সাঙ্গ হলো প্রাণের খেলা

রামেন্দু মজুমদার

শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশাল আসরে অতিথি হিসেবে তাঁর নির্ধারিত বক্তৃতায় এদেশে সংগীত ও চিত্রকলার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে চুম্বক কথাগুলো বলে তিনি নিজের আসনে ফিরে গেলেন। পরবর্তী বক্তার কথা শুরু করার আগে তিনি হঠাৎ আবার উঠে এলেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘একটা কথা বলতে আমি ভুলে গেছি।’ কিন্তু বলা হলো না সে-কথা। অকস্মাৎ পেছনের দিকে ঢলে পড়লেন। হাজার হাজার শ্রোতা হতবিহবল। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়েছে। যখন বেদনায় কাতর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সংগীতের আসরে কাইয়ুম চৌধুরীর চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, তখন সমবেত শ্রোতৃমন্ডলী সমস্বরে হাহাকার করে উঠলেন।

কী কথা বলতে চেয়েছিলেন তিনি? আমরা কেবল অনুমানই করতে পারি, জানতে পারব না আর কোনোদিন।

অবিশ্বাস্য এ চলে যাওয়া। এমন গৌরবের মৃত্যু খুব কম মানুষের ভাগ্যে ঘটে। কোনো কষ্ট পেলেন না, কাউকে কষ্ট দিলেন না, হঠাৎই জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন। তবে তাঁর স্বজনের পক্ষে, আমাদের মতো তাঁর গুণগ্রাহীদের পক্ষে এ-মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। ৮২ বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন, তবু মনে হয় এ অকালমৃত্যু। কাইয়ুম চৌধুরীর মতো মানুষদের অনেক বেশিদিন বেঁচে থাকা প্রয়োজন দেশের জন্যে, আমাদের জন্যে।

চিত্রশিল্পের বাইরে সংস্কৃতির যে-মাধ্যমের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা, তা হচ্ছে সংগীত। সংগীতানুরাগী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে যে-রেকর্ড সংগ্রহ আছে, তা ঈর্ষণীয়। এমনই ভাগ্য তাঁর, যে-সংগীত ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, সে-সংগীতের মহাআয়োজনে অজস্র সংগীতপিপাসুর সান্নিধ্যেই তিনি চিরবিদায় নিলেন। আজীবন সুন্দরের সাধনা করেছিলেন বলেই হয়তো এমন সুন্দর পরিবেশে চলে যেতে পেরেছেন। বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের সব দিনই অনেক রাত অবধি তিনি গান শুনেছেন। যাওয়ার দিন তাঁর বক্তৃতায়ও ঢাকায় উচ্চাঙ্গসংগীত আয়োজনের ইতিহাস কী চমৎকারভাবেই তিনি শুনিয়েছিলেন। সংগীতের ওপর তাঁর লেখাপড়া ছিল, সংগীতের সত্যিকার সমঝদার ছিলেন তিনি। শ্রোতার আসর থেকে যখন দীর্ঘবাদনের রেকর্ড প্রকাশিত হলো, তাঁর প্রাণের স্পর্শ ছিল বলেই হয়তো তিনি সেগুলোর এত দৃষ্টিনন্দন কভার ডিজাইন করতে পেরেছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতির কী আধুনিক উপস্থাপনা।

কাইয়ুম চৌধুরীর আসন ছিল আমাদের সংস্কৃতির ভুবনজোড়া। চিত্রকর হিসেবে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছেছিলেন, তা তো আমরা সকলেই মানি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যখন ঢাকায় প্রথম আর্ট স্কুল স্থাপন করেন, তার প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন মুর্তজা বশীর ও রশিদ চৌধুরী – যাঁরা পরবর্তীকালে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। কাইয়ুম চৌধুরীর তুলিতে বাংলার নিসর্গ নতুন রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশকে ভালো না বাসলে ছবি আঁকা যায় না।’

আমাদের যাপিত জীবনের সকল অনুষঙ্গকে তিনি তাঁর চিত্রমালায় স্থান দিয়েছেন। লোকশিল্পের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। আমাদের লোকসংস্কৃতির মোটিফগুলো নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল, লোকঐতিহ্যের মধ্যেই রয়েছে আমাদের শিল্পের শেকড়। গ্রামীণ জীবনের, পল্লি প্রকৃতির এমন দৃষ্টিনন্দন প্রকাশ তাঁর শিল্পকর্মের বাইরে খুব কমই চোখে পড়ে। জলরং, তেলরং, রেখাচিত্র – সবক্ষেত্রে তিনি অনন্য। তাঁর লেটারিং বা রেখাচিত্র কিংবা পেইন্টিং দেখলে যে-কেউ বলে দিতে পারত এটা কাইয়ুম চৌধুরীর করা। তিনি তাঁর একটা নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

