সুইটনেস

অনুবাদ : রাজিয়া সুলতানা

এটা আমার দোষ নয়। তোমরা আমাকে এজন্য দোষ দিতে পারো না। আমি কিছুই করিনি। কীভাবে এটা ঘটল এ-ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। ওরা যখন আমার দু-পায়ের মাঝখান থেকে ওকে টেনে বের করে আনল, এরপর আমার বুঝতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি যে, কিছু একটা ভুল হয়েছে। সত্যিই ভুল ছিল। ও এতটাই কালো যে, আমাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দেয়। সেই রং, যেন মধ্যরাতের কালো। সুদানীয় কৃষ্ণত্ব বলতে পারো। কিন্তু আমার গায়ের রং তো ফর্সা, চুল সুন্দর, যাকে আমরা বলি উজ্জ্বল-হলুদ বর্ণের কেশ। লুলা অ্যানের বাবাও ছিল এরকমই। আমাদের কারো গায়ের রংই ওর গায়ের রঙের মতো নয়। ওই রঙের কথা ভাবলে অনেকটা আলকাতরার কাছাকাছি কোনো রঙের কথা মনে হবে। তারপরও ওর চুল ওর গায়ের রঙের সঙ্গে মেলে না। একেবারেই আলাদা – সোজা আবার কোঁকড়ানো। অস্ট্রেলিয়ার নগ্ন আদিম উপজাতিদের চুলের মতো। তোমরা ভাবতে পারো, ও হয়তো ওর পূর্বপুরুষের মতো হয়েছে। কিন্তু কার মতো? তোমরা হয়তো আমার দাদিকে দেখেছ। তাকে শ্বেতাঙ্গিনী বলতে পারো। বিয়েও করেছেন একজন শ্বেতাঙ্গকে। আর এ-ব্যাপারে তাকে কখনো কাউকে একটা কথা বলতে শুনিনি। আমার মা-খালাদের কাছ থেকে কোনো চিঠি এলে তিনি তা না খুলেই সঙ্গে সঙ্গে আবার তাদের কাছেই ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। অবশেষে দেখা যেত, তার কোনো খবরই তারা পেতেন না এবং তাকে তার মতোই থাকতে দিয়েছিলেন তারা। সে-সময়ে প্রায় সব মিশ্রবর্ণের লোক এরকম করত। বিশেষ করে তাদের চুলের রংটা যদি সাদাদের মতো হতো, তাহলে কোনো কথাই ছিল না। কত শ্বেতাঙ্গ-শরীরের শিরায় শিরায় যে নিগ্রো-রক্ত লুকিয়ে আছে, তা কল্পনা করতে পারো? আন্দাজ করো তো। আমি শুনেছি কুড়ি শতাংশই নাকি এমন। আমার মা লুলা মে নিজেকে শ্বেতাঙ্গিনী বললে সহজেই পার পেয়ে যেতেন; কিন্তু তিনি তা ইচ্ছা করেই করেননি। এর জন্য তাকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা তিনি আমাকে বলে গেছেন।

