সাহিত্যপ্রেমিক ও মার্কসবাদী অশোক মিত্র

আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাবুক, অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক অশোক মিত্র গত পয়লা মে চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এমন নীতিবান এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা পালটে দিয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবীর কর্ম ও দায় তাঁর জীবন ও মননে সমার্থক হয়ে উঠেছিল; যদিও নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলতে তিনি ঘৃণা করতেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মানুষটি বিগত সত্তর বছরের সমাজ ও রাজনীতির উত্থান-পতন ও সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই প্রত্যক্ষণ তাঁকে করে তুলেছিল ক্ষুব্ধ এবং বেদনায় জর্জরিত। কখনো তিনি অপার সম্ভাবনার কথা বলেছেন, কখনো সমালোচনা করেছেন চতুর্পার্শে¦র। সমাজে বিরাজিত বিপুল আর্থিক বৈষম্য ও বিপুলতর সামাজিক অবক্ষয় তাঁকে সমগ্র জীবন দগ্ধ করেছিল। তাঁর স্মৃতিকথাসহ কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থে সমাজে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য তাঁকে কত যে পীড়া দিয়েছে সে-কথা বারংবার তিনি উল্লেখ করেছেন।

অশোক মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১০ এপ্রিল ১৯২৮ তারিখে পূর্ব বাংলায়। ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলে তাঁর প্রথম ছাত্রজীবন কাটে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর পরিচিতি। আরমানিটোলা স্কুল থেকে সসম্মানে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক। তারপরে, দেশভাগের টালমাটাল পরিস্থিতি ও ছাত্র-আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, সুতরাং তাঁকে কলকাতা চলে যেতে হয়।

অশোক মিত্রের ভাষায় : ‘ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন ইতিমধ্যে স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে যাচ্ছে, ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের বিভিন্ন আন্দোলন ক্রমশ ঘনবদ্ধ হচ্ছে, অথচ কী গেরো, ধনবিজ্ঞানের সাম্মানিক পরীক্ষায় বসতে হবে, বছর ভরে তেমন পড়াশুনো হয়নি, একটা-দুটো মাস আদা-নুন খেয়ে লাগা। নির্ঝঞ্ঝাটেই আশানুরূপ – অর্থাৎ অভিভাবকদের কাছে আশানুরূপ – ফল করে বেরিয়ে এলাম। পরীক্ষায় বসা এবং ফল বেরোনোর মধ্যে কয়েক মাসের ব্যবধান, ছাত্রদের অসন্তোষ-অভিযোগ উঁচু পর্দায় বাঁধা, কয়েক মাস ধরে দফায়-দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জোরালো ধর্মঘট। সরকার বাহাদুর অন্তর্বর্তী কয়েক মাসে অনেকটা সামলে উঠেছেন, সাহস সঞ্চয় করেছেন, ছাত্রদের মধ্যেও কয়েকজন বিভীষণের খোঁজ পেয়েছেন, যথেষ্ট দমন-পীড়নোর সাহায্যে ধর্মঘট প্রতিবার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রদের কেউ-কেউ গ্রেফতার হলেন, কেউ-কেউ বহিষ্কৃত হলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের মতো অ-মুসলমান ছাত্র একজন-দু’জন, যারা যবনিকার একটু আড়ালে ছিলাম, তাদের নামে হুলিয়া জারি হলো। সুতরাং সিদ্ধান্ত, কিছুদনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে গা ঢাকা দেওয়া সমীচীন। পুলিশ তখনও রপ্ত-দুরন্ত হয়নি, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে গোয়ালন্দ স্টিমার ধরে এক রাত্রের মধ্যে কলকাতা পৌঁছুতে তেমন অসুবিধা হলো না।’ সেই যে গেলেন, ভেবেছিলেন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলে অচিরেই ফিরবেন ঢাকায়, কিন্তু তা আর হলো না।

অশোক মিত্র শুধু অর্থনীতির উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন না; নানা অভিজ্ঞতায় ভারতবর্ষের তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। একদিকে অর্থনীতির চর্চা, অন্যদিকে ব্যাপক অর্থে কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত বৈভব হয়ে উঠেছিল। বেনারস, দিল্লি, লখনৌ, কলকাতা ও হল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা, পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আহরণের পর তিনি হয়ে উঠলেন ধনবিজ্ঞানের সমীহ-জাগানিয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

আপিলা চাপিলা যখন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল তখনই আরেক অশোক মিত্রকে আমরা চিনে নিচ্ছিলাম। পরিণত বয়সে লিখেছেন আপিলা চাপিলা; স্মৃতি এতটুকু ধূসর হয়নি। শৈশব ও যৌবনের দিনগুলো, তাঁর মানসগঠন পর্ব এতটুকুও মলিন হয়নি। আত্মকথা হলেও এ-গ্রন্থে বহু মানুষের আনাগোনায় দীর্ঘ এবং ব্যাপ্ত সময়ের উজ্জ্বল এক কালকে খুঁজে পাই আমরা।

আপিলা চাপিলা তাঁর স্মৃতিকথা। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি এ-গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন তাঁর বর্ণময় জীবন, যেখানে শৈশবস্মৃতি, বেড়ে ওঠা, চল্লিশের দশকে ঢাকার দাঙ্গা এবং তৎকালীন রাজনীতি খুবই অন্তরঙ্গভাবে ফুটে উঠেছে। চল্লিশের দশকে ঢাকার বিবদমান হিন্দু ও মুসলমান কীভাবে তৎকালীন সমাজে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে হিংসার পথে অগ্রসর হয়েছিল তারও বিবরণ আছে এ-গ্রন্থে। দাঙ্গার সময়ে যে-উত্তেজক অবস্থা এবং এ-পাড়া ও-পাড়া বিভাজন হয়েছিল, তাঁর কলমে সে-বিবরণ খুবই মর্মস্পর্শী। অথচ এই দাঙ্গার কিছুদিন আগেও রাজনৈতিক কারণে মুসলমান ও হিন্দু এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক মর্যাদায় সৌহার্দ্য ছিল। এছাড়া আপিলা চাপিলায় ঢাকার মুসলমানদের অবস্থানেরও এক ভিন্ন ছবি পাই তাঁর লেখনীতে। তাঁর স্কুলজীবন অতিবাহিত হয়েছিল ঢাকার আরমানিটোলা হাই স্কুলে। এই স্কুলে পাঠগ্রহণকালে অনেক মুসলমান ছাত্রের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্য হয়েছিল। দীর্ঘদিনের ব্যবধানেও তাঁর বর্ণনায় এই আরমানিটোলা স্কুলটি খুবই উজ্জ্বল। কৈশোর-উত্তীর্ণকালে ঢাকার সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে সম্পর্কছিন্নের বেদনা আপিলা চাপিলায় উঠে এলেও স্কুলের বন্ধুদের তিনি ভোলেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে তিনি যখন ঢাকায় এলেন, তখন অনেক বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশেষত বন্ধুবর এনায়েত করিমের কথা খুবই আবেগ নিয়ে বর্ণনা করেছেন তিনি। এনায়েত করিমও খুব মেধাবী ও উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন। স্কুল ও শৈশব মানুষের মনোগহনে যে-ছাপ রেখে যায় তাঁর ক্ষেত্রেও তা খুবই সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল। অন্তরঙ্গভাবে কৈশোরের প্রত্যক্ষণে ধরা পড়েছে তৎকালীন মাস্টারমশাইদের শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, ছাত্রদের শিক্ষায় প্রেরণাসঞ্চারের নানা প্রসঙ্গ। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও বন্ধুদের প্রসঙ্গ আপিলা চাপিলায় বর্ণিত হয়েছে অন্তরঙ্গভাবে।

