সাক্ষ্য

আহমাদ মোস্তফা কামাল

ওমন, কাঁদো কেন? ও চোখ, কেন এত ভিজে ওঠো? – নিজেই নিজের মন আর চোখকে জিজ্ঞেস করেন আজিজুল হক। আর না করেইবা উপায় কী, ওরা যে কাজই করতে দিচ্ছে না, কোনো শাসনও মানছে না। অথচ দ্রুত কাজটি করে ফেলতে হবে, এই কবর তৈরি করার কাজটি, মুর্দাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি দাফন করার তাগিদ দিয়ে গেছেন স্বয়ং নবীজী, এসব ক্ষেত্রে অবহেলা চলে না, গুনাহ হয়, সেই গুনাহর মাফ নাই। অথচ তাঁর হাত থেমে যাচ্ছে, মন কেঁদে উঠছে, চোখ ভিজে উঠছে। তিনি তাই নিজেই নিজের মনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন, আর মন বলে –

কাঁদব না কেন? ওই অতটুকুন একটা ছেলে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল! এটা কি তার যাওয়ার সময়?

অতটুকু কই? পঁচিশ বছর বয়স হলো ওর! আর যাওয়ার তো কোনো সিরিয়াল নাই, কে যে কখন যাবে তারও কোনো ঠিক নাই।

সেজন্যই তো কাঁদি – মন বলে, কেন নাই? আসার সিরিয়াল আছে, যাওয়ার সিরিয়াল নাই কেন? আর এই পঁচিশ বছর কোনো যাওয়ার বয়স হলো? এই বয়স তো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াবার বয়স!

এ-প্রশ্নের কোনো উত্তর নাই। আজিজুল হক প্রায় সারাটা জীবন পার করে দিয়েছেন ছাত্রদের পড়িয়ে। তাদের নানারকম প্রশ্নের উত্তর তিনি হাসিমুখেই দিয়েছেন, কিন্তু ওরা কোমলমতি, তেমন কোনো বেয়াড়া প্রশ্নই করেনি কোনোদিন। ওদের প্রশ্নগুলো নিতান্তই সরল কৌতূহলে ভরা, যদিও সেগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে তাদের গলা শুকিয়ে যায়, আর তাঁর মায়া হয় তখন। আহা, জানার কত তৃষ্ণা ওদের, কেবল ধমক খাওয়ার ভয়ে কোনোদিন কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। যা হোক, ওদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কখনো থমকে যাননি তিনি। যেমন – এ-মুহূর্তে যে-বেয়াড়া প্রশ্নটি করে বসল তাঁর মন, ছাত্ররা কেউ এ প্রশ্নটি করলে তিনি বিপাকে পড়তেন। তিনি নিজেই তো জানেন না এ প্রশ্নের উত্তর এবং নিজেও প্রশ্নটি বয়ে বেড়াচ্ছেন বহুকাল ধরে। সত্যিই তো, যাওয়ার কোনো সিরিয়াল নাই কেন? কী এমন ক্ষতি হতো যদি বয়স্করা আগে যেত, যেমন করে তাঁরা আগেই এসেছিল এই জগতে? কেন কেউ কেউ দীর্ঘ সময় বরাদ্দ পায় এই অপূর্ব সৃষ্টিজগতের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগের, আর কেউ কেউ পায় অতি অল্প সময়? কেন কাউকে কাউকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় পূর্ণ চোখে তাকাবার আগেই? এসব প্রশ্ন তিনি কাকে করবেন? সৃষ্টিকর্তাকে? তিনি তো চিরনিরুত্তর। সারাজীবন ধরে আজিজুল হক কত যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তাঁর উদ্দেশ্যে, তিনি তো কোনো উত্তরই দিলেন না কখনো।               এ-প্রশ্নেরইবা উত্তর দেবেন কেন? মনের কাছ থেকে নিজের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার বদলে উল্টো এসব বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে তিনি এবার চোখের কাছে উত্তর শুনতে চান।

চোখ বলে, আমি তো কাঁদি না, কাঁদে মন – আমি তার প্রকাশ করি মাত্র। মন না কাঁদলে কি আর আমি ভিজে উঠতে পারি? আমি তো নিমিত্তমাত্র, মনের প্রকাশমাধ্যম, ঠিক যেমন করে তিনি প্রকাশিত হন তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে।

সত্যি কি তিনি তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন? যদি তাই হয়, তাহলে প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কি তাঁরও একবার করে মৃত্যু ঘটে না?

