সরযূবালা দেবী : যে জন আছেন মাঝখানে

অংশুমান ভৌমিক
‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’ – আমাদের রংমহলে চালু থাকা এই প্রবচনটি সরযূবালা দেবীর বড় প্রিয় ছিল। তাঁর বেলায় যে সেটি সত্য হয়নি। তবু সত্যি বলতে কী সরযূবালাকে আজকের বাঙালি তেমন চেনে না। বাংলা মহল্লার বাইরে আরো কম। যদিও ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিলিস্ন দরবারে গিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সংগীত নাটক আকাদেমির দেওয়া সম্মান গ্রহণ করেছেন তিনি, নাট্যাভিনয়ের জন্যে এটিই সর্বোচ্চ সম্মান, তা সত্ত্বেও তাঁকে বড় একটা মনে রাখি না আমরা। তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন, কেয়া চক্রবর্তীকে যত চর্চা হয়, তার সাপেক্ষে সরযূবালাকে বেশ অপাঙক্তেয়ই মনে হতে পারে। অথচ না চিনেও যাঁদের চেনা হয়ে যায়, তাঁদের মধ্যে সরযূবালা একজন। আমাদের বিচারে সরযূবালাই বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেত্রী। কলকাতায় রবীন্দ্র সদন-নন্দন-পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ইত্যাদি নিয়ে যে-সংস্কৃতিপ্রাঙ্গণ, তার এক ধারে মান্ধাতা আমলের বিরজি তালাওয়ের পাড়ে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি ভবনে যদি যান, চারতলার মন্মথ রায় গ্রন্থাগারে ঢোকেন, দেখবেন একটি গ্রন্থসংগ্রহ পরিপাটি করে সাজানো আছে। ওই গ্রন্থাগারের যে-‘পরিগ্রহণ খাতা’, যাকে আমরা ‘অ্যাকুইজিশন রেজিস্টার’ নামেই বেশি জানি, তার ৩৮-সংখ্যক পাতা থেকে ৪৬ পাতা জুড়ে সরযূবালার দেওয়া ১৫১টি বইয়ের খতিয়ান আছে। তাতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের যে বাংলা সংস্করণ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল সেটি যেমন আছে, তেমনি আছে নানান জীবনীগ্রন্থ, গুটিকয় রবীন্দ্রসাহিত্য। উৎপল দত্তের গিরিশ মানস তাঁর একটি প্রিয় বই ছিল। নানান সাক্ষাৎকারে সেটির উলেস্নখ করেছেন। তাঁর স্পর্শধন্য সেই বইটিও সেখানে আছে। তবে নাটকের বই-ই বেশি। সে-আমলে সাহেবি কায়দার নাটক তো খালি কলকাতা বা মফস্বলের প্রসেনিয়াম থিয়েটারে হতো না। ছাপাখানার সঙ্গেও তার দহরম-মহরম ছিল। নাটক একটু চললেই তার পেপারব্যাক এডিশন বেরোত। লোকের হাতে হাতে ঘুরত। সারা বাংলায় ছড়িয়ে যেত। কলাকুশলীদের কাছেও সেসব বই থাকত। সরযূবালার কাছেও ছিল। একেকটি বই ছুঁয়ে দেখলে তাঁকে পাবেন। এমনকি আশ্চর্য কিছু আবিষ্কারও হতে পারে। তাঁর সংগ্রহ দেখতে গিয়ে চোখ আটকাতে পারে শ্যামলীতে। শ্যামলী, আপনারা সকলেই জানেন, কলকাতার থিয়েটারের একটি মাইলফলক। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের কয়েক বছর পর উত্তর কলকাতার থিয়েটারপাড়ায় মন্দা নেমেছিল। প্রোপ্রাইটার-ম্যানেজার-অ্যাক্টর-মোশন মাস্টার-মিউজিক ট্রেনার-ডান্স মাস্টার-প্রম্পটার- টেকনিশিয়ান এরকম আরো অনেককে নিয়ে প্রফেশনাল বোর্ডের যে-থিয়েটার সিস্টেম সেই গিরিশ ঘোষের আমল থেকেই চালু ছিল, সেটি প্রায় থমকে যাচ্ছিল। সলিলকুমার মিত্র স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই ডুবোজাহাজে দরকারি যেসব মেরামত করেন তাতে ওই নাট্যসংস্কৃতিতে ফের জোয়ার আসে। সেই জোয়ারের তোড়েই উত্তর কলকাতার থিয়েটার আরো পঞ্চাশ বছর টিকে ছিল। ওই জোয়ার এনেছিল শ্যামলী। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর, অর্থাৎ দেবীপক্ষের সপ্তমীর দিন থেকে শুরু করে স্টার থিয়েটারে লাগাতার ৪৮৪ রজনী চলে এটি নজির গড়েছিল। তাতে একটি বোবা মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। শ্যামলীর সূত্র ছিল নিরূপমা দেবীর লেখা একটি উপন্যাস, যেটি আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে বেরিয়েছিল। এটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। এটি বই হয়ে বেরিয়েছিল সেই আমলের মুদ্রণ সংস্কৃতির এক দিকপাল প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে, ১৩৬০ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে। দাম ছিল এক টাকা আট আনা। সেই বইটি বেরোনোমাত্র সরযূবালা দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন দেবনারায়ণ। বইয়ের আখ্যাপত্রে লিখে দিয়েছিলেন -স্নেহময়ী মা ‘সরলা’নাট্যসম্রাজ্ঞী শ্রীমতী সরযূবালাশ্রীকরকমলেষু।গুণমুগ্ধদেবনারায়ণ গুপ্ত ২১.১.৫৪

