সুনীল ও তাঁর কবিতায় নিরন্তর আত্মস্বীকারোক্তি

অঞ্জন আচার্য 

‘নিজের কবিতা বিষয়ে কিছু লেখা এক বিড়ম্বনা মাত্র। তাতে প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় যে, আমার কবিতার বিশেষ কিছু মূল্য আছে। আমি নিজে বিশ্বাস করি, এতদিন শুধু কবিতা রচনার চর্চা করেছি মাত্র, আসল কবিতা এখনও লেখা হয়নি। এক অসম্ভব অতৃপ্তি ও যাতনা – যা অন্য কারুর পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব – আমাকে একটি নতুন কবিতা লিখতে বাধ্য করে। সেটি শেষ করার পরই সেই অতৃপ্তি ও যাতনা আবার শুরু হয়। চিকিৎসার অতীত ক্ষয়রোগের মতন এরা আমার সারা জীবনের সঙ্গী থাকবে।’ সুনীল সম্পর্কে সুনীলের রচনায় এভাবেই কবি সুনীলকে আয়নার সামনে দাঁড় করান ব্যক্তি সুনীল। এই ক্ষয়রোগ প্রতিটি কবিকেই হয়তো বহন করতে হয়। সুনীলও এর বাইরের কেউ নন। তিনি বহন করেছিলেন, আর করেছিলেন বলেই তিনি প্রধানত কবি; তারপর অন্য কিছু। এ-কথার গ্রহণযোগ্যতা মেলে সুনীলকে নিয়ে লেখা কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি সমালোচনা-নিবন্ধে। তাঁর মতে, ‘কবিতা লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছিল নেশা। গল্প, উপন্যাস লেখা ছিল তাঁর (সুনীল) পেশা বা কাজ।’ (‘ভ্রাম্যমাণ লেখকের স্মৃতিসঞ্চয়’, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বইয়ের দেশ, এপ্রিল-জুন ২০১০, পৃ ৩৭)। অর্থাৎ অর্থের জন্য সাহিত্যের নানাবিধ শাখায় বিচরণ করলেও কবিতার অঙ্গনটি ছিল সুনীলের একান্ত আপন। বলতে গেলে সেই রহস্য গভীর গোপন।

১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকা। সেখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় সুনীলের কবিতা। দেশের বয়স তখন ১৮। আর কবির বয়স ছিল ১৭। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। তখনো কবির নামের পেছনে ঝুলে ছিল ‘কুমার’ শব্দটি। এরপর ১৫ জানুয়ারি ১৯৫৫ সংখ্যায় ‘কুমার’ শব্দটি খসে পড়ে কবির নাম থেকে। নাম হয় শুধুই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথম লেখাটি ছিল এক কিশোরীর মন পাওয়ার আশায় রচিত। কারণ সুনীল জানতেন, সেই কিশোরীর বাসায় অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে রাখা হতো দেশ পত্রিকাটি। তাই তার মন পাওয়ার জন্য অথবা নিজের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার জন্য বের করলেন অভিনব এক বুদ্ধি। নিজেকে কবি হিসেবে কিশোরীর কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে একরকম পথ বেছে নেন তিনি। সুনীলের নিজের কথায় – ‘একটি রচনা ঝোঁকের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। কবি-খ্যাতির আশায় নয়, শুনেছিলাম, কোনো লেখা ছাপা হলে সেই পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সত্যিই ডাকযোগে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্যাকেট পেলাম। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৫১ সালের কোনো এক মাসের ‘দেশ’ পত্রিকায়, কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’ (দেশ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক হর্ষ দত্তের হিসাবমতে ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যা; সূত্র : ‘প্রিয় ‘দেশ’, প্রিয় ‘মানুষ’, হর্ষ দত্ত, দেশ, ১৬ কার্তিক ১৪১৯, ২ নভেম্বর ২০১২, ৮০ বর্ষ, ১ সংখ্যা, পৃ ৪০)। বন্ধুবান্ধব এবং সেই কিশোরী আমায় বলেছিল দেখেছ, দেশ-এ একজন একটা কবিতা লিখেছে। ঠিক তোমার সঙ্গে নাম মিলে গেছে। আমিই যে ওটা লিখতে পারি কেউ কল্পনাও করেনি, আমিও বলিনি।’ প্রথম কবিতা প্রকাশের আরো কিছু তথ্য জানা যায় সে-সময়ে দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদক কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এক লেখায় – ‘আমি এককালে দীর্ঘ পঁচিশ বছর দেশ পত্রিকায় কবিতাবিভাগ সম্পাদনা করেছি। একদিন ফাইল খুলে দেখি প্রচুর কবিতা জমে আছে। কিছু কবিতা মনোনীত হত, অমনোনীত কবিতা ডাকটিকিট থাকলে ফেরত পাঠানো হত, নাহলে ফেলে দিতে হত। সেখানে সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজনের কবিতা আমার খুব ভাল লেগে যায়। আমি সেই কবিতাটি মনোনীত কবিতার ফাইলে রেখে দিই। …নতুন কেউ ভাল লিখছে, এ তো খুবই আনন্দের। আমি তখন সুনীলকে একটা চিঠি লিখি, ঠিকানা দেওয়া ছিল তো। সুনীল পরে আমাকে বলে যে, চিঠিটা পেয়ে সে খুব সঙ্কোচ বোধ করেছিল। সুনীল আর সেই চিঠির কোনও উত্তরই দেয়নি।’ (‘কখনও মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৭)।