তিনি আর আমার বাবা যখন কোর্টে বিয়ে করতে যান, সেখানে দুটো বাইবেল ছিল। তাদের হাত রাখতে হয়েছিল নিগ্রোদের জন্য রাখা বাইবেলের ওপর। অন্যটা ছিল শ্বেতাঙ্গদের জন্য। বাইবেল! এর যে অন্যথা কিছু হতে পারে, ভাবা যায়? এক ধনাঢ্য শ্বেতাঙ্গ দম্পতির ঘরে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন আমার মা। প্রতি বেলাতেই তারা তার হাতের রান্না খেত। স্নানের সময় যখন তারা বাথটাবে বসত, মাকে বলত তাদের পিঠ ঘষে দিতে। ঈশ্বরই জানেন আর কী কী একান্ত নিজেদের কাজ তারা তাকে দিয়ে করিয়ে নিত। শুধু এক বাইবেল! বাইবেল একটাই, তবু তিনি তা স্পর্শ করতে পারেননি। রং যত ফর্সা হবে, ততই তাকে ভালো বলা হবে। সামাজিক সমাবেশ, পাড়া, গির্জা, মেয়েদের সমিতি, সবখানে এমনকি কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুল পর্যন্ত – একই অবস্থা। তোমরা কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারো, চামড়ার রং অনুসারে আমাদের এভাবে ভাগ করে দেখা মন্দ একটা কাজ; কিন্তু আর কীভাবেই-বা আমাদের ন্যূনতম সম্মানটুকু ধরে রাখতে পারতাম? ওষুধের দোকানে আমাদের গায়ে যে থুতু ছিটিয়ে দেওয়া হতো, এড়িয়ে যেতে পারতাম? বাসস্টপে কনুইয়ের গুঁতো থেকে, শ্বেতাঙ্গদের জন্য রাস্তার সবটুকু পাশ ছেড়ে দিয়ে নালার ওপর গিয়ে দাঁড়ানো থেকে, মুদিদোকানে বিনামূল্যে যে-কাগজের ব্যাগ শ্বেতাঙ্গরা পায়, সেই ব্যাগের প্রতিটির জন্য পাঁচ পয়সা (নিকেল) করে দেওয়া থেকে – আর কী কী ভাবে রক্ষা পেতে পারতাম আমরা? গালাগালের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। এখানে যা কিছু বললাম, সেসব তো বটেই, আরো অনেক কিছু শুনেছি আমি। শুধু তার গায়ের রঙের কারণে দোকানে আমার মা হ্যাট মাথায় দিয়ে কেনাকাটার সময় কিংবা মহিলাদের ওয়াশরুম ব্যবহার করার সময়, তাকে বিরত রাখা হতো না। বাবাও জুতোর দোকানের সামনে বসে জুতো পায়ে দিয়ে দেখতে পারতেন। তাকে পেছনের কোনো রুমে যেতে হতো না। তৃষ্ণায় মরে যাওয়ার উপক্রম হলেও দুজনের একজনও ‘শুধুমাত্র  কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য’ নির্ধারিত ঝরনার পানি পান করতেন না।

আমার বলতে ঘৃণা হয়, শিশু লুলা অ্যান একদম প্রথম থেকেই হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। জন্মের সময় সব বাচ্চার চামড়ার রং – যেমন আফ্রিকার বাচ্চাদের গায়ের রং ফ্যাকাশে থাকে, সেরকম ছিল। কিন্তু দ্রুত তা বদলে গেল। আমার চোখের সামনে ওর রং নীল হলো। তারপর কালো। সেই দেখে মনে হচ্ছিল আমি পাগল হয়ে যাব। ক্ষণিকের জন্য হয়েছিলাম বইকি! কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি ওর মুখের ওপর কম্বল চেপে ধরেছিলাম। চাপও দিয়েছিলাম। কিন্তু যতই আমার ইচ্ছা হোক না কেন, ও এই ভয়ংকর গায়ের রং নিয়ে না জন্মাক – শেষ পর্যন্ত সে-কাজটা আমি করতে পারিনি। এমনকি এও ভেবেছিলাম, ওকে কোথাও কোনো এতিমখানায় দিয়ে দেবো। কিন্তু যেসব মা বাচ্চাদের গির্জার সিঁড়িতে ফেলে রেখে আসে, তাদের মতো হতে আমি ভীষণ ভয় পেতাম।

শুনেছি, সম্প্রতি জার্মানিতে তুষারের মতো সাদা রঙের এক দম্পতির কালো রঙের এক বাচ্চা হয়েছে, যার কোনো ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি। যমজ বাচ্চাদুটোর একটা সাদা হয়েছে, আরেকটা কালো। সত্য কি না জানি না। শুধু জানি, আমার এই শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়ানো মানে একটা নিগ্রোশিশুকে আমার স্তনবৃন্ত চুষতে দেওয়া। বাসায় পৌঁছানো মাত্র আমি ওকে বোতল ধরালাম।

আমার স্বামী লুইস একজন কুলি। সে রেলের কাজ থেকে ফিরে আমার আর বাচ্চার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন আমি সত্যিই একটা পাগল আর বাচ্চাটা যেন এসেছে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে। ক্ষিপ্ত হওয়ার মতো মানুষ নয় সে। তবু যখন বলল – ‘হায় ঈশ্বর! এইটা কী?’ তখনই বুঝেছিলাম আমরা বিপদে আছি। সেই থেকে শুরু হলো ঝগড়াঝাঁটি আর মারধর। বিয়ে ভেঙে গেল আমাদের। এর আগে তিন বছর একসঙ্গে ভালোই সময় কেটেছিল; কিন্তু মেয়ের জন্মের পর দোষ এসে পড়ল আমার ওপর। সে লুলা অ্যানের সঙ্গেও এমন আচরণ করত যেন ও ছিল অপরিচিত কেউ, একজন শত্রু। লুইস কখনো ওকে ছুঁয়েও দেখেনি।