এ-প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি সামান্য চোখ, এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাধ্যি আমার নেই।

তিনি তখন মনকেই জিজ্ঞেস করেন আবার। মন বলে – না, রূপান্তর ঘটে তাঁর। শূন্য থেকে দৃশ্যমান হন তিনি তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে, এটা একবার রূপান্তর, আর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে দিয়ে তাঁর দ্বিতীয় রূপান্তর ঘটে, শূন্য থেকে এসে শূন্যে মিলিয়ে যান।

যদি তাই হয়, সে আবার মনকে প্রশ্ন করে – যদি সবই তাঁর রূপান্তরের খেলা হয়, যদি নিজেই এসে নিজেকেই ফিরিয়ে নেন নিজেরই ইচ্ছেমতো, তাহলে তুমি কাঁদো কেন?

কাঁদি, কারণ, এ-পৃথিবীতে তাঁর যে রূপান্তর ঘটে, যেসব সত্তায় তিনি বিভাজিত করেন নিজেকে, তার প্রতিটি স্বতন্ত্র, অনন্য এবং স্বাধীন। যেমন এই জগৎ তাঁর সৃজন নৈপুণ্যর অপূর্ব নিদর্শন, বলা যায় – নিজেকেই সৃজন করেছেন তিনি দৃশ্যমান রূপে, সেই অনিন্দ্যসুন্দর পৃথিবীর রূপ দেখা থেকে বঞ্চিত হলো একজন, অতি অল্প বয়সেই, মিলিয়ে গেল শূন্যে। ওখানে তো শূন্যতা ছাড়া কিছু নাই, এই এতটুকুন একটা ছেলে ওখানে গিয়ে কী করবে? নাও নাও হয়েছে, অনেক প্রশ্ন করেছ, এবার কাজ করো।

কিন্তু আজিজুল হকের কাজ করতে ইচ্ছে করছে না; বরং মনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেই ভালো লাগছে। ভাগ্যিস এসব আলাপ কেউ শুনতে পায় না, মনের সঙ্গে কথাবার্তা যা হয় তা মনেই রখেন, বাইরে আনেন না সচরাচর, ফলে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না – একা একা গম্ভীরভাবে কী এত ভাবছেন তিনি! এই যে এখন, যারা কবর খুঁড়ছে তারাও জানতে পারছে না কিছুই, আজিজুল হক ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন, কখনোবা দু-একটা নির্দেশনা দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁর ভেতরে কী ঘটে চলেছে তার আন্দাজ করাও কারো পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি পেশাদার গোরখোদক নন, এ তাঁর কাজও নয়, তবু কত যে কবর বানালেন তিনি জীবনভর, তার হিসাব নেই। সেই যে যুদ্ধের সময় দেখেছিলেন, কী যে এক অদ্ভুত যুদ্ধ লাগল দেশে – শুধু লাশ আর লাশ; তখন বর্ষাকাল, মাঠঘাট ডুবে আছে, গোরস্তানও পানির নিচে, তিনি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতেন – নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য লাশ, শত শত লাশ, হাজার হাজার লাশ; কোনো কোনোটা নদী থেকে ঢুকে পড়ছে খালে, খাল থেকে ঢুকে পড়ছে গ্রামের ভেতর; নদীতে লাশ, খালে লাশ, মাঠের পানিতে লাশ; নারীর লাশ, পুরুষের লাশ, শিশুর লাশ, বৃদ্ধের লাশ – এত লাশ দেখতে দেখতে তার চোখ অন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। মন কাঁদত, বুকের ভেতর পুড়ত; মনে হতো, আহা, না জানি কার স্বজন ভেসে যায় জলে, ঘুমানোর জন্য শেষ ঠিকানাটুকুও পেল না! সেই থেকে, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে, এই এতগুলো বছর ধরে তিনি কবর তৈরি করে এসেছেন। এখন বেলা পড়ে এসেছে, নিজেরই যাবার সময় হয়ে এলো প্রায়, তবু কারো মৃত্যুর খবর পেলে নিজে থেকেই এগিয়ে আসেন, মৃতের ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। মনে হয়, মানুষটি সারাজীবন কতই না কষ্ট পেয়েছে, এবার শান্তিমতো ঘুমানোর সুযোগ পাবে, শেষ শোবার ঘরটি আরামের হওয়া দরকার। খুব যত্ন করে সেই ঘর নির্মাণ করেন তিনি, লোকে জানে সে-কথা, আর কামনা করে – তাদের মৃত্যুর পরও যেন কবরটি আজিজুল হকের তত্ত্বাবধানেই তৈরি করা হয়। তিনি নিজেও মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার কথা জানেন, কী করে এই অন্তিম আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করবেন? এখন আর পেশিতে শক্তি নেই, নিজে কোদাল চালাতে পারেন না, ওগুলো করে অন্য লোকেরা, তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দেন, আর কবর খোঁড়া শেষ হলে নিজে নেমে পড়েন সেখানে, হাত দিয়ে মাটি সমান করে এবড়ো-খেবড়ো ভাবটা সরান, আরো কী কী যেন করেন, এই কাজটি করার সময় তিনি কারো সহযোগিতা নেন না, নিবিষ্ট মনে চুপচাপ একা একা কাজ করেন, ফলে ঠিক বোঝা যায় না যে তিনি আসলে কী করেন, কিন্তু কাজ শেষ হলে দেখা যায় – পরিপাটি এক মাটির ঘর তৈরি করেছেন তিনি, যেন সযত্নে রচিত শয্যা উপহার দিচ্ছেন মৃত মানুষটিকে। কেউ তাঁর এই অতি যত্নে কবর রচনার কারণটি বুঝতে পারেন না, শুধু তিনি নিজে ভাবেন, আপনমনে – সারাজীবনে কিছুই করিনি, ওপারে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াবার মতো কিছুই সঞ্চয় করতে পারিনি, তবু এটুকু বলতে পারব – তোমার বান্দাদের জন্য কবর বানিয়েছি যত্ন করে, এছাড়া আর কিছুই করিনি, তুমি যা দেবার দাও। শাস্তি দেবার হলে দাও, পুরস্কার দিতে চাইলে দাও। আমার আপত্তি নেই।