এছাড়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এবং সম্ভাবনারও প্রসঙ্গ, আর ঘুরেফিরে আসে মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা।

আদ্যন্ত মার্কসবাদী, অর্থনীতিতে তুখোড়, মেধাবী ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কবিতার প্রতি ভালোবাসা এবং রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতায় পরিচর্যা যে কত গভীর ছিল কবিতা থেকে মিছিলে গ্রন্থ পাঠ করে আমরা তা বহু পূর্বেই উপলব্ধি করেছিলাম। কবিতার ভুবনেও তাঁর ছিল অনায়াস দক্ষতা এবং কবিতার

মর্ম-উপলব্ধি ছিল তীব্র ও তীক্ষè । যুবা বয়স থেকে কবিতা তাঁর ধমনিতে মিশে গিয়েছিল। একদা কবিতা-চর্চাও করেছেন। কবিতার গুণগ্রাহী ও কবিতারচনায় আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু কবিতারচনায় তাঁকে অনুপ্রাণিত করেননি। বরং তাঁর গদ্যে ও প্রবন্ধে বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল এক সম্ভাবনাময় তরুণকে প্রত্যক্ষ করে তাঁকে প্রবন্ধ লিখতে প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল গভীর। গীতবিতানও তাঁর প্রিয় বই ছিল। বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। বামপন্থীরা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিমুখ ছিলেন দীর্ঘদিন; অশোক মিত্র এটা সমর্থন করেননি।

বরং দৃঢ়তার সঙ্গে জীবনানন্দের মৃত্যুর পর, ১৯৫৫ সালে, তিনি লেখেন – ‘কৈশোরের সিঁড়িতে সদ্য-পা-দেয়া আমরা, জীবনানন্দের কাব্যে এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য আবিষ্কার করে, চকিত, অভিভূত …  হয়ে গেলাম। সে এক অদ্ভুত মমতা-মাখানো অধিকারবোধ, আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত; সে-সাম্রাজ্য আমরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম, সে-সাম্রাজ্য সুতরাং আমাদের। শোকের এই নিদারুণ মুহূর্তে দাঁড়িয়েও এখনো সেই গর্ব।’ (বিবেকের কাছে/ অচেনাকে চিনে চিনে)। মহৎ এই অধিকারবোধ এবং এই অধিকারবোধে একজন মহৎ কবিকে জীবনের মধ্যে পাওয়া।

অনেকের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সম্পর্ক সখ্যের ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ছিল। অশোক মিত্রের মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা দময়ন্তী বসুসিংসহ তাঁদের পরিবারের সঙ্গে অশোক মিত্রের যে-সখ্য গড়ে উঠেছিল তার যে-চিত্তাকর্ষক বিবরণ তিনি দিয়েছেন তা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। এই বিবরণে শুধু বুদ্ধদেব বসুর প্রসঙ্গ নয়, উঠে এসেছে প্রতিভা বসুসহ ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটি এবং সাহিত্যের প্রতি অশোক মিত্রের অনুরাগ-প্রসঙ্গও। আজ থেকে ৬৫ বছর আগের যে-কথা দময়ন্তী লিখেছেন, তাতে পাই এক অন্তরঙ্গ চিত্র। তিনি বলেছেন, ‘ফিরে যেতে হয় আমার বছর সাতেক বয়সে, যখন নরেশ গুহ, অরুণ সরকার, অশোক মিত্র ও নিরুপম চট্টোপাধ্যায় নামের চারটি যুবক ‘কবিতা ভবন’ মাতিয়ে রেখেছিল। আমরা তখন ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে থাকি। … আমি তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে, যখন অশোক মিত্র বিশাল এক চাকরি নিয়ে থাইল্যান্ড গেলেন। সে সময়ই তিনি আমাকে প্রচুর চিঠি লিখতেন। সেই থেকেই হয়তো অশোক মিত্রের সঙ্গে আমার এক অসম বন্ধুতার সূত্রপাত। ফিরে এলেন অনেক উপহার নিয়ে। এরপর তিনি হঠাৎ একদিন একটি পার্সেল পাঠিয়েছিলেন আমার নামে। খোলার পর সকলের চক্ষুস্থির! খুব সুন্দর ও দামি একটি সাউথ সিল্কের শাড়ি। আমি তো আনন্দে লাফাচ্ছি, মা হঠাৎ বলে বসলেন মিমিকে পাঠাতে লজ্জা পেয়েছে, তাই রুমির নামে পাঠিয়েছে। বেচারা মা!’

