সালামতের সমস্যা

আটত্রিশ বছর আগে ঢাকার তখনো সেকেলে চেহারা, ওই জংধরা সময়ে হালকা গড়নের আটপৌরে জীবনের নিরীহ সালামতের সঙ্গে আমার পরিচয় ধীরে ধীরে জমাট হয়। বয়সে আমার চেয়ে খানিক বড় হলেও সে কিছুতেই তা মেনে নিতে রাজি না। অনিচ্ছায় আমি তাকে নাম ধরে ডাকি, সালামত আমাকে দাদা বলে। এই সালামতকে কাজ দেওয়ার পর তাকে একাধিকবার পইপই বোঝাতে হতো। কোনো কাজে পুরো সে পটু নয় – আধাআধি পারলেই খুশি। আমরাও কম বেতনের এমন মানুষ দিয়ে চলে যাচ্ছে ভেবে যে যার চেয়ারে অলসতা উদ্যাপন করি। তার ঢিলেঢালা চলাচল, অহেতুক বাইরে সময় খরচে বিরক্ত হলেও কোনো রুঠো কথা তাকে বলি না। মুখে অসন্তোষের রং ফুটে উঠলেও জলদি পালটে ফেলি যেন সালামতের মন কিছুতেই মচকে না যায়।
ঘোড়াশাল থেকে আসা নওল যুবা বয়সে সালামত গাজী সাহেবের অফসেট প্রেস ও প্রকাশনায় কাজ শুরু করে। প্রেসের পিয়ন, চা তৈরি করে, কাগজ-ফাইল নিয়ে এ-টেবিল সে-টেবিলে সে যায়। পুরনো দিনের সেই যে লেটার কম্পোজ তাও কাজ চালানোর মতো সে শিখে ফেলে। প্রেসের ছাপাছাপি, ছাপার জন্য প্লেট প্রস্তুতের সামর্থ্য নিয়ে সালামত দারুণ খুশি। দেখা গেল, বই ছাপার পর ফর্মা ভাঁজ, বাঁধাই, কাটিং এবং বাংলাবাজারের দোকানে বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সালামত তৎপর। জুতো সেলাই থেকে চ-ীপাঠ চালানোর মতো এই সাদাসিধে মানুষটা খোদ ঢাকা শহরে উনিশশো আটানব্বইয়ের বন্যায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের আমোদ উপহার দেয়।

সালামত থাকে খিলগাঁও চৌরাস্তা থেকে ভেতরে বারোয়ারি কুমিল্লা হোটেলের পেছনে লাগালাগি দীন এক বেড়ার ঘরে। প্রায় সাত বছর এখানে এ-ওর গায়ে শ্বাস ফেলে বাস। তার স্বল্প আয়ে সস্তায় এর চেয়ে সে কোথায় থাকবে। বাড়িঅলার সঙ্গে একটু একটু করে মাখামাখি ঘন হয়ে এলে মানুষটা সালামতের সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়ালও রাখে। এই তো তার বউয়ের পয়লা বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতাল অবধি বাড়িঅলা দৌড়ঝাঁপ করেছে। একা কিছুতেই আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে এই ঝামেলা সে সামাল দিতে পারত না। ফ্লাস্কে গরম পানি, বাটিতে খাওয়া নিয়ে বাড়িঅলার বউ হাসপাতালে হাজির। কিন্তু সবকিছু ডুবিয়ে মারা শত্রুবন্যার মধ্যে রাস্তাঘাট, ঘর-দরজা ভেঙে গেলে কে কার খোঁজ নেবে, যে যার দুরবস্থা সামাল দিতে ব্যস্ত। বাড়িঅলা থাকে তিন ঘর পর এক টিনের চৌখোপের নিচে। সালামতের মতো সেও কাঠের তক্তা, ইট সাজিয়ে মালপত্র, খাট উঁচুতে তুলে নিজে উঠেছে ছাউনির ওপর। ওই ওপর থেকে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়িঅলা কথা উড়িয়ে নিচের ঘোলা-ময়লা পানিভর্তি ছোট্ট উঠোনে এনে ফেলেন – ‘আপিস-উপিস বাদ দ্যান। গর্তে-উর্তে মচকাইয়া যাইবেন, ঠিক আছে কুনো। এক লগে আছি, এক লগে বাঁচপো।’
সালামত শুভার্থী বাড়িঅলার বিলিকরা মঙ্গলভাবনায় হাসে। এই হাসির খানিকটা বন্যার উদ্দেশে রেখে সে কুমিল্লা হোটেলের দিকে পানি ভেঙে এগিয়ে যায়। লুঙ্গি গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তোলা, ঘাড়ে কালো পলিথিনের ব্যাগে তার প্যান্ট-স্যান্ডেল।
