সুনীলের জন্যে শোক

আহমেদ মাওলা
বাংলা সাহিত্যের সুনীল আকাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২) আর নেই। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। কিন্তু তিনি ছিলেন এবং আছেন কোটি পাঠকের হৃদয়জুড়ে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় থাকবেন চিরকাল আত্মার আত্মীয় হয়ে। আমাদের এই মল্লযুগে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন না, আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের যুগের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন বহুমাত্রিক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বহুলপ্রজ। না, পাঠক ভুল বুঝবেন না; আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুনীলের তুলনা করছি না। সুনীল আকাশেই তো রবি বিরাজ করে। শোনা যায়, তরুণ বয়সে সুনীলরা নাকি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে কবিতা লিখেছেন। পরিণত বয়সে এসে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার-অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কার। এই বই পড়ে জেনেছি, সুনীলরা সারাদিন রবীন্দ্রনাথের চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে রাতে মুগ্ধ হয়ে গোপনে পড়েছেন লিপিকা। তারুণ্যের উদ্দামতায় তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে গিয়ে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথকে। এভাবেই হয়ে ওঠা, ব্যক্তি সুনীলের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগে থেকে সুনীল হয়ে ওঠেন আমাদের আরাধ্য-পাঠ্য। তাঁর লেখা পড়ে পড়ে আমাদের চোখ-কান-মন তৈরি হয়েছে। আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন সুনীল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শীর্ষেন্দু মুখোপধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন – এঁদের লেখার তুলনা-প্রতিতুলনা করে, বন্ধুদের আড্ডায় রাগারাগি করে কতদিন বাড়ি ফিরেছি। চিঠি লিখেছি সুনীলদার কাছে। মাস পেরোতেই সুনীলদার উত্তর পেয়েছি। ঢাকা এসেছেন শুনে কতবার ছুটে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। অন্তরঙ্গ আড্ডায় যতবারই অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি সুনীলদার হৃদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশ। দেশ বিভাগ তাঁর হৃদয়কে বিভক্ত করতে পারেনি। মাতৃভূমি তাঁকে আকুল করে টানত। নাহলে তিনি কী করে লিখেছিলেন সেই অমোঘ পঙ্ক্তি – ‘বিষণ্নআলোয় এই বাংলাদেশ…/ এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি/ যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো/ আমি বিষ পান করে মরে যাবো।’ – হায়! কোন জগতে নির্বাসনে গেলেন সুনীলদা!
সম্প্রতি পড়লাম তাঁর অন্যরকম একটি বই সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই। এই বই পড়ে সাহিত্য সম্পর্কে আমার এতদিনের সব ধারণাই ভেঙে গেল। পূর্বপ্রচলিত কত ভুল নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ি এবং পড়াই! কোনো অ্যাকাডেমিক বিবেচনা নয়, একজন লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার এক তূরীয় প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই গ্রন্থটির লেখাগুলোর মধ্যে। পায়ের তলায় সরষে গ্রন্থের নাম দেখেই চমকিত হলাম। লেখা পড়ে আরো বিস্মিত। দেখার দৃষ্টি এরকম হতে পারে! এতো বৈভব, এতো ঐশ্বর্য থাকতে পারে চোখের পাতায়!
সুনীল-শক্তি-বেলাল চৌধুরীর সেই কৃত্তিবাস পত্রিকার উত্তাল জীবনস্মৃতির কথা পড়ে উদ্বেল হয়েছি। কবি হিসেবে সুনীলের আসন তখনই পাকাপোক্ত। তারপর গল্প, উপন্যাস, কিশোর সাহিত্য, ভ্রমণকাহিনি, নাটক, প্রবন্ধ দুহাতে লিখে বাংলাভাষী পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন সুনীলদা। প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ, দ্বিতীয় উপন্যাস অরণ্যের দিনরাত্রি আমরা পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। আমাদের পুরো প্রজন্ম তিনি আচ্ছন্ন করে ফেললেন প্রায়। ‘সনাতন পাঠক’ কিংবা ‘নীললোহিত’ ছদ্মনামে লেখাগুলো কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়–য়া পাঠকদের মুগ্ধ করল। আমরা বিস্মিত হয়ে পড়ি তাঁর লেখা অর্জুন কিংবা আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি উপন্যাস। সন্তু ও কাকাবাবু পড়ে একবার মায়াজালে বন্দি হলাম। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস  সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম, জীবন যে রকম, অর্ধেক জীবন, রক্তমাংস, একা এবং কয়েকজন, প্রতিদ্বন্দ্বী, মহাপৃথিবী ও মনের মানুষ পড়লে মনে হয়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছে আসলে উপন্যাস লেখার জন্যে। না হলে তিনি কী করে তুলে ধরতে পারেন ব্যক্তিমানুষের অন্তঃজীবন? মনের গহিনে গোপন ভাবনার কথা এমন সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরার জন্যেই সুনীলের জন্ম হয়েছে।
