সময়ের মিথস্ক্রিয়া

Somoyer Mithskria

জাফরিন গুলশান

শিল্পী মাহবুবুর রহমানের শিল্প-ভাবনার একটি সামাজিক অঙ্গীকারের দিক রয়েছে। সমাজের নানা অসংগতি এর মুখ্য বিষয়। ‘ডাস্ট টু ডাস্ট’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীটিতে অন্তত তা-ই প্রতীয়মান হয়। সমসাময়িক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃত, যা এ-অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সম্পর্কের বিচ্যুতি প্রবণতার মধ্যে দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে চলমান, তার প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যবস্থার আঙ্গিকে মাহবুবুর রহমান শিল্পচিন্তা করেছেন। ড্রইং, ইনস্টলেশন, ভিডিও আর্ট, পারফরম্যান্স – এসব মাধ্যমে শিল্পী প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কাজ করছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ‘ডাস্ট টু ডাস্টে’র পরিপক্বতা ঘটেছে। মাহবুব ইতিহাস নিয়ে ভাবেন, দেশ-রাজনীতি নিয়ে ভেবেছেন। আধ্যাত্মিকতাও তাঁর চিন্তার বিষয়। তাই মাহবুবুর রহমান সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত নাটক নূরলদীনের সারাজীবনের দর্শনগত সারাৎসারকে দৃশ্যশিল্পের ভাষায় রূপ দিতে প্রবণতা বোধ করেছেন। সেখানে নূরলদীন একজন সাধারণ কৃষক। নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজ অধিকার রক্ষায় জনগণের প্রতি হাঁক তুলেছিলেন – ‘কোন ঠে বাহে, জাগো!’ আর মাহবুবুর রহমান সেই প্রাসঙ্গিকতায় বর্তমানে দাঁড়িয়ে তাঁর অবস্থান থেকে প্রশ্ন তোলেন, ‘What is the aesthetic impulse for tragedy’. নীলচাষি বাবার হালের বলদ হওয়া নূরল দীনের ঘাড় ভেঙে যাওয়ার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পুনঃউপস্থাপন ‘বাফেলো ম্যান’ শিরোনামের পারফরম্যান্স আর্টটি। এ-প্রদর্শনীতে সেটি স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে দড়ি বুননের মতো শিংওয়ালা ভাস্কর্য আকারে উপস্থাপন করেন শিল্পী। আরো উপস্থাপন করেন উত্তর ঔপনিবেশিক সমাজের বর্তমান চিত্র ‘ট্রান্সফরমেশন’ শিরোনামে। এখন নীল চাষের কথা গল্প-উপন্যাস-নাটকে ইতিহাস হয়ে আছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে এদেশের শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা দুই-ই নতুন আঙ্গিক নিয়েছে। আর তখনই ঘটে ‘রানা প্লাজায়’ গার্মেন্টস শ্রমিক নিপীড়নের চূড়ান্ত নিদর্শন। ২০১৩-এর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে শ্রমিক নিহতের ঘটনা কি হত্যা, নাকি নিছক দুর্ঘটনা! ‘সাউন্ড ফ্রম নো হয়্যার’ শিরোনামের ইনস্টলেশনধর্মী কাজটিতে ভায়োলিন, হ্যাক্সো মেকানিক্যাল ফিটিংস, সাউন্ড ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আটকেপড়া আহত শ্রমিকদের উদ্ধার করা একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ধারাভাষ্য রেকর্ড করে চালানো হয়েছে। বিভীষিকাময় এই অভিজ্ঞতা গা-শিউরে তোলে দর্শকের। বিশ্ব নাড়িয়ে দেওয়া এই ঘটনা কি আদতে শ্রমিকদের জীবনের মূল্যমান রক্ষার্থে কিছু করতে পেরেছে? কিছু পরিবর্তন কি আশা করা যায় না? হয়তো ‘না বোধকে’ই আটকে যায় বাস্তবতা। কারণ, সেই নূরলদীনের আর্তনাদ আর গার্মেন্টস শ্রমিকদের আর্তনাদ শেষাবধি ইতিহাসে, সাহিত্যে, শিল্পচর্চায় ঠাঁই নেওয়াটাই যেন বাস্তবতা! কিন্তু শিল্পী বা সংবেদনশীল মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না এই নিরন্তর অন্যায়। তাই মাহবুবুর রহমান এই অবস্থার চিন্তাকে নিরন্তর উপস্থাপন করেছেন কাজে, নিছক তথ্য ও জিজ্ঞাসায় আবদ্ধ না হয়ে, রূপ দিয়েছেন শিল্পকর্মে, যেখানে রক্ত-মাংসের বাস্তবতার পথ তৈরি হয়। তৈরী হয় মিথস্ক্রিয়া। শিল্পী ও দর্শকের মধ্যকার বিশ্বাসের আদান-প্রদান ঘটে যন্ত্রণাকর নান্দনিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু মাহবুবুর রহমান এখানে ভায়োলিন ব্যবহার করলেন কেন? সম্পর্ক কি হতে পারে ভায়োলিনের সঙ্গে রানা প্লাজায় আহত পড়ে থাকা শ্রমিকের হাত-পা কেটে বের করতে ব্যবহৃত হ্যাক্সোর? ‘আই ওয়াজ টেল টু সে দিজ ওয়ার্ডস’ – স্থাপনাটি ২০১১-তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দৃশ্যশিল্পের প্রদর্শনী ভেনিস বিয়েনালে প্রদর্শিত হয়েছিল। স্টেইনলেস স্টিল, কাঁটাতার, ছাগলের চামড়া, ফাইবার গ্লাস, নিয়ন আলো, শূকরের আঙ্গিকের নির্মাণ, শব্দ প্রভৃতির সমন্বয়ে এ-কাজটি করেছেন শিল্পী। পশু বলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে প্রতিবছর ঈদুল আজহা উদযাপনে যে-প্রাণী (গরু, ছাগল, গৃহপালিত পশু) হত্যা হয়, সেই উৎসবের সাংস্কৃতিক উদযাপনের বিশেষ একটি সংবেদনশীল দিক তুলে ধরেছেন শিল্পী। শিল্পী বলেন, ‘The values and norms that we inherit are difficult to shift, like trying to make a pig into a cow’. ‘অ্যা স্পেস ফর দ্য রেইনবো’ – ২০১৪ সালে করা এ-কাজটি স্থাপনাধর্মী। ক্ষমতা ও ক্ষমতাধারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটনের উপায় খোঁজার প্রচেষ্টায় একটি স্বপ্নের ইউটোপিয়ান সম্ভাবনার কথা ভাবেন শিল্পী। মাহবুবুর রহমান আদতে বলেন, ‘Ideas like memories are translucent and layered’. সম্ভবত তিনি এভাবেই ইতিহাস ও বর্তমানের ভেতরে যোগসূত্র স্থাপন করেন।
এ-ধরনের প্রদর্শনীতে বেচা-বিক্রির সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ – জানেন মাহবুবুর রহমান। সবসময়ই চ্যালেঞ্জ নেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন। কারণ প্রযুক্তির সার্বক্ষণিক ব্যবহারের যুগে বহুমাত্রিকতার মিশ্রণ ঘটবেই। সচেতনভাবেই তিনি শিল্পকে সমসাময়িক ভাষায় উন্মোচন করেন। প্রদর্শনীটি বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ১১ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত চলে।