ায় এই একখানাই চেয়ার। চেয়ারকে ঘিরে মোটা করে গণ্ডি টানা হয়েছে। কফিল-মফিল কূল করতে পারছে না তাই ঝুমঝুমপুর থেকে আরো দুজন শিষ্য এসে যোগ দিয়েছে।

তারা ঢোল-করতল বাজিয়ে সফেদ আলীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বারেক ওঝা দ্রুত মন্ত্র পড়ে।

মফিলের হাত যেখানে বিষ নির্দেশ করছে সেখানে সাদা পুঁটলি বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। সফেদের মাথার ওপর কাঁসার থালা-বাটি। হয়তো বিষ টেনে নেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে। পায়ে মুরগির একটা বাচ্চা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মুরগির বাচ্চা বাঁধার কারণ সফেদ আলী নির্ণয় করতে পারে না। সম্ভবত সেটা সাপের খাবার হিসেবে। মুরগির পায়ে ঠোকর দিচ্ছে। এ-কাজে বেদম রাগ লাগে। লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়।

স্রোতের মতো মানুষ আসছে। পাকা সড়ক ধরে, ছোট-বড় মাটির পথ দিয়ে আর কালিকাসিন্দুর নদী বেয়ে। সফেদ আলীর উঠোন এত লোকের ভার সইতে পারছে না। সুতরাং নিকিরিপাড়া ছাড়িয়েও মানুষের দঙ্গল বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। গ-ির লাগোয়া যারা দাঁড়িয়েছে তারাই শুধু ওঝা আর সফেদ আলীকে দেখতে পাচ্ছে। তাদের মাধ্যমে সফেদ আলী-সংক্রান্ত যাবতীয় খবর এককান থেকে বহুকান হয়ে ভিড়ের শেষ প্রান্তে চলে যাচ্ছে। ফলে ছোট খবরটি আর ছোট থাকছে না, বাড়তে বাড়তে সাপের থেকেও লম্বা হয়ে যাচ্ছে।

বিকেল নাগাদ সুন্দরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসেন। তাকে ভিড় ঠেলে লক্ষ্মণ রেখার কাছে আনা হয়। তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে বলেন, ভাই সকল, ইমাম সাহেব আমাকে বলেছেন সফেদ আলী বেঁচে আছে। আপনারা দোয়া করেন। বারেক আলী যেভাবে চিকিৎসা চালাচ্ছেন চলতে থাকুক। খরচের বিষয়টা আমি দেখব।

চেয়ারম্যানের কথায় জনগণের মধ্যে হর্ষধ্বনি ওঠে।

কফিল-মফিল লাল টুল কাপড় দিয়ে সফেদ আলীর শরীরে বাতাস করছে। একজন ঘুরে ঘুরে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। তার মাথার দুলুনির তালে তালে লম্বা শনের মতো চুলও দুলছে। অন্যজন কিছুটা গম্ভীর। সে কিছু সময় পরপর ডাক্তারি যন্ত্রপাতি দিয়ে সফেদ আলীর শরীর পরীক্ষা করে জনতার উদ্দেশে বলছে, প্রেসার আছে। রোগী বেঁচে আছে। বলেন আলহামদুলিল্লাহ, জয় মা মনসা।

সন্ধ্যার আগের দিকে দুজন লোক ক্যামেরা হাতে নিয়ে খুব হম্বিতম্বি করতে করতে এগিয়ে এলো। তারা টপাটপ ছবি তুলতে তুলতে বারেক ওঝাকে প্রশ্ন করেন, আমরা শুনেছি হাসপাতাল থেকে সফেদ আলীকে মৃত ঘোষণা করেছে তাহলে ঝাড়ফুঁক কেন করছেন?

বারেক ওঝা বলেন, আপনারা কারা?

আমরা সাংবাদিক। আপনি যেটা করছেন সেটা প্রতারণার শামিল। আপনার নাম ছবিসহ পত্রিকায় ছাপিয়ে দেবো।

দেন জনাব। কিন্তুক রোগী বেঁচে আছেন। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, বাকি আল্লাহ ভরসা।

আপনি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন সফেদ আলী বেঁচে আছেন, সেরে উঠবেন?

হায়াত-মউতের মালিক ভগবান বা আল্লাহ। গ্যারান্টি দেওয়ার আমি কে? আমি চেষ্টা করতে পারি।

লাশ নিয়ে ব্যবসা! সব টাকা খাবার ধান্দা। ওদিকে চেয়ারম্যান সাহেবের লোক চিকিৎসার খরচের নামে রাস্তায় চাদর পেতে টাকা তুলছে। সবকিছু ডিটেইল রিপোর্ট করব বুঝেছেন?

তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে বেরিয়ে যান।

সফেদ আলী খেয়াল করল সাংবাদিকের কথা বলার পর থেকে বারেক ওঝা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। শিষ্যদের গলার জোর কমে এসেছে। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে ভালো লাগল পত্রিকায় নিশ্চয় সফেদের ছবি ছাপা হবে।

যখন রাত হলো তখন তুলা রাশির হাত আরো ওপরে উঠে কোমর ছাড়িয়ে গেল। উঠোন থেকে লোক তেমন কমেনি। পুরনো কেউ গেলে নতুন কেউ এসে তার জায়গা পূরণ করে দিচ্ছে। কেউ কেউ অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করছে, কী হলো সফেদ আলীর হুঁশ আসে না ক্যান? বাঁচপি তো?

ভিড়ের ভেতর থেকে কোনো এক যুবক বলল, এসব বুজরুকি রাখেন মিয়া। বিটা মইরে গেছে কত আগে এখন খেলতাছেন।

তার কথা শেষ হওয়ার পর অন্য একজন বলল, এহ্ শরিলথে গন্ধ ছুটছে।

লাশের গন্ধের এই খবরটি ভিড়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চাউর হয়ে গেল আর ভিড়ের শেষ মানুষটিও নাক চেপে বলল, উহ্ লাশের গন্ধ ছুটছে।

জনতার মধ্যে গুঞ্জন ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং সম্ভবত লাশপচা গন্ধের কারণেই ভিড় খুব দ্রুত পাতলা হয়ে যায়।

সফেদ আলী খেয়াল করে অন্ধকারের মধ্যে প্রস্রাব করতে যাওয়ার কথা বলে বারেক ওঝা উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে গেল। সে আর ফিরে আসে না বরং একজন একজন করে শিষ্যরাও স্থান ত্যাগ করল।

উঠোনের মাঝখানে সফেদ আলী শুয়ে থাকে অথবা সফেদ আলীর লাশ। পাড়া-প্রতিবেশীর কয়েকজন ছাড়া কোথাও কেউ নেই। কেউ এখন গণ্ডি পেরিয়ে আসার জন্য জোরাজুরি করছে না। কিছুক্ষণ পরপর ঘরের ভেতর থেকে আলতাবানুর কান্নার সুর ভেসে আসছে। সে সুর খুব ক্লান্ত, একঘেয়ে। উমেদ ধীরপায়ে ভাইয়ের লাশের পাশে এসে বসে। রাজনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো প্রতিবেশীদের কেউ তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছে।

বেশ ভালোই ছিল সফেদ আলী। এত লোকজন। এত কথা, আশা-উৎকণ্ঠা। এক ধরনের সরগরম ভাব। কিন্তু মধ্যরাতে এসে সবকিছু মিইয়ে গেছে। উঠোনের এককোণে বরইপাতার সঙ্গে পানি ফুটছে। বুচির মা পানিতে জ্বাল ধরিয়ে উদাস হয়ে বসে আছে। হ্যাজাকের আলোয় গোরস্তানে গোর খোঁড়া হচ্ছে। সফেদ আলী এখান থেকেই কোদাল চালানোর ধুপধাপ শব্দ শুনতে পায়। ঠিক সে-সময়ে সফেদ আলী দৃশ্যটি দেখল বা অনুভব করল।

হাওয়া ঘরের পাশে হাসনুহানার গাছটির নিচে ওরা একে অপরের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ। উমেদ এবং আলতাবানু। ওরা জানে

না সফেদ আলী এই অন্ধকারেও ওদেরকে দিনের মতো দেখতে পাচ্ছে। আগে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা সফেদ আলীর চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায়। কিন্তু আজ কোনো ধরনের ভাবনাই কাজ করে না।

ধীরে ধীরে সফেদ আলীর চারপাশে অনেক লোক হাজির হলো। তাদের সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি ঝলমল করছে। শরীর থেকে ভেসে আসা আতরের তীব্র গন্ধ সফেদ আলীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সফেদ আলী বুঝতে পারে না সে কি মারা যাচ্ছে, নাকি আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার প্রচণ্ড ঘুম পায়। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে সফেদ আলী দেখতে পায়, পদ্ম গোখরাটি তার সমান্তরালে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছে। আর গাবগাছের ডালের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তিন বা চারদিনের চিকন কাঁচির মতো একফালি চাঁদ।