বন্যায় জনজীবন নষ্ট, দিনযাপন দুরূহ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও অফিসে সালামতের যেতেই হবে। নাশতা পেটে চালান করতে পারল কি পারল না – খিদের বিরুদ্ধে তার নালিশ নেই। সকাল নয়টা বাজল তো শুরু নিজের মধ্যে দারুণ অস্থিরতার তোড় – অভ্যাসের জোরালো টানে সে উপড়ে যায়। অফিস যেন তাকে ডাকে; আর সে উড়াল দিয়ে পৌঁছাতে পারলে খুশি। স্বাধীনতার পর থেকে একনাগাড়ে পুরানা পল্টনের নামিদামি এক প্রেস ও পাবলিকেশনসে হেন কোনো কাজ নেই, সে না করছে। পুরোটা না পারায় তার আফসোস নেই। সময়ের প্রহারে ও নিত্যনতুন চাহিদার জন্য ওই প্রেসের এখন পড়তি দশা, ক্ষয় ধরেছে, তবু ভাঙাগড়া দেখতে দেখতে সাবেক বেতনে সে চাকরি কামড়ে আছে। কম্পিউটারের চাহিদার কারণে ব্যস্ত এলাকা থেকে লেটার কম্পোজ মার খেয়ে গলি-ঘুপচিতে গিয়ে ঢুকেছে। কত কত আধুনিক ছাপাখানা এখন। এখানকার অফসেট মেশিনটা চৌপর আগের মতো ব্যস্ত নেই। সালামতের মনে পড়ে, কত কাজ কত ছাপাছাপি। প্যাসেজ দিয়ে হাঁটবে কি, ডাঁই করা সব ছাপানো কাগজ। এ-পাশে কাজ ও-পাশে কাজ। হঠাৎ দুপুরে লাঞ্চ করতে গিয়ে গাজী সাহেব বাসা থেকে ফোন করলেন। সালামত ফোন ধরে। – বাইন্ডাররা ঘুমুচ্ছে না কাজ চালু রেখেছে? সরেজমিনে দেখে কাজের বিস্তারিত ফোনে সালামতকে জানাতে হয়। এখন? মেশিনে ধুলো পড়ে আসছে, ক্যামেরা সেকশনে মরচেধরা গন্ধ বাসি বাতাসের সঙ্গে
ধেই-ধেই করে। ক্যামেরা সেকশন, পেস্টিংরুম অগোছালো, দেয়ালের কোনায় ঝুলকালি। বাইন্ডারের অনেকে এখানে-সেখানে বেশি মজুরির কাজ ধরে সরে পড়েছে। ক্যামেরা সেকশনের হারাধনবাবু নিজেই আরামবাগে কম্পিউটার বসিয়ে ভালোই আয় করছে। পোস্টিং ও ক্যামেরা সেকশনের যুবক লম্বা-চওড়া মাহবুব এখন সৌদি আরবে – মাসে মাসে কামাই পাঠিয়ে গ্রামে নাকি কয়েক বিঘা জমি কিনেছে। ম্যানেজার নয়ন মিয়া গোল মুখ, মাথায় টাক, পুরু গোঁফের মোটা মানুষটা আর বেঁচে নেই। কেবল কাহিল, চুপসানো চোয়ালের সালামত পড়ে আছে – কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা তার নেই। অন্য কোথাও কোনো কাজের চেষ্টা সে করেনি। গেল বহু বছর তার মুখে কাজ নিয়ে কেউ না শোনেনি, কিছু একটা নিয়ে দাবিও শোনেনি। আজ কি হচ্ছে? জরুরি কাজ, রাতে থাকতে হবে – সালামত খিলগাঁওয়ের বাসা ফেলে প্রেসে থেকে গিয়েছে। আজ কী? পেস্টিং আছে। মাহবুব খুব করে জাপটে ধরলে সালামত ঠিকই অফিসে থেকেছে। কাজের অবস্থা দেখতে রাতে গাড়ি করে ঘুরতে এসে সাহেব সালামতকে দেখে অবাক – ‘তুই, তুই এখনো আছিস?’ সালামত খুশি, সাহেবের ওই স্নেহমাখা তুই-তোকারি শোনার জন্য একগাল হাসি বরাবর সে জমিয়ে রাখে।

আজ বন্যার মধ্যেও ভিড়, ঠেলাঠেলি, তার ওপর পাঁচ টাকা দিয়ে নৌকোয় শাহজাহানপুর চৌরাস্তা, সেখান থেকে টেম্পো ধরে অফিসে পৌঁছতে সালামতের দেরি হয়ে গেল। দৌড়পায়ে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখে সাহেব তাঁর কাচঘেরা অফিসে বসা, কানে ফোন। তিনি হাত তুলে ইশারা করলে সালামতের বুকের ভেতর হিম ভেঙে আসে। নির্ঘাৎ দেরির জন্য সাহেব আজ তাকে ছেড়ে দেবে না। দরজা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকলে সাহেব ফোন নামিয়ে রাখেন।

  • এই বন্যায় তোর ঘরের মধ্যে তো পানি, অবস্থা কী?