এখানে দুটি কথা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। ওই শ্যামলী নাটকে উত্তমকুমার-অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল ‘অনিল’। এই অনিলের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেন সরযূবালা। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল ‘সরলা’। ওই চরিত্রায়ণ সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকার নাট্য-সমালোচক লিখেছিলেন, ‘সরলার ভূমিকায় সরযূবালা অভিনয় চাতুর্য্যে চরিত্রটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।’ আর ওই সময় থেকেই উত্তর কলকাতার থিয়েটারে মাতৃমূর্তির একটি আদিকল্প হিসেবে সরযূবালার অভিনয়শৈলী এক ধরনের প্রামাণ্যতা পায়। পরবর্তীকালে বয়ঃকনিষ্ঠমাত্রেই যে সরযূবালাকে ‘সরযূ মা’ বলতেন, এখনো কেউ কেউ বলেন, তারও সূচনাবিন্দু ওই শ্যামলী।
শ্যামলীর দ্বিশততম অভিনয়ের যে স্মারক-উৎসব হয়েছিল, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট তার সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়, প্রধান অতিথি ছিলেন যুগান্তর সংবাদপত্রের সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ। সেদিন যে স্মরণিকাটি বেরিয়েছিল সেটি আমাদের কাছে আছে। তাতে প্রথম অভিনয়রজনীর শিল্পীবৃন্দের একটি তালিকা আছে। সে-আমলের রেওয়াজমাফিক পুরুষ চরিত্র ও স্ত্রী চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের নাম আলাদা আলাদা করে ছাপা হতো। স্ত্রীদের সবার ওপরে সরযূবালার নাম। অষ্টম পৃষ্ঠায় বড় করে সরযূবালার ছবি। দ্বাদশ পৃষ্ঠায় শ্যামলী নাটকের সকল অভিনেত্রীর একত্র সমাবেশের ছবি আছে। তাতে শ্যামলী ওরফে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্চে তাঁর শাশুড়ির ভূমিকায় অভিনয় করা সরযূবালা। সাবিত্রী সেই হাতটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। তৎকালীন নাট্যসমাজে সরযূবালার অবস্থানটি বুঝতে এমন ছবি আমাদের সাহায্য করে বই কি!
আর ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’? কী করে তাঁর নামের সঙ্গে এ-উপাধি জুড়ল? মান্যতা পেল? তাঁর সমকালীন কোনো অভিনেত্রীর নামের আগে তো এমন খেতাব নেই! ‘নাট্যাচার্য’ আছেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী। ‘বাণীবিনোদ’ আছেন। নির্মলেন্দু লাহিড়ী, যিনি একাধারে সরযূবালার শিক্ষক ও স্বামী। এই উপাধিগুলির মধ্যে তৎকালীন কলকাতার কুলীন সংস্কৃতি মহল নাট্যসংস্কৃতিকে কোন উঁচু নজরে দেখত তার একটি হদিস আছে। আমাদের
মনে রাখতে হবে যে, এই উপাধিগুলি কিন্তু স্ব-আরোপিত নয়। সরযূবালাকে এই উপাধি দিয়েছিল সংস্কৃতি পরিষদ, যা পরে ফিল্ম অ্যান্ড থিয়েটার আর্কাইভস অব ইন্ডিয়া নামে চালু ছিল। এই উপাধির জন্যে তাঁর নাম যাঁরা অনুমোদন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন অশোক কুমার সরকার, তুষার কান্তি ঘোষ, চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মন্মথ রায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। অর্থাৎ গণমাধ্যম ও
নাট্যসংস্কৃতির যাঁরা পুরোধাপ্রতিম, তাঁদের দেওয়া খেতাব এই ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’। আর মানুষের দেওয়া খেতাব ‘সরযূ মা’।
সরযূবালা দেবীর প্রয়াণ ঘটে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই। কুমার রায় তখন বহুরূপী নাট্যপত্রের সম্পাদক। সে-পত্রের ৮২তম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে কুমার লিখেছিলেন –

ভালোবেসে দেশের নাট্যানুরাগীরা তাঁকে সম্রাজ্ঞীর ভূমিকায় বসিয়েছিলেন – নাট্যসম্রাজ্ঞী! সরযূদেবী পরিণত বয়সেই চলে গেলেন – সেকাল এবং একালের মানুষদের কাছ থেকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা আদায় করে। খুব অল্প বয়সে বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং সেই রঙ্গালয়ের সুখদুঃখের সাক্ষী হয়েছিলেন। পুরোনো যুগের হয়েও তিনি এ-যুগের মানুষের সঙ্গে একটা সেতু রচনা করতে পেরেছিলেন তাঁর আপন ব্যবহারে সৌজন্যের প্রকাশে।১
কলকাতাকেন্দ্রিক নাট্যসংস্কৃতির কোনো ভাঙা সাঁকো আজ তেমন করে আমাদের নজরে নেই। কিন্তু সরযূবালা অনেকদিন ধরেই যে ‘সেতু’ হয়ে আমাদের মধ্যে ছিলেন তার উদার স্বীকৃতি আছে কুমার রায়ের এই মন্তব্যে।
আমাদের মনে হয়, খ্রিষ্টীয় বিশের দশকের গোড়া থেকে আশির দশকের শেষ অবধি অর্থাৎ প্রায় ৬৫ বছর ধরে যিনি রংমহলে সক্রিয় ছিলেন, নাট্যসমাজ ও সংস্কৃতিতে এত অদলবদল সত্ত্বেও প্রতিভা ও পারদর্শিতার যুগল মিলনে যাঁর আসন টলেনি, যিনি নানান রকমের থিয়েটারের পাশাপাশি সিনেমায়-রেডিওতে সসম্মানে বিচরণ করেছেন, সকলের ‘সরযূ মা’ হয়ে উঠেছেন, তাঁকে বছরে একটিবারের জন্যে মনে করা শিল্পরসিক সব বাঙালির কর্তব্য। এত উঁচুদরের শিল্পী হয়েও তিনি যে আগাগোড়া আর পাঁচজনের মধ্যে ছিলেন এ আমরা জানি। তিনি এখনো কীভাবে আমাদের মধ্যে আছেন সে-ব্যাপারটি আমরা আজ একটু তলিয়ে দেখতে চাই।