চল্লিশের দশকেই অশোক মিত্র তৎকালীন পূর্ব বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সমীহ-জাগানিয়া এক মার্কসবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা এবং ঢাকার সাহিত্যবৃত্ত ছিল বিচরণের ক্ষেত্র। আপিলা চাপিলায় তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ঢাকার তৎকালীন খ্যাতনামা কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত তাঁকে খুঁজে পেতে আবিষ্কার করেন এবং অচ্যুত গোস্বামী ও অজিত গুহের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। কিরণশঙ্করের উৎসাহে তিনি ঢাকায় প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের বৈঠকে যোগদান করেন।

তাঁর জবানিতে পাই : ‘ততদিনে আমি প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেছি, আলোচনা-অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছি, পরিচয়ের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বিখ্যাত ভালো ছাত্র, সরদার ফজলুল করিম, কৃষক পরিবারের সন্তান, ইচ্ছা করলেই মস্ত উঁচু কাজে যোগ দিতে পারতেন পাকিস্তানে, পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আলাপ প্রগতি লেখক সংঘের সূত্রে। মুনীর চৌধুরী ও তাঁর দাদা কবীর চৌধুরীর সঙ্গে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণেই পূর্বপরিচয়, তাঁরা বুদ্ধিমত্তা ও সৌজন্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। ক্রমশ আলাপ হলো ‘লাল শালু’র লেখক, অতি অমায়িক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র সঙ্গে। সংঘের সম্পাদক অজিত গুহর উৎসাহের শেষ নেই, সংঘের কার্যসূচি ক্রমশ প্রসারিততর হলো। এ-সময়েই, অথবা কিছু আগে বা পরে, পরিচয় হয় সানাউল হকের সঙ্গে; পঞ্চাশের দশকের উপান্ত পর্যন্ত সানাউল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান কবি বলে খ্যাত ছিলেন, তারপর অবশ্য রাষ্ট্রদূত গোছের বড়ো-বড়ো কাজের ঝামেলায় কাব্যচর্চা খানিকটা চাপা পড়ে, কিন্তু তাঁর সৌহার্দ্যবোধে নয়।’

উত্তরকালে রাষ্ট্রীয় বিরূপতার কারণে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করলেও সর্বদা বাংলাদেশ তাঁর হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে ছিল। তাঁর স্মৃতিকথার একটি অধ্যায়ে শৈশব ও কৈশোরের ঢাকা শহর এবং ঢাকার অদূরে অবস্থিত মামাবাড়ি মালখানগর ও পিতৃপুরুষের ঠিকানা ধলেশ্বরী নদীর করাল থাবায় হারিয়ে যাওয়া ভিটের যে-ছবি এঁকেছেন তা হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।

নানা গ্রন্থ ও স্মৃতিকথা পাঠ করে আমরা জেনেছি, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, নিরুপম চক্রবর্তী আর অশোক মিত্র কবিতা ও সাহিত্যে-অনুরাগের সূত্রে পরস্পরের সঙ্গে এক অচ্ছেদ্যবন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি যখন অর্থমন্ত্রী সেই সময়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বিরূপতাকে অগ্রাহ্য করে কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে অরুণকুমার সরকারের যে-স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন তা শুধু

বন্ধুকৃত্য ছিল না, পঞ্চাশের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কবির প্রতি ভালোবাসারও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ছিল। কবি অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে যে-অভিন্নহৃদয় সখ্য গড়ে উঠেছিল এবং অশোক মিত্র হয়ে উঠেছিলেন পারিবারিক সুহৃদ তার মনোগ্রাহী বর্ণনা পেয়েছি অরুণ সরকারের পুত্র অভিরূপ সরকার-লিখিত আরেক রকম পত্রিকার অশোক মিত্র স্মরণসংখ্যায়। অরুণকুমার সরকারকে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি মনে করতেন। তাঁর কবিতা মুখস্থ ছিল।

আপিলা চাপিলা গ্রন্থে পেলাম একজন অসামান্য ব্যক্তিকে, এক প্রতিভাধর স্থিরপ্রাজ্ঞ মার্কসবাদীকে; যাঁর জীবন নানা ঘটনার বিবর্তনে প্রত্যয়ে দীপ্ত। এই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের অর্জন নিয়ে নানা প্রসঙ্গ। তিনি অর্থনীতিশাস্ত্রে কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার পর আন্তর্জাতিক বিবিধ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভাববিনিময় করেছেন অনেকের সঙ্গে, এবং মানুষের ভাগ্য-উন্নয়নে নীতি ও অঙ্গীকার কীভাবে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে সে নিয়ে দৃঢ় ও জোরালো বক্তব্য রাখেন। এছাড়া হল্যান্ডে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জনের সময়ে অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী তাঁর শিক্ষক ইয়ান টিনবার্গেনের চারিত্রিক মাধুর্যে তিনি উজ্জীবিত বোধ করেছেন। এই খ্যাতনামা শিক্ষকের  সরল ও নিরহংকার জীবনযাত্রা তাঁকে সেকালে মোহিত করেছিল। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বিদ্যালয়ে আসতেন সাইকেলে চড়ে। লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি ভেবেছিলেন হল্যান্ডে তিনি ইয়ান টিনবার্গেনের কাছে অর্থনীতির পাঠ গ্রহণ করবেন। সে-সুযোগ অভাবিতভাবে তাঁর জীবনে এসেছিল। বিদেশের এই বিদ্যাপীঠে পড়তে আসা ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিদ্যার্থীদের দৈনন্দিন জীবনযাপনসহ নানাদিক উল্লিখিত হয়েছে আপিলা চাপিলায়। এমনকি পূর্ববাংলায় ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনে  পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বিদ্যার্থীরা নীতি ও ভাষা প্রশ্নে যে-অবস্থান গ্রহণ করেছেন তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।

হল্যান্ডে পাঠগ্রহণকালে বিশেষত রাজনৈতিক ও সামাজিক দায় প্রসঙ্গটি তাঁর জীবন ও মননে প্রখর হয়ে উঠেছিল। অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাঁর পিএইচ.ডির গবেষণা – আয়ের বণ্টন। বিশেষ করে, উৎপাদিত আয়ে শ্রমিকদের অংশ কীভাবে নির্ধারিত হয়, তা নিয়ে তাঁর গবেষণা। পোল্যান্ডের মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ মিখাইল কালেস্কির এই সংক্রান্ত গবেষণাকে তিনি আরো বিস্তৃত করেন। এই শিক্ষালয়ে তাঁর সঙ্গে এক পাকিস্তানি অনিন্দ্যসুন্দর মহিলা খুরশিদ হাসানের বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. করে আন্তর্জাতিক আইনের ধারাবলি নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিলেন।