  • অখনো আছি স্যার। মালসামান নিয়া কই যাই?
  • তাহলে? তোর তো সাহায্যের দরকার।
  • না স্যার।
    সালামতের জোরালো না শুনে সাহেব রীতিমতো ঘাবড়ে যান। ঘরে পানি, বউ-বাচ্চা নিয়ে বিপদে, বন্যা ভেঙে এসে অফিস করছে, অথচ তার সাহায্যের দরকার নেই – বলে কি, বন্যায় মানুষটার কি মাথা বিগড়েছে! নিজের বিস্ময়ে ভর রেখে সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে সালামতকে দেখেন। এত বছর এক জায়গায়, এই প্রেসে কাজ করছে, তাই তো সালামত মুখফুটে কোনোদিন সাহায্য চায়নি। সালামতকে নতুন চোখে নতুন করে তিনি জরিপ করেন।
    সালামতকে কাজে এখানে কে এনেছিল গাজী সাহেবের পরিষ্কার মনে নেই। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে ঘোড়াশাল, এপারে কালিগঞ্জ, এই কালিগঞ্জের চৌড়া গাঁয়ে হচ্ছে সাহেবের পৈতৃক বাড়ি। কারো এখানে বাস নেই – সবাই আরাম-আয়েশে থাকে ঢাকায়। পুরনো আমলের খসে পড়ো পড়ো মাটির বাড়িটা আছে। মাঝেমধ্যে ছুটিছাটায় বন্ধু নিয়ে তিনি বাড়ি যান – এ-বেলা গিয়ে ও-বেলা ফেরেন। শীতলক্ষ্যার দুই পারে তাঁর পরিচিতজন আছে। প্রেসের ম্যানেজার নয়ন মিয়া ঘোড়াশালের বাসিন্দা, সম্ভবত ে
    সই-ই তাঁর পাড়ার ছেলে সালামতকে কাজের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসেন। নাকি অন্য কারো হাত ধরে সালামতের আগমন! তবে, কাজে কতজন এলো-গেল, বিভিন্ন চেহারা মুছে গেল, কেবল সালামত শেকড় ছিঁড়ল না। তাই তো এখন সালামতই তার পুরনো কর্মচারী। ভাবতেই সাহেবের মাথায় বোধের উদয় হয়। ওর প্রতি সহানুভূতি তাহলে হালকা কেন?
  • ‘এত বড় বন্যায় তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না?’ সালামতের অসুবিধা খুঁজতে সাহেব ভেতরে ভেতরে দৃঢ় হন।
  • সোমস্যা আছিল। তিন-চারডা তক্তার দরকার আছিল। জোগাড় কোরচি। তয় একডা সোমস্যা আছে, কওন যাইবে না। স্যার।
  • ‘তক্তা মানে কাঠ, কী কাজে লাগল?’ সাহেব নিরিবিলিতে সালামতকে খনন করেন।
  • মালসামান উঁচু কোরছি, ঘরে ঢুকবার পথে বিছাইচি।
  • আর সমস্যাটা কী?
    সাহেব একদৃষ্টিতে তাঁর চশমার ভেতর দিয়ে চেয়ে আছেন দেখে সালামত ভারি অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে দেয়াল, পরে নজর ফ্লোরে ফেলে আবার সাহেবের ওপর রাখতেই মুহূর্তে সে গলে যায়।
  • ‘বন্যায় লুঙ্গি পইরা নৌকোতে আহি, নৌকোতে যাইগা। টেম্পুতেও পানি ওডে। আপিসে আইয়া পর লুঙ্গি ছাইরা প্যান্ট পরতাছি। সোমস্যা স্যার, আওন-যাওনে প্যান্ট পরন যাইতাছে না। ভালা লাগে না।’