সবচেয়ে প্রভাবসৃষ্টিকারী লেখকদের একজন

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় বহুকালের। ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যপ্রীতি কিংবা মার্কেজের লেখার গুণে তাঁর লেখা অচিরেই আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। পেশাগত কারণে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ১৯৭০ সালেই ওই বিভাগের পাঠক্রমে মার্কেজের লেখা সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ বা শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা অন্তর্ভুক্ত করি। সেই সময় ছাত্রদের পড়ানোর তাগিদে ওঁর কিছু ছোট ছোট লেখা বাংলায় অনুবাদ করি। এর মধ্যে ছিল সরলা এরেন্দিরা আর তার নিদয়া ঠাকুমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি এবং কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না ইত্যাদি। এসবই তাঁর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির (১৯৮২) অনেক আগের কথা। ১৯৬৭ সালে একদিকে যেমন মার্কেজের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা প্রকাশিত হয়, অন্যদিকে এল সেনিওর প্রেসিদেন্তের লেখক মিগুয়েল আনজেল আন্তুরিয়াস নোবেল পুরস্কার পান। এই যোগাযোগটাকে কাকতালীয় বলবো। কারণ আন্তুরিয়াস কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে কাজ করছিলেন। এই জাদুবাস্তবতা বিষয়ে মার্কেজের কয়েকজন পূর্বসূরি অবশ্যই ছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৬১ সালে হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো উপন্যাসটি হাতে না পেলে হয়তো তাঁর শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা লেখাই হতো না। এছাড়া বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনারের কথা। আরেকজন মার্কিন লেখককে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি হলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তিনি যখন ১৯৫১ সালে কুবায় দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি লিখছেন তখন সম্ভবত তাঁর সঙ্গে মার্কেজের যোগাযোগ হয়েছিল। এছাড়া পিয়েত্রি, কার্পেন্তিয়ের ও কার্লোস ফুয়েন্তেসের কাছ থেকে এই ঐতিহ্য তিনি পেয়েছিলেন। এই ফুয়েন্তেস তাঁর বাড়ির পাশেই অনেকগুলো কটেজ বানিয়ে রেখেছিলেন। ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব লেখককে সরকার তাড়িয়ে দিত তাঁরা সেখানে এসে লেখালেখি করতেন। সেরকমই একটা কটেজে বসে চিলির হোসে দোনোসো এল অবসিনো পাহারো দেলা নোচে (‘দ্য অবসিন অফ নাইট’) লিখেছিলেন। ওই মেহিকো নগরীতে মার্কেজও থাকতেন। পেদ্রো পারামোর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। হুয়ান রুলফোর এ-উপন্যাসটি আমি একসময় অনুবাদ করি। রুলফো নিজেও ওই মেহিকোতে থাকতেন। এ-উপন্যাসে আছে মেহিকোর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা। জাদুবাস্তবতার এক অনন্য উদাহরণ এ-উপন্যাস। কোনো সরলরৈখিক উপন্যাস এটি নয়। কখনো আগে, কখনো পিছিয়ে চলেছে এর কাহিনি। মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে আমরা দেখি কাহিনির কথক হোয়ান প্রেসিয়াদো বহুকাল আগে মরে ভূত হয়ে গেছে। যাদের কাহিনিটা বলছে তারা ভূত, যারা শুনছে তারাও ভূত। গোলকধাঁধার মতো এর গঠন। মার্কেজ তাঁর প্রথম উপন্যাস লিফ স্টর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এমন এক গোলোকধাঁধা যার না আছে ঢোকার পথ, না আছে বেরোনোর।’ এটাকে আমি ঠিক প্রভাব বলবো না, অনুকরণের ছায়া আছে তাও নয়, তবে বলা যেতেই পারে, রুলফোর লেখা পড়ে তিনি উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত আরেকজন লেখকের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন আর্জেন্টিনার লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস। তাঁর সম্পর্কে অনেকেরই বিশেষ কৌতূহল ছিল। সেটা তাঁর ভাষাব্যবহারের কৌশলের জন্য, তাঁর রাজনীতির জন্য নয়। চিন্তার দিক থেকে বোর্হেস খানিকটা ফ্যাসিস্তদের পক্ষেই ছিলেন। তবে ভাষা-ব্যবহারে তিনি ছিলেন অনন্য।