দুই
প্রথমেই খুব দ্রম্নত সরযূবালা সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ অজ্ঞানতা সেটি দূর করা যাক।
সরযূবালার জন্ম দক্ষিণেশ্বরে, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে। বাবা ভূতনাথ দত্ত, মা ইন্দুমতী দেবী। আটপৌরে গরিব ঘর। বাবা গানবাজনা জানতেন। মেয়েকেও শেখাতেন। শৈশবেই একে একে মা ও বাবাকে হারান সরযূবালা। লেখাপড়া বেশি এগোয়নি। ন-বছর বয়সে এমিনেন্ট থিয়েটার নামে এক অ্যামেচার থিয়েটার দলের সঙ্গে যুক্ত হন বালিকা সরযূ। দক্ষিণেশ্বরেই। নিজের মুখেই বলে গেছেন যে, কুমার সিংহ বলে একটি নাটকে এক ভিখারি বালকের ভূমিকায় তাঁর প্রথম মঞ্চে আসা। তাঁর গান সকলের ভালো লেগেছিল বলে সেদিন রৌপ্যপদক পেয়েছিলেন সরযূবালা। আজীবন সেই রৌপ্যপদকটিকে আগলে রেখেছেন তিনি। ওই বয়সে তখনকার দিনের জনপ্রিয় সব নাটক যেমন সাজাহান, তাতে সিপারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সবই ওই এমিনেন্ট থিয়েটারে। এর দু-বছরের মাথায় ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে অরোরা ফিল্ম করপোরেশনের মালিক অনাদি বসু যে ট্যুরিং থিয়েটার কোম্পানি চালাতেন, তাতে চলে আসেন সরযূবালা। সারা বাংলায় আলিবাবা, মিশরকুমারী, সুদামা এমন অনেক নাটকে ছোট-বড় চরিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। এখানে হাতেখড়ি হলেও তাঁর আসল শিক্ষা শুরু হয় ১৯২৭ নাগাদ, যখন তিনি নির্মলেন্দু লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসেন। দক্ষিণেশ্বরে এমিনেন্ট থিয়েটারের নাটক চন্দ্রশেখর দেখতে গিয়েছিলেন নির্মলেন্দু। তাতে শৈবলিনী করছিলেন পঞ্চদশী সরযূ। নির্মলেন্দুর পছন্দ হলো খুব। সরযূবালাকে নিয়ে এলেন তাঁর ট্যুরিং থিয়েটার কোম্পানিতে। কয়েক মাস ধরে ঘষামাজার পর তাঁকেই নায়িকা করে বেরিয়ে পড়লেন সদরে-মফস্বলে। সাতটি নাটক। সবকটিতেই নায়িকার চরিত্রে সরযূবালা। কী কী? চন্দ্রশেখরে শৈবলিনী, চন্দ্রগুপ্তে ছায়া, বঙ্গে বর্গীতে মাধুরী, আর প্রফুল্ল, দেবলাদেবী, শ্রীদুর্গা ও ষোড়শীতে নামভূমিকায়।২ কাদের জায়গায় এলেন তিনি? আর কাদের সঙ্গে গেলেন? দুটি নাম বললেই যথেষ্ট হবে। তারাসুন্দরী ও কুসুমকুমারী। আরো ছিলেন অনেকে। কোথায় কোথায় গেলেন নাটক করতে? ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো ঘাঁটি তো বটেই, গেলেন একেবারে রেঙ্গুন অবধি।
পরের বছর মনোমোহন থিয়েটার লিজ নিলেন অনাদি বসু। ম্যানেজার হয়ে এলেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, মানে দানীবাবু। নির্মলেন্দু যোগ দিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে। এই মনোমোহন থিয়েটারেই বিষবৃক্ষ নাটকে কুন্দনলিনী করা হলো সরযূবালাকে। পাশে কারা? দানীবাবু, নির্মলেন্দু, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, ইন্দুবালা এরকম তাঁহা তাঁহা সব নট-নটী। আবির্ভাবেই নজর কাড়লেন সরযূবালা। পরের নাটক দক্ষযজ্ঞ। তাতে মহাদেব হলেন দানীবাবু, দক্ষ হলেন নির্মলেন্দু। আর সতী অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে সরযূবালা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সরযূবালাকে। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের শেষে নাটকে ফের নায়িকা। নাম পারুল। এবারে আরো সাড়া পড়ল। নাচঘর পত্রিকায় বেরোল, ‘স্ত্রী ভূমিকার ভিতরে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন পারুলের ভূমিকায় শ্রীমতী সরযূবালা। এই নতুন অভিনেত্রীটির কথাগুলি যেমন মিষ্টি, তাঁর অভিনয়ও তেমনি আনন্দদায়ক, এঁকে মনোমোহন থিয়েটারের সুন্দর আবিষ্কার বলা যায়। নাট্যজগতে ইনি যে নিজের পথ কেটে নিতে পারবেন, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত, কারণ আজ পর্যন্ত যতগুলি ভূমিকায় এঁর অভিনয় দেখলুম, তার প্রত্যেকটি হয়েছে উপভোগ্য। আমরা এঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’৩
অর্থাৎ কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটারের তথাকথিত গিরিশ যুগের শেষে, শিশির যুগের মধ্যগগনে সবদিক থেকে ফুলেফেঁপে ওঠা মরসুমের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন এক ষোড়শী, যাঁর নাম সরযূবালা। একদিকে দানীবাবু, অন্যদিকে নির্মলেন্দু – দুজনের প্রশিক্ষণে হয়ে উঠলেন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ওই মনোমোহন থিয়েটারেই মঞ্চস্থ হয় শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের প্রথম নাটক রক্তকমল। কতক বার্নার্ড শ-র মিসেস ওয়ারেনস প্রফেশনের ছায়ায় লেখা। তাতে গান লিখলেন কাজী নজরুল ইসলাম আর হেমেন্দ্রকুমার রায়। সুর সাধলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেই প্রথম নজরুলের কাছে গান শিখলেন সরযূবালা। কত আদর করে ভরসা দিয়ে সকালবেলার গানের ক্লাসে তাঁকে গান তোলাতেন নজরুল তার চমৎকার এক ধারাভাষ্য আছে নাট্য আকাদেমির লেখ্যাগারে সংরক্ষিত সরযূবালার সাক্ষাৎকারে।
ক্যালকাটা ইমপ্রম্নভমেন্ট ট্রাস্ট যখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন মনোমোহন থিয়েটার ভাঙা পড়ে। এ নিয়ে বিধায়ক ভট্টাচার্যের বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক আছে। সরীসৃপ। ১৯৬২-তে ছেপে বেরিয়েছিল। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর তার প্রথম বেতার সম্প্রচার হয়, জগন্নাথ বসুর প্রযোজনায়। তাতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাডামের ভূমিকায় সরযূবালাই অভিনয় করেছিলেন। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম চক্রবর্তী, শ্রীলা মজুমদারের সঙ্গে। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, ম্যাডামের চরিত্রের অনেকটাই সরযূবালার শিল্পীজীবনের আদলে গড়া।
ওই নাটকে এক জায়গায় আছে –
নিকুঞ্জ। হ্যাঁ, কাল সকাল থেকেই ভাঙা শুরু হবে। (একটু থেমে) আমি আজকাল আর আমার কথা ভাবিনে ম্যাডাম। ভাবি, তোমার কথা।
ম্যাডাম। আর ভেবো না।
নিকুঞ্জ। না ভেবে পারছি কই? বঙ্গরঙ্গমঞ্চের নাট্যসম্রাজ্ঞী সারদাসুন্দরী ওরফে ম্যাডাম। – এই স্টেজে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে তুমি হাসিয়েছ, কাঁদিয়েছ। – তোমাকে বাংলা স্টেজ ভুলে গেল কী করে?
ম্যাডাম। কেন? কাগজেই তো পড়েছ যে, নিকুঞ্জ-সারদাসুন্দরীর বস্তাপচা অ্যাক্টিং আর চলবে না। দেশে নব নাট্যের নতুন হাওয়া বহিতেছে –
নিকুঞ্জ। কেন? এইতো কিছুদিন আগেই বুড়ো বয়সে আমরা শচীন সেনগুপ্তের ‘রক্তকমল’ যখন করলাম, তখনো কি নতুন হাওয়া বয়নি? সেই যে নজরুলের গানটা – আহা, কী যেন গো? ম্যাডাম। কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি।/ কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে, কেউ ভুলিতে গায় গীতি।৪
রক্তকমলের কথা আগেই বলেছি। ওই নাটকে ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’ সত্যিই ছিল। গাইতেন ইন্দুবালা। আর নিকুঞ্জের কথায় উঠে আসা ‘বঙ্গরঙ্গমঞ্চের নাট্য-সম্রাজ্ঞী’? কে? সরযূবালা। আজকের দিনে পড়লে বিধায়কের এই নাটক সরীসৃপকে আমাদের উত্তর কলকাতার থিয়েটারের প্রয়াণলেখ বলে মনে হয়। শুনেছি অনীক নাট্যদল বিধায়কের জন্মশতবর্ষে এটির প্রযোজনা করেছিল, মলয় বিশ্বাসের নির্দেশনায়। তা এখনো অভিনীত হয়। দেখতে দেখতে সরযূবালাকে মনে পড়বেই আপনাদের। এতখানি জুড়ে আছেন তিনি সরীসৃপের ওই প্রতীকের মধ্যে।

