সহজিয়া এক হ্যামলেট অথচ নিশ্চিতভাবেই শেক্সপিয়রের

অলোক বসু

‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। সন্দেহ নেই যে, রবীন্দ্রনাথের মতো মহান একজন মানুষের পক্ষেই সহজ করে এমন কথাটিও বলা সম্ভব। যাঁরা অনেক বড়মাপের লেখক, শিল্পী তাঁরা যেমন সহজ বিষয়টি সহজ করে প্রকাশ করতে পারেন, তেমনি অনেক জটিল বিষয়ও সহজ করে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। এখানেই তাঁদের মহত্ত্ব।   বলছিলাম যুক্তরাজ্যের গ্লোব থিয়েটারের হ্যামলেট নাটকের কথা। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক নাটক। গ্লোব থিয়েটার সম্প্রতি ঢাকায় এ-নাটকের একটি প্রদর্শনী করে গেল। যাঁরা এই নাটকটির প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন যে, নানামুখী হ্যামলেটীয় জটিলতা গেলাব থিয়েটারের কর্মীরা কত সহজে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখেন।

শেক্সপিয়রের ৪৫০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে গ্লোব থিয়েটার ২০৫টি দেশে হ্যামলেট নাটক নিয়ে পরিভ্রমণের অংশ হিসেবে গত ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মূল হলে নাটকটির একটি প্রদর্শনী করে। রোজা এবং ঈদের ছুটির কারণে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে পড়লেও ওই সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণের চেহারা ছিল অন্যরকম। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে দর্শকদের মিলনায়তনে ঢুকতে হয়েছে একটি ঘুরপথ দিয়ে। যদিও নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ৭৩০ জন দর্শক। এই সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি মানুষই নাটক দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রদর্শনীর প্রায় কুড়িদিন আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল, তাও অনলাইনে, মাত্র কয়েক মিনিটে। নাট্যালোচনা পড়তে বসে কতজন টিকিট পেল, কতজন পেল না, কত মিনিটে সব টিকিট শেষ হয়ে গেল এই হিসাব পাঠকের কাছে অবান্তর মনে হতে পারে জেনেও বলতে হচ্ছে এজন্য যে, একটি ভালো নাটক দেখার জন্য ঢাকার নাট্যামোদী মহল কতটা উদগ্রীব, কতটা আগ্রহী তা বোঝানো।

নাটকের শুরুতেই নির্দেশক বুঝিয়ে দিলেন, তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল একটি পথ ধরে এগোতে চাচ্ছেন তাঁর হ্যামলেট নিয়ে। জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চের মাত্র অর্ধেকটা জায়গা অভিনয়ের উপযোগী করে সাজানো হয়েছে নিরাভরণ মঞ্চসজ্জায়। মঞ্চের মাঝামাঝি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু বাক্সপেঁটরা ও তক্তপোশ। ডাউন স্টেজের মাঝামাঝি দুটি খুঁটির সঙ্গে পর্দা ঝোলানো। তবে পর্দা খোলা। আপ স্টেজে সাইকোরমা। তার সামনে সাইকোরমার সমান্তরালে দুপাশে সাদা কাপড়ের সঙ্গে দুটি ফ্রেম। তার সঙ্গে পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাদ্যযন্ত্র ঝোলানোর জন্য আংটা লাগানো। মাঝামাঝি জায়গাটা ফাঁকা রাখা হয়েছে অভিনয়শিল্পীদের চলাচলের জন্য। নাটকের শুরুতে একসঙ্গে সকল অভিনয়শিল্পী মঞ্চে প্রবেশ করেন অত্যন্ত মামুলি ভঙ্গিতে। কারো গলায় ঝোলানো অ্যাকোর্ডিয়ান, কারো হাতে বেহালা কিংবা কারো সঙ্গে অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র, কেউবা খালি হাতে। আমাদের দেশীয় লোকনাট্যরীতির মতো সুরে-সংগীতে নাট্য আবহ রচনার সম্মিলিত প্রয়াস। সংগীত-তাল-লয় ঠিক রেখে কেউবা তক্তপোশ ঠুকে, কেউবা মঞ্চে বুট ঠুকে বাক্সপেঁটরা যথাস্থানে রেখে সাজেস্টিভ সেট নির্মাণ করছেন। এরই মাঝে ওফেলিয়া চরিত্রে রূপদানকারিণী অ্যাকোর্ডিয়ান বাজাতে বাজাতে এবং কোরাস গাইতে গাইতে দর্শকসারিতে চলে আসেন এবং দর্শকের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়মূলক কথাবার্তায় অংশ নেন। তিনি মঞ্চে ফিরে যেতেই শুরু হয় নাটক।

শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের গল্প পাঠকমাত্রেরই জানা। তাই তার পুনরুক্তি না করাই ভালো। বরং প্রযোজনা ও উপস্থাপনা বিষয়ে কিছু বলাই সংগত হবে।

হ্যামলেট এমন এক নাট্যাখ্যান যার প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি সংলাপে রয়েছে নানা মাত্রিকতা। সুতরাং সমস্ত সম্ভাবনাকেই নির্দেশক কাজে লাগাতে চাইবেন – এটাই স্বাভাবিক। এই মহাকাব্যিক উপাখ্যান নিয়ে সারাবিশ্বে কত রকমের যে কাজ হয়েছে, তার সংখ্যা নিরূপণ করাও আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য। আমাদের বাংলাদেশেও হ্যামলেটের নানারকম প্রযোজনা লক্ষ করেছি আমরা। সব হ্যামলেটের কথা কি আমরা মনে রাখতে পেরেছি? সেসব ‘হ্যামলেট’ই স্মরণীয় হয়ে আছে, যারা প্রযোজনা-কৌশল ও অভিনয়কুশলতায় অভিনবত্বের ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে বিগত শতকের নববইয়ের দশকের মাঝামাঝি আলী যাকেরের রূপান্তর ও নির্দেশনায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দর্পণ নাটকের কথা। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকটি তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রূপান্তর করে দর্পণ নামে মঞ্চায়িত করেছিলেন। সেখানে ডেনমার্ক কিংবা ইংল্যান্ডের পরিবর্তে ছিল বাংলাদেশের সোঁদামাটির গন্ধ। আরো স্মরণ করা যেতে পারে নববইয়ের দশকের শুরুর দিকে নাট্যধারার দুঃসাহসী প্রযোজনা হ্যামলেট, ওহ্ হ্যামলেটের কথা। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল হ্যামলেট, ওহ্ হ্যামলেট নাটকটি, যদিও সে-নাটকে স্থানকালপাত্রের নামে কোনোরকম পরিবর্তন আনা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৫-এ নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড-পরবর্তী বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মাঝে বিদ্যমান নৈরাশ্য, অবিশ্বাস, হানাহানি ও সন্ত্রাসের বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল এই নাটকে। এই নাটকে হ্যামলেট ছিল পাঁচজন এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

নিকট অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের হ্যামলেট প্রযোজনাটিও স্মর্তব্য। অ্যারিনা বা চতুর্মুখী স্পেস ডিজাইনে নিরীক্ষাধর্মী এ-নাটকটির কথাও ঢাকার নাট্যামোদী মহলের মনে থাকবে দীর্ঘদিন। আরো অনেক রকম হ্যামলেট দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও যুক্তরাজ্যের গ্লোব থিয়েটারের হ্যামলেট যেন অন্য সব হ্যামলেটের থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র, মহিমান্বিত। নির্দেশক ডমিনিক ড্রোমগুল ও বিল বুখার্স্ট হ্যামলেট প্রযোজনায় কোনোকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। বরং গল্পটি সহজ ও স্বাভাবিকভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। নাটকের শুরুতে যেমন গান, বাদ্যযন্ত্র ও কোরিওগ্রাফির ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক তেমনি বিরতিতে যাওয়ার আগে, বিরতি থেকে ফেরার সময় এবং নাটকের শেষেও ব্যবহার করা হয়েছে গান, বাদ্যযন্ত্র ও কোরিওগ্রাফি। তবে কোথাও ছন্দপতন ঘটেনি কিংবা আরোপিত মনে হয়নি। প্রযোজনাটির উপস্থাপনরীতির সঙ্গে আমাদের লোকনাট্যরীতির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়ার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। যাঁরা হাবিব তানভিরের প্রযোজনারীতির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা এ-নাটকের ডিজাইনের সঙ্গে হাবিব তানভিরের কাজের ধরনের অনেক মিল খুঁজে পেতে পারেন। তার মানে এই নয় যে, একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত। ব্যাপারটা যেমন কাকতালীয় হতে পারে, আবার গ্রেটমেন থিংক অ্যালাইকও হতে পারে। তাছাড়া দেশে দেশে শিশুতোষ লোকসাহিত্য উপস্থাপন কৌশলে ‘হাউ মাউ খাউ’ ধরনের সংলাপের সঙ্গে একই ধরনের শারীরিক অভিনয় প্রদর্শনের সাযুজ্যের কথা তো আমাদের সকলেরই জানা – সেরকম একটা ব্যাপারও হতে পারে। পরিচিত এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করার ফলে দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগটা নিবিড় হয়েছে।