ম্যাজিক রিয়ালিজমের সঙ্গে সিনেমার একটা যোগ রয়েছে। আমরা অনেকেই জানি না মার্কেজ কিন্তু সিনেমাও করেছিলেন। বিশেষ করে ফুয়েন্তেসের সঙ্গে মিলে। নিজের গল্প নিয়ে তিনি যে প্রথম চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, তার নাম এ শহরে কোনো চোর নেই। আবার হুয়ান রুলফোর গল্প ‘সোনার মোরগে’র চিত্রনাট্য করেছিলেন মার্কেজ। মার্কেজের তৈরি একটি ছবিতে বুনুয়েল অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে ল্যাটিন আমেরিকার চলচ্চিত্র-সংগঠন তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করে। সেই সময়েই প্রকাশিত হয় তাঁর  মা-বাবার প্রণয়কাহিনি নিয়ে উপন্যাস কলেরার মরশুমে প্রেম। চিলির চলচ্চিত্রকার মিগেল লিতিনের গোপনে চিলিতে গিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর প্রচেষ্টা থেকে তিনি লেখেন চিলিতে গোপনে। ১৯৮৭-তে তিনি রাশিয়ায় যান এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে গর্বাচেভের সাক্ষাৎ নিয়ে পরে লেখেন। পরের বছর বুয়েনেস আইরেসে তাঁর একমাত্র নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৮৯-তে বেরোয় তাঁর উপন্যাস গোলকধাঁধায় রাষ্ট্রপতি। পরের বছর তিনি জাপান সফরে গিয়ে আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে দেখা করে চলচ্চিত্র এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৯১-তে তিনি শুরু করেন তাঁর জীবনস্মৃতি লেখার কাজ। কিন্তু সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৯২ সালের মে মাসে ধরা পড়ে তাঁর ফুসফুসে কর্কট রোগের উপস্থিতি। সেই রোগ বহন করেই তিনি আরো ২২টা বছর বেঁচেছিলেন। কোনো কাজেই খামতি রাখেননি এই ২২টা বছর। ভ্রমণ, সভা-সমিতি, লেখালেখি, ভাষণ-বক্তৃতা, আলোচনা ইত্যাদি।

সবশেষে তাঁর ভারতে আসা নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা শোনাব – যা হয়তো অনেকেরই অজানা। ১৯৮৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে নয়াদিল্লিতে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর এক সম্মেলন হয়েছিল। আর তাতে যোগ দেওয়ার জন্য এসেছিলেন কুবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রো মার্কেজকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। দুজনের বন্ধুত্ব বহুদিনের। রাষ্ট্রনায়কদের সম্মেলনে তাঁর কোনো কাজ নেই বলে সরকারি অতিথিশালা থেকে মার্কেজ তিন-চারদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান। গোপনেই তাঁর সন্ধান চলতে থাকে। নিরুদ্দেশ হওয়ার চারদিনের দিন তাঁর সন্ধান মেলে দিল্লির জামে মসজিদের সামনে। সেখানে তিনি এক গণৎকারকে হাত দেখাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে চেনার কোনো উপায় নেই। তবু হঠাৎ এক পুলিশকর্মীর সন্দেহ হওয়ায় তাঁর সন্ধান মিলল। অর্থাৎ চারদিন পরে কাস্ত্রোর সঙ্গে মিলিত হলেন মার্কেজ। সেটা ছিল ১৯৮৩-র মার্চ মাস। তাঁর জন্মও হয়েছিল এই মার্চ মাসে –  ১৯২৭-এ। ৮৩-তে মার্কেজের হয়তো অন্যরকম এক জন্ম হয়েছিল। তাঁর ওই ভারতভ্রমণ আমাদের কাছে তাই স্মরণীয় হয়ে আছে।

শেষের শেষ করি একটি সংখ্যা দিয়ে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-রচিত শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা গ্রন্থটির এখন পর্যন্ত আনুমানিক বিক্রিসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি অর্থাৎ পঞ্চাশ মিলিয়ন।