আমি কোনোভাবেই তাকে বোঝাতে সমর্থ হইনি যে, আমি কখনো অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করিনি। সে একেবারে নিশ্চিত ছিল যে, আমি মিথ্যা বলছিলাম – এ নিয়ে তর্ক আর তর্ক। শেষে যখন বললাম, তারই বংশধারা থেকে মেয়েটির গায়ের রং কালো হয়েছে, আমার বংশ থেকে নয়, তখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হলো যে, সে হঠাৎ করেই আমাকে ছেড়ে চলে গেল। তখন আমাকে আরো কম পয়সার বাসা খুঁজতে হলো। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম খুঁজে পেতে। আমি জানতাম বাসা ভাড়ার জন্য আবেদন করতে বেরোলে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে যাওয়া যাবে না। এজন্য আমি আমার কিশোর-বয়সী এক কাজিনের কাছে ওকে রেখে বাসা খুঁজতে যেতাম। আমি মেয়েকে খুব একটা বাইরে নিতাম না। স্ট্রলারে করে নিয়ে যখন বাইরে যেতাম, ওকে দেখার জন্য লোকজন নিচু হয়ে উঁকি দিয়ে সুন্দর কিছু বলতে গিয়ে আঁতকে উঠে ভ্রু কুঁচকাত। আমার খারাপ লাগত তখন। উলটোটা হলে অর্থাৎ আমার গায়ের রং কালো আর মেয়ের গায়ের রং সাদা হলে আমি নিজেই বেবিসিটার হতে পারতাম। উজ্জ্বল-হলুদ বর্ণের চুল হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গ হলে শহরের অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া মুশকিল। যে-সময়ে লুলা অ্যানের জন্ম হয়েছিল, সেটা ছিল নব্বইয়ের দশক। বাসা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও বাড়িওয়ালারা গ্রাহ্য করত না। কারো কাছে বাসা ভাড়া দিতে না চাইলে কোনো-না-কোনো কারণ তারা খুঁজে বের করে ফেলত। আমার ভাগ্য ভালো যে, সাত ডলার ভাড়া বাড়িয়ে হলেও মিস্টার লিহ্ আমার কাছে বাসা ভাড়া দিয়েছিল। তবে ভাড়ার টাকা দিতে সামান্য দেরি হলে সে চেঁচামেচি করত।

মেয়েকে বলেছিলাম আমাকে ‘মা’ বা ‘মামা’ না ডেকে ‘সুইটনেস’ বলে ডাকতে। আমাদের জন্য সেটাই ছিল নিরাপদ। এমন কালো গায়ের রং আর মোটা ঠোঁট নিয়ে আমাকে ‘মামা’ বলে ডাকলে লোকে ধন্দে পড়বে। তাছাড়া তার চোখের রংও বেশ হাস্যকর। কাক-কালো রং, আবার নীলচে আভা, কেমন যেন ডাইনি ডাইনি দেখতে।

মা আর মেয়ে শুধু দুজন আমরা অনেকদিন একা ছিলাম। নিশ্চয়ই তোমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না, একজন পরিত্যক্ত স্ত্রী হওয়াটা কতটা দুর্বিষহ। আমার মনে হয় আমাদের ওভাবে ছেড়ে চলে যাওয়াতে লুইসের একটু খারাপও লাগত। তাই সে কয়েক মাস পরপর আমরা কোথায় আছি, তা খুঁজে বের করে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে শুরু করে। যদিও আমি কখনো তার কাছে পয়সা চাইনি, আদায় করার জন্য কোর্টেও যাইনি। প্রতি মাসে লুইসের পাঠানো পঞ্চাশ ডলার আর রাতে হাসপাতালে আমার চাকরিটা আমাকে ও লুলাকে ওয়েলফেয়ার ছেড়ে দিতে সাহায্য করেছিল। এই একটা ব্যাপার ভালো হয়েছিল। আমার মতে, ওরা একে ‘ওয়েলফেয়ার’ বলা বন্ধ করে ‘রিলিফ’ বললেই ভালো করত, যেমনটি আমার মায়ের আমলে বলা হতো। সেটা শুনতে অনেক ভালো শোনায়। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার আগে স্বল্পসময়ের একটা ব্যবস্থা। শ্বাস নিতে পারা আর কি।