সরযূবালা এক অর্থে সৌভাগ্যবতী। কারণ তিনি যখন কলকাতায় এলেন সে-সময় কলকাতার থিয়েটারে কয়েকটি নতুন দিক খুলছিল। শিশিরকুমার ভাদুড়ী জাঁকিয়ে বসার পর থেকেই উচ্চশিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি কলকাতার থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিক-পৌরাণিক-সামাজিক নাটকের পাশাপাশি গ্রামবাংলার মাটির কথা নদীর কথা শোনানোর একটি অবকাশ তৈরি হচ্ছিল। গ্রামোফোন রেকর্ডে তথাকথিত ‘লোকসংগীতে’র জনপ্রিয়তা এতে ইন্ধন জুগিয়ে থাকবে। কিন্তু এ-কথা সত্য যে, লোকজীবনের সঙ্গে আমাদের নাগরিক ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতির যে ভাঙা সাঁকো সেটি একটু একটু করে জুড়তে শুরু করেছিল। আমরা জানি যে, দীনেশচন্দ্র সেন-সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকা এই ধারার একটি কীর্তিস্তম্ভ। এটি বেরোয় ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এর তিন-চার বছরের মাথায় জানা যাচ্ছে জনৈক সুশীলকুমার সেন ‘কর্ত্তৃক নাটকাকারে গ্রথিত’ নাটক মহুয়া হ্যারিসন রোড-কলেজ স্ট্রিট মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ‘মহাসমারোহে অভিনীত ও সর্বজন প্রশংসিত’ হওয়ার পর বই হয়ে ছেপে বেরোচ্ছে। সে-বইয়ের ভূমিকা লিখছেন স্বয়ং দীনেশচন্দ্র।৫ আর ছ-বছরের মাথায় পোড়খাওয়া ম্যানেজার প্রবোধ গুহ ওই মনোমোহন থিয়েটারের দায়িত্ব নিয়েই মন্মথ রায়কে দিয়ে মহুয়া পালার একটি নাট্যরূপ লেখান। সেই প্রযোজনার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের মাপের গীতিকার-সুরকার, চারু রায়ের মাপের চিত্রশিল্পী ও মঞ্চস্থপতি, এবং অহীন্দ্র চৌধুরী ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাপের দুই নট। আজকের লবজে যাকে বলা যেতে পারে বিগ বাজেট প্রোডাকশন। নাচে-গানে-অভিনয়ে জমজমাট মহুয়া ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম মঞ্চে আসে। যে সোনাই মাধব, সোনাই দীঘি, মাধব মালঞ্চী কইন্যা বা কমলা রাণীর সাগরদীঘি, চন্দ্রাবতী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে মুগ্ধতার অবধি নেই, তার অনেক আগে। মহুয়া সফল হয়। এতে নির্মলেন্দু সাজেন হোমরা বাইদ্যা, নদের চাঁদ হন দুর্গাদাস, আর মহুয়ার ভূমিকায় সরযূবালা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের নাট্য-ইতিহাসে এমন অসংখ্য কানাগলি আছে, যেখানে অনেক হারামণি আটকা পড়েছে। নইলে কলকাতা বা ঢাকার নাট্যচর্চার আলোচনায় এই দুটি মহুয়ার প্রযোজনার কথা কখনো আসে না কেন? কেনই বা উত্তর কলকাতার থিয়েটারকে আমরা আজ কোন চোখে দেখব তার হদিস পাই না? পাই না বলেই সরযূবালা যে কীভাবে আমাদের মধ্যে রয়ে গেছেন তা ঠাহর হয় না। মহুয়া দেখে এসে নাচঘর লিখেছিল, ‘শ্রীমতী সরযূবালার ‘মহুয়া’ যে কত সুন্দর হয়েছে, সকলকেই তা দেখতে অনুরোধ করি। এই নবীনা নটীর শক্তি আমাদের বিস্মিত করেছে। এতটুকু দেহের ভিতরে এমন ভাব প্রকাশের শক্তি যে গোপন থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। বলতে কি সমগ্র অভিনয়ের ভিতরে প্রধান জয়মাল্য তাঁরই প্রাপ্য।’ মনে রাখবেন, নির্মলেন্দু ও দুর্গাদাসের কথা মাথায় রেখেই এমন মন্তব্য করা হয়েছিল।
মন্মথ রায়ের কথা যখন উঠল, তখন কারাগার নাটকের কথা না বললেই নয়। আপনাদের মনে আছে যে, ত্রিশের এই নাটক কীভাবে স্বদেশি আন্দোলনের স্রোতে মিশে গিয়েছিল। তাতে কঙ্কা সাজতেন সরযূবালা।
মনোমোহন থিয়েটার ভেঙে দেওয়ার পর বিচিত্র ধারায় বয়েছে সরযূবালার অভিনয়জীবন। রংমহলে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নির্দেশনায় শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়ায় (১৯৩১) তিনি নারায়ণী সেজেছেন। নাট্যনিকেতনে নির্মলেন্দুর কাছে থেকে মা (১৯৩৩), খনা (১৯৩৫) এমন কত নাটকে নায়িকার ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। তবে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শচীন সেনগুপ্তের সিরাজদ্দৌলা নাটকে লুৎফুন্নিসার ভূমিকায় সরযূবালা যে-অভিনয় করেছিলেন তা প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠল। কে না দেখেছেন সে-অভিনয়। একবার নাট্যনিকেতনে এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। সরযূবালা লিখেছিলেন –