কবিতাটি যে সুনীল সেই কিশোরীর উদ্দেশেই লিখেছিলেন তা তিনি ওই বয়সে না হোক; পরে অবশ্য অকপটেই স্বীকার করেছেন তাঁর অনেক লেখায়। তাছাড়া সে-সময় প্রেমের ক্ষেত্রে কবিদের পাতে মোটামুটি ভাত জুটতো বলা যায়। আর সাহিত্যপ্রেমী নারীদের কাছে তো কথাই নেই। যাই হোক, হুট করে একদিন দেশ পত্রিকার দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কবিতা, ছাপাও হয়ে গেল। তবে ঘটনা অন্য জায়গায়। সেই কবিতা দেখিয়ে ওই কিশোরী এসে সুনীলকে বলেছিল – ‘দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় একজনের কবিতা বেরিয়েছে। তার নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ দেখ কান্ড! যে-কিশোরী এ-কথাগুলো বলছিল তার চোখের সামনেই যে স্বয়ং কবি দাঁড়ানো তা তাকে কে বোঝায়? তার ওপর মেয়েটি জানতেও পারেনি সেই কবি তার উদ্দেশেই এ-কবিতা লিখেছেন। নিজের কবিতার বিষয়ে অক্লেশে বলে গেছেন সুনীল, কোনো রাখঢাক কখনো কোথাও ছিল না (কেবল নীরা-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর ছাড়া, এ-প্রশ্নে সুনীল বরাবরই বড় রহস্যময় ছিলেন) – ‘আমি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি একটি মেয়েকে উদ্দেশ করে, আমার বয়েস তখন পনেরোর একটু কম (হিসেব অনুযায়ী ১৭)। কিন্তু কথা হচ্ছে এই, হঠাৎ আমি কবিতা লিখতে শুরু করলাম কেন? আমাদের বংশে বা পরিবারে কেউ কখনো লেখক ছিলেন না। সাহিত্যানুকূল আবহাওয়া ছিল না আমাদের বাড়িতে। আমার ধারণা থাকা স্বাভাবিক ছিল যে, কবিতা রচনা অন্য একপ্রকার মনুষ্যজাতির কাজ – কারণ আমার চেনাশুনো আত্মীয়স্বজন, বাবা-কাকা-জ্যাঠামশাইরা আহার-বাসস্থান সংগ্রহেই ব্যতিব্যস্ত। তবে আমার মধ্যে দুর্বলতা হঠাৎ জেগে উঠলো কীভাবে?’ (সূত্র : কবিতার সুখ-দুঃখ, যুগলবন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; প্রথম দে’জ সংস্করণ : শ্রাবণ ১৪০২, আগস্ট ১৯৯৫, পৃ ৯)