এছাড়া ওইসব ওয়েলফেয়ার ক্লার্ক থুতুর মতোই নীচ প্রকৃতির মানুষ। শেষে আমি যখন একটা কাজ পেলাম এবং আমার আর ওদের সাহায্য নিতে হলো না। তখন আমার আয় ছিল ওদের আয়ের চেয়ে বেশি। ওরা কখনো আমার মতো এত বেশি উপার্জন করতে পারত না। ওদের স্বল্পবেতনের চাকরির জন্যই ওরা এতটা নীচ হয়ে থাকে। সেজন্যই ওরা আমাদের সঙ্গে ভিক্ষুকের মতো আচরণ করত। বিশেষ করে যেভাবে ওরা লুলার দিকে তাকিয়ে পরে আমার দিকে তাকাত, দেখে মনে হতো যেন আমি ওদের ঠকানোর তালে আছি অথবা এরকম একটা কিছু। পরে আমার অবস্থার উন্নতি হলো; কিন্তু আমি সতর্ক থাকতাম। মেয়েকে মানুষ করার ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলাম। আমাকে কঠোর হতে হয়েছিল অনেক। লুলার আচার-আচরণ শেখার প্রয়োজন ছিল। নমনীয় থাকা, কোনো ঝামেলা না-বাধানো – এসব। ও ওর নাম যতবার হয় পরিবর্তন করুক, সে-ব্যাপারে আমার মাথাব্যথা ছিল না। আমি জানি, ওর গায়ের রং ওকে সারাজীবন ক্রুশের মতোই বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু সে-দোষ তো আমার নয়। সে-ভুল আমার নয়। কিছুতেই নয়।

ও হ্যাঁ, ছোট্ট লুলার সঙ্গে আমি কীরকম আচরণ করেছি, কখনো কখনো সে-কথা ভাবলে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু তোমাদের বুঝতে হবে, আমার কাজ ছিল ওকে রক্ষা করা। পৃথিবী সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা ছিল না। চামড়ার ওই রং নিয়ে আর যা-ই হোক কঠোর বা দাপুটে হওয়া চলে না। যতই তুমি সঠিকপথে চলো না কেন, স্কুলে মারামারি অথবা মুখে মুখে উত্তর দেওয়ার কারণে তোমাকে পাঠানো হবে কিশোর অপরাধের তালাবদ্ধ রুমে। কাজে নিয়োগ দেওয়া হবে সবার পরে আর ছাঁটাই করা হবে সবার আগে। ও এসব কিচ্ছু জানে না। ওর চামড়ার কুচকুচে কালো রং দেখে যে শ্বেতাঙ্গরা ভয় পাবে অথবা হাসাহাসি করবে এবং ওকে এজন্য বিপদেও ফেলতে পারে, এসব কথা ও জানে না। আমি একবার একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। লুলা অ্যানের মতো গায়ের রং এত কালো নয় ওর। বয়স খুব বেশি হলে দশ। কোত্থেকে একদল শ্বেতাঙ্গ ছেলে এসে ওকে ল্যাং মারল। পড়ে গিয়ে যখন ও হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, আরেকজন এসে পেছনে লাথি দিয়ে আবার ওকে ফেলে দিলো। সেই ছেলেগুলোর ওর এরকম অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার উপক্রম। তাই পেট ধরে নিচু হয়ে হাসছিল ওরা। মেয়েটি নিস্তার পেয়ে চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরও ওরা হিহি করে হাসছিল। কী তাদের গর্ব! আমি বাসের জানালা দিয়ে ওকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তা না হলে আমি ওকে সাহায্য করতে পারতাম। ওই শ্বেতাঙ্গ আবর্জনা থেকে ওকে টেনে তুলে দূরে নিয়ে যেতাম। দেখো, আমি যদি লুলা অ্যানকে ভালোমতো না শেখাতাম, সে জানত না যে, এই শ্বেতাঙ্গ ছেলেগুলোকে এড়াতে হলে সবসময় ওদের পেছনে ফেলে রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে। সেই প্রশিক্ষণ সত্যিই কাজে এসেছে। এ নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই।