এত কবর খুঁড়েছেন আজিজুল হক, এতকাল ধরে, কিন্তু কখনো এমন হাত থেমে যায়নি। সহযোগীদের ওপর নির্ভর করতে পারেন না তিনি। মনে হয়, মানুষের শেষ ঠিকানার মর্যাদা ওরা বোঝে না। শহরের মতো এখানে তো আর সব পয়সা দিয়ে কেনা যায় না, এখানে সমাজ আছে, সমাজের মানুষ আছে, তারাই নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসে। কিন্তু সবাই কি আর সবকিছু বোঝে? কবর মানে যে কেবল একটা চারকোনা গর্ত নয়, এটাই তো বোঝে না অনেকে। কেবল খুঁড়লেই হলো? কেবল কাফন পরিয়ে শুইয়ে দিলেই হলো? যেখানে কেয়ামত পর্যন্ত শুয়ে থাকবে একজন মানুষ, সেই ঘর এত হেলাফেলা করে বানানো যায়? কত সময় দরকার, কত যত্ন! কিন্তু আজকে কী করে এই কাজ শেষ করবেন তিনি? হাত যে আর চলছে না! মন কাঁদছে, চোখ কাঁদছে, আর তাদের সঙ্গে হাতও অচল হয়ে পড়ছে। কেন হচ্ছে এমন? যে-ছেলেটি চলে গেল আজ, রাতুল তার নাম – সে তো তার কেউ নয়। মানে রক্তের সম্পর্ক নেই আর কি, যদিও একই গ্রামের বাসিন্দা বলে সেই জন্ম থেকেই চেনেন। গ্রামে থাকত না সে, মা-বাপের সঙ্গে শহরেই বসবাস ছিল, মাঝেমাঝে কেবল বেড়াতে আসা। অবশ্য বেড়াতে এলেও ঘর থেকে বেরুতে পারত না ছেলেটি। কী যেন এক রোগ হয়েছিল ছোটবেলাতেই, ধীরে ধীরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছিল তাকে। কী যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা পেয়েছে, তবু চিরকাল তার হাসিমুখ, আজিজুল হক কোনোদিন তাকে বিষণ্ণ হতে দেখেননি। ‘কেমন আছো বাবা?’ জিজ্ঞেস করলে মিষ্টি হেসে উত্তর দিত – ‘ভালো আছি চাচা, আপনি কেমন আছেন?’ আজিজুল হক ভাবতেন, এত কষ্ট নিয়ে কত সহজেই না ছেলেটি ভালো থাকার কথা বলে অথচ আমরা ভালো থাকলেও সহজে তা স্বীকার করতে চাই না। তিনি একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি যে সবসময় বলো বাবা, ভালো আছো, তোমার যে এত কঠিন অসুখ, কষ্ট হয় না?’ সে বলেছিল, ‘কষ্ট তো একটু হয় চাচা, কিন্তু আমার চেয়েও কষ্টে আছে কত মানুষ! আপনারা সবাই আমার কত যত্ন নেন, আদর করেন, ভালোবাসেন, কত মানুষ তো সারাজীবনেও একটু ভালোবাসা পায় না। তাদের তুলনায় আমি কত ভালো আছি!’ এই উত্তর শুনে আজিজুল হক সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন, মানুষ যে জিনিসটি সারাজীবন সাধনা করেও পায় না, এই ছেলেটি এই বয়সেই সেটি অর্জন করে ফেলেছে। অভিযোগহীনতা। ওর কোনো অভিযোগই নেই।