এ-প্রসঙ্গে সুনীল তাঁর সাহিত্যের কোন শর্ত নেই গ্রন্থের ‘স্বীকারোক্তি, স্মৃতি, স্বপ্ন’ শিরোনামের লেখায় এভাবেই উত্তর দিয়েছেন নিজে – ‘দুটি কারণে আমি প্রথম কবিতা লিখি। প্রথম যে বালিকার প্রণয়ে লিপ্ত হই সে কবিতা পড়তে ভালবাসত – সে আমাকে যেসব চিঠি লিখত, তার অধিকাংশই কবিতার লাইনে সাজানো। সুতরাং তাকে মুগ্ধ করার জন্য স্বরচিত কবিতায় একবার চিঠি লেখার কথা মাথায় এল। এই সময়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরবর্তী ছুটিতে, আমার বাবা আমাকে দুপুরবেলা বাড়িতে আটকে রাখবার জন্য টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে দিতেন। কয়েকদিন বাদেই আমি নিজেই একটি কবিতা টেনিসনের বলে চালিয়ে দেই। সেটাই সন্ধেবেলা সেই বালিকাটির হাতে দিই, আমার নতুন চিঠি হিসেবে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না ওটা পুরোপুরি আমার লেখা। তখন কবিতাটি কপি করে ডাকে পাঠিয়ে দিই ‘দেশ’ পত্রিকার ঠিকানায়। …‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় আমার কবিতা, নাম ‘একটি চিঠি’। তখন আমি কলকাতার রাস্তাঘাটও ভাল করে চিনি না, ‘দেশ’ পত্রিকার কার্যালয় কোথায় তাও জানি না। আমি শুধু বন্ধুদের ও সেই বালিকাটিকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে, ঐ কবিতাটি আমারই লেখা এবং কবিতা লেখার ব্যাপারটা এমন কিছু শক্ত না।’ (‘কালের খেয়া’, সমকাল, ২ নভেম্বর ২০১২, পৃ ৬)।

কবি হওয়ার জন্য সুনীল মোটেও প্রস্ত্তত ছিলেন না। কবিতার আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়নি তাঁকে কিশোর বয়সে। কবি হওয়ার স্বপ্ন তো দূরে থাক, বরং জীবনে তাঁর স্বপ্ন ছিল জাহাজের খালাসি হয়ে দেশে দেশে ভ্রমণ করার। ছাত্র বয়স থেকেই পায়ের তলে সর্ষে নিয়ে হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন সুনীল। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনো দূরাকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। কলেজ-জীবনেও তাঁর সেই জাহাজের খালাসি হওয়ার স্বপ্নটা জিইয়ে ছিল। জাহাজের খালাসির চাকরি অবশ্য তাঁকে করতে হয়নি। তবে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে দিকশূন্যপুর যাত্রী নীললোহিতকে। নতুন কোথাও বেড়ানোর নেশা আমৃত্যু লালন করে গেছেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬ অক্টোবর ২০১২ সালে প্রকাশিত সম্পাদকীয় পাতায় ‘শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ শিরোনামে যে-স্মরণ অংশটি প্রকাশিত হয় যেখানেও উঠে আসে সুনীলের আমৃত্যু বোহেমিয়ান চরিত্র – ‘ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউইয়র্ক থেকে শান্তিনগর – সুনীলের উৎসাহ সমান।’ সুনীলের আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তি – ‘অনেক লেখকের খুব বাল্যকাল থেকে সাহিত্য রচনার দিকে অনেক ঝোঁক দেখা যায়। আমার ছিল না। আমি বই পড়তে ভালবাসতাম, বই লেখার দায়িত্ব অন্য লোকের। আমার ঝোঁক ছিল নানারকম অ্যাডভেঞ্চারের দিকে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি কোনও না কোনও বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ বাইরে কোথাও চলে যেতাম। এমনও হয়েছে, সিমলা শহরের স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে বসে বিখ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি আমি আর আমার বন্ধু দীপক মজুমদার, পেটে দাউদাউ করে জ্বলছে খিদের আগুন, পকেটে একটাও পয়সা নেই, রাত্তিরে কী খাব তার ঠিক নেই। শুধু সঙ্গে আছে একটি রেলের পাস, তাও অন্যের নামে, সেটার সাহায্যে আমরা যে কোনও জায়গায় চলে যেতে পারি। …অনেকের মতো আমারও ছেলেবেলা থেকেই বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। জাহাজে আলুর খোসা ছাড়াবার চাকরি নিয়েও কোনও একদিন বিদেশে যাব, এ রকম ভেবে রেখেছিলাম এবং আর ফিরব না। সত্যি সত্যি বিদেশে যাবার কিছুদিন পরেই আমি ছটফটিয়ে উঠেছিলাম, আমার মন টেকেনি। তখন আমার কোনও বন্ধন ছিল না। যে কোনও ছুতোনাতায় বাইরের যে কোনও দেশে পাঁচ-সাত বছর কাটিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসেই, কিন্তু বাংলা ভাষা আমার মর্মে এমন গেঁথে গেছে যে এই আবর্জনা-ভরা, শত অসুবিধেয় ভরা কলকাতা ছেড়ে কিছুতেই বেশি দিন দূরে থাকতে পারি না।’

‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’ শিরোনামের লেখায় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে – ‘যখন এ লেখা লিখছি, তখন সুনীল বড় একা হয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা ঘরে, পিস হ্যাভেনে। ডোরবেল বাজিয়ে কেউ আসবে না আজ। সুনীল উঠে গিয়ে দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে বলবে না, আরে, এসো এসো -! … বেড়াতে যেতে বড় ভালবাসত সুনীল। নতুন অচেনা কোনও জায়গায় যাওয়ার কথা শুনলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত চোখ। আজও সুনীল চলল নতুন এক দেশে।’ (‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেশ, ১৬ কার্তিক, ১৪১৯; ২ নভেম্বর ২০১২; ৮০ বর্ষ; ১ সংখ্যা, পৃ ২৩)

আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায় – ‘সুনীল খুব বড় মাপের লেখক, আবার খুব বড় মনের মানুষও বটে। ওর সমসাময়িক যাঁরা সাহিত্যিক, ও চেয়েছে তাঁদের প্রাপ্যটা যেন তাঁরা পান। ওর মধ্যে কখনও ঈর্ষা, হিংসা দেখিনি। ওর চেয়ে বয়েসে যারা ছোট, তাদের দিকে ও সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, তা নয়, সংসার চালানোরও একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া! যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এসব ব্যাপারে প্রখর নজর ছিল সুনীলের। … এখান থেকেই বলা যায়, সুনীল ভালবাসাকেই তার ধর্ম বলে মেনে এসেছেন। ও বিশ্বাস করত, ভালবাসার ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষের সব অসুখ সারিয়ে তোলা যায়! ধর্মে বিশ্বাস না করুক, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করুক, কিন্তু ভালবাসায় বিশ্বাসী। আসলে, কবিদের কাছাকাছি পৌঁছতে হলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একটা মইয়ের প্রয়োজন হয়, নইলে নাগাল পাব না তো! … সুনীল ঘোষিত নাস্তিক। … সুনীল নাস্তিক হলেও, মানুষের কল্যাণ কামনা করত সব সময়। যদি আমরা ঈশ্বরকে মঙ্গলময় বলে ভাবি, তবে মানুষও তো সেই ঐশ্বরিক দায়িত্বটা নিতে পারে। সুনীল তো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি কখনও, অনেক মানুষের অনেক কুকীর্তি সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। সে দুঃখবাদীও নয়, হতাশাবাদীও নয়, সুনীল অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে তার আশা ভরসাকে সে শেষদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল।’ (‘কখনও মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৮-৩০]

আসা যাক সুনীলের কবিতা প্রসঙ্গে। সুনীলের প্রকাশিত সামগ্রিক কাব্যগ্রন্থগুলো হলো – একা এবং কয়েকজন, আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, বন্দী, জেগে আছো, আমার স্বপ্ন, সত্যবদ্ধ অভিমান (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত যুগলবন্দী গ্রন্থের সুনীলের কবিতাংশ), জাগরণ হেমবর্ণ, দাঁড়াও সুন্দর, মন ভালো নেই, এসেছি দৈব পিকনিকে, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়, স্বর্গ নগরীর চাবি, সোনার মুকুট থেকে।

সুনীলের কবিতা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তাঁর প্রতিটি কবিতাই আত্মস্বীকারোক্তিমূলক। সুনীলের এমন কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তিনি নিজে উপস্থিত নন। এজন্যই তাঁর কবিতাগুলো উত্তম পুরুষে (আমি, আমার, আমাকে, আমায় প্রভৃতি) লেখা। সুনীলের ভাষায়, ‘আমার প্রতিটি কবিতাই আমার জীবনযাত্রার প্রতিফলন, সেই জন্যেই আমি একাধিক জায়গায় বলেছি, আমার কবিতাগুলো স্বীকারোক্তিমূলক!’ অকপটেই তিনি স্বীকার করেছেন, ‘আমার এমন একটিও কবিতা নেই, যে-কবিতায় আমি ‘আমি’ শব্দটা অন্তত একবারও ব্যবহার করিনি।’ সুনীলের সরল দাবি, ‘আমি তো কবিতাতে আমার জীবনকেই ব্যবহার করেছি। আড়াল করিনি।’ কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক :

আমারও আকাঙ্ক্ষা ছিল সূর্যের দোসর হবো তিমির শিকারে

সপ্তাশ্ব রথের রশি টেনে নিয়ে দীপ্ত অঙ্গীকারে।

অথচ সময়াহত আপাত বস্ত্তর দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত মনে

বর্তমান-ভীত চক্ষু মাটিতে ঢেকেছি সঙ্গোপনে।

(‘প্রার্থনা’, একা এবং কয়েকজন)

অথবা,

আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ

এই কি মানুষজন্ম? নাকি শেষ

পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধেবেলা

আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা

করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে

থাকি – তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।

(‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি)

অথবা পাঠকপ্রিয় সেই উক্তি,

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ

আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?

…এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি

এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?

(‘সত্যবদ্ধ অভিমান’, সত্যবদ্ধ অভিমান)

অথবা সুনীলের সেই চির অম্লান কবিতা,

ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে

ফেলেছিলাম

নিঃশব্দ রাত্রির দেশ, তার ওপরে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ

অদূরে খাজুরাহো মন্দিরের চূড়া

মিথুন মূর্তিগুলো দেয়াল ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠেছে আকাশে

নীল মখমলে শুয়ে নক্ষত্রদের মধ্যে চলছে শারীরিক প্রেম

আমি যে-কোনো দিকে যেতে পারি

অথচ আমার কোনো দিক নেই!

(‘ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে’, স্বর্গ নগরীর চাবি)

কবিতা লেখার বিষয়ে সুনীলের সুন্দর একটি পঙ্ক্তি আছে। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে কবিতার প্রতি এ-কবির সুন্দর ভালোবাসা।

কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা লিখবো এই ভাবনা

আরও প্রিয় লাগে

মনে ফুরফুরে হাওয়া, এবার কবিতা, একটি নতুন কবিতা…

তবু আমি কিছুই লিখি না

কলম গড়িয়ে যায়, ঝুপ করে শুয়ে পড়ি, প্রিয় চোখে

দেখি সাদা দেয়ালকে, কবিতার সুখস্বপ্ন

গাঢ় হয়ে আসে, মনে মনে বলি, লিখবো

লিখবো এত ব্যস্ততা কিসের  (‘কবিতার লেখার চেয়ে’, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়)

নিজের সেরা লেখাটি লেখার তৃষ্ণা সব লেখকের মধ্যে থাকে। সুনীলেরও তেমনটি অত্যন্ত তীব্রভাবে। নিজের সেরা লেখাটি উপহার দেওয়ার বুভুক্ষা প্রতিটি কবিমনেই চলতে থাকে আমৃত্যু। এ যেন এক দিকশূন্যপুরের পথে অক্লান্ত যাত্রা।

সেই লেখাটি লিখতে হবে, যে লেখাটি হয়নি

এর মধ্যে চলছে কত রকম লেখালেখি

এর মধ্যে চলছে হাজার হাজার কাটাকাটি

এর মধ্যে ব্যস্ততা, এর মধ্যে হুড়োহুড়ি

এর মধ্যে শুধু কথা রাখা আর কথা ভাঙা

শুধু অন্যের কাছে, শুধু ভদ্রতার কাছে, শুধু দীনতার কাছে

কত জায়গায় ফিরে আসবো বলে আর ফেরা হয়নি

(‘সেই লেখাটা’, দেখা হলো ভালোবাসা, বেদনায়)