‘সিরাজদ্দৌলা’র অভিনয় হচ্ছে। হঠাৎ শুনলাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র, হেমেন্দ্রকুমার রায় এসেছেন নাটক দেখতে। আমি মঞ্চের উপর লুৎফা-চরিত্রে অভিনয় করছি। লুৎফার সংলাপে ছিল, ‘চলুন, জাঁহাপনা, আপনার হাত ধরে, এই আঁধার রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ি। কেউ জানবে না, বাংলার নবাব তাঁর বেগমের হাত ধরে চিরদিনের মতো বাংলা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন’ – এই ধরনের সংলাপ বলে চলে যাব, হঠাৎই সামনের সারিতে নজর পড়লো, সুভাষচন্দ্র রুমাল বার করে চোখ মুছলেন। অভিনয় শেষে ভিতরে এসে শচীনদাকে জড়িয়ে ধরে তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। নেতাজী খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। আমরা অভিভূত হয়ে দুই দেশপ্রেমিক মহান মানুষকে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখলাম। সে ছবি আমার চোখে আজও অমস্নান হয়ে রয়েছে।৬

মঞ্চ তো বটেই, গ্রামোফোন রেকর্ডের সৌজন্যে এই নাটক ছড়িয়েছিল সর্বত্র। তখন তো ‘সুখী গৃহকোণ’ মানেই ‘শোভে গ্রামোফোন’। তাপস সেন একবার লিখেছিলেন –

একটি সংলাপ আমার ছোটবয়স থেকে মনের মধ্যে প্রায়ই ধ্বনিত হত – ‘বাঙলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি – তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব’ – গ্রামোফোন রেকর্ডে ঐ পালা শুনেছি আসামের ধুবড়ীতে, ময়মনসিংহে আমার মামাবাড়ীতে এবং দিলস্নীর ইস্কুলে পড়ার দিনগুলোতে।৭

তাপসের জন্ম অসমে (আসামে)। ১৯২৪-এ। তার মানে ১৯৩৮-এর ওই রেকর্ড আকৈশোর মাতিয়ে রেখেছিল তাঁকে। লাখ লাখ রেকর্ড বিক্রি হয়েছিল। সুধী প্রধান লিখেছিলেন –

শচীনদা আমাকে বলেছিলেন যে ‘সিরাজদ্দৌলা’র গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি থেকে তিনি ৪৫ হাজার টাকা কমিশন পেয়েছিলেন। আমি যতদূর জানি অন্য কোন নাটকের রেকর্ড থেকে এত কমিশন কেউ পায় নি। আমাদের ছোট বয়সে অমর দত্তের ‘গোবিন্দলাল ও রোহিণী’ নামক একটি রেকর্ড বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, কিন্তু ‘সিরাজদ্দৌলা’র রেকর্ড সমস্ত বাঙালী শুনতে চেষ্টা করেছে।৮

একদিকে কংগ্রেসের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সাদৃশ্য, অন্যদিকে চড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা – এই বাতাবরণে দাঁড়িয়ে সিরাজদ্দৌলা যে প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি পেয়েছিল, তার মূলে অবশ্যই শচীন সেনগুপ্তের রচনা এবং নির্মলেন্দু লাহিড়ীর গ্রন্থনা ও নামভূমিকায় অভিনয়। তবে লুৎফা সরযূবালাও কিছু কম যাননি। আমাদের অনুমান, সিরাজদ্দৌলার এই রেকর্ডিং, এটি বাংলার যন্ত্রায়িত শ্রবণ সংস্কৃতির সবচেয়ে উঁচু ইমারত। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এর লংপেস্নয়িং রেকর্ড বেরোয়। বছর দশেকের মাথায় ক্যাসেট বেরোয়। সবই গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া থেকে। সেই ক্যাসেটের নকলও বেরোয়। টি সিরিজ থেকে। মুড়িমুড়কির মতো না বিকোলে কি আর জালিয়াতির ফাঁদে দেয় নাটক? এক্ষেত্রে কিন্তু দিয়েছিল।
আরো একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা সে পালন করেছিল। সেটি ষাটের দশক জুড়ে, পূর্ব পাকিস্তানে। ইতিহাসের কত কথাই তো অলিখিত থেকে যায়, লেখা হলেও ছাপা হয় না, ছাপা হলেও রাখা হয় না। তাই একজনের স্মৃতিচারণের একটি অংশ আপনাদের শোনাতে চাই। এটি লিখেছেন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী শার্শা এলাকা, বেনাপোল থেকে যশোর যাওয়ার পথে যেটা পড়ে, সেখানকার শালকোনা নামের এক গ্রামে খ্রিষ্টীয় ষাটের দশকে ছেলেবেলা কেটেছে লেখকের। গ্রামের যাত্রাদলের করা রূপবান, আলোমতীর মতো যাত্রাপালার মধ্যে বড় হয়েছেন। তাঁর লেখার একটি অংশ –

