সম্পর্কের কনস্ট্রাকশন ও কম্পোজিশন

2জাফরিন গুলশান

পাটের চট, চটের বুনট, এর আঁশ এবং এর থেকে সম্ভব সকল সম্ভাবনার সঙ্গেই খেলেন কাজী সাঈদ আহমেদ। কোলাজ পদ্ধতিতে বিবিধ আঙ্গিক (ফর্ম) গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে সংযোজিত হয় ক্যানভাসে। ক্যানভাস বা চিত্রপটের মূল আধার কখনোবা প্রচলিত মার্কিন কাপড়, কখনোবা চট। এর ওপরের বিভিন্ন তলে পরতের পর পরতে রং লেপনে বিনির্মাণ হয় শিল্পীর চেতনার ভাষা। ‘রিকনস্ট্রাকশন সিরিজে’র শিল্পকর্মগুলো আধা বিমূর্ত ও বিমূর্তবাদী। আধা বিমূর্ত ও বির্মূতবাদী উপায়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন সরকার নাহিদ নিয়াজী। ‘The Archaeology of Relationship’
অর্থাৎ ‘সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্ব’ শিরোনামের এই দ্বৈত প্রদর্শনীটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টসে হয়েছে।
কাজী সাঈদ আহমেদ এবং নাহিদ নিয়াজীর দ্বৈত প্রদর্শনীতে ৪৭টি শিল্পকর্মের মধ্যকার অন্ত্যমিল সার্থকভাবে নান্দনিক দৃশ্যবোধের সৃষ্টি করেছে। নাহিদ নিয়াজীর শিল্পকর্মগুলোর চারিত্রিক শেকড় সন্ধান করলে মনে পড়ে ১৯১৭ থেকে ১৯২০-এর সময়ে প্রবর্তিত রাশিয়ান শিল্প-আন্দোলন, যা আঙ্গিকগত কাঠামোর কারণে কনস্ট্রাকটিভিজম নামে পরিচিত হয়েছে। এর কিছু পূর্বে শিল্পী ব্রাক ও পিকাসোরা কিউবিস্ট আন্দোলনের শুরুতে কোলাজের চর্চা করেন এবং অতঃপর বহু সময় পর এই প্রদর্শনীর দুই শিল্পীর শিল্পকর্ম নির্মাণ-কৌশলে ওই দুই ধারার উপকরণ আবিষ্কার হয়। এবং সেটা খুব বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক যে, শিল্পীরা নিজ ভাষা নির্মাণে পৃথিবীতে বিদ্যমান যাবতীয় সকলকিছুর সহায়তা নিতেই পারেন। যুগযুগ ধরে এই-ই হয়ে এসেছে এবং এ-প্রক্রিয়ায় নতুন ভাবনা ও ফলাফলের জন্মও হয়েছে। শিল্পী সাঈদ আহমেদ এবং নাহিদ নিয়াজী ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক স্থানে ত্রিমাত্রিক অবয়ব নির্মাণে ব্যবহার করছেন চট এবং অন্যজন কাঠ, লোহা, তার কিংবা আরো অনেক নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যাদি। শিল্পী নাহিদ নিয়াজী কাঠের পাটাতনের ভেতরে আঁশের রেখাকে রং লেপন ও ড্রইং দিয়ে এক গল্প বলেছেন। রূপান্তর ঘটেছে কাঠের আঁশের বুনটের আসল বাস্তবতা। যেখানে শিল্পীর ভাষা কর্তৃত্বপরায়ণ। এগুলো শিল্পীর ‘ন্যাচার’ সিরিজের কাজ। ব্রোকেন ইমেজ, উড কম্পোজিশন সিরিজের শিল্পকর্মগুলো অনুভূতিময়। এবং এতে সৃষ্ট বৈচিত্র্য সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্বের কোন মীমাংসা প্রতিভাত করতে চায় সেটা বিবেচ্য। ব্যক্তিগত জীবনে দুজন স্বামী-স্ত্রী। এ-প্রদর্শনীর নির্মাণযাত্রায় শিল্পী দুজনের পরস্পর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ছায়া রয়েছে। দুজনেই শিল্প উপকরণ ভাঙেন, নতুনভাবে চিন্তা করেন এবং আবারো নতুনভাবে নতুন কিছু সৃষ্টি করেন। অন্যভাবে, প্রত্নতত্ত্ব শব্দটিকে প্রতœতত্ত্বে পরিণত হতে দীর্ঘ সময়ের অতীত প্রয়োজন। প্রয়োজন ইতিহাস সংযোজন। সম্পর্কের প্রত্নতত্ত্বকে শিল্পীদ্বয় ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে বিচার করেন হয়তো। কারণ, সামষ্টিক বা ঐতিহাসিক কোনো দ্রব্যবস্তু আঙ্গিকগতভাবে সচেতনভাবে বিবেচিত হয়নি। তবে প্রতিটি ক্যানভাসে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক আরো সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। ভবিষ্যৎ দাবি করে অনেক নিরীক্ষা। রং হিসেবে অ্যাক্রিলিক প্রাধান্য পেয়েছে। ভারী করে রং লেপন শিল্পী সাঈদের ছবির বৈশিষ্ট্য। নাহিদ নিয়াজী ও সাঈদ আলো-ছায়া নিয়ে ভেবেছেন। শিল্পী নাহিদের চিত্রকর্মের রং নির্বাচনে টারশিয়ারি গ্র“পের প্রাধান্য, যাতে কাঠ, কাঠের ফাটল, টেক্সচার, লোহা কিংবা এসব কম্পোজ করে হাতে ফর্ম এঁকে সম্পূর্ণ হওয়া ছবিতে যথাযথ বক্তব্যের অনুভূতি তীব্র হয়। দুজনেই আয়তাকার ক্যানভাস আকৃতিকে নির্বাচন করেছেন। এই দুই শিল্পীর অন্যতম আরেকটি সাধারণ গুণগত সাদৃশ্য হলো, ‘কম্পোজিশন’। বিভিন্ন দ্রব্যবস্তুর একত্রিত কম্পোজিশনের ছন্দ তাঁদের ছবির প্রাণ।
প্রদর্শনীতে কাজী সাঈদ আহমেদের ২৩টি এবং শিল্পী নাহিদ নিয়াজীর ২৪টিসহ মোট শিল্পকর্মের সংখ্যা ৪৭টি।