সুনীলের প্রিয় দেশ পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুর পর স্মরণসংখ্যায় ‘একা এবং কয়েকজন’ শিরোনামের সম্পাদকীয় লেখাটি তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সেই লেখাটিতে প্রকাশিত হয়েছে প্রয়াত কবি সুনীল সম্পর্কে মোটা দাগে অনেক জানা-অজানা কথা, মৃত্যু-পূর্ব ও মৃত্যু-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনার বহুলীকরণ – ‘কবির মৃত্যুতে রোরুদ্যমান এই শহর। কারণ, তিনি সেই কবি, যাঁর চিন্তাচেতনা জুড়ে ছিল সর্বজনীনতার ভাব। সৌজন্য ও সৌহার্দ্যের বিষয়ে যিনি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য, সেই কবির অন্তিমযাত্রা উপলক্ষে তাঁর নিজের প্রিয় শহরে তাঁকে ‘আমাদের লোক’ বলে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসটি কারও চোখ এড়ায়নি। আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এ-রাজ্যের বামপন্থী নেতৃবর্গ মার্কিনপন্থী এক ভোগবাদী সাহিত্যিক বলেই জ্ঞান করতেন। কবিতার অনুবাদ সংক্রান্ত স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন মুলুকে যাওয়াই হোক অথবা মার্কিন কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সখ্য – বঙ্গজ বামপন্থীদের চোখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন স্রেফ সিআইএ-র একজন দালাল বই কিছু নন! তাঁর বিরুদ্ধে চরবৃত্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ না মিললেও, তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টিকে নিয়মিত গালমন্দ করে গিয়েছেন বামপন্থীরা। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি কবি। প্রতিবাদ করার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। কারণ, আজীবন তিনি বিশ্বাস করেছেন তিনি কবি, রাজনীতির কারবারি নন। তাই রাজপথের মিছিলে পা মেলানোর চেয়ে কলম ধরতেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে তিনি অক্লান্ত, অপ্রতিরোধ্য। সেই সময়েই তাঁর জনপ্রিয়তা, মানুষের সঙ্গে নাড়ির যোগ রেখে চলার অপার আগ্রহ দেখে চোখ ট্যারা হয়ে গিয়েছিল তদানীন্তন শাসক দলের। টনক নড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁকে নিয়ে যে পড়ে গেল কাড়াকাড়ি অবস্থা! বস্ত্তত, তিনি যখন স্বীয় প্রতিভায় মানুষকে কাছে টানতে পেরেছেন, তখন তাঁর সেই জনপ্রিয়তাকে রাজনৈতিক কৌশলে কাজে লাগাতে চেয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শাসকদলের প্রতিভূরা। সেদিন থেকেই কবিকে করে নিলেন তাঁদের ঘরের লোক! আবার ঘোষিতভাবেই তিনি পরিবর্তনপন্থী ছিলেন না। বরং, সুনীল লিখেছিলেন, বাম-জমানার পরে যারা এ-রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারে, তাদের কথা ভাবতে গেলে তাঁর বিবমিষা হয়। এ-রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের নীতির একজন দৃঢ় ও কঠোর সমালোচক ছিলেন কবি। ফলে তাঁর সঙ্গে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে শৈত্য থাকাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। সুনীলের সমালোচনায় গাত্রদাহের কারণ ঘটেছিল বলেই তাঁকে শিশু-কিশোর অকাদেমির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিতে সৌজন্য-শিষ্টাচারে বাধেনি পরিবর্তনপন্থী সরকারের। কিন্তু এসময়ের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকের মৃত্যুতে বিহবল বাঙালির আবেগ বাঁধ ভাঙতে চাইছে। আর সেই বাঁধভাঙা আবেগের ঢেউয়ে যদি বর্তমান শাসকদলের প্রবলতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সিপিএম বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়, তবে তা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মেনে নেওয়া দুরূহ! অতএব কবির শেষযাত্রায় শোকের আবহ ভঙ্গ করে নিজের প্রবলতম ‘সাংস্কৃতিক’ উপস্থিতি ব্যতীত অন্য কোনও পন্থা জানা ছিল না তাঁর। কিন্তু আশির দশকের মধ্যভাগের মতোই কে জানে হয়তো জীবন-পারাপারের সরণি ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একাই চলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। সৌজন্যে, রাজনীতির সেই কয়েকজন!’

মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে একজন কবিকে নিয়ে এমন দলাদলি এবং হাত কালো করা রাজনীতির প্রসঙ্গ না হয় থাক। বরং লেখাটি শেষ করতে চাই দেশের প্রগুক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত সুনীলকে নিয়ে জয় গোস্বামীর একটি কবিতার (২৫ অক্টোবর, ২০১২) মধ্য দিয়ে –

একবার আকাশ আর দু’বার আকাশ আর তিনবার আকাশ

এইভাবে সতেরো বছর

তারপর ক্রমাগত শেষ হয় আলো

সমুদ্রের দিকে ফেরে রক্তমাখা জ্বর

লোহাপাথরের শব্দ ঢুকে পড়ে মনের ভিতর

সেই অবকাশে

হাড়ের অন্দরে কীট একদিন দু’দিন তিনদিন

খেতে থাকে সব স্নেহঋণ

কীটদল ক্রমশ অঙ্গার

জ্বালা শুধু জ্বালা শুধু জ্বালা

যতটুকু নীল ছিল পুড়ে ছারখার

বড় হল আমার-ই অহং

অন্যের কারণে শুধু অন্যের কারণে অন্যদের কারণে কারণে

একদিন তোমার কাছ থেকে

সম্পূর্ণ ফিরিয়ে আনলাম

মন।

 

