সমকালীন বাস্তবতার ছবি

হোসনে আরা

একটি ট্রেনের যাত্রী

শাকিলা হোসেন

সূচীপত্র

ঢাকা, ২০১৮

২০০ টাকা

 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কাজের একটা মাহাত্ম্য এই যে, কাজের খাতিরে নিজের ব্যক্তিগত সুখদুঃখকে অবজ্ঞা করে যথোচিত সংক্ষক্ষপ্ত করে চলতে হয়। … কর্মের এই নিষ্ঠুরতায় মানুষের কঠোর সান্তবনা।’ (ছিন্নপত্র, ১৪৮ সংখ্যক

পত্র)। শাকিলা হোসেনের একটি ট্রেনের যাত্রী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অভিক আদিত্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এ-বক্তব্যের সার্থক স্ফুরণ দেখতে পাওয়া যায়।

দৈনিক কাগজের সহকারী সম্পাদক ও ক্রমে পূর্ণ সম্পাদক, অনুসন্ধানী প্রতিবেদক অভিক পেশাগত জীবনকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে উপন্যাসের কাহিনিতে এনেছেন অপ্রত্যাশিত বাঁক। প্রথম প্রেম শাশ্বতী, নবপরিণীতা বধূ রূপ, স্নেহ-ভালোবাসার নির্মল উৎস বাবা-মা – এদের সবার চেয়ে কর্মনিষ্ঠাই তাঁর কাছে বরাবর প্রাধান্য পেয়েছে। একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়েও তাঁর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি, বরং নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় সাংসারিক জীবন হয়েছে প্রতিকূল; তবু কাজের প্রতি নিমগ্নতা তাঁর কমেনি। উপন্যাসের সমাপ্তির সুরে অবশ্য তাঁর কর্মনিষ্ঠতার পুরস্কারস্বরূপ একটি প্রতিষ্ঠিত গবেষণাধর্মী পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার এবং সমৃদ্ধিময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়; তবু অর্থ বা খ্যাতির লোভে নয়, নিজের পেশার প্রতি সর্বোচ্চ নিষ্ঠা এবং ভালোবাসা অভিকের চরিত্রকে পূর্ণতা দিয়েছে।

প্রধান চরিত্র অভিককে উজ্জ্বল করতে এ-উপন্যাসের অন্যান্য অপ্রধান চরিত্রের অবতারণা – শাশ্বতী, রূপা, তাপস; এমনকি সাজেদ, দুলকির মতো প্রান্তিক চরিত্রও অভিককে দ্যুতিময় করতে সৃষ্ট। সাজেদের ভণ্ডামি ও যথেচ্ছাচারের বিপরীতে অভিকের স্বচ্ছ-নির্মল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরো বেশি প্রভাময় হয়ে ওঠে। দুলকির ক্ষুদ্র উপাখ্যান জানায় অভিকের মহত্ত্বের বিবরণ। ঔপন্যাসিক সর্বতোভাবে এ-চরিত্রটিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তি হিসেবে নির্মাণ করে উপন্যাসের কাহিনিতে গতির সঞ্চার করেছেন। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনের যাত্রী প্রকৃতার্থে অভিকের অনুপম অভিযাত্রার শৈল্পিক কাহিনি হয়ে উঠেছে।

শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন – ‘শাকিলার রচনার ধরনটা অনেক ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের মতো।’ উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ অবধি খুব কাছে থেকে নিবিড়ভাবে দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণ, মুহূর্তেই ভিন্ন দৃশ্যপটে প্রবেশের অনুপম রীতি চিত্রনাট্যের আভাস দেয়। ভাষা ব্যবহারে তাই পর্যবেক্ষণাত্মক বর্ণনারীতি এবং নাটকীয়তার সাবলীল ব্যবহার নজরে পড়ে সহজেই।

বিশেষত প্রকৃতির বর্ণনার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী এবং নান্দনিক। কাহিনির বিস্তারে তিনি অনেক বেশি পরিমার্জিত এবং সংযত।

সাজেদ-তটিনীর জৈবিক সম্পর্কের বিবরণে, অথবা অভিক-শাশ্বতীর নির্জন সাক্ষাতের নির্মাণে, যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাঠককে আকৃষ্ট করতে বা উপন্যাসের কাটতি বাড়াতে কোনো অহেতুক উত্তেজক বর্ণনা ব্যবহার হয়নি। ঔপন্যাসিকের পরিমিতিবোধ এবং সুরুচি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

উপন্যাসের শুরু এবং সমাপ্তিতে ঔপন্যাসিক নিজস্ব দৃষ্টিকোণে কাহিনি বয়ান করলেও মাঝে মাঝেই বিভিন্ন চরিত্র তাদের সরব উপস্থিতি ঘোষণা করে তাদের দৃষ্টিকোণে কাহিনির সূত্র গ্রথিত করেছে – সময়ে সময়ে তা পাঠককে কিছুটা বিভ্রান্তও করেছে। দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো একটু সতর্ক হলে ভালো হতো বলে মনে করা যেতে পারে।

কাহিনির বিন্যাসে বাস্তবতার নিদারুণ উপস্থিতি, সমকালীন সমাজ-মানুষকে চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন, নান্দনিক ভাষাশৈলী এবং চিত্রনাট্য রচনায় পারদর্শিতা সবকিছুর মিশেলে শাকিলা হোসেনের দ্বিতীয় উপন্যাস একটি ট্রেনের যাত্রী সুখপাঠ্য একটি উপন্যাস।