উপন্যাসে সুনীলের বিষয়বৈচিত্র্য যেমন পাঠককে মুগ্ধ ও বিহ্বল করত, তেমনি বিচিত্র পেশা ও জাতের মানুষ ভিড় করেছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসে কাল বা সময় হয়ে উঠেছে নায়ক, সময়ই যেন মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, কাহিনির গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে সময়। সেই সময় বা প্রথম আলো উপন্যাস তাই ইতিহাস নয়, হয়ে উঠেছে সময়ের বিনির্মাণ। তাঁর উপন্যাসের ডিটেইল বা অন্তর্বয়ন প্রায় তলস্তয়ের মতো। দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত ছাড়া বাংলা উপন্যাসে সুনীলের মতো অন্তর্বয়নের ক্ষমতা আমার চোখে পড়েনি। উপন্যাসে সময়কে ব্যবহারের পাশাপাশি পটভূমি বা ভূগোলকেও সুনীল ব্যবহার করেছেন সচেতন প্রজ্ঞা দিয়ে। তাঁর পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে শুধু সময় নয়, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী চেতনা ছাড়াও ভূগোলের চমৎকার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। মানুষের জীবন যে কত বিচিত্র হতে পারে, সেই বৈচিত্র্যময় জীবনকে তুলে ধরার জন্যে উপন্যাসের আঙ্গিকও যে কত প্রকার হতে পারে, তা একমাত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়লে বোঝা যায়।
কাহিনিবিন্যাস আর চরিত্রসৃজনই যে ঔপন্যাসিকের একমাত্র কাজ নয়, তা ভালো করে বোঝা যায়, যখন পড়ি অরণ্যের দিনরাত্রি, সরল সত্য, অর্জুন, প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা রক্তমাংস। তাঁর মনের মানুষের সঙ্গে কি মেলানো যায় রক্তমাংস উপন্যাস? অথবা জীবন যে রকমের সঙ্গে সোনালী দুঃখ উপন্যাসের কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপন্যাসে মূলত জীবনকে সন্ধান করেছেন, জীবনকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, জীবনকে স্পর্শ করতে চেষ্টা করেছেন। একজন নিমগ্ন পাঠক হিসেবে সুনীলের উপন্যাস থেকে আমি অনেক দীক্ষা নিয়েছি, সুনীলের কাছে এটাই আমার সবচেয়ে বড় ঋণ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পড়লে মনে হয়, বুঝি কবিতা লেখার জন্যেই তাঁর জন্ম হয়েছে। একটা জীবন বিকিয়ে দিয়েছেন, উৎসর্গ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কেবল কবিতার কাছে, কবিতার জন্যে।
সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ অথবা ‘যদি নির্বাসন দাও’, ‘হারিয়ে যেয়ো না নীরা’ এবং ‘তুই একবার এসে দেখে যা নিখিলেশ’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর আসন দেবে নিশ্চয়। উত্তর-কৈশোরে আমি যখন পদ্যমাতাল ছিলাম, তখন ঠোঁটস্থ এসব কবিতা পড়ে আড্ডার বন্ধুদের কতোবার অবাক করে দিয়েছি। সেসব স্মৃতি গাঢ় অশ্র“জল হয়ে নেমে আসে।
এ-বছরটা কেন জানি বড় কষ্টের বছর। হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও জীবনাবসান হলো। বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের দুই কিংবদন্তি। এ শোক আমরা কোথায় রাখি! কষ্টটা আমি একা নিতে পারছি না। এর কাছে, ওর কাছে ফোন করি, ইমদাদুল হক মিলনের কাছে ফোন করলাম। তিনি ফোনে কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। শেষে শিশুদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন। নিজে সান্ত্বনা খুঁজব কী, তাঁকে শান্ত করতে ভাষা খুঁজে পাই না। বুঝলাম, লেখকরা বড়ই সংবেদনশীল, দুঃখ-কষ্ট দ্রুত সঞ্চারিত হয়ে যায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। মিলনভাই-আমি দুজনই ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে দুজনেই স্মৃতি হাতড়াই। হাসি-আনন্দের স্মৃতি অশ্রুসিক্ত হয়ে ঝরে পড়ে। শোকে মুহ্যমান দুজন মানুষ পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে কাঁদে, আমরা দুজনও শব্দ করে কাঁদি। আমার ভেতরের অস্থিরতা কমে না। ঘরের ভেতর পায়চারি করি আর ফাঁকে-ফাঁকে মনে পড়ে সুনীলদার সঙ্গে কত স্মৃতি। চোখের ভেতরে, মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেসব দিনরাত্রির কথা।