এই নাটকের সবচেয়ে যে বিষয়টি সকলের মনোযোগ কাড়ে, তা হলো সকলের অভিনয়কুশলতা। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক সংলাপ প্রক্ষেপণ এবং পরিমিতি বোধসম্পন্ন অভিনয় দর্শকদের হৃদয় কেড়েছে। ব্যতিক্রম ছিল কিং হ্যামলেট, কডিয়াস ও গ্যাট্রুটের চরিত্রে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়। তাদের সংলাপ প্রক্ষেপণে কখনো কখনো মেলোড্রামাটিক ব্যাপারটি রাখা হয়েছে, তাতে করে সেই ভিক্টোরিয়ান সময়টি যেমন ধরা যায়, তেমনি তাদের চারিত্রিক বৈচিত্র্য, সেই সঙ্গে চরিত্রের সঙ্গে পাওয়ার পলিটিক্স বা ক্ষমতার গন্ধটিও ধরা পড়ে।

হ্যামলেট কনটেন্টের প্রতি অনুগত নির্দেশক নাটকজুড়ে চেষ্টা করেছেন হ্যামলেটের দর্শন, ক্রাইসিস, ব্যক্তিত্ব এসবকে জঙ্গম করে তুলতে, সেইসঙ্গে ওফেলিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক, পিতৃহত্যার কারণে মা গ্যাট্রুটের প্রতি ঘৃণা এবং কডিয়াসের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণতার যে জটিল মনস্তত্ত্ব তা অনেক সহজ প্রকরণে প্রকাশ করায় সহজেই জারিত করতে সমর্থ হয়েছে দর্শকচিত্তকে। বিশালসংখ্যক কুশীলবের নাটক হ্যামলেটের গ্লোব থিয়েটারের প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন মাত্র আট-দশজন শিল্পী। নির্দেশকের সাফল্য হলো, তিনি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন ভিন্ন মুডে ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সফলভাবে চরিত্রান্তর ঘটিয়েছেন একজনের অভিনয় অথবা একাধিক চরিত্রে বিভিন্নজনের অভিনয়ের মাধ্যমে। সবদিক থেকেই নির্দেশক সচেষ্ট ছিলেন নাটকটির সহজ-সরল ও স্বতন্ত্র উপস্থাপনা পদ্ধতি আবিষ্কারে। কী ডিজাইন, কী সংলাপ, কী অভিনয়, কী আবহসংগীত – সর্বত্রই স্বতন্ত্র এক ধারা সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন নির্দেশক। টেক্সটের ব্যাপারেও তিনি সতর্ক ছিলেন আগাগোড়া। তাই এই হ্যামলেট যেন প্রকৃত অর্থেই শেক্সপিয়রের হয়ে উঠেছে। এর আগে এই লেখক আর কোনো হ্যামলেটে এতটা শেক্সপিয়রের গন্ধ যে পাননি সেটাও হলফ করে বলা যায়।

আধুনিককালে নাটককে বলা হয় নির্দেশকের সৃজন। এ-নাটকটিতে নির্দেশকের সৃজনের যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও নাট্যকারকে দেখা যায় আরো অধিক ঔজ্জ্বল্যে। গ্লোব থিয়েটারের হ্যামলেট প্রযোজনার অসাধারণত্ব এখানেই।

সবশেষে এ-নাটকে আলোর ব্যবহার নিয়ে মনের মাঝে একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে যায়। মাত্র বারোটি জেনারেল লাইট দিয়ে পুরো মঞ্চটি আলোকিত করে রেখে অভিনয় চলেছে। একবারের জন্যও আলো কমানো, বাড়ানো বা নেভানো হয়নি। এটা হয়তো ডিজাইন করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মঞ্চে কিংবা খোলা জায়গায় অভিনয় করার উপযোগিতার কথা ভেবে। কিন্তু যেখানে আলো ব্যবহারের আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে এর ব্যবহার না করার মধ্যে হয়তো একটা স্পর্ধা দেখানোর ব্যাপার থাকতে পারে; কিন্তু আলোর সহযোগিতায়  নাট্যমুহূর্ত তৈরি করার সুযোগটিও যে তাতে হাতছাড়া হয়ে যায়, তার প্রমাণও এই হ্যামলেট।

হ্যামলেট নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে রূপদানকারী কেইথ বারটলেট, জন ডগাল, ল্যাডি এমেরুয়া, ফোয়েবি ফিলডেস, মিরান্ডা ফস্টার, নাঈম হায়াৎ, বেরুস খান, জেনিফার লিওঙ, টম লরেন্স, রাউরি প্যারাটেন, ম্যাথিউ রোমেইন, অ্যামান্ডা উইলকিন, নাটকের নির্দেশকসহ সকল কলাকুশলীর প্রতি এবং আয়োজনটি সফল করার ক্ষেত্রে ঢাকা থিয়েটার, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কেন্দ্র, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রতি কৃতজ্ঞতা।