হল্যান্ডে অধ্যয়নকালে পাকিস্তানি এই তরুণী খুরশিদ হাসান তাঁর বিদ্যানুরাগ ও ব্যক্তিত্বের আলোকিত প্রভায় বিদ্যায়তনে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সখ্যের ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিদেশে বলেই এ বন্ধুত্ব সম্ভব হয়েছিল। খুরশিদ অশোক মিত্রকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে বহু বিষয়ে তাঁর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালেও তাঁদের এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল এবং পাকিস্তান-ভারতের রাজনৈতিক বিরূপতার মধ্যেও যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। পরবর্তীকালে খুরশিদ হাসান পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রদূত হয়ে উঠেছিলেন। এই মহিলার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি বলে তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থনীতি উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে তিনি উপদেষ্টার পদ ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে রাজ্যের আর্থনীতিক ব্যবস্থাপনায় তাঁর অনন্য অবদান তাঁকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। বিশেষত ভূমি-সংস্কারে এবং চিট-ফান্ডের ক্ষেত্রে যে-উদ্যোগী অবদান তিনি রেখেছিলেন আজ তা বহু আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। মন্ত্রী

থাকাকালে তিনি যেসব দিকে সংস্কার সাধন করেছিলেন তার মুখ্য লক্ষ্য  ছিল দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর

অকৃত্রিম সহায়তা না পেলে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা সম্ভব হয়তো হতো না। তিনিই মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে দিল্লিতে ভারতবর্ষের যাঁরা নীতিনির্ধারক ছিলেন তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের দুজন অর্থনীতিবিদের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরাই আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে উদ্দীপক ভূমিকা রেখেছিলেন।

আপিলা চাপিলা স্মৃতিকথা এবং স্মৃতিমথিত আরো কিছু রচনা ও প্রবন্ধে আমরা একদিকে পাই তাঁর জীবনসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়; অন্যদিকে সময়ের উত্তাপও। এছাড়া জন্মভূমি এবং ঢাকার জন্য হাহাকার হৃদয়ের খাঁজে আমৃত্যু কতভাবে যে বহন করেছেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিক পরিম-লের নানা চিত্র, মাকর্সবাদে তাঁর যে-অঙ্গীকার, যে-দায় তা তিনি সমগ্র জীবন লালন করে আমৃত্যু সেই পতাকাকে সমুন্নত রেখেছিলেন। সে অনুষঙ্গও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্মৃতিকথায়। ছেলেবেলায় প্রত্যক্ষ করা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার পাশাপাশি রাজনীতির অধোগতি তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল। এই বৈষম্যের চিত্র তাঁকে সর্বদা বিচলিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলত। দরিদ্রদের প্রতি লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা সারাজীবন তাঁকে প্রবলভাবে পীড়িত করেছিল। মানবজীবনের এই বৈষম্য নিরসনকল্পে মার্কসবাদকেই তিনি ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর বর্ণনায় পাই মধ্য তিরিশের ঢাকা এবং মামাবাড়ি মালখানগরের ছবিও; সঙ্গে তৎকালীন ঢাকা ও মুসলমান সমাজের ছবিও উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘সেই অতি ক্ষুদ্র শহরটিও ছিল প্রথাগতভাবে কুড়ি-পঁচিশটি পাড়ায় বিভক্ত। ধনী-দরিদ্রের বিভাজন তো ছিলই। অধিকাংশ আপাতসচ্ছল মানুষজন হিন্দু; বস্তিতে মালিন্যে অভাবে ক্লিষ্ট বসবাসকারীরা প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। এমন নয় যে, একজন-দুজন সম্ভ্রান্ত সচ্ছল মুসলমান পরিবার আদৌ ছিল না। ঢাকার নবাবগোষ্ঠী, তাঁদের বিভিন্ন শরিককে জড়িয়ে যাঁরা শহরের এবং মফস্বলের বহু সম্পত্তির মালিক, তাঁদের কথা তো উল্লেখ করতেই হয়! তাছাড়া শহরের বিভিন্ন অংশে

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন আরো বেশ কিছু মুসলমান জমিদার। কিন্তু বণিক, ব্যবসাদার, কলেজ ও স্কুল-শিক্ষক, চিকিৎসক, উকিল, মোক্তার, এঁরা অধিকাংশই হিন্দু, উচ্চবর্ণ-নিম্নœবর্ণ-মেøচ্ছ-চ-াল মেলানো ভিড়। প্রায় প্রতি পাড়ার কেন্দ্রস্থলজুড়ে একটু বর্ধিষ্ণু কিংবা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত হিন্দুদের ঘরবাড়ি, পল্লীর প্রান্তদেশে মুসলমান বস্তি। প্রকৃতির নিয়ম হিসেবেই যেন এই গণবিন্যাসের মানচিত্র মেনে নেওয়া হতো।’

এই ছবি ঘিরেই আমি তৎকালীন ঢাকার রাজনীতি, সমাজের বিন্যাস, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ও সত্তর বছর আগের শহরকে উপলব্ধির চেষ্টা করেছি। প্রসঙ্গত বলি, আরমানিটোলার খুব কাছেই আমারও শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল। এই স্কুলসংলগ্ন তারা মসজিদের চৌবাচ্চায় লাল-নীল মাছ ছিল আমার স্বপ্নের জায়গা। কৈশোরক কৌতূহলে বহুবার গেছি তারা মসজিদে মাছ দেখতে। এর স্থাপত্যশৈলীও ছিল দেখার মতো।

মালখানগর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অতটা বিখ্যাত না হলেও অনুরূপ আর একটি উচ্চ কুলীন কায়স্থ বংশ ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুর পরগনার মালখানগর গ্রামের বসুঠাকুর পরিবার। ‘ঠাকুর’ লেজুড়টি কবে বংশপদবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তা অবশ্য স্পষ্ট করে জানা যায়নি, তবে বংশগরিমা জাহিরে এই পরিবারেরও কোনোদিন খামতি ছিল না। শাসন-প্রজাপীড়ন পরিচিত অভ্যাসের মতো, পাশাপাশি বিদ্যাচর্চা, বিভিন্ন প্রকৃতির সংস্কৃতিচর্চাও। বংশগর্ব নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বিন্দুমাত্র গবেষণা না করেও বলে দেবেন খোদ বুদ্ধদেব বসু এই বংশজাত, একসময় ছোটদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রচনায় সিদ্ধহস্ত সুনির্মল বসুও, এমনকি সম্প্রতি প্রয়াত ‘ক্ষুধার্ত’ কবিদের মস্ত পৃষ্ঠপোষক – পরে ভদ্দরলোক বনে যাওয়া উৎপলকুমার বসু পর্যন্ত। দিলীপকুমার রায়ের অনুশীলনে কণ্ঠনালিকে ক্ষইয়ে দেওয়া অকালপ্রয়াতা সংগীতশিল্পী উমা বসু মালখানগর তনয়া, একদা হিমাংশুকুমার দত্তের চামেলি পর্যায়ের গানগুলির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত সাবিত্রী ঘোষও একই বংশজাতা। আবার দেখুন উমা বসুর পিতামহ বসন্তকুমার বসু প্রায় একশো বছর আগে কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম প্রধান আইনজীবী, একটা সময়ে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি পদে বৃত হয়েছিলেন, তাঁর পুত্র উমা বসুর জনক ধরণীকুমার বসু বহুদিন কলকাতা কর্পোরেশনের কংগ্রেসি কাউন্সিলর ছিলেন। আবার বসন্তকুমার বসুর দৌহিত্র একদা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমাজসেবিকা ফুলরেণু গুহ, অর্থাৎ ফুলদি ও উমা বসুর মধ্যে মামাতো-পিসতুতো বোনের সম্পর্ক।’