নাটক দেখা নয়, শোনার অভিজ্ঞতা রেডিওতে। সেকালে রেডিও ছিল বড় কম। সেকালের জাঁদরেল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমাদের গ্রামের তবিবর রহমান বিশ্বাসের বড় মারফি রেডিও ছিল। তার বদান্যতায় আমরা মাসে দুয়েকটি নাটক শোনার সুযোগ পেতাম। ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে ট্রান্সিস্টর এসে গেলে নাটক শোনা আরেকটু সহজ হয়ে যায়। ষাটের দশকে আকাশবাণী কলকাতার নাটক ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার নাটকও লোকে শুনত প্রাণ ভরে। যেদিন নাটক হত, গ্রামের লোক সব রেডিওর পাশে গোল হয়ে বসত, নাটক শুনতে। আকাশবাণী কলকাতা থেকে রাত সাড়ে ৮টায় নাটক প্রচারিত হলেও ঢাকা কেন্দ্রের নাটক প্রচারিত হতো রাত ১০টায়। বিশেষ করে প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর যেসব যাত্রা প্রচারিত হতো তার আকর্ষণই ছিল আলাদা। সামাজিক নাটকের চেয়ে পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর নাটক বেশি জনপ্রিয় ছিল। নাটকে অভিনয় করার সুযোগও আমরা পেয়েছি সেই স্কুলে থাকতেই। ১৯৬২ সালে আমি যখন ক্লাস ফোরের ছাত্র, তখন আমাদের স্কুলের ছেলেরা মঞ্চস্থ করে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক। সে নাটকে আমিও ওয়াটসের ভূমিকায় অভিনয় করি। আমার বড়ভাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আরেক ভাই মীর জাফরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বলা বাহুল্য, নারীচরিত্রে ছেলেরাই অভিনয় করেছিল। মনে পড়ে, আমার এক ক্লাস ওপরে পড়া ছাত্র নবিছুদ্দিন আলেয়ার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। গানগুলোও তিনিই গেয়েছিলেন, সেইসাথে নাচও।
নানা কারণে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক মঞ্চস্থ করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একটা প্রাইমারি স্কুলের ছেলেদের দিয়ে আইয়ুবি শাসনের সেই দুঃসময়ে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক মঞ্চস্থ করানো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে কেন আমাদের অভিভাবকরা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক মঞ্চস্থ করিয়েছিলেন? তাদের একটি রাজনৈতিক বক্তব্য যে ছিল, তা আমরা তখন না বুঝলেও বড় হয়ে বুঝেছি। আইয়ুবি আমলে, তখনও মার্শাল ল’ জারি রয়েছে, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক মঞ্চস্থ করা রীতিমত দুঃসাহসী এক কাজ ছিল। তাছাড়া, ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়া ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানোটাও ছিল যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ।
নাটকের কোনো বই তারা জোগাড় করতে পারেননি। গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড বাজিয়ে তার শ্রম্নতিলিখন থেকে বই তৈরি করেন আয়োজকরা। হাতে লেখা সেই বই থেকে অভিনয়। তাতে অবশ্য কিছু সুবিধাও হয়েছিল। অভিনয় কেমন হবে, গানগুলোই না কেমন গাইতে হবে তার উঁচুদরের নমুনা ছিল তাদের কাছে। যারা শেখাচ্ছিলেন, তারা সবাই অপেশাদার যুবক। এক দুর্মর আকাঙক্ষা থেকে তারা আমাদের এই নাটকে অভিনয় করিয়েছিলেন।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, দুয়েকবার শুনলেই পুরো বই মনে গেঁথে যায়। নিজের পার্ট তো বটেই, পুরো বই সবার মুখস্থ। কাজেই প্রমট করার খুব দরকার হয়নি। আমরা মোটামুটি সাবলীল অভিনয় করে সকলের মন জয় করেছিলাম।৯

