সময় যখন পরিমলদের

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
এখন পরিমল
মঈনুল আহসান সাবের
অনিন্দ্য প্রকাশনী
ঢাকা, ২০১৩
২৫০ টাকা

মঈনুল আহসান সাবের কথাশিল্প-চর্চা করছেন সাত দশক ধরে। তিনি লেখালেখির শুরু থেকেই সময়কে একটা দরকারি ফ্যাক্টর হিসেবে ধরছেন, এ তাঁর এক সাধনা বটে! আমরা যখন ২০১৩ সালের বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস এখন পরিমল পড়তে থাকি, তখন আমাদের কারো কারো মনে হতেও পারে, তিনি যেন এ-সময়টার যাবতীয় ব্যয়ভার পরিমলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা চলমান হিস্টরির ভেতর যখন চরিত্রটাকে দেখি, তখন মনে তাকে একজন ধর্ষক হিসেবেই ধরব। সাবেরের উপন্যাসেও তা আছে বটে। তবে সাবের একজন কথাশিল্পী হিসেবে পরিমলকে আমাদের এ-নষ্টভ্রষ্ট সময়ের একজন জলজ্যান্ত প্রতিনিধি হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন।
আমরা উপন্যাসটির নির্মাণকৌশল খানিক দেখে নিই। আমাদের কেউ কেউ বলেন, ব্যক্তিবিকাশের চরমতম মাধ্যম হচ্ছে উপন্যাস, একটা সময়কে চারদিক থেকে দেখার, বোঝার, ধরার শিল্পিত হাতিয়ারই উপন্যাস। সাবের যে-সময়কে ধরেছেন, যেভাবে ধরেছেন, ধরার ভেতর যে শৈল্পিক সাংবাদিকতা আছে তা অতিপ্রয়োজনীয় এক বিষয়। কেন প্রয়োজনীয় তা এক কথায় বোঝানো মুশকিলই। কারণ এর ভেতর দিয়ে সমাজের দারুণ শিক্ষা হয়ে যাবে; এ সমাজ বৃষ্টির জলের মতো, সকালের শিশিরের মতো, সন্ধ্যার ম্লান-ক্লান্ত আকাশের মতো বিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কথাশিল্পের অত শক্তি আছে বলে মনে করাও যায় না। এর কাজ হতে পারে ভেতরে  ভেতরে, হয়তো তা একজন পরিমলকেও ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। একধরনের ভয়ও এর ভেতর দিয়ে সমাজের আনাচে-কানাচে বিচরণ করতে পারে! তার মানে এ-সম্পর্কীয় কাজটা নেগেটিভ হতে থাকবে, তা মনে করছি না আমরা, তবে এতে আশার কোনো প্রতিবেদন নেই। বরং সময়কে যত নির্মোহভাবে সাবের এঁকেছেন, তাতে আমরা অনেক অনেক শঙ্কিত হবো, বাস্তবের যথার্থতা নিয়েও নিজেরা নিজেদের দেখব।
এর চরিত্রসমূহ আমাদের প্রথাগত নিয়মে বিচরণ করেন না, তা হচ্ছে এ-উপন্যাসের আরেক ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে। এর লিখিয়েকেও আমরা বাস্তবত পাই; নিজের সৃজিত চরিত্রের ভেতর তিনি নিজেকে মিশিয়ে দেন। পরিমল এমনই এক চরিত্র, যিনি কল্পনা আর বাস্তবকে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ করেছেন। গ্রন্থস্থ নিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়ে আমাদের দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। আমরা আশার আলো বলতে তেমন কিছু পাই না। আমরা ক্রমাগত সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত দেখি। এই যে মধ্যবিত্তের কথা বললাম, তা আমাদের যত না সমাজের, সাবেবের তার চেয়ে বেশি। যারা সাবের পাঠ করেন, তারা অন্তত এটুকু মানবেন যে তিনি মধ্যবিত্ত-স্পেশালিস্ট। তারা কথিত মধ্যবিত্তের আরাম-আয়েশের লাগাতার কামনায় থাকেন না। তারা নিম্নবিত্ত থেকে খুব বেশি দূরেও থাকেন না। তাদের আকাক্সক্ষা উচ্চবিত্তীয়ই থাকে। তাদের প্রধান প্রবণতা সুবিধাবাদিতাই। হাসনাইন হাসান নামের চরিত্রটি নিজেকে লেখার ভেতর দিয়ে একধরনের নির্মোহ, ঝামেলামুখর শিল্পময় জীবন চান; বাস্তবতার কঠিনতায় নিজেকে বেশিক্ষণ রাখেন না। কখনোবা তারই চরিত্র, রোমান্টিক আবহের মানুষ মুস্তাকে ভর করেন। সেখানেও যেন তিনি খানিক সময় দিতে চান। তবে উপন্যাসের প্রযোজিত চরিত্র পরিমল সর্বত্রগামী। এই চরিত্র সমাজের নষ্টভ্রষ্টতার প্রতীক হয়ে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