অশোক মিত্র-বর্ণিত আপিলা চাপিলায় আরমানিটোলা সংলগ্ন অঞ্চল এবং ঐতিহাসিক সিনেমা হল পিকচার হাউস ও আর্মেনিয়া গির্জা শুধু উজ্জ্বল নয়, তৎকালীন ছিমছাম ঢাকাও অমলিন হয়ে ফুটে উঠেছে। এই পিকচার হাউসেই তিনি বালক বয়সে মায়ের সঙ্গে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অভিনয় দেখেছেন। নাট্য-অভিনেতা কুমার রায়ের স্মরণে তাঁর একটি বক্তৃতা থেকে এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি : ‘…অভিনয় চলছে – অভিনয় চলছে – হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম যে পাশের খালি দুটো আসনে নিখুঁত ইউরোপীয় পোশাক পরা একজন ভদ্রলোক এসে বসলেন এবং তাঁর পাশে আশ্চর্য সুন্দরী একজন মহিলা। খেয়াল করতে পারিনি যে শিশিরকুমার ভাদুড়ী অধ্যাপক দিগম্বর মিত্র রূপে এসেছেন এবং পাশে তাঁর স্ত্রী স্বাগতা দেবী। একটু পরেই যে মুহূর্তে মঞ্চে দিগম্বর মিত্রের বোন শ্রীমতী রানিবালা দেবী উপস্থিত হলেন, হঠাৎ আমার মায়ের পাশে বসা শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অধ্যাপক দিগম্বর মিত্র একেবারে ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে চেঁচামেচি করে একটা মস্ত গোলমাল শুরু করে দিলেন। তাঁর বোনের উদ্দেশে কটূক্তি করলেন এবং এসব নাটকের দল, যারা মেয়েদের বাড়ি থেকে বাইরে টেনে এনে এসব করছে, তাদের বিরুদ্ধে একেবারে হৈহৈ রৈরৈ অবস্থা। লোকজন ছুটে এসেছে, এদিকে দর্শকরা প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন। তারপর আস্তে আস্তে ঠা-া হলো। শিশিরবাবুকেও স্বাগতা দেবীর চরিত্রাভিনেত্রী কঙ্কাবতী দেবী ঠা-া করলেন, তারপর দিগম্বর মিত্র বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী স্বাগতা দেবীও বেরিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ শিশিরকুমার ভাদুড়ী মশাই আমার মায়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, এসব পাগলা দিগম্বরের প্রলাপ।’ আমার কাছে একটা মস্ত নাটকীয় মুহূর্ত হয়ে উঠল।

‘ভাবুন, মফস্বল শহরে একটা নাটক করতে এসেছেন – এতবড় অভিনেতা এবং অভিনয় করে চলে যাচ্ছেন, তাঁর যা করণীয় সেই অভিনয় করে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছেন। হঠাৎ খেয়াল হলো – একজন মহিলা তাঁর এই চেঁচামেচি শুনে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। শিষ্টাচার, শিষ্টাচারের পরাকাষ্ঠা, শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয় নিচু হয়ে আমার মায়ের কাছে বলছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, এসব পাগলা দিগম্বরের প্রলাপ।’ সেই নাটকের কিছু আমার মনে নেই, নাটকটি কালের স্রোতে ধুয়েমুছে গেছে। নাটকটিতে কী ছিল কিছু জানি না। কিন্তু আমার জীবনে সেই নাটকীয় মুহূর্ত উপলব্ধির একটা স্তর থেকে আমাকে কেউ ধাক্কা মেরে বুঝিয়ে দিলো শিষ্টাচার কাকে বলে।

‘শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মতো মহৎ একজন অভিনেতা একটা মফস্বল শহরে অভিনয় করতে এসে শিষ্টাচারের যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেলেন, আমি বলব এইটা হচ্ছে নাটকীয় মুহূর্ত। নাটক নয়, অথচ নাটকের সংলগ্ন একটা সামান্য ঘটনা থেকেই আট-নয় বছর বয়সেই প্রথম নাটকীয়তার অভিজ্ঞতায় সিক্ত হলাম।’

 

দুই

১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি হয়ে অশোক মিত্র যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এক আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল যুব সম্মেলনে। তখনো তিনি জানেন না আর মাত্র কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে ছাত্র-আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার জন্য দেশত্যাগ করতে