রাতুলের সত্যিই কোনো অভিযোগ-অভিমান ছিল না। আর অভিযোগ করবেইবা কার কাছে? ছোটবেলায় রোগটি ধরা পড়ার পর এবং সেটি যে নিরাময়যোগ্য নয় তা জানার পর তার এক ধরনের অবুঝ অভিমান হতো! কেন তাকেই বেছে নেওয়া হলো, কেন তাকেই যাপন করে যেতে হবে রোগ-জর্জরিত জীবন, কেন বিরল রোগটি তার শরীরেই এসে বাসা বাঁধল – এসব প্রশ্ন ছুড়ে দিত চির-অচেনা ঈশ্বরের দিকে। কিন্তু যখন বুঝতে শিখল, ঈশ্বর শুধু চির-অচেনাই নন, চির-নিরুত্তরও, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি বাধ্য নন, দেনও না, নিজের কর্মকান্ডের জন্য জবাবদিহি করার কোনো দায়ও তাঁর নেই, তখন থেকে প্রশ্ন করাও ছেড়ে দিয়েছিল। আর এই অসুখের জন্য চারপাশের মানুষেরও তো কোনো দোষ নেই। মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালারা তো যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন তাকে একটু ভালো রাখার জন্য, কখনো এতটুকু বিরক্ত হননি, কখনো তাকে বুঝতে দেননি যে, সে একটা বোঝা হয়ে বসে আছে সবার ওপর। কিন্তু সে নিজে তো বুঝত, মনে হতো সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এবার যাওয়া দরকার। মনে হতো, অনেকগুলো বছর ধরে বোঝা হয়ে চেপে বসে আছি, আর কত, আর কত নিজেকে ছোট করা যায়, আর কত অন্যের কষ্টের কারণ হওয়া যায়? কিন্তু এখন, অসময়ে চলে এসে তার খারাপ লাগছে। মায়ের আর্তনাদ, স্বজনদের কান্না, আর এই বুড়ো লোকটার কান্নাভেজা চোখ দেখে মনে হচ্ছে – এত তাড়াতাড়ি না এলেও পারতাম! ভেবেছিল খুব সহজ হবে এই চলে আসা, সেটা হলো না। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, ওপার থেকে সে কেবল এসবকিছু চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, কিছু বলার সুযোগ নেই তার।