কাজেই সরযূবালার শিকড় আমাদের ভেতরে কত গভীরে চারিয়ে আছে, ভেবে দেখার বিষয়। এরই কাছাকাছি সময়ে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে খান আতাউর রহমান-পরিচালিত ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌলা পূর্ব পাকিস্তানকে মাতিয়ে তুলছে। আনোয়ার হোসেন প্রমুখের অভিনয় মনে করুন। পাশাপাশি শুনুন নির্মলেন্দু লাহিড়ী-সরযূবালা দেবী- অভিনীত গ্রামোফোন ডিস্ক প্রযোজনা। দেখবেন প্রথমটি অবিকল দ্বিতীয়টির অনুকরণ। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা অঙ্গনে সবচেয়ে জনপ্রিয় পালা ছিল সিরাজউদ্দৌলা। অমলেন্দু বিশ্বাস-জ্যোৎস্না বিশ্বাস-অভিনীত সেই কিংবদন্তিপ্রতিম প্রযোজনার সুরটি আমাদের কোনো পাঠকের কানে গেঁথে থাকলে মিলিয়ে দেখতে পারেন। আমাদের ধারণা, তাতেও ওই গ্রামোফোন ডিস্কের অনুরণন বাজবে। এখন নাটোরের গ্রামে-মহল্লায় চলন নাটুয়া এই নাটক মঞ্চস্থ করে। যাত্রার ধাঁচে। অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, তাতেও ওই একই অনুরণন। এর বাইরে যেখানেই বাঙালি আছে, অফিস ক্লাবে বা অ্যামেচার থিয়েটারে বা স্কুলে-কলেজে, যেখানেই এ-নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, ওই গ্রামোফোন ডিস্কবাহিত অভিনয়রীতি কতক অবধারিতভাবে অনুসৃত হয়েছে। অনুসৃত হয়েছেন সরযূবালা। বস্ত্তত ঐতিহাসিক নাটক অভিনয়ের যে লোকপ্রিয় ধারা, যাতে সুরের ওঠানামা বেশি, তাতে এই রেওয়াজ প্রায় অনিবার্য।
এর আরেকটি পরাকাষ্ঠা অবশ্যই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান নাটকের জাহানারা। প্রথমবার তিনি জাহানারা সেজেছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে। শেষবার অহীন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে। প্রথমটি ১৯৩১-এ এক কম্বিনেশন নাইটে মনোমোহন থিয়েটার আর শিশিরকুমারের দলের যৌথ আয়োজনে, গিরিশচন্দ্র ঘোষের মূর্তির আবরণ উন্মোচন উপলক্ষে। শেষেরটি অহীন্দ্রের প্রয়াণের কিছুদিন আগে, সত্তরের দশকের গোড়ায়, অভিনেত্রী সংঘের আয়োজন। আমাদের সৌভাগ্য যে, সে দুটি অভিনয়ের কোনো ধ্বনিরূপ আমাদের কাছে না থাকলেও মধ্যবর্তী ৪০ বছরে যে অসংখ্য কম্বিনেশন নাইটে জাহানারা হয়েছেন সরযূবালা, তার দুটি অডিও রেকর্ডিং আমাদের হাতের নাগালে আছে। প্রথমটি লংপেস্নয়িং রেকর্ড, গ্রামোফোন কোম্পানির এইচএমভি মার্কা লাগিয়ে বেরিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের জন্মের একশ বছরে, অর্থাৎ ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। তাতে সাজাহান হয়েছিলেন বিপিন গুপ্ত। আরেকটি বেরিয়েছে একেবারে হালে, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর সৌজন্যে, ইনরেকো থেকে। এটি আগাপাশতলা আকাশবাণীর নাটক বিভাগের প্রযোজনা, যার দায়িত্বে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, যাতে সাজাহান হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। এটির প্রথম সম্প্রচার হয় ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রম্নয়ারি।
এ-দুটি রেকর্ডিং এখন ইউটিউবে মিলছে। পরপর শুনলেই বুঝতে পারব যে, কীভাবে প্রযোজনার দাবি অনুযায়ী নিজেকে বদলে বদলে নেওয়ার দুর্লভ ক্ষমতা ছিল সরযূবালার।
এর বাইরেও আরেকটি লংপেস্নয়িং রেকর্ডের খোঁজ পাওয়া যায়। সেটিও সেনোলা রেকর্ডে বেরিয়েছিল। নদের নিমাই। রচনা ও পরিচালনা নরেশ চক্রবর্তীর, সংগীত চ-ীদাস বসুর। তাতে নিমাই ছিলেন দ্বিজু ভাওয়াল, বিষ্ণুপ্রিয়া জয়শ্রী সেন, এবং শচীমাতার ভূমিকায় সরযূবালা দেবী। অনুমান করি যে, এটি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার রেকর্ডিং।
নানান লেখ্যাগার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে খোঁজ করলে সরযূবালা- অভিনীত আরো নাটকের ধ্বনিমুদ্রণ আমাদের হাতে আসতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটির নাম করলেই অনেকে চমকে উঠবেন। নরমেধ, প্রতাপাদিত্য, বিদ্যাপতি, রুক্মিণী মিলন। ৭৮ আরপিএম ঘূর্ণনের কালো চাকতিতে সব আটকা পড়ে আছে। কিন্তু আছে। হারিয়ে যায়নি। আশেপাশে খুঁজলে আরো কিছু মিলে যেতে পারে। কাজেই সরযূবালার বাচিক অভিনয় আমাদের নাগালে আছে।
ভুলে গেলে চলবে না সিনেমাতেও সক্রিয় ছিলেন সরযূবালা। তাঁকে দিয়ে অভিনয় করানোর জন্যে হত্যে দিয়ে পড়ে ছিলেন খোদ প্রমথেশ বড়ুয়া। এখন মুশকিল হচ্ছে, তাঁর প্রায় কোনো ছবিই আর আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই। তবে অগতির গতি হয়ে আছে কিছু ফিল্ম বুকলেট এবং লবিকার্ড। তার থেকে বুঝে নেওয়া যায় যে, ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ঋষির প্রেম থেকে ১৯৭৭-এর ফুলশয্যা – বেশ লম্বা পাড়ি দিয়েছিলেন সরযূবালা। ১৯৪৫-এ মতিমহল থিয়েটার্সের শ্রীদুর্গায় তিনি ছিলেন কেন্দ্রে। দুর্গার অকালবোধনের সেই গল্পে নায়িকা হয়েছিলেন তিনি। নির্দেশক শৈলজারঞ্জন মজুমদার। ছায়া দেবীর সঙ্গে সরযূবালার ছবি ছাপা হয়েছিল বুকলেটের পাতায়। ভারতী বিদ্যাপীঠের দাসীপুত্রে তাঁর ছবি বুকলেটের মলাটে। কুশীলবদের সবার আগে তাঁর নাম। এটি ১৯৪৯-এর ছবি। ওই বছরই শঙ্কর কথাচিত্রের কৃষ্ণা কাবেরী বেরোচ্ছে। তাতেও প্রধান ভূমিকা তাঁর। এ-দুটি ছবির নির্দেশক যথাক্রমে দেবনারায়ণ গুপ্ত ও বিধায়ক ভট্টাচার্য। এর পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের কালিন্দী নিয়ে নরেশ মিত্র যখন ছবি করলেন, তাতেও সরযূবালা ছিলেন। উত্তমকুমারের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিন-চারটি ছবিতে। যেমন পুনর্মিলন, রাজদ্রোহী, মঞ্জরী অপেরা। তবে আর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নয়।

তিন
তাঁর মূল্যায়ন হয়েছে অনেক। সমকালে তো বটেই, পরবর্তীকালেও। নাচঘরের কথা আগে বলেছি। আরো দুটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের বড়দিনের সন্ধ্যায় মিনার্ভা থিয়েটারে শচীন সেনগুপ্তের কালো টাকা নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে সজনীকান্ত দাসের মতো কড়া সমালোচক লিখেছিলেন –

নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করিয়াছেন মঞ্চের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী শ্রীমতী সরযূবালা। দেশসেবিকা বিজয়া যে বেদনা লইয়া চোরাকারবারী স্বামীর ঘর করিতে বাধ্য হইয়াছে শুধু স্বামীকে সৎপথে ফিরাইবার আকাঙক্ষা লইয়া সেই বেদনা এবং নিজের আদর্শবাচন দ্বারা সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় অভিনয় দ্বারা সরযূবালা এমন চমৎকার ফুটাইয়া তুলিয়াছেন যে দেখিতে-দেখিতে মনে হয় তিনি যেন এই নাটকে নিজেকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইয়াছেন।

আর তাঁর অভিনয়জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর, ১৯৮৭-তে একটি মূল্যায়ন করেছিলেন অজিতকুমার ঘোষ। গ্রম্নপ থিয়েটার পত্রিকার পাতায়।