হবে। অশোক মিত্র হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন সেই

সম্মিলন-প্রসঙ্গ; সেখানে কিটি মেননের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। সেই সময়ে বহু প্রগতিশীল লেখক ও কর্মীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে আলাপে তাঁর ভাবজগৎ ও মানস কতভাবে যে সমৃদ্ধ হয়েছে সে-প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন অশোক মিত্র। এই সময়ে তাঁর বামপন্থায় নিমজ্জন, ছাত্র-আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং এই বামপন্থাকে ধারণ করে বুকে স্বপ্নলালনের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তাঁর লেখনীতে। সেই সময়ের ঢাকার সাহিত্যিক পরিম-ল, বিশেষত নবগঠিত প্রগতি লেখক সংঘের প্রসঙ্গও খুবই জ্বলজ্বল করে উঠেছে। ছাত্র-আন্দোলন ও বামপন্থায় নিমজ্জনজনিত কারণে বাধ্য হয়ে ঢাকা ত্যাগের পর তাঁর জীবনসংগ্রাম কোনোভাবেই সরল ও একরৈখিক ছিল না। লাখ লাখ শরণার্থীর মতন দুর্দশার জীবন বেছে নিতে হয়নি বটে, তবে সচ্ছলতা যে ছিল না পরিবারে সে-সময়, সে-কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হতে চেয়েছিলেন কলকাতায়; কিছুদিন ক্লাসও করেছেন কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শরীর ও মননে পশ্চাৎপদ ঢাকার ছাপ থাকায় কলকাতার কুলীন সমাজে তিনি কোনো স্থান পাননি। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হতে পারেননি কলকাতায়। চলে গিয়েছিলেন বেনারসে। তাঁর গুরু ও নিবেদিতপ্রাণ ধনবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের আনুকূল্যে ও প্রযতেœ তিনি অর্থনীতিতে ভালো ফল করে জীবনে প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। উন্নতহৃদয় এই শিক্ষককে সমগ্র জীবন স্মরণে রেখেছিলেন তিনি। আপিলা চাপিলায় তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণও করেছেন। অমিয় দাশগুপ্তের শতবার্ষিক সম্মাননা গ্রন্থেও এই কীর্তিমান অর্থনীতিবিদ ও ছাত্রবান্ধব শিক্ষককে স্মরণ করেছেন। বেনারসের পাঠ শেষ করে গিয়েছিলেন দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে। দিল্লিতে যে-প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য গিয়েছিলেন সেখানকার পরিবেশ কাজের জন্য সুখকর ছিল না। দিল্লি ছেড়ে গেলেন অধ্যাপনার জন্য লখনৌ। তারপর নেদারল্যান্ডসে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় সহায়তা করেছিলেন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ইয়ানবার্জন। বিশ্বব্যাংকে কাজ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের অধীনে একটি ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেছেন। এই সময়ে ওঁর সঙ্গে ভুবনখ্যাত অর্থনীতিবিদদের সাক্ষাৎ ও ভাববিনিময় হয়েছে। সুযোগ হয়েছে পৃথিবীর নানা অঞ্চল ভ্রমণ করার ও অর্থনীতি বিষয়ে বক্তৃতা দেবার। কিছুদিন কর্মময় জীবন কাটিয়েছেন ব্যাংককে।

থাইল্যান্ড তাঁর এতটুকু ভালো লাগেনি। থাইল্যান্ডের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনে মার্কিন আগ্রাসন তাঁকে ব্যথিত করেছিল।

থাইল্যান্ডের অর্থনীতি তখন ভঙ্গুর; রাজাকেন্দ্রিক প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য তাঁকে বিষণœ করেছিল। এই কাজ করার সময়ে তাঁর চোখে ধরা পড়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা। এই সময়ে মার্কসবাদকে আরো গভীর প্রত্যয় নিয়ে অনুভব করেন তিনি। কর্মব্যপদেশে বেশ কিছুদিন পড়িয়েছিলেন লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এ-কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছিলেন সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। তাঁরই আনুকূল্যে অশোক মিত্র অধ্যাপনার চাকরিটি পান। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল সর্বভারতে সুবিদিত। দর্শন, সাহিত্য ও সংগীত ধূর্জটিপ্রসাদের প্রিয় বিষয় ছিল। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ধূর্জটিপ্রসাদের সখ্য ছিল। কলকাতার সাহিত্যানুরাগী মহল ধূর্জটিপ্রসাদের পাণ্ডিত্যের খ্যাতির জন্য তাঁকে সমীহ করত। ধূর্জটিপ্রসাদকে ঘিরে লখনৌতে যে নক্ষত্রম-লীর সমাবেশ হয়েছিল তার বিবরণ আছে আপিলা চাপিলায়। লখনৌ অবস্থানকালে এই নক্ষত্রম-লীর সদস্য হয়ে সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের নানা বিষয় পরিগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এই সময়ে অশোক মিত্র ধূর্জটিপ্রসাদের স্ত্রী ছায়াদেবীর স্নেহ পেয়েছিলেন। তার উজ্জ্বল বর্ণনা আছে আলোচিত স্মৃতিকথায়।

বছর দশেক আগে কালি ও কলম পত্রিকার সূত্রে তাঁর সান্নিধ্য ও স্নেহ পেয়েছিলাম। আলীপুর পার্ক রোডে সোনালি অ্যাপার্টমেন্টে আমাকে নিয়ে যেতেন ছোটগল্পকার শচীন দাশ। কালি ও কলমের অনুরোধে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন এ-পত্রিকায়। শৈশবের দুই বন্ধুকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণা ও নারীশিক্ষার একটি অনুষঙ্গ নিয়ে একটি রচনা সাবিত্রী কাটারা থেকে শুরু এবং ঢাকার স্মৃতি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারও আমাদের জন্য ছিল পরম পাওয়া। সাবিত্রী কাটারা আজ থেকে সত্তর বছর আগের স্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থায় এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে। বাংলাদেশের মেয়েরা আজ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে উচ্চশিক্ষাগ্রহণে, সাবিত্রী কাটারা পাঠ করলে অনেকেই বিস্মিত হবেন। কালের দর্পণের আলোকে নারীশিক্ষার এই অগ্রযাত্রার বিষয়টি গবেষকদের কাছে আগ্রহের বিষয় হতে পারে। এছাড়া বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত তাঁর গুরুকন্যা ও স্নেহধন্যা অলকনন্দা প্যাটেল-লিখিত পৃথিবীর পথে হেঁটে গ্রন্থের তাঁর লেখা ভূমিকাটি বইয়ের মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে।

কলকাতায় সাক্ষাতের সময়ে দেখেছি, ফ্ল্যাটভর্তি বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। দেয়ালচিত্র শোভিত; কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়ার মাটির পুতুল ফ্ল্যাটের শোভাকে ভিন্ন মর্যাদা দান করেছে। কথায় কথায় ঢাকার জন্য তাঁর আকুলতা প্রকাশ করতেন। শরীর তখনই ভঙ্গুর, কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে, কানে কম শোনেন। শীর্ণ শরীর, কিন্তু তেজোদ্দীপ্ত কথা বলার ধরন। যা বলেন খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন। খুবই সচল মন, সমীহ-জাগানিয়া; দেখা হলেই খোঁজ নেন ঢাকার সারস্বত সমাজের। বন্ধুদের প্রসঙ্গও উঠে আসে তখন কথাপ্রসঙ্গে। শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৮ সালে, খুবই ব্যস্ততায় সময় কেটেছিল। দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও রবীন্দ্রগবেষক সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে। ছায়ানট ভবন দেখে খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন মনে পড়ে। অপরিসর যে-ঢাকাকে তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন, সংগীত ও সংস্কৃতি-চর্চা ক্ষীণ ছিল তৎকালে। সেখানে শত বিরূপতার মধ্যে একটি গানের স্কুল গড়ে উঠেছে ও সংগীত সাধনায় রত শত শত ছেলেমেয়ে – এ তাঁকে খুব আলোড়িত করেছিল। আপাতরুক্ষ খুবই কঠিন মনে হতো মানুষটিকে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বে একটি স্নেহশীল মন যে ছিল তা প্রকাশ পেত। জীর্ণ শরীর; কিন্তু লেখালেখির কোনো বিরাম ছিল না। তিনি বলে যেতেন, কেউ লিখে নিত। অনুলিখনে প্রকাশিত রচনাগুচ্ছেও তাঁর গদ্যের শাণিত স্বাতন্ত্র্য, অমোঘ দীপ্তি ও উজ্জ্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। ২০০৮ সালে প্রকাশ করেছিলেন আরেক রকম পাক্ষিক পত্রিকা; যে-পত্রিকাটি তাঁর সঞ্চিত অর্থ ও বন্ধু-বান্ধবের আর্থিক সহায়তায় প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটির প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় যে-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল তাতে অগণিত পাঠক এই পত্রিকার লক্ষ্য, দায় ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পান ও প্রাণিত বোধ করেন। সম্পাদকীয়টির কিয়দাংশ নিচে তুলে দেওয়া হলো :