আজিজুল হকের এসব কথা জানার কথা নয়, তবু কেন এত কষ্ট হচ্ছে? নাকি অন্যকিছু মনে পড়ছে? যেসব কথা তিনি কিছুতেই মনে করতে চান না, তেমন কিছু? সেই যে যুদ্ধের সময়, তাঁর বয়স তখন কুড়ি পেরিয়েছে, তবু তিনি যুদ্ধে গেলেন না, কিন্তু তিন বছরের ছোট ভাইটা – শহীদুল হক, চলে গেল। তিনি ছিলেন ভীতু, বড় ভয় হতো ওইসব ভয়াল-দর্শন অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাগুলির শব্দ। শহীদ তখন ঢাকা কলেজে পড়ছে। পঁচিশে মার্চের রাতে আর তার পরের দিন ঢাকার বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ তাকে দেখতে হয়েছিল খুব কাছ থেকে। তারপর সুযোগ বুঝে কোনোক্রমে পালিয়ে বাড়িতে আসতে পেরেছিল। এসে কিছুদিন গুম হয়ে বসে রইল শহীদ। কারো সঙ্গে কথা বলত না, চোখে এক ধরনের অনিশ্চিত ভয় আর উদাসীনতা, কখনোবা যেন ধক ধক করে জ্বলত সেই চোখ। তারপর বলা নেই, কওয়া নেই একদিন পালাল বাড়ি থেকে। কয়েক মাস পর আরেকবার ফিরেছিল সবার সঙ্গে দেখা করার জন্য। ততদিনে সে পুরোদস্ত্তর যোদ্ধা। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েই গেল শহীদ। সেই যে গেল আর ফিরল না। যুদ্ধশেষে সবাই ওর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই অনিশ্চিত অপেক্ষার দিনগুলো, যেন একেকটা দিন একেকটা যুগের সমান আর ফুরোতেই চায় না। ও ফিরল না, মাস কয়েক পর ওর কয়েকজন সহযোদ্ধা এসে খবর দিয়েছিল। বাড়ি পর্যন্ত আসেনি ওরা, লোক পাঠিয়ে আজিজুল হককে ডেকে নিয়েছিল বাজারে, তারপর খবরটি জানিয়েছিল। শহীদ ধরা পড়েছিল আর্মিদের হাতে, নির্মম অত্যাচার করা হয়েছিল ওর ওপর, তবু সে কোনোকিছু স্বীকার করেনি, সহযোদ্ধাদের ব্যাপারে কোনো তথ্যই তার কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি পাকিস্তানিরা। ওরা বলেছিল, ‘আমরা এ-খবর মাকে দিতে পারব না, তাই বাড়িতে গেলাম না। আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন, ওকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।’

আজিজুল হক কেবল জানতে চেয়েছিলেন – ওর কবরটা কোথায়?

কবর দেব কীভাবে? ওর লাশ আমরা পাইনি তো!

আজিজুল হক এ খবর মা-বাবাকে দেননি। মা অপেক্ষা করতেন, কাঁদতেন, কাঁদতে কাঁদতে এক সময় অন্ধ হয়ে গেলেন। তবু তিনি বলেননি। ওরকম বিভীষিকাময় মৃত্যুসংবাদ শোনার চেয়ে এই অপেক্ষা ভালো, কান্না ভালো, অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো। বাবা বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছিলেন, তিনি এতই চুপ করে থাকতেন যে মনে হতো, বোবা হয়ে গেছেন। এই মৃত্যুর ভার আজিজুল হক একা বহন করেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই রাতুল ছেলেটি দেখতে হুবহু শহীদের মতো। কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই এরকম দুজন মানুষের মধ্যে এতটা মিল থাকতে পারে? আজিজুল হকের মনে হতো, তার ভাইটা পুনর্জন্ম নিয়ে আরেক বাড়িতে এসেছে। ওকে দেখলে মন শান্ত হতো, চোখ জুড়িয়ে যেত। সেই ছেলেটিও চলে গেল অসময়ে। না, ওসব কথা আর মনে করতে চান না আজিজুল হক। যন্ত্রণা হয়, বড় যন্ত্রণা। তিনি তাই কাজে মন দেন। কবর খোঁড়া শেষ হয়ে গেছে দেখে নেমে পড়েন সেখানে। দু-হাত দিয়ে চারপাশের মাটি লেপ্টে দিয়ে নিখুঁত-সমান করে দেন, তারপর মেঝেটি, যেখানে শুয়ে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে থাকবে শিশুর মতো নিষ্পাপ ছেলেটি। বারবার ফিরে দেখেন – কোথাও কোনো খুঁত রয়ে গেছে কিনা, কোথাও মাটি এবড়ো-থেবড়ো হয়ে আছে কিনা। না নেই। কবর থেকে উঠে এসে নিজের বাগানে যান তিনি। ঝুড়িভর্তি করে বেলি, টগর আর শিউলি ফুল তোলেন, তারপর ফিরে এসে আবার কবরে নামেন। গভীর মমতায় পুরো কবরটি ফুলে ফুলে সাজিয়ে দেন আজিজুল হক।

