সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আনিসুজ্জামান
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯০ সালের দিকে, ঢাকায়, গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সূত্রে। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে সুনীলের সেই দিন সেই রাত্রি উপন্যাসটি  গাজী প্রকাশ করেছিল পরে। তবে সেটা গৌণ। এই দুই পরিবারের যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ ও পুরনো। গাজীর বাল্যবন্ধু হিসেবেই আমার প্রথম পরিচয় সুনীলের কাছে।
তারপর আমরা নানা সময়ে নানা অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছি – ঢাকা ও কলকাতায়, লন্ডন ও নিউইয়র্কে, আটলান্টিক সিটি ও কলাম্বাসে। সে-উপলক্ষে অনেক সময়ে আমরা একই জায়গায় থেকেছি। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর একটা উদ্যোগ উপলক্ষে প্রায়ই একসঙ্গে বসা হতো। কালি ও কলম প্রকাশের আয়োজন হতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার মতো উপন্যাস চাইলাম। সে-মুহূর্তে তিনি ছেলের কাছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কথা দিলেন, কলকাতায় ফিরে আমার দাবিপূরণে অগ্রসর হবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। পরে যখন মানুষ, মানুষ! উপন্যাসটি কলকাতা থেকে প্রকাশ পেলো, তখন তিনি ভূমিকায় আমার কথা উল্লেখ করেছিলেন। না করলেও পারতেন, বস্তুত তা আবশ্যক ছিল না। তবু যে উল্লেখ করেছিলেন, তা তাঁর সদাশয়তার পরিচয়।
তাঁর সঙ্গে যতটুকু মেলামেশার সুযোগ হয়েছে, তাতে তাঁর ঔদার্যের পরিচয়ই পেয়েছি বারংবার। কখনো কোনো বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার গুরুতর মতান্তর হয়েছে, কিন্তু তা পারস্পরিক সৌহার্দ্যে ছায়া ফেলেনি। কত মানুষ তাঁকে কতভাবে বিরক্ত করতো, তিনি পরম ধৈর্যের সঙ্গে তা সহ্য করে গেছেন। বিরক্তি যে প্রকাশ করতেন না কখনো, তা নয়। আবৃত্তিকারেরা বই বা কাগজ দেখে কবিতা পড়লে কিংবা সংগীতশিল্পীরা গানের বই বা খাতা নিয়ে গান গাইলে তিনি বলতেন, এরা মুখস্থ করার কষ্টটুকুও স্বীকার করতে চায় না! একবার কলাম্বাসে সাহিত্যবাসরে এক শ্রোতা আমাকে বললেন, বাংলাদেশের বইতে যেসব আরবি-ফারসি শব্দ থাকে, বইয়ের শেষে তার অর্থসহ একটা নির্ঘণ্ট থাকলে পাঠকের সুবিধে হয়। আমি জবাব দেওয়ার আগেই সুনীল বেশ রাগতভাবে তাঁর প্রস্তাবের অসারতা বা অযৌক্তিকতা সম্পর্কে বললেন। এসব সম্মেলন প্রভৃতিতে অনেকেই কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করে থাকেন। সুনীল তাঁদের থামিয়ে দিতে বিলম্ব করতেন না। তেমনি আবার তাঁর অনুরাগী পাঠকদের – তার মধ্যে, দেখা যেত, মেয়েদের সংখ্যাই বেশি – নানা আবদার তিনি হাসিমুখে রক্ষা করতেন।
জীবনে যেমন হয়ে থাকে, উপকৃত ব্যক্তি অনেক সময়েই উপকারীর বিরুদ্ধাচরণ করে থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনেও তা ঘটেছে। কিন্তু তেমন মানুষ সম্পর্কে তাঁকে বিরূপতা প্রকাশ করতে দেখিনি। বরঞ্চ কেউ সে-প্রসঙ্গ তুললে তিনি সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। এরপরও তাঁর পরোপকারবৃত্তির কিছু হানি ঘটেনি। শুধু সাহিত্যক্ষেত্রে নয়, জীবনক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন তিনি বহু মানুষকে। এই লক্ষে প্রতিষ্ঠানও গড়তে গেছেন। নিজের জীবনে এককালে যে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সে-কথা কখনো ভোলেননি, অন্যের দুঃখ তাঁর হৃদয়কে তাই সহজেই বিগলিত করতো। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সকলের সঙ্গেই প্রীতির বন্ধনে তিনি জড়িয়ে থাকতে ভালোবাসতেন।