এ উপন্যাসের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চরিত্রের ভেতর নাটকীয়তা চালু রাখা। তারা তাদের চারপাশ নিয়ে, প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে খুব বেশি সময় খরচ করতে চান না। সময়কে দেখার চেতনা এত বেশি যে, চারপাশ দেখার, দেখানোর, বোঝানোর অবসর তাদের নেই! আমরা তাদের কথা শুনি। কাজের ভেতর তাদের অবস্থান খুব বেশি হয় না। অথবা বলা যায়, পরিমল যে-সময় নির্মাণ করে দেন, সেখানে তাদের পক্ষে বাড়তি কোনো কর্মে থাকার মতো কর্মও থাকে না। ফলে আমরা উপন্যাসটির একেবারে শুরু থেকেই কঠিন সময়ের  ভেতর সময় পার করি। আমাদের এ-সময় পার করাও আমাদের হাতে থাকে না। সেখানেও পরিমল অপরিহার্য। এ-উপন্যাসের ক্ষণস্থায়ী এক চরিত্র হচ্ছে শুভনীল, সে কথিত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাকে হেনস্থা করার জন্য ধর্মীয় সংখ্যাগুরু মহোদয়রা সদাপ্রস্তুত। কিন্তু পরিমলকে নিয়ে এ-ধরনের কোনো হিসাব-নিকাশ উপন্যাসে নেই। সেভাবে তাকে নির্মাণও করা হয়নি। ধর্ম এখানে ফ্যাক্টর নয়; সে এক ক্ষমতাধর চরিত্র মাত্র। এটাই তাকে জান্তব এক আকার দিয়েছে। সেটা এমনই এক ব্যাপার, এমনই ঘন-আবদ্ধ পরিবেশ এখানে আছে যে, আমরা চাইলেও, কিংবা না-চাইলেও এর বাইরে যেতে পারি না। এমন দীর্ঘ উপন্যাসে এক কঠিন-জটিল-রোমহর্ষক অবস্থা জারি রাখতে পারাটা একটা মুন্শিয়ানার বিষয়ই বটে!
হাসনাইন আর অনুপমার গার্হস্থ্য জীবন আমরা যেমন দেখি,  মুস্তফা আর মাহীর কথা আছে, আছে লেখক হাসানকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মাহী কর্তৃক ওপরে উঠার বিলাস। শিল্পও যেন এখন শর্টকাটে কিছু করার এক ব্যাপার। আমরা শারমিন আর মুস্তাকের ভালোবাসার স্পেস উপন্যাসের এক খোলা জানালা মনে করতে চাইলেও তা হয় না; কারণ উভয়ের আলাদা সংসার আছে। সেটাও কথা নয়, আসলে তারা এনজয়টাকেই বড়ো করে দেখেন। ভালোবাসা এখানে কুণ্ঠিত হয়। প্রচুর কথা বলেন তারা, কথার ভেতর মোহনীয় এক জগৎ খোলে যেতে থাকে। সাবের এ-কাজে দারুণ সিদ্ধহস্ত, চরিত্রসমূহে শুধু কথার ভেতরই রাখেন না; পাঠককে তাতে নিমজ্জিত করতে জানেন। এ তার সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যই।
আমরা উপন্যাসটির ভাষাবৈশিষ্ট্যই আলাদা করে স্মরণ করতে পারি, বয়নচাতুর্য একে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। এটা ঠিক, এতে অনেক অনেক ঘটনা আছে, চরিত্রসমূহ বিচরণের ক্ষিপ্রতা আছে, তবে তারচেয়েও বড়ো কথা, তারা নিজেদের বৈশিষ্ট্য নিজেরাই প্রকাশের ভেতর থাকে যেন। পাঠকের মনোজগৎ থেকে এমন কোনো আচরণ বা বৈশিষ্ট্য তারা নিয়ে রাখেন না, যাতে অতিজাগতিক আকাক্সক্ষা তাকে জিইয়ে রাখতে হয়। বর্ণনার সহজতা পাঠকের সঙ্গে এর নিবিড়তা তৈরি হয়। চরিত্রবৈশিষ্ট্য মনে রাখতে-রাখতে এমন হয় যে, তাদের ভেতর যেন ভাংচুরও শুরু হয়ে গেছে। নারীচরিত্রসমূহ, যেমন শারমিন, অনুপমা, মাহী মধ্যবিত্তীয় আলাদা আলাদা আচরণ দ্বারা আলাদা হতে থাকে। এভাবেই শহুরে সোসাইটির একধরনের যাপিত ধরন আমরা পাঠ করি। লেখক পাঠককে স্বস্তি দেন না। বারবার তিনি মধ্যবিত্তীয় হতচকিত অবস্থা, এমনকি তাদের ভণ্ডামিকে স্পষ্ট করেন। তাতে উপন্যাসটির প্রাণময়তা তেমন কোনো বিঘিœত হয় না।