মুর্দার গোসল-জানাজা শেষে লাশ আসে গোরস্তানে। তার স্বজনরা অবাক বিস্ময়ে দ্যাখে – অপূর্ব সুন্দর এক ফুলের ঘর তৈরি করেছেন আজিজুল হক। যেন কবর নয়, এ তার বাসরঘর। কবরটি ঠিক সাধারণও নয়। সাধারণত কবর হয় চৌকোনা-আয়তক্ষেত্রাকার। ওপর থেকে দেখলে এটিকেও সেরকমই মনে হয়, কিন্তু শয্যার দিকে তাকালে বিশেষত্বটি চোখে পড়ে। পশ্চিমদিকে, মানে যেদিকে মুখ করে শোয়ানো হবে মুর্দাকে, আরো অনেকখানি জায়গা ভেতরের দিকে কাটা হয়েছে। দেখে মনে হয়, ওদিকে একটা বারান্দা। ফুল দিয়ে সাজানো সেই অংশটিও। কেউ এমন অভূতপূর্ব কবরের মানে বুঝতে পরে না। পারবে কীভাবে? কেউ তো আর আজিজুল হকের মন পড়তে পারছে না। তার মনের ভেতরে গেঁথে আছে একটা শিশুর মুখ, কবর দিয়ে সবাই যখন চল্লিশ কদম দূরে সরে আসবে আর ফেরেশতারা এসে জাগাবে তাকে, তখন যেন জেগেই সে দ্যাখে, সে শুয়ে আছে ফুলের বিছানায়। যেন তার মনে না হয় যে এটা কবর, যেন নিজের ঘরের মতোই লাগে। যেন সেই ফুলশোভিত ঘর দেখে তার মুখ হাসিতে ভরে যায় আর সেই হাসি দেখে ফেরেশতারা যেন প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। আর প্রশ্ন করলেইবা কি? যত প্রশ্নই করুক, সেগুলোর উত্তর দেওয়া তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করেনি, কোনো দাগ তার মনে পড়েনি, যে রূপে এসেছিল এই ধরাধামে সেই মন নিয়েই ফিরে গেছে সে। বিশুদ্ধ, নির্মল মন। পরম করুণাময় তো মানুষের মনটাই দেখেন, অন্যকিছু নয়। ফেরেশতারা এরকম এক শিশুকে কীইবা প্রশ্ন করবেন?

ওপার থেকে নিজের জন্য রচিত এই অপূর্ব ফুলশয্যা দেখে রাতুলের চোখে জল আসে, ভাবে – পৃথিবীর মানুষের মনে কেন এত মায়া? কেন এত ভালোবাসা? আমি তো কোনো কাজেই লাগিনি কোনো মানুষের, তবু কেন এত গভীর মমতার বন্ধনে আমাকে ধরে রাখতে চান তারা? এত মায়া ছেড়ে আমি যাই কীভাবে?

রাতুলকে কবরে শুইয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়ে রীতি অনুযায়ী মসজিদের ইমাম সাহেব হাত তোলেন মোনাজাতের জন্য। আর তখনই ঝমঝমিয়ে নেমে আসে বৃষ্টি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়তো কারোরই মন চাইছে না, ইমাম সাহেব তাই দ্রুত মোনাজাত শেষ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে ওঠে আজিজুল হকের কণ্ঠ, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন তিনি, আকুল হয়ে বলেন – হে দয়াময়, হে পাক পরোয়ারদিগার,  তুমি আমাদের সবার চেয়ে ভালো জানো, তুমি নিশ্চয়ই জানো, তবু আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, কারণ তুমি বান্দাদের সাক্ষ্য পেতে পছন্দ করো, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি – যে-বান্দা আজ তোমার কাছে চলে গেল, সে-যুবক শরীরে বয়ে বেড়াত শিশুর মতো মন। তুমিই তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, শিশুদের কোনো বিচার করা হবে না। তোমার এই বান্দারও কোনো বিচার করো না, খোদা। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি হে পরম করুণাময়, সাক্ষ্য দিচ্ছে এই আকাশ-বাতাস, হে দয়াময়, দ্যাখো আকাশ থেকে তোমার করুণাধারা নামছে বৃষ্টির রূপে, দ্যাখো আকাশ কাঁদছে, বাতাস কাঁদছে, বৃক্ষরাজি কাঁদছে, কারণ তারাও এই পৃথিবীরই অংশ, তোমার প্রিয় বান্দা এই পৃথিবী থেকে আজ চলে গেল সেই শোকে কাঁদছে তারা, কেঁদে কেঁদে সাক্ষ্য দিচ্ছে। ও দয়াময়, এই সাক্ষ্য তুমি গ্রহণ করো, খোদা, এই নিষ্পাপ শিশুটির উছিলায় আমাদের মতো পাপী বান্দাদের তুমি পার করে নিয়ো, খোদা, আমার শহীদকে তুমি পার করে নিয়ো…।