সাতাশিটা বছর পার ক’রে দিয়ে আমার বাবা

ভূমেন্দ্র গুহ
সাতাশিটা বছর পার ক’রে দিয়ে
সে-সব বছরের সকল সকালবেলাকে পাখির কিচির-মিচিরে ভরাট ক’রে তুলে
আমার বাবা মাত্রই তাঁর সাতাশিটা বছরের সাতাশিটা শীতের ডালপালা
রূপকথার সূর্যেরও চেয়ে পুরনো আর-এক রূপকথার দিকে এক্ষুনি বাড়িয়ে দিলেন।
বড়ো উঠোনের সামনে সরু রাস্তা, তার পাশে ছোটো পুকুর
তার বাঁ দিকের মুখোমুখি ঘন হিজল-বনের মন-কেমন-করার আড়ালে দাঁড়িয়ে
তাঁর যে ছোটো সমাধি-মন্দিরটি
শ্যাওলায় শুকনো পাতায় ধুলো-বালিতে অনাচারী গাছের শিকড়-বাকড়ে
মুছে রয়েছে, চোখের সামনেই সুখী নতুন বছরের নম্র রোদে
তা পালিশ হয়ে ঝকঝকে হয়ে উঠল ব’লে মনে পড়ল কত বার তাঁর
নড়বড়ে পা, সেই পায়ের ধ্বনি, এই পথ কেটে গিয়েছে,
কোনো-না-কোনো শ্মশান-ঢিবির তলা থেকে তিনি ফিরে এসেছেন।

অনেক – অনেক দিন আমার বাবা বাড়ির বার হন নি।
ছেলেপিলেদের একটা দঙ্গল শুধু ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছে
গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বস্তিতে, সে সবের রাজনীতি, স্লোগান মিছে কথা প্রতিশ্র“তি
কখনো-কখনো আমার যে-মা আজ কত বছর-যে খোলা জানালার দিকে মুখ ক’রে
ব’সে আছেন তাঁর বিছানায়, তাঁর কাছে বলাবলি করেন খাটের পাশের
একাকী বেতের-মোড়াটায় ব’সে থেকে; আর আজকে, তাঁর সেই বিখ্যাত
বেতের-লাঠিটায় ভর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমার বাবা পরিপূর্ণভাবে অজ্ঞাত, ভঙ্গুর;
যখন মরতে মরতে বেঁচে ছিলেন, তখন – সেই বছরগুলিতে – তাঁর লাঠিটা
যে-সব শব্দ করত তার ডগায়, তারা হয়তো-বা মিথ্যে ছিল না, সত্য ছিল, সুশ্রাব্য ছিল।

আমার বাবা হলেন একজন পূর্বাভাস আবহাওয়ার, অন্যমনস্কভাবে তিনি
রাস্তার থেকে খুঁটে-খুঁটে তোলেন স্মারক সব পদার্থ অথবা দেহাবশেষ,
বহন ক’রে বেড়ান আদিম কোনো-কোনো প্রতœ রতœ অথবা ঠিকুজি।
স্মৃতি, স্মৃতিবাহিত কত-যে গল্প অথবা উপদেশ –
যে-সকল ভোর শান্তি – শান্তির মতন – তারা তাঁর
সঙ্গে-সঙ্গে থেকে যায় সাদা পাখির সাদা পাখার দাক্ষিণ্যের উপর ভর ক’রে।

আজকের দিনটা একটা চিরকালীন দিনের মতন, অকৃত্রিম দিন,
ছেলেমানুষের মতন সরল,
সমবেত গানে মুখর, গায়কে-গায়কীতে ভরপুর;
সাদা পায়রার দল মুকুট হয়ে বসেছে এসে সময়ের ডগায়,
মাসটা তো জানুয়ারি, শীত – তবু গান, পুব দেশের মনীষী, ভেড়ার-খোঁয়াড়ের গান,
যে-সব ফুল ফুটবেই, তারা ফুটবেই; তোমার খঞ্জ ভালোবাসা
ক্ষীণ শব্দের উপর ভর ক’রে পেরিয়ে যাচ্ছে ঘরের-মুখের দ্বীপচর, তার পরে নদী,
তার পরে আকাশ অর্থাৎ আকাশের ও-পারের যে-আকাশ।
এবং যদিও তুমি তোমার চারপাশের বাচ্চাগুলির দিকে তাকিয়ে হেসে উঠবে
এবং সারাটা স্থান-কালের ভিতরে জয়দৃপ্ত অস্থিরতা ফেটে পড়বে।

এমন-কি যদিও বছরটা নতুন বছরই, তবু মাংসের-পকৌড়াওয়ালারা, ঝালমুড়িওয়ালারা
থাকবে রাস্তায় ডালা সাজিয়ে আমাদের শহরের, যা প্রায় একটা গ্রাম,
এবং আমার ক্ষুধাও থাকবে পেটে, সেই অন্ধ গান-গাইয়ে লোকটার যেমন থাকে –
তার সঙ্গে কথা বলত তো আমার টাটকা একটা ইসকুলের-ছেলের
বর্ণ-পরিচয়’এর অ আ ক খ বিন্দু-বিসর্গ, এবং মা’এর আদরে বেড়ে ওঠা
আমার গাব্দা-গোব্দা নিষ্পাপ ও নিরপরাধ,
এবং যখন সকালবেলাটা করুণায় থই-থই করতে থাকে,
সময়ের বুকের ভিতর থেকে উথলে ওঠে প্রেম –
যা আসলে বহুবিধ নিরধিকার আত্মস্থ ক’রে নেওয়ার সনির্বন্ধতা ছাড়া আর কিছু নয় –
তোমার বহুবাচনিক ও বহুমানবিক ও বহুমাত্রিক শব্দগুলির গায়ে তখন পাখা জুড়ে যায়,
তারা উড়তে থাকে – উড়তে থাকে –
তোমার অস্তিত্বের ছেঁড়া-খোঁড়া সুতোর অণু-পরমাণু উড়তে থাকে বাতাসে
সাদা পাখির সাদা পাখার সাদা পালকে ভর ক’রে,
আমার দাক্ষিণ্যের বোনের পাখার পালকের সাদায়, পিতঃ, আমার পিতা।