সুজয়েন্দ্র দাস
১০জানুয়ারি, ২০১৬ সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ৬৬তম জন্মদিবস। ইংরেজি ২০১৫-এর ১২ মে রাত্রিতে বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্য চিরশামিত্মধামে যাত্রা করেন। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ৬৬তম জন্মদিন তাঁর পরিবারের লোকেরা উদ্যাপন করবেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ও পাঠকেরা নিশ্চয় অনুভব করবেন যে, তিনি যদি আরো কয়েক বছর জীবিত থাকতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের ভা-ার আরো সমৃদ্ধ হতো।
সেই ইংরেজি ২০০৪ থেকে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সম্পূর্ণ সাহিত্যসেবায় নিজেকে আমৃত্যু নিয়োজিত করেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। সরকারি চাকরি থেকে নিজ ইচ্ছায় অবসর নিয়ে একেবারে সাহিত্যসেবায় মনোনিবেশ করা আজকের দুনিয়ায় এক দুর্লভ ঘটনা। তাঁর জীবনের নীতি ছিল ‘সৎ হও, সব রকম লোভ-লালসা ত্যাগ করে নিজের জীবনকে আরো পরিশীলিত ও সংযত করে তোলো।’
আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে সুচিত্রা ভট্টাচার্য উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরে আনন্দ পাবলিশার্সের এক বিক্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর কলকাতা ফেরার জন্য তিনি তোড়জোড় করছিলেন, ঠিক তখনি অঝোরধারায় বৃষ্টি নামল। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গিয়ে এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মানুষের চলাফেরায় বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। ঠিক এই মুহূর্তে সুচিত্রা ভট্টাচার্য নৈহাটির পিচ্ছিল রাস্তায় পড়ে গিয়ে ডান হাতের মাঝামাঝি হাড়ে প্রচ- আঘাত পান। সেই হাড় চার টুকরো হয়ে যায়। তারপর থেকে কতবার নার্সিংহোম-বাড়ি, বাড়ি-নার্সিংহোম করতে হয়েছে তাঁকে, তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। এই আঘাত লাগার ফলে তাঁর ডান হাত প্রায় অকেজো হয়ে গেল। তবু তিনি দমবার পাত্রী ছিলেন না।
সাহিত্যে নব সৃষ্টি, নব উদ্ভাবন, তাঁর রক্তের মধ্যে গাঁথা। বাড়িতে নতুন করে কম্পিউটার বসিয়ে হাতের একটিমাত্র আঙুল দিয়ে আমৃত্যু কাজ চালিয়ে গেলেন। এ-ব্যাপারে তাঁর সহ্যশক্তি ও সাহসিকতা অত্যমত্ম প্রশংসনীয়। সহ্যশক্তি ও সাহসিকতা সম্পন্ন মানুষ হলেও তাঁর যে মানসিক জ্বালা-যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ওই দুর্ঘটনার পর, তা ভালোমতন প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর সহ-লেখক-লেখিকা ও শুভানুধ্যায়ীর নিকট। তাঁদের খালি জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি আরো নব-নব সৃষ্টিতে সফল হবেন কি না। এর ফলে ধীরে-ধীরে তাঁর শরীর ভাঙতে আরম্ভ করল।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের জীবৎকাল মাত্র ৬৫ বছর হলেও তিনি ২৪টি উপন্যাস ও অসংখ্য ছোটগল্প লিখে গেছেন। তাঁর সাহিত্যভা-ার থেকে বহু চমকপ্রদ নিবন্ধও আমরা লাভ করেছি। এছাড়া শিশুদের জন্য তাঁর সৃষ্টি মিতিন মাসি সমগ্র কোনোদিন ভোলা যাবে না। তাঁর উলেস্নখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে দহন, ভাঙনকাল, হেমমেত্মর পাখি, কাছের মানুষ, অলীক সুখ, আমি রাইকিশোরী প্রভৃতি। তাঁর শেষ উপন্যাস ২০১৫-এর দেশ শারদ সাহিত্যসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। নাম পথে বিঁধে বিঁধে…। সত্যিই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতন রচনা। নিজের জীবনের নানান যন্ত্রণা এবং গ্রিক অর্থনীতির ধ্বংসাবশেষ – এই চিত্রগুলি তাঁর ওই উপন্যাসের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এতে তিনি নিজের জীবনের শেষ প্রামেত্মর কথা ব্যক্ত করেছেন।
শিশুসাহিত্যে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি সমগ্র এক অনবদ্য সৃষ্টি। এটি পাঠ করলে অনুভব করা যায় শিশুদের প্রতি তাঁর কী প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সবার প্রতি অত্যমত্ম আমত্মরিক ছিলেন।
তাঁর রচিত উপন্যাসের কয়েকটি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম দহন।
সৃষ্টিশীল কর্মে ছোটদের আগ্রহী দেখতে পেলে তিনি খুবই উৎসাহ দিতেন। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। দুবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখনই খোঁজখবর নিয়েছিলেন কী বই পড়লাম। মানুষটা সব সময়ে হাস্যময়ী ছিলেন, তা তাঁর পাঠক-পাঠিকারা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না।
সাহিত্যসৃষ্টি ছাড়াও সমকালীন ঘটনাধারা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ও জ্ঞানী ছিলেন। কলকাতার প্রতিটি টিভি চ্যানেলে তিনি সমকালীন বিষয় নিয়ে তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও তিনি এবিপি আনন্দ টিভি চ্যানেলে একটি রাজনৈতিক আলোচনাচক্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সর্বদা মানুষের কল্যাণ কামনা করে গেছেন; বিশেষত মহিলাদের জন্য, তাঁরা যেন জীবনে সফল হন, বিশেষ করে সংসারজীবনে সুখী হন। তাই শ্রদ্ধেয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও শ্রদ্ধেয়া নবনীতা দেবসেনের ক্ষিাভ যে, আশাপূর্ণা দেবীর কাছাকাছি পৌঁছেও অকালে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের জীবনপ্রদীপ নিভে গেল। মহিলাদের উন্নয়নকল্পে লড়াই করার মতন তেমন কেউ আপাতত জীবিত নেই বাংলা সাহিত্যে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.