তুমি কিছু বলোনি তখন।

স্মিত হেসেছিলে শুধু।

পোড়া একটা হাওয়া উঠল। কালো জল ঘূর্ণিপাক মেরে

উঠে গেল আমার মাথায়

যেদিকে তাকাই দেখি বিষ ভেসে যায় শুধু বিষ

ভেসে যায়

সেই বিষস্রোত ধরে এতদূর এসে পৌঁছলাম

রইল না ফেরার উপায়

যা হল তা হয়ে গেল। দিন গেল একের পর এক

বিরোধিতা করলাম অনেক।

তোমার সুস্পষ্ট বিরোধিতা।

আজ, তোমার মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে

মনে হয় ভুল-ই করেছি। মনে হয় সমস্ত কারণেই অকারণ

সজোরে সমূহ বাধা ঠেলে একবার সামনে গিয়ে যদি বসতাম

একবার পা ছুঁতাম যদি

আবার আগের মতো পা ছুঁতাম যদি…

 

কিন্তু তা হওয়ার নয়। তুমি রইলে না

মানুষের মুখে মুখে, রয়ে গেল আমাদের মধ্যেকার সেই বিষনদী

তুমি যে-স্নেহের ডালা হাতে দিয়েছিলে

তা কবেই ভেসে গেছে রক্তমাখা অহং-এর জ্বরে

সমুদ্র ছাপিয়ে যাওয়া তোমার নামের পাশে

আমার ধূলিকণার নাম

শোকের সুযোগ পায় না –

অনুশোচনায় পুড়ে মরে

 

কবিতা প্রসঙ্গে সুনীল লিখেছেন অনেক। সুনীল সম্পর্কে সুনীলের রচনার এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন – ‘কবিতা লিখতে আমার কষ্ট হয়। আমি ইদানীং গল্প-উপন্যাসও রচনা করে থাকে, কিন্তু ওসবের তুলনায় কবিতা রচনার কষ্ট অনেক বেশি। এই শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করা যে কী সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক ব্যাপার – ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে তা বুঝবে না। যেন একটু অসতর্ক হলেই আঙুল ঝল্সে যাবে কিংবা তুষার ক্ষত হবে। শব্দের এই খেলার সময় সমস্ত স্নায়ু এমন উগ্র টনটনে হয়ে থাকে যে তার ফলে শারীরিক যন্ত্রণা হতে পারে। কবিমাত্রই যে কারণে কিছু না কিছুভাবে অসুস্থ। …ভালোবাসারই মতন, কবিতা নেয় অনেক বেশি, দেয় খুব কম। শুষে নেয় জীবনীশক্তি, ফিরিয়ে দেয় শুধু সম্ভাবনার ঝলক।’ কবিতা নিয়ে সুনীলের আত্মবিশ্লেষণটি ছিল এমন – ‘বিরলে বসে যখনই নিজের কবিতা বিষয়ে ভাবি, তখন মনে হয় কিছুই লিখতে পারিনি। যত লিখছি, যত চেষ্টা করছি, ততই বুঝতে পারছি শব্দের সেই পবিত্রতাকে স্পর্শ করা কত দুরূহ। ছেলেমানুষি বয়েস কেটে গেলে বোঝা যায় কবিতা লেখাটা ছেলেখেলা নয়, তখনই লিখতে গেলে ভয় করে। আবার এ-কথাও ঠিক, কোনো কোনো দুর্বল মুহূর্তে নিজের দু-একটা কবিতা পড়ে বেশ লাগে। কণ্ঠ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর শ্যালিয়াপিন রেকর্ডে নিজের যৌবনের সোনালি কণ্ঠস্বর শুনে যেমন কেঁদেছিলেন, তেমনই নিজের পূর্বেকার কবিতা পড়তে পড়তে গলায় বাষ্প জমে, মনে হয়, আমিও একদিন বেঁচেছিলাম, আমারও মূল্য ছিল – যত সামান্যই হোক।’