এমন এক উপন্যাসে যখন আমরা মনোনিবেশ করি এবং এর চরিত্রসমূহ নিয়ে একধরনের বিবেচনায় নামি, তখনই আমাদের মনে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে, ঔপন্যাসিক কাকে কেন্দ্র করে এটি সাজালেন, মানে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র কে? একটা উপন্যাসকে জানার জন্য তা কতটুকু ন্যায্য প্রশ্ন তা কল্পনা করতে চাইলেও আমার কাছে মনে হয়েছে, এ-উপন্যাসের এ এক প্রয়োজনীয় প্রশ্ন বটে। আমরা এর লেখক মানে হাসনাইন হাসানকেই মূল চরিত্র ধরতে পারি, তার ভেতর দিয়েই তো সময়ের সত্য প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতে থিতু হওয়া যায় না; অতি স্বল্পসময়ে যাপিত পরিমল আমাদের ঘাড়ের কাছে তার তীব্র, হিংস্র শ্বাস ফেলতে থাকে। সে তার লেখনীর চরিত্রবৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করে যেন চাক্ষুষ বৈশিষ্ট্য দিয়েই নিজেকে হাজির-নাজির করতে থাকে। কারণ তার চলাচলের ধরন এমন যে, তাকে তার সব সমস্ত বৈশিষ্ট্যেও ভেতর একজন জলজ্যান্ত সময়-নিয়ন্ত্রক মনে হয়। উপন্যাসে তার জীবনযাপন শুধু লিঙ্গপিপাসু ধর্ষক মনে হয় না; সময়ের যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক কামনাই যেন তার দখলে, তাকে বিনা আমাদের এই জাগতিক সংসার অচল। এমনকি একসময়কার ধর্ষণে শততম পজিশনে আসার কামনাকারী মানিকও যেন তারই ধারাবাহিকতার অংশ।
আমরা স্বভাবতই এ-তর্কে যাবো না যে, হাসনাইন হাসানের ব্যক্তিত্বেও ভেতর একজন মঈনুল আহসান সাবের তার ব্যক্তিত্বসমেত বিরাজ করেন কিনা। এ সন্দেহ কেউ করতেই পারেন। পাঠকের সন্দেহ অতিজাগতিক বা সৃজনমুখর কিনা আমরা তাও বলব না। তবে একজন কথাশিল্পীর অন্তর্জগৎ, তাদের গল্পসংগ্রহের ধরন, ব্যক্তিত্বর স্ফুরণ কিন্তু হাসনাইনের  ভেতর আছে! মোস্তাকের ভেতর আছে কবির চলাচল, শারমিন জীবনকে অতি স্বাধীনতায় দেখার বাসনা করেন। মাহী অতিচতুরতায় কাব্যিক আবহ নির্মাণ করতে চায়। কিন্তু পরিমল শুধু একটা কাজই চায়, আর সেটা হচ্ছে, সময়ের অপরিহার্য অংশ হয়ে সে বিচরণ করতে চায়। এই ‘চায়’ শব্দটিও যথার্থ হয় না, তা যেন সে বহন করতেই সমর্থ হয়। তার ভেতর দিয়ে একটা সময়কে আমরা পাই। এ পাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা এখানে আছে। কথাক্রমেই পরিমলের গল্পে ফিরে আসি – আমরা তো কার্যত তার বহুমুখী জীবন দেখি, অন্যায় আর অসত্যকে যে নাকি একতরফাভাবে কন্ট্রোল করে, তা সে করতে পারে;  ফলে, সেই জীবনকে কথাশিল্পে উদ্ভাসিত করার জন্য উপন্যাসের বাজারি-কাঠামোবাদ যথেষ্ট মনে হয় না। তাই তো সাবের শব্দবিন্যাসে কাঠামোবাদে থাকলেও আঙ্গিকে উত্তর-কাঠামোবাদী হয়ে যান। নতুন করে আঙ্গিক সাজান! এটি আমাদের কথাশিল্পের নবতর উদ্যোগ।
আমরা এ-উপন্যাসের ভেতর দিয়ে একটা সময়কেই শেষতক পাঠ করে নিতে পারি। আমাদের কারো কারো ভেতর এ-আফসোস থাকতেই পারে, গোটা একটা উপন্যাস মধ্যচিত্ততা দিয়েই শুরু, খানিক বিস্তার, আবার শেষও হয়ে গেল। আমরা যদি এ-সময়টার, মানে পরিমলশাসিত এ-সময়টার একটা পোস্টমর্টেম করতে চাই, তাহলে এটি একটা সাংস্কৃতিক মিউজিয়ামের মতো কাজ করবে।  এ-সময়টাকে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেখার জন্য সাবের সমস্ত ব্যবস্থাই রেখেছেন। সে-হিসেবেও একে এক জান্তবতার প্রতীক বলা যায়। আমরা এতে নিমজ্জিত হই, নিজেদেরকেই যেন দেখে নিই। সেই দেখার  ভেতর রক্তাক্ত হওয়ার এক নিদারুণ ব্যবস্থা সাবের রাখতে পেরেছেন।