সার্বিক অধোগমনের প্রবণতাকে ললাটলিখন বলে মেনে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে মহাপ্রলয়ের বিশেষ মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষায় থাকা মহাপাতকের সমার্থক, প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ার দায়িত্ব আমাদেরই বহন করতে হবে, যে যেখানে অবস্থান করছি আমাদের প্রত্যেককে। আমাদের উপর গোটা ভুবনের ভার বাইরে থেকে কেউ চাপিয়ে দেবে না, কারও সেই মাথাব্যথা নেই, আমাদেরই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হতে হবে। সামনের দিকে কী আছে তা আমাদের জানা নেই, কী আর করা, এ ধরনের নেতিবাচক উচ্চারণে বিরত থেকে আমরা যেন বিকল্প উচ্চারণ করি : সামনের দিকে কীসের অবস্থান তা নির্ভর করছে আমাদের আচরণ-বিচরণ-সিদ্ধান্তের উপর। হতভম্ব উদ্রেককারী পরিস্থিতি। তাহলেও আমাদের প্রতীতি, ইতিহাসের এখানেই ইতি ঘটছে না, আগামী দিনে ইতিহাস কোন্ দিকে ঘুরবে তার নিয়ামক হতে পারি আমরাই।

অগণিত বন্ধু ও সুহৃদ তাঁর উপরোধে সাড়া দিয়ে আরেক রকম পত্রিকার জন্য আর্থিক সহায়তার হস্ত প্রসারিত করেছিলেন। প্রথম বছর শঙ্খ ঘোষ খুবই সহায়তা করেছিলেন সম্পাদনাকর্মে। এই পত্রিকায় তাঁর অনুরোধে বহু লেখক নিয়মিত ও অনিয়মিত লিখতেন। লেখালেখিতে সংকোচ ছিল অনেকের। তাঁর অব্যাহত তাগিদেই অনেকে লেখনী ধারণ করেছিলেন। অশোক মিত্রের প্রণোদনায় পত্রিকাটি রাজনৈতিক বিরূপতার মধ্যেও ভিন্ন ধরনের বিবেকি কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কড়া সমালোচনা প্রকাশিত হতো এ-পত্রিকায়। সমাজের অসংগতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষার অধোগতি নিয়েও সমালোচনা পত্রস্থ হতো। সমকালীন রাজনৈতিক প্রবণতার, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সমালোচনা প্রাধান্য পেত। ভারতবর্ষের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও শিল্প-সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ এই পত্রিকার আলোচ্য বিষয় ছিল।

অর্থনীতি তাঁর প্রধান চর্চার বিষয় হলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীতের ভুবনে সমগ্র জীবন তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। মার্কসবাদী অর্থনীতিতে পা-িত্যখ্যাতি সর্বভারত ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে তাঁকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।

অশোক মিত্রের মৃত্যুর পরে আরেক রকম একটি বিশেষ সম্মাননা সংখ্যা প্রকাশ করেছে। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ও তথ্যে এই সংখ্যাটি হৃদয়কে মথিত করে। ১৫টি রচনায় সমৃদ্ধ সংখ্যাটি অনন্য। অশোক মিত্র-রচিত দুটি প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে এ-সংখ্যায়। নবনীতা দেব সেন এবং আজিজুর রহমান খান স্মৃতিচারণা করেছেন অনেকের সঙ্গে অশোক মিত্রের। তরুণরা তাঁর মতো আদর্শবাদী নীতিনিষ্ঠ মানুষকে কীভাবে দেখত কয়েকটি রচনায় তা উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপকে উপলব্ধির জন্য এই সংখ্যাটি খুবই মনোগ্রাহী হয়।

বিখ্যাত সাংবাদিক ও মেধাবী ছাত্র জাত বোহেমিয়ান শচীন চৌধুরী একদা ঢাকায় অধ্যয়ন করেছিলেন। ঢাকায় অধ্যয়নকালেই তাঁর বিদ্যাবত্তা, মনন ও প্রজ্ঞা শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাঁর অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে বিখ্যাত ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী ও সিনেমায় সংশ্লিষ্ট হিতেন চৌধুরীর নাম সমধিক আলোচিত। আপিলা চাপিলা

স্মৃতিকথার একটি অধ্যায়ে এই বৃহৎ পরিবারের কথা অশোক মিত্র খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন।

শচীন চৌধুরী অনুরাগীজনদের শুভেচ্ছা নিয়ে জীবনের এক পর্যায়ে বোম্বাইয়ে বসবাস শুরু করেন। দেশ-বিদেশ পরিক্রমার পর এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা হিতেনের ঐকান্তিক প্রয়াসে প্রকাশ করলেন সাক্সেসিয়া গ্রুপের আর্থিক সহায়তায় ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ইকোনমিক উইকলি। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় সর্বভারতে এটি প্রভাবশালী পত্রিকা হয়ে উঠেছিল।