২০০৮ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আমন্ত্রণ পাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনাবলীর একটি খণ্ডের ভূমিকা লিখতে। জানতে চাইলাম, তাঁরা লেখকের মত নিয়েছেন কি না। বললেন, অবশ্যই নিয়েছেন; লেখকের মত না নিয়ে কি কাউকে তাঁর বইয়ের ভূমিকা লিখতে বলা যায়? সুনীল কিন্তু নিজে আমাকে কিছুই বলেননি। এমনকী ভূমিকা দিতে যখন দেরি হয়ে যাচ্ছিল, প্রকাশক তাগাদা দিচ্ছিলেন, তখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনি কিছুই বলেননি। ওই ভূমিকায় তাঁর উপন্যাসের গুণের কথা যেমন লিখেছিলাম, তেমনি কিছু কিছু ত্রুটি বা অসংগতিও নির্দেশ করেছিলাম। পরে সুনীল জানিয়েছিলেন, ভূমিকাটা তাঁর ভলো লেগেছে। গত বছরে কলকাতায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের বই আমি কি বাঙালি? তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আমাকে। আমি তো অভিভূত। এবছরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আমার নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য আমি তাঁকে উৎসর্গ করি। তিনি যে তাতে প্রীত হয়েছিলেন, তা সর্বসমক্ষে জানাতে কুণ্ঠিত হননি।
কলকাতায় ৩১ আগস্টে আমার এই বইটির প্রকাশনা-অনুষ্ঠানে অতিথি-বক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। সেখানেই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। যদিও তাঁর অসুস্থতার কথা জেনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, তবু তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে কখনো কিছু বলিনি তাঁকে। সেদিন আর নীরব থাকতে পারলাম না। বলেই ফেললাম, আপনি বড্ড রোগা হয়ে গেছেন। তিনি মৃদু – কিংবা ম্লান – হাসি হেসে বললেন, এই বয়সে একটু রোগা হওয়া ভালো। এরপর আর কী বলা যায়! আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর দুমাসও যায়নি, তিনি চলে গেলেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার আমাকে বলেছিল, আমাদের মধ্যে সুনীলই একমাত্র কবি, আমরা সব পদ্যকার। এ-কথার মধ্যে নিজের সম্পর্কে বিনয়জনিত ঊনোক্তি আছে, বন্ধুপ্রীতির প্রকাশ আছে, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিসত্তার প্রতি সম্ভ্রমপূর্ণ ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধানিবেদন আছেন। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যাত্রা কবি হিসেবে। ষাটের দশকে কী প্রচণ্ড আলোড়ন তিনি তুলেছিলেন, তা ভোলা যায় না। আমাদের মুখের ভাষাকে কবিতার ভাষা করে তোলা, যে-কোনো মহৎ বা তুচ্ছ অনুভূতিকে কবিতার বিষয়ে রূপান্তরিত করা – এই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান। কোনো ভাবনাই কবিতায় প্রকাশের অযোগ্য তিনি মনে করেননি, বাংলা ভাষার কোনো শব্দই কবিতায় অপাঙ্ক্তেয় বিবেচনা করেননি। এর জন্যে শুধু সাহসের দরকার হয়, তা নয়, কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব জোরালো বোধ দরকার হয়।
তিনি শুধু নিজে কবিতা লেখেননি, তাঁর প্রজন্মের কবিকুলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নেতৃত্বদানের সহজাত গুণ তাঁর মধ্যে ছিল – লেখা ছাড়াও আড্ডায়, আবৃত্তিতে, নাট্যাভিনয়ে, অনানুষ্ঠানিক সংগীত-পরিবেশনে কেন্দ্রীয় আসনটি তাঁর। কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে তাঁরা একটি সাহিত্য-আন্দোলনই গড়ে তুলেছিলেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবি সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও সুনীলই ছিলেন তার নেতৃত্বপদে। আমার মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, তখন রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করবার বা ছাড়িয়ে যাওয়ার ঝোঁক যাঁদের ছিল, তাঁরা কেন পাঁচশো বছর আগের এক কবিকে স্মরণ করে যাত্রা শুরু করেছিলেন?