সরযূদেবী ষাট বছর ধরে রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি পুরোনো যুগের সঙ্গে বর্তমান যুগের সংযোগ রক্ষা করেছেন। অভিনেত্রীর কতকগুলি স্বাভাবিক সম্পদ থেকে অবশ্য সরযূদেবী বঞ্চিত। তাঁর আকৃতি দীর্ঘ নয় এবং চেহারাতেও কোন অসামান্য আকর্ষণ নেই। কিন্তু এ-সব সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সযত্ন চেষ্টা ও অনুশীলনের দ্বারা তিনি তাঁর অভিনয়কে অসাধারণ স্তরে উন্নীত করতে পেরেছেন। তিনি যখন তাঁর দেহভঙ্গিকে ঋজু, কঠিন ও প্রত্যয়শীল করে তোলেন, তখন তাঁর আকৃতির খর্বতা আর চোখে পড়ে না। স্বরের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে এবং স্বরক্ষেপণ করতে তিনি বিশেষ পারদর্শিনী। মনোমোহন রঙ্গমঞ্চে সরযূদেবী যখন আত্মপ্রকাশ করেন, তখন নাচগানের কয়েকটি ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সামাজিক নাটকে করুণরসাত্মক ভূমিকায় তিনি কয়েকটি অবিস্মরণীয় অভিনয়-উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর করুণরসাত্মক অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য হল দ্রম্নত কণ্ঠস্বর পরিবর্তনের পর হঠাৎ একটা কূলহারা আর্তনাদের মধ্যে তাঁর কথাগুলি যেন ভেঙ্গে পড়ে। প্রবল ভাবে নিঃশ্বাসবায়ু আকর্ষণের মধ্যেও একটা বুকফাটা বেদনার হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অভিনীত করুণরসাতমক ভূমিকাগুলির মধ্যে পারুল (পথের শেষে), প্রফুল্ল, পার্বতী (দেবদাস), প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। ঐতিহাসিক নাটকে তাঁর সব চেয়ে করুণরসাত্মক ভূমিকা বোধহয় সিরাজদ্দৌলার লুৎফা। সরযূদেবীর অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে উঠেছে ঐতিহাসিক নাটকের বীর্যদীপ্ত ট্র্যাজিক চরিত্রগুলিতে। এই ঐতিহাসিক ভূমিকাগুলির জন্যই তিনি নাট্যসম্রাজ্ঞী। কারাগার নাটকের কঙ্কারূপে তিনি তেজস্বিনী সংগ্রামশীলা নারীর ভূমিকায় প্রথম অবতরণ করেন। ধাত্রীপান্নার ভূমিকায় সুদৃঢ় কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে সুমহান আত্মত্যাগের মিশ্রণের ফলে চরিত্রটির মধ্যে তেজস্বিতা ও মহাপ্রাণতার এক চমৎকার সমন্বয় ঘটেছিল। তবে তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় অভিনয় বোধহয় মহাশক্তিধর ঔরংজীবের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিনী জাহানারার ভূমিকায়। তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ দাঁড়াবার ভঙ্গিমা, জ্বলন্ত দৃষ্টি, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং তেজোগর্ভ বাচন চরিত্রটিকে অসাধারণ মর্যাদায় ভূষিত করেছিল। সরযূদেবী অভিনেত্রী জীবনের শেষ পর্বে দীর্ঘকাল রঙমহলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিলেন। রঙমহলে অভিনীত অপরাধজনক ও কৌতুকজনক নাটকে স্নেহ-সহিষ্ণুতাময়ী মাতৃচরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। কৌতুকরসাত্মক চরিত্রে তিনি যে কিরূপ পারদর্শিনী তা সুবর্ণগোলকের অভিনয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি।১০

এই কথাগুলির সঙ্গে আমাদের অনেক কথাই জুড়বার থাকতে পারত। কিন্তু থিয়েটারের মতো নশ্বর শিল্পের বেলায় সে-সুযোগ নেই। সেকেন্ডারি মেটেরিয়াল নিয়ে বেশি কিছু বলাও যায় না। তবু ভাবতে ভালো লাগে যে, সরযূবালা আজো আমাদের মধ্যে আছেন। দক্ষিণ কলকাতার রইস পাড়া বালিগঞ্জের যে-রাস্তার ওপরে তিনি থাকতেন সেটির নাম পালিত স্ট্রিট। তার পাশের একটি রাস্তার পুরনো নাম ছিল ক্লার্কস স্ট্রিট। সেটি এখন সরযূবালা সরণি নামে খ্যাত। ঠিক তাঁর উলটোদিকে আছে তুলনায় দীর্ঘ একটি রাস্তা। তার নাম নরেশ মিত্র সরণি।
এই দুটি সতীর্থের নামে এই দুই সরণি মনে করিয়ে দেয় থিয়েটারকে একদা কোন মর্যাদার আসনে রেখেছিল বাঙালি।

[২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি-আয়োজিত ‘সরযূবালা দেবী স্মারক বক্তৃতা ২০১৯’-এর সম্পূর্ণ পাঠ।]

বিবিধ
১. কুমার রায়, ‘সম্পাদকীয়’, বহুরূপী ৮২ (সং কুমার রায়), কলকাতা, অক্টোবর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৭।
২. অমিত মৈত্র, ‘সরযূবালা’, রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৭৪১।
৩. ওই, পৃ ৭৪৪।
৪. বিধায়ক ভট্টাচার্য, সরীসৃপ, বাংলা একাঙ্ক নাট্যসংগ্রহ (সং অজিত কুমার ঘোষ), সাহিত্য অকাদেমি, দিলিস্ন, ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৮৪।
৫. নাচঘর (সং নলিনীমোহন রায়চৌধুরী), এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ২৭ কার্তিক ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, পৃ ৬।
৬. সরযূবালা দেবী, ‘পড়ন্ত আলোয় শচীন্দ্র-স্মৃতি’, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী স্মরণিকা, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি, কলকাতা, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ১৪।
৭. তাপস সেন, ‘শচীন সেনগুপ্ত’, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী স্মরণিকা, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি, কলকাতা, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৫৭।
৮. সুধী প্রধান, ‘আমার জানা শচীন্দ্রনাথ’, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী স্মরণিকা, শচীন সেনগুপ্ত জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি, কলকাতা, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৪৭।
৯. আমিরুল আলম খান, ‘নাটক পাঁচালি’, বিবর্তন যশোর-আয়োজিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নাট্য-উৎসবের স্মরণিকা, যশোর, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ১৬-১৭।
১০. অজিতকুমার ঘোষ, ‘সাধারণ মঞ্চের অভিনেত্রী : শিশির যুগ ও পরবর্তীকাল’, গ্রম্নপ থিয়েটার ৩৭ (সং নৃপেন্দ্র সাহা), আগস্ট-অক্টোবর ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ ৭৮-৭৯।