প্রথম সংখ্যায় ধূর্জটিপ্রসাদের অস্বাক্ষরিত সম্পাদকীয় খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন অশোক মিত্র; তিনি এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আমার মতো একগুঁয়ে ব্যক্তিরা যখন সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনায় হাত পাকাতে শুরু করলেন উত্তাপের অভাব ঘটলো না।’ শচীন চৌধুরী আরেকটি প্রথা এই পত্রিকায় চালু করেছিলেন; তিনি নিজে খুব কমই সম্পাদকীয় লিখেছেন। তাঁর পরিচিত সুহৃদজন যাঁরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁরাই সম্পাদকীয় লিখতেন। সম্পাদকীয় নীতির নিরপেক্ষতা ও নির্ভীকতা সমগ্র ভারতবর্ষের সমাজবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক মহলে এক নবীন সাংবাদিকতার প্রতিমান সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা শচীন চৌধুরীর এই পত্রিকার বিশ্লেষণ ও সাংবাদিকতাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ইকোনমিক উইকলি যখন নানাভাবে ভারতবর্ষের অর্থনীতিবিদদের পরিম-লকে আন্দোলিত ও স্পন্দমান করছিল তখন অশোক মিত্র বিদেশে ছিলেন। বোম্বাই এবং ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানীরা এই পত্রিকার নিবন্ধে আলোকিত হয়ে উঠছিলেন।

সাক্সেসিয়া গ্রুপ ১৯৬৫ সালে এই পত্রিকাপ্রকাশে অনীহা প্রকাশ করলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়, যদিও এই পত্রিকা খুব প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল।

পরবর্তীকালে শচীন চৌধুরী বন্ধু, আত্মজন ও হিতেন চৌধুরীর তাগিদে একটি সমীক্ষা ট্রাস্ট গঠন করে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি প্রকাশ করেন। শচীন চৌধুরী বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি খুব বেশিদিন সম্পাদক ছিলেন না। কয়েক বছর পরে তিনি মারা যান। তবে ভারতবর্ষের সাংবাদিকতায় এক নক্ষত্র হয়ে উঠেছিল এ-পত্রিকা। অশোক মিত্র ও তাঁর বন্ধুরা এই পত্রিকায় টাকা লগ্নি করেছিলেন। তিনি অন্যতম ট্রাস্টিও ছিলেন। পরবর্তীকালে যাঁরা সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁরাও পত্রিকাটিকে উন্নতমানের করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন।

এই পত্রিকায় অশোক মিত্র লেখেন সত্তরের দশকের কলকাতা ডায়েরি। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে সেই অন্ধকার সময়ে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির পাতায় অশোক মিত্রের নিয়মিত কলাম ‘ক্যালকাটা ডায়েরি’ অগণিত সচেতন মানুষের দৈনন্দিন মনোযন্ত্রণার অংশীদার হয়ে সেই যন্ত্রণাকে এক ভাষা দিয়েছিল। সেই লেখাগুলো নিয়ে মালেনী ভট্টাচার্য ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে ২০০৮ সালে কলকাতা প্রতিদিন বেরোল। অনুবাদেও লেখকের হৃদয়স্পন্দনটি চমৎকার ধরা পড়েছে। এ দুজনই অনুবাদক ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে খ্যাতিমান; ইংরেজি থেকে বাংলা করার সময়ে এ দুজন অশোক মিত্রের গদ্যশৈলীর বিশিষ্টতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। একদিকে দেশজুড়ে তখন তীব্র আর্থিক সংকট, অন্যদিকে রাজ্যজুড়ে নির্মম রাষ্ট্রযন্ত্রীদের পৈশাচিক দমননীতি, দুইয়ের বিরুদ্ধেই তাঁর সুতীব্র লেখনী ক্রমাগত অগ্নিবর্ষণ করেছে এ-গ্রন্থে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র, মার-খাওয়া মানুষের জন্য একটা আশ্চর্য মায়া ছিল এই কলামের ছত্রে ছত্রে। তাঁর লেখনী যে কত সজীব ও সজাগ ছিল, তা এ-গ্রন্থপাঠে বোঝা যায়। কলকাতা জীর্ণশীর্ণ প্রাচীন হয়ে পড়েছিল। কলকাতা আজো তেমন আছে। তিনি তাঁর মমতাময় ক্রোধে কত অবিচল ছিলেন, এ-গ্রন্থ হয়ে উঠেছিল তারই দলিল। কলকাতা প্রতিদিন রচনার গুণে-বৈশিষ্ট্যে আজো সমকালীন।

কবিতা তাঁর জীবন ও মননের সঙ্গে মিশে ছিল। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই মানুষটির হৃদয়ে সর্বদা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে রচিত কবিতার পঙ্ক্তি হনন করত। উপলব্ধি করতে চাইতেন, হৃদয় খুঁড়ে দেখতে চাইতেন কোনো কোনো কবিতাকে, বিশ্রুতপ্রায় কবিকে, তাঁর রচনার প্রসাদগুণকে। আকস্মিক তাঁর চেতনা এবং কবিমনকে এই অনুষঙ্গ করত আলোড়িত। বিস্মিত হয়েছি আমরা তাঁর রচিত একটি প্রবন্ধ পাঠ করে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে; নাম ‘যা হারিয়ে যায়’। যৌবনে কবিতা বা পরিচয় পত্রিকার বহু কবিতাকে তিনি এতটুকুও ভোলেননি। কালের প্রবাহে অনেক কবি হারিয়ে গেছেন। দু-একটি স্মরণীয় কবিতা ও পঙ্ক্তি লিখে তাঁরা হারিয়ে গেলেও তাঁরা যে কখনো কখনো কবিতাপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তাঁর লেখা পাঠ করে তা আমরা জানতে পারি। হারিয়ে যাওয়া এই কবিরা কবিতা রচনা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৪৩ সালে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি তাঁর মনে পড়েছে লেখিকার নামসহ। আকস্মিক সেই পঙ্ক্তি স্মরণ করে কাতরতা প্রকাশ করেছেন ‘যা হারিয়ে যায়’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধটি পাঠ করার পর আমরা ভেবে অবাক হয়েছি এবং বুঝতে পেরেছি কবিতা তাঁর হৃদয়ে কতভাবে মিশে ছিল।

অশোক মিত্র স্পষ্টভাষী, নীতিতেও অবিচল ছিলেন। সেই যে যৌবনে কমিউনিস্ট আদর্শের ঝরনাতলায় অবগাহন করেছিলেন আমৃত্যু সে-আদর্শ লালন করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চীনের সমাজতন্ত্র থেকে সরে আসায় বিষণœবোধ করেছেন। কিন্তু হতাশায় ভেঙে পড়েননি। মার্কসবাদ মানবমুক্তিতে এখনো প্রাসঙ্গিক – একথা বারংবার উচ্চারিত হয়েছে শেষ জীবনের লেখনীতে। এখানেই একক ও নিঃসঙ্গ ছিলেন তিনি।