সুনীল কবিতা লেখা কখনো ছাড়েননি, কিন্তু পরে অনেক বেশি সময় দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যে। শুধু সময় নয়, শ্রম ও নিষ্ঠা।  সেই সময়, প্রথম আলো ও পূর্বপশ্চিম – প্রত্যেকটি দুখণ্ডের এই ত্রয়ীতে – বাংলার ইতিহাসের বিশাল এক যুগ, তার বিচিত্র সব মানুষ, নানা রকমের আন্দোলন ও ঘটনা, নানাধরনের প্রবণতা, আশ্চর্যজনকভাবে জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে। ভালোমন্দের স্পষ্ট ধারণা সত্ত্বেও এতে লেখকের যে-নৈর্ব্যক্তিকতা প্রকাশ পেয়েছে, তা ঈর্ষার যোগ্য। লণ্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসেও তাঁকে বইপত্র ও অপ্রকাশিত কাগজপত্র ঘাঁটতে দেখেছি এসব বইয়ের মালমশলার খোঁজে। রানু ও ভানু কিংবা মনের মানুষেও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের আশ্রয় করে যে-কথাসাহিত্য তিনি সৃষ্টি করেছেন, এ-প্রসঙ্গে তাও উল্লেখযোগ্য। শুনেছিলাম, এরপর বিবেকানন্দকে নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখবেন – শুধু প্রচারক বিবেকানন্দ বা ভক্ত বিবেকানন্দকে নিয়ে নয়, তাঁর মতে – অন্তরে নিঃসঙ্গ, ভলোবাসার কাঙাল এক বিবেকানন্দকে নিয়ে। সে-সময় আর তাঁর হলো না। এরই পাশে ভারত-বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় ছড়িয়ে থাকা পটভূমিতে তিনি লিখেছেন একালের সাধারণ নারীপুরুষের কথা – পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদের জীবনে কতরকম ওলটপালট ঘটিয়ে যাচ্ছে, জীবনের স্বাদ পেতে কত বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে তারা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তার বৃত্তান্ত।
ছোটগল্পেও তাঁর সিদ্ধি আশ্চর্যজনক। অর্ধেক শতাব্দী বা এরকম শিরোনামের একটি গল্প মনে পড়ে – যাতে দশটি ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান আছে। একাদশীতে অভ্যস্ত বিধবাদের পদ্মার ইলিশের গুণবর্ণনা, এ-যুগেও দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের জায়া ও পতির সামাজিক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হওয়া, সাম্প্রদায়িক বিচারের দরুন কলকাতায় বাড়িভাড়া না-পাওয়া, বাংলাদেশে সংবর্ধিত ভারতীয় গুণী স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করতে চাইলে তার সম্ভাব্য বিড়ম্বনা – এইসব টুকরো চিত্রের সমাহার তাতে। রচনাগুণে অসাধারণ, পরিকল্পনায় একেবারে নতুন এই ছোটগল্পও স্বল্পপরিসরে আমাদের কালের ইতিহাস ধরে রেখেছে।
সুনীল নিজের বাঙালি সত্তা নিয়ে গৌরব করতেন। কলকাতার ইংরেজি নাম বদলে কলকাতা করার পেছনে তাঁর অনেকখানি অবদান আছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কাজকর্মে বাংলাভাষা ব্যবহারের দাবিতে তিনি আন্দোলনে নেমেছিলেন। বিশ্বব্যাপী বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় রাখার নানা সমস্যা সম্পর্কে তিনি ভেবেছেন, তার সমাধান খুঁজেছেন। নিজের মানবসত্তাকে  তিনি সবার ওপরে তুলে ধরেছিলেন সত্য, কিন্তু তারপর এই বাঙালিত্ব নিয়ে ছিল তাঁর গর্ব। তিনি একজন সেরা বাঙালি ছিলেন, ছিলেন এক শ্রেষ্ঠ মানুষ।