আমাদের প্রকাশনা সৌকর্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে কাইয়ুম চৌধুরীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুরুর দিকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি গ্রন্থের প্রচ্ছদ ডিজাইন ও অঙ্গসজ্জায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মোটিফ নিয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ তিনিই উপহার দিয়েছিলেন। তবে সবকিছুর মধ্যেই একটা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। সেই ১৯৫০ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অজস্র গ্রন্থের সাড়াজাগানো প্রচ্ছদ করেছেন তিনি। পত্রপত্রিকার অলংকরণে তাঁর জুড়ি ছিল না। কেবল বাংলা একাডেমির জন্যেই তিনি ৩০০-রও বেশি গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আমার একটি অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। অনেক বছর আগে থিয়েটার থেকে আমরা আনিসুজ্জামানের মুনীর চৌধুরী গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলাম। সে-বইয়ের প্রচ্ছদ করতে দিয়েছিলাম কাইয়ুম চৌধুরীকে। প্রায় ছয়মাস ধরে তাঁকে তাগাদা দিয়েও কোনোমতেই কাজ আদায় করতে পারছিলাম না। শেষে একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘কাইয়ুমভাই আপনি যত বড় শিল্পীই হোন না কেন, আমি জীবনে আর কোনোদিন আপনার কাছে প্রচ্ছদ আঁকাবার জন্যে আসব না।’ তিনি আমার কথায় রাগ না হয়ে দুদিন পর আসতে বললেন। শেষ পর্যন্ত যখন প্রচ্ছদটি হাতে পেলাম, তখন আমার সব রাগ-অভিমান দূর হয়ে গেল। মুনীর চৌধুরী-উদ্ভাবিত মুনীর অপটিমা টাইপরাইটারে নামপত্র টাইপ করে অসাধারণ একটি প্রচ্ছদ করেছিলেন তিনি এবং সে-বছর বইটি গ্রন্থ সৌকর্যের জন্যে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেছিল।

এ-দেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছিল তাঁর গভীর সম্পৃক্ততা। আন্দোলন হোক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তাঁর হাতে-করা পোস্টার হয়ে উঠত একটা মূল্যবান শিল্পকর্ম। আমরা যখনই তাঁর কাছে এসব কাজের অনুরোধ নিয়ে গিয়েছি, সানন্দে তিনি তা করে দিয়েছেন। এটি ছিল এসব আন্দোলন বা কাজে তাঁর অংশগ্রহণ। ছবি আঁকার পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন মাঝেমধ্যে। আগে তিনি একেবারেই বক্তৃতা করতে চাইতেন না। শেষের দিকে সবার অনুরোধে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে চমৎকার কথা বলতেন।

মানুষ হিসেবে কাইয়ুমভাই যে কত বড় মাপের ছিলেন, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ তা অনুমান করতে পারবেন না। বিনয়, নিজেকে জাহির না করা, সকলের সঙ্গে সহজে মেশা এবং কখনো কারো নিন্দা না করা বা কটুকথা না বলা – তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির অন্যতম। ছোট-বড় নির্বিশেষে এমন বন্ধুবৎসল মানুষ খুব কমই দেখা যায়।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কণ্ঠশীলনের ভাগাভাগি নিয়ে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কারো কারো ব্যবহারে তিনি খুব অপমানিত বোধ করেছিলেন। আমরা কেন ভুলে যাই, কাইয়ুম চৌধুরীর মতো মানুষরা সংগঠনের চাইতেও বড় প্রতিষ্ঠান। তিনি আমাকে ফোন করে তাঁর বেদনার কথা বলতেন, আমার পরামর্শ চাইতেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, কণ্ঠশীলন থেকে সরে আসতে। তাঁর জবাব ছিল, সরে আসবেন – তবে তাঁর নেতৃত্বাধীন কণ্ঠশীলনকে একটা সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে দিয়ে, কারণ ওয়াহিদুল হক তাঁর হাতে সংগঠনটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন।

মাঝে মাঝে ঢাকা ক্লাবে এসে কতক বন্ধুজনের সঙ্গে সময় কাটাতে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। বেশিরভাগ সময়েই বন্ধুবর আবুল হাসনাতকে ফোন করে একসঙ্গে ক্লাবে যেতেন। কবি স্থপতি রবিউল হুসাইনও থাকতেন। কখনো আমি গিয়ে উপস্থিত হতাম। এঁদের সঙ্গ যে এত উপভোগ করতাম, তা বলার নয়। তাঁর মতো গুণী শিল্পীকে সদস্য হিসেবে পাওয়া ছিল ঢাকা ক্লাবের অহংকার।

কাইয়ুমভাই নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে এবং আমাদের স্মৃতিতে। কাইয়ুমভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, আনন্দে থাকুন – এটাই প্রার্থনা করি।