তোমাদের বুঝতে হবে যে, আমি আসলে মন্দ মা ছিলাম না। কিন্তু আমার একমাত্র সন্তানকে রক্ষা করতে হবে বলেই হয়তোবা ওকে কষ্ট দিয়েছি, ওর সঙ্গে কঠোর হয়েছি। আমার কোনো উপায় ছিল না। সাদা চামড়ার বিশেষাধিকারের জন্যই আমাকে ওর ব্যাপারে কঠিন হতে হয়েছে। প্রথমে আমি ভুলতেই পারছিলাম না, গায়ের রং কালো হওয়ার যে কী ব্যথা! আমি এই যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে যদি ওকে শুধু ভালোবাসতে পারতাম, ভালো হতো! আমি সত্যি ওকে ভালোবাসি, এটাই আমি মনে করি।

গত কিছুদিনের মধ্যে ওর সঙ্গে যখন আমার দুবার দেখা হলো, ওকে বেশ ভালো আর আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অদম্য আর আত্মবিশ্বাসী। যতবারই ও আমাকে দেখতে এসেছে – আমি দেখতাম ও ওর গায়ের রঙের সুবিধাটুকু নিয়ে মনোরম সাদা পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করেছে। তখন ও যে এত কালো তা আমার মনেই থাকত না।

আমার মেয়ে আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে, যা আমার সবসময়ই জানা উচিত ছিল। সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার আচরণ কীরকম হওয়া দরকার – এ-ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা এমন একটা বিষয় যে, তারা কখনো নাও ভুলতে পারে। তাই যত তাড়াআড়ি পেরেছে ও আমাকে সেই ভয়ংকর অ্যাপার্টমেন্টে একা ফেলে রেখে যতদূর সম্ভব চলে গেছে। নিজেকে পরিপাটি পোশাকে সাজিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় বড় চাকরি পেয়েছে। মেয়ে আমাকে ফোন করে না, দেখতেও আসে না। কখনো কখনো টাকা, জিনিসপত্র পাঠায়। কিন্তু অনেকদিন আমি ওকে দেখিনি – কতদিন হবে জানি না।

উইনস্টন হাউজ – এ-জায়গাটা আমার পছন্দের। শহর থেকে বাইরের একটা ব্যয়বহুল নার্সিংহোম আছে এখানে। আমি যেখানে থাকি সেটা ছোট, গৃহতুল্য, সস্তা। এখানে চব্বিশ ঘণ্টা নার্স ও ডাক্তার থাকে এবং সপ্তাহে তারা দুবার আসে। আমার বয়স মাত্র তেষট্টি – অবসরে যাওয়ার মতো এতটা বয়স আমার হয়নি। কিন্তু আমার হাড়ের রোগ হয়েছে, ভালো সেবাযতœ খুব প্রয়োজন। তবে এখানে একঘেয়ে লাগে। শরীরের দুর্বলতা বা ব্যথার চেয়ে বেশি খারাপ সেটা। কিন্তু নার্সরা ভালো। যখন এদের একজনকে বললাম যে, আমি নানি হতে চলেছি, তখন সে আমার চিবুকে চুমু খেল। তার হাসি আর মন্তব্য ছিল মন-ভরানো, যেন কাউকে মুকুট পরিয়ে সম্মান দেওয়া হচ্ছে। লুলার কাছ থেকে পাওয়া নীল কাগজে লেখা নোটটা আমি ওকে দেখালাম। নিচে লুলার স্বাক্ষর – ‘কনে’। বিয়ে করেছে ও। আমি অবশ্য এসব তেমন খেয়াল করি না। ও খুশি হয়ে লিখেছে – ‘ভাবতে পারো সুইটি, আমার একটা বেবি হবে – এ-খবর দিতে আমার যে কী সুখ! আমি তো রীতিমতো রোমাঞ্চিত! আশা করি তুমিও রোমাঞ্চিত হবে।’ দেখলাম, এই থ্রিলটা ওর বাচ্চাকে নিয়ে, বাচ্চার বাবাকে নিয়ে নয়। যে-কারণে তার নাম একবারও উল্লেখ করেনি। আমি ভাবি, ওর বর ওর মতোই এমন বিশ্রীরকমের কালো কি না। তাই যদি হয়, তবে বাচ্চাকে নিয়ে আমার মতো ওকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি যখন ছোট ছিলাম – এখন সামান্য পরিবর্তন হয়েছে সেই সময়ের। টেলিভিশন, ফ্যাশন ম্যাগাজিন, বিজ্ঞাপন, এমনকি মুভিতে পর্যন্ত এখন নীলাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গী – সবরকম মানুষকেই দেখা যায়।

সেই খামে ফিরতি ঠিকানা নেই। ভেবেই নিচ্ছি আমি সেই মন্দ মা-ই রয়ে গেছি। এজন্য মৃত্যুর দিন পর্যন্ত শাস্তি পেতে হবে আমাকে। কিন্তু যা করেছি ভালো উদ্দেশ্যেই করেছি। আসলে ওকে এভাবে বড় করার প্রয়োজন ছিল। লুলা অ্যান আমাকে ঘৃণা করে। ও আমাকে টাকা পাঠায় – আমাদের সম্পর্কটা এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বলতেই হয়, ওর পাঠানো এই নগদ টাকার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। অন্য রোগীদের মতো বাড়তি খরচের জন্য আমার হাত পাততে হয় না। একা একা যে-তাস খেলি তার জন্য আমাকে লাউঞ্জের জীর্ণ, নোংরা কার্ড দিয়ে খেলতে হয় না। আমার তা কেনার সামর্থ্য আছে। আমার মুখের জন্য বিশেষ ফেসক্রিমও আমি কিনতে পারি। কিন্তু আমি বোকা নই। আমি জানি এই টাকা পাঠানো আমার কাছ থেকে দূরে থাকার একটা ছল ওর। সামান্য যে-বিবেকটুকু অবশিষ্ট আছে ওর, সেটাই আমাকে বোঝায়।

মনে হতে পারে, আমি হয়তো বিরক্তিকর আর অকৃতজ্ঞ একজন নারী। ছোট ছোট যেসব কাজ আমি করেছি, ভুল করেছি, সেজন্য গভীর অনুতাপ আছে আমার। মনে আছে, যখন প্রথমবার সে ঋতুবতী হলো তখন আমার প্রতিক্রিয়া কীরকম ছিল। আবার ও যদি হোঁচট খেত অথবা ওর হাত থেকে যদি কিছু পড়ে যেত, আমি চিৎকার করতাম। সব সত্যি ছিল। আমি সত্যিই খুব রেগে যেতাম। এমনকি ওর জন্মের সময় ওর গায়ের রং কালো দেখে আমি ক্ষিপ্ত হই। প্রথমে মনে হয়েছিল … না থাক। সেসব স্মৃতি আমাকে দ্রুত পেছনে ফেলে আসতে হবে। এর কোনো মানে হয় না। আমি জানি যে, অবস্থার শিকার ছিলাম, তারপরও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি সবকিছু মানিয়ে চলার। আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে চলে গেল যখন, লুলা অ্যান আমার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াল। ভারী এক বোঝা; কিন্তু আমি তা ভালোভাবেই বহন করেছি।

হ্যাঁ, আমি লুলার সঙ্গে অনেক কঠিন আচরণ করেছি। যখন ওর বয়স বারো পূর্ণ হলো এবং তেরোতে পড়বে, তখন আমাকে আরো কঠোর হতে হয়েছিল। সে মুখে মুখে তর্ক করত, যা রান্না করতাম তা খেতে চাইত না। নিজের মতো করে চুল সাজাত। আমি বেণি করে দিলে স্কুলে গিয়ে তা খুলে ফেলত। আমি চাইনি ও বখে যাক। আমি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সাবধান করতাম ওকে। বলতাম – কী কী বলে ওকে গালি দেওয়া হবে। এরপরও আমার কিছু কিছু শিক্ষাদান ওর কাজে এসেছে। দেখো, আজ ও কী হয়েছে? এক ধনী কর্মজীবী নারী। আর কী চাই?

এখন সে সন্তানসম্ভবা। খুব ভালো, লুলা অ্যান। যদি ভেবে থাকো মাতৃত্ব শুধু পাখির কূজন, পা নাড়ানো, ডায়াপার পরানো, এসব – তবে প্রচ- ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো। প্রবল ধাক্কা! তুমি, তোমার নামহীন ছেলেবন্ধু, যাকে যেখান থেকে তুলে নাও – যে কেউ – চিন্তা করে দেখো – উহ্! বাচ্চা! কিচি কিচি কু!

শোনো, তুমি খুব শিগগির জানতে পারবে এজন্য কী প্রয়োজন, জানতে পারবে এ-পৃথিবীটা কেমন আর তুমি যখন একজন মা হবে, তখন কীভাবে সবকিছু বদলে যায়।

ভাগ্য প্রসন্ন হোক তোমার। আর ঈশ্বর, তুমি আমার এই সন্তানকে সাহায্য করো।